বসন্তের এক চমৎকার সকাল। ওমর শরীফ-তিন গোয়েন্দার ওমর-ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটে চলেছে কিশোর আর মুসা, রকি বীচ এয়ার ক্লাবের দিকে। বিমানে উড়বে, তারপর ওখানেই দুপুরের খাবার সারার ইচ্ছে ওদের। বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে রানওয়ে আর অন্যান্য বাড়িগুলো। পাশে একটা পার্ক। মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে। পার্কের ভেতর দিয়েও যাওয়া যায়। সেদিক দিয়েই চললো ওরা, সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখতে মাখতে। টুঁইই টুঁইই করে একটা নাম না জানা পাখি ডাকছে ফুলের ঝাড়ে, দেখা যায় না।

এতো ভালো লাগছে, পার্ক থেকেই বেরোতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। তবে বিমানে ওড়াটাও কম মজার নয়। সুযোগ পেলেই আসে এখানে, ওড়া চর্চা করে।

ঢোকার মুখে দেখা হয়ে গেল লোকটার সঙ্গে। খাটো, একহারা শরীর, ক্লিন শেভ, ইটের মতো লাল চুল ছোট করে ছাটা, রোদে পোড়া চামড়া। মুখ দেখলে মনে হয় কোনো কথা বললেই বুঝি মারমুখো হয়ে উঠবে। তোবড়ানো একটা ব্রায়ার পাইপ দাঁতে কামড়ে রেখেছে। তাকিয়ে আছে সবুজ মাঠের দিকে, যার বুক চিরে চলে গেছে রানওয়ে।

লোকটার দিকে তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে নিয়েছিলো ওমর, কি মনে হতে আবার তাকালো। থমকে দাঁড়ালো সে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর প্রায় চিৎকার করে উঠলো, আরে, ডজ না! হ্যাঁ, ডজ ম্যাকমবার! তুমি এখানে কি করছো? এতোদিন পর! কেমন আছো?

দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে নিলো ছোটখাটো মানুষটা। তার চোখও বড় বড় হয়ে গেছে। ওমর না! আমাদের সেই দুর্ধর্ষ ওমর শরীফ, মরুর বুনো ঘোড়া!

মনে আছে তাহলে?

থাকবে না আবার। তোমার মতো বেদুইন ডাকাতকে ভোলা যায় নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ।

হাতটা ধরলো ওমর। তারপর একটানে নিয়ে এসে বুকে ফেললো। জড়িয়ে ধরলো একে অন্যকে, বেদুইনের কায়দায় কোলাকুলি করে স্বাগত জানালো।

তার পর? কেমন আছো, ভাই?

ভালো।

আরও কিছু কুশল বিনিময়ের পর দুই কিশোরের দিকে তাকালো ডজ। ওমরকে জিজ্ঞেস করলো, ছাত্র বুঝি?

ছাত্র এবং বন্ধু। পরিচয় করিয়ে দিলো ওমর, ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান। নামকরা গোয়েন্দা ওরা।

তা-ই নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ। এক এক করে হ্যান্ডশেক করলো কিশোর আর মুসা।

ডজের পরিচয় দিলো ওমর, ক্যাপ্টেন ডজারন ম্যাকমবার। আমরা ডাকি ডজ। ইরাকী বাহিনীতে একই স্কোয়াড্রনে ছিলাম আমরা। ইরাক-ইরানের যুদ্ধের সময় যা খেল দেখিয়েছে না ও। হুট হুট করে যখন তখন প্লেন নিয়ে ঢুকে পড়তো। শত্রু এলাকায়। একদিন খুব নিচু দিয়ে উড়ে শত্রুর বাংকার আবিষ্কার করতে গিয়ে বাড়ি লাগালে টেলিগ্রাফের খুঁটির সঙ্গে। তারপর গায়েব। আমরা তো ভেবেছি মরেই গিয়েছে। প্লেনটা পাওয়া গেছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। কিন্তু ডজের খোঁজ নেই। বহুদিন আর কোনো খবর পাইনি। থামলো ওমর। ডজের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর একদিন খবর পেলাম, দক্ষিণ সাগরের এক দ্বীপে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। আমাদের ডজারন ম্যাকমবার।

যে বলেছে, সে একটা আস্ত মিথ্যুক, কড়া গলায় প্রতিবাদ করলো ডজ। কারণ ওখানে বিলাসেও গা ভাসিয়ে ছিলাম না আমি, কোনো একটা বিশেষ দ্বীপে বাসও করছিলাম না। আমি তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।

তা বেশ করেছিলে, ওমর বললো। যার যা স্বভাব তা-ই তো করবে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি কেন আমরা? এতোদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। একটু খাতির-টাতির করা দরকার। খেয়েছো?

এখানেই খেয়ে নেবো ভাবছিলাম। আমি এসেছিলাম ক্লাবটা দেখতে। হলিউড-ফলিউড দেখে দেখে আর সময় কাটছিলো না। রকি বীচ ক্লাবের নাম শুনেছি। অনেক পুরনো আমলের বিমানও নাকি আছে এখানে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাই করিনি।

আমিও না। এখানকার মেম্বার আমি। এরা দুজনও, কিশোর আর মুসাকে দেখালো ওমর। এসো। আগে গিয়ে বসি। খাওয়া-দাওয়া হোক। দক্ষিণের দ্বীপে নারকেল আর কলা কেমন ফলালে সেই গল্প শোনাও আমাদেরকে। তারপর ক্লাবটা দেখানো যাবেখন। এসো।

নারকেল ফলাবো! ফুহ্! জঘন্য লাগে আমার! দেখলেই বমি আসে এখন। তোমারও আসতো, যদি আমার মতো এতো নারকেল খেতে হতো, মুখ বাঁকালো ডজ। সুইং ডোর ঠেলে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো ওমরের পিছু পিছু।

জানালার কাছে একটা টেবিল বেছে নিয়ে এসে বসলো চারজনে।

তো, আমেরিকায় কি করছো? জানতে চাইলো ওমর। মেনু কার্ড টেনে নিলো সে। ছুটিতে বেড়াতে এসেছো? বাড়ি গিয়েছিলে?

ডজের বাড়ি বৃটেনে। মাথা নাড়লো সে, না, যাইনি। বেড়ানোর কথা বলছো? এখানেও জঘন্য লাগছে আমার। দুনিয়ার কোথায় গেলে যে ভালো লাগবে বুঝতে পারছি না। আসলে দক্ষিণ সাগর মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে আমার। আরেকটা মেনু কার্ড, টেনে নিলো সে। এই, শিক কাবাব হলে কেমন হয়? ভেড়ার মাংসের?

চমৎকার হয়!

দারুণ! বলে উঠলো মুসা।

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো ডজ। জোরে হেসে উঠলো, ভোজন রসিক মনে হচ্ছে?

ধরে ফেলেছেন তাহলে, হাসতে হাসতে বললো কিশোর।

দ্বীপের কথা আর বলবেন না, ডজ ভাই.‥

বাধা দিয়ে ডজ বললো, শুধু ডজ। ওসব ভাবটাই শুনতে ভালো লাগে না। শুধু ডজ।

আচ্ছা, ঠিক আছে, শুধু ডজ। মাথা ঝাঁকাল মুসা। দ্বীপের খাবারের কথা বলছেন তো? সেকথা আর মনে করিয়ে দেবেন না, ডজ ভাই…

আবার ভাই।

থুককু। মনে থাকে না। নিজের চেয়ে বয়সে বড় কাউকে দেখলেই… যাকগে, ডজ। হ্যাঁ, দক্ষিণের কিছু দ্বীপে আমরাও বেরিয়ে এসেছি, ডজ। শুয়াপোকার বাচ্চা পর্যন্ত খেয়ে এসেছি আমরা তিনজনে…

তিনজন? আরেকজন কোথায়?

গানের অফিস চালাতে গেছে। রবিন মিলফোর্ড, বললো ওমর। আমাদের আরেক বন্ধু। ওরা তিনজনে মিলে একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছে। নামঃ তিন গোয়েন্দা। সংক্ষেপে তিন গোয়েন্দার কথা ডজকে জানালো সে।

ভালো, খুব ভালো, মাথা দুলিয়ে বললো ডজ। ওমর শরীফের সঙ্গে যখন এতো মাখামাখি, তখনই বুঝেছি স্বভাবও একই হবে। বেপরোয়া, অ্যাডভেঞ্চারাস, দুঃসাহসী…

কাকে কি বলছো? তুমি কি আর কম নাকি?

