এই যে, এসেছিস, কিশোরকে দেখে বললেন মেরিচাচী, ইনি মিস্টার জন ফেরেনটি। আর্ট ডিলার। হল্যাণ্ড থেকে এসেছেন। তোর সঙ্গে কথা বলতে চান। গত হপ্তায় কতগুলো ছবি কিনে আনলি না, ওগুলো সম্পর্কে। লোকটার দিকে ফিরলেন। আপনারা কথা বলুন। আমি যাই।

অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন মেরিচাচী।

আর্ট ডিলারের কালো চোখের দিকে তাকাতেই ভয় লাগে। অ্যামস্টারডাম থেকে এসেছি আমি, ভোঁতা কণ্ঠস্বর, রিগ ডেনবারের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলাম মরে গেছে। তারপর শুনলাম, তার ছবিগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে তিন গোয়েন্দা। এখানে তোমরা খুবই পরিচিত, ঠিকানা বের করতে মোটেই অসুবিধে হলো না। ছবিগুলো কিনতে এসেছি। পেয়েছো?

মাথা নাড়লো মুসা। না।

একটাও না? গম্ভীর হয়ে বার দুই পায়চারি করলো ফেরেনটি, তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকালো ছেলেদের দিকে। ভালো দাম দেবো।

শুঁটকি টেরি একটা ছবি নিয়ে এসেছিলো, বলে ফেললো রবিন। কিন্তু…

ওলন্দাজ লোকটার কাঁধের ওপর দিয়ে ইয়ার্ডের গেটের দিকে তাকিয়েছিলো কিশোর, ঝট করে মাথা ফেরালো, কিন্তু ওটা আসল না। মানে রিগ ডেনবারের ছবি না।

রিগ ডেনবারের নয়?

না।

গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করছে রবিন আর মুসা ৷ মিথ্যা কথা বলছে কেন? নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। চুপ করে রইলো ওরা।

তিনজনের দিকেই একে একে তাকালো জন ফেরেনটি। মিছে কথা বলছো তো?

নাহ, মাথা নাড়লো কিশোর।

শুঁটকি টেরি না কি একটা নাম যেন বললে? ঢেঙা, পাতলা ছেলেটা?

আপনি চিনলেন কিভাবে? অবাক হলো মুসা।

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ফেরেনটি বললো, পরিবারটা ধনী, না? আর্ট কালেকশন আছে? ছবি কেনে?

কিছু তো বোধহয় আছেই, রবিন শিওর না।

আসলে, শুঁটকি টেরিকে আমরা ভালোমতো চিনিই না, স্যার। এখানকার ছেলেরা শুঁটকি শুঁটকি করে তো, তাই আমরাও বলছি। কোথায় থাকে, তা-ও জানি না। নির্জলা মিথ্যেগুলো এমনভাবে বলে গেল কিশোর, মুসা আর রবিনেরই বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো।

তারমানে আমাকে সাহায্য করবে না? কড়া চোখে তাকালো ফেরেনটি।

করতে পারলে তো খুশিই হতাম, স্যার।

হু। বেশ, যদি ছবিগুলো তোমাদের হাতে আসে, আমাকে মোটেলে ফোন করো। প্যারাডাইজ মোটেল। ঠিক আছে? মনে রেখো, ভালো দাম দেবো।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর।

ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো ফেরেনটি। অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে। চেয়ে রয়েছে রবিন আর মুসা।

কিশোর! লোকটা দূরে সরে গেলে বললো রবিন। দেখেছো…

হ্যাঁ, আগেই খেয়াল করেছি। পাথরের ওপর পড়ে লেগে থাকতে পারে।

ওকেই তাড়া করেছিলাম সেদিন?

এজন্যেই মিছে কথা বলেছো? মুসা বললো।

হ্যাঁ, সেটা একটা কারণ।

আরেকটা? জানতে চাইলো রবিন।

ওর গাড়ি। এখনও খেয়াল করোনি?

জাঙ্কইয়ার্ডের বাইরে গেটের ধারে পার্ক করা ছোট নীল সেডানটাতে উঠছে ফেরেনটি। স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।

কাউন্টেসের গাড়ির পিছু নিয়েছিলো ওটাই! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

আর আমি কিনা শুঁটকির কথা সব বলে দিলাম! ছবির কথাও! কপালে হাত রাখলো রবিন।

না, তেমন কিছু বলোনি, সান্ত্বনা দিলো কিশোর। আমার ধারণা, শুঁটকির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে ফেরেনটি। কাজেই তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমাদের। ওর আগেই গিয়ে শুঁটকিকে ধরতে হবে।

দেরি করছি কেন তাহলে? চলো চলো, তাড়া দিলো মুসা।

কিন্তু আমি তো এখন যেতে পারছি না, রবিন বললো। বাড়িতে কাজ আছে। মা যেতে বলে দিয়েছে।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে কিশোর বললো, যাও। হোমিং ট্রান্সমিটার নিয়ে আমরা যাচ্ছি। তোমার কাজ শেষ হলে রিসিভারটা নিয়ে চলে যেও ওখানে। দেরি হবে?

না না, তা হবে না।

বেশ, এসো তাহলে।

.

সৈকতের ধারে অনেকগুলো বাড়ি। সরু একটা পথের ধারে রেডউডে তৈরি বিশাল বাড়িটা ডয়েলদের। রাস্তা থেকে সরু একটা গলি বেরিয়ে ওদেরটা, আর আরেকটা বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। পথের ধারে, বাড়িগুলোর আশপাশে, সব জায়গায়ই পামের সারি আর হিবিসকাসের ঘন ঝড়।

বড় একটা ঝাড়ের ধারে সাইকেল থেকে নামলো মুসা আর কিশোর। ওখান থেকে ডয়েলদের বাড়িতে ঢোকার দুটো গেট দেখা যায়–সামনের বড়টা, আর এক পাশের ছোট একটা। গ্যারেজের দরজাও দেখা যায়। টেরিয়ারের স্পোর্টস কারটা ভেতরেই রয়েছে।

আগে ওর সঙ্গে কথা বলি। সাইকেল ঠেলে নিয়ে এগোলো কিশোর। পাশে চললো মুসা।

ডাক শুনে দোতলার একটা জানালা খুলে মুখ বের করলো টেরিয়ার। আরে, শার্লকের বাচ্চারা যে! তা কি মনে করে? পুরনো শত্রু

ছবিটা কিনতে এসেছি, শুঁটকি, বললো মুসা।

হেসে উঠলো টেরিয়ার। কান পাতলো। ভালো শুনি না। কি করতে এসেছো? নাচতে?–

ছবিটা এখনও তোমার কাছেই আছে, শুঁটকি, কিশোর বললো। আমি জানি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি তো সবই জানো। জলদি বেরোও। নইলে পুলিশকে ফোন করবো। বলবো, চুরি করতে ঢুকেছে।

গালিটা এসে গিয়েছিলো মুসার মুখে, অনেক কষ্টে সামলে নিলো।

ফিরে চললো দুজনে। সেই ঘন ঝাড়টার কাছে এসে সাইকেল রেখে লুকিয়ে রইলো।

সৈকতের ওদিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে গ্যারেজে ঢুকবো, বললো কিশোর। ওর .. গাড়িতে লাগিয়ে দেবো তোমারটা। তুমি চোখ রাখ। শুঁটকিকে বেরোতে দেখলেই শিস দিয়ে হুঁশিয়ার করবে আমাকে।

ঠিক আছে।

ঝোপ থেকে বেরোনোর জন্যে ঘুরেই স্থির হয়ে গেল কিশোর। আরি! ওই লোকটা কে?

