এইই, কিশোর, ইস্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো মুসা আমান, পিনটু আলভারেজ কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে। সবে ছুটি হয়েছে ইস্কুল, বাইরে তারই জন্যে অপেক্ষা করছে রবিন আর কিশোর।

ওই নামের কাউকে চেনো বলে জানতাম না তো, রবিন বললো কিশোরকে।

ঠিক চিনি বলতে পারবো না এখনও, জবাব দিলো গোয়েন্দাপ্রধান। ক্যালিফোর্নিয়া হিস্টরি ক্লাবে মাঝে মাঝে দেখা হয়। তবে কথা বিশেষ বলে না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। মুসা, কি চায় ও?

কাছে এসে দাঁড়িয়েহে মুসা। জানি না। আমাকে অনুরোধ করলে তোমাকে বলতে, ইস্কুল ছুটির পর যেন তার সাথে দেখা করো, অবশ্য যদি তোমার সময় হয়। জরুরী কথা বলবে বলেই মনে হলো।

তিন গোয়েন্দার সাহায্য চায় নাকি?

শ্রাগ করলে মুসা। চাইতেও পারে।

চল তো, কি বলে শুনি। কোথায় দেখা করতে বলেছে?

খেলার মাঠে।

আগে আগে চললো কিশোর। ইস্কুল বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে এসে পড়লো শান্ত, নীরব একটা রাস্তায়। দুই ধারে গাছের সারি। শেষ মাথায় একটা গেট, ওটা দিয়ে যেতে হয় খেলার মাঠে। গায়ের জ্যাকেট টেনেটুনে নিলো ওরা। নভেম্বরের বিকেল। রোদেলা দিন, কিন্তু তারপরেও ঠাণ্ডা, নকনে বাতাস বইছে।

কই, পিনটু কোথায়? এদিক ওদিক তাকালো রবিন।

সর্বনাশ হয়েছে। নিমের তেতো ঝরলো মুসার কষ্ঠে। দেখো, কে।

গেটের ঠিক বাইরে হোট একটা হুডতোলা পিকআপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এগুলোর ডাকনাম রাঞ্চ ওয়াগন, র্যাধের কাজে ব্যবহার হয়। চওড়া কাধ, গাট্টাগোট্টা একজন মানুষকে দেখা গেল গাড়ির সামনের বাম্পারের ওপর বসে থাকতে। মাথায় কাউবয় হ্যাট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট, পরনে নীল জিনস, পায়ে ওয়েস্টার্ন বুট। ওর পাশে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিপছিপে, লম্বা এক তরুণ। ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো, লম্বা, পাতলা নাক। পিকআপটার দরজায় সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখা রয়েছেঃ ডয়েল র‍্যাঞ্চ।

শুঁটকি টেরি! নাকমুখ কুঁচকে ফেললো রবিন। ও এখানে…

রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদেরকে দেখে ফেললো লম্বা ছেলেটা, বলে উঠলো, বাহ, শার্লক হোমস এসে গেছে দেখি। সঙ্গে দুই চেলাও আছে।

খিকখিক করে গা জ্বালানো হাসি হাসলো তিন গোয়েন্দার চিরশত্রু টেরিয়ার ডয়েল। ধনী ব্যবসায়ীর বখে যাওয়া ছেলে সে। সুযোগ পেলেই ওদের পেছনে লাগে, জ্বালিয়ে মারে। নিজেকে খুব চালাক ভাবে, কিন্তু প্রতিবারেই হেরে যায় তিন গোয়েন্দার কাছে।

শুঁটকির টিটকারির জবাব না দিয়ে পারা যায় না, গেটের কাছে থমকে দাঁড়ালো কিশোর। ভোতা গলায় বললো, রবিন, ঘেউ ঘেউ করে উঠলো যেন কেউ?

