শহুরে শব্দ আর বাড়ির ছায়াগুলো হারিয়ে গেল, ক্রমশ ছোট হয়ে এল দালানের আকৃতি, একসময় দৃষ্টির আড়াল হলো সোডা স্প্রিং-এর সবচেয়ে উঁচু দালান, গির্জাটাও। রুক্ষ ট্রেইল ধরে টানা এগোল জিম শেভার্ন, তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে সূর্য। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ঘোড়া দুটো, একসময় মৃত গ্রে টাকে খুঁজে পেল ও-ততক্ষণে ওটার শরীরে কামড় বসিয়েছে কয়োটের দল।

স্যাডল ছেড়ে নামল শেভার্ন। ঘোড়া বেঁধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসপত্র থেকে যে কটা ব্যবহার করা সম্ভব তুলে নিল। প্রায়ই মরা গ্রে-র দিকে চলে যাচ্ছে দৃষ্টি, বিষণ্ণ বোধ করছে। শেরিফ জেসন বেলহ্যামের মতে একেবারেই পাষাণ ও, কিন্তু ততটা বোধহয় হতে পারেনি এখনও। দুটো মাসট্যাঙ আর দুটো মৃতদেহ অসাধারণ একটা গ্রে-র বিপরীতে কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য লেন দেন হতে পারে না, যেখানে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে গ্রে-টা।

অকস্মাৎ দূরে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। ইন্ডিয়ানরা কি খেপে গেছে নাকি? সোডা স্প্রিং-এ কারও কাছ থেকে জেনে নিলে হত। শেষবারের মত জায়গাটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল ও। ইতোমধ্যে প্রায় শখানেক গজ উঁচু ট্রেইলে উঠে এসেছে ঘোড়া দুটো, কিন্তু সূর্য আর উত্তাপও উচ্চতার সাথে সঙ্গী হয়েছে।

গোল্লায় যাক সোডা স্প্রিং! কি কুক্ষণে যে শহরে ঢু মারতে ইচ্ছে হয়েছিল, এড়িয়ে গেলে এতক্ষণে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে যেত-ঝামেলা বা অযথা কিছু মূল্যবান সময় আর সম্পদ নষ্ট হত না।

দুই জুয়াড়ীও সুখী থাকত, এবং ও নিজে গ্রে-র স্যাডলে রাইড করত। মাসট্যাঙটা যথেষ্ট বাধ্য, কিন্তু আকারে ছোট হওয়ায় নিশ্চিন্তে স্যাডলে বসতে পারছে না শেভার্ন, প্রায়ই মনে হচ্ছে পায়ের ফাঁক গলে হয়তো সরে পড়বে ওটা।

দুরে আবারও পরপর দুটো গুলির শব্দ শোনা গেল, প্রতিধ্বনি হলো না একটারও। স্ট্যিাপের ওপর ভর দিয়ে সামনের এলাকা খুঁটিয়ে দেখল শেভার্ন, কিন্তু মাইলের পর মাইল বিরান প্রান্তর ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না। দূরে পর্বতমালার চূড়ায় তুষার জমা হয়েছে, শুভ্র বরফের মাঝখানে নীল শিরার মত উঁকি দিচ্ছে সবুজ গাছপালা। ট্রেইলের আশপাশে সবুজের কোন চিহ্ন নেই, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে কোন রকমে টিকে থাকা ফ্যাকাসে চেহারার জুনিপার ঝোপই চোখে পড়ছে শুধু। কোথাও কোন ছায়া নেই, জীবনের চিহ্ন নেই…

ঘণ্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেল, একসময় ওর সামনে চলে এল নিদাঘ সূর্য। সরাসরি চোখে পড়ছে আলো। হ্যাটের ব্রিম আরও নামিয়ে দিল শেভার্ন; শীতল ছায়াঘেরা কিছু জায়গার কথা মনে পড়ছে প্রায়ই, ঝামেলা এড়ানোর জন্যে থামেনি কোনটায়। মনে করতে থাকলে তো বেড়ে যাবে, সামান্য দুর্ভোগকেই দুর্বিষহ মনে হতে পারে ভেবে আমল দিল না। কিন্তু কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন বোধ করছে, হয়তো প্রচণ্ড উত্তাপই দায়ী সেজন্যে। জোর করে নিজেকে সচকিত করল শেভার্ন, তারপর আচমকাই উপলব্ধি করল: একা নয় ও!

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারবে না, কিন্তু নিশ্চিত জানে মাসট্যাঙ দুটো, জুনিপার ঝোপের কাছাকাছি আশ্রয় নেওয়া কাঁটাঅলা ব্যাঙের দল আর ও ছাড়াও অন্য কেউ এই খরতাপে দগ্ধ হচ্ছে। সন্দেহ চেপে রাখল শেভার্ন। কোন ইন্ডিয়ান যদি ওকে বুশওয়্যাক করতে চায়, ধরে নিতে হবে এরইমধ্যে সফল হয়ে গেছে সে। কোল্টের নাগাল থেকে হাত দুটো সরিয়ে রাখল ও, সতর্ক দৃষ্টিতে সামনের জমিতে নজর চালাচ্ছে। মাসট্যাঙের দুই কানের নড়াচড়া ওকে জানিয়ে দিল লোকটা বা জিনিসটা যাই হোক, সামনে কোথাও আছে।

দুই হাঁটু ঘোড়ার পেটের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল শেভার্ন, হাতের লাগাম যে কোন সময়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি। মাথা নেড়ে সামনে বাড়ল প্যাকহসটা। ঘোড়াকে আগে বাড়ানোর তান করল ও, লাগাম নেড়ে তাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর দাবাল। এই ফাঁকে পিস্তলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওর হাত। ঠিক তখনই মরা ঘোড়াটা দেখতে পেল।

বিশাল একটা রোয়ান পড়ে আছে ট্রেইলের পাশে। বেশিক্ষণ হয়নি মারা গেছে, সরু ধারায় ক্ষত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে এখনও। ঘোড়াটার বিশ কদমের মধ্যে। পৌঁছে গেল ও, আচমকা একটা রাইফেল দেখা গেল ঘোড়ার পিঠের ওপর। ওখানেই দাঁড়াও, মিস্টার! কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল।

লাগাম টেনে ধরল শেভার্ন। রাইফেলের নল স্থির হয়ে আছে ওর বুক বরাবর, বিন্দুমাত্র নডছে না। পলকের জন্যে রাইফেলের পেছনে ধূসর রঙের কিছু চুল দেখতে পেল। আজকে এরইমধ্যে দুজনের সঙ্গে লড়াই করেছি, একদিনের জন্যে যথেষ্ট এবং সাধ মিটে গেছে আমার, কয়েক সেকেন্ড পর নীরবতা ভাঙল শেভার্ন। স্যাডল ছাড়তে পারি?