মুসাও দেখলো। ডয়েলদের বাড়ির একধারে সরু একটা পথের মোড়ে লোকটা। পরনে ইউনিফর্ম। মাথার ক্যাপটা কপালের ওপর টেনে দেয়া। চোখ আড়াল করতে চাইছে বুঝি। হাতে ভারি একটা ব্যাগটুল কিট-ওটার ভারে। কাত হয়ে হাঁটছে।

টেলিফোন মিস্ত্রী, চেপে রাখা নিঃশ্বাস আস্তে করে ছাড়লো মুসা।

ডয়েলদের বাড়িতে ঢুকে গেল লোকটা।

ভ্রূকুটি করে কিশোর বললো, লাগলো তো সেরকমই। কিন্তু…

কিন্তু কি?

না, কিছু না। নির্জন, শূন্য পথের দিকে তাকালো কিশোর। কোথায় যেন একটা ঘাপলা হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।

তুমি যাও। আমি কড়া নজর রাখবো।

মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলো কিশোর।

.

ডয়েল আর তাদের প্লাশের বাড়ির মাঝখান থেকে গভীর নালা নেমে এসেছে। সৈকতে। গরমকালে এখন শুকনো। লুকিয়ে থাকার উপযুক্ত জায়গা। আর এটার ভেতর দিয়ে গ্যারেজে উঠে যাওয়াও সহজ, কারও চোখে পড়বে না।

উঠতে শুরু করলো কিশোর। টেরিয়ারকে কোথাও দেখা গেল না। হোমার ট্রান্সমিটারটা শেষবারের মতো চেক করলো সে। শক্তিশালী একটা চুম্বক লাগানো রয়েছে, গাড়ির বডিতে লাগিয়ে দিলে শত ঝাঁকুনিতেও খুলে পড়বে না।

আবার এগোতে শুরু করলো সে। কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। টেলিফোনের মিস্ত্রী বাড়ির চারপাশে এক চক্কর ঘুরে এখন এগিয়ে আসছে গ্যারেজের দিকে। তারটা খুঁজে বের করলো, যেখান দিয়ে মূল বাড়িতে ঢুকেছে। যন্ত্রপাতি বের করে ঝুঁকলো ওটার ওপর।

হঠাৎ বুঝে ফেললো কিশোর, গোলমালটা কোথায়। মিস্ত্রী এসেছে, কিন্তু ভ্যান গাড়ি নেই। কে কবে শুনেছে, ভ্যান ছাড়া টেলিফোন মিস্ত্রী কাজ করতে আসে? ব্যাটা ছদ্মবেশী! তারমানে হলো, হয় তার কাটছে, কিংবা তারের সঙ্গে চোরা লাইন লাগাচ্ছে, যাতে সূব কথাবার্তা চুরি করে শুনতে পারে। এখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে গেলে লোকটার চোখে পড়ে যেতে পারে, তাই হামাগুড়ি দিয়ে। দ্রুত এগোলো কিশোর। কি করছে লোকটা, জানতে হবে।

চলে এলো একেবারে নালার মাথার কাছে। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে। কয়েক : সেকেণ্ড চুপ করে পড়ে থেকে দম নিয়ে আস্তে মাথা তুললো।

চমকে উঠলো ভীষণ ভাবে! মিস্ত্রীর চোখে চোখ পড়ে গেছে। মাত্র ফুটখানেক তফাতে রয়েছে লোকটার মুখ। বুকের ভেতর কাঁপুনি তুলে দেয়া ভীষণ একজোড়া চোখ। কালো। জন ফেরেনটি!

হাতে মস্ত এক ছুরি!

.

ঝাড়ের ভেতরে ঘাপটি মেরে রয়েছে মুসা। টেরিয়ার কিংবা কিশোর, কারোরই দেখা নেই। রবিনও আসছে না এখনও।

মুসাআ!

সৈকতের দিক থেকে শোনা গেল চিৎকারটা।

 মুসাআ! বাঁচাও!

হুড়মুড় করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। ঘুরেই দৌড় দিলো শব্দ লক্ষ্য করে। সরু পথ ধরে ছুটে গিয়ে বাড়ির পেছনে মোড় নিতে যাবে, এলো প্রচণ্ড বাধা। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো একটা শক্তিশালী থাবা, মুচড়ে নিয়ে গেল। পেছনে পিঠের ওপর, আরেকটা হাত চেপে ধরলো তার মুখ। যাতে চিৎকার করতে না পারে। আটকা পড়লো সে-ও।

.

০৭.

ঝাড়ের কাছে সাইকেল দুটো দেখতে পেলো রবিন। কিন্তু মুসা আর কিশোর কোথায়? মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, নির্জন পথ। কেউ নেই, কোনো নড়াচড়া। নেই।

হঠাৎ একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো ডয়েলদের বাড়ির ধারে। দুটো বাড়ির মাঝের সুরু গলি থেকে শাঁ করে বেরিয়ে এলো নীল সেডানটা। তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় কর্কশ আর্তনাদ তুললো টায়ার।

আর্ট ডিলারের গাড়ি! জন ফেরেনটি এখানে কি করছিলো?

 বিপ বিপ বিপ বিপ! বেজে উঠলো রবিনের পকেটে রাখা রিসিভার। একটানে বের করে দেখলো কাটাটা পথের দিকে নির্দেশ করছে, ধীরে ধীরে কমে আসছে। জোরালো বিপ বিপ। কি ঘটেছে, বুঝে ফেললো সে।

হোমারটা টেরিয়ারের গাড়িতে লাগাতে পারেনি কিশোর কিংবা মুসা। ধরা। পড়েছে। তাদেরকে বন্দী করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ফেরেনটি।

চোখের আড়ালে চলে গেছে নীল গাড়িটা। বোঝার পর আর বিন্দুমাত্র সময়। নষ্ট করলো না রবিন, সাইকেল নিয়ে ছুটলো ওটার পেছনে। চলতে চলতে উঠে এলো উপকূলের প্রধান সড়কে।

বাঁয়ে মোড় নিলো বিপ বিপ। রকি বীচের উত্তর সীমানার দিকে চলেছে নীল সেডান। ইতিমধ্যে দুই বার সংযোগ হারিয়েছে রবিন, তারপর আবার খুঁজে পেয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সাইকেল নিয়ে পেরে উঠছে না গাড়িটার সাথে, পারার কথাও নয়। বোধহয় ট্রাফিক পোস্টের লাল আলো জ্বলায় থামতে বাধ্য হয়েছিলো ফেরেনটি, সেই সুযোগেই দুবার কাছে চলে গিয়েছিলো রবিন।

মুহূর্তের জন্যে থামছে না সে, গতি কমাচ্ছে না।

তার পরেও তৃতীয়বার সংযোগ হারালো। নীরব হয়ে গেল রিসিভার।

উত্তেজনা আর পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে রবিন। বুকের খাঁচায় যেন পাগল হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডটা। কিন্তু থামলো না সে। দ্রুত প্যাডাল করে এগিয়ে চললো কোস্ট হাইওয়ে ধরে। সামনে পাতলা হয়ে আসছে শহর, খোলা অঞ্চল দেখা যাচ্ছে।

.

টেলিফোনের তার দিয়ে হাত-পা বেঁধে, মুখে রুমাল গুঁজে মুসা আর রবিনকে গাড়ির বুটে ঢুকিয়ে দিয়েছে ফেরেনটি। হাত বেঁধে ফেলার আগেই সেই সুযোগে হোমারের সুইচটা অন করে দিতে পেরেছে কিশোর। মনে মনে এখন লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে, আগে আরও ভালোমতো খেয়াল করেনি বলে। ট্রেরিয়ারদের বাড়িতে ঢোকার সময়ও খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো ফেরেনটি। তবে দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। ভালো করে লক্ষ্য করলে অবশ্যই বুঝতে পারতো কিশোর। আর তাহলে এখন এই বিপদে পড়তে হতো না।

পথে বার দুই থেমেছে গাড়ি।

তৃতীয়বার থামলো। এঞ্জিন বন্ধ হলো। কিশোর আন্দাজ করলো, মিনিট দশেক পেরিয়েছে।

উঠে গেল বুটের ডালা। টেনে ছেলেদেরকে বুট থেকে বের করলো ফেরেনটি। তারপর একজন একজন করে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ছোট মোটেলের শেষ মাথার একটা ঘরে। ইতিমধ্যে ছেলেদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি আর্ট ডিলার।

 পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসিয়ে ছেলেদের মুখের রুমাল খুলে দিলো। ফেরেনটি। বড় ছুরিটা বের করে হাতে নিয়ে ছেলেদের মুখোমুখি বসলো। চোখের দৃষ্টি ভীষণ। তারপর? পুঁটকি টেরিকে চেনো না, না? ও আসল ছবি আনেনি? মিথ্যুক কোথাকার। তোমরা ওই ছবি চুরি করতে গিয়েছিলে।

চুরি বলছেন কেন? গরম হয়ে বললো মুসা। ওই ছবির আসল মালিক কাউন্টেস। তার জন্যেই কিনে আনতে গিয়েছিলাম।

তাই? কাউন্টেস আর ব্রাউনের হয়ে কাজ করছো তাহলে? কি কি বলেছে ওরা?

