০৬.

চমকে গিয়ে ব্রেক চেপে ফেলছিল মুসা, কিশোরের চিৎকারে সেটা ছেড়ে দিয়ে আরও জোরে চেপে ধরল অ্যাক্সিলারেটর। লাফ দিয়ে এগোতে গেল ভারি গাড়িটা। পারল না, পেছনের অংশ বসে যাচ্ছে।

পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে! বলে পেছনের সীটে বসা রবিন চেঁচাতে শুরু করল।

অ্যাক্সিলারেটর ছাড়ল না মুসা। ভীষণ গোঁ গো শুরু করল ইঞ্জিন। পড়ে যাবেই, আর বাঁচানো গেল না!–যখন ভাবছে সে, এই সময় সামনের কাঠে কামড় বসাল টায়ার। টেনে তুলল গাড়ির পেছনের অংশটাকে। নিরাপদে টেনে আনল ব্রিজের অন্যপ্রান্তে, রাস্তার ওপর।

কখন যে অ্যাক্সিলারেটর ছেড়ে দিল মুসা, বলতে পারবে না। ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। কেয়ার করল না সে। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বেঁচেছি, উফ! থরথর করে কাঁপছে সে।

কাঁপছে অন্য দুজনও।

ব্রিজের কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে নেমে এল তিনজনে। মাঝখানের দুটো তক্তা ঝুলে আছে নিচের কালো পানির দিকে, আরেকটা গায়েব।

কোন গাড়ি উঠলেই এখন মরবে, গম্ভীর স্বরে কিশোর বলল। সাবধান করার ব্যবস্থা করা দরকার।

কি করে করব? রবিনের প্রশ্ন।

লোহার কাঠামোতে পা রেখে আর রেলিঙ ধরে প্রায় ঝুলে ঝুলে আবার। অন্যপাশে চলে এল ওরা। পাহাড় থেকে শুকনো ডাল এনে পথের ওপর বিছিয়ে, তার সামনে বড় বড় পাথর রেখে দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করল। এপাশটাতেও একই ভাবে প্রতিবন্ধক তৈরি করে দিল।

আবার গাড়িতে ওঠার পর রবিন বলল, একটা ফোন পেলেই রিপোর্ট করতে হবে।

বনে ঢাকা পাহাড়ের ঢালের নিচ দিয়ে প্রায় মাইলখানেক এগোনোর পর পথের ধারে একটা খামারবাড়ি চোখে পড়ল। নেমে গেল তিন গোয়েন্দা। লেটার বক্সে নাম লেখা: হুফার কট। দরজা খুলে দিলেন বাড়ির মালিক, সবে। খেতে বসেছিলেন, ঘণ্টা শুনে উঠে এসেছেন। খবরটা শুনে ফোনের দিকে। দৌড় দিলেন তিনি।

মিসেস কট বললেন, ওখানে বহুবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, পথের মোড়টার জন্যেই এমন হয়। একবার একটা গাড়ি স্পীড না কমিয়েই উঠে পড়েছিল ব্রিজে, আর সামলাতে পারেনি, রেলিং ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, একজনও বাঁচেনি। তোমাদের ভাগ্য খুব ভাল, বেঁচে এসেছ?…এসো না, বসে যাও আমাদের সঙ্গে, খাও।

খুব ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করল কিশোর। বলল, ওরা খেয়ে এসেছে, তা : ছাড়া পাশের শহরে নিলাম দেখতে যাচ্ছে। দেরি করলে গিয়ে আর পাবে না।

কটদেরকে গুডবাই জানিয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠল ওরা।

পনেরো মিনিট পর সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। তীর চিহ্ন এঁকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোন দিকে যেতে হবে। বড় বড় অক্ষরে লেখা:

পশু নিলাম
একশো গজ সামনে।

বেশ কয়েকটা লাল রঙ করা বাড়ি আর খোয়াড়ের সামনে পার্কিঙের জায়গা। ওখানে গাড়ি রাখল মুসা। তিনজনেই নেমে এগোল উঁচু ছাতওয়ালা একটা বাড়িতে। সারি সারি বে রাখা। অনেক লোক বসে আছে ওগুলোতে। সামনের কাঠের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েস্টকোট পরা একজন। রোগা টিংটিঙে লোক, শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক ভারি কণ্ঠে একটা বাদামী সাদা বাছুরের গুণগান করছে। বাছুরটাকে ধরে রেখেছে তার সহকারী।

এটা বড় জানোয়ারের জায়গা, কিশোর বলল। কুকুর অন্য কোন ঘরে।

 আবার বেরোনোর দরজার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ কিশোরের হাত খামচে ধরল রবিন। একটা বেঞ্চে চাষীদের মাঝখানে বসে আছে লম্বা এক লোক। সতর্ক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, পুরু গোফ। চওড়া কানাওয়ালা একটা হ্যাট মাথায়। গায়ে সুন্দর ছাঁটের স্পোর্টস জ্যাকেট।

চিনতে পারো? জিজ্ঞেস করল রবিন।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা ও কিশোর। চেনাই লাগছে।

হঠাৎ লম্বা মানুষটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরে গেল ওদের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে এল।

কর্নেল হুমবার মত লাগল না? রবিন বলল। এখানে কি করছে?

জবাব দিতে পারল না কেউ।

লম্বা, সরু একটা ঘরের ভেতর থেকে বিচিত্র কোলাহল আসছে। মুসা বলল, কুকুর ওটাতে।

ঢুকল ওরা! মুরগি, কুকুর, শুয়োর, ভেড়া, ছাগল, খরগোশের খাঁচায় বোঝাই এ ঘরটা। ঘরের শেষ মাথায় রয়েছে কুকুরের খাঁচা। বেশির ভাগ কুকুরই দেখা গেল শ্রমিক কিংবা শিকারী জাতের। পশু খেদানোর কোলি কুকুরগুলোর পাশ কাটিয়ে এল মুসা, এগোল লম্বা কান, কোমল, আকর্ষণীয় চোখওয়ালা হাউন্ডগুলোর দিকে।

হাউডই আমার পছন্দ, বলল সে। পছন্দ করতে শুরু করল, কোনটা নেব? কুন হাউন্ড? উই, বেশি বড়। ব্লাড হাউন্ড? বেশি গোমড়া। ব্যাসিট? মোটুকরাম, পা এত খাটো, মনে হয় জন্মদোষ।

সবারই তো এ দোষ না সে দোষ, মুচকি হেসে বলল রবিন। তাহলে নেবেটা কি?

শোনার অবস্থা নেই মুসার। কোণের দিকে হাত তুলে বলল, চলো তো ওগুলো দেখি?

এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ছয়টা নাদুসনুদুস বাচ্চা ঘুরঘুর করছে তার পায়ের কাছে।

বাহ, বিগলস, চওড়া কাঁধ, সেই তুলনায় খাটো পা আর চোখা লেজওয়ালা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে উঠল মুসা। হঠাৎ একটা বাচ্চা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল তার কাছে। তার পায়ে গা ঘষতে লাগল। নিচু হয়ে হাত বাড়াতেই মা জিভ বের করে তার হাত চেটে দিল।

বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে হাসিমুখে বলল সে, এটাই নেব।

ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কত?

দশ ডলার।

নিলাম। মাব্যিাগ বের করুল কিশোর।

আবার তার বাহুতে হাত রাখল রবিন। তাকানোর ইঙ্গিত করল। ভেড়ার খাঁচার সামনে দেখা গেল সেই লোকটাকে, কর্নেল হুমবা। একটা ভেড়া দামদরকরছে।

তোমাদের সঙ্গে এসেছে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।

না, জবাব দিল রবিন। তবে চিনি।

ওটা নিলে ঠকবে। এত বুড়োর বুড়ো, দাঁড়াতেই পারে না। এই পশু দিয়ে কি করবে?

 আমিও তো সে-কথাই ভাবছি, বিড়বিড় করল কিশোর। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল, ভেড়া কিনতে এল কেন হুমবা? পুমাকে খাওয়াবে?

 গাড়িতে উঠল ওরা। থরথর করে কাঁপছে কুকুরের বাচ্চাটা। রবিনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, সেরে যাবে। এই প্রথম ভাইবোনদের কাছ থেকে সরে এল তো, ভয় পাচ্ছে। কোলে নিয়ে ওটাকে আদর করল সে।

গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল এবার রবিন। কিশোর, কেবিনে ফিরে যাব?