ধীর-স্থির লোক বেশি দিন বাঁচে, এবং সুখে থাকে।

প্রবাদটার প্রয়োগ খুব সীমিত। আমি যদি যথেষ্ট ক্ষিপ্র না হতাম… কথাটা শেষ করল না ও, হাত থেকে লাগাম ছেড়ে দিল।

ধূসর চুলের একটা মাথা দেখা গেল রাইফেলের পেছনে, ইতোমধ্যে কণ্ঠ শুনে শেভার্নের ধারণা হয়েছে লোকটা বয়স্ক। দুঃখিত, স্ট্রেঞ্জার, এটা এমন এক দেশ যেখানে লোকজন প্রায়ই ভুলে যায় কিভাবে অন্যের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হয়, ব্যাখ্যা দিল সে।

আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গি, কিন্তু এই অঞ্চলের টান নেই। কয়েক মুহূর্ত ভাবার পর শেভার্ন ধারণা করল মরা ঘোড়ার পেছনে শুয়ে থাকা লোকটি জীবনের অন্তত কিছু সময় স্কটল্যান্ডে কাটিয়েছে। আচমকা টের পেল মাসট্যাঙ দুটো থেমে যাওয়ার পরই বরং গরম লাগছে বেশি, এতক্ষণ চলার পথে সূর্যের উত্তাপ এতটা অসহ্য মনে হয়নি। 

মরা ঘোড়ার পেছনে উঠে দাঁড়াল লোকটি। বয়সটা নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে না, পঞ্চাশ থেকে সত্তর, যে কোন বয়সের হতে পারে। রোদপোড়া তামাটে তুক, ধূসর কাঁচাপাকা চুল। কোন হ্যাট নেই মাথায়, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এক কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।

কাছের বসতিটা কত দূর? জানতে চাইল শেভার্ন।

 ত্রিশ মাইল দূরে, এবং ওখানে কোন ডাক্তার নেই।

এখান থেকে সোডা স্প্রিংও একই দূরত্বে, শেভার্নের ধারণা।

তাছাড়া, ক্লান্ত, দুর্বল স্বরে একমত হলো বুড়ো। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার দিকে যাবে তুমি, বুলেট বের করতে পারবে এমন অন্তত একজন লোক আছে সোডা স্প্রিং–এ।

খোদা, আবার! নিজেকে সামলে নিল ও। রাইড করতে পারবে?

চেষ্টা করার আগে বলতে পারছি না।

আকাশের দিকে তাকাল শেভার্ন। সূর্য ডুবতে অন্তত আরও কয়েক ঘন্টা বাকি। সবগুলো ঘোড়াকে একত্রিত করে বাঁধল ও, তারপর ক্যান্টিন বের করে বুড়োর দিকে এগিয়ে দিল। ছোট্ট একটা চুমুক দিল সে প্রথমে, কাশি উঠতে নিরস্ত হলো ক্ষণিকের জন্যে। মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা, কাঁধ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে পুরোদমে।

একটু পর কিছুটা সামলে নিল বুড়ো। গেলার চেষ্টা না করে আগে বরং কিছুটা চুষে দেখা উচিত, মন্তব্য করল সে। খুব বেশি তেষ্টা পেলে অবশ্য ভিন্ন। কথা, সোডা স্প্রিং-এর কটু স্বাদের পানিও তোমার কাছে সুপেয় মনে হবে।

আমার সন্দেহ আছে কোন চোলাইখানা আছে ওখানে, নিরাসক্ত স্বরে বলল শেভার্ন, জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। ভাবছে তেরপলের কাছাকাছি কিছু বোল্ডার এনে রাখতে হবে যাতে কয়োটেরা দূরে থাকতে বাধ্য হয়।

আরেক চুমুক পানি পান করল বুড়ো, এবার অবশ্য কোন অসুবিধে হলো না।

ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ করেছে তোমাকে?

 অদ্ভুত, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল বুড়ো। আমি নীল ম্যাকলেন্ডন, শেষে বলল

মৃদু নড করল ও, কিছুই বলল না।

তুমি কি নতুন এসেছ এদিকে?

 এই প্রথম।

লোকজন জানে বরাবরই ইন্ডিয়ানদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল আমার, ব্যাখ্যা করল ম্যাকলেন্ডন।

দুই জুয়াড়ী? আনমনে ভাবল শেভার্ন-অসম্ভব। বুড়ো গুলি খাওয়ার বহু আগেই মারা গেছে ওরা। তাছাড়া উল্টো দিক থেকে এসেছিল লোকগুলো। এ অঞ্চলে হয়তো লোকজন বেশি নেই, শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তবে খারাপ লোকের সংখ্যা কম নয়।

আচমকা চুলের মতই ফ্যাকাসে হয়ে গেল বুড়োর মুখ। শেভার্নের ধারণা হলো পুরো এক চুমুক পানি দেয়া ঠিক হয়নি তাকে। কারণটা অবশ্য ভিন্ন। হ্যাট ছাড়া প্রখর সূর্যের নিচে কয়েক ঘণ্টা থাকতে হয়েছে তাকে, স্রেফ মনের জোরের ওপর টিকে ছিল। এখন সাহায্য পাবে জেনে জীর্ণ শরীর শিথিল হয়ে গেছে।

একটা কম্বলের ভাঁজ খুলে দুটো জুনিপারের সাথে টানটান করে বাঁধল ও। কিছুটা ছায়া পাওয়া যাবে এতে। ম্যাকলেন্ডনের ফ্যাকাসে মুখে রঙ ফিরে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। ব্যান্ডানা ভিজিয়ে বুড়োর মুখ মুছে দিল শেভার্ন। শার্ট খুলে ক্ষতটা জরিপ করল। রক্তক্ষরণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেঁচে যাবে তুমি, শেষে বলল ও। বুলেটটা বের করতে হবে। এ মুহূর্তে তাপই বরং তোমার আসল শত্রু। মনে হয় না ত্রিশ মাইল রাইড করতে পারবে, যদিও ঢালু পথ বেয়ে নামতে হবে।

ঠিকই বলেছ।

কাজটা কে করেছে, চেনো?