কই, কোনো মানুষকে তো দেখতে পাচ্ছি না, শুঁটকির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো রবিন।

মানুষ দেখছি না, তবে একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছি, নাক কোঁচকালো মুসা। বোধহয় শুঁটকির।

রসিকতাটা বুঝলো কাউবয়, হেসে উঠলো। লাল হয়ে গেল টেরির মুখ। ঘূসি পাকিয়ে হুমকির ভঙ্গিতে এগোলো তিন গোয়েন্দার দিকে। এই সময় ডেকে উঠলো আরেকটা নতুন কন্ঠ, কিশোর পাশা, দেরি করে ফেললাম, সরি। একটা উপকার চাইতে এসেছি তোমার কাছে।

সুন্দর স্বাস্থ্য, কালো চোখ, কালো চুলওয়ালা একটা ছেলে বেরিয়ে এলো গেট দিয়ে। পিঠ এতো খাড়া করে হাঁটে যে যতোটা না লম্বা তার চেয়ে বেশি লম্বা মনে হয়। পরনে আঁটো পুরানো জিনস, পায়ে খাটো রাইডিং বুট, গায়ে ঢাললে সাদা শার্ট, জোড়াগুলো রঙিন সুতো দিয়ে সেলাই করা। কথায় কোনো টান নেই, তবে পোশাকেই বোঝা যায় পুরানো স্প্যানিশ জমিদারের রক্ত রয়েছে শরীরে।

কি উপকার? জানতে চাইলো কিশোর।

হেসে উঠলো টেরি। হা-হা, শার্লক, শেষমেষ চেঁড়োদের সঙ্গে মিশলে? লাল কাপড় দেখিয়ে ষড় খেদানো ছাড়া ওরা আর কি বোঝে? একটা উপকার অবশ্য করতে পারো। ঘাড়টা ধরে মেকসিকোতে ফেরত পাঠাতে পারো। উপকারটা আমাদের সবারই হয় তাহলে।

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো পিনটু। এতোই দ্রুত, অবাক করে দিলো টেরিকে, মুখের হাসি মুছে দিলো তার কঠিন কণ্ঠে বললো, কথাটা ফিরিয়ে নাও! আর মাপ চাও আমার কাছে।

শুঁটকির চেয়ে খাটো ছেলেটা, ওজনও কম হবে, কিন্তু পরোয়াই করলো না। মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে টেরির মুখোমুখি, একেবারে স্প্যানিশ জমিদার। কিংবা ডন।

পাগল!কললো বটে, কিন্তু হাসলো না টেরি। আমি মেকসিকানদের কাছে মাপ চাই না।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঠাস করে টেরির গালে চড় মারলো ছেলেটা।

শয়তানের বাচ্চা! ভীষণ রাগে গাল দিয়ে উঠে এক ধাক্কায় ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে দিলো টেরি। কিন্তু চোখের পলকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল পিনটু। আবার তাকে ফেলে দিলো টেরি। আবার উঠলো পিনট, আবার পড়লো। আবার উঠলো। টেরির শার্টের বুক খামচে ধরলো। তাকে ঠেলে রাস্তার দিকে নিয়ে চললো টেরি, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন আশা করছে কেউ এসে এই অসম লড়াইটা থামায়। চেঁচিয়ে বললো, এই, এই আেঁকটাকে সরাও তো…।

জেঁকটাকে সরানোর জন্যে নয়, অন্য উদ্দেশ্যে শার্টের হাতা গুটিয়ে আগে বাড়লো মুসা। হেসে উঠলো মোটা কাউবয়। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বাম্পার থেকে। পিনটুকে বললো, এই ছেলে, থামো। পারবে না ওর সাথে। অহেতুক মার খাবে আরও।

নাআআ!

তীক্ষ্ণ, কঠিন আরেকটা কণ্ঠ যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে জমিয়ে দিলো সবাইকে। কোনদিক থেকে এসেছে সে, উত্তেজনার মাঝে খেয়াল করেনি কেউ। পিনটুর একটা বড় সংস্করণ মনে হচ্ছে লোকটাকে। চেহারার মিল তো রয়েছেই, পোশাক-আশাকও অবিকল একরকম, শুধু পিনটুর চেয়ে লম্বা আর বয়েস কিন্তু বেশি এই যা। আর মাথায় একটা কালো সমব্রেরো হ্যাট রয়েছে। পাথর কুঁদে তৈরি যেন মুখ, কালো শীতল চোখ। কেউ এগোবে না, গর্জে উঠলো আবার লোকটা। ওরা লেগেছে, ওদেরকেই মীমাংসা করতে দাও।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার ফিরে এলো কাউবয়, হেলান দিয়ে দাঁড়ালো গাড়ির গায়ে। মুসাও দাঁড়িয়ে গেছে। চেয়ে রয়েছে রবিন আব কিশোর। জ্বলন্ত চোখে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে আবার পিনটুর দিকে তাকালে টেরি। রাস্তায় নেমে গেছে দুজনে। টেরির শার্ট ছেড়ে দিয়েছে পিনটু। ঘুসি তুলে এগিয়ে গেল তাকে মারার জন্যে।