হ্যাঁ।

গাড়ি চালাল রবিন। কাঁচা এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা ধরে কয়েক মাইল এগোনোর পর খেয়াল করল ব্যাপারটা, আরি, গাধা নাকি! এই রাস্তা দিয়ে চলেছি কেন? ব্রিজ না ভাঙা?

অন্যমনস্ক হয়ে ছিল কিশোর। চমকে গিয়ে বলল, তাই তো! আমিও খেয়াল করিনি!

আর মুসা তত কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়েই ব্যস্ত, রাস্তার দিকে তাকায়নি সে।

কয়েক মিনিট ধরে ম্যাপ দেখল কিশোর। বলল, আবার ফিরে যেতে হবে। যেখানে নিলাম হচ্ছে সেখান থেকে আরেকটা রাস্তা গেছে ব্ল্যাক হোলোর দিকে। চলো।

দূর, গাধার মত কাজ করলাম!

নতুন রাস্তাটা আগেরটার মত অত খারাপ না। প্রায় সাতটা বাজে। এখনও সূর্য আছে, কিন্তু বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বেশ আরাম। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। বেশ কিছু গাড়ি কেবল একটা দিকেই চলেছে।

যাচ্ছে কোথায় ওরা? কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল রবিন। প্রতিটি গাড়িতেই তো মনে হচ্ছে ফুল ফ্যামিলি। সেজেগুঁজে বেরিয়েছে।

মোড় নিতেই কিশোর বলল, ওই যে তোমার জবাব।

বাতাসে ভেসে এল মিউজিক। আরও এগোতে চোখে পড়ল সারি সারি তাঁবু। হ্যারিজ কার্নিভাল নতুন জায়গায় খেলা দেখাতে এসেছে।

ভাল, খুশি হয়ে বলল মুসা, থামব এখানে। আবার পপকর্ন আর পানাট খেতে ইচ্ছে করছে।

থামো!

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, তোমারও ওসব খেতে ইচ্ছে করছে!

না। পুমার খেলা আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

রবিন বুঝে গেল, খেলা দেখাটা আসল ব্যাপার নয়, অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কিশোরের। কিছু জিজ্ঞেস করল না। গাড়ি রাখল পার্কিঙের জায়গায়। তিনজনে নেমে এগোল পুমার তাঁবুর দিকে। দলে এখন আরও একজন আছে, মুসার বাহুতে গুটিসুটি হয়ে থাকা কুকুরের বাচ্চাটা।

যাচ্ছি তো, বলল মুসা, কিন্তু খেলা দেখাবে কে? হুমবাকে তো দেখে এলাম নিলামের জায়গায়।

এতক্ষণে নিশ্চয় চলে এসেছে, রবিন বলল। উল্টো দিকে গিয়ে সময় নষ্ট করলাম না আমরা।

চলে তো এসেছেই, তিন গোয়েন্দা যখন তাঁবুতে ঢুকল, দেখল খেলাও আরম্ভ হয়ে গেছে। আগের বারের মতই টাইট পোশাক পরেছে হুমবা। সাদা খেলা দেখানোর পোশাকে কিছুটা অন্য রকম লাগছে তাকে, একটু আগে নিলামের জায়গায় যাকে দেখে এল ওরা, তার চেয়ে যেন সামান্য আলাদা। কঠিন শাসনে রেখেছে ভয়ঙ্কর জানোয়ারগুলোকে। তেমনি ঘৃণা দেখা যাচ্ছে ওগুলোর চোখে।

খেলা শেষ হলে, দর্শকরা যখন বেরোনোর গেটের দিকে হুড়াহুড়ি করে এগোল, কিশোর তখন দুই সঙ্গীকে নিয়ে চলল পুমাগুলোকে কাছে থেকে দেখতে। অল্পবয়েসী জানোয়ার, তেল চকচকে শরীর, খাওয়ার কষ্ট পায় না। বোঝা গেল।

আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে খাঁচার কাছে দাঁড়াল কর্নেল হুমবা।

দারুণ জানোয়ার পোষেণ, হেসে খাতির করার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কী খেতে দেন?

কাঁচা মাংস, কসাইয়ের দোকান থেকে আনা। শান্তকণ্ঠেই জবাব দিল কর্নেল, তবে কিছুটা অন্যমনস্ক, তাড়াহুড়ো করে সরে গেল ওখান থেকে।

কিন্তু তাকে আমরা ভেড়া কিনতে দেখেছি! ব্ল্যাক হোলোর দিকে আবার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল রবিন। পুমাকে খাওয়াতে যদি কিনে থাকে, বলল না কেন?

কেবিনে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। সূর্য ডুবে গেছে, বনের মধ্যে অন্ধকার, কিন্তু আকাশ এখনও পুরোপুরি কালো হয়নি, কেমন একধরনের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে।

ছেলেরা আশা করল, এইবার কেবিনে ঢুকে গৃহকর্তাকে দেখতে পাবে। কিন্তু নীরব হয়ে রইল বাড়িটা। কেউ বেরিয়ে এল না ওদের স্বাগত জানাতে। ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর তার নোটটা পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। ফেরেননি ক্যাপ্টেন রিচটন।

হলো কি তার? উদ্বেগে ফেটে পড়ল রবিন, খুঁজে বের করতেই হবে, যত জলদি পারা যায়!

হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, শোনো, গাড়ি!

ক্যাপ্টেন এসেছেন মনে করে দরজার কাছে দৌড়ে এল ছেলেরা। খোলা জায়গায় ঢুকেছে গাড়িটা, সব আলো নেভানো, কেবল পার্কিং লাইট জ্বলছে। মোটাসোটা, খাটো একজন মানুষ নামল। পরনে বিজনেস স্যুট। দড়াম করে। দরজা লাগিয়ে গটমট করে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।

রিচটন কোথায়? খসখসে কণ্ঠস্বর, অধৈর্য ভাবভঙ্গি।

তিনি নেই, জবাব দিল কিশোর।

নেই? কোথায় গেছে?

জানি না। এলে কিছু বলতে হবে?

আমি টাকা পাই ওর কাছে। দেয় না কেন?

এলে বলব। আপনার নামটা?

অ্যাঁ?.. হুগারফ। আর্নি হুগারফ। বললেই হবে ওকে, চিনবে। আমি ফরেস্টবার্গের অ্যাটর্নি।

অ্যাটর্নি? এক পা এগোল কিশোর, মনে হয় আপনি জানবেন, মিস্টার হুগারফ: ব্ল্যাক হোলোর মালিকের নাম কি? আরিগন?

হ্যাঁ। একটা সামার কটেজ ছিল এখানে ওদের, আগুন লেগে ছাই হয়ে গেছে। চলে গেল সব। তারপর আর কোন হুগারফকে দেখিনি।

 ডাইনীর গল্প আপনি বিশ্বাস করেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল কিশোর।

প্রশ্নটায় যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অ্যাটর্নি। তিনজনের ওপর ঘুরতে লাগল চোখ। তারপর বলল, কিসের ডাইনী! ওই গর্তটাই যত নষ্টের মূল। অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তোলে। ওই ধারটা তত কয়েক মাইল দূরে, কিন্তু ওখানে গিয়ে চিৎকার করলেও এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাবে।

তাই নাকি! আচ্ছা, ক্যাপ্টেন রিচটন এলে আপনার কথা বলব।

গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই মুসা বলল, লোকটাকে একবিন্দু পছন্দ হয়নি আমার। কেমন খটখট করে কথা বলে দেখেছ?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমি এখনই পরীক্ষা করে দেখব। কয়েক মাইল দূর থেকে শোনা যায়, এ কথা বিশ্বাস হয় না আমার। গাড়ি নিয়ে হোলোর অন্যপাশে চলে যাচ্ছি। বাতাস এখন এদিকে বইছে। গিয়ে চিৎকার করব, দেখো, তোমরা শোনো কিনা। ওখানে পৌঁছে হেডলাইট জ্বেলে-নিভিয়ে সঙ্কেত দেব।

বারান্দা থেকে নেমে গেল সে।

.

০৭.