চিনি, স্মিত হেসে বলল বুড়ো। আর কোন ব্যাখ্যা দিল না।

মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো একটা অভিশাপই তাড়া করছে আমাকে। এখানে বসে থেকে তোমাকে মরতে দেখা উচিত, নাকি সাহায্যের জন্যে যাওয়া উচিত আমার?

মরতে যাচ্ছি না আমি! তিক্ত স্বরে বলল বুড়ো। শহরে গিয়ে শুধু বোলো ম্যাকলেন্ডন বিপদে পড়েছে।

নড করল শেভার্ন। কিন্তু তোমার বন্ধুরা? ওরা তো ফিরে আসতে পারে, তাই না?

মনে হয় না। হারামজাদারা ভেবেছে মরে গেছি আমি।

বুড়োর নাগালের মধ্যে একটা পানির ক্যান্টিন আর কিছু খাবার রাখল শেভার্ন। মুহূর্তের দ্বিধা শেষে গ্রীন রীভারের বোতলটাও পাশে রেখে দিল। ধীরে সুস্থে খেয়ো, বুলেটের চেয়েও বেশি মানুষ মরেছে এটার কারণে।

আসল হুইস্কি নেই তোমার কাছে? আচমকা স্কটিশ উচ্চারণে জানতে চাইল নীল ম্যাকলেন্ডন।

সহাস্যে মাথা নাড়ল ও। বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি।

একটা নাম তো আছে তোমার, নাকি?

জিম শেভার্ন। আর কিছু লাগবে তোমার?

বুড়োর জন্যে বাড়তি কিছু করার নেই আর। রাইফেলটা লোড করা আছে। নিজের জন্যে যা করতে পারত, নীল ম্যাকলেন্ডনের জন্যেও তাই করেছে-যতটা সম্ভব আরামের ব্যবস্থা করেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার চেষ্টা করব, প্রতিশ্রুতি দিল ও, ভাবছে ঘোড়াগুলো কত দ্রুত ছুটতে পারবে। ইতোমধ্যে প্রায় বিশ মাইলের মত পাড়ি দিয়েছে।

ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন, পেছন থেকে আবারও বলল বুড়ো, স্মিত হাসি দেখা গেল ফ্যাকাসে ঠোঁটের কোণে, নীল চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আচমকা; স্যাডলে চাপছে তখন শেভার্ন, যে কারণে বুড়োর হাসি বা উজ্জ্বল চাহনি কোনটাই দেখতে পেল না।

যাত্রা শুরু করার পর শেভার্ন খেয়াল করল খুঁড়িয়ে চলছে প্যাকহর্সটা। খোঁড়া ঘোড়া মরুভূমিতে খুব সহজেই মরে। অতিরিক্ত মাসট্যাঙটাকে লীড হর্স হিসেবে ব্যবহার করল ও, তারপর চলার পথে প্রায়ই ঘোড়া বদল করতে থাকল।

সোডা স্প্রিং-এ যখন আবারও পৌঁছল, রাত নেমেছে তখন। রাস্তায় আলো নেই, নেই চাঁদের আলোও। ল-অফিসে বোধহয় কাউকে পাওয়া যাবে না এখন, ভাবল ও। পুরা শহরে কেবল একটা বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে-গোল্ডেন ঈগলে, যেখান থেকে সমস্ত ঝামেলার শুরু হয়েছিল।

সেলুনের সামনে এসে থামল শেভার্ন। স্যাডল ছাড়ার সময় টের পেল সত্যিই ক্লান্ত বোধ করছে। হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকল ও। ছয়-সাতজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বারের আশপাশে। একটা টেবিল দখল করে আছে চারজন। সেলুনের একটা মেয়ে ওকে দেখতে পেল প্রথম। তারপরই আচমকা নীরব হয়ে গেল পুরো সেলুন। অদ্ভুত হ্যাট পরা লাইমি ফিরে এসেছে আবার! বিড়বিড় করে বলল কেউ।

শেরিফকে কোথায় পাব বলতে পারো কেউ?

শেভার্নের প্রশ্নে উৎকণ্ঠা বা অস্বস্তি যেন আরও জাঁকিয়ে বসল সেলুনে। সোডা স্প্রিং-এ ইতোমধ্যে কুখ্যাত হয়ে গেছে ও, উপযুক্ত কারণও আছে। প্রথমবার এসেই জুয়ার টেবিলে খুন করেছে একজনকে, তারপর চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই দুটো লাশ নিয়ে ফিরে এসেছে। স্বেচ্ছায় কে কথা বলতে চাইবে এমন মূর্তিমান আপদের সঙ্গে?

ওকে সাহায্য করার ব্ল্যাপারে কাউকেই উৎসাহী মনে হলো না, বরং প্যাকহর্সের পিঠে এবার কি নিয়ে এসেছে, সেটা দেখতেই বেশি আগ্রহী। অপেক্ষায় থেকে একসময় অধৈর্য হয়ে পড়ল শেভার্ন, কিন্তু সযত্নে বিরক্তি চেপে রাখল।

তিন দরজা যেতে হবে আরও, পরের বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ো-তাহলেই জায়গামত পৌঁছে যাবে-নরকে! প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে বলল বিশালদেহী বারটেন্ডার, শেষ পর্যন্ত অন্তত একজন সাহস সঞ্চয় করেছে।

শেরিফকে ডেকে আনছি আমি, বলে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।

অপেক্ষার ফাঁকে একটা বীয়ার নিল শেভার্ন। স্পষ্ট টের পাচ্ছে অন্যদের কৌতূহলী দৃষ্টি ফুড়ে যাচ্ছে ওকে, কিন্তু কেউই প্রশ্ন করছে না। নিজেও মুখ খুলল না ও। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেলুনে চুকল শেরিফ জেসন বেলহ্যাম; উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে ঘুমের রেশ লেগে আছে এখনও। একবার সতর্ক করেছি তোমাকে… সরোষে বলতে শুরু করল সে, চোখে তীব্র অসন্তোষ।

ম্যাকলেন্ডনের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছি আমি।

পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এল সেলুনে, স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখছে শেরিফ। শেষে বোধহয় বুঝতে পারল ঝগড়া করার তালে নেই শেভার্ন, হাল ছেড়ে দিল সে। বলে যাও, বিড়বিড় করল লম্যান।