সেজন্যেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। হাঁ হাঁ করে হাসলো ডজ। অন্য তিনজনের মাঝেও সংক্রমিত হলে হাসিটা।

খাবারের অর্ডার দিয়ে আবার ডজের দিকে তাকালো ওমর, হ্যাঁ, এবার বলো। কি জন্যে আমেরিকায় এসেছে? বেড়াতে আসেনি। তোমার আচরণ বলে দিচ্ছে।

সত্যি কথা বলবো? টাকার জন্যে এসেছি। শুনেছি, এখানে নাকি বাতাসে টাকা ওড়ে।

ঠিকই শুনেছে। তবে তার পেছনে ছোটার লোকেরও অভাব নেই। প্রতিদিন ধরার জন্যে হন্যে হয়ে ছুটছে কোটি কোটি লোক। বেশির ভাগই ধরতে পারছে না, মুখ চুন করে বাড়ি ফিরছে। এই আমার কথাই ধরো না। অনেক তো ছুটলাম, বড় লোক আর হতে পারলাম না। কিছুদিন থেকে ভাবছি, পুলিশের চাকরিতে যোগ দেবো। ভালো অফার এসেছে।

চেহারা কিন্তু চকচক করছে তোমার, ডজ বললো। পকেটে পয়সা না থাকলে অমন হয় না। টাকার জন্যে নয়, পুলিশে যোগ দেয়ার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে তোমার, তাহলে ওই বেদুইনগিরি করার লোভে। অ্যাডভেঞ্চার। তা কতো জমিয়েছো?

ব্যাপারটা কি, বলো তো? এতোই টানাটানিতে পড়ে গেলে? ঠিক আছে, লাগলে অল্পস্বল্প ধার দিতে পারি।

অল্পতে হবে না, বেদুইন, বিষন্ন কণ্ঠে বললো ডজ, গাদা গাদা দরকার আমার। আর ধারটারের মধ্যেও যাচ্ছিনে। আমি চাইছি পার্টনার।

গাদা গাদা বলতে কতো বোঝাচ্ছে?

ধরো, শুরুতে হাজার পঞ্চাশেক।

শিস দিয়ে উঠলো ওমর। কেন? দ্বীপ কিনবে নাকি?

দ্বীপফীপের দরকার নেই আমার। নাক দিয়ে ঘোৎ ঘোঁৎ করলো ডজ। বিনে পয়সাতেই হাজারটা দ্বীপ দখল করে নিতে পারি, ইচ্ছে করলে। পয়সা লাগে না। সাগরের ওই দক্ষিণ অঞ্চলটায় খালি পড়ে আছে হাজারে হাজারে। থাকার লোকও নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও গিয়ে থাকতে পারো। না ভাই, ওসব নয়। আমার উচ্চাকাঙ্খা আরেকটু বেশি।

বলে ফেলো। দেখি সাহায্য করা যায় কিনা।

উজ্জ্বল হলো ডজের মুখ। সত্যি সাহায্য করবে আমাকে? টাকার ব্যবস্থা করে দেবে?

সেই টাকা দিয়ে তুমি কি করতে চাও, তার ওপর নির্ভর করে দেয়া না দেয়া। তোমাকে তো আমি চিনি। আর স্মৃতিশক্তিও অতোটা খারাপ না আমার। আগেও বহুবার নানারকম উর্বর বুদ্ধি এসেছিলো তোমার মাথায়। কোটিপতি হবার অনেক পরিকল্পনা করেছিলে। কয়েকবার ফতুর করেছে আমাকে। আর ফতুর হতে রাজি আমি।

ছুরি কাঁটা তুলে নিয়েছিলো ডজ। নামিয়ে রেখে হেলান দিলো চেয়ারে। স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওমরের দিকে। এক ঝুড়ি মুক্তো যদি দিয়ে দেয়া হয় তোমাকে, নিজেকে আর ফতুর ভাববে?

হাসলো ওমর। বাড়িয়ে বলার স্বভাবও গেল না তোমার। একমুঠো বললেও নাহয় বিশ্বাস করতাম।

এক ঝুড়িই বলছি! বড় এক ঝুড়ি! জোর দিয়ে বললো ডজ। আর এখানকার গহনার দোকানে যেসব মটরের দানার মতো দেখলাম, সেরকম নয়। আরও অনেক বড়। পায়রার ডিমের সমান।

তাহলে তো ভালোই হয়, স্বীকার করলো ওমর। তারপর মাথা নাড়লো অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে, কিন্তু তা তো তুমি দিতে পারবে না। কারণ সেই মুক্তো আনতে হলে ডালাস কিংবা হলিউডের বড়বড় বাড়িতে যেতে হবে তোমাকে। দুর্গম দুর্গ একেকটা। সেসব বাড়িতে ঢোকার সাধ্য বড় বড় ডাকাতেরও নেই। তবে সঙ্গে যদি নিয়ে এসে থাকো, আলাদা কথা।

সঙ্গে আনতে পারলে কি আর তোমার কাছে টাকা চাইতাম নাকি? গুঙিয়ে উঠলো ডজ। তবে আমি দেখেছি।

নাকি অন্য কেউ দেখে তোমাকে বলেছে? সেকথাই শোনাচ্ছাে।

গ্লাস তুলে নিয়েছিলো, দড়াম করে নামিয়ে রাখলো ডজ। আরেকটু জোরে আছাড় দিলেই ভেঙে যেতো। চেহারার মারমুখো ভাবটা আরও প্রকট হয়ে গেছে।

দেখ, বেদুইন, আমি বলছি আমি দেখেছি। নিজের চোখে। বিশ্বাস করো দয়া করে!

মাথা ঝাঁকাল ওমর। বেশ, এতোই যখন জোর দিয়ে বলছো, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু দেখলেই যখন, পকেটে ভরে কয়েকটা নিয়ে এলে না কেন?

পারলে কি আর আনতাম না নাকি? আরেকটা হুইস্কি আনতে বলো। গল্পটা শোনাচ্ছি। তাহলেই বুঝতে পারবে।

হুইস্কি আনার অর্ডার দিলো ওমর। সিগারেট কেস বের করে টেবিলের ওপর রাখলো। ডালা তুলে বেছে নিয়ে ঠোঁটে লাগালো একটা। লাইটার দিয়ে ধরালো। মুখ তুলে তাকালো ডজের দিকে। শুরু করো। অনেক দিন ভালো গল্প শুনিনি।

বিশ্বাসই যদি না করো, অহেতুক বকবক করে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। গম্ভীর হয়ে গেল ডজ।

না শুনলে বুঝবো কি করে? সত্যিই বলবে তো, নাকি বানিয়ে বানিয়ে? তোমার তো আবার কল্পনার দৌড় একটু বেশি।

একটা শব্দও বাড়িয়ে বলবো না। যা সত্যি, শুধু তা-ই।

নীরব একটা মুহূর্ত ডজের দিকে তাকিয়ে রইলো ওমর। বেশ, বলো। বিশ্বাস করবো।

হ্যাঁ, শুরু করুন, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে কিশোর।

একটা কথাও বাড়িয়ে বলবো না আমি, আবার বললো ডজ। গেলাসে লম্বা একটা চুমুক দিলো। যে লোকের কাছে শুনেছো, আমি দক্ষিণের দ্বীপে আছি, সে ঠিকই বলেছে। তবে আরামে ছিলাম, একথা ঠিক নয়। ওরকম জায়গায় আরামে থাকা যায় না। সভ্যতার ছিটেফোঁটা আছে কিনা ওখানে সন্দেহ। যা-ই হোক, গিয়ে তো উঠলাম। বসে থাকতে ভালো লাগে না। কিছু একটা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মনের মতো কাজ পেলাম না। আমি হলাম গিয়ে বৈমানিক, প্লেন চালানো আর বোমা ফেলা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। ওখানে ওরকম লোকের দরকার হয় না কারো। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি করি, কি করি! পকেটের টাকাও প্রায় শেষ। কোথাও যেতে হলে ভাড়ার টাকা লাগে। শেষে তাহিতির পাপিতি দ্বীপে যাওয়ার জন্যে জাহাজের একটা তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কাটলাম। মোটামুটি বাস করার মতো একটা জায়গা ওটা।

গিয়েছি আমরা, মুসা বললো।

তার দিকে তাকালো ডজ। গিয়েছে, না? তাহলে তো জানোই। সব রকমের লোক আছে ওখানে। সৎ লোক যেমন আছে, তেমনি আছে অসৎ লোক। ভদ্রলোক আছে, আছে অভদ্রলোক। ব্যবসায়ী, চোর-ডাকাত, শাদা, কালো, বাদামী, হলুদ, যতো রকমের মানুষ আছে দুনিয়ায়, সব রকমের পাওয়া যাবে ওখানে। সমস্ত দুনিয়ায় ঘুরেফিরে আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে গিয়ে যেন ওঠে ওই তাহিতির বন্দরে। একটা ব্যাপারে সবার মিল রয়েছে, সকলেই পোড় খাওয়া লোক। সাধারণ কেউ গিয়ে বাঁচতে পারবে না ওখানে। আমার যা মনে হয়েছে, বেশির ভাগই ভালো। তবে যেগুলো শয়তান, মহা শয়তান। একেবারে খাটাশ। থেমে দম নিলো ডজ। বার কয়েক চুমুক দিলো গেলাসে।