ব্ল্যাক হোলোর কিনারে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন। অন্ধকার হয়ে গেছে। খানিক পর দেখতে পেল দুটো উজ্জ্বল আলো এগিয়ে যাচ্ছে গর্তের অন্য প্রান্তের দিকে। প্রায় দুই মাইল দূরে।

ওটাই কিশোর, দূরবীন চোখে লাগাতে লাগাতে বলল রবিন। কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল আলোটা। তারপর আবার দেখা গেল, জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে।

আমাদের দিকে গাড়ি ঘুরিয়েছে কিশোর, আবার বলল রবিন।

চিৎকার শোনার জন্যে কান খাড়া করে রাখল দুজনে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করল। গাড়িটার দিক থেকে এসে গালে পরশ বোলাচ্ছে বাতাস, কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। স্থির হয়ে গেল আলো দুটো, ঘুরল, তারপর আবার চলতে আরম্ভ করল। ফিরে আসছে কিশোর।

কেবিনে ফিরে জানাল সে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি। হর্নও বাজিয়েছি।

আমরা কিছুই শুনিনি, রবিন বলল।

হ্যাজাক লাইট জ্বেলে রান্নার জোগাড় করছে মুসা।

টেবিলে কনুই রেখে কুটি করল কিশোর। কই, তেমন কোন প্রতিধ্বনিইতো হয় না হোলোতে। তারমানে হুগার মিথ্যে কথা বলেছে। কেন?

কিছু ঢাকার চেষ্টা করছে না তো? রবিনের প্রশ্ন। লুকাচ্ছে কিছু?

ক্যাপ্টেন রিচটন যে নিখোঁজ হয়েছে, কাজ করতে করতে বলল মুসা, এ কথা কিন্তু জানে না।

বলা যায় না, ভানও হতে পারে তার। হয়তো এসেছিল আমরা কতখানি জানি, জানার জন্যে।

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ডাইনীর চেয়েও রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে এখানে। ক্যাপ্টেনের ভাগ্যে খারাপ কিছুই ঘটেছে। কাল আবার খুঁজতে বেরোব।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। তাই কুকুরটাকে টোপ হিসেবে বাইরে রেখে জেগে থাকার চিন্তাটা বাদ দিল সে-রাতের জন্যে। ঘুমানো দরকার।

 কিন্তু ঘুম আসতে চাইল না। তিনজনেই কান পেতে আছে ডাইনীর। চিৎকার শোনার আশায়। চোখ লেগে এসেছিল, মাঝরাতে তন্দ্রা টুটে গেল তীক্ষ্ণ চিঙ্কারে।

ব্ল্যাক হোলোর নিচ থেকে উঠে এল যেন চিৎকারটা, আগের দিনের চেয়ে অন্যরকম। লম্বা, তীক্ষ্ণ, কাঁপা কাঁপা। গোঙাতে শুরু করল বাচ্চাটা, কাঁপছে। ভয়ে।

আজকেরটা আরেক রকম কেন? মুসার প্রশ্ন।

হঠাৎ হাসতে শুরু করল রবিন।

এত হাসির কি হলো! রেগে উঠল মুসা। দেখছ না, কুত্তাটাও ভয় পেয়েছে?

পাবেই তো, হাসতে হাসতে বলল রবিন। যে ডাকছে সে যে তার শত্রু। কুকুরের বাচ্চার অনেক শত্রু থাকে। ডাইনী নয় ওটা, বুঝলে, পেঁচার ডাক। অনেক বড় পেঁচা।

পেঁচা! ওরকম করে ডাকে নাকি?

 ডাকে। অনেক জাতের পেঁচা আছে। একেকটার ডাক একেক রকম।

বাংকে উঠে বসল মুসা। তোমার ধারণা এটা পেঁচার ডাক? আর কিছু না?

মাথা ঝাঁকাল রবিন। না আর কিছু না। তবে কাল রাতে যেটা ডেকেছিল সেটা পেঁচা ছিল না। মুসাকে ভয় দেখানোর জন্যে বলল, পেঁচাকে কিন্তু অশুভ পাখি বলা হয়, ডাইনী আর ভূতের সঙ্গে নাকি সম্পর্ক আছে ওদের।

আহ, রাত-বিরেতে ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো!

এসব রসিকতার মধ্যে গেল না কিশোর, বলল, পেঁচা কিন্তু কুত্তা চুরি করতে পারে না, রবিন।..রাত দুপুরে ওসব আলোচনা থাক। এসো, ঘুমাই। কাল ভোরে উঠতে হবে।

.

খুব ভোরে উঠল ওরা। কুয়াশা পড়ছে ঘন হয়ে। বিষণ্ণ, ধূসর আলো। রোদের দেখা নেই। নাস্তা খাওয়া শেষ করে স্যান্ডউইচ বানাতে বসল মুসা। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যাতে খিদের জন্যে কাজের অসুবিধে না হয়।

কিশোর অপেক্ষা করতে লাগল শেরিফের লোকের জন্যে।

ঘণ্টাখানেক পর জোরাল বাতাস এসে হঠাৎ করেই সরিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা। রোদ উঠল। ঝলমল করে হেসে উঠল যেন প্রকৃতি। মুহূর্তে দূর করে দিল সমস্ত বিষণ্ণতা।

ওরা আসবে না, বলল কিশোর। চলো, আমরা বেরিয়ে যাই। বসে থাকার মানে হয় না। আগে মিস্টার আরিগনকে খুঁজে বের করব।

কেবিনের দরজা খোলা দেখে একছুটে বেরিয়ে যেতে চাইল কুকুরের বাচ্চাটা, কিন্তু হ্যাঁচকা টান লেগে আটকে গেল। দড়ির একমাথা তার গলায় বাধা, আরেক মাথা মুসার হাতে ধরা। পিঠে বাঁধা একটা ব্যাগ। এই ফগ,. জোরাজুরি করিসনে। ব্যথা পাবি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল রবিন। ফগ? বাচ্চাটার নাম রাখলে নাকি?

হ্যাঁ, সকালে কুয়াশা দেখেই নামটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।

ভাল। বেশ ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে একটা ভাব আছে।

কেবিনের পাশের খাড়া সেই পথটা ধরে আবার নিচে নামতে শুরু করল। গোয়েন্দারা। আগের দিনের মতই নিথর, নীরব হয়ে আছে চারপাশের বন। ওর মধ্যে যাওয়ার ইচ্ছে এমনকি কুকুরটারও নেই, প্রজাপতি কিংবা ফড়িঙ খুঁজতেও নয়।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিলোর। নিচু স্বরে বলল, কালকের মতই অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে আমাদের।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল তিনজনে। কিন্তু কিছুই শোনার নেই। আবার হাঁটতে লাগল ওরা। নিজেদের অজান্তেই যেন চলে এল সেই ঘরটার কাছে। দরজায় থাবা দিল কিশোর।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। দেখা দিল একজন লম্বা, চওড়া কাঁধ, ভারি ভুরু, পুরু গোঁফওয়ালা নোক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল গোয়েন্দাদের দিকে।

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল রবিনের, কর্নেল হুমবা!

কর্নেল? ভারি কণ্ঠস্বর মানুষটার। জীবনেও কখনও আর্মিতে ছিলাম না, ওই র‍্যাঙ্ক পাব কি করে?

তারমানে, তোতলাতে শুরু করল মুসা, আ-আপনি বলতে চাইছেন, আপনি কর্নেল ডুম হুমবা নন? অ্যানিমেল ট্রেনার?

ভারি গলায় হাহ হাহ করে হাসলেন তিনি। ওসব কিছুই না আমি। আমি অতি সাধারণ ডোবার আরিগন।

হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। সাধারণ পোশাকে আবার কিছুটা অন্যরকম লাগছে তাকে, ভেড়া কেনার সময় যেমন লেগেছিল। বলল, মিস্টার হুম…সরি, আরিগন, আপনাকেই খুঁজছি আমরা। ক্যাপ্টেন রিচটন নামে একজনের ওখানে বেড়াতে এসেছি, কিন্তু তাকেই পাচ্ছি না। দুই রাত ধরে। তিনি নিখোঁজ।

হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল আরিগনের। এসো, ভেতরে এসো।কুত্তাটাকে আনার দরকার নেই, বাইরে রেখে এসো।

ছোট একটা ঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পুরানো কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল আছে। আরিগন বললেন, দরজাটা খোলা রাখো, নইলে অন্ধকার লাগবে। তোমরা বসো, আমি আসছি। মাথা নুইয়ে নিচু একটা দরজা দিয়ে ওপাশের রান্নাঘরে চলে গেলেন। বালতি নড়ার শব্দ হলো, দরজা বন্ধ হলো যেন একটা, তারপর ফিরে এলেন তিনি।

