বাঁচাও! তীক্ষ্ণ চিৎকার। বাঁচাও! খানখান হয়ে গেল নীরবতা।

পুরানো ভাঙা বাড়িটার ভেতর থেকে আসছে আর্তনাদ। শিরশিরে ঠাণ্ডা যোত যেন বয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দা মুসা আমানের মেরুদণ্ড বেয়ে।

আবার শোনা গেল চিৎকার। শেষ হলো চাপা ঘড়ঘড় করে। শব্দের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিল আরও।

একটা ব্যারেল পামের গোড়ায় হুমড়ি খেয়ে আছে মুসা, চোখ খোয়া-বিছানো আঁকাঝকা পথের দিকে। কেউ আসছে কিনা দেখছে।

চিৎকার শুনে মুসার মতই পথের অন্য ধারের একটা ঝোপে গিয়ে লুকিয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা। চেয়ে আছে বাড়ির দিকে।

অপেক্ষা করছে দুজনেই।

স্প্যানিশ ধাঁচের একটা অনেক পুরানো বিলডিং। অযত্নে বেড়ে পুরানো গাছপালা আর লতার ঘন জঙ্গলে ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে।

আর শোনা গেল না চিৎকার। কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। পুরুষ না মহিলা? জানি না, ফিসফিসিয়েই জবাব এল। তবে কোনটার মতই তো লাগল না।

কোনটাই না? ঢোক গিলল মুসা। শিশুও নয়। তাহলে আর একটা সম্ভাবনাই থাকে, যেটা ভাবতেও ভয় পাচ্ছে সে।

আড়াল থেকে বেরোল না ওরা। গরমে ঘামছে দরদর করে। রকি বীচের চেয়ে গরম কি বেশি নাকি হলিউডে?

চারপাশে তাল জাতীয় গাছের ছড়াছড়ি, ঘন ঝোপঝাড়, লতা, আর নানা রকম ফুলগাছ। চমৎকার একটা বাগান ছিল এককালে। কিন্তু অযত্নে অবহেলায় এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। ওপাশের বাড়িটাও ঠিকমত চোখে পড়ে না।

এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেতা মিস্টার মরিসন ফোর্ডের বাড়ি, চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের বন্ধু। প্রিয় কাকাতুয়াটা হারিয়ে খুব মনোকষ্টে আছেন অভিনেতা, বন্ধুকে জানিয়েছেন। পরিচালকই তিন গোয়েন্দাকে অনুরোধ করেছেন ব্যাপারটা একটু তদন্ত করে দেখতে। সেজন্যেই এসেছে কিশোর আর মুসা। গেটের ভেতরে ঢুকেই শুনেছে চিৎকার, লুকিয়ে পড়েছে। কি ঘটে, দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।

কিশোর, নিচু স্বরে বলল মুসা, খুঁজতে এলাম কাকাতুয়া। এ-যে দেখছি ভূত! ভূতুড়ে বাড়িতে ঢুকলাম না তো, টেরর ক্যাসলের মত? তিন গোয়েন্দার প্রথম রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা মনে করল সে।

খুব আশাব্যঞ্জক, বিশেষ বিশেষ সময়ে কঠিন শব্দ ব্যবহার আর দুর্বোধ করে কথা বলা কিশোরের স্বভাব। আরেকটা কেস বোধহয় পেলাম। চলো, এগোই। কি হয়েছে দেখা দরকার।

ভূতেরা খেলায় মেতেছে। বাজি রেখে বলতে পারি, গিয়ে একটা দরজাও খোলা পাব না, সব তালা বন্ধ। আমাদেরকে দেখলেই ঝটকা দিয়ে দিয়ে খুলে যাবে…

চমৎকার বর্ণনা! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। মনে রেখো। ঠিক এভা, গিয়ে বলো রবিনকে, নোট করে নেবে…

দেখো কিশোর, রসিকতার সময় নয় এটা…

কিন্তু মুসার কথায় কান নেই কিশোরের। ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে নিঃশব্দে এগোতে শুরু করেছে বাড়ির দিকে।