আবার বলতে লাগলো, সব কিছু মিলিয়ে, চমৎকার একটা জায়গা তাহিতি, আমার তা-ই মনে হয়েছে।

আমারও, মুসা বললো।

বাহ্, স্বভাব চরিত্রে মিলে যাচ্ছে দেখি! হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ। হাত মেলাও। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তোমরা যখন গিয়েছে, নিশ্চয় সব জানো…

আমি যাইনি, ওমর বললো। যা বলার বলো।

এককালে সোসাইটি অ্যাইল্যান্ড বলা হতো দ্বীপটাকে। তখন ফ্রান্সের দখলে ছিলো ওটা। চীনারা থেকেছে বহুদিন। জাপানীরা দ্বীপটা নিয়ে বহু গুতোগুতি করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। চীনারা এখনও আছে। মায়া কাটাতে পারে না। দেখার মতো একটা বন্দর। জাহাজ আসছে যাচ্ছে। পোড় খাওয়া সব মানুষ, দ্বীপের প্রধান রপ্তানী দ্রব্য নারকেলের ছোবড়ার মতো শুকনো, রোদে পোড়া। রপ্তানী দ্য আরও আছে। নানা রকমের ঝিনুক এবং মুক্তো। আশপাশের দ্বীপে যতো মুক্তো তোলা হয়, সব নিয়ে আসা হয় পাপিতিতে, বিক্রির জন্যে। ব্যাপারিরা কিনে চালান করে দেয় প্যারিসে কিংবা অন্য কোনো বড় শহরে। সেখানে মুক্তার চাহিদা রয়েছে। যা-ই হোক, ভূগোলের জ্ঞান অনেকই দিলাম। এবার আসল কথায় আসি।

জাহাজে তো উঠলাম। ভেসে চললাম এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে। একদিন গিয়ে পৌঁছলাম পাপিতিতে। গিয়েই কাজ পেয়ে গেলাম। আমার মনের মতোই বলতে হবে। অবশ্যই জাহাজের চাকরি। দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাই। কয়েক দিনের বেশি ভালো লাগলো না এই চাকরি। মালবাহী জাহাজ থেকে নেমে চাকরি নিলাম, এক ব্যবসায়ীর দোকানে। দোকানদারি করলাম কিছুদিন। ভালো লাগলো না। বসে রইলাম কয়েক দিন। আরও খারাপ লাগলো। কথা বলার লোকের অভাব হয় না ওখানে। যদি কেউ মানিয়ে নিতে পারে, আরামেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে ওরকম একটা দ্বীপে। দুই বেলা রুটি জোগাড়ের জন্যে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। দেখার জিনিসের অভাব নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, ওই সবুজ দ্বীপ, রূপালী সৈকত, নীল লেগুন আর ঝলমলে মুক্তার চেয়ে অনেক ভালো আমাদের স্কটল্যান্ডের ধোঁয়াটে কুয়াশা ওঠা মেঘলা দিনগুলোও। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করতো। আসতে পারতাম, কিন্তু আসিনি। চেষ্টা করতে লাগলাম কিছু একটা করার। ওখানে অনেকে বড়লোক হয়েছে, আমি পারবো না কেন? টাকা নিয়ে স্কটল্যান্ডে ফিরতে পারলে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দিতে পারবো। অনেক উপায় আছে টাকা রোজগারের, কিন্তু আমার হাতে ধরা দিতে চাইলো না। হাতে আসি আসি করেও আসে না, কেবলই ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।

কিভাবে? কৌতূহল বাড়ছে কিশোরের।

কিভাবে? সেসব গল্প বলতে গেলে কয়েক ঘণ্টায় কুলোবে না। অনেক সময় দরকার। তবে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। পমোটাস দ্বীপে একদিন এক দোকানে একটা ডাইভিং স্যুট নজরে পড়লো। জিনিসটা দোকানের মালিকের শখের জিনিস। বিক্রি করতে রাজি হলো না। তবে আমার চাপাচাপিতে ধার দিতে রাজি হলো এক শর্তে। যদি মুক্তো খুঁজে বের করতে পারি, তাহলে তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিতে হবে তাকে। ওটা নিয়ে চলে গেলাম আরেক পরিচিত লোকের কাছে। ঝরঝরে একটা বোট আছে তার। আরও একটা ভাগ দিতে হবে, এই কথা আদায় করে নিয়ে বোটটা নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলো সে। স্যুট পেলাম, বোট পেলাম, আর ভাবনা কি? বেরিয়ে পড়লাম মুক্তো শিকারে। নিগ্রোরা ওখানে ভীষণ পরিশ্রম করে। গাধার মতো খাটতে পারে। আমিও ওদেরই মতো গাধা হয়ে থাকলাম পুরো একটা বছর। ডুবলাম ভাসলাম, ডুবলাম ভাসলাম, কতো হাজার বার যে ডুব দিয়েছি সাগরে, হিসেবই করতে পারবো না। বেশ কিছু মুক্তোও জোগাড় করলাম। ছোটখাটো একটা ব্যাগ ভর্তি। তিন ভাগের দুই ভাগ দিয়েও আমার যা থাকবে, যথেষ্ট। আর দরকার নেই। নিয়ে রওনা হলাম পাপিতিতে। পরের দিনই আঘাত হানলো সাইক্লোন। ওখানে ঝড়ের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যখন তখন চলে আসে। ভাঙা একটা কাঠ ধরে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছলাম মেরিয়েটা দ্বীপে, জান নিয়ে কোনোমতে ধুকতে ধুকতে। রোদে পুড়ে উঠে গেছে পিঠের চামড়া। নতুন চামড়া গজানোর জন্যে পড়ে থাকতে হলো হাসপাতালে। আর মুক্তোগুলো? যেখান থেকে তুলেছিলাম সেই সাগরের তলায়ই আবার ফিরে গেছে বোটটা সহ। আরেকবার একটা মালবাহী জাহাজে চাকরি নিয়ে চলেছি। একটা ক্যানুতে দেখলাম দুজন লোক, মারকুইস দ্বীপের লোক। মুক্তোর জন্যে ডুব দিচ্ছে। বড় বড় তিরিশটা ঝিনুক তুলে ফেলেছে, একটাও খোলা হয়নি। হাতে কাজকর্ম কিছুই নেই। ভাবলাম কিছু তো একটা করি। ঝিনুকগুলোর জন্যে দুটো পূরনো পাইপ আর এক কৌটো তামাক দিতে চাইলাম। লাফিয়ে উঠলো ওরা। লুফে নিলো প্রস্তাবটা। কারণ তিরিশটা কেন, তিরিশ হাজার ঝিনুক খুলেও অনেক সময় একটা মুক্তো পাওয়া যায় না। তবে ঝিনুকেরও দাম আছে, সেটা অন্য ভাবে। বীজ হিসেবে। টন টন ঝিনুক কিনে নিয়ে গিয়ে সাগরের বিশেষ জায়গায় ফেলে, যারা মুক্তোর চাষ করে। ওসব ঝিনুকের অনেক দাম। তবে এমনিতে তিরিশটা ঝিনুকের কোনো দামই নেই ব্যাপারটা আমার পাগলামি হিসেবেই ধরে নিলো ওরা। কিন্তু আমি তখন কাজ খুজছি, হাত চালানোর মতো যে কোনো কাজ। ডেকে বসে খুলতে শুরু করলাম ঝিনুকগুলো। একটা কথা বলে নিই। কিশোর আর মুসার দিকে ফিরে বললো, তোমাদেরকে বলছি না। তোমরা নিশ্চয় জাননা। ওমরকে বললো, এমনিতে সাধারণত যেসব ঝিনুক দেখা যায়, দক্ষিণ সাগরের ওসব মুক্তোওয়ালা ঝিনুক সেরকম নয়। অনেক বড়। কয়েক পাউন্ড ওজন। অনেক সময় নিয়ে খুললাম প্রথমটা কিছু নেই। দ্বিতীয়টা খুললাম। ওটাতেও কিছু পেলাম না। এক এক করে উনত্রিশটা ঝিনুক খুলে ছড়িয়ে ফেললাম ডেকের ওপরে। আমার ভাগ্যে কিছুই মিললো না। আর একটা মাত্র ঝিনুক বাকি। ওতে কিছু পাওয়ার আশা করলাম না। সবগুলোর চেয়ে ছোট ওটা। খাবার সময় লোকে কি করে? প্রথমে বড়টা বেছে নেয়, সে যা-ই হোক। মিষ্টি হোক, মাছ হোক, যেটাই হোক, প্লেটের বড়টার দিকেই ঝোঁক মানুষের। আমিও তা-ই করেছিলাম। প্রথমে বড়টা বেছে নিয়ে খুলেছিলাম, তারপর ওটার চেয়ে ছোটটা। এভাবে খুলতে খুলতে বাকি রয়ে গিয়েছিলো সব চেয়ে ছোটটা। বেশ অবহেলা নিয়েই ফাঁক করলাম ওটা। ভেতরে আঙুল ঢোকালাম। নরম মাংসের মধ্যে শক্ত কি যেন লাগলো। বের করে আনলাম। মুক্তোই! থ্রাশ পাখির ডিমের সমান বড়। এমন মুক্তো জীবনে দেখিনি। ডেকের ওপর পড়ে রইলো। ঝিনুক থেকে বের করার পর ভেজা মুক্তোর রঙই অন্যরকম লাগে। আগুনের মতো জ্বলে। প্যারিসে নিয়ে গেলে ওই একটার দামই বিশ হাজার ডলারের কম হবে না। বেশিও হতে পারে। এর আগে আমিও এতো বড় আর সুন্দর মুক্তো দেখিনি। বোকা হয়ে গেলাম যেন। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক ওই সময় জোরে বাতাস লাগলো, ঢেউয়ে কাত হয়ে গেল জাহাজ। ডেকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল মুক্তোটা। চিৎকার করে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম, থাবা দিয়ে তুলে নিতে চাইলাম ওটাকে। ধরতে পারলাম না। চোখের সামনে গড়িয়ে গিয়ে সাগরে পড়ে গেল। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ঝিলিক দিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল নীল সাগরে। আরেকবার চিৎকার করে উঠেছিলাম, যেন ওটাকে ফেরানোর জন্যেই। কিন্তু কথা শুনলো না মুক্তোটা। চলে গেল। মুক্তো সম্পর্কে অনেক গুজব রয়েছে। অনেক কিংবদন্তী। দ্বীপের লোকেরা বলে, অনেকের ভাগ্যে মুক্তো সয় না। তাকে দেখা দিয়ে আবার ফিরে যায় সাগরে অনেকের আবার দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। আমার ভাগ্যে যে কোনটা ঘটলো, বুঝতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলাম। কতো মুক্তোই হাতে এসেছে, একটাও বিক্রি করতে পারিনি। যা-ই হোক, আসল গল্পটা এবার বলি।

