গাড়িতে ওঠো, দরজা খুলে দিয়ে ডাকলো কিশোর। খুলে বলো সব বুঝে দেখি সাহায্য করতে পারবো কিনা।

পেছনের সিটে চাপাচাপি করে বসলো চার কিশোর। অল্প কথায় সব জানালো টিম। বছর তিনেক আগে স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে, এসে থাকার জন্যে মিস্টার রোজারের বাড়িতে উঠেছিলো তার বাবা বেকার ডেলটন। বীমা কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ করতো। সামান্য আয়ে সংসার চলতো না। তাই বাধ্য হয়ে মিস্টার রোজারের হাউসকীপারের চাকরি নিয়েছিলো টিমের মা। বাড়ির পেছনে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসও বিনা ভাড়ায় পেয়েছিল থাকার জন্যে।

ভালোই কাটছিলো। তারপর, মাস ছয়েক আগে বেভারলি হিল-এ এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুরি হলো। তিনটে দামী, ছবি। কিভাবে ঢুকেছিলো চোর, জানতে পারেনি পুলিশ। অনুমান করছে, হয় সরু জানালা দিয়ে, জোরজার করে ঢুকেছে, কিংবা নকল চাবি বানিয়ে নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলো ওরা, চুরির হপ্তা দুই আগে ওই বাড়িতে গিয়েছিলো ডেলটন। মালিকের একটা পলিসি করানোর জন্যে। ছবিগুলো দেখেছে।

শুধু ওই বাড়িতে যাওয়ার অপরাধেই ডেলটনের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ছবি খুঁজেছে পুলিশ। রান্নাঘরে পেয়েছে চোরাই মাল। ধরে নিয়ে গিয়ে পাঁচ বছরের জন্যে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাস তিনেক আগে বিচার শেষ হয়েছে তার। অনেক মিনতি করেছে ডেলটন, কসম খেয়েছে। বলেছে, সে চুরি করেনি।- ছবি চেনে না। দামী কিনা বলতেই পারবে না। তাছাড়া দুজনের আয়ে সংসার চলে যাচ্ছিলো। ভালোমতোই, চুরি কেন করতে যাবে? কিন্তু জুরিরা শুনলো না সে কথা।

বিশ্বাস করো, শেষে বললো টিম, বাবা চুরি করেনি। আমার বাবা চোর নয়। হলে আমি আর মা জানতাম। পুলিশের ধারণা, এই এলাকায় গত দশ বছর ধরে যতো ছবি চুরি হয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাবা। বীমার দালাল, লোকের বাড়িতে ঢোকা তার জন্যে সহজ। থেমে দম নিলো সে। তারপর হঠাৎ কিশোরের হাত চেপে ধরে বললো, তোমাদের ভাড়া করতে চাই। আমাকে সাহায্য করো। ব্যাংকে পনেরো ডলার জমিয়েছি আমি, তোমাদের দেবো। এর। বেশি দিতে পারবো না, নেই আমার কাছে। আমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করে দাও, প্লীজ!।

চোখ মিটমিট করলো কিশোর, চিন্তিত। রবিন আর মুসার চোখে শূন্য দৃষ্টি। না জেনেশুনে ভালোমতো সাক্ষী-প্রমাণ না নিয়ে কি আর একটা লোককে জেলে ঢুকিয়েছে পুলিশ?

কাজটা খুব কঠিন, টিম, বোঝানোর চেষ্টা করলো কিশোর। তবু, সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।

কঠিন, সে-তো, জানিই। সহজ হলে কি আর গোয়েন্দার সাহায্য লাগতো?

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। আচ্ছা, একটা কথা বলো তো, ছবিগুলো তোমাদের রান্নাঘরে গেল কি করে?

বলতে পারবো না। মিস্টার রোজারের কাছে অনেকে আসতো। তাদের কেউ রেখে যেতে পারে। কিংবা বাবার কোনো শত্রু।

দরজায় তালা লাগানো থাকতো না? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

থাকলেই বা কি? পুরনো দরজা, পুরনো তালা। সহজেই খোলা যায়। তাছাড়া এমন দামী কিছু থাকে না রান্নাঘরে, যে সাবধান থাকবো।

হুমম্। নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটেই চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান।

মিস্টার রোজারই চুরি করেননি তো? মুসা বললো। চুরি করে এনে হয়তো তোমাদের রান্নাঘরে লুকিয়েছিলেন। ওটাই সহজ জায়গা।

টিম জবাব দেয়ার আগেই কিশোর বললো, মিস্টার রোজারকে সন্দেহ করেছিলো পুলিশ?

মাথা নাড়লো টিম। মিস্টার রোজার ওরকম কাজ করতেই পারেন না। আমাদের পছন্দ করতেন। তাছাড়া, ছবিগুলো যেরাতে চুরি হয়েছে, সেরাতে ঘরে ছিলেন তিনি।

কিছু মনে কোরো না, বললো কিশোর। গোয়েন্দাগিরিতে কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম। একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগছে আমার।

অদ্ভুত? রবিন ফিরে তাকালো।

তদন্ত শুরু করলাম চেঁচানো ঘড়ির। এখন দেখছি ছবি চুরির কেস। কি যেন একটা যোগাযোগ রয়েছে।

তা কি করে হয়? প্রশ্ন তুললো মুসা।

বুঝতে পারছি না। টিম, মিস্টার রোজারের কথা সব খুলে বলবে? রবিন, নোট নাও।

বেশি কিছু জানাতে পারলো না টিম। বেঁটে, মোটা, হাসিখুশি মানুষ মিস্টার রোজার। অনেক টাকার মালিক। ডেলটনদের ধারণা বছর কয়েক আগে হঠাৎ ওগুলো কারও কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন রোজার। অনেক লোক যাতায়াত করতো তার কাছে। ওদেরকে দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয়নি, একসময় অভিনেতা ছিলেন রোজার, কিংবা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি সেকথা কখনও ডেলটনদের বলেননি।

টিমের বাবা চোর, একথা রোজারও মানতে পারেননি। নিজের খরচে উকিল রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না ডেলটনকে। এতেই বোধহয় মন খারাপ হয়ে যায় তার। বেকার ডেলটন জেলে যাওয়ার পর পরই বিদেশে চলে গেলেন তিনি। বলে গেলেন, হাওয়া বদলাতে যাচ্ছেন। বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন টিমের মায়ের ওপর।

সঙ্গে শুধু দুটো সুটকেস নিয়ে সেই যে গেছেন রোজার, গেছেনই, আর কোনো খোঁজ নেই তার। একটা চিঠিও লেখেননি। যাওয়ার পর কিছুদিন বন্ধুরা এসেছে। দেখা করতে, না পেয়ে ফিরে গেছে। ওদের আসাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন।