বলেছে কাউন্টেসের পারিবারিক জিনসগুলো উদ্ধার করতে চায়, জবাব দিলো কিশোর। সবই পেয়েছি আমরা, ছবিগুলো ছাড়া।

আবার মিথ্যে কথা। আরও কিছু জানো তোমরা। ব্রাউনের প্ল্যান কি? ওরা। আসলে কি খুঁজছে? ওদের কাছে কি মেসেজ পাঠিয়েছিলো রিগ ডেনবার?

আমরা শুধু জানি, মেজাজ দেখিয়ে বললো মুসা। আপনি সারাক্ষণ কাউন্টেসকে ফলো করেছেন। হপ্তাখানেক আগে গিয়েছিলেন প্রফেসর এলউড হোফারের বাড়িতে…।

তাড়াতাড়ি মুসাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বললো, কাউন্টেসকে মেসেজ পাঠিয়েছে ডেনবার, একথা কেন মনে হলো আপনার? আর…

দেখো, আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করো না, ধমক দিয়ে বললো ফেরেনটি। মুসার দিকে তাকালো। এই, তুমি কি বলছিলে? প্রফেসর হোফারের বাড়িতে গিয়েছিলাম?

 ঢোক গিললো মুসা। বুঝতে পেরেছ, কিশোর চায় না, কথাটা ভাঙুক। হপ্তাখানেক আগে রেমুডা ক্যানিয়নে প্রফেসরের বাড়িতে চোর ঢুকেছিলো, একথা ফেরেনটিকে জানাতে চায় না।

 মুসাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভয়াল ভঙ্গিতে ছুরিটা নাচালো ওলন্দাজ।

ইয়ে মানে, ছুরিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো মুসা, কাউন্টেস আর ফ্রেড ব্রাউন যেদিন প্রফেসরের বাড়িতে প্রথম, গেছে, আপনিও সেদিন গিয়েছিলেন।

জ্বলন্ত চোখে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ফেরেনটি। না। সেকথা বলতে চাওনি। কাউন্টেস এখানে আসার আগেই কেউ একজন গিয়েছিলো প্রফেসরের বাড়িতে। তোমাদের ধারণা, সেই লোকটি আমি। কেন?

চুপ করে রইলো দুজনেই।

তারমানে, আবার বললো ফেরেনটি। বলবে না, ডেনবার কি মেসেজ পাঠিয়েছিলো? প্রফেসর হোফার আর তার ছেলের সঙ্গে অনেক কথা বলেছো তোমরা। ওরা কিছু জানায়নি? ওদেরকেও কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যায়নি বুড়ো, ডেনবার?

 কিসের ইঙ্গিত, স্যার? মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো কিশোর।

আবার দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ফেরেনটি। বাহ! আমি ভেবেছিলাম, তোমরা বোকা। কি করছো, জানো না। উঠে দাঁড়ালো সে। দেখে যা মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চালাক তোমরা। অনেক কিছু জানো, তাই না?

ভুরু কুঁচকে তাকালো ফেরেনটি। শক্ত করে চেপে ধরলো ছুরির হাতল।

.

অনিশ্চয়তায় ভুগছে রবিন। এগিয়ে চলেছে কোস্ট রোড ধরে। ভাবছে, গাড়িটা কি খুঁজে পাবে? আরও এগিয়ে যাবে, নাকি কোথাও থেমে পুলিশের চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করবে?

অনেক ভেবে শেষে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো সে।

চলে এলো শহরের উত্তর প্রান্তে। মোটেলগুলো শুরু হয়েছে এখান থেকে। গভীর আগ্রহে কান পেতে রেখেছে, যাতে রিসিভারের সামান্যতম বিপ শব্দও মিস না করে। নীল সেডানটাকে খুঁজছে দুই চোখ।

.

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে ফেরেনটি। ছুরিটা হাতেই রয়েছে। মিনিট দশেক কাটলো। ভাবেসাবে মনে হয়, মনস্থির করতে পারছে না সে।

হঠাৎ ফিরলো। তোমাদেরকে কি করি, তোমরাই বলো? আমার কাজে বাধা দিয়েছে, ছেড়ে দিলে আরও দেবে।

মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, রিগ ডেনবারের কাছে কি মূল্যবান কিছু…

এই সময় বাজলো টেলিফোন। ঝটকা দিয়ে ঘুরলো আর্ট ডিলার। এমনভাবে। তাকালো যন্ত্রটার দিকে যেন ওটা একটা বিষাক্ত সাপ। ছেলেদের দিকে একবার ফিরে চেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ফোনের কাছে। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো।

হ্যাঁ হ্যাঁ, উজ্জ্বল হলো ফেরেনটির চোখ। কি? একটা ছেলে?… টেরিয়ার?…হ্যাঁ, চিনি ওকে।…না না, এখানে পাঠানোর দরকার নেই। আমিই অফিসে আসছি। রিসিভার রেখে ফিরে চাইলো। টেরিয়ার ডয়েল–যাকে তোমরা চেনোই না–দেখা করতে এসেছে আমার সঙ্গে! কি বুঝলে?

 গোঁ গোঁ করে উঠলো মুসা। তখনই বলেছি, শুঁটকি ব্যাটা কোনো তালে। আছে!

ওকে বিশ্বাস করলে জ্বল করবেন, মিস্টার ফেরেনটি, বললো কিশোর।

তোমাদেরকেও তো বিশ্বাস করতে পারছি না, কাটা জবাব দিলো আর্ট ডিলার। আবার ছেলেদের মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলো দুই গোয়েন্দা। অবধা। খোলী তো দুরের কথা, ঢিলই করতে পারলো না, বরং আরও কেটে বসলো তার। হতাশ হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।

হঠাৎ আবার খুলে গেল দরজা।

 হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রবিন!

 দ্রুত এসে দুজনের বাঁধন খুলে দিলো সে। মুখের রুমাল নিজেরাই খুললো ওরা।

রবিন! বলে উঠলো মুসা। বাঁচালে ভাই। এলে কিভাবে…

হোমারটাকে ফলো করলাম কিছুক্ষণ। তারপর সিগন্যাল হারিয়ে গেল। না থেমে এগিয়ে এলাম কোস্ট রোড ধরে। কোনো সাড়া নেই রিসিভারে। প্রায় ফিরেই যাচ্ছিলাম, এই সময় মনে পড়লো, ফেরেনটি বলেছিলো সে প্যারাডাইজ মোটেলে উঠেছে। চলে এলাম।

খুব ভালো করেছে, প্রশংসা করলো কিশোর। চলো, ভাগি।

কিন্তু শুঁটকি? মনে করিয়ে দিলো মুসা। ওই ব্যাটা এখন মোটেলের অফিসে…

হেসে উঠলো রবিন। শুঁটকি আসবে কোত্থেকে? আমিই মোটেলের রিসিপশনিস্ট সেজে ফোন করেছিলাম। গলাটা ধরতে পারেনি ফেরেনটি। অভিনয় করা সোজা, তাই না কিশোর?