বছর দেড়েক আগে, টাকাপয়সা নেই আমার হাতে। শেষে এক জাহাজে চাকরি নিলাম। মালিক করসিকার লোক, ভীষণ পাজি। নাম গুডু কারনেস। অনেক বদনাম আছে লোকটার। তার শয়তানী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি। চিনতে দেরি হয়নি। ওসব দ্বীপে তো চিনতে সময় লাগে না। সবাই খোলামেলা। বুঝেও কিছু করতে পারলাম না। চাকরিটা না নিয়ে উপায় ছিলো না আমার। আর কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। মারকুইসাস হয়ে পমোটাস ঘুরে এসেছে সবে তার জাহাজ। জাহাজটারও অদ্ভুত নাম রেখেছে। দুনিয়ার ভয়ংকরতম হাঙরের নামে নাম, হোয়াইট শার্ক; যতোটা নোংরা করা সম্ভব করে রেখেছে। তেলাপোকা আর ছারপোকায় বোঝাই। নারকেলের ছোবড়ায় একরকম পোকা হয়, সাংঘাতিক যন্ত্রণা দেয়, সেই পোকারও অভাব নেই। আর তেলাপোকাও যা একেকখান। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ওসব তেলাপোকার কথা আরেকদিন বলবো তোমাকে। রাতে ঢেকেঢুকে না ঘুমালে ঘুমের মধ্যেই পায়ের তলার চামড়া খেয়ে সাফ করে দেবে, টেরও পাবে না। সকালে উঠে যখন আর দাঁড়াতে পারবে না তখন বুঝবে মজা। হারামীর একশেষ। ওই জাহাজে করেই রওনা হয়ে পড়লাম একদিন পাপিতি বন্দর থেকে। লম্বা একটা পাড়ি জমাবে গুডু কারনেস। ছয় মাস, এমনকি নয়মাসও লেগে যেতে পারে।

যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম তার চেয়েও খারাপ কারনেস। আস্ত শয়তান। ভীষণ মুখ খারাপ। আমি বাদে আরও আটজন নাবিক তার জাহাজে। স্থানীয় লোক। ওগুলোও মহা বদমাশ। বোধহয়, একারণেই ওদেরকে বাছাই করেছে সে। সাধারণত স্থানীয় মানুষেরা ভালো হয়, তাহিতি, মারকুইস, পমেটোর লোকেরা। কিন্তু কারনেসের লোকগুলোর বাড়ি ওসব অঞ্চলে হলেও বেজায় খারাপ। পরে শুনেছি, মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে অস্ট্রেলিয়ায় জেল খাটতে হয়েছে ওদের। তাতে আর অবাক হইনি তখন। ততোদিনে জেনে গেছি, কপালে দুঃখ আছে আমার। তবে কতোটা দুঃখ আছে তা যদি জানতাম, দ্বীপ থেকে নড়তামই না; যতোই না খেয়ে মরি। সাগরে বেরোনোর পর জানতে পারলাম কারনেসের জাহাজে কি আছে। স্থানীয়দের কাছে স্পিরিট বিক্রি করা ওখানে বেআইনী। ওসব খেলে কতোটা ক্ষতি হয়, ভালো করেই জানে স্থানীয়রা। তার পরেও খায়। আর সাপ্লাই দেয়ার লোকেরও অভাব নেই। নানারকম কায়দা করে চালান দেয়া হয় ওগুলোকে। এই যেমন সেন্টের শিশিতে ভরে, কিংবা তেলের বোতলে ভরে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না আমার। কারনেসের সঙ্গে কথা বললাম। স্বীকার করলো সে, আছে। নিজেও প্রচুর গিলে সে। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো সেন্টের কিংবা তেলের বোতলেও ভরেনি সে, এতোই বেপরোয়া। সরাসরি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়, কেয়ারই করে না আইনের। ওর ওসব ব্যবসায় আমি জড়াতে চাই না, সাফ বলে দিলাম। তর্কাতর্কি হলো, ঝগড়া হলো। শেষমেষ বোকার মতো হুমকি দিয়ে বসলাম আমি ওকে। পুলিশকে বলে দেব। বলার সময়ও বুঝিনি, আমাকে পুলিশের কাছে পৌঁছতেই দেবে না সে।

যাই হোক, আমি আমার মতো আছি। আর কারনেস তার সলোমন আইল্যান্ডের গলাকাটা ডাকাতগুলোকে নিয়ে সারাদিনই মদে চুর হয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করতে পারো, ওই অবস্থায় জাহাজ চলছিলো কি করে? চলছিলো। তার কারণ কারনেসের লোকগুলো সব পাকা নাবিক। ওসব অঞ্চলের সব লোকই ভালো নাবিক। সমুদ্র সম্পর্কে অসীম জ্ঞান। ছোট একটা ক্যানুতে করেও বিশাল সাগর পারি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। কম্পাস-টম্পাস বাদেই দুহাজার মাইল দূরের অন্য কোনো দ্বীপে চলে যেতে পারে, একটুও ভুল করে না। বিশ্বাস করো, এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। প্রথমে আমরা গেলাম পমোটোসে। ঠিক দ্বীপ বলা যায় না। ওটাকে, একসারি প্রবালের দেয়াল বলাই ভালো। পানি থেকে বেশি উঁচু নয়। তাই অনেকে এর নাম দিয়েছে লো আরচিপেলাজো। স্থানীয়রা নাম দিয়েছে বিপদের দ্বীপ, এটাই মানিয়েছে ভালো। ওখানকার সাগরে জাহাজ চালানো যতোটা কঠিন, পৃথিবীর আর কোনো সাগরেই ততটা নয়। মারকুইসাসের দিকে চললাম আমরা। ওটা হলো পমোটোস থেকে একেবারে ভিন্ন জাতের। আগ্নেয় শিলায় বোঝাই, আর রয়েছে ঘন জঙ্গল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মস্ত কোনো মহাদেশ ছিলো একসময় ওই জায়গাটায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সাগরের নিচে চলে গেছে। উঁচু পার্বত্য অঞ্চলগুলো ডোবেনি, বেরিয়ে রয়েছে এখনও পানির ওপরে। দেখে অবশ্য সেরকমই মনে হয়। হাজার হাজার ফুট উঁচু বড় বড় পাহাড় যেন তালগোল পাকিয়ে রয়েছে। পাহাড়ের এরকম চেহারা আর কোথাও দেখা যায় না। কোনো কোনোটা তো বিশাল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম।