টিমের মাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন রোজার। এক সময় শেষ হয়ে গেল সেই টাকা। ঠিক এই সময় ভাড়া বাড়ির খোঁজে এসে হাজির হলো লারমার। টাকা নেই, খাবে কি? অগত্যা লারমারকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিলো মিসেস ডেলটন। লারমারের শর্ত, তাকে নিরিবিলিতে থাকতে দিতে হবে, আর কোনোরকম হৈ-চৈ করা চলবে না বাড়িতে।

ব্যস, এইই জানি, টিম বললো। কিছুক্ষণ উসখুস করলো সে। তারপর বললো, দেখো, শুরুতে তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, কিছু মনে রেখো না। ফোনে মা যখন তোমাদের সঙ্গে কথা বলছিলো, তখন আমিই ঘড়িটার চিৎকার চালু করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, খবরের কাগজের লোক ওদের দেখতে পারি না আমি। কাজের কাজ কিছু করতে পারে না, খালি…যাক ওসব কথা। তোমরা কিছু মনে রেখো না। আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।

পারছি, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। তোমার সমস্যাটা নিয়ে ভাববো। কিছু বুঝতে পারলে, জানাবো।

টিমকে গুডবাই জানালো তিন গোয়েন্দা। গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল টিম।

আবার এঞ্জিন স্টার্ট দিলো হ্যানসন। কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার ক্রিস্টোফারের ওখানেই যাবো?

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা কাত করলো কিশোর। যান। ওখানেই তো যেতে চাইছিলাম আমরা। এখন তো যাওয়াই দরকার। রোজার অভিনেতা হলে হয়তো তাকে চিনতে পারবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।

কয়েক মিনিটেই প্যাসিফিক স্টুডিওর গেটে পৌঁছে গেল গাড়ি। আরও কয়েক মিনিট পর বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা।

এই যে, ছেলেরা, বিশাল ডেস্কের ওপর থেকে বললেন পরিচালক। হঠাৎ? নতুন কোনো কেস?

হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বললো। গোলমেলে ঘড়ির তদন্ত শুরু করেছিলাম…

প্রথম দুটো শব্দ বাংলা বলেছে কিশোর, বুঝতে পারলেন না পরিচালক। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের তদন্ত বললে?

গোলমেলে ঘড়ি, স্যার। স্ক্রীমিং ক্লক।

কীই! স্ক্রীমিং ক্লক! ভুরু আরও কুঁচকে গেছে তাঁর, রীতিমতো অবাক হয়েছেন। অনেক বছর কোনো খোঁজ নেই। কি হয়েছিলো তার?

.

০৭.

তার? বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। স্ক্রীমিং ক্লক নামে কোনো মানুষ আছে?

ওটা তার ডাকনাম, জানালেন পরিচালক। ওর আসল নাম হ্যারিসন ক্লক। চেঁচাতো তো, সেজন্যেই লোকে নাম রেখেছিলো স্ক্রীমিং ক্লক। স্ক্রীমার ছিলো সে।

স্ক্রীমার? বুঝতে পারছে না কিশোর।

কিশোর পাশাও তাহলে অনেক কিছু জানে না, মুচকি হাসলেন পরিচালক। চেঁচানোকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলো হ্যারি। রহস্যময় কণ্ঠে বললেন তিনি।

বুঝিয়ে বলবেন, স্যার, প্লীজ!

অনেক বছর আগে, টেলিভিশন তখনও এতো উন্নত হয়নি। রেডিওর চলই ছিলো বেশি। রেডিওতে তখন নাটক শুনতো লোকে। রহস্য গল্প নিয়েও নাটক হতো। লোকে পছন্দও করতে খুব। একবার তো মনে আছে আমার, শুধু রহস্য গল্প নিয়েই এক হপ্তায় হয়েছিলো পঁয়তিরিশটা নাটক। আজকাল টেলিভিশনে যেমন উপভোগ করো তোমরা, আমরা করতাম রেডিওতে শুনে। রোমাঞ্চিত হতাম।

সে-সব নাটকে কণ্ঠ দিতে হতো অনেককে। বিশেষ সাউণ্ড ইফেক্টের জন্যে চেঁচানোর দরকার পড়তো। শুনে যতো সহজ মনে হচ্ছে, কাজটা মোটেও ততো সহজ নয়। এটাও একটা আর্ট। এর জন্যে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা সব কিছুরই প্রয়োজন আছে। খুব ভালো শিল্পী ছিলো হ্যারি। পরিচালকদের কাছে তাই তার কদরও ছিলো খুব।

আমার দুটো ছবিতে তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছি আমি। চিৎকারে তার জুড়ি নেই। শিশু, মহিলা, পুরুষের কণ্ঠ তো বটেই, নানারকম জন্তুজানোয়ারের ডাকও সে নিখুঁত নকল করতে পারে।

সময় বদলালো। টেলিভিশন জনপ্রিয় হলো। রেডিওর কদর আর রইলো না। ফলে হ্যারিসন ক্লকের মতো লোকদের দামও কমতে লাগলো। বছর কয়েক আগে। আমার দুটো ছবিতে কাজ করার পর গায়েব হয়ে গেল হ্যারি। আর কোনো খোঁজ পাইনি। তার ব্যাপারেই তদন্ত করছো?

কি জানি, হতেও পারে, বললো কিশোর। তবে আপাতত একটা স্ক্রীমিং ক্লকের তদন্ত করছি আমরা। ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে টেবিলে রাখলো সে। ওটা হাতে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে, খুলে বললো।

আশ্চর্য! গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালেন পরিচালক

শুনে তো হ্যারিসন ক্লকের মতোই লাগছে, রোজারকে। ক্লক বেঁটে ছিলো। হালকা-পাতলা। রোজার বেঁটে, মোটা। তবে পাতলা মানুষ মোটা হতে সময় লাগে না। আরেকটা ব্যাপার, রেডিওতে আয় কমে গিয়েছিলো, কিন্তু শেষ দিকে কি করে যেন হঠাৎ বড়লোক হয়ে গিয়েছিলো হ্যারি। আনমনে প্রশ্ন করলেন নিজেকেই, কিন্তু নাম বদলাবে কেন?

