এই জিনা, মা বললেন, কি হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেন? জিনিসপত্র গোছাতে দিবি না নাকি?

ভাল্লাগছে না কিছু!

কিছু একটা করার চেষ্টা কর গিয়ে, তাহলেই ভাল লাগবে।

কি করব? আকাশের যা অবস্থা, বাইরে বেরোতে পারলে তো। বৃষ্টি আর বৃষ্টি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ওই দেখ, আবার নেমেছে। জানালায় বসে যে সাগর দেখব, তারও উপায় নেই, কিচ্ছু দেখা যায় না। আমার দ্বীপটা পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। কি যে করব।

বৃষ্টির দিন, বৃষ্টি তো হবেই, মা বললেন। অবাক করছিস তুই আমাকে, জিনা। ছুটির পয়লা দিনেই বিরক্ত হয়ে গেলি?

ছুটি শব্দটা হাসি ফোঁটাল জিনার মুখে। আবার ছেলে সাজার শখ হয়েছে তার। মাঝে মাঝেই করে এরকম। নামটা পর্যন্ত পাল্টে ফেলে তখন। জরজিনা বা জিনার বদলে তখন তাকে জর্জ বলে ডাকলেই খুশি হয়। মনমেজাজের কোন ঠিকঠিকানা নেই তার। চুল ছেটে আবার ছেলেদের মত করে ফেলেছে। আশা করছে, আবার তাকে কিছুদিন ছেলে ভাবা হবে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, ঘাড় নেড়ে বলল জিনা। ছুটির পয়লা দিনেই ওরকম বিরক্ত হওয়া উচিত না। কিন্তু হয়ে গেছি, কি করব? ভাগ্যিস বাবা আমাদেরকে নিয়ে যাবে বলেছে। এখানে থাকলে মরেই যেতাম! মাঝেমাঝেই বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্যে বিদেশে যান মিস্টার পারকার। এবারেও যাচ্ছেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন জিনা আর তিন গোয়েন্দাকে। মা, লণ্ডনেও কি এরকমই আবহাওয়া থাকবে?

কিছুই বলা যায় না। আরও খারাপ হতে পারে। তবে জায়গা বদল তো হবে, তাতেই আমি খুশি। কিছুদিনের জন্যে এখান থেকে ভাগা দরকার। মেয়েকে আস্তে করে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন মা। যা, আর কিছু করতে না পারলে রাফিকে নিয়ে খেলগে। আমি ততক্ষণে গোছগাছটা সেরে ফেলি।

জিনা যেখানে যাবে, রাফিয়ানও সঙ্গে যাবে। জিনার ধারণা, দনিয়ার সব চেয়ে ভাল এবং বুদ্ধিমান কুকুরটা তার। আয়, রাফি, জিনা বলল, এখানে কিছু নেই। চল, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি খাবার কিছু মেলে কিনা।

রান্নাঘরে কাজ করছে আইলিন। অনেক সময় কাজ বেড়ে যায়, একা সামলাতে পানে না মিসেস পারকার, তখন খবর দেন আইলিনকে। এই গাঁয়েরই মেয়ে, এসে কাজ করে দিয়ে যায়।

এই যে জিনা, আইলিন বলল। রাফিও যে। তা কি দরকারে এই আন্টির কাছে আগমন? খাবারের খোঁজে নিশ্চয়ই? একটু রাখ, হাতের কাজটা শেষ করে নিই। আপেলের জেলি বানাচ্ছি, তাড়াহুড়ো করলে নষ্ট হয়ে যাবে।

চুলায় কি? জিনা বলল। দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে। টেবিলে বসে পড়ল সে। মিনিট কয়েক পরেই হাজির হয়ে গেল বেশ বড় এক মগ গরম গরম কোকো, আর এক প্লেট সদ্য বানানো বনরুটি। রাফিয়ানও বাদ গেল না, তাজা, রসালো দেখে একটা হাড় দেয়া হয়েছে তাকে।

ছুটিতে বাড়ি এলে খিদে খুব বেড়ে যায়, না? হেসে বলল আইনি। বাড়বেই। হোস্টেলে কি না কি খাও, খাওয়া হয় নাকি।