দুটো দ্বীপপুঞ্জকেই ম্যাপে দেখে মনে হবে খুব বুঝি কাছে। আসলেই কাছে, অবশ্যই দক্ষিণ সাগরের বেলায়। ওখানে পাঁচশো মাইল কিছুই না। এখানে আমেরিকায় এই দূরত্ব অনেক বেশি। ওখানে শত মাইলের হিসেবটাকে কিছুই মনে করা হয় না। বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ নিয়ে হয়তো বেরিয়ে পড়লে, চলছে তো চলছেই, ছহাজার সাত হাজার মাইল পেরিয়ে গেলে, এতো মাইলের মধ্যে ছোট একটা প্রবাল প্রাচীর দেখা না গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওখানে ওরকমই। মারকুইসাসের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। ভালো বাতাস পাওয়ার জন্যে সামান্য একটু বায়ে কেটে চালাচ্ছে নাবিকেরা। বোধহয় তাতেই, কিংবা বাতাসের কারণে সরে গেল জাহাজ। একটা দ্বীপ দেখতে পেলাম। নাবিকেরা তো বটেই, কারনেসের কাছেও দ্বীপটা নতুন। আগে কখনও দেখেনি। গ্যালাপাগো থেকে ল্যাডরোনি পর্যন্ত এলাকা যাদের নখদর্পণে, তাদের নজরে ওই দ্বীপ পড়েনি! অবাকই হলাম। ওরা হলো না। প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বীপের অভাব। নেই, কখন কোন একটা দ্বীপ নজর এড়িয়ে গেল, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ওদের। যেহেতু অচেনা দ্বীপ, নোঙর করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না কারনেস। দ্বীপটা নির্জন। ওখানে থেমে তার কোন লাভ হবে না। এইখানে এসেই আমার আসল গল্প শুরু, এবং এখানেই আমার প্রাণ প্রায় যেতে বসেছিলো।

কদিন ধরে একনাগাড়ে মদ গিলে চলেছে কারনেস। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে জাহাজ চালানোে আমি শিখে গেছি ভালোমতোই। চালাচ্ছি। আর কোনো উপায়ও ছিলো না। জাহাজে তখন একমাত্র আমিই সুস্থ রয়েছি। বাকি সবগুলোর অবস্থা কাহিল। কোনখান দিয়ে চলেছি আমরা কিছুই বুঝতে পারবে না কারনেস, বাইরে না বোরোলে। আর বেরোনোর মতো অবস্থাও তখন নেই তার। দ্বীপটার কাছ ঘেঁষে গেলাম, পাঁচশো মাইল দূর দিয়ে গেলাম, কিছু জানবে না। না জানায় ভালোই হয়েছে আমার জন্যে, পরে বুঝতে পারবে। সাগর মোটামুটি শান্ত। তখন ঠিক দুপুর। প্রচন্ড গরম। দ্বীপটাকে কাছে থেকে দেখলাম। প্রবালে তৈরি, অ্যাটল বলে ওগুলোকে। পাশ দিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে জাহাজ। মনে হয় জাহাজটাই স্থির হয়ে আছে, দ্বীপটা ভেসে যাচ্ছে। চার্টে অবস্থান দেখে নিলাম। সেক্সট্যান্টটা রাখলাম হুইলের কাছে। কখন আবার উঠে এসে রীডিং দেখতে চায় কারনেস কে জানে। সব কিছু রেডি রাখলাম। কে বকা শুনতে যায় খামোকা। লংগি চিউড আর ল্যাটিচিউড দুটোই মনে রাখলাম। পরে লগবুকে লিখে নেবো। ওরকম বহুবার করেছি। কখনো ভুল হয়নি। ডেকেই ছায়ায় শুয়ে পড়লাম। বাতাসের অপেক্ষায় রয়েছি। ভালো বাতাস না হলে ঠিকমতো চলবে না জাহাজ। কেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছে। হোয়াইট শার্ক স্কুনার জাতের জাহাজ। ইঞ্জিন থাকলেও পালের দরকার হয়। নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি। অলস ভাবনা। কারনেসের কথা, আমার কথা, আরও অনেক কথা। ডেকের কিনারে উপুড় হয়ে রয়েছি। হঠাৎ এমন একটা জিনিস চোখে পড়লো, ধক করে উঠলো বুক। আরেকটু হলেই বোধহয় কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে সাগরে পড়ে যেতো চোখ। সাগরের যেখানটায় সাংঘাতিক গভীর থাকার কথা, আচমকা যেন সেখানটা উঠে চলে এসেছে কোন জাদুমন্ত্রের বলে! জাহাজের, খোলের নিচেই একেবারে, পঁচিশ-তিরিশ ফুট গভীর হবে। আরেকটু উঠলেই ঘষা লাগবে জাহাজের তলায়। উঠে গিয়ে যে হুইল ঘোরাবো, সে কথাও মনে রইলো না। এতোই অবাক হয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যেমন হঠাৎ উঠলো তেমনি হঠাৎ করেই নেমে গেল সাগরের তল। বিশ্বাস করলাম না। ভাবলাম, গরম আর রোদ এমন কিছু করেছে, যাতে চোখে ভুল দেখেছি। কিন্তু। ডেকের কিনারে বসে তাকিয়েই রইলাম। মনে হতে লাগলো আবার দেখতে পাবো। ঘটলোও তাই। অদ্ভুত কান্ড। মুহূর্তের জন্যে দেখা যায় তল, তারপরই মিলিয়ে যায়, আবার দেখা যায়, আবার গায়েব। গায়ে কাঁটা দিলো। ব্যাপারটা কি! হঠাৎই বুঝে ফেললাম। সাগরের তল উঠছে নামছে তা নয়। ঢেউ। অনেক চওড়া আর উঁচু ঢেউ। খুব ধীরে আসছে। সেজন্যেই জাহাজটা যে একবার উঠছে ঢেউয়ের মাথায়, একবার নামছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। যখন ঢেউয়ের নিচে নামছে, তখন তল চোখে পড়ছে, ওপরে উঠলেই হারিয়ে যাচ্ছে আবার। আর উঁচু কতো জানো একেকটা ঢেউ? চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট। নিচে কিন্তু বালির চড়া নয়, প্রবাল। ঘাবড়ে গেলাম। ভীষণ ধারালো। কোনোমতে যদি একটা ঘষা লাগে জাহাজের তলায়, তরমুজের মতো চিরে ফেলবে। আর আছড়ে পড়লে গুড়িয়ে যাবে ডিমের খোসার মতো। এখানে জাহাজ সামলানো আমার কর্ম নয়। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম।

ছুটে এলো কারনেস আর তার দলবল। যতোটা মাতাল ভেবেছিলাম ওদেরকে ততোটা হয়নি। চেঁচিয়ে শুধু বলতে পারলাম, জাহাজ সামলাও! কি হয়েছে জানতে চাইলো কারনেস। ডেকের কিনারে এসে দেখতে বললাম। এলো ওরা। পাথর হয়ে গেল যেন আমারই মতো। ওদের মতো মানুষও অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম। আর আমার তো কথাই নেই। তাকিয়ে রয়েছি নিচের দিকে। কি দৃশ্য, বলে বোঝাতে পারবো না। লাল, নীল, সবুজ, আরও কতো রঙ প্রবালের না দেখলে বুঝবে না। যেন এক অপরূপ বাগান তৈরি হয়ে আছে সাগরের তলায়। প্রবাল দেখে অবাক হইনি, ওরকম অনেক দেখেছি দক্ষিণ সাগরে। অন্য জিনিস দেখে হয়েছি। ঝিনুক। হাজারে হাজারে, বাসনের সমান বড় একেকটা। একেকজোড়া করে গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। ভালো করে তাকাতে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। খুলে রয়েছে ঝিনুকগুলো, খোসাগুলো ফাঁক করে চিত হয়ে আছে। খাওয়ার জন্যে ওরকম করে খুলে যায় ওরা। খুব ভালো করেই জানি ওরকম ঝিনুকের ভেতরেই মুক্তো থাকে। সাগরের তলায় তিল ধারণের জায়গা নেই, শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, খুলে রয়েছে। খোলা জায়গায়, প্রবালের খাঁজে, যেখানেই ঠাই, পেয়েছে শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, সোয়ালো পাখির বাসার মতো আঁকড়ে রয়েছে যেন প্রবালের গা। কতো লক্ষ-কোটি ডলারের সম্পদ পড়ে রয়েছে ওখানে কল্পনা করে পা কাঁপতে লাগলো আমার, দুর্বল হয়ে এলো, যেন দেহের ভার রাখতে পারবে না। মনে হতে লাগলো এরকম দৃশ্য শুধু স্বল্লেই দেখা সম্ভব। এতো কিছুর মধ্যেও কি এক অদ্ভুত উপায়ে যেন সজাগ হয়ে গেল আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। অকারণেই ঝট করে ফিরে তাকালাম কারনেসের দিকে। একেবারে সময় মতো। তাকিয়ে ভালো করেছিলাম। তার চোখে এক ধরনের বন্য দৃষ্টি, কলজে ঠান্ডা করে দেয়। ওরকম আর কখনো কোনো মানুষের চোখে দেখতে চাই না আমি। হাত চলে গেছে পকেটে। ওখানেই তার পিস্তলটা থাকে, জানি আমি। চেহারাটা কুৎসিত হয়ে উঠেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, খুব বেশি নেই এখানে, কি বলো? আমাদের দুজনের নেয়ার মতো হবে না। লাফিয়ে সরে গেলাম। আর একটা মুহূর্ত দেরি হলেই গুলি খেতে হতো। অল্পের জন্যে মিস হয়ে গেল বুলেট।