মুসাও উঠে দাঁড়াল। পথের অন্য ধারে গাছের আড়ালে থেকে এগোল সে-ও।

বাড়িটা শ-খানেক ফুট দূরে থাকতেই কিসে যেন মুসার পা জড়িয়ে ধরল। টান দিয়ে গোড়ালি ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে, বাধন আরও শক্ত হলো। হ্যাচকা টানে পা ছুটিয়ে নেয়ার জন্যে সামনে লাফ দিল। পাল্টা টান দিয়ে ফেলে দেয়া হলো তাকে মাটিতে, কিসে ধরেছে দেখতে পাচ্ছে না ঘন পাতার জন্যে।

কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বাঁচাও আমাকে মেরে ফেলল।

ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে এল কিশোর।

দেখো, কিসে জানি টানছে, কোলা ব্যাঙ ঢুকেছে যেন মুসার গলায়, চোখ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে গর্তে। অজগর…না না, অ্যানাকোণ্ডা।

ভাবান্তর নেই কিশোরের চেহারায়। শান্তকণ্ঠে বলল, তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার, মুসা। ভয়ঙ্কর ভিটিস ভিনিফেরায় ধরেছে তোমাকে।

খাইছে! আল্লারে, মরে গেলাম! কিশোর, দোহাই তোমার, ভিটিস বি জানি…বাঁচাও…।

আট ফলার প্রিয় ছুরিটা বের করল কিশোর। ধীরে সুস্থে বসে পেঁচিয়ে কাটতে শুরু করল ভিটিস ভিনিফেরাকে।

টান মুক্ত হতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। কিসে ধরেছিল, তাকাল।

নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে কিশোর। ছুরিটা আবার ভাঁজ করে বেল্টে ঝুলিয়ে রাখছে।

ফিক করে হেসে ফেলল মুসা। প্লীজ, কিশোর, রবিনকে বোললা না।

পা ফেলেছিলে লতার ফাঁদে, ভেবেছ সাপ। ওই ভূতের ভয়ই তোমার মনকে . ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল, মুসা, উপদেশ দিতে শুরু করল কিশোর। এভাবেই ভয় পেয়ে মরে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের লোক, বোকারা ভাবে ভূতে মেরেছে। ভয় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তোমার মনকে, ফলে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, বুঝতে পারোনি ওটা সাপ না লতা।

কিশোরের এ ধরনের লেকচারে এখন আর কিছু মনে করে না মুসা, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বলল, ঠিকই বলেছ, ওই চিৎকারই…

সেজন্যেই বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। আতঙ্ক বিপদকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সেকারণেই মনীষীরা বলেছেন বলেছেন…।

মনীষীরা যেন ভয় পেতেই বলেছেন কিশোরকে, বড় বড় হয়ে যাচ্ছে চোখ। ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে চোয়াল। চেহারা ফ্যাকাসে। দৃষ্টি মুসার পেছনে।

সত্যি খুব ভাল অভিনেতা তুমি, কিশোর, প্রশংসা করল মুসা। কেন যে টেলিভিশনে অভিনয় বাদ দিলে। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অনেক বেশি উন্নতি করতে পারতে। এভাবে ভয় পাওয়ার অভিনয়… হঠাৎ সন্দেহ হলো তার। ফিরে তাকাল। স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

অভিনয় করছে না গোয়েন্দাপ্রধান।

বিচ্ছিরি রকম মোটা এক লোক দাড়িয়ে আছে, হাতে ভীষণ চেহারার একটা পুরানো আমলের পিস্তল, পিলে চমকে দেয়। পুরু লেন্সের চশমার জন্যে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড় লাগছে, গোল গোল, যেন মাছের চোখ।

এসো, পিস্তল নাড়লো লোকটা, আগে ঘরে এসো। তারপর শুনব কেন ঢোকা হয়েছে।

মুখ শুকিয়ে গেছে মুসার, পা দুটো যেন দুই মণ ভারি। কোন মতে টেনে টেনে এসে উঠল খোয়া বিছানো পথে। খবরদার, পালানোর চেষ্টা কোরো না, হুশিয়ার করল লোকটা। তাহলে পস্তাবে।

যা বলছে, করো, মূসার কানের কাছে ফিসফিস করল কিশোর। দেখি কি হয়।

পাগলু, জবাব দিল মুসা। পালানোর চেষ্টা করব মরতে? হাঁটতেই তো পারছি না ঠিকমত।

আগে আগে চলেছে দুই গোয়েন্দা।

পেছনে মোটা লোকটার জুতোর মচমচ শব্দে শিরশির করছে মুসার গা, শুয়োপোকা দেখলে অনেকের যে অনুভূতি হয়।