একজন ডাক্তার আর একটা ওয়্যাগন নিয়ে যদি সময়মত পৌঁছতে পারো তাহলে হয়তো বেঁচে যাবে সে। আরেকটা দিন রোদের মধ্যে টিকতে পারবে না বুড়ো। এই ফাঁকে কেউ কি আমাকে একটা তাজা ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দেবে? যেটায় এসেছি মনে হয় না অতদূর পর্যন্ত যেতে পারব।

সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থাকল শেরিফ, শেষে কোমল হয়ে এল চাহনি। আবার যাওয়ার দরকার নেই তোমার, এরইমধ্যে বোধহয় একশো মাইলের মত ঘোড়া ছুটিয়েছ।

কিন্তু এ শহরের ব্যাপারে কিছুটা অস্বস্তি আছে আমার, এবং নিশ্চিন্ত না হয়ে কোথাও রাতও কাটাই না। তাছাড়া ম্যাকলেন্ডন লোকটা যেই হোক, ওর কাছেই আমার মালপত্র রেখে এসেছি।

এবারও ব্যাখ্যা দিল না কেউ।

ডাক্তার আর লিভারি স্টেবলের হসলারকে জাগাতে দুজনকে পাঠাল শেরিফ। এই ফাঁকে বীয়ারে শেষ চুমুক দিল শেভার্ন, ভাবছে সামান্য বীয়ারই সহ্য করতে পারে কি-না এখন, শরীরে যা ক্লান্তি। শেষবার ঘুমানোর পর কত পথ যে পাড়ি দিয়েছে মনে করতে পারল না। কয়েকটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে শরীর সোজা করে দাঁড়াল ও, কঠিন হয়ে গেছে পেশীগুলো। সেলুনের লোকগুলোকে নিজের ক্লান্তি সম্পর্কে জানতে দিতে চায় না।

শেষ পর্যন্ত সবকিছুরই ব্যবস্থা হলো। শেভার্নের জন্যে তাজা ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে, মাসট্যাঙের চেয়ে বড়জোর এক হাত লম্বা হবে, একটা বাকবোর্ডের পেছনে বেঁধে রাখা হয়েছে ওটাকে। তেরপল দিয়ে বাকবোর্ডটা এমন ভাবে ঢাকা যে প্ৰেয়ারির স্কুনারের মত দেখাচ্ছে। কষ্টেসৃষ্টে স্যাডলে চাপল শেভার্ন, তারপর শেরিফের পাশাপাশি এগোল। আগেই বাকবোর্ডে উঠে বসেছে স্বল্পভাষী ডাক্তার।

স্যাডল থেকে দুবার খসে পড়ার অবস্থা হলো ওর। একসময় ক্লান্তি আর ঘুমের সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাকবোর্ডে চড়ে বসল, শক্ত পাটাতনে শুয়ে পড়ল, বন্ধুর ট্রেইলে বাকবোর্ডের লাগাতার লাফ-ঝাপ বা ধীর গতি কোনটাই বিরক্ত করতে পারল না ওকে। চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এল। টানা ঘুমিয়ে জাগল। পরদিন ভোরে।

ঘুম থেকে উঠে চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল শেভার্ন, বুঝতে চাইছে কত দূরে এল। ঘণ্টাখানেক পর ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ততক্ষণে মারা গেছে নীল ম্যাকলেন্ডন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। মরা এক আগন্তুকের জন্যে এত খাটুনি! ভাবতেই অবাক লাগছে, নিজের ওপর কিছুটা বিরক্তিও জাগছে। ষাট মাইল বন্ধুর ট্রেইল পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া দুর্ভোগ কোন কাজে আসেনি বুড়োর, লাভের মধ্যে আরেকটা দিন খুইয়েছে ও। হয়তো এখানে থাকাই উচিত ছিল, ম্যাকলেন্ডনের মৃত্যুর সময় কিছুটা হলেও সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারত।

কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে মরার মত খারাপ ছিল না ম্যাকলেন্ডনের অবস্থা, অন্তত শেভার্নের তাই মনে হয়েছে। নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করল ও, এদিকে মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছে ডাক্তার।

ও গুলি খেয়েছে আমাদের বলোনি কেন? জানতে চাইল শেরিফ।

নিখাদ বিস্ময় নিয়ে মাঝবয়সী লোকটিকে দেখল শেভার্ন। তাতে কিছু যেত আসত? এ এলাকায় একেবারেই নতুন আমি, সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি এ অঞ্চলে সামান্য কারণেও মারা যেতে পারে মানুষ।

রাগে লাল হয়ে গেল শেরিফের মুখ, কিন্তু উত্তর দিল না।

দ্বিতীয় শটে মারা গেছে ম্যাকলেন্ডন, দীর্ঘ নীরবতা ভাঙল ডাক্তার।

 চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল শেভার্ন। অসম্ভব!

তুমি কি ডাক্তার? প্রশ্ন করল চিকিৎসক।

 আরে না! ওকে যখন রেখে গেছি, শুধু কাঁধে একটা ক্ষত ছিল। ওর বাঁচার সম্ভাবনা যদি নাই থাকত তাহলে এত পথ পাড়ি দিলাম কেন যেখানে ওই শহরে ফিরে যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই আমার?

ঠিক আছে! অধৈর্য স্বরে বলল সোডা স্প্রিং-এর ল-ম্যান। মানছি, নিজের দিকটা পরিষ্কার করেছ তুমি!

ওর রাইফেলটা এখনও লোড করা?

অস্ত্রটা পরীক্ষা, করল শেরিফ। ৫০ ক্যালিবারের স্প্রিংফিল্ড, চেম্বারে এক রাউন্ড তাজা বুলেট রয়ে গেছে তখনও।

সিঙ্গেল শট, তাই না?

 অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল জেসন বেলহ্যাম, শেষে নড করল।

বাকবোর্ডে ম্যাকলেন্ডনের মৃতদেহ তুলল শেরিফ আর ডাক্তার, এই ফাঁকে নিজের জিনিসপত্র গোছাতে ফিরে গেল শেভার্ন। আচমকা টের পেল সন্দেহের দৃষ্টিতে ওকে দেখছে অন্য দুজন।

ম্যাকলেন্ডন কে, জানো তুমি?

মি. বেলহ্যাম, ক্লান্ত সুরে বলল শেভার্ন। আমি এমনকি এখনও জানি না তুমিই বা কে। এখানে নিজের সম্পর্কে মুখ খোলে না কেউ, দুদিনের অভিজ্ঞতায় একটা কথা নিশ্চিত জেনেছি-একমাত্র সেন্ট পলের দৃষ্টিভঙ্গিই সঠিক!

