০৬.

কালো সুড়ঙ্গমুখগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো বুড়ো মানুষটা।

অনেক ভেতরে ঢুকেছে ওগুলো, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর। সহজেই হারিয়ে যাবে ওর মধ্যে ঢুকলে।

দুষ্টুমি করে একটা লাল চোখ টিপলো বুড়ো। চিনি তো জায়গাগুলো, ভালো করেই চিনি। পঞ্চাশ বছর ধরে আছি, মুণ্ডু কাটা যায়নি একবারও। শত্রুর সঙ্গে কতো লড়াই করলাম।

মুণ্ডু কাটা যায়নি? চোখ মিটমিট করলো মুসা। ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই, করেছেন? এখানে?

 রাইফেলটা নাড়লো বুড়ো। ইনজুনস! ইনজুনসদের অনেক গল্প শোনাতে পারি তোমাদেরকে। সারা জীবন ওদের সাথে এখানে কাটালাম। লোক ভালো ওরা, তবে খুব খারাপ শত্রু। দুবার মুৎ প্রায় গিয়েছিলো আমার। ইউটি আর অ্যাপাচিদের দেশে গিয়ে। ভীষণ পাজি ওই অ্যাপাচিরা। কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছি।

এখন আর এখানে কোনো ইনডিয়ান নেই, স্যার, ভদ্রভাবে বললো কিশোর। আর আমরাও সুড়ঙ্গে ঢুকে হারাবো না।

কিশোরের ওপর স্থির হলো বুড়োর দৃষ্টি, যেন এই প্রথম তার ওপর চোখ পড়লো। এখন? না, এখন আর ইনজুনসরা নেই। তা তোমরা কি পাগল? এই গুহায় ঢুকতে সাহস করেছো? নতুন নাকি? কণ্ঠস্বর অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। চোখের বন্য দৃষ্টিও কোমল হয়েছে।

রবিন জবাব দিলো, হ্যাঁ, স্যার, রকি বীচ থেকে।

মিস্টার হারভের র‍্যাঞ্চে উঠেছি, মিস্টার..? জিজ্ঞাসু চোখে লোকটার দিকে। তাকালো কিশোর।

ডিন মারটিন, নাম বললো বুড়ো। ডিন বলে ডাকবে আমাকে। তো, হারভের ওখানে, আঁ? ভালো লোক ওরা। বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চিৎকার। শুনলাম। তোমাদেরই কেউ?

হ্যাঁ, স্যার, বললো কিশোর। তবে হারিয়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে চেঁচাইনি। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন দেয়ালে, দাগ দিতে দিতে এসেছি।

তাই? বুদ্ধি আছে। আরও একশো বছর আগে জন্মানো উচিত ছিলো। তোমাদের, আরামে কাটাতে পারতে। তা এখানে কি করছো?

কিসে গোঙায় দেখতে এসেছি, রবিন বললো।

আমরা ঢুকতেই থেমে গেল, বললো মুসা।

হঠাৎ কুঁকড়ে গেল লোকটা। চোখে ভয় ফুটলো ৭ পরিবর্তনটা এতোই প্রকট, ছেলেদের মনে হলো অন্য একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে এখন। আগের বুড়ো নয়। গোঙানি, না? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। লোকে বলে, হেনরি ফিগারো ফিরে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি না। গোঙান ওই ভদ্রলোক, বুড়ো মানুষটা। বুঝেছো? থামলো এক মুহূর্ত। ভয়ে ভয়ে তাকালো এদিক-ওদিক। শ্বেতাঙ্গরা এই এলাকায় আসার আগে থেকেই আছেন তিনি। সময়, বা বয়েস তাঁর কাছে কিছুই নয়। তিনি আছেন, থাকবেন। বাঁচতে চাইলে, তাঁকে রাগাতে না চাইলে আর কক্ষণো এখানে ঢুকো না। আমি ঢুকি বটে, কিন্তু গোঙানির কারণ। জানার চেষ্টা করি না। শেরিফ আর তার লোকেরাও তাঁকে ভয় পেতো। ওদের সবাইকেই ধরেছেন তিনি! ঢুকতে বারণ করে দেবে। এখানকার শেরিফও যেন না ঢোকে। ঢুকলে সবাইকে ধরবেন তিনি, কাউকে ছাড়বেন না।

ভীত চোখে কিশোরের দিকে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু সে তাকালো। না। চেয়ে আছে বুড়োর দিকে। ভাবছে কি যেন। তাঁকে আপনি কখনও দেখেছেন, মিস্টার মারটিন? বুড়ো মানুষটাকে? এই গুহায়?

তাঁকে? দ্রুত চারপাশে তাকালো মারটিন। এসো আমার সঙ্গে, বাইরে দিয়ে আসি। খবরদার, এখানে ঢুকে আর কখনও চিল্লাবে না। তিনি সহ্য করবেন না।

মাথা কাত করলো কিশোর হা, বেরোনো যায় এখন কি অনেক কিছুই দেখলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানে সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়।

বৈদ্যুতিক লণ্ঠনটা তুলে নিলো বুড়ো। ছেলেদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো গুহার বাইরে, উপত্যকায়। সঙ্গে সঙ্গে চললো, একেবারে সাইকেলের কাছে পৌঁছে দেবে। কান খাড়া রেখেছে কিশোর। কিন্তু গোঙানি আর শোনা গেল না।

ডিন মারটিনকে ধন্যবাদ দিলো ছেলেরা, গুড নাইট জানালো।

তোমরা খুব ভালো ছেলে, চালাক, বললো মারটিন। তবে বুড়ো মানুষটা তোমাদের চেয়ে, চালাক, সবার চেয়েই চালাক। তোমরা সাবধানে থাকবে। হারভেকেও হুঁশিয়ার করে দেবে। বলবে, বুড়ো মানুষটা সবার ওপরই চোখ রাখছেন। খনখনে হাসি হাসলো সে।

চাঁদের আলোয় কাঁচা সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। এখনও যেন কানে বাজছে বুড়োর হাসি। হঠাৎ থেমে গেল কিশোর।

ধাঁই করে হ্যাণ্ডেল আরেক দিকে ঘুরিয়ে দিলো মুসা, অল্পের জন্যে কিশোরের সাইকেলের ওপর পড়লো না।

রবিনও ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো। কি ব্যাপার?

কাজ শেষ হয়নি এখনও, বলতে বলতেই আবার সাইকেল ঘোরালো কিশোর।

র‍্যাঞ্চে ফিরে গেলেই ভালো, বললো রবিন।

আমিও তাই বলি, তাড়াতাড়ি বললো মুসা।

কোনো কাজে হাত দিলে শেষ না করে ছাড়ে না তিন গোয়েন্দা, ঘোষণা করলো যেন কিশোর।

কিন্তু ভোটে হেরে যাবে, রবিন বললো। দুজন আর একজন।।

ঠেকানো গেল না কিশোরকে। প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। তারপর নীরবে অনুসরণ করলো। জোরে জোরে প্যাডেল করে চলে এলো কিশোরের পাশে।

পথের মোড়ে ছায়ায় এসে থামলো কিশোর। ভালো করে দেখে বললো, অল ক্লীয়ার। এসো।

এবার কি করতে হবে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

আপাতত সাইকেলগুলো লুকাতে হবে। তারপর হেঁটে যাবো। চুপে চুপে।

চুপে চুপে হেঁটে কোথায় যাবো? জানতে চাইলো মুসা।

একটু আগে দেখলাম, এই পথটা ডেভিল মাউনটেইনের পাশ ঘুরে সাগরের দিকে গেছে। সাগরের দিক থেকে ঢোকার আর কোনো পথ আছে কিনা দেখবো।

 পাহাড়ের ছায়া পথের ওপর। কিশোরের পিছু পিছু চললো রবিন আর মুসা। চাঁদের আলোয় পাহাড় আর পাথরের বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে উপত্যকায়, দেখলে কেমন যেন গা ছমছম করে। পথের ধারে কখনও গাছপালা, কখনও পাথরের চাঁই। কখনও বা সরু গিরিপথের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে পথটা।

তিনটা প্রশ্ন, হাঁটতে হাঁটতে বললো কিশোর। আমরা ঢোকার পরই কেন বন্ধ হয়ে গেল গোঙানি? বাতাস তো আগাগোড়া একই রকম বইছে। তারমানে শুধু বাতাসের কারণে হয় না শব্দ।

অন্য কিছু? রবিন বললো।

হ্যাঁ।

কী? জানতে চাইলো মুসা।

আমাদের ওপর চোখ রেখেছে এমন কিছু কিংবা কেউ। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ডিন মারটিন আমাদেরকে গুহা থেকে বের করে দেয়ার জন্যে এতো ব্যস্ত হলো কেন?

বার বার তার বদলে যাওয়া ভালো লাগেনি। শেষ দিকে কেঁপে গেল রবিনের গলা।

হ্যাঁ,আনমনা হয়ে গেল কিশোর, ক্ষণিকের জন্যে। এক আজব বুড়ো! মনে হলো, দুজন ভিন্ন লোক ভিন্ন সময়ে বাস করছে। অভিনয়ই করলো কিনা কে জানে!