বিশাল সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, ওপরে টালির ছাউনি বেরিয়ে আছে সামনের দিকে।

দরজা খোলো, হুকুম করল লোকটা। জলদি করো। গুলি করার জন্যে আঙুল নিশপিশ করছে আমার।

নব ঘুরিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। খুলে গেল দরজা। আবছা অন্ধকার একটা হলঘর।

ডানে ঘোরো, আবার বলল লোকটা। ওই যে, পাশের দরজাটা, খোলো।

আরেকটা বড় ঘরে ঢুকল ওরা। পুরানো আসবাবপত্র। খবরের কাগজ আর বইয়ে ঠাসা। উল্টো প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে সাজানো রয়েছে কয়েকটা বড় বড় চেয়ার, চামড়ায় মোড়া গদি।

যাও, বসো ওখানে।

যা বলা হলো, করল ওরা।

মুখখামুখি দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। মুখে সন্তুষ্টির হাসি। পিস্তলের নলের মুখে জোরে ফু দিল, যেন ভেতরে জমে থাকা বালি পরিষ্কার করছে। পথ সুগম করে দিচ্ছে বুলেটের।

এবার বলল, কি চুরি করতে এসেছ?

মিস্টার মরিসন ফোর্ডের কাছে… বলতে গিয়ে বাধা পেল কিশোর।

আমিই মরিসন ফোর্ড।

অ। আপনার কাছেই এসেছি…

কিন্তু এবারও কথা শেষ করতে দিল না ফোর্ড। নাকের একপাশ চুলকাল। আমার কাছে? তাহলে এভাবে লুকিয়ে কেন? চোরের মত?

কে যেন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করল, বলে ফেলল মুসা। তাই লুকিয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম ভেতরে চোর-ডাকাত…কত কিছুই তো ঘটছে আজকাল। দিনে-দুপুরেও লোকের বাড়িতে ডাকাত পড়ে।

অ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল লোকটার। শুনেছ, না?

মিস্টার ফোর্ড, বুঝিয়ে বলল কিশোর, মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার পাঠিয়েছেন আমাদের। আপনার নাকি একটা কাকাতুয়া হারানো গেছে, পুলিশ কিছু করতে পারছে না। সেটাই তদন্ত করতে এসেছি আমরা, পাখিটা খুঁজে বের করতে। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল সে। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।

গোয়েন্দা, না? একনজর দেখেই কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল লোকটা। কাকাতুয়া খুঁজতে এসেছ। হাসল।

হাঁপ ছাড়ল মুসা। কিন্তু লোকটার পরের কথায়ই চুপসে গেল আবার।

তোমাদের কথা বিশ্বাস করতে তো ইচ্ছে করছে, চেহারা সুরতও ভালই, চোরের মত না। তোমরা ফিরে না গেলে খুব কান্নাকাটি করবে বাবা-মা, না?

খুব শান্ত ভাবে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল লোকটা। পিস্তলের নল প্রথমে ধরল কিশোরের বুক সোজা, তারপর ঘোরাল মুসার দিকে।

টিপে দিল ট্রিগার। চাপা একটা আওয়াজ হলো।

ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা, কিছুই ঘটল না দেখে মেলল আবার।

পিস্তলের নলের মাথায় জ্বলছে নীলচে আগুন। সেটা থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিচ্ছে মিস্টার ফোর্ড। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ভকভক করে, ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে পিস্তলটা রেখে দিল টেবিলে।

হায় হায়, ভাবল মুসা, এত ভয় পেলাম। ওই সিগারেট লাইটারটা দেখে? দূর, আমি একটা ভীতুর ডিম। রক্ত ফিরে এল আবার চেহারায়। নড়েচড়ে বসল।

চমৎকার, হাসি হাসি ভাব করে বলল লোকটা। পরীক্ষায় পাশ। নাকি আমার অভিনয় ভাল হয়নি?