প্যাচাল বন্ধ করো তো! তুমি কি জানো কে গুলি করেছে ওকে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছে চেনে।

তো?

তো কি?

বলেনি তোমাকে?

তথ্যটা আমাকে দেয়ার মত যোগ্য লোক মনে করেনি মি. ম্যাকলেন্ডন, আচমকা অদ্ভুত একটা ব্যাপার মনে পড়ল শেভার্নের, ঘুরে মরা ঘোড়াটার দিকে তাকাল। সত্যিই মজার বিষয়! স্বগতোক্তি করল ও।

মজার বিষয়?

গ্রীন রীভারের একটা বোতল রেখে গিয়েছিলাম। ওটা দেখছি উধাও হয়ে গেছে!

কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নেমে এল। ইন্ডিয়ান? শেষে মন্তব্য করল ডাক্তার।

মি. ম্যাকলেন্ডন নিশ্চিত ছিল ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ করেনি ওকে।

দ্বিতীয় শটের কথা বলছি আমি। কাঁধের ক্ষতের জন্যে নয়, বরং নতুন একটা শটের জন্যে মারা গেছে নীল ম্যাকলেন্ডন। খুব কাছ থেকে ওকে গুলি করেছে কেউ।

সেটা যদি জানোই, তাহলে আমাকে সন্দেহ করছ কেন?

দলা পাকানো একটা কাগজ বের করল শেরিফ, সতর্কতার সাথে ভাজ খুলে মেলে ধরল ওর সামনে। পড়ল শেভার্ন:

দশ হাজার পশু, ঠিকমত দেখেন রাখতে পারলে সত্যিই লাভজনক সম্পত্তি হতে পারে। এক-তৃতীয়াংশ হবে তোমারও, শেভার্ন।

পড়তে পারছ? অধৈর্য কণ্ঠে জানতে চাইল শেরিফ।

নিশ্চয়ই।

হস্তাক্ষরের ব্যাপারে কি বলবে?

বুড়ো কোন মানুষের লেখা-হিজিবিজি, তবে পড়া যাচ্ছে। কি জানতে চাইছ তুমি?

সত্যিই কি বুড়ো লিখেছে এটা?

স্থির দৃষ্টিতে শেরিফের দিকে তাকাল শেভার্ন। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আসলে কি জানতে চাও তুমি?

আমাকে যে নোট পাঠিয়েছ হস্তাক্ষরটা কিন্তু সেটার মতই মনে হচ্ছে।

তোমাকে পাঠিয়েছি…? তারপরই গতদিনের ব্যাপারটা মনে পড়ল শেভার্নের। ওই ছেলেটার কথা বলছ তো? কিন্তু তাতে কি?

কিছুই না। দেখা যাচ্ছে একই হাতের লেখা।

শ্রাগ করল শেভার্ন। মি. ম্যাকলেন্ডন একজন স্কটিশ। আমরা বোধহয় একই। ধরনের শিক্ষকের কাছ থেকে পড়তে বা লিখতে শিখেছি।

তারপরও একই রকম মনে হচ্ছে।

ফালতু ব্যাপার! তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল ও। স্কটিশরা বরাবরই কপারপ্লেট হরফ পছন্দ করে, হয়তো কিছুটা ধীর-স্থির আর স্পষ্ট লেখা হয় বলেই। তোমরা আমেরিকানরা যা অস্থির, স্বভাবের মতই টেনে-টুনে পেঁচিয়ে লিখতে পছন্দ করো। স্পেন্সার হরফে হয়তো দ্রুত লেখা সম্ভব, কিন্তু কপারপ্লেট হরফের লেখা পড়া ততোধিক সহজ। যাকগে, মি. ম্যাকলেন্ডনের নোটের সাথে আমার সম্পর্ক কি? এতে কি স্পষ্ট হয় খুনটা আমিই করেছি?

উঁহু, নোটের লেখা কোন ভাবেই তোমাকে অভিযুক্ত করে না। ভাবতেই অবাক লাগছে নিজের সম্পত্তি এক আগন্তুককে দিয়ে গেছে মি. ম্যাকলেন্ডন, অথচ ওর পরিবার আছে!

আজব এক দেশ এটা এবং তারচেয়েও আজব চিড়িয়ায় ভরা! ঘুরে নিজের ঘোড়ার দিকে এগোল শেভার্ন, তারপর আচমকাই উপলব্ধি করল কাকে নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে বুড়ো ম্যাকলেন্ডন।

.

০৪.

 ব্যাপারটা শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, রীতিমত খাপছাড়া, অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর। নীল ম্যাকলেন্ডনকে দেখে মনে হয়নি অসুস্থ ছিল, কিন্তু নিজের পরিবারকে বঞ্চিত করল কেন?

ঘুরে ডাক্তার আর শরিফের মুখোমুখি হলো শেভার্ন। তোমাদের কথা বুঝতে ভুল না হলে ধরে নিচ্ছি নিজের সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছে বুড়ো। এবার আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। যত দামই হোক, ম্যাকলেন্ডনের সম্পত্তি যদি সোডা স্প্রিং-এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যেও থাকে, সেটা গ্রহণ করছি না আমি! ফর্ক দিয়ে লোকজন পানি পান করে এমন যে কোন জায়গায় স্থির হতে পারি, কিন্তু এখানে থামছি না! এমনকি সোডা স্প্রিং-এর শেরিফ বদল হলেও মত পাল্টাবে না আমার।

বেশি দূরে যেতে হবে না, শুকনো স্বরে বলল শেরিফ, থমথমে মুখ দেখে বোঝা গেল অন্তত এবার নীরবে অপমান হজম করছে। দশ মাইল সামনে গেলেই নীল ম্যাকলেন্ডনের বাথান। শেভার্ন যেদিকে যাচ্ছিল সেদিক নির্দেশ করল সে। কিন্তু ওখানেও আমার কর্তৃত্ব রয়েছে। এবার প্যাচাল বাদ দিয়ে স্যাডলে চেপে শহরে ফিরে চলল।

দুঃখিত।

 দুঃখিত?

সোডা স্প্রিং-এর কর্তৃপক্ষ আমাকে সতর্ক করেছে শহরে আমার আগমন ভাল চোখে দেখবে না কেউ।

নিকুচি করি তোমার! তুমি কি চাও বাগানে গিয়ে কেঁচো খুঁড়ে খাই আমি?

বিস্ময় নিয়ে দুজনের বাদানুবাদ দেখছে ডাক্তার।

কোন অপরাধের অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে?