হ্যাঁ, বলো এবার। ক্যাপ্টেন রিচটন কে, তার কি হয়েছে, সব শুনতে চাই।

আগে নিজেদের পরিচয় দিল ছেলেরা। তারপর রবিন জানাল, তিনি আমাদের একজন বন্ধুর বন্ধু। আমরা চিঠি দিয়েছিলাম, আসছি। কিন্তু এসে দেখি তিনি নেই। একেবারে উধাও। এই হোলোতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। তার ভাঙা টর্চটা পেয়েছি বনের মধ্যে, আর দুটো শটগানের গুলির খোসা। তিনিই ফায়ার করেছেন সম্ভবত।

হ্যাঁ, আরিগন বললেন, সেদিন রাতে গুলির শব্দ শুনেছি। প্রথমে ভাবলাম কেউ শিকার করতে এসেছে। এখানে কেবল কুন শিকারের অনুমতি আছে, আর কুন শিকার করতে কুকুর সঙ্গে আনে শিকারীরা। কিন্তু কুকুরের ডাক শুনলাম না। তখন ভাবলাম চুরি করে হরিণ মারতে ঢুকেছে কেউ। নাহ্, তোমাদের বন্ধুর কথা জানি না, কি হয়েছে বলতে পারছি না। সরি।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, আরেকটা কথা কি বলতে পারবেন? এখানে নাকি কুত্তাও হারিয়ে যাচ্ছে। বনের মধ্যে কোনটাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন?

না, দেখিনি, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আরিগন। কুত্তা হারাচ্ছে, সেটা কুত্তা চোরের কাজ হতে পারে। এদিকে কুকুর বিক্রির একটা চোরাই মার্কেট আছে। ওখান থেকে কারা কেনে জানো, ডাক্তারের দালালেরা। কিছু কিছু ডাক্তার কুকুরকে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষণা করে, বড়ই নির-অবলা জানোয়ারের ওপর এই অত্যাচার, ধরতে পারলে মজা দেখাতাম–

কাল একটা লোককে দেখলাম, আমাদের ওপর নজর রাখছে। এক্কেবারে বুনো মনেহলো। পিছু নিয়েছিলাম, ধরতে পারুলাম না, পালাল।

হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি, একটা আঙুল তুললেন আরিনি। ওর নাম পিচার। বোবা। আর লোক কোথায় দেখলে, বয়েস তো বেশি না। পাশের উপত্যকায় থাকে ওর বিধবা মায়ের সঙ্গে। জন্ম থেকে বোবা নয় সে, কানে শোনে, একটা দুর্ঘটনায় কণ্ঠনালীতে ব্যথা পেয়ে বাকশক্তি হারিয়েছে। সারাটা গরমকাল বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বুনো ফলমূল আর আশপাশের খামার থেকে চেয়েচিন্তে যা জোগাড় করতে পারে, খায়।

বিপজ্জনক? প্রশ্ন করল মুসা, মানে, ওর কাছ থেকে বিপদের ভয় আছে?

আমি ওকে এড়িয়েই চলি। কিছু হলেই পাথর ছুঁড়ে মারে, হাতের নিশান বড় সাংঘাতিক, বন্দুকের গুলিকেও হার মানায়। কুর্তগুলোকে সে-ও নিয়ে যেতে পারে। জন্তু-জানোয়ার, পাখি, এসবে ওর ভীষণ আগ্রহ।

আশ্চর্য জায়গায় মানুষ এখানে বুনো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, রাতে ডাইনী এসে চিৎকার শুরু করে অবাক কাণ্ড না?

চোখের তারায় হাসি ফুটল আরিগনের। ডাইনী-ফাইনী আমি বিশ্বাস করি না। তবে রাতে চিৎকারটা ঠিকই শুনি। লোম খাড়া করে দেয়।

রান্নাঘরে পুটপুট শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠলেন আক্লিান, আমার কফির পানি পড়ে যাচ্ছে! এসো না তোমরা, রান্নাঘরেই চলে এসো।

প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে নিচু দরজাটা পেরিয়ে অন্যপাশে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। জানালাবিহীন ছোট একটা ঘর, দুটো লণ্ঠন জ্বলছে। ঠাণ্ডার সময় ঘর গরম রাখার জন্যে ছোট একটা স্টোভ আছে। চুলায় কফির পানি ফুটছে। কেটলি থেকে কাপে কফি চলতে গেলেন আরিগন।

আমি এখানে ক্যাম্প করেই আছি বলতে পারো, বললেন তিনি। ছোট একটা টেবিল ঘিরে বসেছে সবাই। এখানে বিশ্রাম নিতে আসি। ইচ্ছে হলে ভেড়াটেভা পালি। খুব শান্তির জায়গা।

তা বটে, স্বীকার করল মুসা। একেবারেই নিরিবিলি।

আরও একটা ব্যাপার, পাগলামিও বলতে পারো। সন্ন্যাসীরা কেমন করে বাস করে, একা থাকতে কেমন লাগে তাদের, জানার খুব আগ্রহ আমার। সে জন্যেই এখানে এসে নিজের ওপরই পরীক্ষা চালাচ্ছি। এ ছাড়া জানার আর তো কোন উপায় নেই।

এই কেবিনটা আমার খুব পছন্দ। আশপাশটা কি চমৎকার দেখেছ? পেছনের দেয়াল একেবারে অরিজিন্যাল, নকল-টকল নয়। নিরেট পাথর। এই কেবিনটাও অনেক পুরানো, একশো বছরেরও বেশি। সে-সময় কি ঘটছিল এই এলাকায়, জানো?

স্মৃতি ঘেঁটে তথ্য বের করার চেষ্টা চালাল রবিন, সে-সময়? নিশ্চয় গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাই না?

হ্যাঁ। পড়ালেখা করো তুমি, বোঝা যাচ্ছে। তখন এটা ছিল স্মাগলারদের একটা ঘাটি। মানুষ চোরাচালান করত ওরা। পালিয়ে আসা গোলামরা লুকিয়ে থাকত এখানে, তারপর তাদের পাচার করে দেয়া হত কানাডায়। এ জন্যেই এত লুকোছাপা, পাহাড়ের দেয়াল ঘেষে তৈরি, জানালা নেই, রাতে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আলো যাওয়ারও পথ নেই। জায়গাটা ছোট হতে পারে, কিন্তু খুব নিরাপদ, আরামদায়কও বটে।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে আর ভাবছে কিশোর: বিচিত্র এই ছোট্ট কেবিনটাতে মাত্র একটা দরজা, সামনেরটা; তাহলে কোন গোলাম যদি এসে লুকিয়ে থাকে এখানে, তারপর দেখে তাকে ধরতে আসা হচ্ছে, পালাবে কোন পথে? এমন একটা জায়গায় কি লুকাতে চাইবে ওরা যেখান থেকে পালানোর গোপন পথ থাকবে না? তা ছাড়া খানিক আগে যে আরেকটা দরজা লাগানোর আওয়াজ শুনল, সেটা কি সত্যি শুনেছে, না তার কল্পনা?

ঠিক এই সময় থাবা পড়ল সামনের দরজায়।

.

০৮.

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে রোদ আসা আটকে দিল একটা মোটাসোটা শরীর। লম্বা মানুষটাকে দেখে বললেন, মর্নিং, মিস্টার আরিগন। অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়লাম, সরি। আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।

রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। গলা শুনেই চিনতে পেরেছিল আগন্তুককে, শেরিফ টোনার। ওদের দেখে বলে উঠলেন, ও, তোমরা আগেই চলে এসেছ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনজন। লোক। এই যে, তোমাদের সার্চ পার্টি নিয়ে এলাম। তিনজনের বেশি। পারলাম না, এই দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তবে তোমরা তিন, মিস্টার আরিগন, আর আমরা মিলে আটজন হয়ে যাচ্ছি, কম না, কি বলো? একটা কুত্তা থাকলে আরও ভাল হত।

আছে, মিস্টার টোনার, মুসা জানাল। আমাদের ফগ।

কালই কিনলাম বিগলের বাচ্চাটা, রবিন বলল।

সার্চ পার্টি কেন, শেরিফ? জানতে চাইলেন আরিগন, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে?

দ্রুত একবার আরিগনের হাসি হাসি মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন শেরিফ, কেন, ছেলেরা কিছু বলেনি আপনাকে?