আমাদের ভালোই হয়তো চেয়েছে, তাই বের করে দিয়েছে, মুসা বললো। দেখলে না, বুড়ো মানুষের কথা বলার সময় কেমন ভয় ফুটলো চোখে। দানবটাকে দেখেছেও বোধহয়।

হয়তো। তিন নম্বর প্রশ্নটা হলো, কালো চকচকে যে জিনিসটা তুমি দেখলে। কি দেখেছো? কোনো সন্দেহ নেই আমার, পানিতে ভিজে ছিলো বলেই ছাপগুলো পড়েছে। পর্বতের ভেতরে কোথাও হ্রদ-টদ কিংবা খাড়ি যেমন থাকতে পারে, তেমনি পারে সাগর থেকে গুহায় ঢোকার কোনো গোপন পথ। সেটাই দেখতে চলেছি।

 আর কিছু দূর এগোতেই সামনে লোহার গেট চোখে পড়লো। পথটা ওখানে। শেষ। তার পরে পাহাড়ের প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে ডানে-বাঁয়ে নেমে গেছে দুটো সরু পথ। অনেক নিচে ঢেউয়ের ফেনা শাদা রেখা সৃষ্টি করেছে চাঁদের আলোয়। গেট ডিঙিয়ে এসে পাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো ছেলেরা।

ডালে যাবো, গুহাটা ওদিকেই, বললো কিশোর। পর্বতারোহীদের মতো। কোমরে দড়ি বেঁধে নেবো।-মুসা, তুমি আগে যাবে, আমি থাকবো পেছনে। সারি দিয়ে এগোবো। পথ যেখানে বেশি খারাপ একজন একজন করে পেরোবো। প্ল পিছলালেও অন্য দুজনে যাতে তাকে টেনে তুলতে পারি।

দ্রুতহাতে কোমরে দড়ি বেঁধে নিলো ওরা। সরু পথ ধরে আগে আগে চললো মুসা। নিচে বড় বড় পাথরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কালো, পাথরগুলো রুপোলি দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। মাঝে মাঝে পথ এতো নিচে নেমে যাচ্ছে, আছড়ে ভাঙা ঢেউয়ের পানির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। তিনবার থামতে হলো। পথ এতো খারাপ ওসব জায়গায়, একজন একজন করে পেরোতে হলো।

শেষ দিকে প্রায় খাড়া ভাবে সোজাসুজি নেমে গেছে পথটা। নিচে ছোট এক টুকরো সৈকত, ঝকঝকে শাদা বালি। এখন নির্জন। তবে লোকজন যে আসে, সাঁতার কাটে, পিকনিক করে, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিয়ারের খালি টিন, ফান্টা-কোকাকোলার বোতল, খাবারের বাক্স পড়ে আছে এদিক-ওদিক।

ভালোমতো চোখ রাখবে, বললো কিশোর। ফোকর-টোকর থাকতে পারে।

ঢালের গোড়ার কাছটায় ঘন হয়ে জন্মে আছে ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে বড় জাতের গাছ, কোনো কারণে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়েছে ওগুলোর। ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় পাথরের চাই।

টর্চের আলো ফেলে দেখছে ওরা। বিশেষ করে চাঁইগুলোর পেছনে।

আমার মনে হয় না এখানে কিছু আছে, মুসা বললো।

তাহলে কোথায় আছে? প্রশ্ন করলো রবিন।

কি জানি! কেউ তো বলেনি, এদিকেও সুড়ঙ্গমুখ আছে। আমরা আন্দাজ করছি। থেকে থাকলেও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

থাকলে কাছাকাছিই কোথাও আছে। কারণ, পথটা শেষ হয়েছে এখানেই। ৪. ঠিকই বলেছো, মুখ খুললো কিশোর। রবিন, তুমি আমার সাথে এসো। ডান দিকে খুঁজবো। মুসা, তুমি বয়ে যাও।

পানির কিনারের পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে শ্যাওলায়। তাতে কামড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক-গুগলি। ওগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটার সময় খুব সাবধান হতে হচ্ছে রবিন আর কিশোরকে।

অবশেষে এমন একটা জায়গায় এসে থামলো, আর এগোনোর উপায় নেই। তাহলে পানিতে নামতে হবে। হতাশ হয়ে ঘুরতে যাবে এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। এই, পেয়েছি!

ভেজা পাথরগুলো কোনোমতে পেরিয়ে এসে সৈকতে নেমেই দৌড় দিলো রবিন আর কিশোর। বাঁ দিকের প্রায় শেষ মাথায় চ্যাপ্টা বড় একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মস্ত দুটো পাথরের চাঁইয়ের মাঝে টর্চের আলো ফেলেছে। ছোট একটা মুখ, পানি থেকে বড়জোর ফুট খানেক ওপরে।

এই, শুনছো? কান পাতলো মুসা। আবার শুরু হয়েছে।

অন্য দুজনও শুনলো।

গোঙানিটা আসছে খোলা সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। মৃদু শব্দ, যেন পর্বতের অনেক, গভীর থেকে আসছে।

আরেকটু এগিয়ে মুখের ভেতরে আলো ফেললো মুসা। কালো, ভেজা, সরু পথ। সোজা চলে গেছে সুড়ঙ্গ, শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছে না।

.

০৭.

খাইছে রে! কি অন্ধকার! বললো মুসা।

কিছু দূর গিয়েই বোধহয় শেষ হয়ে গেছে, রবিন অনুমান করলো।

না দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নিশ্চয় ওই গুহায় যাওয়া যায় এটা দিয়ে। নইলে গোঙানি শুনতে পেতাম না।

দেখে কিন্তু তা মনে হয় না, মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।

ঝুঁকে ভেতরে তাকালো কিশোর। ঢোকা যাবে। সাবধান থাকতে হবে। আরকি। রবিন, তুমি যাও। যে রকম সরু ওটা, তোমার জন্যেই সহজ। কোমরে। দড়ি বেঁধে নামো, আমরা দড়ি ধরে রাখছি।

আমি? একা! তিনজনে একসাথে যাওয়া যায় না?

বোকামি হবে। এরকম অচেনা সুড়ঙ্গে একলা গেলেই ভালো। আমরা বাইরে থাকছি। তুমি কোনো বিপদে পড়লে দড়ি ধরে টেনে বের করে আনতে পারবো। তিনজন একসাথে বিপদে পড়লে তিনজনেই মরবো।

হ্যাঁ, সিনেমায় দেখেছি, মুসা বললো। ওই যে, জেলখানা থেকে পালায়, ওসব ছবিতে। অচেনা সুড়ঙ্গে আগে একজনকে পাঠায়। ও গিয়ে দড়িতে একবার হ্যাঁচকা টান দিলে বাইরের ওরা বোঝে, বিপদে পড়েছে, কিংবা নিরাপদ নয়; তাড়াতাড়ি দড়ি ট্রেনে লোকটাকে বের করে নিয়ে আসে।

 তুমিও একবারই টেনো, রবিনকে বললো কিশোর। টেনে বের করে নিয়ে আসবো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোমরে শক্ত করে দড়ি বেঁধে নেমে পড়লো রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো।

ভেতরে খুব ঠাণ্ডা। অন্ধকার তো বটেই। ছাত এতো নিচু, উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দেয়াল ভেজা, সবুজ শ্যাওলায় পিচ্ছিল। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে একটা জন্তুর মতো এগিয়ে চললো সে, সাবধানে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে। অনেক কাকড়া আছে ভেতরে। টর্চের আলো পড়লেই বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়া নেড়ে তাড়াহুড়ো করে গিয়ে ঢুকছে ভেজা পাথরের আড়ালে।

তিরিশ ফুট মতো এগিয়ে হঠাৎ ওপরে উঠে গেছে ছাত। উঠে দাঁড়ালো রবিন। সামনে এখনও ভোলা সুড়ঙ্গ। বাধা নেই। ছাত উঁচু হয়েছে, দেয়াল দুদিকে সরে গিয়ে মাঝখানটা চওড়া হয়েছে, কোণাকুণি উঠে গেছে পথটা। ভেজা, নয় আর, শুকনো।

কিশোর! মুসা! চেঁচিয়ে বললো সে। ঠিকই আছে সব। এসো।

ওরা দুজনও তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

বেশ শুকনো তো এখানে, বললো মুসা।

 জোয়ারের পানি উঠতে পারে না, তাই, কিশোর বললো।

এগিয়ে চললো ওরা। প্রতি দশ ফুট পর পর চিহ্ন আঁকছে কিশোর। চল্লিশ ফুট পর, বড় একটা গুহা পাওয়া গেল। দেয়ালে এতো বেশি ফোকর, যেন মৌমাছির বিরাট এক বাসা। কোনটা দিয়ে ঢুকবে?

পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা।

 আবার সেই সমস্যা, মুসা বললো।

পাহাড়টার তলায় সুড়ঙ্গ ছাড়া যেন আর কিছু নেই, নিরাশ হয়ে মাথা নাড়লো রবিন। কোনটায় ঢুকবো?

গুহা, কিংবা ফোকরগুলোর দিকে বিশেষ নজর নেই কিশোরের। কান পেতে রয়েছে। শব্দ কই?

তাই তো! মুসার দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো রবিন। নেই!

না, নেই! মুসাও মাথা নাড়লো।

আমি সুড়ঙ্গে ঢোকার পর থেকেই কিন্তু শুনিনি, রবিন বললো।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। আমরা ঢুকলেই বন্ধ হয়ে যায়। আশ্চর্য! একবার নয়, দুবার ঘটলো একই ঘটনা। কাকতালীয় আর বলা যায় না।

কি বলতে চাইছো? অবাক মনে হলো মুসাকে। আমরা ঢুকলেই কিছু একটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে? তাতে থেমে যাচ্ছে গোঙানি?

হতে পারে।

আরও একটা ব্যাপার হতে পারে, বললো রবিন। ফুকলেই আমাদের কাউকে দেখে ফেলছে। নিজেই প্রশ্ন তুললো আবার, কিন্তু কিভাবে?

মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। হয়তো…

শোনা গেল শব্দটা। মৃদু, বহুদূর থেকে আসছে। ঘোড়ার খুরের খটাখট।

ঘোড়া! চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।

মাথা ঘুরিয়ে শুনছে কিশোর। গুহার দেয়ালের ভেতর দিয়ে যেন আসছে শব্দটা। মনে হচ্ছে…পর্বতের অনেক গভীর থেকে আসছে!

রবিন বললো, হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে…

উঁহু! ওটা এখন আমাদের বাঁয়ে। সোজাসুজি ঢুকেছি আমরা, পাহাড়ের দিকে মুখ করে আছি। তুমি যেদিকের কথা বলছো, সেদিকে কোনো সুড়ঙ্গ নেই, দেখো।

সব চেয়ে ভালো হয়, এখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলে, মুসা বলে উঠলো।

 চলো, বেরিয়েই যাই। সেই ভালো।

পেছন ফিরে প্রায় দৌড়ে চললো ওরা। সুড়ঙ্গের সরু মাথাটার কাছে আগে পৌঁছলো মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এগোলো। পেছনে রবিন আর কিশোর।

বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গ থেকে।

এখন কি করবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

এক রাতে যথেষ্ট হয়েছে, জবাব দিলো কিশোর। র‍্যাঞ্চে ফিরে যাবো।

দুই সহকারীর মনের কথা বলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। সানন্দে ফিরে চললো ওরা। কোমড়ে দড়ি বেঁধে উঠে চললো বিপজ্জনক পাহাড়ী পথ বেয়ে। নিরাপদেই উঠে এলো ওপরে।

আগে রয়েছে কিশোর। গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো কিশোর। তার পিঠের ওপর এসে পড়লো মুসা। কি ব্যাপার?

জবাব দিলো না কিশোর। চেয়ে রয়েছে ডেভিল মাউনটেইনের দুই চূড়ার দিকে, একই রকম দেখতে চূড়া দুটো, যেন জমজ।

কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

ধীরে ধীরে বললো কিশোর, কি যেন নড়তে দেখলাম ওখানে…

শোনা গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ। খটখট খটাখট খট-খট…

আবার! গুঙিয়ে উঠলো রবিন।

গুহার মধ্যে এই শব্দই শুনেছিলাম না? মুসা বললো।

তাই তো মনে হয়, বললো কিশোর। পাহাড়ের কোনো ফাটল দিয়ে ঢুকেছিলো শব্দটা।

গেটের কাছে একটা ঘন ঝোপে লুকিয়ে পড়লো ওরা।

এগিয়ে আসছে খুরের আওয়াজ। বড় একটা কালো ঘোড়া দেখা গেল, পর্বতের ঢালের পথ ধরে। দুলকি চালে চলে গেল ছেলেদের কয়েক ফুট দূর দিয়ে।

মানুষ কই? রবিনের প্রশ্ন।

ধরবো নাকি? মুসা বললো।

না। ঘোড়াটার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। দেখি, কি করে?

ঝোপের ভেতরেই বসে আছে ওরা।

হঠাৎ আঙুল তুলে দেখালো মুসা। ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে আসছে একজন, মানুষ। কাছে এলে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলো ওরা। লম্বা, বাদামী চামড়া, চোখা নাক। ডান গালে একটা কাটা দাগ। বা চোখের ওপর কালো পট্টি।

পট্টিটা দেখলে? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

আর গালের কাটা, যোগ করলো রবিন।

আমি দেখেছি ওর স্যুট, কিশোর বললো। বিজনেস স্যুট। মনে হলো কোটের নিচে পিস্তলও আছে।

এবার তাহলে যেতে পারি আমরা? মুসা বললো।

হ্যাঁ। দারুণ কাটলো সময়।

সাইকেলের কাছে আসতে আসতে বার বার পেছনে ফিরে তাকালো ওরা। কিন্তু আর কিছু চোখে পড়লো না।

তবে, সাইকেল চালিয়ে মোনিং ভ্যালি পেরোনোর সময় আবার রাতের নীরবতা ভাঙলো সেই আজব গোঙানি।

.

০৮.

চোখেমুখে রোদ লাগতে ঘুম ভাঙলো মুসার। চোখ মেলে তাকালো। অপরিচিত লাগলো ঘরটা। কোথায় রয়েছে? বাইরে ঘোড়া নাক টানলো, একটা গরু হাম্বা করে উঠলো। মনে পড়লো তার, হারভে র‍্যাঞ্চের দোতলায় একটা বেডরুমে শুয়েছে। ওপরের বাংক থেকে ঝুঁকে নিচে তাকালো, কিশোরের বাংকের দিকে। সে কি করছে দেখার জন্যে। গোয়েন্দাপ্রধান নেই।

এক লাফে উঠে বসতে গিয়ে ছাতে আথা ঠুকে গেল মুসার। উফ করে উঠলো।

ওধারের বাংক থেকে সাড়া দিলো রবিন। হাত তুলে জানালা দেখালো।

জানালার কাছে বুদ্ধদেবের মতো আসন করে বসেছে কিশোর, গায়ে ওরকমই একটা চাদর জড়ানো। তার সামনে মেঝেতে বিছানো কাগজের বড় একটা শীট, ওটার ওপর চারটে বই। পেন্সিল দিয়ে অনেকগুলো লাইন টেনেছে কাগজটাতে।

হাঁ করে চেয়ে রইলো মুসা। বুঝতে পারলো, বই দিয়ে মোনিং ভ্যালির একটা মডেল বানিয়েছে কিশোর। পেন্সিল দিয়ে এঁকেছে সুড়ঙ্গমুখ।

এক ঘন্টা ধরে বসে আছে ওভাবে, রবিন জানালো।

খাইছে! দশ মিনিটও পারবো না আমি! মাঝে মাঝে তাদের তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি। বন্ধুটির আচার-আচরণ খুবই অবাক করে মুসা আর রবিনকে।

ধ্যান ভাঙলো অবশেষে। কথা বললো কিশোর পাশা। গোঙানি উপত্যকার সঠিক টপোগ্রাফিকেল অ্যারেঞ্জমেন্ট নির্ণয়ের চেষ্টা করলাম। জায়গাটার ফিজিকাল প্যাটার্নের মধ্যেই রয়েছে রহস্যের চাবিকাঠি।

গ্রীক বললে!

ও বোঝাতে চাইলো, বুঝিয়ে দিলো রবিন। জায়গাটার গঠনের ওপর নির্ভর করছে রহস্যের সমাধান।

এরকম সহজ করে বললেই পারতো।

মুসার কথায় কান দিলো না কিশোর। গোঙানি উপত্যকার আসল রহস্য, আমরা ঢুকলেই কেন ওটার গোঙানি বন্ধ হয়ে যায়? কাল রাতে দুবার ঘটেছে। ঘটনাটা। অথচ আমরা ফেরার সময়ও আবার শুরু হলো, একটা খবরের কাগজ দেখালো। নতুন করে গোঙানি শুরু হওয়ার রিপোর্ট বেরিয়েছে এটাতে। শেরিফের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। শেরিফ বলেছেন, কারণটা জানা যাচ্ছে না তার আরেকটা কারণ, কেউ গুহায় ঢুকলেই নাকি ওই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। কাগজটা নামিয়ে, রাখতে রাখতে বললো, আমি এখনও শিওর, কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয় ওটা।

হয়তো তোমার অনুমানই ঠিক, রবিন বললো। এমনভাবে ঘটেছে, যেন। আমাদের ওপর কেউ চোখ রেখেছিলো।

তো, তোমার মডেল কিভাবে সাহায্য করছে আমাদের? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

বই দিয়ে বানানো মডেলটার দিকে তাকালো কিশোর। কাল রাতে যতো জায়গায় গিয়েছি, সবগুলো জায়গায় চিহ্ন দিয়েছি এখানে। দুবার দুদিক দিয়ে ঢুকেছি, দুবারই গোঙানি বন্ধ হয়ে গেছে। রবিন ঠিকই বললো, যেন আমাদের ওপর কেউ চোখ রেখেছিলো।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। আমরা ঢাকার আগেই দেখে ফেলছিলো আমাদের।

হ্যাঁ। আর এই মডেলটা বানিয়ে বুঝলাম, যতো জায়গায়ই গিয়েছি আমরা, আমাদের দেখেছে। ডেভিল মাউনটেইনের চূড়া থেকে।

তাহলে তো হয়েই গেল, বললো মুসা। মিস্টার হারভেকে গিয়ে বলবো একথা। চূড়া থেকে ধরে ফেলা হবে লোকটাকে।

না, মুসা, মাথা নাড়লো কিশোর। লোকটাকে ধরা এতো সহজ নয়। ওপর থেকে দেখে সে। ধরতে আসছে বুঝতে পারলেই পালাবে।

তাহলে…, শুরু করলো রবিন।

কিভাবে…, একই সময় বললো মুসা।

নজর রাখবো আমরা, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। গুহায় আসলে কি ঘটছে জানার চেষ্টা করবো। তারপর জানাবো সবাইকে।

গুহায় কি ঘটছে কিছুই জানি না আমরা, মুসা বললো। জানি?

না। তবে একটা প্ল্যান করেছি আমি। একটা সূত্র পেয়েছি।

 পেয়েছো? কি?