না।

তাহলে নিজের পথে যেতে পারো তুমি, ঘোড়ার দিকে এগোল শেভার্ন, তারপর আচমকা লেখাটার কথা মনে পড়ল-কপারপ্লেট হরফের লেখাটা ওকে পড়তে দিয়েছিল শেরিফ।

কি ধরনের লোক হলে এমন সম্পত্তি হাতছাড়া করতে পারে!

নীরবতা নেমে এল। খুনীর সম্ভাব্য পরিচয় পেতে চারপাশে ট্র্যাক খোজা শুরু করল জেসন বেলহ্যাম, শেভার্ন নিজেও সাহায্য করল তাকে। কিন্তু তেমন কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না ওদের। ট্রেইল থেকে ক্যাম্পের দিকে সরে এসেছে বড়সড় একটা ঘোড়া, বিশ কদম দূর থেকে ম্যাকলেন্ডনকে গুলি করেছে অশ্বারোহী। তারপর গ্রীন রীভরের বোতলটা নিয়ে কেটে পড়েছে, অন্য কিছু স্পর্শ করেনি।

নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে একটা গোল্ড প্যান বের করল শেভার্ন, পানি ভরে এগিয়ে দিল ঘোড়ার উদ্দেশে। পানি শেষ করে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল ঘোড়াটা।

দেখে মনে হয় না কোন মাইনার তুমি, গোন্ড প্যানটার ওপর লেগে আছে শেরিফের দৃষ্টি।

তোমাকেও শেরিফ মনে হয় না আমার, বলতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিল

পরিবারটা বিপদে আছে।

একটা দলিল লিখে দিচ্ছি, ওই সম্পত্তি চাই না আমার।

ব্যাপারটা তা নয়, শুকনো, হতাশ সুরে বলল শেরিফ, খানিকটা হলেও বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। ম্যাকলেন্ডনদের ভাল-মন্দ দেখবে এমন লোককে কেবল কথায় নয়, কাজেও পারদর্শী হতে হবে।

ভাড়া খাঁটি না আমি।

না, আমারও তাই মনে হয়। যে ছেলেটাকে আমার কাছে পাঠিয়েছ তুমি, চেনো ওকে? ম্যাকলেন্ডনের ছেলে ও।

ঘুরে শেরিফের মুখোমুখি হলো শেভার্ন। আসলে আমার কাছে কি চাও

কৌতূহল হচ্ছে, জানতে চাইছি আসলে কি আছে তোমার মধ্যে। কেন নিজের পরিবারের চেয়ে তোমাকে শ্রেয় মনে করেছে ম্যাকলেন্ডন-সত্যিই যদি তাই করে থাকে! বেঁচে থাকতে বুড়োকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত লোকজন, কিন্তু একটা কথা বলত না কেউ।

নীরবে অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন।

কেউ বলেনি যে সে বোকা। …এবার কি দয়া করে সোডা স্প্রিং-এ গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করবে?

এত করে বলছ যখন! বিদ্রুপের স্বরে বলল শেভার্ন, স্যাডলে চেপে অপেক্ষায় থাকল। বাকবোর্ড ঘুরিয়ে এগোতে শুরু করল ডাক্তার।

আগে গেলে ধুলো কম লাগবে, বাতলে দিল শেরিফ।

এবং আমার পিঠ জরিপ করার লোকও বেশি থাকবে, মনে মনে বলল শেভার্ন। ক্ষীণ হেসে নড করল ও, কিন্তু বাকবোর্ডের পেছনেই থাকল।

আবারও যখন সোডা স্প্রিং-এ পৌঁছল ওরা, ডাক্তার আর শেরিফ তখন স্যাডলে বসেই ঢুলতে শুরু করেছে। গতরাতে কিছুটা হলেও বিশ্রাম পেয়েছে শেভার্ন, ক্লান্তি লাগছে না তেমন। সতর্ক দৃষ্টিতে শহরের একমাত্র রাস্তাটা জরিপ করল ও। ফাইন ফার্নিচার অ্যান্ড কিউনেরালস-এর সামনে থামল ওরা। তুমিই যেহেতু আসতে বাধ্য করেছ, নিস্পৃহ স্বরে বলল ও। এবার নিশ্চয়ই কোথায় থাকতে পারি সেই পরামর্শও দেবে?

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল শেরিফ, চিন্তাটা যেন মাথায় আসেনি তার। মিজ বোম্যানের ওখানে চলে যাও, স্বেচ্ছায় পরামর্শ দিল ডাক্তার।..

শহরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জায়গা, একমত হলো জেসন বেলহ্যাম, আঙুল তলে দেখিয়ে দিল।

নির্দেশ মত এগোল শেভার্ন।

মিসেস বোম্যান মোটাসোটা হাসিখুশি মহিলা, এক নজরেই পছন্দ হলো শেভার্নের। ভেতরে ঢোকার পরপরই ছোট একটা ছেলেকে ওর মালপত্র নিয়ে আসার ইঙ্গিত করল। ঘোড়া দুটোকে স্টেবলে নিয়ে গেল ছেলেটা। ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে তুলতে থাকল শেভার্ন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তরুণী এক মেয়েকে পেছনের আঙিনায় পানি গরম করার নির্দেশ দিল মহিলা।

পানি গরম করো তোমরা? আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে জানতে চাইল ও।

সোডা স্প্রিং-এর পানি খুব ঠাণ্ডা, ব্যাখ্যা দিল মিসেস বোম্যান, নিজেই দোতলার একটা কামরায় নিয়ে এল ওকে।

ধূলিমলিন জুতো খুলে মোটামুটি আরামদায়ক বিছানায় দীর্ঘদেহ বিছিয়ে দিল শেভার্ন। দারুণ ক্লান্তি লাগছে, দরজায় করাঘাতের শব্দে সচকিত হলো ও। তরুণী মেয়েটিকে অনুসরণ করে নিচে নেমে এল হলঘর হয়ে আরেক কামরায় ঢুকে রীতিমত বিস্মিত হলো। আশা করেছে গরম পানি পৌঁছে দেওয়া হবে কামরায়, কিন্তু টিনের তৈরি বাথটাব বসানো হয়েছে এখানে। সরু নালার ড্রেন পানি খালি করছে পেছনের বাগানে।