তখন আমার অবস্থা কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে রয়েছি। কারনেসের হাতে পিস্তল, খুনের নেশা চেপেছে তার মাথায় আমার কাছে অন্ত্র বলতে কিছুই নেই। ছুরি বের করে ফেলেছে তার সাগরেদরা। পালানোর পথ নেই। লুকানোর জায়গা নেই। সারা জাহাজে এমন একটা জায়গা নেই যেখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে রেহাই পাবো। ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে আমার শরীর। বুঝতে পারলাম, আমার দিন শেষ। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়লো, মুক্তোর খেত দেখেছে বটে কারনেস, কিন্তু সেটার অবস্থান জানা নেই তার। আমরা কোথায় রয়েছি, জানে না। জানি শুধু একমাত্র আমি। লগবুকে লিখিনি। তবে সেক্সট্যান্টটা দেখলে জেনে যাবে কারনেস। পরে এসে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে। আমি যদি মরি, তাকেও পেতে দেবো না ওই মুক্তো। সেক্সট্যান্টের রীডিং ছাড়া কিছুতেই বের করতে পারবে না কারনেস; আমরা কোথায় রয়েছি। এমনিতেও মরেছি, ওমনিতেও। গুলির পরোয়া আর করলাম না। মরিয়া হয়ে দিলাম ছুট। গুলি করলো কারনেস। তাড়াহুড়োয় আবার মিস করলো। পৌঁছে গেলাম হুইলের কাছে। থাবা দিয়ে তুলে নিলাম সেক্সট্যান্টটা। সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আনন্দে। আবার গুলি করলো কারনেস। কিন্তু ওর গুলিতে আমার মরণ লেখা নেই। ঈশ্বরের দয়া। ঠিক এই মুহূর্তে জোরে এক ঢেউ এসে বাড়ি মারলো জাহাজের গায়ে। ভীষণ দুলে উঠলো জাহাজ। পড়ে গেলাম আমি। কারনেসও পড়লো। কিন্তু তার সাগরেদরা বহাল তবিয়তেই রইলো। ছুরি নিয়ে তেড়ে এলো আমাকে খুন করার জন্যে। মোরব্বা হওয়ার চেয়ে সাগরে ঝাপিয়ে পড়ে মৃত্যু অনেক ভালো মনে হলো আমার। দ্বিধা করলাম না আর। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম পানিতে। প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগলাম। প্রাণের ভয়ে সাঁতরাচ্ছি। উঠতে উঠতে দেরি করে ফেললো কারনেস। ততক্ষণে আমি দূরে চলে গেলাম। গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারিনি। কিন্তু অতো দূর থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে ঢেউয়ের মাঝে একটা মানুষের গায়ে লাগানো আর সম্ভব ছিলো না। তবু গুলির পর গুলি করতে লাগলো সে। আমার আশেপাশে এসে পড়লো কয়েকটা। গায়ে লাগলো না।

কিছুতেই আমাকে পালাতে দিতে রাজি নয় কারনেস। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পাল ঠিক করছে সাগরেদরা। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আমাকে ধাওয়া করলো। জানি, পালাতে পারবো না। ধরা আমাকে পড়তেই হবে। সাগরের মাঝে কোথায় যাবো? বাতাসও বইতে শুরু করেছে। খানিক আগে যেরকম শান্ত ছিলো সেরকম নয়। দুবার আমার পাশে চলে এলো জাহাজ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডুব মারলাম। এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকলো কারনেস। লাগাতে পারলো না। বাতাসের বেগ বাড়লো। ভীষণ গড়াতে লাগলো জাহাজ। এই অবস্থায় রেলিঙের কিনারে দাঁড়িয়ে গুলি করা খুব কঠিন। বাতাস আরেকটু বাড়তে গুলি করা বাদ দিয়ে জাহাজ সামলাতেই ব্যস্ত হতে হলো ওকে। নইলে যাবে কাত হয়ে ডুবে কিংবা প্রবালে বাড়ি খেয়ে ছাতু হবে। ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে সরে যেতে লাগলো স্কুনারটা। আমি বাঁচবো না, জানি। তবে শান্তিতে মরতে পারবো, এই যা। সেটাও আর তেমন সুখকর কল্পনা মনে হলো না কয়েক মিনিট পরে। কিন্তু মরা ছাড়া আর করবোটাই বা কি? কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে। ডাঙা নেই। হাঙরের ঝাঁক। তার ওপর প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস। সাংঘাতিক না?

হ্যাঁ, মারাত্মক, স্বীকার করলো ওমর।

একেবারে ঠিক শব্দটা বলেছো। মারাত্মক। অনেকক্ষণ বলে বলে গলা শুকিয়ে এসেছে ডজের! চুমুক দিতে লাগলো গেলাসে। দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, একটা খড়ও নেই যে ধরে ভাসবো। জাহাজডুবি হলে অনেকেই অনেক কিছু পায়, ধরতে পারে, আমার নেই। তবে চিত হয়ে থাকলে অনেকক্ষণ ভেসে থাকা যায়। যদি হাঙরে না ধরে। পানি গরম। চিত হয়ে ভেসে রইলাম। খুব আস্তে পা দিয়ে লাথি মারছি পানিতে, ভেসে থাকার জন্যে। বেশি জোরে নাড়াতে সাহস পাচ্ছি না, যদি হাঙরের নজরে পড়ে যায়। কাপড় খুলে ফেলে দিলাম, বোঝা কমানোর জন্যে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম কখন ভেসে ওঠে হাওরের পিঠের পাখনা। শাই শাই করে ছুটে আসে পানি কেটে। দুএকটা এলো কাছাকাছি, তবে কোনোটাই মানুষখেকো নয়, কামড়াতে এলো না আমাকে। দিগন্তে হারিয়ে গেল জাহাজটা। আমার চারপাশে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। আমি জানি, মরবো, তবু ইচ্ছে করে তো আর ডুবে যেতে পারি না। ভেসেই রইলাম। রাত হলো। বাতাস পড়ে গেল। শান্ত হতে লাগলো সাগর। ভেসেই রয়েছি তখনও। মনে হতে লাগলো, কেন ভেসে থাকছি? যন্ত্রণা আরও দীর্ঘ হচ্ছে! মরে গেলেই তো হয়! কিন্তু একেবারে নিরাশার মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকতে চায়। আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা। মরা দরকার, মরলেই ভালো হয়, কিন্তু মরতে আর পারছি না। কেউ যে আমাকে তুলে নেবে, তারও কোনো-আশা নেই। কয়েক হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে তখন কোনো জাহাজ আছে কিনা, কারনেসের স্কুনারটা ছাড়া, সন্দেহ। আর থাকলেই বা কি? জানতে পারছে না আমি রয়েছি ওখানে। বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো জাহাজ এসে আমাকে উদ্ধার করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার কপাল ভালো, বাঁচবো, তাই এমন একটা স্রোতে পড়ে গেলাম, যেটা আমাকে টেনে নিয়ে চললো। কোথায় যাবো, জানতাম না। উত্তর মেরুর দিকে, না দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। যেদিকেই যাই, বাঁচবো না এটা ঠিক, ধরেই নিয়েছিলাম। সকাল বেলা দেখতে পেলাম ওটাকে। কাছেই। খুব নিচু, পানির সমতল থেকে সামান্য উঁচুতে। দ্বীপটা দেখলাম না, চোখে পড়লো শুধু নারকেল গাছের মাথা। মনে হলো, পানি থেকে গজিয়ে উঠেছে। আশা হলো মনে। সাঁতরাতে শুরু করলাম সেদিকে। ভালো করেই জানি, শুধু পানিতে নারকেল গাছ জন্মাতে পারে না। ডাঙা আছেই। আজব একটা ব্যাপার ঘটলো আমার মধ্যে, বাঁচার সম্ভাবনা দেখা দিতেই। যতোক্ষণ জেনেছি, মৃত্যু নিশ্চিত, ভয়-ডর-আশঙ্কা কোনো কিছু ছিলো না। যেই বাঁচার আশা দেখলাম অমনি সেসব এসে চেপে ধরলো। সেই সঙ্গে উদ্বেগ আর উত্তেজনা। মনে হতে লাগলো গাছগুলোর কাছে। পৌঁছার আগেই হাঙরে ধরে খেয়ে ফেলবে, কিংবা ডুবে যাবো সাঁতরাতে না পেরে।