কাল রাতে গুহার ভেতর এটা পেয়েছি, বলে পাথরের টুকরোটা বের করে। দেখালো কিশোর। একসময় খুনিতে ঢোকার পথ ছিলো ওই সুড়ঙ্গ। পাথর পড়ে। যেখানে বন্ধ হয়েছে, ওখানে পেয়েছি।

বাংক থেকে নেমে গিয়ে পাথরটা হাতে নিলো রবি দেখলো। তুলে দিলো। মুসার হাতে।

কি এটা, কিশোর? মুসা বুঝতে পারছে না। আমার কাছে তো পিছলা একটা পাথর ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

জানালার কাঁচে ঘষা দাও ওটা দিয়ে।

কী? আরও অবাক মুসা। তাতে কি হবে…

দিয়েই দেখো না।

বাংক থেকে নেমে গিয়ে কাঁচে ঘষা দিলো মুসা। কেটে গেল কাঁচ। শিস দিয়ে উঠলো মুসা।

কিশোর! চেঁচিয়ে বললো রবিন। তারমানে…

হীরা, কথাটা শেষ করে দিলো কিশোর। হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়। আনকাট ডায়মণ্ড। বড় বটে, কিন্তু জাত ভালো নয়, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল স্টোন সম্ভবত। তবে এটা হীরা।

হেনরি ফিগারোর গুহাটা হীরার খনি? পাথরটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস। করতে পারছে না রবিন। এখানে, এই ক্যালিফোর্নিয়ায়?

গুজব তো রয়েছে। হয়তো…

বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর। দরজায় থাবা দিয়ে জোরে জোরে ডাকলেন। মিসেস হারভে, এই ছেলেরা, জলদি ওঠো। নাস্তা দেয়া হয়েছে।

খাবারের কথা শুনে পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। এতোক্ষণ বুঝতেই পারেনি। ওরা, কতোটা খিদে পেয়েছে। কাপড় পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এলো। র‍্যাঞ্চের বিরাট রান্নাঘরে। ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন মিস্টার হারভে আর প্রফেসর হারকসন।

বাহ্, মন্তব্য করলেন প্রফেসর। মোনিং ভ্যালির রহস্যও দেখি তোমাদের খিদে কমাতে পারেনি।

বড় বড় পাত্রে করে খাবার এনে রাখছেন মিসেস হারভে।

খাওয়া শুরু করলো ছেলেরা।

কাজটাজ করবে কিছু আজ? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার হারভে।

নিশ্চয় করবে, ওদের হয়ে জবাব দিলেন মিসেস হারভে। উত্তরের মাঠে যাবে না খড় কাটতে? ওদেরও নিয়ে যাও।

ভালো বলেছো। খড় কাটা শেষ হলে ম্যাভারিক জড়ো করবো. সাহায্য করতে পারবে।

র‍্যাঞ্চ জীবনের ওপর মোটামুটি পড়াশোনা আছে রবিনের। ম্যাভারিক মানে জানে। পশুর মূল পাল হতে সরে যাওয়া গরু ছাগল-ভেড়াকে বলে ম্যাভারিক।

তো, কাল রাতে সৈকতে কেমন লাগলো? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। কি কি দেখলে?

চমৎকার, জবাব দিলো কিশোর। এক আজব বুড়োর সঙ্গে দেখা হলো। নাম বললো ডিন মারটিন। লোকটা কে, স্যার?

ডিন মারটিন আর তার বন্ধু কার্ল বেইরি ছিলো প্রসপেকটরস, বললেন মিস্টার হারভে। যৌবনে সমস্ত পশ্চিম ছুঁড়ে বেরিয়েছে সোনা রূপা আর হীরার সন্ধানে।

অনেক বছর আগে, এখানে এসেছিলো দুজনে, মিসেস হারভে বললেন। তখন গুজব ছিলো, এই অঞ্চলে সোনা পাওয়া গিয়েছে। আসলে যায়নি, কিন্তু ডিন। আর কার্ল আশা ছাড়েনি। খোঁজ চালিয়েই যাচ্ছে। পর্বতের ঢালে একটা ছাউনি তুলে থাকে। তাদের ঘরে কারও যাওয়া পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে র‍্যাঞ্চের কাজকর্ম করে দিয়ে তার বিনিময়ে খাবার নেয় আমাদের কাছ থেকে।

এখানে ওদেরকে সবাই চেনে, জানালেন প্রফেসর।

অনেক গল্প জানে মারটিন, আর বলতেও পারে, হাসলেন মিস্টার হারভে। খেয়ালি লোক,গল্পগুলোও বেশির ভাগ বানানো কিংবা রঙ চটানো। যেমন, শুরুতেই বলবে, ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে ফাঁইট করেছিলো। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে।

মিথ্যে বলে? মুখ ভরতি খাবার চিবাতে চিবাতে বললো মুসা।

মিস্টার হারভে জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে পেছনের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলো ফোরম্যান ডেভিড কোহেন। থমথমে চেহারা। বললো, পেদ্রো পড়ে ছিলো মোনিং ভ্যালিতে।

পেদ্রো? উদ্বিগ্ন হলেন মিস্টার হারভে।

কাল রাতে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে। সারারাত ওখানেই পড়ে ছিলো।

 কেমন আছে ও? মিসেস হারভেও উদ্বিগ্ন হলেন।

ডাক্তার বললো ঠিক হয়ে যাবে। সানতা কারলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এখুনি যাচ্ছি দেখতে! লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন মিস্টার হারভে।

শ্রমিকেরা ভীষণ ভয় পেয়েছে, জানালো কোহেন। আরও দুজন বলেছিলো, এখানে আর কাজ করবে না। পেদ্রো বলেছে, মোনিং ভ্যালিতে নাকি কি নড়তে দেখে দেখার জন্যে যায়। হঠাৎ গোঙানি শুনে ভয় পেয়ে যায় ঘোড়াটা। পেদ্রোকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে ছুটে পালায়। সারা শরীর জখম হয়েছে বেচারার গোড়ালি মচকে গেছে।

পরস্পরের দিকে তাকালেন মিস্টার এবং মিসেস, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

কিশোর জিজ্ঞেস করলো, ঘোড়াটা কি কালো? রড়?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো ফোরম্যান। নাম ব্ল্যাকি। খুব ভালো জানোয়ার। আজ সকালে কোরালে ফিরেছে। একা। তখনই.পেদ্রোর খোঁজ শুরু করলাম।

কেন, কাল রাতে তোমরা ঘোড়াটাকে দেখেছিলে? তীক্ষ্ণ হলো মিস্টার হারভের দৃষ্টি।

হ্যাঁ, স্যার। পিঠে লোক ছিলো না।

র‍্যাঞ্চের নিয়ম জানো? আরোহী ছাড়া কোনো ঘোড়া দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে রিপোর্ট করতে হয়। তোমাদের তা-ই করা উচিত ছিলো। তাহলে কাল রাতেই পেদ্রোকে হাসপাতালে পাঠানো যেতো।

নিয়মটা জানতাম না, স্যার। তা-ও এসে জানাতাম, যদি খালি ঘোড়া দেখতাম। ওটার পেছনে একজন লোককে দৌড়ে যেতে দেখেছি। ভাবলাম, ওই লোকটাই বুঝি ঘোড়ার সওয়ারি। লম্বা, ডান গালে কাটা দাগ, চোখে পটি।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মিস্টার হারভে। ওরকম চেহারার কাউকে তো চিনি।

লম্বা, চোখে পট্টি? ভুরু কোঁচকালেন প্রফেসর। শুনে সুবিধের লোক মনে হচ্ছে না। তবে নিশ্চয় হেনরি ফিগারো নয়। ফিগারো লম্বা নয়, আর চোখে পট্টিও লাগাতো না।

দরজার দিকে এগোলেন মিস্টার হারভে। ডেভিড; শ্রমিকদের গিয়ে ঠাণ্ডা করো। পেদ্রোকে দেখে উত্তরের মাঠে চলে আসবো আমি। আর লোকটার কথাও জানিয়ে আসবো শেরিফকে।

স্যার, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। শহরে গেলে আমাকেও নিয়ে যান। রকি বীচে যাবো।

কেন, কিশোর? মিসেস হারভে বললেন, আজই যাবে কেন? আর কটা। দিন থাকো না।

চলে আসবো আবার। আমাদের ডুবুরির পোশাকগুলো আনতে যাবো। কাল রাতে সৈকতের ওদিকে কয়েকটা স্পট দেখেছি। ভালো ভালো অনেক নমুনা পাওয়া যাবে, বুঝেছি। ইসকুলের ম্যারিন বায়োলজিতে ভালো নম্বর তুলতে পারবো।

হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে রবিন আর মুসা। ম্যারিন বায়োলজি ওন্দের বিষয় নয়। কিন্তু কিছু বললো না। কোনো কারণ ছাড়া যে মিথ্যে বলে না কিশোর, জানা হয়ে গেছে এতোদিনে।

কিন্তু রকি বীচে তো আজ যেতে পারবো না…

যেতে হবে না, স্যার। আমি বাসে চলে যাবো।

বেশ। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

রবিন আর মুসার দিকে চেয়ে হাসলেন মিসেস হারভে। পালের গোদাই তো চলে গেল। সময় কাটাবে কি করে? যে ঝামেলা বাধলো, মিস্টার হারভে আজ র‍্যাঞ্চের কাজ দেখানোর সময় পাবেন না।

দেখি, ব্যবস্থা একটা করে নেবো সময় কাটানোর, রবিন বললো।

দুই সহকারীকে ইশারা করে বেডরুমে চলে এলো কিশোর। রবিন আর মুসা। এলে বললো, আমি চলে গেলে তোমরাও সানতা কারলায় যাবে। বড় দেখে এক ডজন মোম কিনবে। আর তিনটে মেকসিকান সমব্রেরো হ্যাট। কোথায় যাচ্ছো। জানতে চাইলে মিসেস হারভেকে যা হোক একটা কিছু বলে দেবে।

হ্যাট দিয়ে কি হবে? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

দরকার আছে, এখন বলার সময় নেই। রবিন তারপর পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবে। ডেভিল মাউনটেইন আর মোনিং ভ্যালির সমস্ত ইতিহাস জানার চেষ্টা করবে।

ঠিক আছে, জানলাম। কিন্তু তুমি রকি বীচে যাচ্ছো কেন?