আরেকটু হলেই হার্টফেল করতাম, বাড়িতে ঢোকার পর এই প্রথম হাসি ফুটল মুসার মুখে। হাত মেলা। লোকটার নরম তুলতুলে হাতের চাপ খুব শক্ত, দেখে মনে হয় না এরকম হবে।

কিশোরের সঙ্গেও হাত মেলাল লোকটা। এভাবে অভিনয় করে অনেক বয়স্ক লোককেও বেহুশ করে দিয়েছি। আর তোমরা ছেলেমানুষ…ভাল গোয়েন্দাই পাঠিয়েছে ডেভিস। ও-ই বলেছিল, তোমাদের একটা টেস্ট নিতে।

মানে ইয়ে… বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফার বলেছেন আমাদের সাহসের পরীক্ষা নিতে!

হ্যাঁ, এই তো, একটু আগে ফোন করল। তবে তোমরা ভালই উৎরেছ। জানাব ডেভিসকে। আর হ্যাঁ, তোমাদের কিছু তদন্ত করতে হবে না, সরি।

কিন্তু আপনিই নাকি মিস্টার ক্রিস্টোফারকে জানিয়েছেন কাকাতুয়া হারিয়েছে? মুসা অবাক।

হারিয়েছিল, মাথা ঝাকাল লোকটা। তাকে জানিয়েও ছিলাম। কিন্তু ওটা যে ফিরে এসেছে, জানানো হয়নি আর। ডিয়ার বিলি, কি কষ্টটাই না দিয়েছে আমাকে।

বিলি? কিশোর জিজ্ঞেস করল, কাকাতুয়াটার নাম?

হ্যাঁ, বিলি শেকসপীয়ার, উইলিয়াম শেকসপীয়ারের…

কিন্তু বাঁচাও বাঁচাও বলে কে চেঁচাল? মুসা বলল, এ বাড়ি থেকেই…

খুব খুঁতখুঁতে তোমরা। গোয়েন্দাগিরির জন্যে ভাল। গলা ফাটিয়ে হাসল লোকটা, দুলে উঠল মস্ত ভুড়ি। ওটা বিলির কাণ্ড। নিজেকে অনেক বড় অভিনেতা ভাবে সে, মাঝেমাঝেই সেটা প্র্যাকটিস করে। আমিই শিখিয়েছিযেন হাজতে আটকে রাখা কয়েদী বিলি, তার ওপর নির্যাতন চলছে…হা-হা-হা।

বিলিকে দেখাবেন, প্লীজ? অনুরোধ করল কিশোর। খুব বুদ্ধিমান পাখি, দেখতে ইচ্ছে করছে।

সরি মেঘ জমল লোকটার চেহারায়। আজ বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল বিলি। তাকে থামানোর জন্যে শেষে খাঁচার ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকেছি। এখন

আবার তুললেই হয়তো চেঁচানো শুরু করবে। মাথাই খারাপ হয়ে গেল, না কী।

ঠিক আছে ঠিক আছে, থাক তাহলে, হাত তুলল কিশোর। তদন্ত করার আর তো কিছু নেই, হতাশ হয়েছে খুব। যাই আমরা, মিস্টার ফোর্ড। আপনার কাকাতুয়া ফিরে এসেছে, এটা অরিশ্যি খুশির খবর।

থ্যাংকু বলল মোটা লোকটা। তোমাদের কার্ড রইল। কখনও দরকার পড়লে ডাকব। তিন গোয়েন্দা, মনে থাকবে।

সদর দরজা পর্যন্ত ছেলেদের এগিয়ে দিয়ে গেল ফোর্ড।

খুব খারাপ লাগছে, আঁকাবাঁকা পথে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল কিশোর। আশা হয়েছিল, দারুণ একখান কেস মিলেছে। পোড়া নির্জন বাড়ি, আর্তনাদ, অদ্ভুত এক মোটা লোক…বড় বেশি আশা করে ফেলেছিলাম।

আমার ভালই লাগছে, খুশি দেখাচ্ছে মুসাকে। ঢুকেই যা শুরু হয়েছিল, সত্যি সত্যি হলে এ-যাত্রা ঠিক ভূতের হাতে মারা পড়তাম। দরকার পড়লে আবার ডাকবে বলেছে ফোর্ড। না ডাকুক, সেটাই ভাল। ওকে মোটেও পছন্দ হয়নি ডাকবে হেলে এ-যাত্রা ঠিক খুশি দেখাচ্ছে আশা করে ফেলে নির্জন বাড়ি আমার।