পেইন্টিঙের ব্যাপারে কি তার আগ্রহ ছিলো, স্যার? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

জানি না। অনেক অভিনেতারই অবশ্য থাকে। ক্লকের ছিলো বলে শুনিনি।

থ্যাংক ইউ, স্যার, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। অন্য দুজনও উঠলো। অনেক, মূল্যবান তথ্য জানালেন। এসব নিয়ে ভাবতে হবে।

পরিচালকের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো ওরা।

রকি বীচে, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে ওদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। হ্যানসন।

গেটের ভেতরে ঢুকেই থমকে গেল কিশোর। পেছনে প্রায় তার গায়ের ওপর এসে পড়লো অন্য দুজন। কতগুলো আসবাবপত্রের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন মানুষ।

হাই, ছেলেরা, এগিয়ে এলো সে। চিনতে পারছো?

 পারছে। মাত্র ঘন্টাখানেক আগে ওকে দেখেছে রোজারের বাড়িতে।

একটা ঘড়ি আছে তোমার কাছে, কিশোরের দিকে চেয়ে বললো লারমার। ওটা আমার জিনিস।

হাতের ব্যাগটা পেছনে নিয়ে গেল কিশোর।

লাফিয়ে এগিয়ে এলো লারমার। আমার জিনিস আমাকে দিচ্ছো না কেন? জলদি দাও। নইলে…

কিশোর আর লারমারের মাঝে এসে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেল মুসা। কিছুই করতে পারবেন না আপনি, মিস্টার। ওটা আপনার জিনিস হলে নিশ্চয়ই দেবো। কিন্তু প্রমাণ করতে হবে…।

এক ধাক্কায় মুসাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো লোকটা। গায়ে মোষের। জোর, এতোটা আশা করেনি গোয়েন্দা-সহকারী। ইদানীং কারাত শিখছে সে, সেই ভরসায়ই সামনে এসেছিলো। হাল ছাড়লো না। কিশোরের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালালো লারমার। জাপানী জুজিৎসুর কায়দায় তার কব্জি চেপে। ধরলো মুসা।

সেই একই কায়দায় চোখের পলকে হাত ছাড়িয়ে নিলো লারমার। বুঝতেই পারলো না মুসা, কখন ঘুরে গেছে সে, তার পিঠ এখন লোকটার দিকে। শার্টের কলার ধরে তুলে তাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো লারমার। আবার কিশোরের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিতে গেল।

এই মিস্টার! মস্ত থাবা পড়লো লারমারের কাঁধে, যেন ভালুকের থাবা। তিন। গোয়েন্দাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান, বোরিস। হচ্ছে কী?

ফিরে তাকালো লারমার। আমার জিনিস চুরি করেছে। ওটা ফেরত চাই।

ব্যাগ ছাড়ুন, শান্ত কণ্ঠে বললো বোরিস।

তোমার কথায়, না? ভালুক কোথাকার! বলেই ধাঁ করে হাত চালালো বোরিসের গলা সই করে, কারাতের কায়দায়।

গলাটা সরিয়ে নিলো শুধু বোরিস। কারাত-ফারাতের ধার দিয়েও গেল না। লারমারের হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে আরও কাছে নিয়ে এলো। তারপর দুহাতে ধরে তাকে তুলে নিলো মাথার ওপর, টারজানের মতো। জনি ওয়াইসমুলারকে বোরিসের খুব পছন্দ, সুযোগ পেলেই তাঁকে অনুকরণের চেষ্টা করে। কিশোর, কি করবো ব্যাটাকে? আছাড় মেরে কোমর ভাঙবো, না পুলিশ ডাকবে?

না, ওসব কিছু না, দ্রুত ভাবনা চলেছে গোয়েন্দাপ্রধানের মাথায়। পুলিশকে ডেকে এনে উন্মেও হতে পারে, হয়তো লারমার প্রমাণ করে দেবে ঘড়িটা তারই। তাহলে জটিল একটা রহস্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। মাপ করে দিন ওকে।

লারমারকে বুকের কাছে নামিয়ে এনে হাত থেকে ছেড়ে দিলো বোরিস। গমের বস্তার মতো দড়াম করে মাটিতে পড়লো লোকটা। কোমরে হাত দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। মুসার গা-জ্বালানো হি-হি হাসি উপেক্ষা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, বেশ, দেখে নেবো আমি!….

হাত বাড়ালো বোরিস। তাহলে হয়ে যাক না এখুনি আরেকবার…

ঝট করে পিছিয়ে গেল লারমার। কিশোরের দিকে ফিরলো। পস্তাবে, মনে রেখো! আমি…আমি… কথা শেষ না করেই গটমট করে হেঁটে চলে গেল সে।

.

০৮.

পরদিন হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসলো তিন গোয়েন্দা। টিমও রয়েছে।

সকালে লারমার চলে যাওয়ার পর টিমকে ফোন করেছিলো কিশোর। কথায় কথায় জেনেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তার, পুরনো একটা গাড়িও আছে। গাড়িটা তার বাবার। চাইলে ওটা কাজে লাগাতে পারে তিন গোয়েন্দা। গাড়ি নিয়ে। ওকে আসতে বলেছিলো সে।

তারপর, রবিন; তোমার খবর বলো, সামনে ঝুঁকলো কিশোর।

লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা বড় খবরের কাগজে কাজ করেন রবিনের বাবা। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলো সে, রেকর্ড রুমে পুরনো কাগজ ঘেঁটে দেখার জন্যে, অবশ্যই কিশোরের পরামর্শে। পকেট থেকে কয়েক পাতা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলে টেবিলে বিছালো রবিন।

টিমের বাবা বেকার ডেলটনের সম্পর্কে নতুন তেমন কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছে। দশ বছর ধরে হলিউড আর লস অ্যাঞ্জেলেসে যতো ছবি চুরি হয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে ডেলটন জড়িত ছিলো, একথা, তার মুখ দিয়ে বের করাতে চেয়েছে। কিন্তু বেকার ডেলটনের এক কথাঃ সে চোর নয়। ছবির ব্যাপারে কিছুই বোঝে না। এসব কথা সঙ্গীদের জানিয়ে টিমের দিকে ফিরলো রবিন। জিজ্ঞেস করলো, তোমরা স্যান ফ্রান্সিসকোয় থাকতেই অনেকগুলো চুরি হয়েছে, তাই না?

হ্যাঁ। ছয় বছর আগে হলিউডে এসেছি আমরা। চুরি হচ্ছে আরও বছর চারেক আগে থেকেই। এতেই বোঝা যায়, আমার বাবা নির্দোষ।

চুরিগুলো একটা দলই করছে কিনা সেটা বুঝতে হবে আগে, কিশোর বললো। রবিন, দশ বছরে কটা ছবি চুরি হয়েছে?