বললাম না, স্কুবা ইকুইপমেন্ট আনতে। তোমাদেরগুলোও নিয়ে আসবো। আর লজ অ্যাঞ্জেলেসে গহনার দোকানে গিয়ে দেখিয়ে আনবো হীরাটা।

 নিচে থেকে ডাকলেন মিস্টার হারভে, কিশোর, তোমার হয়েছে?

দ্রুত নেমে এলো তিনজনে। পিকআপ ট্রাকে মিস্টার হারভের পাশে ব্যাগ নিয়ে উঠে বসলো কিশোর। ওর চলে যাওয়া দেখছে রবিন আর মুসা। ডুবুরির। পোশাক দিয়ে কি করবে গোয়েন্দাপ্রধান, কিছুই বুঝতে পারছে না দুজনে।

যেচে এসে রান্নাঘরে মিসেস হারভেকে সাহায্য করলো রবিন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মহিলাটি পটিয়ে তার লাইব্রেরি কার্ডটা ধার নিয়ে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে সাইকেল নিয়ে সানতা কারলায় চললো সে আর মুসা।

দেখো, সাবধানে যেও! পেছন থেকে ডেকে বললেন মিসেস হারভে।

 মহিলা সত্যি খুব ভালো, চলতে চলতে বললো মুসা।

হ্যাঁ, হাসলো রবিন। জোর করে খাবার তুলে দেন তো পাতে…

আরে না, সেজন্যে না। আসলেই ভালো…

 কথা বলতে বলতে চলেছে দুজনে। উপত্যকার ভেতর দিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে, কখনও বা দূর দিয়ে ঘুরে গেছে পথ। তিন দিক থেকে ঘিরে রয়েছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বাদামী পর্বতের সারি, আরেক ধারে সাগর। কড়া রোদ। সাগরের তীরে বাতাস বেশ ঠাণ্ডা, সরে গেলেই ভীষণ গরম। প্রতিটি পাহাড়ের চূড়া খটখটে শুকনো, আর্দ্রতার লেশমাত্র নেই। সানতা-কারলা নদীর ওপরে চওড়া ব্রীজ। নিচে নদীর বুকে শাদা বালি, পানি নেই। গরমে শুকিয়ে গেছে। ভেজা মৌসুমে কিছু কিছু তৃণলতা জন্মেছিলো, জীবন ধারণের প্রচণ্ড চেষ্টায় সেগুলো এখন ধুকছে।

ধীরে ধীরে উঠে চলেছে পথ। স্যান মেটিও গিরিপথে ঢুকলো ওরা। দুর্গম পথ, মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ মোড়। চালানোর চেয়ে সাইকেল ঠেলে নেয়া সহজ। তা-ই করলো দুজনে। বাঁয়ে পর্বতের খাড়া ঢাল, ডানে হাঁ করে রয়েছে যেন কালো। গিরিখাত। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য।

অনেকক্ষণ পর ঘামতে ঘামতে গিরিপথের বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা।

খাইছে! দেখো দেখো! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

থমকে দাঁড়ালো রবিন। বিপুল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।

এ-রকম দৃশ্য খুব কমই দেখেছে ওরা। ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে পর্বতের ঢাল, ছোট একটা পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে মিশেছে। তার ওপারে ছড়ানো তৃণভূমি, ঘন নীল প্রশান্ত মহাসাগরকে গিয়ে ছুঁয়েছে। এক ধারে সানতা কারলা শহর, ঝলমল করছে রোদে। দূর থেকে ঘরগুলোকে দেখাচ্ছে বিশাল এক সবুজ চাঁদরের মাঝে দেশলাইয়ের রঙিন বাক্সের মতো। সাগরের পানিতে নানারকম জাহাজ, নৌকা চলাচল করছে। আর, বহুদুরে, পার্বত্য চ্যানেল আইল্যাণ্ডস যেন ভেসে আছে। সাগরের ওপর।

 দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে দুজনে। পেছনে শোনা গেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। প্রায় একই সঙ্গে ঘুরলো ওরা। জোরে ছুটে আসছে মস্ত এক কালো ঘোড়া। রূপার কাজ করা লাগাম, চ্যারো জিনটাতেও রূপার কাজ। জিনের ধাতব পোমেল হর্ন-এ রোদ চমকাচ্ছে।  

পাথর হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। পা নড়াতে পারছে না। ওদের দিকেই ছুটে আসছে ঘৌড়াটা। পিঠে আসীন ঘোড়সওয়ারের ছোট্ট শরীর, মাথায় কালো সমব্রেরো হ্যাট, কালো চোখের নিচে নাক-মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে, গায়ে কালো খাটো জ্যাকেট, পরনে কালো আঁটো প্যান্টের নিচের ঢোলা অংশ উড়ছে চকচকে বুটের ওপর। হাতের পুরনো পিস্তলটা তাক করে ধরেছে ছেলেদের দিকে।

হেনরি ফিগারো!

.

০৯.

অনেক দেরিতে আতঙ্কিত ছেলেদুটোকে চোখে পড়লো যেন ঘোড়াটার। হঠাৎ ব্রেক, কষে থামলো, সামনের দুই পা শূন্যে তুলে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়লো।

ঘোড়াটাকে সামলালো আরোহী। হাতের পিস্তল নাচিয়ে ছেলেদের বললো, ভিভা ফিয়েসতা! একটানে নামিয়ে দিলো মুখের কালো কাপড়। এক কিশোর, দুষ্টুমি ভরা চেহারা। ফিয়েসতা দেখতে এসেছো? এসো। বলেই ঘোড়ার লাগাম; ধরে টানলো। খটাখট করে চললো হাইওয়ে ধরে, সানতা কারলার দিকে।

কি বললো ব্যাটা? সেদিকে তাকিয়ে বললো মুসা।

 ভিভা ফিয়েস্তা। ওই তোমরা ঈদ মোবারক বলো না, অনেকটা ওরকম। আজ বোধহয় সানতা কারলায় ফিয়েসতা হচ্ছে। ভালোই হলো। অনেক দিন থেকে দেখার শখ।

ফিয়েসতার জন্যে ওরকম পোশাক পরেছে! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তাদেরই বয়েসী একটা ছেলে এভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে গেল, মেনে নিতে পারছে না।

ফিয়েসতায় গেলে ওরকম অন্তত আরও দশটা হেনরি ফিগারোকে দেখতে পাবে, বাজি ধরে বলতে পারি।

থাকুক। কোনো কানাগলিতে ওদের সামনে পড়তে চাই না আমি।

আবার সাইকেলে চাপলো ওরা। নেমে চললো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। প্যাডাল ঘোরানোর দরকারই পড়লো না। তীব্র গতিতে নেমে চলে এলো শহরের কিনারে। পাহাড় ওখানে শেষ।

 প্যাডাল করে চললো ওরা। দুধারে বাড়িঘর, গলফ খেলার মাঠ, বড় বড় সপিং সেন্টার।

 পথে একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, লাইব্রেরিটা শহরতলীতে। চলে এলো ওরা ওখানে। সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানে রেখে হেঁটে এগোলো সানতা কারলার প্রধান সড়ক ইউনিয়ন স্ট্রীট ধরে। বেশি দূর যেতে পারলো না। ব্যারিয়ার দিয়ে বুক করে দিয়েছে পুলিশ, ফিয়েসতা প্যারেডের জন্যে। ব্যারিয়ারের ওধারে ইতিমধ্যেই সারি দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে লোকে, প্যারেডে অংশ নিতে এসেছে যারা। বেশির ভাগেরই পরনে পুরনো আমলের স্প্যানিশ পোশাক, চোখ ধাঁধানো রঙ। আনন্দঘন পরিবেশ। ও তাড়াতাড়ি কেনাকাটা সেরে নিলো দুই গোয়েন্দা। পথের ধারে ছোট একটা দোকানেই পাওয়া গেল মোম আর খড়ের তৈরি সমব্রেরো হ্যাট। তারপর ছুটে এলো আবার পথের মোড়ে, ব্যারিয়ারের কাছে, প্যারেড দেখার জন্যে।

শুরু হলো প্যারেড। ধিড়িম ধিডিম বেজে উঠলো ড্রাম, সেই সাথে পাল্লা দিলো যেন ট্রাম্পেটের কড়া, মিষ্টি চিৎকার।

ব্যাণ্ডের পর এলো ফ্লোট। ফুলে ফুলে সাজানো। সুন্দরী মেয়েরা রয়েছে তাতে, আর নানারকম বিচিত্র পোশাক পরা পুরুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের এক অসাধারণ মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে ফ্লোটগুলোতে। প্রথম ফ্লোটটা তৈরি হয়েছে ফাদার জুনিপাররা সেরা-র সম্মানে। ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে পুরনো যতোগুলো চমৎকার মিশন রয়েছে, তার বেশির ভাগেরই প্রতিষ্ঠাতা এই মহৎ ফ্রানসিসকান মিশনারি। আরেকটাতে দেখানো হয়েছে, মেকসিকানদের কাছ থেকে সানতা কারলা দখলের পর সেখানে আমেরিকান পতাকা উত্তোলন করছেন জন, সি. ফ্রেমন্ট। আরেকটাতে রয়েছে হেনরি ফিগারো (এই রকম চরিত্রের একজন লোক সত্যি ছিলেন। তাঁর নাম জ্যাসপার ওরটেগা জেসাস ডি ডেলগাডো ওয়াই ক্যাবরিলো)। পাঁচজন সেজেছে হেনরি ফিগারোর সাজে, তার মাঝে সেই ছেলেটাকেও দেখতে পেলো দুই গোয়েন্দা, গিরিপথে যে তাদেরকে চমকে দিয়েছিলো।