ওর কাপড়গুলো ধুতে নিয়ে গেল তরুণী। গা পরিষ্কার করতে প্রায় পুরো একটা সাবান খরচ করে ফেলল শেভার্ন, ফেনা হচ্ছে না তেমন। শেষে বিরক্ত হয়ে ইস্তফা দিল। শরীর থেকে ক্ষারের মিহি প্রলেপ ধুয়ে একটা কম্বল জড়াল গায়ে। হলঘরে ঢুকতেই থমকে দাড়াল, বাইরের দরজা খুলে গেছে।

যে মুখটা দেখতে পেল, মানতেই হলো বিষণ্ণ হলেও এমন অপূর্ব সুন্দর মুখ বহুদিন দেখেনি ও। শুধু কম্বলমোড়া একজন পুরুষকে সামনে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়ালে সরে গেল মেয়েটা। নিজের কামরায় ফিরে এসে কাপড় পরল শেভার্ন, বিছানায় শুয়ে একটা চুরুট ধরাল।

লাল-চুলো মেয়েদের নিয়ে পশ্চিমে বহু মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে, আদৌ এসবের কতটা সত্যি কে জানে। ভাবতেই বিস্ময় লাগছে ওর। তবে এরচেয়েও। বেশি বিস্ময় বোধ করছে নিজেকে নিয়ে-এভাবে ছন্নছাড়ার মত কাটাতে থাকলে কোথায় গিয়ে থামবে শেষে? অন্যদের মত সৌভাগ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ও, কারণ বরাবর যে কোন লড়াইয়ে বিজিতের পক্ষ নিয়েছে। এবার বোধহয় ভাগ্য পরিবর্তন করার সময় হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা এক লোকের কাছ থেকে একটা বাথান আর দশ হাজার পশুর উত্তরাধিকার নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, যেখানে নিজের পরিবারকে বঞ্চিত করেছে লোকটি? ক্ষণিকের পরিচয় হলেও ওর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস রেখেছে বুড়ো, অথচ গৃহযুদ্ধের শুরুতে আঠারোশো চৌষট্টির গোড়ার দিকেই নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে ও।

ডিনারের ঘণ্টার শব্দে যখন ঘুম ভাঙল ওর, উঠে দেখল ধোয়া কাপড় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কামরায়, আগের চেয়ে কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। সাফসুতরো হয়ে নিচে নেমে এল ও। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় দেখল অন্য অতিথিরা আগেই টেবিলে এসে বসেছে।

নেহায়েত দায়সারা গোছের পরিচয় হলো অন্যদের সঙ্গে। হলে দেখা লাল চুলো মেয়েটি নেই টেবিলে। খাওয়ার দিকেই মনোযোগ দিল শেভার্ন। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় ঠিকমত পেটে পড়েনি কিছু। স্টু, বেকন, মাংস আর রুটি সহযোগে খাওয়া সারল ও। খাবারটা সুস্বাদু, রাধুনীর হাতের গুণেই বোধহয়-সোডা স্প্রিং-এর ক্ষার-মিশ্রিত পানি কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি খাবারের গুণগত মানে। সবশেষে কফি দেওয়া হলো, কিছুটা ক্ষারীয় স্বাদ। থাকলেও অন্তত খাওয়ার অযোগ্য হয়নি। মিসেস বোম্যান পুরোপুরি সফল।

অন্যদের নির্লিপ্ত আচরণে বোঝা গেল ইতোমধ্যে ওর খ্যাতি সম্পর্কে জেনে গেছে সবাই। খারাপ খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। বোম্যানস হাউসে প্রায়ই এরকম বিতর্কিত চরিত্রের অতিথির সমাগম হয় কিনা কে জানে, আনমনে ভাবল শেভার্ন।

সোডা স্প্রিং-এ আদপে কোন চার্চ নেই। ফিউনেরালের কাজ তাই কবরের পাশে সারা হয়। পরদিন ভোরে নীল ম্যাকলেন্ডনের ফিউনেরালে যোগ দিল শেভার্ন। লোকজনের সমাবেশ হতাশ করল ওকে, গুটি কয়েক লোক উপস্থিত? দূর থেকেই ওর উদ্দেশে নড করল ডাক্তার আর শেরিফ। কবরের পাশে চারটে চেয়ার রাখা, এর মধ্যে দুটো শূন্য।

কবরের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা, পাশেই এক তরুণ। পেছন থেকে দুজনকে দেখল শেভার্ন। একটু পর বুঝতে পারল এই মহিলাই বোম্যানস হাউজে দেখা সেই লাল-চুলো যুবতী, আর ছেলেটা ওর সঙ্গে সোডা স্প্রিং ছাড়তে চেয়েছিল। নীল ম্যাকলেন্ডনের পরিবার।

রহস্যময় চরিত্র একেকজন!

মোমের মত চটচটে চামড়ার এক প্রীচার গৎ বাঁধা সুরে প্রার্থনা করছিল, প্রায়ই কেশে উঠছে। কিছুটা হলেও শঙ্কিত দেখাচ্ছে তাকে, যেন আশঙ্কা করছে। কঠিন লোকটিকে ওর নিজ হাতেই কবরে শোয়াতে হবে।

ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন। নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে মিথ্যে বড়াই করেছিল বুড়ো, নাকি ভুল ধারণা করেছে? কিংবা সীমান্তের কাছাকাছি এই শহরের লোকজন নেহায়েতই অসামাজিক? গতকাল ভোরে সোডা স্প্রিং-এ ঢোকার ক্ষণটি মনে পড়ল ওর। সূর্য ওঠার আগেই প্রাত্যহিক কাজ শুরু করার জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বেশিরভাগ লোক।

ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন। বুড়ো বলেনি যে এখানে খুব জনপ্রিয় সে-শুধু বোঝাতে চেয়েছে সোডা স্প্রিং-এ পরিচিত।

প্রার্থনা শেষে কবরের দিকে এগোল লাল-চুলো যুবতী, পাশে ডাক্তার আর ছৈলেটা। কবরে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলল মেয়েটা, ঘুরে দাড়াল এরপর। শেভার্ন। খেয়াল করল শোকে কাতর নয় মেয়েটি, বরং কিছুটা হলেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কোমরের ওপর থেকে সারা শরীর আড়ষ্ট, নাড়াচাড়া করছে না। সেজন্যেই হাঁটার সময় ওকে সাহায্য করছিল অন্য দুজন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল শেভার্ন। সুন্দরী কোন মহিলার জন্যে মানসিক অক্ষমতা সত্যিই দুঃখজনক।

মি. শেভার্ন?