যারা জানে তাদের কাছে সোজাই, বললো কিশোর। বেরোও এখন। সামনের দরজা। কুইক!

বেরিয়ে এলো ওরা। কাউকে দেখা গেল না। তিনজনেই দৌড় দিলো রবিনের সাইকেলের দিকে।

মুসা, তুমি চালাও, বললো কিশোর। আমি পেছনে বসছি। রবিন সামনে বসুক। তোমার একটু কষ্ট হবে আরকি..জলদি!

বড় জোর বিশ গজ এসেছে ওরা, এই সময় পেছনে শোনা গেল উত্তেজিত চিৎকার। যে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা, ওটার সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে। জোরে জোরে হাত নাড়ছে ফেরেনটি। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে লাফিয়ে নামলো দরজার নিচে, দৌড় দিলো। বুঝলো, এভাবে খুঁড়িয়ে দৌড়ে পারবে না সাইকেলের সঙ্গে। ঘুরে আবার ছুটলো মোটেলের দিকে।

গাড়ি আনতে যাচ্ছে! বললো কিশোর। লুকাতে হবে। আশেপাশে তাকালো সে। কোনো জায়গা দেখলো না।

প্যাডালে পায়ের চাপ আরও বাড়ালো মুসা। ভারি বোক্স নিয়েও শাঁই শাঁই করে ছুটেছে।

 আরে এতো তাড়াহুড়োর দরকার নেই বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি রবিন। আসতে পারবে না। ওর গাড়ির ইগনিশনের তার একটাও নেই। সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।

তুমি আজ যা দেখালে না, নথি, এতোক্ষণে হাসি ফুটলো কিশোরের মুখে। মুসা, গতি কমিও না, চালিয়ে যাও…

হু, চালিয়ে যাও, মুখ ভেঙুচালো মুসা। এক সাইকেলে তিনজন, বললেই হলো…

কি করবো, ভাই? তুমি তো তা-ও পারছো, আমি আর রবিন তো চালাতেই পারবো না।

কয়েক মিনিট পর হাইওয়েতে একটা খালি ট্রাক থামালো ওরা। ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে সে ওদেরকে সাইকেল সহ তুলে নিলো পেছনে।

 শহরে ফিরে এলো তিন গোয়েন্দা। টেরিয়ারদের বাড়ির কাছে গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে যার যার সাইকেল বের করে নিলো মুসা আর কিশোর।

 স্যালভিজ ইয়ার্ডে ফিরে, খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো তিনজনে।

জটিল এক রহস্য দানা বাঁধছে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর। ফেরেনটির ধারণা, মূল্যবান কোনো জিনিস ছিলো ডেনবারের কাছে। কিভাবে। পেতে হবে, মেসেজ রেখে গেছে। কাউন্টেস আর ব্রাউনের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করলো কিশোর। কেউ ধরলো না।

সকালে আবার চেষ্টা করবো, বললো গোয়েন্দাপ্রধান। তবে তার আগে রিগ ডেনবারের সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর নেয়া দরকার। লোকটা কে ছিলো, কি। করতো..রবিন, কাল সকালে লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখো। বলা যায় না, কিছু বেরিয়েও পড়তে পারে!

.

০৮.

তাকের দিকে চেয়েই অবাক হয়ে গেল রবিন। আর্টের ওপর লেখা মোটা মোটা বইগুলো বেশির ভাগই নেই। সরে এলো ওখান থেকে।

ভুরু কোঁচকালেন লাইব্রেরিয়ান মিস হকিনস। কি হয়েছে, রবিন?

আর্টের রেফারেন্স বইগুলো নেই। কে নিলো?

একজন লোক, ছোট পড়ার ঘরটায় নিয়ে গিয়ে পড়ছে। লাইব্রেরি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছে। এখনও বেরোয়নি। কালও এসেছিলো। কেন, কোনো বই তোমার দরকার? গিয়ে বলবো দিতে?

না, থ্যাংক ইউ। আমিই যাচ্ছি।

ছোট ঘরটায় ঢুকলো রবিন। পেছন ফিরে বসে আছে লোকটা। টেবিলে একগাদা বই। আরেকটা বইয়ের জন্যে হাত বাড়াতেই মুখটা দেখতে পেলো সে। চমকে উঠলো। প্রফেসর এলউড হোফার।

দ্রুত বেরিয়ে এলো রবিন। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে মাথায়। আর্টের বই পড়ছেন ভাষাবিদ প্রফেসর! উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে। চেয়ার টেনে নিয়ে এমন একটা জায়গায় বসলো, যেখান থেকে দরজা দিয়ে প্রফেসরকে দেখতে পায়। কি পড়ছেন তিনি? ইস্, যদি দেখা যেতো!–

অবশেষে উঠলেন প্রফেসর। বেরিয়ে গেলেন। রবিন ভাবলো, তাঁকে অনুসরণ করবে? না, তাতে বিশেষ লাভ হবে না। নিশ্চয় এখন বাড়ি ফিরবেন তিনি। তার চেয়ে যে কাজ করতে এসেছে সে, সেটাই করে যাবে। রেফারেন্স বইতে রিগ ডেনবারের সম্পর্কে কি লেখা আছে, দেখবে।

.

প্রফেসর হোফার!

হ্যাঁ, কিশোর, বললো রবিন। আর্টের যে কটা বই আছে ওখানে, সব ঘেঁটেছেন।

খাইছে! মুসা বললো। হঠাৎ করে আর্টের বইয়ের ওপর এই আগ্রহ, * কেন?

হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা।

আচ্ছা, প্রফেসরের কথা আপাতত থাক, বললো গোয়েন্দাপ্রধান। তো, রেফারেন্স বইতে রিগ ডেনবারের কথা কিছুই লেখা নেই?

না, একটা শব্দও না।

অন্য কোনো বইতে থাকতে পারে। তবে বোঝা যাচ্ছে, তেমন বিখ্যাত কেউ নয়। তাহলে বড় বড় বই সবগুলোতেই থাকতো।

বড়ই যদি না হবে, ওর, ছবির জন্যে পাগল হয়ে গেছে কেন জন ফেরেনটি? মুসার প্রশ্ন।

এমনও হতে পারে, রবিন বললো। আসলে ছবি খুঁজছে না লোকটা। ছবির ছুতোয় অন্য কিছু খুঁজছে। জিনিসটা কী, হয়তো কাউন্টেস আর তার ম্যানেজারও জানে।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর। যুক্তি আছে তোমার কথায়। হয়তো সেই জিনিসটাই সেদিন নিতে এসেছিলো কালো পোশাক পরা লোকটা। আগেই, যাতে আর কেউ পেয়ে না যায়। কিন্তু পায়নি। ডেনবারের জিনিসগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন প্রফেসর, আমরা বেচে দিয়েছি অন্যের কাছে। সেটার খোঁজ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে লোকটা।

জন ফেরেনটির মতো, বলে উঠলো মুসা।

আমার এখন অবাক লাগছে, রবিন বললো। হঠাৎ করে আর্টের ওপর। আগ্রহী হয়ে উঠলেন কেন ল্যাংগোয়েজের প্রফেসর?

নাক চুলকালো কিশোর। বোধহয় মেসেজ। মেসেজের কথা বলেছে। ফেরেনটি। হয়তো মৃত্যুর আগে কোনো মেসেজ রেখে গেছে ডেনবার। রিকি, বলেছে প্রলাপ বকেছে। সেই প্রলাপের মধ্যেই কোনো মূল্যবান তথ্য দিয়ে গেছে হয়তো লোকটা।

এবং সেটা প্রফেসর জানেন, কিন্তু কাউন্টেস নয়?

আমার তাই মনে হচ্ছে, নথি। চলো, রেমুডা ক্যানিয়ন থেকে ঘুরে আসি।

 আমার বাবা! শুনে রিকিও অবাক। বাবা আর্টের বই ঘেঁটেছেন?