এলো অশ্বারোহী মাউন্টেড পুলিশ বাহিনী। ঘোড়াগুলো অপূর্ব। ওরকম একটা ঘোড়ার মালিক হতে না পারায় আফসোস হলো মুসার। প্যালোমিনো জাতের, প্রায় সোনালি গায়ের রঙ, যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে শরীর থেকে।

তাদের পেছনে এলো পুরনো আমলের ঘোড়ায়-টানা গাড়ির বহর, ওয়াগন, স্টেজকোচ, এইসব। সব শেষের ফ্লোটটা গোল্ড রাশ (স্বর্ণ-সন্ধান) যুগের প্রতিচ্ছবি।

মুসার হাত খামচে ধরলো রবিন। দেখো দেখো।

পাশের দুজন লোককে দেখালো সে। একটা খচ্চরের পাশে হাটছে। জানোয়ারটার পিঠে চাপিয়েছে খাবার, বেলচা, গাঁইতি, আর খনি খোঁড়ার অন্যান্য সরঞ্জাম। দুজনের একজনকে চেনে ওরাঃ বুড়ো ডিন মারটিন।

আরেকজন নিশ্চয় তার দোস্ত, মুসা বললো। কার্ল বেইরি।

এই ফ্লোটটা দেখে বেশ মজা পেলো জনতা। এমনভাবে সেজেছে মারটিন আর বেইরি, একেবারে আসল প্রসপেকটরের মতো দেখাচ্ছে। খনিতে কাজ করার উপযোগী.পুরনো পোশাকে বালি লেগে রয়েছে, যেন এই মাত্র বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে। মাথা উঁচু করে আগে আগে হাঁটছে মারটিন, সামান্য খোঁড়াচ্ছে, বাতাসে উড়ছে তার শাদা লম্বা দাড়ি। পেছনে বেইরি। লম্বা, রোগাটে, বয়স মারটিনের। মতোই, তবে দাড়ির বদলে তার রয়েছে শাদা মস্ত গোঁফ। 

ব্যাণ্ড বাজছে, ফ্লোট চলেছে শহরের প্রধান সড়ক ধরে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে জনতা। হাসি-আনন্দে মুখর। এতোই তন্ময় হয়ে দেখছে দুই গোয়েন্দা, লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথাই ভুলে গেল। একটা লোকের ওপর চোখ পড়তে চমকে উঠলো মুসা। ফিসফিস করে বললো, রবিন!

রবিনও দেখলো। কয়েক ফুট দূরে সেই লোকটা। লম্বা, গালে কাটা দাগ, চোখের ওপর পট্টি। প্যারেডে মনোযোগ নেই তার। উসখুস করছে। তারপর যেই একটু ফাঁক পেলো, ইউনিয়ন স্ট্রীট পেরিয়ে দ্রুত চলে গেল ওপাশে।

এসো, বলেই তার পেছনে ছুটলো রবিন।

বিশ ফুট দূরে দেখা গেল লোকটাকে। দ্রুতপায়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থেমে সামনের কি যেন দেখছে।

কারও কিছু নিয়েছে, রবিন বললো।

কার?

দেখছি না। তুমি দেখছো কাউকে?

চোখের ওপর হাত এনে রোদ আড়াল করে, মাথা উঁচু করে দেখলো মুসা।, কাউকে দেখছি না।

লাইব্রেরির চত্বরে পৌঁছলো লোকটা। দরজার দিকে এগোলো।

ওখানে ঢুকছে কেন? অবাক হলো রবিন।

উঁচু ডাবল ডোর দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। পেছনে ছুটে গেল ছেলেরা। ভেতরে ঢুকেই থেমে গেল ফিয়েসতার দিনে আজ লাইব্রেরি প্রায় নির্জন। অথচ লোকটাকে চোখে পড়লো না।

বিরাট হলঘর। অসংখ্য বুকশেলফের মাঝে মাঝে হাঁটাচলার জন্যে ফাঁক.। ওখানে সেই লোকটা। বাইরে বেরোনোর দুটো দরজা দিয়েই বেরিয়ে দেখলো ওরা। দুটো গলি, কোনোটাতেই দেখা গেল না লোকটাকে।

পালিয়েছে, হতাশ হয়ে বললো মুসা।

আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমাদের। তাহলে একজন পেছন দিয়ে যেতে পারতাম, আরেকজন সামনে দিয়ে।

চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। চলো, তোমার রিসার্চ সেরে নাও।

আবার লাইব্রেরিতে ঢুকলো দুজনে। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো রবিন, লোকাল হিস্টরির বইগুলো কোনখানে পাওয়া যাবে। হলের পাশের ছোট একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন মহিলা। জানালেন, ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের ওপর স্পেশাল কিছু বইও আছে ওখানে।

ছোট ঘরটায় সবে ঢুকেছে দুজনে, একটা হাত পড়লো মুসার কাঁধে। বাহ, আমাদের গোয়েন্দারা দেখছি!

পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর হারকসন। ভারি পাওয়ারের কাঁচের ওপাশে একটা চোখ টিপলেন। বিশেষ কিছু জানতে এসেছো?

হ্যাঁ, স্যার, জবাব দিলো মুসা। মোনিং ভ্যালি সম্পর্কে।

গুড, গুড, উৎসাহ দিলেন প্রফেসর। আমিও সেজন্যেই এসেছি। সুবিধে হলো না। সত্যিকার ইতিহাস বলতে কিছু নেই, অধিকাংশই উপকথা, রূপকথা কিংবা কিংবদন্তী। …তারপর, ফিয়েসতায় গিয়েছিলে?

গিয়েছিলাম! যা সুন্দর সুন্দর ঘোড়া না?

অতি চমৎকার একটা উৎসব।…যাই। এখানে বসে থেকে আর লাভ নেই। তা, যাচ্ছ কিভাবে?

সাইকেল নিয়ে এসেছি, স্যার, রবিন জানালো।

 বেশ। দেখা হবে, চলি, বলে ঘুরলেন প্রফেসর।

স্যার? এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো রবিন, একটা লোককে দেখেছেন? চোখে কালো পট্টি?

মাথা নাড়লেন প্রফেসর। না তো। কাল রাতে যাকে দেখেছিলে?

হ্যাঁ, মুসা বললো।

এখানে, এই শহরে? চিন্তিত মনে হলো প্রফেসরকে। না, দেখিনি।

প্রফেসর বেরিয়ে গেলে, কাজে বসলো দুই গোয়েন্দা। গোটা চারেক বই পেলো, যেগুলোতে মোনিং ভ্যালির উল্লেখ আছে। তবে নতুন কিছু জানা গেল না। শেষে ছোট আরেকটা বই খুঁজে পেলো রবিন। পাতাগুলো, হলদে হয়ে এসেছে, কুঁচকানো। তাতে রয়েছে উপত্যকাটার পুরো ইতিহাস, একেবারে ১৯৪১ সাল। পর্যন্ত। ভুল তাকে ভুল জায়গায় ছিলো বইটা, সে-কারণেই বোধহয় খুঁজে পাননি প্রফেসর।

মিসেস হারভের কার্ড দেখিয়ে বইটা ধার নিলো রবিন। বাইরে বিকেলের রোদ তখনও বেশ চড়া, প্যারেড মাত্র. শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে লোকেরা। মোম, বই আর হ্যাঁটের প্যাকেট সাইকেলের ক্যারিয়ারে রেখে চড়ে বসলো দুই গোয়েন্দা। র‍্যাঞ্চে ফিরে চললো।

নামার সময় তো আরামেই নেমেছে, ওঠার সময় কষ্ট হলো। শেষে গিরিপথের কাছাকাছি এসে আর পারলো না। সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগলো।

কিছুদূর উঠে বিশ্রাম নিতে বসলো। তাকালো চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এর দিকে। আলো কম। দূরে এখন আবছা দেখা যাচ্ছে দ্বীপগুলো।

ইস, যদি যেতে পারতাম ওখানে! মুসা বললো।

 শুনেছি, ওখানেও তৃণভূমি আছে। কাউবয়েরা গরু চরায়।

দ্বীপের কিনারে নোঙর করে আছে নেভির নৌ-বহর।

সানতা কারলার দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। শব্দ কানে এলো ছেলেদের, ফিরলো না, ওরা তাকিয়ে রয়েছে সাগরের দিকে। হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলো। প্রচণ্ড গতিতে আসছে গাড়িটা।

লাফিয়ে উঠে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো দুজনে। গাড়ির দুই চাকা রাস্তায়, দুই চাকা রাস্তার বাইরে। সোজা তাদের দিকেই আসছে।

এক ধাক্কায় রবিনকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও সরে গেল মুসা। ধাঁ করে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল গাড়িটা, নাক ঘুরিয়ে উঠে পড়লো রাস্তায়। চলে যাচ্ছে।

গা বাঁচাতে গিয়ে বেশি সরে গেছে দুজনে। ঢালের কিনারে। তাল সামলাতে পারলো না। পিছলে, গড়িয়ে পড়তে লাগলো ঢাল বেয়ে। নিচে গভীর খাদ।

.