বলেছে। ওদের এক ক্যাপ্টেন বন্ধুর নাকি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ধারণা, বনের মধ্যে লম্বা সফরে বেরিয়েছে। সার্চ পাটি নিয়ে খোদ শেরিফ এসে হাজির হয়ে যাবেন তাকে খুঁজতে, এতটা সিরিয়াস ভাবিনি, হেসে কথাটা শেষ করলেন আরিগন।

 ভ্রূকুটি করলেন শেরিফ-যেন বলতে চাইছেন, আরও কত জরুরী কাজ ফেলে এসেছি সেটা তো জানেনই না! কিন্তু বললেন না। কিশোর আর রবিন বুঝতে পেরে চট করে তাকাল পরস্পরের দিকে। ঘাবড়ে গেল, মত বদলে শেষে না খোঁজা বাদ দিয়েই চলে যান।

কিন্তু তা করলেন না তিনি, শান্তকণ্ঠে বললেন, মিস্টার আরিগন, এই এলাকা সবচেয়ে ভাল চেনেন আপনি, আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব।

নিশ্চয় করব। খুঁজতেই যখন এসেছেন, আমার এই ঘরটা থেকেই শুরু হোক। কারণ একসময় লুকানোর জায়গা হিসেবেই ব্যবহার করা হত এটাকে। আপনি আসার আগে ছেলেদের এই গল্পই শোনাচ্ছিলাম।

শেরিফকে রান্নাঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন আরিগন, ছেলেরা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। চুপ করে বসে না থেকে তিনজন ডেপুটির সঙ্গে পরিচয়ের পালাটা শেষ করে ফেলল ওরা।

বাচ্চাটা কি করছে দেখার জন্যে বাইরে বেরোল মুসা। ভেড়ার খোয়াড়ের কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ওটা। ওটাকে ডেকে ফিরিয়ে আনতে যাবে, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘাসের ওপর। কি যেন একটা চকচক করছে। তুলে নিয়েই থমকে গেল, কুঁচকে গেল ভুরু। রেখে দিল পকেটে।

শেরিফ আর অন্যদের নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন আরিগন। মাথায় নরম হ্যাট। সামনের দিকটায় উজ্জ্বল রঙের একটা প্লাস্টিকের প্রজাপতি বসানো। ছেলেদের দেখিয়ে দেখিয়ে লম্বা নলওয়ালা, কারুকাজ করা সাদা বাঁটের একটা পিস্তল জলেন কোমরের বেল্টে, যেন খুব মজা পাচ্ছেন। হেসে বললেন, জীবনে কখনও ডেপুটি হওয়ার সুযোগ পাইনি।

সার্চ পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশিত পথেই চলতে লাগল সবাই।

কিছুদূর এগিয়ে মুসাকে বললেন, কুত্তাটাকে নিয়ে তুমি আগে আগে থাকো। গন্ধেই অনেক কিছু বুঝতে পারবে ওটা। সবার উদ্দেশ্যে জ্ঞান। বিতরণ করলেন, দুই ধরনের তরাই আছে ব্ল্যাক হোলোতে, নিচে বন, আর ঢালের গায়ে পাথর। প্রথমে বনে ঢুকব আমরা, সেখানে কিছু না পেলে পাথুরে এলাকায় খুঁজতে যাব।

সবাইকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন শেরিফ। প্রতিটি লোক তার ডান পাশের লোককে নজরের মধ্যে রাখবে। তাহলে দলছুট হয়ে পড়ার ভয় থাকবে না কারও।

ফগকে নিয়ে মুসা রইল দলটার ঠিক মাঝখানে। সারির বা প্রান্তের শেষ লোকটি হলেন শেরিফ, ডান প্রান্তে কিশোর। তার পাশের লোকটি রবিন। মুসার পাশে আরিগন। ঘন বনে ক্যাপ্টেন রিচটনের খোঁজ চালাল সার্চ পার্টি।

লতায় ছাওয়া ঝোপঝাড়, স্বল্প আলো, আর ঘন হয়ে জন্মানো বড় বড় গাছ বাধা দিয়ে কঠিন এবং ধীর করে তুলল খোঁজার কাজ।

 শেরিফ! চিৎকার করে বললেন আরিগন, আপনার সামনে একটা খাত পড়বে। ওটাতে ভাল করে দেখবেন। হাড়গোড় ভেঙে ওতে পড়ে থাকতে পারেন ক্যাপ্টেন।

এক মিনিট পরেই জবাব এল, নেই এখানে।

খানিক পরে রসিকতার সুরে কিশোরদের বললেন আরিগন, তোমাদের সামনে একটা বড় গাছ পড়বে। তাতে মস্ত ফোকর। ভাল করে দেখো, ওর মধ্যে লুকিয়ে বসে আছেন কিনা তোমাদের বন্ধু।

আরিগন ব্যাপারটাকে এত হালকা ভাবে নিয়েছেন দেখে রাগ হতে লাগল কিশোরের। রবিনেরও ভাল লাগছে না এ ধরনের আচরণ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাটি আর আশপাশের সব কিছু দেখতে দেখতে চলেছে দু-জনে। মূসা আর ফগও খুব সতর্ক।

বিষণ্ণ বনের মধ্যে চলল একঘেয়ে খোঁজার কাজ। হঠাৎ কোন কিছু চমকে দিল ফগকে, সামনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার শুরু করল।

মানুষ! চেঁচিয়ে বলল মূসা, একটা লোক পড়ে আছে!

দুই পাশ থেকে দৌড়ে এল সবাই। হাত তুলে দেখাল-মুসা। সবাই দেখল, আবছা অন্ধকার বনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে কালো কোট, কালো টুপি আর ধূসর ট্রাউজার পরা একটা দেহ।

সবার আগে ছুট লাগাল ফগ। তার পেছনে দৌড় দিল সবাই। পড়ে থাকা দেহটার কাছে আগে পৌঁছল তিন গোয়েন্দা।

দূর! মানুষ কোথায়? হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল রবিন, ক্যাপ্টেনের লাশ দেখতে হয়নি বলে খুশিও হয়েছে, এ তো গাছ!

রসিকতা করে ফগকে বললেন আরিগন, কেমন কুত্তারে তুই? গাছকে মানুষ ভেবে বসিস?

কিন্তু সে যে মানুষ ভেবে চিৎকার করেনি তার আচরণেই বোঝা গেল। ছোঁক ছোঁক করছে গাছটার কাছে। নাক নামিয়ে শুকছে। ইঁদুর বা বেজি জাতীয় কোন প্রাণীর গন্ধ পেয়েছে মনে হয়, খোড়লে ঢুকে পড়েছে ওটা।

ওর আর দোষ কি? আমরাও তো ভেবেছি, মুখ কালো করে বলল একজন ডেপুটি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল অন্য দুজন।

দূর থেকে কিন্তু এক্কেবারে মানুষ মনে হয়েছে, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মুসা। এমন একটা ভুল করাতে লজ্জা লাগছে তার।

শেরিফ বললেন, থামি এখানে। একটু জিরিয়ে নিই।

খুশিমনে ব্যাগ খুলে খাবার বের করতে লাগল মুসা। হাতে হাতে তুলে দিল টিউনা মাছ, ডিমের সালাদ, আর ভেড়ার মাংস ও পনিরে তৈরি স্যান্ডউইচ। যে গাছের গুঁড়িটা বোকা বানিয়েছে ওদের, তার ওপর বসেই চিবাতে লাগল তিন ডেপুটি। নিচে বসল তিন গোয়েন্দা ও শেরিফ। খানিক দূরে একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসেছেন আরিগন।

ঘড়ি দেখে মুখ বাকিয়ে শেরিফ বললেন, এখন যে দুপুর, বনের মধ্যে এই অন্ধকার দেখলে কে বিশ্বাস করবে!