পেট ভরি আরকি কোনরকমে। হোস্টেলের বাবুর্চিও রাধে, আর তুমিও রাধা। আমার তো মনে হয় দুনিয়ার সেরা বাবুর্চি তুমি, লিনুআন্টি! কিশোররাও তোমার রান্নার খুব প্রশংসা করে।

কালই তো আসছে ওরা, না? প্রশংসায় খুশি হল আইলিন। দেখি, ওদের জন্যে ভাল কিছু বানিয়ে রাখতে হবে।

হ্যাঁ, তাই কর। খাওয়ানোর সুযোগ অবশ্য এবারের ছুটিতে বেশি পাবে না।

না, তা পাব না। কাউকে তো আর রেখে যাচ্ছেন না মিস্টার পারকার।

দারুণ মজা হবে, তাই না? বন চিবাতে চিবাতে বলল জিনা। কিশোররা এখনও জানে না। ওরা আসছে, ভেবেছে এখানেই ছুটি কাটিয়ে যাবে। লণ্ডনে যাচ্ছি, সেটা জানে না। জানাইনি। সারপ্রাইজ দেব। কালই আসছে। কিন্তু ভয় লাগছে, যা পচা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, যদি না আসে!

পরদিন বৃষ্টি থামল। আবার ফিরে এল শীতের ঠাণ্ডা, শুকনো, পরিষ্কার আবহাওয়া, বড়দিনের সময় যেরকম থাকে। সকালের বাস ধরল তিন গোয়েন্দা। এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেল গোবেল বীচে। খুশিতে কলরব করতে করতে এসে জিনাদের বাড়িতে ঢুকল ওরা। বসার ঘরেই রয়েছেন মিসেস পারকার।

কেমন আছেন, আন্টি? হেসে বলল কিশোর।

ভাল, কেরিআন্টি বললেন। তোমরা কেমন?

ভাল, জবাব দিল কিশোর।

ভুরু কুঁচকে জিনার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। এই জিনা, আবার ছেলে সেজেছ…

জিনা নয়, জর্জ বলবে, গম্ভীর হয়ে বলল জিনা।

হা-হা করে হাসল মুসা। বুঝেছি। তা কদ্দিন চলবে এটা?

যদ্দিন জর্জের ইচ্ছে হয়, রবিন বলল হেসে।

হুফ! হুফ! সায় জানাল রাফিয়ান। রবিনের হাত চেটে দিল।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল মিস্টার পারকারের স্টাডির দরজা। ভুরু কুঁচকে। তাকালেন ছেলেমেয়েদের দিকে। ও, এসে গেছ। এজন্যেই এত হৈ-চৈ, বলে আবার লাগিয়ে দিলেন দরজা হট্টগোল একদম সহ্য করতে পারেন না তিনি।

রাগলেন না তো! মৃদু শিস দিয়ে উঠল মুসা। আঙ্কেল বদলে গেছেন মনে হচ্ছে? যাক, ছুটিটা তাহলে ভালই কাটবে। ধমক খেতে হবে না।

হ্যাঁ, ভালই কাটবে, কিশোর বলল, কারণ এখানে থাকতে হচ্ছে না আমাদের। পত্রিকায় পড়লাম, লণ্ডনের কাছের আরেকটা শহরে স্পেস ট্রাভেলের ওপর একটা সম্মেলন হচ্ছে। আক্কেল নিশ্চয় দাওয়াত পেয়েছেন। জিনা যখন এত করে আমাদের আসতে বলেছে, ধরেই নেয়া যায়, কোন কারণ আছে। আর সেই কারণ একটাই হতে পারে, আমাদেরকেও সঙ্গে নেয়া হবে।

তুমি বুঝে ফেলেছ! সারপ্রাইজ দিতে না পেরে হতাশ হল জিনা।

রবিন আর মুসা অবাক হল। রবিন বলল, কই, আমাদেরকে তো কিছু। বলনি?