১০.

গড়িয়ে পড়ছে মুসা। চোখা পাথর আর কাঁটাগাছে লেগে কেটেছিলে যাচ্ছে চামড়া। পাগলের মতো থাবা মারছে, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে গাছের গোড়া, পাথর। হাত পিছলে যাচ্ছে। গাছ যেটাও বা ধরতে পারছে, তার ভর রাখার মতো শক্ত নয়, উপড়ে যাচ্ছে। আর ফুট চারেক পরেই ঢাল শেষ, তার পরে শূন্যতা। বাঁকা হয়ে থাকা বড় একটা গাছের ওপর আছড়ে পড়লো সে, সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো গাছের কাণ্ড। হউফ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত গাছ ধরে ঝুলে রইলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তারপর লক্ষ্য করলো, সে একা। চেঁচিয়ে ডাকলো, রবিন!

সাড়া নেই। নিচে নিঃসীম কালো খাদ হাঁ করে রয়েছে।

রবিন! আরও জোরে ডাকলো।

বাঁয়ে মৃদু নড়াচড়া। ঘন ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি দিলো রবিনের মুখ। আমি..আমি ভালোই আছি। দুর্বল কণ্ঠস্বর। কার্নিশের মতো বেরিয়ে আছে…কিন্তু পা নাড়াতে পারছি না!

চেষ্টা করো। খুব আস্তে।

অপেক্ষা করছে মুসা।

নড়ছে ঝোপটা। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, হ্যাঁ, পারছি এবার। ভাঙেনি। গায়ের নিচে বেকায়দা ভাবে চাপা পড়েছিলো। ব্যথা করছে খুব।

ক্রল করে উঠতে পারবে?

জানি না। ওপর দিকে তাকাতেই ভয় লাগছে, যা খাড়া!

পড়লে একেবারে… কেঁপে উঠলো মুসার গলা, কথাটা শেষ হলো না।

চেঁচালে কেমন হয়? কেউ না কেউ শুনতে পাবে।

শুরু করো। কিন্তু চিৎকার, বেরোলো না মুসার গলা দিয়ে, শুধু খসখস শব্দ। আসলে চিৎকার করলোই না। সবে মুখ খুলেছে, এই সময় ওপরে ঢালের কিনারে দেখতে পেলো একটা মুখ। নিচে উঁকি মারছে। গালে কাটা দাগ, চোখে পট্টি।

পুরো দশ সেকেণ্ড চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো দুজনে। তারপর সরে গেল। মুখটা। দৌড়ে যাওয়া পদশব্দ, গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার আওয়াজ, মেটাল। বাধানো পথে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। চলে গেল গাড়িটা।

ওটার এঞ্জিনের আওয়াজ মিলাতে না মিলাতেই অন্য গাড়ির শব্দ শোনা গেল।

চেঁচাও! বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলো মুসা।

পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হলো দুজনের চিৎকার। ওপরে ব্রেক কষার শব্দ হলো। ভারি জুতোর আওয়াজ। দুটো মুখ উঁকি দিলো ঢালের কিনারে।

খানিক পরেই নেমে এলো মোটা দড়ি। কোমরে কয়েক প্যাঁচ দিয়ে মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখলো মুসা। টেনে ওপরে তুলে নেয়া হলো তাকে।

রবিনও উঠে এলো। ভাঙা পা-টা দেখলো ভালো করে। মনে হলো, চমকেছে। দড়ি ফেলেছে যে লোকটা, সে ট্রাক ড্রাইভার। জানালো, হারভে র‍্যাঞ্চের দিকেই যাচ্ছে। ছেলেরা কোথায় যাবে শুনে নিজে থেকেই লিফট দেয়ার কথা। বললো। মিনিট পনেরো পরে সাইকেল সহ র‍্যাঞ্চের গেটে নামিয়ে দিয়ে গেল তাদেরকে। ড্রাইভারকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে, হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা।

ঘর থেকে বেরিয়ে দুজনকে দেখে থমকে গেলেন মিসেস হারভে। সর্বনাশ! কি হয়েছে? এরকম অবস্থা কেন?

বলতে গিয়ে পায়ে রবিনের আলতো লাথি খেয়ে চুপ হয়ে গেল গলা।

বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়েছি, রবিন বললো। ঢলে গড়িয়ে পড়লাম, গিরিপথের কাছে। পায়ে ব্যথা পেয়েছি। একজন ট্রাক ড্রাইভার তুলে এনে নামিয়ে দিয়ে গেল।

দেখি, পা-টা? এগিয়ে এলেন মিসেস হারভে।

র‍্যাঞ্চের মহিলারা সাধারণত নার্সিঙের কাজে ওস্তাদ, এসব শিখতে হয়। তাদের। মিসেস হারভেও ব্যতিক্রম নন। টিপেটুপে দেখে বললেন, সামান্য মচকেছে। ডাক্তার কিংবা ওষুধ লাগবে না, তবে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে রবিনকে। বারান্দায় একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে গিয়ে লেমোনেড নিয়ে এলেন।

মুসা আমান, তুমি কাজ করতে যাও, বললেন তিনি। মিস্টার হারভে এখনও ফেরেননি। সামনের কোরালের ঘোড়াগুলোকে খড় খাওয়াও গিয়ে।

যাচ্ছি।

চেয়ারে পা তুলে দিয়ে, আরাম করে ছায়ায় বসে লেমোনেড খেতে খেতে মুসার দিকে চেয়ে হাসছে রবিন। রোদের মধ্যে কাজ করে ঘেমে সারা হচ্ছে গোয়েন্দাসহকারী। রবিনের হাসি দেখলো, কিন্তু মন খারাপ করলো না। কাজ করতে ভালোই লাগছে তার। পেশীতে জোর বাড়ছে।

সাপারের আগে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের পুরনো ট্রাকটা এসে থামলো র‍্যাঞ্চ হাউসের বাইরে। ড্রাইভিং সীটে বোরিস, পাশে বসে আছে কিশোর। নামলো সে। মালপত্র নামাতে তাকে সাহায্য করলো মুসা। স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো ছাড়াও ছোট আরেকটা রহস্যময় প্যাকেট রয়েছে, ভেতরে কি বুঝতে পারলো না সে। গোলাঘরে রাখা হলো মালগুলো।

বোরিস না খেয়ে যেতে পারবে না, বলে দিলেন মিসেস হারভে।

বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান লোকটার চওড়া কাঁধ আর হাতের পেশীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালেন মিস্টার হারভে। ভাবলেন, এরকম একজন লোক র‍্যাঞ্চে থাকলে খুব সাহায্য হতো।

র‍্যাঞ্চে কাজ করতে আপনার কেমন লাগে, বোরিস? জিজ্ঞেস করলেন। তিনি। আপনাকে পেলে দশজনকে ছেড়ে দিতে পারতাম।

আপনাদের লোক দরকার, কিশোর গিয়ে বলেছে, জানালো বোরিস। কয়েক হপ্তার জন্যে আমাকে, আর আমার ভাই রোভারকে এখানে কাজ করতে দিতে রাজি আছেন মিস্টার রাশেদ পাশা।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে মিস্টার হারভে বললেন, তার বোধহয় দরকার হবে না। গোলমালটা সাময়িক, শীঘ্রি সব ঠিক হয়ে যাবে। পেদ্রো বলেছে সে ভয় পায়নি। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে শ্রমিকদের বোঝাবে বলে দিয়েছে।

তাই বলেছে বুঝি? খুব ভালো, বললেন মিসেস হারভে।

মুখ কালো করে ফেললেন মিস্টার হারভে। কিন্তু ওর ফিরতে সময় লাগবে। আর এর মাঝে আবার কোনো অঘটন ঘটে গেলে কাউকে রাখা যাবে না। শেরিফও কিছু করতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেনরি ফিগারোর কোনো ছেলেটেলে ছিলো না। পট্টিওয়ালা লোকটা কে, তা-ও জানতে পারেনি।

এতো উতলা হচ্ছো কেন? সান্ত্বনা দিলেন প্রফেসর। ব্যাখ্যা একটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আসল কারণটা জেনে ওদেরকে জানাতে পারলেই ভয় দূর হয়ে যাবে। টাইম লাগবে আরকি; এই যা।

জানা যে যাবে, এ-ব্যাপারে শিওর হতে পারলেও হতো, বললেন মিস্টার হারভে।

আলোচনা চললো।

 খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়ে ট্রাকে গিয়ে উঠলো বোরিস।

প্রফেসরও বেরোলেন। ইউনিভারসিটিতে যাবেন, একটা ক্লাস নিতে হবে। মিস্টার হারভের অনেক কাজ জমে রয়েছে র‍্যাঞ্চে। তিনিও গেলেন।

তিন গোয়েন্দা চলে এলো নিজেদের বেডরুমে।

 দরজা বন্ধ করলো রবিন।

এখন কি করা? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

পাথরটা কি হীরা? জানতে চাইলো রবিন।

হাসলো কিশোর। হীরাই। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মণ্ড। দাম খুবই কম। কোথায় পেয়েছি শুনে চোখ কপালে তুললল লস অ্যাঞ্জেলেসের এক ডায়মণ্ড এক্সপার্ট।

বিশ্বাসই করতে চায় না। ওর ধারণা, ওটা আফ্রিকান পাথর। কয়েকটা টেস্ট করবে। রেখে দিয়েছে পাথরটা। বলেছে, টেস্ট সেরেই এখানে ফোন করবে।

খাইছে!