খাওয়ার পর আবার উঠে আগের মতই ছড়িয়ে গেল দলটা। আবার চলল খোঁজা। বিকেল নাগাদ বনে ছাওয়া উপত্যকার নিচেটা পুরো দেখা হয়ে গেল। পাওয়া গেল না কিছু। বন থেকে বেরোতে সামনে পড়ল হোলোর পাথুরে দেয়াল।

ওই যে ওখানে একটা গুহা আছে, হাত তুলে একটা পাথরের চাঙড় দেখিয়ে বললেন আরিগন। ওর মধ্যে পড়ে থাকলে অবাক হব না। গোয়েন্দাদের বললেন, তোমরা যাও। উঠে গিয়ে দেখো। আমি পেছনেই আছি। পা-টাতে যে কি হলো আজ, চাপই দিতে পারছি না।

তরতর করে উঠে যেতে লাগল রবিন। তার পেছনে মূসা, সবশেষে কিশোর। কিছুদূর উঠেই গুহার কালো মুখটা নজরে এল। পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা শৈলশিরা। খাড়া ঢাল থেকে ওটার ওপর সবে নিজেকে টেনে তুলেছে রবিন, এই সময় শাঁ করে কি যেন একটা চলে গেল তার কানের পাশ দিয়ে।

খবরদার! তোমার ওপরে! নিচ থেকে চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।

একের পর এক পাথর ছুটে আসতে লাগল ছেলেদের দিকে। কিন্তু। কোনটাই গায়ে লাগল না। অল্পের জন্যে মিস হতে লাগল। মুখ তুলে ওরা দেখল, লম্বা, পাতলা একটা মূর্তি উঁকি দিয়ে আছে দেয়ালের একেবারে কিনার থেকে। পাথরগুলো সে-ই ছুড়ছে।

 পিচার! ও-ই পিচার! আবার চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।

মুঠো পাকিয়ে ওপর থেকে হাত ঝাঁকাতে লাগল বোবা ছেলেটা। কিশোরের মনে হলো, কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সরে যেতে বলছে যেন।

ওপরে উঠতে মানা করছে আমাদের, রবিন বলল। কে শোনে তার কথা! আমরা উঠবই, দেখি কি করতে পারে!

পাথর ছুঁড়েও ঠেকাতে না পেরে যেন হাল ছেড়ে দিল ছেলেটা। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

গর্তের কাছাকাছি চলে এসেছে রবিন আর মুসা। কিনারে এসে ভেতরে তাকিয়েই থমকে গেল। ধড়াস করে উঠল বুক।

মাত্র তিনফুট দূরে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত একটা র‍্যাটল স্নেক। ছোবল হানতে প্রস্তুত। চোখের পলকে পাথরের আড়াল থেকে ওটার কাছে চলে এল আরও দুটো সাপ। উদ্দেশ্য ওগুলোরও ভাল না!

.

০৯.

ঝট করে যে পিছিয়ে যাবে ওরা, তারও উপায় নেই, শৈলশিরাটা এতই সরু। আটকে দিয়েছে ওদেরকে ভয়াবহ সরীসৃপগুলো। খাড়া ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে সরে যাওয়া যাবে না, তার আগেই ছোবল খেতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলে আরও বিপদ আছে, হাত ফসকে যেতে পারে, তাহলে আছড়ে পড়তে হবে অনেক নিচের পাথরে। ভাল বিপদেই পড়া গেছে! ওদিকে লেজের খড়খড় আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে অন্য দুটো সাপ। যে কোন মুহূর্তে কামড়ে দেবে।

বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই দেখছে না দুই গোয়েন্দা, এই সময় টাশশ করে উঠল পিস্তল। ছোবল মারতে তৈরি হয়েছিল যে সাপটা, নিমেষে গায়েব হয়ে গেল ওটার মাথা। শরীরটা পাথরে আছড়ে পড়ে মোচড় খেতে লাগল। গুলির শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে পালাতে শুরু করল অন্য দুটো।

জলদি সরে এসো ওখান থেকে। চিৎকার করে ডাকল কিশোর।

শৈলশিরা ধরে যত দ্রুত সম্ভব গর্তের কাছ থেকে সরে গেল মুসা আর রবিন। ওদের কাছে উঠে এলেন আরিগন আর কিশোর। আরিগনের পিস্তলের নল থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

ওরা চারজন নিরাপদে মাটিতে নামার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শেরিফ। ভুরুর ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ওখানে যাওয়াটা উচিত হয়নি তোমাদের! গলা কাঁপছে তার।

এক্কেবারে সময়মত গুলিটা করেছিলেন, মিস্টার আরিগন, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রবিন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি থাকাতে আজ বাঁচলাম।

হাসি মুছে গেছে আরিগনের মুখ থেকে। গম্ভীর স্বরে বললেন, এখানে আমি ছিলাম বলে রক্ষা, এটা অন্য কোথাও ঘটতে পারত। সাবধান না হয়ে অত তাড়াহুড়ো করে গর্তের কাছে যাওয়া উচিত হয়নি তোমাদের। অচেনা জায়গায় আরও দেখেশুনে যেতে হয়।

আন্তরিক ভঙ্গিতে একটা হাত মুসার কাঁধে, আরেক হাত রবিনের কাঁধে রাখলেন তিনি। শোনো, আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। বনে চলার অভিজ্ঞতা নেই তোমাদের, বুঝতে পারছি। এখানে আরও অনেক সাবধান থাকতে হয়। কোথায় যে কোন বিপদ ঘাপটি মেরে থাকে কল্পনাও করতে পারবে না। এই সাপগুলোর কথাই ধরো না, ওরা যে ওখানে আছে ভাবতে পেরেছিলে? অথচ ভাবা উচিত ছিল। গর্তের কাছে পাথুরে জায়গায় শুয়ে রোদ পোয়ায় সাপেরা, কাজেই গর্তের কাছে যাওয়ার আগে সাবধান থাকতে হয়। বুনো এলাকা এটা, এখানে বনের ভেতরে যেমন বিপদ, বাইরেও বিপদ।

তার কথায় সায় জানাল একজন ডেপুটি।

আরেকজন নীরবে মাথা ঝাঁকাল।

শেরিফ বললেন, বনের মধ্যে এ ধরনের বিপদে আনাড়ি লোকেরাই সাধারণত পড়ে। শহরে বাস করা মানুষকে এনে এই পর্বতের মধ্যে ছেড়ে দিলে মুহূর্তে পথ হারিয়ে বসে থাকবে। বেরোতেই পারবে না আর।

হাসি ফুটল আবার আরিগনের মুখে, হালকা হয়ে এল কণ্ঠস্বর, যাই হোক, বুদ্ধিমান লোকেরা একবারই বোকামি করে। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমরা বুদ্ধিমান। আশা করব, ব্ল্যাক হোলোর ধারেকাছেও আসবে না আর। এখানে পদে পদে বিপদ যে ওঁত পেতে থাকে, নিজের চোখেই তো দেখলে।

ক্যাপ্টেন রিচটনকে খোঁজার এখানেই ইতি হলো। আরিগন, শেরিফ আর তাঁর তিন ডেপুটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে হতাশ হয়ে কেবিনে ফিরল তিন গোয়েন্দা। সাপের কবল থেকে বাঁচার পর থেকেই শরীরটা দুর্বল লাগছে। রবিনের, ধপ করে শুয়ে পড়ল বাংকে। কুকুরের বাচ্চাটাকে কিছু খাবার দিয়ে। মুসা গেল রান্নাঘরে। আবার রিচটনের ক্যালেন্ডারটা নিয়ে বসল কিশোর। দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে।

শিক কাবাব, পটেটো চিপস আর ভেজিটেবল সুপ রান্না করে সবাইকে খেতে ডাকল মুসা। তখনও চুপ করে আছে রবিন। কিশোর গম্ভীর। এই পরিস্থিতি ভাল লাগল না মুসার। হালকা করার জন্যে বলল, ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি তোমাদের?

মুখ তুলল কিশোর, কোনটা?

এই যে খোকাবাবু মনে করে আমাদের লেকচারটা দিয়ে দিলেন আরিগন। আমার তো রাগই হচ্ছিল। বনেবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঝানু হয়ে গেলাম, আর আমাদের কিনা বলে বন চিনি না। আরে বাবা ক্যাম্প করেই তো থাকলাম কত শতবার।

 চিবাতে চিবাতে রবিন বলল, আমারও ভাল লাগেনি। কিছু বললাম না, আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে। গাধামি তো সত্যিই করেছি আমরা।

কিশোর বলল, না, সেটা আমাদের দোষ নয়। নাহয় ধরলামই আমরা আনাড়ি, বন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, কোথায় সাপ শুয়ে রোদ পোহায়, জানি না, কিন্তু আরিগন তো জানতেন। আর জানতেনই যদি আমাদের ওখানে যেতে বললেন কেন?