হাসল শুধু কিশোর। জবাব দিল না।

রাফি যাচ্ছে তো? মুসা জানতে চাইল।

নিশ্চয়ই, বলল জিনা। বাৰা ভাল করেই জানে, আমি ওকে ছাড়া কোথাও যাই না। চল, বাগানে, ঘরে দম আটকে আসছে। কপাল ভাল আমাদের, আজ বৃষ্টি নেই।

বলা যায় না, রবিন বলল। আবার এসে যেতে পারে।

তা ওখানে গিয়ে কোথায় উঠছি, জিনা…থুড়ি জর্জ? কিশোর জানতে চাইল। হোটেলে?

দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। তারপর হাসল। থাক, জর্জ বলার দরকার নেই, তোমরা আমাকে জিনাই ডেকো।…না, হোটেলে উঠছি না আমরা। এখন ছুটির সময়, খরচ অতিরিক্ত ঘর পাওয়াও কঠিন। তাছাড়া হোটেলে কুকুর জায়গা দেয়ার নিয়মও বোধহয় নেই। সম্মেলন যেখানে হচ্ছে, সেই শহরে মার এক বোনের বাসা আছে। খালাম্মা-খালু ছুটিতে বাইরে চলে যাচ্ছেন, ফ্ল্যাটটা খালিই থাকবে। মাকে বলেছেন, ওখানে থাকতে পারব আমরা।

চমৎকার। হোটেলের চেয়ে অনেক ভাল হবে। স্বাধীনতা থাকবে।

সাগরের পাড়ে হাঁটতে বেরোল ওরা। চলল নানারকম আলোচনা। ছুটি কি করে কাটাবে সে-সম্পর্কে আলোচনাই বেশি হল। ফিরল দুপুরের খাবার সময়। মুরগীর রোস্ট করেছে আইলিন। আপেলের জেলি। মাংসের কিমা আর নানারকম শাকসবজীর পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ। সাগরের খোলা হাওয়া আর বৃষ্টিধোঁয়া রোদে ঘুরে খিদেও পেয়েছে ছেলেময়েদের। খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। মিনিট পনেরো মুসা তো মুখই তুলল না।

দুপুরের পরে আবার খারাপ হয়ে গেল আকাশ। মেঘে ঢাকা পড়ল সূর্য। নামল ঝমঝম বৃষ্টি। বাইরে বেরোনো বন্ধ। তবে আজ আর জিনার খারাপ লাগল না। তিন তিনজন বন্ধু এসেছে, ঘরের ভেতরেই সময় খুব ভাল কাটবে।

পরদিন সকালে রওনা হল ওরা। বাস ধরে এল এয়ারপোটে। সেখান থেকে বিমানে লওন। তারপর ঘন্টা দুয়েকের রেলযাত্রা। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে করে এল জিনার খালার ফ্ল্যাটে।

বেশ ব্যস্ত একটা সড়কের দিকে মুখ করে রয়েছে বাড়িটা। বড় ফ্ল্যাট। কয়েকটা ঘর। মাঝে চওড়া বারান্দা। বেডরুমগুলো সব পুবমুখো, অন্যান্য বরগুলো পশ্চিমে।

বাড়িটা পছন্দ হল ছেলেমেয়েদের। ঘরের আসবাবপত্রও ভাল। আয়-রোজগার বেশ ভালই মনে হয় জিনার খালু-খালাম্মার। অন্যের ঘরে রয়েছে, এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে রাফিয়ানের, কাজেই জিনিসপত্র যাতে নষ্ট নাহয় সেভাবে চলাফেরা করল। বাড়িতে হলে এতক্ষণে লাফালফি করতে গিয়ে অন্তত একটা ফুলদানী তো উল্টে ফেলতোই।

নিজেদের জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে ফেলল ছেলেমেয়েরা। তারপর গেল মিসেস পারকার কতখানি কি করেছেন দেখার জন্যে।

তিনিও গুছিয়ে ফেলেছেন। বললেন, এখন আমাদের প্রথম কাজ হল, খাবার কিনে আনা। একসাথে দুকাজ হয়ে যাবে। খাবারও কেনা হবে, শহরও ঘোরা