লনের মধ্যে ছায়ায় বসে কথা বলছে চার কিশোর।

ছবির কথা কি খুব বেশি বলাবলি করতো ডেনবার? জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দাপ্রধান।

নাহ্। আমাকে ছবি আঁকা শেখানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছি, পারিনি। একবার একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলো। সে নাকি দুনিয়ার সব চেয়ে দামী পেইন্টার। কিন্তু কেউ জানে না সেকথা। বলেই হেসে উঠেছিলো।

এতে কিছু বোঝা যায় না, মন্তব্য করলো মুসা।

না, তা যায় না, কিশোরও একমত।

রিকি বললো, কি যে ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। এতোগুলো মাস একা এখানে থাকলে রিগ ডেনবার, কেউ দেখাও করতে আসেনি তার সঙ্গে। কিন্তু যেই মারা গেল, অমনি একের পর এক আসতে লাগলো, আগ্রহী হয়ে উঠলো। কতোজন।…ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এখন ঘরে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন কাউন্টেস আর ব্রাউন।

আবিষ্কার করে ফেলেছে নাকি কিছু?

 চলো না, দেখি, প্রস্তাব দিলো কিশোর।

ম্যানটলপিসে হেলান দিয়ে রয়েছেন প্রফেসর। কাউন্টেস আর তাঁর ম্যানেজারের মুখোমুখি।

 ছেলেদের দেখে হাসলেন কাউন্টেস। এই যে, গোয়েন্দার দল এসে পড়েছে। কাজ চালিয়ে যাচ্ছো তো?

যাচ্ছি, তবে ছবিগুলো এখনও পাইনি, ম্যাডাম, জবাব দিলো কিশোর। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারেন? আপনার ভাই কি কখনও কোনো ছবি কাউকে দেখিয়েছেন? কিংবা বিক্রি করেছেন?

 না, কে কিনবে তার ছবি? একেবারেই নবিস। তবু, ওর ছবিগুলো আমার চাই। ওই যে বলেছি, ভাইয়ের স্মৃতি। তোমরা তদন্ত চালিয়ে যাও, খুঁজে বের করো। ওগুলো।

করবো। যদি আমাদের আগেই কেউ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

 কেউ? অবাক মনে হলো ম্যানেজারকে।

জন ফরেনটি নামে এক লোক। আর্ট ডিলার বলে পরিচয় দিয়েছে। আপনাদেরকে অনুসরণ করে। ছবিগুলো চায়।

নীল গাড়ি নিয়ে কিভাবে পিছে লেগে থাকে ফেরেনটি, ছেলেদেরকে কি করে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলো, জানালো কিশোর। শুনে শিউরে উঠলেন কাউন্টেস। সর্বনাশ! অল্পের জন্যে বেঁচেছে। আরও সাবধানে থাকা উচিত তোমাদের। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমার ভাইয়ের ব্যাপারে তার এতো আগ্রহ কেন। আসলে কি মাকেও ভৰিম কিনুই পেলাম না। তাহলে কি চায়? ছবি, না অন্য কিছু?

কি জানি, হয়তো ছবিই। আজ প্রফেসর সাহেব লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন। আর্টের বই ঘাটতে।

সবাই তাকালো প্রফেসরের মুখের দিকে। রিকির চোখে অস্বস্তি। ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে উঠলো ম্যানেজারের চোখের তারা। সত্যি সত্যি কিছু জানেন আপনি? মাথা ঝাঁকালো সে, নেচে উঠলো রূপালি চুল।

না। স্রেফ কৌতূহল। ডেনবারের ব্যাপারে লোকের এই হঠাৎ আগ্রহ আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তাই ভাবলাম, দেখিই না গিয়ে, লোকটা বিখ্যাত কেউ ছিলো কিনা। কিছুই পেলাম না। তাতে কৌতূহল আরও বেড়েছে আমার। সেদিন সেই কালো পোশাক পরা লোকটা তাহলে কি খুঁজতে এসেছিলো?

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন কাউন্টেস। চোর এসেছিলো? মানে, আমরা এখানে আসার আগেই? নিশ্চয় আমার ভাইয়ের কোনো জিনিস চুরি করতে চেয়েছিলো?

আপনারা আসার এক হপ্তা আগে এসেছিলো, জানালো রবিন। কি যে খুঁজতে এসেছিলো সে-ই জানে।

আই সী, বলেই ম্যানেজারের দিকে তাকালেন কাউন্টেস।

ওই ফেরেনটিটা না তো? তাড়াতাড়ি বললো ম্যানেজার। মিস্টার ডেনবারের জিনিসের ওপর তারই তো বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

নিশ্চয়ই! বলে উঠলো মুসা।

স্যার, প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। রিকি, তোমাকেও বলছি। ফেরেনটির ধারণা, মৃত্যুর আগে মিস্টার ডেনবার কোনো মেসেজ রেখে গেছেন। আপনারা বলেছেন, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছেন তিনি। উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন। কিছু কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?

 ভাবলেন প্রফেসর। তারপর মাথা দোলালেন, হতে পারে, কিশোর। অনর্গল কথা বলে চলেছিলো। এখন মনে হচ্ছে, প্রলাপ ছাড়াও বোধহয় আরও কিছু ছিলো তার কথায়। তবে তখন কিছু বুঝিনি, এখনও না। এই যেমন ধরো, বলেছে…আঁকাবাঁকা ভুল, ক্যানভাস। পেইনটিংস শব্দটা অনেকবার বলেছে। …আর বলেছে মাস্টারস। আমি বেশি যাইনি ওর কাছে, তবে রিকি প্রায় সারাক্ষণই ছিলো। তুমি আর কিছু শুনেছো, রিকি?

মাথা নাড়লো রিকি। ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে প্রলাপই বকেছে। বলেছেঃ ওদের বলল, ওদের বলো…আঁকা…আঁকা যখন বাঁকা…ভুল মনে হবে মাস্টার…আমার পেইনটিংস…আমার ক্যানভাস ক্যানভাস থেকে আঁকা বাঁকা…বিব্বলো…ভুল। বার বার এইসব কথা বলেছে। একই রকম শব্দ, হেরফের ছিলো না।

কিছুক্ষণ নীরবতা। সবাই ভাবছে, শব্দগুলোর মানে কি? মুখ দেখেই অনুমান করা যায়, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। এমনকি কিশোরের দৃষ্টিও শূন্য।

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, বললো ম্যানেজার।

বোঝার কথাও নয়, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাউন্টেস। প্রলাপের কি আর কোনো অর্থ থাকে?,

স্যার, প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মিস্টার ডেনবার কি তাঁর সমস্ত জিনিস কটেজেই রাখতেন?

আমার তো তা-ই বিশ্বাস।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর। হু। আমরা তাহলে যাই। আমার এখনও মনে হয়, ছবিগুলো সব কোথায় আছে টেরিয়ার জানে।

বার বার ছেলেদেরকে হুঁশিয়ার করলেন কাউন্টেস। তারপর বললেন, কোনো সমস্যা হলেই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

সায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। সাইকেলে চড়ে বসলো। আগে আগে চলেছে কিশোর। নালার মুখের কাছে এসেই এখান থেকে প্রফেসরের বাড়িটা দেখা যায় না–মোড় নিলো বায়ে, হঠাৎ। অবাক হলো দুই সহকারী।

কোথায় যাচ্ছি? জানতে চাইলো রবিন।

আমি এখন শিওর, প্রলাপের মাধ্যমে কোনো মেসেজ দিতে চেয়েছিলো। ডেনবার, বললো কিশোর। কী, এখনও বুঝতে পারছি না। লোকটা কটেজ থেকে লন, আর লন থেকে কটেজ, এছাড়া আর কোথাও যেতো না। অন্তত যেতে দেখা যায়নি। তাহলে মূল্যবান কিছু যদি থাকেই, ওই কটেজেই রেখে গেছে।

সাইকেল রেখে নালায় নেমে তার ভেতর দিয়ে এগোলো ওরা। চলে এলো কটেজের পেছনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নীরব বাড়িটার আশপাশে কাউকে চোখে পড়লো না। পা টিপে টিপে এসে ভেতরে ঢুকলো ওরা। কোনখান। থেকে খোঁজা শুরু করবে, ভাবছে কিশোর, এই সময় বাইরে শোনা গেল পদশব্দ।

কুইক! ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। লুকাও।

বেডরুম থেকে দেখলো ওরা, কটেজে ঢুকেছে রিকি। কোনোদিকে খেয়াল, নেই, সোজা এগিয়ে গেল লিভিংরুমের এক কোণে। আঁলগা একটা বোর্ড সরিয়ে, আরও ঝুঁকে হাত ঢুকিয়ে দিলো মেঝের নিচে।

নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা।

তাহলে তুমি জানো, কি লুকিয়েছিলো ডেনবার? শান্ত কণ্ঠে বললো কিশোর।

.