বেশ, সেঁড়ো, দেখাচ্ছি মজা! বলে ঘেঁকিয়ে উঠলো টেরি।

র‍্যাঞ্চ ওয়াগনের একটু দূরে আরেকটা গাড়ি পার্ক করা। মাঝখানের খালি জায়গায় বাধলো লড়াই। হঠাৎ লাফিয়ে পিছিয়ে গেল টেরি, ভালোমতো সই করে একটা ঘুসি ঝাড়ার জন্যে।

সরো! সরো। একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন আর মুসা।

পিছিয়ে একেবারে রাস্তার মাঝে চলে গেছে টেরি। খেয়ালই করেনি গাড়ি আসছে। চোখ পিনটুর দিকে। টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। ব্রেক কষেছে ড্রাইভার, কিন্তু বাঁচাতে পারতো না টেরিকে, যদি সময়মতো ডাইভ দিয়ে না পড়তে পিনটু। করে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় টেরিকে সরিয়ে দিলো গাড়ির সামনে থেকে। তাকে নিয়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে।

ক্ষণিকের জন্যে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো দুটো দেহ। চেঁচামেচি করে ছুটে গেল দর্শকরা।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো পিনটু, হাসিমুখে। টেরিও উঠলো। ক্ষতি হয়নি তারও।

পিনটুর পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলো মুসা। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো ড্রাইভার। পিনটুকে বললো, দারুণ হেলে তো হে তুমি? তা কোথাও লাগেনি তো?

মাথা নাড়লো পিনটু। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে টেরির দিকে এগোলো ড্রাইভার। তার খোঁজখ নিলো। যখন দেখলো কারোরই কোনো ক্ষতি হয়নি, আবার গিয়ে উঠলো গাড়িতে। চলে গেল। টেরি তখনও পা ছড়িয়ে বসে আছে। কাঁপছে মৃদু মৃদু। চেহারা ফ্যাকাসে।

এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে টান দিলো তার কাউবয় সঙ্গী। ওঠো! অল্পের জন্যে বেঁচেছে। ওঠো!

ও…ও আমাকে বাঁচালো। বিড়বিড় করলো টেরি।

কি মনে হয় তোমার? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা। ধন্যবাদ দাও ওকে।

থ্যা-থ্যাংকিউ, পিনটু,কাপা গলায় বললো টেরি। শু

ধু থ্যাংকিউ? কড়া গলায় বললো পিনটু। আর কিছু না?

দ্বিধায় পড়ে গেল টেরি। আর আবার কি?

আর? কেন ভুলে গেছো মাপ চাওয়ার কথা? জলদি মাপ চাও। নইলে এসো, দেখি, আবার হয়ে যাক এক হাত।

ছেলেটার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবে চেয়ে রইলো টেরি।

কি হলো? ভুরু নাচালো পিনটু। কথা বলছো না কেন? কথা ফিরিয়ে নাও। আর মাপ চাও।

লাল হয়ে গেল টেরির গাল। বেশ, তাতে যদি খুশি হও-ফিরিয়ে নিলাম আমার কথা…

হাত তুললো পিনটু। ঠিক আছে, আর মাপ চাইতে হবে না। এমনিতেই মাপ করে দিলাম। বলে ঘুরে দাঁড়ালো সে।

এই, শোনো…,বলতে ঝলতেই টেরির চোখ পড়লো তিন গোয়েন্দার হাসিমুখের দিকে, তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গটমট করে এগোলো র‍্যাঞ্চ ওয়াগনের দিকে। ডরি! হেঁকে বললো কাউবয়কে, আদেশের সুর, চলো!

পিনটুর দিকে তাকালো এবার ডরি। তারপর তার পাশে দাঁড়ানো কঠিন চেহারার লোকটার দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, কাজটা ঠিক করোনি তোমরা। এজন্যে পস্তাতে হবে।

র‍্যাঞ্চ ওয়াগলে টেরির পাশে উঠে বসলো ডরি। গাড়ি স্টার্ট দিলো।

<

Super User