মোম আর হ্যাট এনেছো?

এনেছি, বললো মুসা।

আর মোনিং ভ্যালির ওপরে লেখা একটা বই, রবিন বললো।

সানতা কারলায় যাওয়ার শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা কিশোরকে জানালো। দুজনে।

গাড়িটার নম্বর দেখেছো?

সময় পেলাম কোথায়? মুসা বললো। তবে নম্বর প্লেটটা দেখেছি এক পলক, নীল আর শাদা।

হুমম। মনে হচ্ছে নেভাডার রেজিস্ট্রেশন। গাল-কাটা লোকটা এসে তাকিয়েছিলো তোমার দিকে, না?

আমরা মরেছি কিনা দেখতে এসেছিলো হারামজাদা, রেগে গেল মুসা। মেরে ফেলতো। অন্যান্য গাড়ি আসতে দেখে পালিয়েছে।

হয়তো নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। শহরে প্রফেসরের সঙ্গেও দেখা হয়েছে, না?

ডিন মারটিন আর কার্ল বেইরির সঙ্গেও। তিনজনই গিয়েছিলো, রবিন মনে করিয়ে দিলো।

গিরিপথটা এখান থেকে দূরে নয়, যুক্তি দেখালো কিশোর। র‍্যাঞ্চের কেউ গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারে, তাতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না।

তা ঠিক।

তবু, নেভাডার লাইসেন্স প্লেট, আরেকবার ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। এখানে কারও গাড়ি…সবারই ক্যালিফোর্নিয়ার রেজিস্ট্রেশন।

আমাদের অচেনা কারও কথা বলছো? মুসার প্রশ্ন।

হতেও পারে, বললো রবিন। পট্টিওয়ালাকেই তো আমরা চিনি না।

হু, মাথা দোলালো কিশোর। চলো, কাজ শুরু করি। আমি চট করে বইটা উল্টে নিই। তোমরা গিয়ে স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো চেক করো। ট্যাংকগুলো কোনো কিছুতেই জড়িয়ে নেবে, যাতে দেখে কেউ চিনতে না পারে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলে নিও। মোমের প্যাকেট, হ্যাট, আর আমি যে পোঁটলাটা এনেছি, ওটাও নিও।

তোমার উদ্দেশ্যটা কি?

যেতে যেতে বলবো। হাতঘড়ি দেখলো কিশোর। জলদি করতে হবে। নইলে সূর্য ডোবার আগে মোনিং ভ্যালিতে পৌঁছুতে পারবো না। আজ রাতেই হয়তো রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারবো।

আধঘন্টা পর গোলাঘরে ঢুকলো কিশোর। হাতের বইটা নাড়লো। জবাব বোধহয় পেয়েছি, ঘোষণা করলো সে। এতে বলছে, পঞ্চাশ বছর আগে ডেভিল মাউনটেইনে খনির বেশির ভাগ শ্যাফট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সোনাদানা কিছু। পায়নি, তাই বন্ধ করেছে। সেই সময়ই বন্ধ হয়ে যায় গোঙানি।

তারমানে ওগুলোর কোনোটা নতুন করে ভোলা হয়েছে? রবিন বললো। আর ওটা দিয়ে বাতাস পাস করে বলেই শব্দ হয়।

সে-রকমই তো মনে হয়। তবে প্রশ্ন আছে। যাকগে, তোমরা রেডি?

রেডি, বললো মুসা।

 বেশ। হ্যাট পরো। আমাকে একটা দাও। পরে এখান থেকে বেরোবো।

চটের বস্তায় ট্যাংকগুলো জড়িয়ে নিয়েছে। হ্যাট পরে মালপত্র নিয়ে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। সাইকেলে চাপলো। ক্যারিয়ারে ভারি বোঝা, ঝাঁকুনি লাগলেই মাতালের মতো টলছে, বেশ কায়দা করে ব্যালান্স রাখতে হচ্ছে। সাবধানে হ্যাণ্ডেল ধরে রেখে প্যাডাল ঘোরালো ওরা।

ব্যথায় আঁউক করে উঠলো রবিন।

কি হলো? পায়ে খুব লাগছে? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। কিশোর, তোমরা যাও। আমি বোধহয় পারবো না। থেকেই যাই।

চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো কিশোর। না থাকতে হবে না, রবিন। তোমার ওই মচকানো পা সুবিধেই করে দিলো। ফাঁকি দেয়া সহজ হবে।

ফাঁকি? ভুরু কোঁচকানো মুসা।

ওই যে মিলিটারি ক্লাসিক পদ্ধতিঃ ক্যাম্পের আগুন আর গাছের কাণ্ড, দেখতে লাগে কামানের মতো, খুব সহজ ব্যাখ্যা দিলো কিশোর, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না মুসা। রবিন, তোমার ইকুইপমেন্ট খুলে রেখে এসো। বোঝ না থাকলে সাইকেল চালাতে কষ্ট হবে না।

চেষ্টা করে দেখলো রবিন। চালাতে পারলো। গেটের দিকে এগোলো তিনজনে। বারান্দা থেকে হাত নাড়লেন মিসেস হারভে। বেশি দেরি করো না কিন্তু। সাবধান থেকো।

র‍্যাঞ্চের বাইরে এসেই মুখ ঘোরালো ওরা, মোনিং ভ্যালির দিকে চললল। সেই লোহার গেটটার কাছে পৌঁছে থামলো। সাইকেল আর মালপত্র লুকানো ঘন ঝোপের ভেতরে।

শোনো, কিশোর বললো। গুহায় ঢুকবো আমরা। এমনভাবে, যাতে কেউ দেখে না ফেলে।

বুঝলাম, কান চুলকালো মুসা। গোঙানি-ব্যাটাকে অবাক করে দেবো।

ঠিক। আমার ধারণা, এই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছে আমাদের ওপর।

 কি করে ফাঁকি দেবো ওকে? রবিনের প্রশ্ন।  

পানির নিচ দিয়ে যাবো। ইকুইপমেন্টগুলো কেন আনলাম? হিসেব করে দেখেছি, এখন জোয়ার। সৈকত আর গুহামুখটা পানির তলায়।

 তাতে কি ওরা দেখবে না?

দাঁত বের করে হাসলো গোয়েন্দাপ্রধান। ডিকয় পদ্ধতির নাম শুনেছো? তা-ই ব্যবহার করবো। আর্মিরা ব্যবহার করে। রাতে ক্যাম্পের আগুন জ্বেলে রেখে অন্ধকারে চুপি চুপি কেটে পড়ে।

তোমার কথাবার্তা..

মুসাকে কথা শেষ করতে দিলো না কিশোর। ডেভিল মাউনটেইনের চূড়ায় বসে বাঁ-দিকের পথের নিচের অংশ দেখা যায় না, বুঝতে পেরেছি। ওখান দিয়েই নামবো।

 গেট ডিঙালো ওরা। তারপর বাঁয়ের পথ ধরে চললো। চূড়াটা চোখের আড়াল হতেই বললো কিশোর, থামো। কাঁধ থেকে বোঝা নামালো। খুলতে শুরু করলো রহস্যময় পোঁটলাটা।

আরি! এ-তো দেখি খালি পুরনো কাপড়? মুসা বললো।

এরকম কাপড়ই তো পরে আছি আমরা! রবিনও অবাক।

সে-জন্যেই তো এনেছি। ভেতরে লতাপাতা ঢুকিয়ে মানুষ বানাবো। নাও, শুরু করো। তারপর শুইয়ে রাখবো।

দেখতে দেখতে দুটো ডামি তৈরি হয়ে গেল। মুসা আর কিশোরের

গলার ওপর সমব্রেরো ফেলে রাখলে মনে হবে মাথায় পরেছে! ধীরে ধীরে। বুঝতে পারছে মুসা।

হ্যাঁ, বললো কিশোর। দূরে, পাহাড়ের চূড়া থেকে তা-ই মনে হবে। রবিন। থাকছে এখানে। মাঝেসাঝে নড়াচড়া করবে। ওখান থেকে যে চোখ রাখছে, সে ভাববে আমরাই। সন্দেহ করবে না।

ডামিগুলো পথের ওপর রাখা হলো। পাশে বসে রইলো রবিন। পর্বতের চূড়া থেকে যে-ই থাকুক, মনে করবে, তিনিটে ছেলে ঢালের কিনারে হেলান দিয়ে বসে সাগর দেখছে।

ঢালের আড়ালে থেকে সরু পথ বেয়ে নিচের সৈকতে নামতে লাগলো, কিশোর আর মুসা। নিচে একটা সুবিধেজনক জায়গায় এসে ডুবুরির পোশাক পরে নিলো। পিঠে বাঁধলো এয়ার-ট্যাংক।

ঢেউয়ের জোর আজ কম, বললো কিশোর। সাঁতরাতে সুবিধেই হবে। আমাদের।

পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না, বললো দক্ষ সাঁতারু মুসা। ডুবুরির পোশাক পরে পানির তলায় ডুব দেয়া তার ভারি পছন্দ।

আমার আরেকটু বেশি লাগতে পারে।

এখন কথা হলো, নিচ দিয়ে পুরোটা পথ যাওয়া যাবে কিনা।

অসুবিধে নেই। ভেসে উঠবো। ডিকয় সাজিয়ে দিয়ে এসেছি। এদিকে নজর রাখার কথা ভাববে না কেউ।

ব্রীদিং টিউব ঠিক করে, মুখে মাউথপীস এঁটে পানির দিকে চললো ওরা। পানিতে নেমে হারিয়ে গেল ঢেউয়ের তলায়।

<

Super User