০৯.

হুফ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রিকি। তোমরা। বুকে কাঁপুনি তুলে দিয়েছে।

তোমার হাতে কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

দেখালো রিকি। পুরনো আমলের বড় একটা চাবি। প্রশ্ন করলো, তোমরা এখানে কি করছো? ভাবছো, এই কটেজেই কিছু লুকিয়েছে ডেনবার?

তোমার কি মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর।

আমারও তা-ই মনে হয়। তোমরা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা, ছুটে চলে এলাম। বাবা এখনও ওই দুজনের সঙ্গে কথা বলছে।

কি মনে পড়লো? জানতে চাইলো রবিন।  

মাঝে মাঝে অ্যাডোবে যেতে ডেনবার। ক্যানিয়নের ওধারে। ছবিগুলো, ওখানেই রাখতো। ঘরটা খালি থাকে, তালা দিয়ে রাখে বাবা, যাতে কেউ ঢুকে নষ্ট করতে না পারে। ঐতিহাসিক মূল্য আছে ওটার। তবে, বুড়ো ডেনবার ঢুকতো,

আমিই তাকে চাবি এনে দিয়েছিলাম।

এটাই কি সেই চাবি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হ্যাঁ। বাবা মেহমানদের সঙ্গে কথা বলছে। তোমরাও, চলে গেলে। ভাবলাম, এইই সুযোগ। অ্যাডোবে গিয়ে খুঁজে দেখি।

ভালোই হলো। চলো, আমরাও যাই।

বাইরে বিকেলের রোদ। তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো রিকি। পথ থেকে দূরে নালার ধার দিয়ে হাঁটছে ওরা। হোফার হাউসকে দূর দিয়ে ঘিরে এগিয়ে গেছে নালাটা, তারপর হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে ঢুকে পড়েছে একটা গিরিসঙ্কটে।

কিছুক্ষণ পর বাঁয়ে ঘুরলো রিকি। ঘন ঝোপের ধার দিয়ে চললো। পেছনে তিন গোয়েন্দা।

আরও সামনে ঘন ঝোপঝাড়, মোটা মোটা লতা। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে হাঁটাই মুশকিল। তবে পথ একটা করাই আছে, রিকি সঙ্গে না এলে খুঁজে পেতো না তিন গোয়েন্দা। ঝোপের ভেতর থেকে বেরোতেই দেখা গেল বনের মাঝে একটা খোলা জায়গা। একধারে শক্ত হয়ে আছে কাদার স্তূপ। আরেকধারে। একটা ছোট কুঁড়ে। কাঠের নিচু ছাত, খড়খড়ি লাগানো জানালা। রোদে শুকানো ইঁট দিয়ে তৈরি। নীরব, নিঃসঙ্গ। এটাই অ্যাডোব।

 এই ক্যানিয়নের প্রথম মালিক এক স্প্যানিশ। সে-ই বানিয়েছিলো ওই কুঁড়েটা, জানালো রিকি। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে। ভেতরে শুধু একটা ফায়ারপ্লেস আছে। বাথরুমও নেই।

এই চাবি দিয়ে তালা খুললো রিকি। মোটা তক্তার পাল্লা, তাতে লোহার পাত লাগানো। পাতের এক মাথা গোল করে চৌকাঠে লাগানো মোটা লোহার বাকা শলায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে, এই প্রাচীন কজার ওপরই খেলে পাল্লাদুটো।

 ঠিকই বলেছে রিকি। তিন গোয়েন্দা ঢুকে দেখলো, ভেতরে প্রায় কিছুই নেই। কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে জমেছে ধুলো আর কাঁচা ইটের গুঁড়ো। দুটো ঘর। দুটোই ছোট। একটাকে বোধহয় বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো, আরেকটা শোবার ঘর–ওটার সংলগ্ন রান্নাঘর। জানালার পাল্লাগুলো বাইরের দিকে খোলে। ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ম্লান আলো। ঘরের ভেতর বেশ ঠাণ্ডা।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। দেয়াল কি পুরুরে বাবা। তিন ফুটের কম হবে না।

অ্যাডোব এভাবেই তৈরি হতো, রবিন বললো আগুনে-পোড়া ইটের মতো শক্ত হয় না রোদে পোড়া ইট। ফলে বড় আর পুরু করে বানাতে হতো, যাতে দেয়াল তৈরি করলে ভার রাখতে পারে।

মুসা, রবিনের কথা শেষ হলে কিশোর বললো, রান্নাঘরটায় খোজো। রবিন, তুমি খোজো শোবার ঘরে। আমি আর রিকি খুঁজছি বসার ঘরটায়।

অব্যবহৃত অনেক ক্যানভাস দেখতে পেলো কিশোর। রঙ পাতলা করার তেলের টিনও আছে। কিন্তু কোনো ছবি নেই। অলংকরণ করা একটা সোনালি ফ্রেম রয়েছে। সেটার দিকে চেয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো সে। আনমনে বললো, এটাকে খালি রেখেছিলো কেন ডেনবার?

এটাতে আরেকজনের আঁকা একটা ছবি ছিলো, বললো রিকি। নকল ছবি। ডেনবার বলতো, প্রিন্ট। বলতো, প্রিন্ট মোটেই পছন্দ করে না সে, তাই খুলে ফেলে দিয়েছিলো।

কিন্তু ফ্রেমটা ফেলেনি। ডিজাইনগুলো দেখেছো?

আঁকাবাকা! কিশোর, এটার কথা বলেনি তো?

রিকির কথা যেন শুনতেই পেলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বেশ পুরু। ভেতরে অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখা সম্ভব।

ফ্রেমটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলো দুজনে। জোড়াগুলো দেখলো। আঁকাবাঁকা অলংকরণগুলোতে আঙুল চালিয়ে, টিপেটুপে দেখলো। অবশেষে মাথা নাড়লো কিশোর, না, নেই কিছু। তাহলে কোথায় কি আছে?

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। পেলাম না। কিছু থেকে থাকলে, দেয়ালের মধ্যে লুকানো রয়েছে।

আমরাও কিছু পাইনি, জানালো রিকি।

এই, দেখে যাও! শোবার ঘর থেকে রবিনের ডাক শোনা গেল। এইযে, এখানে।

এক কোণে ফেলে রাখা জীর্ণ মলিন একটা বিছানার গদির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। খোলের কাপড়ে তির্যক রেখা আঁকা ডিজাইন। আমার বিশ্বাস, এটার ভেতরে কিছু আছে। ফুলে থাকা একটা জায়গা দেখালো।

টিপে দেখলো মুসা। খাইছে! নিশ্চয় পাথর। রত্ন! অনেকগুলো।

কাটো কাটো, জলদি কাটো, বললো কিশোর।

পকেট থেকে পেন্সিল কাটার ছোট ছুরি বের করে গদির ওই জায়গাটা কাটলো মুসা। চারপাশ থেকে বুকে এসেছে অন্যরা। মাথা ঠুকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে। গোল গোল পাথরের মতোই কতগুলো জিনিস বেরোলো।

কি ওগুলো? রিকির কণ্ঠে বিস্ময়।

কোনো মেঠো ইঁদুর কিংবা কাঠবেড়ালির রত্ন, নিরাশ হয়ে বললো কিশোর।

মানে?