কাছে পৌঁছে গেলাম। এটা সেই দ্বীপ, জাহাজ থেকে যেটা দেখেছিলাম। আরেকটু হলেই তীরে গিয়ে তরী ডুবতে বসেছিলো আমার। ভীষণ ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো তীরে। চুবিয়ে মারার জোগাড় করেছিলো। সেই দশটা মিনিট জীবনে ভুলতে পারবো না আমি। প্রতিটা অ্যাটল ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রবালের দেয়াল, তার ভেতরে লেগুনের শান্ত পানি। কিন্তু সেখানে যাওয়া সহজ নয়। কোন দিক দিয়ে মুখ বুঝতে পারলাম না। কিছু লেগুন আছে প্রশান্ত মহাসাগরে যেগুলোতে ঢোকার কোনো মুখই থাকে না সাগরের দিক থেকে। তার বাইরের দেয়ালগুলোতে যে কি ভয়ানক বেগে ঢেউ আছড়ে পড়ে না দেখলে বুঝবে না। প্রচন্ড কোনো শক্তি পাহাড়ের মতো অনড় কোনো কিছুকে নড়াতে চাইলে যে কান্ডটা ঘটবে, অনেকটা সেরকম ব্যাপার, আর কোনো ভাবে বোঝাতে পারছি না। হাজার হাজার টন পানির বোঝা নিয়ে একেকটা ঢেউ গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে। দেখে মনে। হবে এমন শক্ত কোনো জিনিস নেই যা ঠেকাতে পারে ওই ঢেউকে। কিন্তু আটকে ফেলছে প্রবালের দেয়াল। ঢেউয়ের গোড়ায় ধরে টান মেরে যেন ছিনিয়ে নিচ্ছে ওটার ভিত। পুরো একটা মিনিট শূন্যে ঝুলে থাকছে পানির পর্বত, তারপর হাজারো বজ্রের মিলিত শব্দকে এক করে ধসে পড়ছে হড়মুড় করে। টগবগ করে যেন ফুটছে ওখানে সাগর, শাদা ফেনা তৈরি করছে, লম্বা একটা শাদা রেখা সৃষ্টি করছে সেসব ফেনা, যেন ফেনার স্থূপকে টেনে লম্বা করে দিচ্ছে অদৃশ্য কোনো হাত। সরে যেতে চাইছে পরাজিত ঢেউয়ের সঙ্গে, কিন্তু দেয়ালের মায়া কাটাতে না পেরে রয়ে যাচ্ছে পরের ঢেউটা আসার অপেক্ষায়। চলছে এভাবেই। বছরের পর বছর, একটানা। থামাথামি নেই। মাঝে মাঝে যেন খেপে গিয়ে সমস্ত রাগ প্রবালের ওপর ঢেলে দেয় সাগর, ঝাল মেটাতে চায়। সেটা হারিকেনের সময়। ওই সময় কোনো নৌকা কিংবা মানুষ ঢেউ আর দেয়ালের মাঝখানে পড়লে ভর্তা হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি যখন পৌঁছলাম তখন হারিকেন ছিলো না। সাঁতরাতে থাকলাম দেয়ালের ধার দিয়ে। পেয়ে গেলাম একটা পথ। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ঢেউ এসে ধরে ফেললো আমাকে। ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের ভেতরে, এক্কেবারে সময়মতো, কারণ তখন কয়েকটা হাঙর আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলো আমার প্রতি। কয়েক মিনিট ধরেই আমার পিছে লেগেছিলো। ভেজা একটা কম্বলের দলার মতো গিয়ে নেতিয়ে পড়লাম সৈকতে।

লোক-টোক ছিলো দ্বীপে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো মুসা। উত্তেজনায় কাঁপছে তার কণ্ঠ। সাংঘাতিক আগ্রহ নিয়ে শুনছে ডজের গল্প।

না, জবাব দিলো ডজ। আগেই তো বলেছি নির্জন। রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেলাম। একা, শুধু একা আমি, আর কেউ নেই। সে অন্তত একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলো দ্বীপে, আমি তা-ও পেলাম না। সৈকতে পড়ে থাকতে দেখলাম। শুধু নানারকম ঝিনুক আর নারকেল। প্রথম ভাবনাটা হলো পানির জন্যে। যদি মিষ্টি পানি না থাকে? কিন্তু ঈশ্বর কাউকে বাঁচাতে চাইলে সব ব্যবস্থা করেই দেন। আমাকেও দিলেন। পানি আছে দ্বীপে। ওই নোনা পানির মাঝে কোথেকে যে এলো ওই মিষ্টি পানি, বলতে পারবো না। এই প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই বের করতে পারিনি। পানি খেলাম। নারকেল খেলাম। বালিতে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করলাম শরীরে। তারপর উঠলাম দ্বীপটা ঘুরে দেখতে। কোন স্বর্গে উঠেছি জানার আগ্রহ হলো খুব। খুবই সুন্দর দ্বীপ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেওনের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না, এতোই সুন্দর। কিন্তু সৌন্দর্য দেখার অবস্থা তখন নেই আমার। একটা কথা এখন জোর গলায় বলতে পারি, রবিনসন ক্রুসোর গল্প পড়তে যতো ভালো লাগে, বাস্তবে তার মতো অবস্থায় পড়লে লাগে ঠিক উল্টোটা। যেমন খারাপ লাগে, তেমনি অসহায়। যতোই ভাবতে লাগলাম বাকি জীবনটা এখানেই একা কাটাতে হবে, ততোই চুপসে যেতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে। ভাবো একবার, এতো টাকার মুক্তো পেলাম, জানি কোথায় আছে, তুলে নিতে পারলেই রাজার হালে কাটাতে পারি জীবনটা। তা না, হয়ে গেলাম রবিনসন ক্রুসো। আর কোনো জাহাজ না আসুক, মুক্তোর খোঁজে কারনেসের জাহাজ আসতে পারে, হয়তো বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে, এই আশায় তাকিয়ে রইলাম সাগরের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম, জাহাজ আর এলো না। আর দেখলাম না তার স্কুলারটাকে।

ওই দ্বীপে কতোদিন ছিলেন আপনি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

মাত্র তিন মাস। আরেকবার আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। রাটুনা থেকে দুজন মারকুইজান এসে ক্যানুতে করে নিয়ে যায় আমাকে। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে। মেয়েটার মারকুইজান নামের ইংরেজি অর্থ করলে হয় সাগরের হাসি, আর ছেলেটার ঝিনুক। ওরকম নামই পছন্দ ওখানকার লোকের। কঠিন নাম নয়। সহজ। বেশির ভাগই সাগর কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। মনে রাখা বোধহয় সহজ, সে-জন্যেই। মাছ ধরতে বেরিয়েছিলো দুজনে, অ্যালবিকোর মাছ। ছোট একটা ঝড়ে পড়ে, স্রোতের মুখে পড়ে যায়। ভেসে যায় দূর সাগরে। তাতে মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি ওরা। ওরকম হরহামেশাই ঘটে। সাগরে ভেসে যায়, আবার বাড়ি ফেরে। সাগরও ওদের কাছে ডাঙার মতোই। ডাঙায় যেরকম সহজ ভঙ্গিতে ঘটতে পারে, পানিতেও তেমনি সাঁতরাতে পারে। পানিকে একটুও ভয় করে না। ভাসতে ভাসতে এসে আমার দ্বীপটা চোখে পড়েছিলো ওদের। পানি আর নারকেলের জন্যে চলে এসেছিলো। পেয়ে গেল আমাকে। কি হাসাটাই না হাসলো আমাকে ওখানে দেখে, যেন এক মস্ত রসিকতা। ওদের কাছে ওরকম দ্বীপে থাকাটা তো কিছু না, সেজন্যে কিছুই মনে করলো না। তবে আমি খুশি হয়েছিলাম ওদেরকে দেখে, সাংঘাতিক খুশি। সাথে করে আমাকে রাটুনায় নিয়ে গেল ওরা।

তারপর ক্যানুতে করে এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপ, সে দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ করতে করতে দুমাস পরে গিয়ে নুকা-হিভায় পৌঁছুলাম। ওই অঞ্চলের সব চেয়ে বড় দ্বীপ ওটা। আরও তিন মাস অপেক্ষা করতে হলো আমাকে জাহাজের জন্যে। জর্জি গ্রিম এলো তার স্কুনার নিয়ে, তুলে নিলো আমাকে। তাহিতিতে পৌঁছে দিলো। জানতে পারলাম, কারনেস ফিরে এসেছিলো, তারপর আবার চলে গেছে। এসেই তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ায় আমি ভাবলাম, নিশ্চয় মুক্তোর সন্ধানে গিয়েছে সে। যাবেই। তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এতো টাকার সম্পদ দেখে এসে কোন্ মানুষটা আনতে যাবে না? সে গেলেও আমি চিন্তা করলাম না। আসল অবস্থান জানা নেই তার। কিছুতেই বের করতে পারবে না অতো বড় মহাসাগরের মাঝে। শুধু আমি জানি কোথায় আছে সেই ঝিনুকের খেত। আর গাধাটা আমাকে খুন করতে না চাইলে অবশ্যই জানিয়ে দিতাম ওকে।