বেশি দামী ছবি মোট বারোটা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জানালা কিংবা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে চোর, ফ্রেম থেকে কেটে ছবি বের করে নিয়ে চলে গেছে। পুলিশের ধারণা, ওগুলো ধনী দক্ষিণ আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। লুকিয়ে রাখবে ওরা, কাউকে দেখাবে না। জেনেশুনেই চোর ও-ধরনের লোকের কাছে বিক্রি করেছে।

যাতে কেউ কখনও খুঁজে না পায় ওগুলো?

হ্যাঁ। টিমদের রান্নাঘরেরগুলোও নিখোঁজ হততা, সময় মতো পুলিশ ওখানে না। গেলে।

দাম কেমন হবে বারোটা ছবির?

সঠিক বলা যাবে না। ছবি বিশেষজ্ঞদের আন্দাজ, নীলামে এক কোটি ডলারে উঠতে পারে।

খাইছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। এত দাম!

মাথা ঝাঁকালো রবিন।

এখন প্রশ্ন হলো, টিমদের রান্নাঘরে এলো কিভাবে তিনটে ছবি? বললো কিশোর। প্রশ্ন অবশ্য আরও আছে। কে চুরি করেছে? মিস্টার রোজার ওরফে ক্লক হাওয়া বদল করতে গিয়ে কেন গায়েব হয়ে গেলেন? আর এটাই বা কোত্থেকে এলো? টেবিলে রাখা ঘড়িটা ছুঁলো সে। কোনো না কোনোভাবে এটার মূল্য আছে। নইলে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে খেপে যেতো না লারমার।

ওকে বলাটাই আমার অন্যায় হয়েছে, কোলের ওপর রাখা দুই হাতের দিকে তাকিয়ে বললো টিম। মুখ তুললো। কি করবো, বলো? এমনভাবে শাসাতে লাগলো মাকে…তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করলো। শেষে বলতে বাধ্য হলাম, একটা ঘড়ি এনেছো তোমরা। কার্ডটা দেখাতেই আর দেরি করলো না। ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছুটলো।

ভাগ্যিস তখন ইয়ার্ডে ছিলো বোরিস। আচ্ছা, টিম, লারমার যে তোমাদের বাড়িতে থাকে, সন্দেহজনক আচরণ কিছু করে-টরে?

মাঝে মাঝে রাতে উঠে বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়! মা কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। জবাব দিয়েছে, সে লেখক। রাতে প্রটের কথা ভাবতে ভাবতে মাথ গরম হয়ে যায়, বাইরে বেরিয়ে ঠাণ্ডা করে। এক রাতে শুনলাম, দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিচ্ছে। গিয়ে দেখলাম। মনে হলো, কিছু খুঁজছে।

হুমম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। একটা সন্দেহ জাগছে, তবে ভুলও হতে পারে। যাকগে, ওসব পরে। আগের কাজ আগে। বুঝতে পারছি না, পুলিশ যে চুরির সমাধান করতে পারেনি, সেটা আমরা কি করে করবো? ঘড়ি ধরেই এগিয়ে দেখা যাক।

তাতে আমার কি লাভ হবে? হাত নাড়লো টিম। বাবা রয়েছে জেলে, আর তোমরা করতে চাইছে ঘড়ির তদন্ত…

কোনোখান থেকে শুরু করতে হবে তো? অনেকগুলো রহস্য জমা হয়েছে।– আমার বিশ্বাস, ঘড়িটার সঙ্গে ওগুলোর কোনো যোগাযোগ আছে।

বেশ, খুশি হতে পারছে না টিম, করো। কিন্তু কি করে বুঝবে ওটা কোত্থেকে এসেছে?

তলায় একটা কাগজ লাগানো ছিলো, মেসেজ। ড্রয়ার খুলে একটা গোপন কুঠুরি থেকে ছোট কাগজটা বের করলো কিশোর। জোরে জোরে পড়ে শোনালো টিমকে।

কাদের নাম? মুসার প্রশ্ন। কারা ওরা? কি করে খুঁজে বের করবো? আর যদি পাই-ই, কি কথা জিজ্ঞেস করবো ওদের?

দাঁড়াও। এক আঙুল তুললো কিশোর, একবারে একটা প্রশ্ন। মিলারের কাছে লেখা হয়েছে মেসেজটা। আগে তার ঠিকানা বের করা যাক।

কিভাবে?

ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। ভাবলেই বুঝতে পারবে। মিলার নিশ্চয় রোজারের বন্ধু, নইলে তার কাছে লিখতো না। হাত বাড়ালো কিশোর, টিম, অ্যাড্রেসবুক পেয়েছো?

না। অনেক খুঁজেছি। একটা লিস্ট পেয়েছি শুধু, ড্রয়ারে অনেক কাগজের মধ্যে গোঁজা। ওদেরকে ক্রিস্টমাস কার্ড পাঠিয়েছিলেন মিস্টার রোজার। এই যে।

ভাঁজ করা কাগজটা খুলে টেবিলে বিছিয়ে হাত দিয়ে ডলে সমান করলো কিশোর। গুড। মনে হচ্ছে এতেই চলবে। অনেক নাম-ঠিকানা আছে।

নাম আর ঠিকানাগুলো পরিষ্কার ভাবে টাইপ করা রয়েছে কাগজটায়। হেনরি মিলার একজনই পাওয়া গেল। জেনি রোবিডও একজন, উত্তর হলিউডের ঠিকানা। তবে বারকেন দুজন, একজন জেসিয়াস বারকেন, আরেকজন হিরাম বারকেন। দুজনেই প্যাসাডোনার কাছে থাকেন। জেলড়াও দুজন–জেলডা ডেনমার আর জেলডা ট্রিক্সটার। দুজন থাকেন দুই জায়গায়।

নামগুলোর পাশে টিক চিহ্ন দিলো কিশোর। বললো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবাই। দুদলে ভাগ হয়ে দেখা করতে যাবো আমরা। রবিন, তুমি টিমের সঙ্গে যাবে। মিলার আর মিস রোবিডকে খুঁজে বের করবে। একই দিকে থাকে দুজনে, সুবিধে হবে তোমাদের। রোলস রয়েসটা নিয়ে আমি আর মুসা যাবো অন্য দুজনকে খুঁজতে। ঠিক আছে?

কিন্তু দেখা হলে কি জিজ্ঞেস করবো?

মিলারকে জিজ্ঞেস করবে, মিস্টার ক্লক ঘড়িটা তার কাছে পাঠিয়েছিলেন কিনা? আর নিচে লাগানো মেসেজটা দেখেছেন কিনা। ঘড়িটা বরং নিয়ে যাও সাথে করে। দেখালে হয়তো সহজে চিনতে পারবেন উনি।

বেশ, নিলাম। আর মিস রোবিডকে?