 দেখছো না? একর আর পাইন নাট।

ওক আর পাইনের ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। প্রথম হাসলো। মুসা। হ্ হুঁহ হাসি থেকে বাড়তে বাড়তে একেবারে অট্টহাসি। সংক্রামিত হলো অন্যদের মাঝেও। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল ওদের। একজন কোনোমতে থামলে অন্যদের হাসি দেখে আবার হেসে উঠছে।

এই হাসির জন্যেই টের পেলো না, বসার ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যখন পেলো, দেরি হয়ে গেছে।

হাসি থামিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বললো মুসা, আরে…?

কথা শেষ হলো না। দরজার ওপাশে খসখস শব্দ। খিল লাগানোর আওয়াজও শোনা গেল।

এই, কে? চেঁচিয়ে উঠলো রিকি। কে তুমি? কে?

খোলো খোলো, দরজা খোলো! রবিন বললো।

পাল্লার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসা। জোরে ঠেলা দিয়ে বললো, এই, বন্ধ করছো কেন?

থামো তোমরা, বললো কিশোর।

চুপ করলে অন্যেরা। বসার ঘরে নড়াচড়া করছে কেউ। জিনিসপত্র নাড়ছে। দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ। আছড়ে ভাঙছে ছবি আঁকার ফ্রেম, ছুঁড়ে ফেলছে তেল আর রঙের কৌটা, টিন।

খুঁজছে ব্যাটা, ফিসফিস করে বললো কিশোর।

আরও কয়েক মিনিট ধরে চললো বিচিত্র শব্দ। ক্ষণিকের জন্যে নীরবতা। বাইরের দরজা বন্ধ হলো, তালা লাগানোর আওয়াজও বোঝা গেল।

সর্বনাশ হয়েছে! গুঙিয়ে উঠলো রিকি। তালায় চাবি লাগিয়ে রেখে এসেছিলাম!

.

শোবার ঘরে একটা মাত্র জানালা। পুরু কাঠের শক্ত পাল্লা। খুলে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্যে মোটা তক্তা আর পেরেক দিয়ে বাইরে থেকে শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছেন রিকির বাবা। খুলতে হলে ছেনি-হাতুড়ি লাগবে।

বাইরে রাত নেমেছে। পাল্লার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছে ঘরে।

কয়েক ঘন্টা হলো আটকে রয়েছে ছেলেরা। চেঁচিয়ে গলা ব্যথা করে ফেলেছে। কিন্তু কে শুনবে? হোফার হাউস থেকে অনেক দূরে এই অ্যাডোব। চেঁচামেচি করে লাভ হবে না বুঝে বেরোনোর অনেক চেষ্টা করেছে, ছেলেরা। সুবিধে করতে পারেনি। ভীষণ পুরু দেয়াল। মুসার পকেট নাইফ কিংবা কিশোরের আটলার সুইস নাইফ দিয়ে খুঁচিয়ে দেখেছে, প্রায় দাগই ফেলতে পারেনি। দেয়ালে। বুঝেছে, বেশি চাপাচাপি করতে গেলে অযথা ছুরির ফলাই ভাঙবে, দেয়ালে গর্ত হবে না। দরজা খুলতে পারেনি, জানালা তো নয়ই। ঘরের মেঝেতে লাথি মেরে বুঝেছে, নিচে ফাঁপা, বোধহয় বেসমেন্ট আছে। কিন্তু ওখানে নামার পথ খুঁজে পায়নি।

হতাশ হয়ে এখন বসে রয়েছে পুরনো গদিটার ওপর। ডিনারের সময় হয়ে গেছে, আফসোস করে বললো মুসা।

আর ডিনার! জোরে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। কাল সকালের নাস্তা করতে পারবো কিনা সন্দেহ। আটকা পড়লাম ভালোমতোই।

রিকি বললো, বাবা আমাকে না দেখলে খুঁজবে। খুঁজে বের করবে।

কি করে জানবে, এখানে এসেছো? প্রায়ই আলো নাকি? জানেন তোমার বাবা?

না।

 তাহলে কেন এখানে খুঁজতে আসবেন?

আবার নীরবতা।

কিছুক্ষণ পর কি মনে হতে উঠলো মুসা। একদিকে দেয়ালের কোণ ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে একটা দেয়াল আলমারি। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েকবার পা ঠুকলো মেঝেতে। বেসমেন্টে নামতে পারলে হতো। হয়তো বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে। কিন্তু নামি কিভাবে?

রিকিও গিয়ে মুসার পাশে দাঁড়ালো। অ্যাডোবের নিচে যে ভাড়ার ঘর আছে, জানতামই না। কেন বানালো বুঝতে পারছি না! বিড়বিড় করলো আপনমনে, ক্যালিফোর্নিয়ায় এসব বানায় না লোকে!

না, তা বানায় না, বললো কিশোর। আর এরকম পুরনো অ্যাডোবের নিচে তো নয়ই। এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, উত্তেজিত। এখন অ্যাডোবের নিচে ভাড়ার বানায় না। কিন্তু যখন আমেরিকান আর স্প্যানিশরা শত্রু ছিলো? পালানোর জন্যে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রাখতো। নিশ্চয় এটার তলায়ও ওরকম কিছু আছে। আবছা আলোয় পুরো ঘরে আরেকবার চোখ বোলালো সে। বিড়বিড় করলো, নামার পট। কোথায়?… আলমারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক মুহূর্ত। ওটার নিচে…

কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লো রবিন আর মুসা। হাত দিয়ে মুছে ফেললো পুরু ধুলো আর ইট-মাটির গুঁড়ো। একটা চিড়মতো দেখা গেল। ওটার মধ্যে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে, চাপ দিয়ে দেখলো মুসা। এই, নড়ছে! চেঁচিয়ে উঠলো সে।

 রবিন আর সে মিলে টেনে তুললো একটা তক্তা। নিচেও ধুলো আর মাটির পুরু আস্তরণ। ওগুলো সরাতে বেরিয়ে পড়লো একটা ট্র্যাপড়োর, লোহার মরচে ধরা বড় আঙটা লাগানো। আঙটাটা চেপে ধরে টান দিতেই উঠে এলো। ট্র্যাপোডোর। ফোকরের তলায় ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না।  

দেখা যায় না, অস্বস্তিতে ভরা রবিনের কণ্ঠ।

নাহ, বললো রিকি। খালি অন্ধকার।

 সুড়ঙ্গ থাক আর যা-ই থাক, আমি নামছি না ওখানে, সাফ বলে দিলো মুসা।

বেশ, থাকো, বললো কিশোর। ফেরেনটির হাতের ছুরির কথা মনে আছে? রাতের বেলা খুন করতে আসতে পারে।

ভয় দেখাচ্ছো? আসুক ছুরি নিয়ে। দরকার হয় লড়াই করবো। কিন্তু আমি ওই অন্ধকারে নামছি না। শুনেছি স্প্যানিশ ভূতগুলো সবচেয়ে পাজি।

অন্য সময় হলে হেসে ফেলতো সবাই, এখন হাসলো না।

ইস, একটা টর্চও যদি থাকতো! জিভ দিয়ে চুক চুক করলো কিশোর। কিন্তু কেউ একজনকে তো নামতেই হবে।

ভয়ঙ্কর লাগছে কালো গহ্বরটা, যেন কোনো দানবের হাঁ করা মুখ।

বেশ, আমিই যাচ্ছি, অসাধারণ দুঃসাহস দেখিয়ে বসলো রবিন। কেউ বাধা দেয়ার আগেই গুড বাই বলে পা নামিয়ে দিলো ফোকরের ভেতরে। দুই হাতে কিনার ধরে রেখে ঝুলে রইলো এক মুহূর্ত। তারপর ঢিল করে দিলো আঙুলগুলো।

পড়তে লাগলো নিচে। কালো অন্ধকার গ্রাস করলো যেন তাকে।

.