 তাই তো, এভাবে তো ভাবিনি! চিবানো বন্ধ করে দিল রবিন। ক্যাপ্টেনকে খোঁজা বন্ধ হয়ে গেল…আমাদের হোলোতে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন…কিশোর, যা-ই বলো, ওই বাড়িটা যেমন রহস্যময়, তার মালিকও তেমনি রহস্যময়। একটা দরজা বন্ধ হতে শুনেছি আমি, অথচ রান্নাঘরে ঢুকে আর কোন দরজা চোখে পড়েনি।

ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছে। একমুহূর্ত চুপ করে ভাবল কিশোর। তারপর বলল, ইচ্ছে করেই সাপের বাসায় আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওখানে সাপ আছে জানেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল নিয়ে এসেছেন, যাতে গুলি করতে পারেন। এ সব করে শেরিফকে বোঝাতে চেয়েছেন, কয়েকটা নির্বোধ, অপোগণ্ড ছেলে আমরা, আমাদের কথায়। ভবিষ্যতে কান না দেয়াই উচিত।

আচ্ছা, মুসা বলল, আমাদের খুন করতে চায়নি তো? সাপে কামড়ে আমাদের মেরে ফেললে কারও দোষ হত না। শেরিফ আর তার ডেপুটিদের চোখের সামনে ঘটত ব্যাপারটা। কোন রকম সন্দেহ জাগত না কারও মনে।

কি জানি, বুঝতে পারছি না, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর।

আরও একটা প্রশ্ন, পিচার আমাদের পাথর ছুঁড়ল কেন? সে-ও কি আরিগনের দলের লোক?

না-ও হতে পারে। সাপের গুহার দিকে এগোচ্ছি দেখেও ছুঁড়তে পারে, আমাদের ঠেকানোর জন্যে। তবে শিওর হতে পারছি না।

ভুরু কুঁচকে রবিন বলল, এই আরিগন লোকটা এক বিরাট রহস্য হয়ে দাঁড়াল! কর্নেল হুমবার সঙ্গে অবিকল মিল, এটাই বা হয় কি করে? যমজ ভাই নাকি…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠল মুসা, এই দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাব তোমাদের! ভুলেই গিয়েছিলাম! পকেট থেকে একটা ধাতব চাকতি বের করে টেবিলে ফেলল সে।

কি জিনিস? হাতে নিয়ে একবার দেখেই ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের, আরি এ তো কুকুরের গলার ট্যাগ! ডবের নাম! পটির কুকুর! কোথায় পেলে?

আরিগনের বাড়ির দরজার সামনে, ঘাসের ওপর।

তবে কি আরিগনই কুকুর চুরি করছেন? আগ্রহে বকের মত সামনে গলা বাড়িয়ে এসেছে রবিন, কিশোরের হাতের তালুতে রাখা ট্যাগটা দেখছে। কোন ধরনের অপরাধে জড়িত? নিজেই তো বললেন, এই এলাকায় একটা বেআইনী কুকুরের মার্কেট আছে।

কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর। ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে রহস্য। তাঁর বাড়িতে কুকুরের ছায়াও তো দেখলাম না।

তার ভেড়ার খোয়াড়টা দেখে এসেছি আমি, মুসা জানাল, ভেড়া নেই, অন্য কোন প্রাণীও নেই। এমন হতে পারে, ডব গিয়ে বাড়িটার সামনে ঘুরঘুর করছিল, ওই সময় কোনভাবে তার গলা থেকে খুলে পড়ে যায় ট্যাগটা।

চুকচুক শব্দ করে দুধ খেতে লাগল ফগ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আজ রাতেই ফাঁদ পাতব।

রাখবে কোথায়?

বারান্দার নিচে, বেঁধে। দরজার কাছে লুকিয়ে থাকবে তুমি আর রবিন। আমি থাকব বাইরে, বাড়ির কোণে। যেদিক থেকেই আসুক চোর, আমাদের চোখে না পড়ে যাবে না।

রাত দশটায় আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল ছোট্ট কেবিনটা। আকাশে মেঘ করেছে। বাতাস গরম। নিথর হয়ে আছে প্রকৃতি। ঝড়ের সঙ্কেত জানাচ্ছে।

নিঃশব্দে দরজা খুলে ফগকে নিয়ে বেরোল মুসা। বারান্দার রেলিঙের সঙ্গে বাঁধল কুকুরটার গলার দড়ি। ঘরে ফিরে গেল আবার। পাল্লাটা খোলা রেখে দুপাশে বসে পড়ল সে আর রবিন।

অন্ধকারে যাতে দেখা না যায়, এ জন্যে গাঢ় রঙের পোশাক পরে বেরোল কিশোর। ক্যাপ্টেনের গাড়ি আর ঘরের দেয়ালের মাঝের ফাঁকে লুকিয়ে বসল, চত্বরের কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কান খাড়া। ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। তারপরেও বন থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এগিয়ে আসে, তাকে দেখতে পাবে না পেছনে গাছগুলো কালো হয়ে থাকায়।

ক্রমেই যেন আরও ভারি, আরও গরম হয়ে উঠছে বাতাস। দিগন্তে ঝিলিক দিতে আরম্ভ করল বিদ্যুতের সরু সরু শিখা। গুমগুম আওয়াজ বেরোতে থাকল মেঘের ভেতর থেকে। হঠাৎ পুরো আকাশটাকে চিরে দিয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল বিদ্যুৎ, ক্ষণিকের জন্যে সবকিছুকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেই নিভে গেল, অন্ধকারকে ঘন করে তুলল আরও। দশদিক কাঁপিয়ে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল।

ঘড়ি দেখল কিশোর। এখন মধ্যরাত।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বজ্রপাতের শব্দ আগের বারের চেয়ে দীর্ঘায়িত হলো। বারান্দার নিচে ভীতকণ্ঠে কুঁই কুঁই করতে লাগল বাচ্চাটা।

ঝড়ের আর দেরি নেই, ভাবল কিশোর।

আবার বিদ্যুতের চমক, আবার বজ্রপাত…তার পর পরই বড় বড় ফোঁটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টিপাত। আচমকা গোঙানো বাদ দিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ফগ। কয়েকটা চিৎকার দিয়েই থেমে গেল, মুখ চেপে ধরা হয়েছে যেন, যাতে ডাকতে না পারে।

ঝড় মুহূর্তের জন্যে অমনোযোগী করে দিয়েছিল তিনজনকেই, কুকুরটার ওপর নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিল, এই সময়টুকুতেই ঘটে গেল ঘটনাটা। ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে দৌড়ে এল মুসা ও রবিন, বাড়ির পাশ থেকে ছুটে

এল কিশোর।

দেখল, ফগ নেই!

মুখ চেপে ধরলেও বাচ্চাটার গোঙানি শোনা যেত, কিন্তু ঝড়ের শব্দ ঢেকে দিল সেটা। বিদ্যুৎ চমকাল, তীব্র নীলচে আলোয় আলোকিত করে দিল বনভূমি, সেই আলোতে তিনজনেরই চোখে পড়ল হোলোতে নামার পথটা ধরে ছুটে যাচ্ছে একটা মূর্তি।

ধরো ওকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।

 টর্চ হাতে ছুটল তিনজনে।

.

১০.

কয়েক লাফে খোলা জায়গাটুকু পেরিয়ে বনে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। টর্চের আলো থাকা সত্ত্বেও গতি কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো। বৃষ্টিতে ভেজা ঢালু এই পথ ধরে জোরে ছোটা ওদের পক্ষে অসম্ভব।

সামনে অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়ে চলেছে কুত্তাচোর। তার চলা দেখেই অনুমান করা যায়, এই এলাকা তার অতিপরিচিত। ফগের চিৎকার শোনা গেল আবার, তার মুখ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছে বৃষ্টি। বিদ্যুতের আলোয় প্রায় তিরিশ গজ নিচে ছুটন্ত মূর্তিটাকে দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা।

হঠাৎ অন্ধকারে মানুষের আর্তনাদ শোনা গেল। ডান দিকে পাথরের মধ্যে একটা ভারি কিছু গড়িয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে বোধহয় থেমেছিল, আবার শোনা যেতে লাগল ছুটন্ত পায়ের শব্দ।

কিশোর, তোমরা দেখো তো কি হলো! আগে আগে ছুটতে ছুটতে বলল মুসা। আমি চোরটার পিছে যাচ্ছি!