হয়তো, কিছু ভাবছে কিশোর। নীরবে এগোল দুজনে, আলগা খোয়ায় জুতোর শব্দ হচ্ছে। হলিউডের একটা পুরানো এলাকা এটা, বড় বড় বাড়ি আছে। কিন্তু প্রায় সব কটাই যত্নের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। মালিকেরা অভাবী হয়ে পড়েছে অনেকেই, ঠিকমত যত্ন নিতে পারে না। কিংবা যাদের এখনও টাকা আছে, তারা আর পছন্দ করতে পারছে না এলাকাটা। অন্য জায়গায় নতুন বাড়ি করে উঠে গেছে।

গেটের বাইরে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো রোলস-রয়েস, জায়গায় জায়গায় সোনালি কাজ করা, আয়নার মত চকচকে শরীর, কিন্তু মডেলটা পুরানো। ইচ্ছে করেই বানানো হয়েছে। একবার বাজি জিতে গাড়িটা তিরিশ দিনের জন্যে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল তিন গোয়েন্দা। এখনও দরকার পড়লে করে, তবে ভাড়া দিতে হয়। খরচ দেয় তাদের এক বন্ধু, অগাস্ট অগাস্ট, রক্তচক্ষু উদ্ধারে তাকে সহায়তা করেছিল তিন কিশোর।

বাড়ি চলুন, হ্যানসন, শোফারকে বলল কিশোর। কাকাতুয়াটা ফিরে এসেছে।

তাই নাকি? ভাল, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল হ্যানসন, খাঁটি ইংরেজ বলে গর্ব আছে তার। চলুন।

গাড়ি ঘোরাচ্ছে হ্যানসন।

মিস্টার ফোর্ডের বাগানের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে কিশোর। গাছের জঙ্গলের জন্যে বাড়িটা দেখা যায় না।

মুসা, হঠাৎ বলল সে, ভাল করে দেখো। কোথায় জানি একটা গোলমাল রয়েছে, ধরতে পারছি না।

কি? বাগানে?

বাগান, ড্রাইভওয়ে, পুরো বাড়িটাই। মাথার ভেতরে কিছু একটা খোঁচাচ্ছে, বের করে আনতে পারছি না।

হাসালে। কিশোর পাশা যেটা বুঝতে পারে না, সেটা আমি পারব?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছে কিশোর, মুসার কথা কানে ঢুকল বলে মনে হলো না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে।

হ্যানসনকে গাড়ি থামাতে বলে ভালমত দেখল মুসা। কিন্তু গোলমাল চোখে পড়ছে না। অযত্নে বেড়ে উঠেছে বাগান, মালির হাত না লাগলে উঠবেই, স্বাভাবিক ব্যাপার। ড্রাইভওয়েতে তালের পাতা জমে আছে, মাড়িয়ে গেছে গাড়ির চাকা। এতেও অস্বাভাবিক কিছু নেই।

নাহ্, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল মুসা। গাড়ি ছাড়তে বলল হ্যানসনকে।

কিশোরের কোন খেয়ালই নেই যেন।

গোটা দশেক রক পেরিয়েছে গাড়ি, আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কিশোের। হ্যানসন! ঘোরান! গাড়ি ঘোরান! কুইক!

ঘোরাচ্ছি, কিশোরের স্বভাব হ্যানসনেরও জানা, কোন কারণ না থাকলে ঘোরাতে বলত না। তাই কোন প্রশ্ন করল না সে।

কিশোর, কি হয়েছে? আবার কেন?

গোলমালটা ধরে ফেলেছি, উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধানের মুখ। মিস্টার ফোর্ডের বাড়িতে টেলিফোন লাইন নেই।

লাইন নেই? তাতে কি?

কারেন্টের লাইন আছে, কিন্তু টেলিফোনের নেই। অথচ ফোনে কথা বলল কি করে মিস্টার ফোর্ড, মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে? মিথ্যে বলেছে। আর তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আর যা যা বলেছে, সবই মিছে কথা।

মিছে কথা? মাথা নাড়ল মুসা। কেন বলবে?

কারণ লোকটা মিস্টার ফোর্ড নয়। ভণ্ড, প্রতারক। খুব সম্ভব আসল মিস্টার ফোর্ডই তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচিয়েছিলেন।

<

Super User