তার কাছে রোজার কোনো মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। বলবে, মেসেজটা তোমাকে জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ক্লক। প্রয়োজন হলে ঘড়িটা মিস রোবিডকেও দেখাবে।

তা নাহয় দেখালাম। কিন্তু তুমি? তোমার ঘড়ি দরকার হবে না?

অবিকল এক রকম দেখতে আরেকটা ঘড়ি নিয়ে যাবো আমি। এমনও হতে পারে দেখানোর দরকারই হবে না। তবু, বলা যায় না। ওরকম ঘড়ি আরেকটা জোগাড় করে রেখেছি আমি।

এখুনি রওনা হবো?

তোমাদের গাড়ি আছে। চলে যেতে পারো। আমাদের বসতে হবে। হ্যানসন। গাড়ি নিয়ে এলে, তারপর…

কিশোর, হাত তুললো মুসা। একটা খুব জরুরী কথা ভুলে বসে আছে। এখুনি রওনা হতে পারি না আমরা।

কেন? অবাক হলো কিশোর।

কারণ, গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো মুসা, এখন লাঞ্চের সময়।

.

০৯.

এখানেই কোথাও হবে, মোড়ে মোড়ে লাগানো রোড-নম্বরগুলো দেখছে রবিন। হ্যাঁ, ওই যে, মিস্টার মিলার ওই গলিতেই থাকেন।

পথের মোড়ে পুরনো সেডান গাড়িটা পার্ক করলো টিম। দুজনেই নামলো গাড়ি থেকে।

 বাপরে, বিরাট বড়লোক, পাথর বসানো ড্রাইভওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো টিম। বাড়ি দেখেছো কত বড়!

মাথা ঝাঁকালো রবিন। হাতে ব্যাগ। বেল বাজাতে গিয়ে অবাক হয়ে ভাবলো রবিন, এই বাড়ি থেকেই ঘড়িটা বেরিয়েছে?

দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। ভুরু কুঁচকে তাকালো ওদের দিকে। মাঝবয়েসী, মনে হচ্ছে, কোনো কারণে উত্তেজিত হয়ে আছে। কি চাই? কড়া গলায় বললেন। চাঁদা? কবার দেবো?

না, ম্যাডাম, ভদ্র কণ্ঠে বললো রবিন, চাঁদা চাইতে আসিনি। মিস্টার মিলারের সঙ্গে দেখা করতে চাই, প্লীজ।

হবে না। উনি অসুস্থ। কয়েক মাস হলো হাসপাতালে রয়েছেন।

ওহ, সরি। তাই নাকি? দ্রুত ভাবছে রবিন। মিস্টার মিলার যদি কয়েক মাস ধরে হাসপাতালেই থেকে থাকেন, তিনি নিশ্চয় ঘড়িটা ফেলেননি। জিজ্ঞেস করলো, তার পুরো নাম কি হেনরি মিলার?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবিনকে দেখছেন মহিলা। বোধহয় আন্দাজ করতে চাইছেন, ছেলেটা ভালো না মন্দ–মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবেন কিনা। ভালোই মনে হলো হয়তো, তাই জবাব দিলেন, হ্যাঁ। কেন? কোনো রকম…

না না, কোনো রকম অসৎ উদ্দেশ্য নেই আমাদের, তাড়াতাড়ি বললো রবিন। মিসেস মিলার। আপনিই নিশ্চয় মিসেস মিলার। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, একটা ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছি আমরা। ব্যাগ থেকে ঘড়ি খুলে দেখালো। এই যে, এটা।

আবার ওটা! চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা। ওরকম বিচ্ছিরি একটা জিনিস আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়েছে। ভাবো একবার, তার অসুখের সময়। ভাগ্যিস চিৎকার শোনেনি। তাহলে নির্ঘাত হার্টফেল করতো। আমি সুস্থ মানুষ, আমিই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম আরেকটু হলে!

চকিতে দৃষ্টি বিনিময় করলো রবিন আর টিম। ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

 নিশ্চয় মিস্টার ক্লক পাঠিয়েছেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

হ্যারিসন ক্লক! ও আবার ভদ্রলোক নাকি? ভেবে দেখো, অসুস্থ একজন মানুষকে ওরকম উপহার পাঠায়? কিসের সুবাদে? না, ওরা একসঙ্গে কাজ করতো একসময়। আমার স্বামী রেডিওর জন্যে রহস্য নাটক লিখতো। ঘড়িটা পেয়ে প্রথমে কিছু মনে করিনি! কিন্তু প্রাগ লাগিয়ে চিৎকার শুনে…ও মাগো! শিউরে উঠলেন মিসেস মিলার। সোজা নিয়ে গিয়ে ময়লার বাক্সে ফেলে দিয়ে এলাম। তোমরা ওখান থেকে কুড়িয়ে এনেছো নাকি?

না। এক বাতিল মালের দোকান থেকে কেনা হয়েছে। নিচে একটা মেসেজ ছিলো, দেখেছেন?

মেসেজ? নূকুটি করলেন মহিলা। না, দেখিনি। পাওয়ার পরদিনই ফেলে দিয়েছি। ঘড়িটার সঙ্গে ছোট একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলো। ওটাও ফেলে দিয়েছি।

কি লেখা ছিলো মনে আছে? ব্যাপারটা জরুরী।

ছিলো?…ছিলো, ঘড়িটা কাজে লাগালে নাকি অনেক টাকার মাল পাবে। মাথামুণ্ড কিছু বুঝিনি। রসিকতার আর সময় পেলো না লোকটা। এদিকে আমার। স্বামী হাসপাতালে মরে, টাকার অভাব, এই সময় কোনো ভালো মানুষ ওসব কথা লেখে? বুঝলাম না, এভাবে আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়ে কি আনন্দ সে পেতে চেয়েছে। থেমে আবার ভ্রূকুটি করলেন মিসেস মিলার। কিন্তু তোমার এসব জানার কি দরকার? ঘড়ি নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেন?

দরকার আছে, ম্যাডাম। মিস্টার ক্লক নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে। হয়তো এই ঘড়িতেই রয়েছে সূত্র। কোত্থেকে ওটা পাঠানো হয়েছে, কিছু বুঝতে পেরেছেন?