১০.

কালো মুখটা দিয়ে নিচে উঁকি দিলো অন্য তিনজন।

রবিন? ডাকলো মুসা।

ভালোই আছি আমি, জবাব এলো নিচে থেকে। সুড়ঙ্গই। বালি আর ইটের ঔড়োয় ভরা। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়ালে দেয়াল হাতে লাগছে। এক মিনিট দাঁড়াও, আরও ভালোমতো দেখে নিই।

নিচে নড়াচড়া শোনা গেল। ছেলেদের মনে হলো কয়েক ঘন্টা পেরিয়েছে, আসলে পেরোলো মাত্র কয়েকটা মিনিট। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, একদিকে ছয় ফুট গেছে, বোধহয় লিভিংরুমের তলায়। ওখানে আরেকটা ট্র্যাপডোর আছে। অনেক টেনেটুনে দেখলাম, খুলতে পারলাম না। ওটা খোলা গেলে হয়তো বেরোনো যাবে।

কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। সুড়ঙ্গটা কোথায় গেছে কি করে জানবো?

 হারিয়ে যেতে পারি, বললো রিকি।

ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। ডেকে জিজ্ঞেস করলো, রবিন? বাতাস কেমন ওখানে?

ভালোই। শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে না। তবে স্থির হয়ে আছে।

কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রাধান! কোথায় গেছে সুড়ঙ্গটা? বলা যায় না, কি হবে! সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারি, বললো সে। মারাও যেতে পারি। কিন্তু এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। চেষ্টা করে দেখা দরকার। যে আটকে রেখে গেছে আমাদের, তার উদ্দেশ্যও জানি না। হয়তো ফিরে আসবে ছুরি নিয়ে…

আমি নামছি, কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো মুসা। রবিনের মতো একই কায়দায় নেমে গেল।

তার পরে গেল রিকি। সব শেষে কিশোর।

একে অন্যের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো ওরা। এভোই অন্ধকার, কিছু দেখতে পেলো না। ঠাণ্ডাও বেশ। বেশিক্ষণ এখানে থাকতে হলে শীতেই কাবু হয়ে যাবে।

চলো, এতোক্ষণ ভয় পাচ্ছিলো বটে, কিন্তু সময়মতো ভয়ডর, সব চলে গেল মুসার, নেতা হয়ে গেল। আমি আগে যাচ্ছি। কিশোর, তুমি আমার পেছনে থাকো। রবিন, রিকি, তোমরা কিছুটা দূরে থাকো। যদি খাদেটাদে পড়েই যাই, তোমরা অন্তত… কথা শেষ করলো না সে।

ট্রাপডোরটা খোলা গেল না। উল্টোদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ আছে। সেটা ধরেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলো মুসা। গাঢ় অন্ধকারে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে আগে বাড়লো। ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসছে ছাত। ঝুঁকতে ঝুঁকতে শেষে বাঁকা হয়ে গেল, কুঁজো মানুষের মতো।

মনে তো হয় সোজাই গেছে, বললো, মুসা। ঠিক বুঝতে পারছি না।

এগিয়ে চলেছে ওরা।

প্রতিটি পা মেপে মেপে ফেলছে মুসা। ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে মাটি আছে, নাকি শূন্য। কথা বলছে না কেউ। গভীর অন্ধকার আর ভীষণ নীরবতা– চেপে ধরছে যেন ওদেরকে।

মুসা, এক সময় বললো কিশোর। কি যেন নড়ছে।

জমে গেল চারজনেই।

বাতাস! বলে উঠলো রবিন। বাতাস নড়ছে।

আবার এগোলো মুসা। গতি সামান্য বাড়ালো। সামনে একটা মোড়।

মোড় ঘুরতেই মনে হলো, সামনে অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে আছে।

সুড়ঙ্গমুখ! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

আর বিশ কদম এগিয়েই খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এলো ওরা। হাসলো একে অন্যের দিকে চেয়ে। এখন নিরাপদ। বন্ধ কারাগার, ভয়াবহ অন্ধকার থেকে যুক্তি মিলেছে শেষ অবধি। ওই অন্ধকারের পর জ্যোৎস্নাকে মনে হলো উজ্জ্বল সূর্যের আলো।

নালাটায় বেরিয়েছি, চারপাশে দেখে বললো রিকি।

নালার ভাটিতে রয়েছে ওরা। উজানের দিকটা উঠে গেছে অনেক ওপরে। যেখান দিয়ে বেরিয়েছে ওরা, সেটাকে দেখে মনে হয় কালো একটা সাধারণ গর্ত, ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। সুড়ঙ্গমুখ যে, বোঝার উপায় নেই।

চলো, বলে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেল কিশোর।

মাত্র দশ গজ দূরে ধুপ করে নালায় পড়লো কে যেন! অসাবধানে পা বাড়াতে গিয়েই বোধহয় পড়েছি। বাবারে! বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

কে? বলে এগিয়ে গেল মুসা।

হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। চাঁদের আলোয় তার চেহারা দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো মুসা। ঘুরেই দিলো দৌড়। চেঁচিয়ে বললো, পালাও, পালাও! জন ফেরেনটি…

অন্যেরাও দৌড়াতে শুরু করলো মুসার পেছনে।

 এই শোনো, থামো থামো।

কিন্তু কে শোনে ডাক? ছুটছে তো ছুটছেই ওরা। পেছনে আসছে ফেরেনটি। পাথরে লেগে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে। থামলো তো না-ই, গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ছেলেরা।

জলদি করো! বললো মুসা। সাইকেলের কাছে।

মোড় ঘুরতেই হঠাৎ সামনে পড়লো আরেকজন। মুসার হাত চেপে ধরলো। ঝাড়া দিয়ে চুটিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বললো সে, খবরদার, কেউ থেমো না! ধরতে যেন না পারে! উত্তেজনায় মানুষটার মুখের দিকেও তাকালো না, হাত। ছাড়িয়ে নিয়েই আবার দৌড়।

এই রিকি! আমি!

আরি, বাবা!

থেমে গেল ছেলেরা।

হাঁপাতে হাঁপাতে মুসা বললো, ফেরেনটি তাড়া করেছে আমাদের।

অ্যাডোবে আটকে রেখেছিলো, জানালো রিকি।

ভাগ্যিস গোপন সুড়ঙ্গটা পেয়ে গেলাম, যোগ করলো রবিন। নইলে এখনও ওখানেই আটকে থাকতাম।

নালার ভাটির দিকে তাকালেন প্রফেসর। কই, কাউকে তো দেখছি না।

ছেলেরাও ফিরে তাকালো। সত্যি, কেউ নেই। শুধু নীরব চাঁদের আলো।

ছিলো তো বললো কিশোর। সংক্ষেপে জানালো অ্যাডোবে ঢোকার পর কি কি ঘটেছে।

হুঁ, মাথা দোলালেন প্রফেসর। কটেজেও আবার কে জানি ঢুকেছিলো। ফেরেনটিই হবে।

হবে কি বলছো, বাবা, নিশ্চয় সে-ই ঢুকেছিলো। আমাদের আটকে রেখে কটেজে গিয়েছিলা। ওখানে খুঁজেছে। কিছু না পেয়ে আবার রওনা হয়েছে অ্যাডভাবে। ল্যাঙড়া তো। পড়ে গিয়েছিলো নালায়। ওখানে আমাদের দেখেই তাড়া করেছে।

ভালো বিপদেই পড়েছিল, বললেন প্রফেসর। কিন্তু ওই ফেরেনটিটা এদিকে এতো ঘুরঘুর করছে কেন? কি চায়?

<

Super User