হবে। তোমাদের আঙ্কেল কাজ নিয়েই ব্যস্ত, তিনি যেতে পারবেন না। যেতে হবে, আমাদেরকেই।

তাতে খুশিই হল ছেলেমেয়েরা।

শহরটা আমেরিকার শহরের চেয়ে অন্যরকম, কিশোর বলল। বাস, লোকের ভিড়। বেশি গাদাগাদি মনে হয়।

সকলেই একমত হল তার সাথে।

দোকানে দোকনে ঘুরল ওরা। চলে এল কাছের বড় স্কোয়্যারটায়। বিশাল এক বাগান রয়েছে সেখানে, অনেকটা পার্কের মত, ছেলেমেয়েরা খেলছে। দিকে দিকে ছুটে যাচ্ছে বাস। এত বিভিন্ন পথে, মনে রাখতেই কষ্ট হয়, শেষ নোটবুকে লিখে নিতে লাগল রুটগুলো রবিন। খাবারের বাক্স, পোটলা নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা। রান্নাঘরে জিনার মাকে সাহায্য করল সবাই, মিস্টার পারকার বাদে, তিনি তার কাজে ব্যস্ত। আধুনিক, সুন্দর রান্নাঘর। প্রয়োজনীয় সব জিনিস হাতের কাছে রয়েছে। কাজ করতে কোন অসুবিধে হল না।

রাতের বেলা খাবার টেবিলে সকলের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত মিলল মিস্টার পারকারের। জানালেন, সম্মেলন যতদিন চলবে, রোজ খুব সকালে বেরিয়ে যাবেন – তিনি, ফিরতে অনেক দেরি হবে। রাতও হয়ে যেতে পারে কোন কোনদিন।

সেটা আমি জানি, মিসেস পারকার বললেন। তোমার কাজ তুমি করে যাও, আমাদের জন্যে ভাবতে হবে না। আমাদের দিক আমরা সামলাতে পারব। রান্না করতে তো আর বেশি সময় লাগবে না। তারপর বেরিয়ে পড়ব শহর ঘুরতে। দেখার অনেক জিনিস আছে। তাছাড়া, কাগজে দেখলাম এক জায়গায় অ্যানটিক নিলাম হচ্ছে। ওখানে যাব। কিন্তু পছন্দও হয়ে যেতে পারে, কেনার ইচ্ছে আছে।

হাসল ছেলেময়েরা। ওরা জানে, পুরানো জিনিসের প্রতি খুব শখ মিসেস পারকারের, বিশেষ করে অ্যানটিক। বেছে বেছে দেখার মত জিনিস জোগাড় করে নিয়ে আসেন। নিলামের ব্যাপারে মায়ের যেমন আগ্রহ, মেয়ের তেমনি নিরাসক্তি। সে ভাবল–মা যাক নিলামে, আমরা চলে যাব অন্য কোথাও ঘুরতে। অনেক জায়গা আছে দেখার, যেগুলো সে দেখেনি। পরদিন সকালেই মাকে সেটা পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে, ঠিক করল।

সুতরাং পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে মাকে বলল জিনা, আমাদেরকে নিশ্চয় একা একা ঘুরতে দেবে, তাই না, মা?

দেবো, রাস্তাঘাট চেনা হয়ে যাবার পর, মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে

হাসলেন মা। তবে কথা দিতে হবে, খুব সাবধানে থাকবি।

থাকব, বলতে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না জিনা।

আর গোলমাল বাধাবি না। ঝগড়া করবি না কারও সঙ্গে।

করব না।

হেসে ফেলল মুসা।

এই এতে হাসির কি দেখলে রেগে গেল জিনা। হাসির কি দেখলে? খারাপ কিছু বললাম নাকি?

এই তো শুরু করে দিলি, হেসে বললেন মা। এইমাত্র না বললি ঝগড়া করবি না?

অ! লজ্জা পেল জিনা। ও এরকম করে হাসল না…আচ্ছা, আর করব না।

তাহলে তো যেতে দিতে আপত্তি নেই, মা?

না, নেই।

<

Super User