না। অবাকই লেগেছে। হ্যারিসন ক্লক যে নিখোঁজ হয়েছে, খবরটা আমিও শুনেছি। ভাবছি…এহহে ফোন বাজছে। যাই। যা যা জানি, সব বলেছি তোমাদেরকে। গুডবাই, বয়েজ।

দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

টিমের দিকে ঘুরলো রবিন। হও আরও গোয়েন্দা! ভিখিরির মতো বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে..যত্তোসব! তিক্ত কণ্ঠে বললো সে। তেমন কিছু জানাও গেল না। শুধু জানলাম, মিস্টার ক্লক ঘড়িটা পাঠিয়েছিলো। ওটা অসুস্থ মিলারের হাতে পড়েনি। মিসেস মিলার পেয়ে ফেলে দিয়েছেন। মেসেজের মানে বুঝলাম না।

এই, গোয়েন্দাগিরিতে মজা পাচ্ছে টিম, অপমান গায়েই মাখেনি, এখানে। দাঁড়িয়ে না থেকে, চলো না মিস জেনি রোবিডের ওখানে যাই। তিনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।

কিন্তু মিস রোবিডও বিশেষ কিছু জানাতে পারলেন না। উত্তর হলিউডের উডল্যাণ্ড হিল-এ ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন তিনি। নানা রকম গাছের ঝোপ আর ঘন কলা ঝাড়ের ওপাশে কটেজটা খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলো ওদের। হালকা-পাতলা মানুষ। রবিনের মনে হলো, কথা বলার সময় পাখির মতো কিচিরমিচির করেন। ধূসর চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পোশাক-আশাকে মনে হয় এইমাত্র বেরিয়ে এলেন রূপকথার জগত থেকে।

দুজনকে আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসালেন লিভিং-রুমে! সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন আর সুদৃশ্য কুশনে বোঝাই ঘরটা দেখে রবিনের মনে হলো, এখানে কিছু রাখলে জীবনেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবিনের প্রশ্ন শুনেই চশমা কপালের ওপর ঠেলে তুলে দিয়ে ডেস্কের ভেতর খুঁজতে শুরু করলেন তিনি, আর পাখি-কণ্ঠে একনাগারে কিচির-মিচির করে চললেন, ভাবতেই পারিনি ওটার জন্যে কেউ আসবে। মেসেজটা নিতে। আমি ভেবেছি রসিকতা, মিস্টার কুকের রসিকতা। খুব রসিক লোক, স্টুডিওতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। আমিও তখন। রেডিওতে কাজ করতাম। একদিন গায়েব হয়ে গেল ক্লক। আর কোনো হদিস পেলাম না। তারপর হঠাৎ ওই চিঠি। সঙ্গে আরেকটা ছোট, কাগজ, মেসেজ। চিঠিতে বলেছে, কেউ মেসেজ নিতে এলে যেন দিয়ে দেয়া হয়। অবশ্যই, যদি ঘড়ির কথা বলে। আরে, রাখলাম কোথায়? চশমাটাও তো পাচ্ছি না। দেখবো কিভাবে?

চশমা কোথায় আছে, বললো রবিন। তাড়াতাড়ি আবার ওটা নাকের ওপর। টেনে নামালেন মিস রোবিড়। ড্রয়ারের ছোট একটা খোপে ঢুকে গেল হাত, বেরিয়ে আসতে দেখা গেল দুআঙুলে ধরে রেখেছেন একটা খাম। এই যে। আমি জানি ওখানে রেখেছি। যাবে কোথায়? এই তো, পেলাম। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, হ্যারিসন ক্লকের কথা। রসিক লোক ছিলো। ভালো লোক। আমার বন্ধু। কিন্তু ওর কণ্ঠ নিশ্চয় রেডিওতে শোনোনি তোমরা?

না, ম্যাডাম, শুনিনি। তবে রসিকতা নিয়েই তদন্ত করছি আমরা। জানতে চাই, তিনি কি বলতে চেয়েছেন। মেসেজটার জন্যে অনেক, অনেক ধন্যবাদ।

আরে না না, এর জন্যে আবার ধন্যবাদ কেন? যখন খুশি চলে আসবে। তোমরা, আমার সাধ্যমতো সাহায্য করবো। হাজার হোক, ক্লকের রসিকতা নিয়ে। গবেষণা করছো। ওর সঙ্গে দেখা হলে আমার কথা বোলো। যা দারুণ চিৎকার। করতে পারতো না.ও! ওর চিৎকার শোনার জন্যে লোকে সব কাজ বাদ দিয়ে। রেডিওর সামনে বসে থাকতো। একটা নাটকের কথা তো বিশেষভাবে মনে আছে। হেনরি মিলারের আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট গল্পের ওপর ভিত্তি করে। কি চমৎকার ভয় যে পাওয়াত না, কি বলবো! আর মিলারও লেখক বটে! ধাঁধা, সূত্র, রহস্যে তার জুড়ি নেই। খুউব বুদ্ধি। ওহহো, ভুলেই গিয়েছি। তোমাদেরকে চা খেতেই তো বললাম না? খাবে না? আচ্ছা, ঠিক আছে, আরেক সময় এলে খেও। যাবে? তাড়াহুড়ো বেশি? বেশ, যাও। বাচ্চাদের স্বভাবই ওরকম। সব কিছুতেই তাড়া।

বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়লো দুই কিশোর।

মেরে ফেলেছিলো আরেকটু হলে। গাড়িতে উঠে হাসলো টিম। এতো বকতে পারে! থামে না। তবে কাজ হয়েছে। কি লেখা আছে মেসেজে, দেখি?

খাম খুলে একটা কাগজের টুকরো বের করলো রবিন। আগ্রহে ঝুঁকে এলো। টিম। হাঁ করে তাকিয়ে আছে দুজনে।

লেখা রয়েছেঃ

ইটস কোয়ায়েট দেয়ার ঈভ ইন আ রিকেন।
জাস্ট আ ওয়ার্ড অভ অ্যাডভাইস, পোলাইটলি গিভেন।
ওল্ড ইংলিশ বোম্যান লাভড ইট।
বিগার দ্যান আ রেইনড্রপ; স্মলার দ্যান অ্যান ওশন।
আয়্যাম ফোর। হাউ ওল্ড আর ইউ?
ইট সিটস অন আ শেলফ লাইক আ ওয়েল-ফেড-এলফ।

সর্বনাশ! মগজ ঘোলা করে দেবে! গুঙিয়ে উঠলো টিম। মানে কি এগুলোর?

.

১০.

প্যাসাডেনায় গিয়ে সঠিক জেলডাকে খুঁজে বের করলো কিশোর আর মুসা। তিনি জেলডা ডেনমোর। ভীষণ মোটা। মুসার মনে হলো, পাকা একটা মিষ্টি কুমড়ো। রেডিওতে কাজ করতেন, এখন অবসর নিয়েছেন।

বেড়াল পোষেন মিসেস ডেনমোর, অনেক বেড়াল। সব সিয়ামিজ। ছেলেদের যেখানে বসালেন, সারা ঘরেই বেড়াল গিজগিজ করছে। তার চেয়ারের দুই হাতায় বসেছে দুটো, দুটোর গায়েই হাত বুলিয়ে আদর করছেন তিনি।

কিশোরের প্রশ্নের জবাবে বললেন, হ্যাঁ, চিনি তাকে। তাহলে তোমাদেরকেই মেসেজটা দিতে অনুরোধ করেছে?