টর্চের আলো ফেলে ঘন ঝোপের দিকে দৌড় দিল কিশোর আর রবিন। ঝোপঝাড় ভাঙার শব্দেই বোঝা গেল তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে কেউ। কিন্তু আর গোঙানি কানে এল না। খানিক পর ঝড়বৃষ্টির শব্দ ছাড়া শোনা গেল না আর কিছুই।

পালিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। ধরতে পারব না।

মুসা ওদিকে গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নেমে যাচ্ছে উপত্যকায়। টর্চ হাতে থাকলেও ওই আলোয় পথ দেখে দৌড়াতে অসুবিধে, কারণ দৌড়ানোর। সময় নাচানাচি করে আলো, এ জন্যে নিভিয়ে দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় যতটা পারা যায় দেখে দৌড়াচ্ছে। পথটা তারও মোটামুটি চেনা।

বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল। আলো রইল বেশিক্ষণ। তাতে তিরিশ গজ। দূরের ছুটন্ত মূর্তিটাকে স্পষ্ট নজরে পড়ল তার। বগলে চেপে ধরে আছে কিছু।

পিচার! চিৎকার করে ডাকল সে, দাঁড়াও!

কিন্তু দাঁড়াল না আজব ছেলেটা। হোলোর পাথুরে এলাকার দিকে দৌড় দিল। পায়ে ব্যথা পেয়েছে মনে হলো, অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে, কিন্তু গতি কমছে না। পাথরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু সমতল জায়গায় রয়েছে মুসা, তার সঙ্গে পারল না ছেলেটা। কয়েক লাফে কাছে পৌঁছে গেল সে। পা সই করে ঝাঁপ দিল। গোড়ালি ধরে ফেলল ছেলেটার। উপুড় হয়ে পড়ে গেল। পিচার, বগলের নিচ থেকে ছিটকে পড়ল দূরে ফগ, ব্যথা পেয়ে কেউ কেউ করতে লাগল।

চরমে পৌচেছে ঝড়। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে আলোকিত করে রেখেছে উপত্যকা।

ছেলেটার গায়ের ওপর চলে এল মুসা, কুস্তির কায়দায় চেপে ধরল। কিন্তু পিচারের গায়েও কম জোর না, তার ওপর ভেজা শরীর, ভেজা হাত, তাকে ধরে রাখতে পারল না মুসা। পিছলে নিচ থেকে সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। একটা বড় পাথর তুলল মারার জন্যে।

নিচ থেকে চিৎকার শোনা গেল, খবরদার, ফেলো ওটা!

চমকে ফিরে তাকাল পিচার, এই সুযোগে গড়িয়ে সরে গেল মুসা। আবার ছেলেটার পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আরেকবার ফেলে দিল মাটিতে।

পৌঁছে গেল রবিন আর কিশোর। তিন জনের সঙ্গে পারল না ছেলেটা, কাবু করে ফেলা হলো তাকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। দু-দিক থেকে দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে দু-জনে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে মুসা। বলল, আমার কুত্তাটা কোথায়? এই ফগ, ফগ?

ডাক শুনে কুঁই কুঁই করতে করতে এসে হাজির হলো বাচ্চাটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, ভয় আর ব্যথা ভুলে গিয়ে মুসার পা ঘেষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। ওটার গলার দড়ি খুলে নিয়ে পিছমোড়া করে হাত বাধা হলো পিচারের। বন্দিকে নিয়ে কেবিনে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল বুনো ছেলেটা, পালানোর চেষ্টা করল না আর।

ভিজে গোসল করে ওরাও কেবিনে পৌঁছল, বৃষ্টিও থেমে গেল। ঝড়ো বাতাসে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে দিল আকাশ।

আমার খিদে পেয়েছে, ঢুকেই ঘোষণা করল মুসা। উফ, যা দৌড়ানটা দৌড়েছি!

পেয়েছে তো আর কি, রবিন বলল, খাবার বানাও, মানা করছে কে।

গা মুছে, কাপড় বদলে রান্নাঘরে চলে গেল মুসা। বিরাট এক পাত্রে স্যুপ বসাল। সেই সঙ্গে চলবে স্যামন মাছের স্যান্ডউইচ।

বন্দির বাঁধন খুলে দিয়েছে কিশোর আর রবিন। কিছু শুকনো কাপড় এনে দিয়ে ভেজাগুলো বদলে নিতে বলল।

কেবিনের উজ্জ্বল আলোয় এই প্রথম কাছে থেকে ভাল করে ছেলেটাকে দেখতে পেল গোয়েন্দারা। বয়েস চোদ্দ হবে, তবে সেই তুলনায় অনেক লম্বা, গঠনও বড়দের মত। কালো লম্বা চুল লেপ্টে রয়েছে ঘাড়ে, কপালে, কতদিন কাটে না কে জানে। টারজানের বাচ্চা সংস্করণ মনে হলো ওকে রবিনের কাছে।

কাপড় বদলে চুপ করে বসল পিচার। পায়ে একটা গভীর কাটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এল কিশোর। কাটাটা আইয়োডিন। দিয়ে মুছে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। বাধা দিল না ছেলেটা। আইয়োডিন লাগানোর সময় যখন ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠল জখমটা, তখনও মুখ বিকৃত করল না। ভয় অনেকটা দূর হয়ে গেছে চোখ থেকে, বুঝে গেছে তার কোন ক্ষতি করবে না কিশোররা।

 ট্রে বোঝাই খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। হাসিমুখে কয়েকটা স্যান্ডউইচ আর একবাটি স্যুপ এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও পিচার, খেয়ে ফেলো।

দ্বিতীয়বার আর বলতে হলো না, গপ গপ করে গিলতে শুরু করল পিচার। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলল। আরও কিছু খাবার তার দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। হেসে বলল, বাহ, আমার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত একজনকে পাওয়া গেল।

পিচার আর মুসাকে খাওয়ায় ব্যস্ত রেখে ইশারায় রবিনকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। নিচু স্বরে বলল, ছেলেটাকে একটুও বিপজ্জনক লাগছে না আমার কাছে। কাল নদীর ধারে আমাদের ওপর চোখ রেখেছিল। যে, সে পিচার নয়। ওই লোকটা এর মতই লম্বা, তবে চেহারা মেলে না, অন্য রকম।

একমত হয়ে মাথা কঁকাল রবিন। আমরা তো আর সন্দেহ করিনি, আরিগন বলেছেন পিচার হতে পারে।

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ওরা, পিচারকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। মুসা। ফগকেও খাবার দেয়া হয়েছে। তাকে আদর করতে লাগল মুসা।

 স্টোভের আগুনে গরম হয়ে উঠেছে রান্নাঘর, বেশ আরাম। বৃষ্টিতে ভিজে এসে শুকনো কাপড় পরে, পেট ভরে খাওয়ার পর বুনো ভাবটা চলে গেছে পিচারের মুখ থেকে। মুসা আর ফগের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল, বুঝিয়ে দিল কুকুর ভালবাসে সে।

কিশোর ভাবল, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু পিচার বোবা, জবাব তো দিতে পারবে না, কি করে বলবে? শেষে বসার ঘরে চলে গেল। কিশোর, কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে এল। ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, আমি কয়েকটা কথা জানতে চাই, জবাব দেবে?

ওদের ব্যাপারে ভীতি আর সন্দেহ চলে গেছে পিচারের। মাথা ঝাঁকাল।

 বেশ, ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে বলল কিশোর, বলো, আমাদের কুকুরটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলে কেন?

বিস্ময় ফুটল ছেলেটার চোখে। টেবিলে কাগজটা বিছিয়ে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করতে লাগল। লম্বা, চওড়া কাধ একজন মানুষের চেহারা ফুটে উঠল কাগজে। ভুরু আর গোঁফ ভারি করে দিল সে।

এ তো আরিগন! অবাক কণ্ঠে বলে উঠল রবিন। কিন্তু ছবি এঁকে কেন? লিখলেও আরও সহজ হয়ে যায়।

লিখতে জানে না বোধহয়। হাত তুলল কিশোর, দাঁড়াও, পিচারের আঁকা এখনও শেষ হয়নি।

টেবিল ঘিরে এসেছে তিন গোয়েন্দা, তাকিয়ে রয়েছে কাগজটার দিকে। লম্বা একজন মানুষ আঁকল পিচার, হাত আঁকল, ফগের চেহারার একটা বাচ্চা কুকুর ধরেছে হাতটা।

আবার চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ও বলতে চায়, আরিগন চুরি করেছেন বাচ্চাটাকে!

<

Super User