মুক্তোগুলো তুলে আনার জন্যে ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম। দ্বীপের এক জাহাজের মালিককে লোভ দেখানোর চেষ্টা করলাম। আমার সঙ্গে গেলে তাকে আধাআধি বখরা দেয়ার কথাও বললাম। রাজি হলো না। বিশ্বাসই করলো না আমার কথা। ওসব অঞ্চলে এরকম গল্প প্রায়ই এসে বলে নাবিকেরা, বেশির ভাগই মিথ্যে। তাই কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। হেসেই উড়িয়ে দেয়। আর ওদেরই বা দোষ দেব কি। আমি নিজের চোখে না দেখলে কেউ এসে যদি ওই গল্প আমার কাছে বলতো, আমিও বিশ্বাস করতাম না। আমিও মুখের ওপর হাসতাম। যদিও এরকম খেত অনেক পাওয়া গেছে। মুক্তোও তুলে নিয়ে এসেছে কেউ না কেউ।

রাটুনায় থাকার সময় স্থানীয়রা আমাকে কয়েকটা ছোট মুক্তো উপহার দিয়েছিলো। অন্যান্য দ্বীপেও পেয়েছি কিছু। বিক্রি করে টাকাও পেয়েছি। কিন্তু এততাই সামান্য, তা দিয়ে বড় ধরনের একটা অভিযান চালানো সম্ভব নয়। অনেক খরচ। জাহাজ ভাড়া করতে হবে, ডুবুরির পোশাক লাগবে, আরও অনেক জিনিস। তাহিতিতে বেশিদিন থাকতে সাহস হলো না। কোন দিন ফিরে চলে আসে কারনেস, ঠিক নেই। মুখোমুখি হলে আমাদের একজনকে মরতেই হতো, খুনের দায়ে অ্যারেস্ট হতো আরেকজন। টাকা জোগাড়ের জন্যে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেও একই অবস্থা। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। দুএকজন যা-ও বা করলো, এতো বেশি খবর জানতে চাইলো, বলাটা উচিত মনে করলাম না। ওরা একেবারে জায়গার ঠিকানাই চায়। বলে দিলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই যদি চলে যায় কিছুই করতে পারবো না। শেষে ভাবলাম, পৃথিবীতে এখন টাকার জায়গা বলতে আমেরিকা আর জাপান। জাপানীরা বেশি চালাক, ওদেরকে রাজি করাতে পারবো না। বাকি থাকলো আমেরিকা। চলে এলাম। মনে করলাম যদি কেউ ইনটারেস্টেড হয়…

তেমন কাউকে পেয়েছো? জানতে চাইলো ওমর।

না।

পাবে বলেও মনে হয় না। আসলে, কাউকে বিশ্বাসই করাতে পারবে না। আর কেউ যদি করেও, এতোবড় জুয়া খেলতে রাজি হবে না।

জুয়া! প্রায় চিৎকার করে উঠলো ডজ, জুয়া বলছে, কেন? সোজা আমি জায়গাটায় নিয়ে চলে যেতে পারি।

নোটবুক আর পেন্সিল বের করলো ওমর। তাহিতি থেকে তোমার দ্বীপটার দূরত্ব কতো? নাম কি?

কোনো নাম নেই। ম্যাপে বের করতে পারিনি। ওদিকের অনেক দ্বীপের নামই ম্যাপে নেই। নেভির চার্টে হয়তো থাকতে পারে।

হু। বেশ, তাহলে একটা নাম ঠিক করে ফেলা যাক। যাও, ওটার নাম রেখে দিলাম ডজ আইল্যাও। তাহিতি থেকে কদ্দূর?

আটশো মাইল মতো হবে।

লেগুনে জাহাজ ঢোকানো যাবে? নিরাপদ?

তা যাবে।

প্লেন তো নেয়া যাবে না। এক কাজ করা যেতে পারে। ফ্লাইং বোট। ল্যান্ড করা যাবে?

উড়ে যাওয়ার কথা ভাবছো নাকি?

কেন নয়?

গাল চুলকালো ডজ। না, তেমন অসুবিধে নেই। তবে একবারও কথাটা মনে আসেনি আমার। পকেটে টাকা না থাকলে বুদ্ধিও খোলে না। স্কুনারে করে যাওয়ার চেয়ে তাতে খরচ বেশি পড়বে।

কিন্তু যাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি।

তা যাবে।

ফ্লাইং বোট থেকে পানিতে নামা যাবে? ডুব দিয়ে ঝিনুক তোলার জন্যে?

যাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে। ওখানকার সাগর শান্তই থাকে দেখেছি।

ডাইভিঙের অভ্যাস তো নিশ্চয় করে ফেলেছো। এতোদিন ওখানে থেকে যখন মুক্তো তোলার কাজ করেছো।

ভালোমতো।

কি কি জিনিস লাগবে, জান তো? ভুলচুক করবে না?

নিশ্চয় জানি। করবো না।

তাহলে, ফ্লাইং বোটের ব্যবস্থা যদি করে দিই, আর সমস্ত খরচ-খরচা জোগাড় করে দিই, মুক্তোর বখরা দিতে রাজি আছো?

দেবো না মানে! নিশ্চয়ই দেবো! চেঁচিয়ে উঠলো ডজ। তুমি সব খরচ দেবে, আমি তুলে আনার ব্যবস্থা করবো। আধাআধি ভাগ হবে।

আধাআধিতে চলবে না। এতো টাকা আমি একলা দিতে পারবো না। কিশোরের সাহায্য লাগবে। কি কিশোর, তোমার চাচার কাছ থেকে কিছু জোগাড় করতে পারবে?

পারবো বলতে একটুও দ্বিধা করলো না কিশোর। চাচাকে চেনে সে। এরকম ঝুকি নেয়ার অভ্যাস আছে তার। অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন জীবনে। মেরিচাচীর বাধা না থাকলে এই অভিযানে শুধু টাকা দেয়াই নয়, তিনি নিজেও বেরিয়ে পড়তেন, জানে সে। তবে, তিন ভাগ করলে চলবে না। আমার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যাচ্ছে। পাঁচ ভাগ করতে হবে। কি বলো, মুসা?

আমি অবশ্যই যাবো, মুসা জবাব দিলো। তবে মুফতে বখরা নিতে চাই না। বাবাকে বলে, আমিও কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে পারবো আশা করি, যদি মাকে না শোনাই।

ভেরি গুড, ওমর বললো। আর রবিন?

তার বাবাও যে কিছু দেবেন না, তা নয়, কিশোর বললো। তবে রবিন যেতে পারবে কিনা সেটাই কথা। আজকাল ও ভীষণ ব্যস্ত, গানের ব্যবসায়। মিস্টার বার্টলেট লজ ইদানীং তাকে বেতনের টাকা তো দেনই, কমিশনও দিতে আরম্ভ করেছেন। ফলে ইস্কুলের পড়ালেখা আর মিউজিক ছাড়া এখন আর কিছু বোঝে না রবিন।

হুঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। রবিনটা যে এভাবে বদলে যাবে, কল্পনাই করিনি কোনোদিন। তার কণ্ঠে দুঃখের সুরটা অপ্রকাশিত থাকলো না।

দেখা যাক, বলে। যেতে রাজি হলে ভালো। না হলে আমরা দুজনেই যাবো। এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার মিস করা যায় না। কি বলো?

তা তো বটেই। দক্ষিণ সাগরে গিয়ে আরেকবার শুঁয়োপোকা খেতে হলেও আপত্তি নেই আমার, তবু যাবো।

তার কথায় হাসলো ডজ। না, শুয়োপোকা আর খেতে হবে না, এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি। তবে প্রচুর নারকেল খেতে হতে পারে।

নারকেল তো ভালো জিনিস। আমার মজাই লাগে।

তাহলে, কাজের কথায় এলো ডজ। কবে রওনা হচ্ছি আমরা?

জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেলেই। এখনই একটা চেক নিয়ে যেতে পারো। যা যা লাগবে লিস্ট করে নিয়ে কিনতে শুরু করে দাও। তবে খরচ যতোটা কম করা যায় সেই চেষ্টা করবে। ফ্লাইং বোটের ব্যবস্থা আমি করবো।

দুই ঢোকে গেলাসের বাকি পানীয়টুকু শেষ করে ফেললো ডজ। হাত বাড়ালো, দাও, চেক। এখুনি বেরিয়ে যাই। আর ভাবনা নেই। ওই মুক্তো এখন আমাদের!

একটা ঝুড়ি কিনতে ভুলো না যেন, হেসে মনে করিয়ে দিলো ওমর। তুমি বলেছিলে ঝুড়ি বোঝাই করে মুক্তো আনতে পারবে। তার কম হলে চলবে না আমাদের।

<

Super User