মিস্টার ক্লক মেসেজ পাঠিয়েছেন? এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর। কখন?

হপ্তা দুই আগে। সঙ্গে একটা চিঠি। লিখেছে, কেউ নিতে এলে যেন তাকে দিয়ে দিই। সামনে থেকে একটা বেড়াল সরিয়ে ড্রয়ার খুললেন মিসেস, ডেনমোর, খাম বের করে দিলেন কিশোরের হাতে। কি করছে এখন ক্লক? ওর সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। রেডিও থেকে কাজ চলে যাওয়ার আগে বেশ টাকার টানাটানিতে পড়েছিলো বেচারা। নতুন কোনো কাজও পাচ্ছিলো না। রেডিও জনপ্রিয়তা হারানোতে অনেক স্ক্রীমারই পথে বসলো।

তার সম্পর্কে আমরাও খুব একটা জানি না। কয়েক মাস আগে কোথায় যেন। চলে গেছেন।

অন্য কেউ হলে অবাক হতাম। তবে ব্লকের পক্ষে সবই সম্ভব। আজব লোক। কখন যে কি ভাবে, কি করে বসে, ঠিকঠিকানা নেই। নানা পেশার লোকের সঙ্গে পরিচয় ছিলো তার, ঘনিষ্ঠতা ছিলো। চোর, ডাকাত, জুয়াড়ীরাও ছিলো তার বন্ধু।

তাই নাকি? থ্যাংক ইউ, মিসেস ডেনমোর। আজ তাহলে উঠি। মুসা, চলো যাই। আরও কাজ আছে।

 মহিলাকে তাঁর বেড়ালের পালের মধ্যে রেখে বেরিয়ে এলো দুই গোয়েন্দা। গাড়িতে অপেক্ষা করছে হ্যানসন।

মেসেজটা দেখি? হাত বাড়ালো মুসা।

 গাড়িতে চলো আগে।

গাড়িতে উঠে খাম খুললো কিশোর। ছোট এক টুকরো কাগজ বের করলো। কতগুলো নম্বর লেখা রয়েছে শুধু তাতে। এরকমঃ

৩-২৭৪-৩৬৫-১৯৪৮-১২৭-১১১৫-৯১০১-২৫-১৬ ৪৫-৩৭৯৮-৯৮২০-১৩৫৮৪-৯

আরও আছে নম্বর। সবই প্রথমগুলোর মতো অর্থহীন, প্রথম দৃষ্টিতে তা-ই মনে : হলো।

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। কি অঙ্ক?

অঙ্ক না. মাথা নাড়লো কিশোর। কোনো ধরনের সঙ্কেত। পরে চেষ্টা করবো। কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো সে। এখন বারকেনকে খুঁজে এক বের করা দরকার।

কোথায় যেতে হবে, বলা হলো হ্যানসনকে। ছুটে চললো রোলস রয়েস।

গম্ভীর হয়ে বসে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। নীরব।

মুসাও ভাবছে। ভাবছে, অগ্রগতি কি কিছু হয়েছে? এক মেসেজে তো রয়েছে দুর্বোধ্য সংখ্যা, আরেক মেসেজে কি আছে?

পুরনো একটা এলাকায় একটা বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামালো হ্যানসন। মুসা আর কিশোর নেমে হেঁটে এগোলো।

বেল বাজালো কিশোর।

দরজা খুলে দিলো একজন লোক। বড়জোর কিশোরের সমান লম্বা, তার মতোই পাতলা। দুই পায়ের মাঝে ফাঁক অনেক বেশি, দুদিকে ধনুকের মতো বেঁকে রয়েছে। কি চাই?

আচ্ছা, লোকটার কড়া দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো কিশোর। এটা কি মিস্টার জেসিয়াস বারকেনের বাড়ি?

কি দরকার তাকে?

জিজ্ঞেস করতাম, মিস্টার হ্যারিসন ক্লককে চেনেন কিনা।

ক্লক? কে বললো আমি তাকে চিনি? জীবনে ওই নামও শুনিনি। যাও, ভাগো।

এক মিনিট, বারকেন, পেছন থেকে বললো একটা ভদ্ৰ কণ্ঠ। দেখা দিলো লম্বা চেহারার এক লোক। চকচকে কালো চুল ব্যাকব্রাশ করা। কথায় স্প্যানিশ টান। ক্লককে খুঁজছো কেন? মুসা আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো। গোয়েন্দা নও তো? হাসলো।

সত্যি বলতে কি… আরম্ভ করেও কিশোরের কনুইয়ের গুতো খেয়ে থেমে গেল মুসা।

মিস্টার ক্লকের পাঠানো কয়েকটা মেসেজ খুঁজছি আমরা, বললো কিশোর। তার রেখে যাওয়া কয়েকটা ঠিকানা পেয়েছি। মিস্টার বারকেনের নামও আছে…

ইনটারেসটিং, বললো লম্বা লোকটা। এসো, ভেতরে এস। মনে হচ্ছে তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। আমার বন্ধুর হয়ে মাপ চেয়ে নিচ্ছি, বারকেনের কাঁধে হাত রেখে বললো।

দুজনকে অনুসরণ করে একটা অগোছালো লিভিং রুমে ঢুকলো কিশোর আর মুসা।

দেখো, মারকো, গোঁ গোঁ করে বললো বারকেন। আমার এসব ভাল্লাগছে। কি করছো, কিছুই বুঝতে পারছি না।

চুপ থাকো, ধমক দিলো মারকো। কিশোরের দিকে চেয়ে বললো, শোনো, ক্লক নিখোঁজ হওয়ায় আমরা খুব চিন্তায় আছি। বারকেনের কাছে আজব একটা মেসেজ নাকি পাঠিয়েছে। মনে হচ্ছে তোমরা ব্যাপারটা জানো। জানো, ক্লক কোথায়?

না, স্যার, জবাব দিলো কিশোর। তবে আমরা মেসেজগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি, এটা ঠিক। প্রথমে অদ্ভুত একটা ঘড়ি হাতে এলো:..

ঘড়ি? সঙ্গে আছে?

ব্যাগ খুলে নকল ঘড়িটা বের করলো কিশোর। এই যে, স্যার।

হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘড়িটা দেখলো মারকো। অতি সাধারণ। হ্যাঁ, এরার মেসেজের কথা বলো। কি কি জেনেছো?

মেসেজে জেলডা আর বারকেনকে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কি জিজ্ঞেস করতে হবে, বলেনি। জেল ডেনমোরকে খুঁজে বের করেছি আমরা, তার কাছে একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন মিস্টার ক্লক। সেখান থেকেই এলাম। ক্লকের ক্রিস্টমাস কার্ডে মিস্টার জেসিয়াস বারকেনের নাম-ঠিকানা দেখলাম তো। মিস্টার বারকেন, আমাদের জন্যে কোনো মেসেজ পাঠানো হয়েছে?

মেসেজ একটা পেয়েছে বটে, জবাবটা দিলো মারকো। সাথের চিঠিতে লিখেছে, ওটা ডেলিভারি দেয়ার আগে অন্য মেসেজগুলো যেন দেখে নেয়া হয়। দেখি তো, জেলডার মেসেজটা? হাত বাড়ালো সে।

কিন্তু… দ্বিধা করছে কিশোর। পকেট থেকে বের করলো সংখ্যা লেখা কাগজটা।

দেখলো মারকো। শুধুই তো নম্বর! হতাশ মনে হলো তাকে। কোড-টোড হতে পারে। মানে কি?

জানি না। আরেকটা মেসেজ দেখলে হয়তো বোঝা যাবে। মিস্টার বারকেনের মেসেজ।

হয়তো। বেশ, সব দায়িত্ব এখন আমার। এই ঘড়ি আর মেসেজগুলো তোমাদের জন্যে নয়, তোমাদের কাছে পাঠানো হয়নি। আর কোনো মেসেজ থাকলে দিয়ে দাও। আমিই সব সামলাবো।

আর নেই, সামান্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিশোরের চেহারা। লম্বা লোকটার হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না তার। দেখুন, ঘড়ি আর মেসেজ দিয়ে দিন, প্লীজ। ওগুলো আমাদের। আমরা তদন্ত…

চুপ! খেঁকিয়ে উঠলো মারকো। ডিংগো, ধরো ব্যাটাদের। দেখি, কোথায়। কি লুকিয়ে রেখেছে!

চোখের পলকে পেছন থেকে মুসার গলা জড়িয়ে ধরলো জেসিয়াস বারকেন ওরফে ডিংগো। বেঁটে, হাড্ডি সর্ব, রগ বের হওয়া প্যাকাটির মতো হাতে যে এতো জোর, ভাবতেও পারেনি গোয়েন্দা-সহকারী।

.

ঠিক ওই সময়, অনেক দূরে রবিন আর টিমও পড়েছে গোলমালে।

বাড়ি ফিরে চলেছে ওরা। রকি বীচের মাইলখানেক দূরে সান্তা মনিকা পর্বতের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। ওখানটায় এসে পেছনের গাড়িটা লক্ষ্য করলো রবিন। ঘন নীল শরীর, সাদা ছাত। দেখেছে আরও আগেই, গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটে আসছে।

 টিম! উত্তেজিত কণ্ঠে বললো রবিন। মনে হয় পিছু নিয়েছে। ধরতে আসছে এখন।

পারলে ধরুক, বলতে বলতেই গ্যাস প্যাডালে পায়ের চাপ বাড়িয়ে দিলো টিম।

লাফ দিয়ে আগে বাড়লো পুরনো গাড়িটা। শাঁ করে একটা মোড় পেরিয়ে তীব্র গতিতে নেমে চললো ঢালু পথ বেয়ে।

আবার পেছনে তাকালো রবিন। নীল গাড়িটাও গতি বাড়িয়েছে। দ্রুত কমছে দূরত্ব। ইতিমধ্যেই একশো গজের ভেতরে এসে গেছে।

প্যাডালে পায়ের চাপ আরও বাড়ালো টিম। মারাত্মক গতিবেগ। কিন্তু তার পরেও ছাড়াতে পারছে না নীল গাড়িটাকে, এগিয়েই আসছে, কমছে মাঝখানের ফাঁক।

আরেকটা তীক্ষ্ণ মোড় নিলো টিম। আরেকটু হলেই পথের ধার দিয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিলো সেডান। কোনোমতে সোজা করে আবার পথের ওপর নিয়ে এলো। ওটাকে। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। ভালোমতো চালাতে শিখিনি এখনও। আর যা রাস্তা খালি মোড়…নাহ, পারলাম না। ধরে ফেলবে।

হাল ছেড়ো না, সাহস দিলো রবিন। রকি বীচে ঢুকলে তখন আর আসতে। সাহস করবে না।

চেষ্টা করছি। সাইড দেবো না। আগে যেতে না পারলে থামাতে পারবে না আমাদের।

গতি কমিয়ে পথের মাঝ দিয়ে গাড়ি চালালো টিম।

ফিরে চেয়ে আছে রবিন। এদিক ওদিক সরে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে নীল গাড়িটা। স্টীয়ারিঙে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে পরিচিত লাগছে, কিন্তু চিনতে পারছে না।

নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। সামনে পথের ওপর একটা ছোট গর্ত দেখে এড়াতে গেল টিম, এই সুযোগে পাশে চলে এলো পেছনের গাড়িটা। সরতে সরতে সেডানটাকে নিয়ে এলো একেবারে পথের ধারে। আর সরার জায়গা। নেই। ধাক্কা লাগলেই এখন পড়ে যাবে খাদে।

থামতেই হবে! চেঁচিয়ে বললো টিম। কায়দা করে ফেলেছে হারামজাদা!

গ্যাস প্যাডাল থেকে পা সরিয়ে ব্রেক চাপলো সে। সেডানটা থামতে শুরু করতেই পাশের গাড়িটাও গতি কমালো।

কালো চশমা পরা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। চেনার চেষ্টা করছে। কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারলো না।

থেমে গেল সেডান। পাশে থামলো নীল গাড়ি। হঠাৎ আবার খেপা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে আগে বাড়লো, শাঁ শাঁ করে ছুটে হারিয়ে গেল পথের বাঁকে।

তাজ্জব কাণ্ড! অবাক হয়েছে টিম। পিছু নিলো, থামলো, এখন পালালো…

বুঝতে পারলো কারণটা। পেছনে শোনা যাচ্ছে সাইরেনের শব্দ। এগিয়ে। আসছে দ্রুত। কিছুক্ষণ পরে ঘ্যাঁচ করে এসে পাশে থামলো একটা পুলিশের গাড়ি। নেমে ওদের দিকে এগিয়ে এলো একজন অফিসার, বর্ষার মেঘলা আকাশের মতো থমথমে চেহারা। হাত বাড়ালো, দেখি লাইসেন্স!

<

Super User