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ও। যুবতীই ডেকেছে ওকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, মুখ নির্বিকার, ভান করছে ওকে চেনে না।

তুমিই কি আমার বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলে?

 নড করল ও।

বিকেলে বাবার উইল পড়ে শোনানো হবে, নিরুত্তাপ স্বরে বলল মেয়েটি।

শেভার্ন কোন উত্তর দেয়ার আগেই ফিরতি পথে এগোল যুবতী, ডাক্তার আর ছেলেটা সাহায্য করছে ওকে।

বদহজম হয়েছে যেন, এমন ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল জিম শেভার্ন, বিতৃষ্ণা বোধ করছে। চুরুট ধরানোর ফাঁকে কবরের দিকে নজর চালাল, বেলচা দিয়ে মাটি ফেলছে দীর্ঘদেহী এক লোক, নিখাদ পাথরের মত কঠিন মুখ লোকটার।

ঘুরে দাঁড়িয়ে লিভারি স্টেবলের উদ্দেশে এগোল ও। চলে যাচ্ছ? জানতে চাইল হসলার।

উঁহু, ঘোড়াগুলো দেখতে এসেছি, চুরুট নেভানোর সময় বলল ও। ঘোড়াগুলোর কোনটাকেই এখন আর ক্লান্ত মনে হচ্ছে না, যথেষ্ট বিশ্রাম আর দানাপানি জুটেছে। ঘোড়াগুলোর মালিকানার ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছে শেরিফ, আগের মালিকদের সম্পর্কে কিছু জানেনা তুমি?

শ্রাগ করার সময় থোক করে তামাকের রস মাটিতে ফেলল লোকটা। লাল মুখো মাসট্যাঙের মালিককে তুমি নিজেই নিয়ে এসেছ।

আমারও তাই মনে হয়েছে, হসলার সত্যিই সহজ সরল লোক নাকি ওর সঙ্গে রসিকতা করছে, বুঝতে পারল না শেভার্ন।

ফের শ্রাগ করে থুথু ফেলল হসলার। গোল্ডেন ঈগলে কিছু বেপরোয়া লোক সবসময়ই থাকে। শুনেছি ওখানে কয়েকটা পট জিতেছ তুমি। ওদের কেউই বোধহয় টাকাটা ফেরত নিতে চেয়েছিল।

নতুন কিছু জানা হলো না। অন্য ঘোড়র মালিক, তরুণ ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জানো?

নেহায়েত ড্রিফটার! মনে হচ্ছে যুদ্ধের পর থেকে দোজখে পরিণত হয়েছে দেশটা। নানা কিসিমের ধান্ধাবাজ আর বন্দুকবাজ গজিয়ে উঠছে, এদের সামাল দেয়ার লোকের অভাব পড়ে গেছে।

ম্যাকলেন্ডন কে?

বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল হসলার। তুমিই তো নিয়ে এসেছ ওকে, তাই না?

 সত্যি। কিন্তু নামটা ছাড়া ওর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না।

পশ্চিমের পাহাড়ে বিশাল একটা বাথান আছে ওর। ইদানীং পড়শীদের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছিল, আমার ধারণা ঝামেলা থেকে চিরতরে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে সে।

একমত না হয়ে উপায় নেই। হসলারকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেবল থেকে বেরিয়ে এল শেভার্ন। আরেকটা চুরুট ধরানোর সময় ভাবল কিভাবে সকালটা কাটাবে। সারা শহরে কেবল গোন্ডেন ঈগলে পোকার খেলা চলে, সেখানে কেউ যদি ওকে পেছন থেকে গুলি করার ফিকিরে না-ও থাকে, মনে হয় না খেলতে রাজি হবে কেউ। সোডা স্প্রিং-এর প্রায় সবাই জেনে গেছে জিম শেভার্ন ওরফে লাইমিকে পোকারে ঠকানোর ফলাফল স্বাস্থ্যকর হয় না।

রাস্তার উল্টোদিকে ডোরাকাটা একটা খুটি দেখতে পেয়ে এগোল ও। ভেতরে ঢুকতেই টের পেল নীরব হয়ে গেছে পুরো দোকান, বুঝতে অসুবিধে হলো না এখানেও ওর কুখ্যাতি পৌঁছে গেছে। চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষায় ছিল দুই লোক, কিন্তু আগে ওকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুজনেই।

অপেক্ষা করব আমি, বলল শেভার্ন। কিন্তু দুজনেরই হঠাৎ জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেছে, দ্রুত বেরিয়ে গেল একজন। অগত্যা একটা চেয়ারে বসে পড়ল শেভার্ন। কারও থালার খাবার কেড়ে নেই না আমি, নাপিত সাবানের ফেনা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলার আগে মৃদু স্বরে মন্তব্য করল ও।

ব্যক্তিগত ভাবে তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই, মি. লাইম জুস, চেষ্টাকৃত কোমল স্বরে বলল অপেক্ষারত অন্য খদ্দের। আসলে তোমার কাছাকাছি থাকারই ইচ্ছে নেই! বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।

এই পানি দিয়ে কিভাবে এত ফেনা তৈরি করেছ? নাপিতের উদ্দেশে জানতে চাইল শেভার্ন।

নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল নাপিত। তোমার চুলের গাঁজলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ তোমাকে বলেনি, টাবের পাশে সবসময় সোডা অ্যাশের সরবরাহ থাকে। সাবান ব্যবহার করার আগে পানিতে কিছু সোড়া মিশিয়ে নিতে হয়, পানি নাড়াচাড়া করার পর ফেনাটুকু তুলে নিলেই ক্ষারের পরিমাণ কমে যায়। কাপড়ের ক্ষেত্রেও একই কাজ করা উচিত, যদি না কেউ প্যান্ট বা ট্রাউজারের পা-কে স্টিল্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

ব্যাপারটা ধাঁধার মত লাগছে শেভার্নের কাছে, ক্ষার-মিশ্রিত পানির সঙ্গে আরও ক্ষার মেশালে পানির গুণগত মান না বাড়লেও অন্তত গ্রহণযোগ্য হয় কিভাবে? অবশ্য এ ধরনের আরেকটি রীতির কথা জানে ও-লোকোমোটিভ ট্রেনের বয়লারে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়।

প্রথম পোচ দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে নাপিত, তার দ্বিধা দেখে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করল শেভার্ন। কিন্তু পরমুহূর্তে শিথিল হয়ে গেল শরীর, অযথাই তটস্থ হয়েছে। নিচু খ্রিমের হ্যাট পরা এক লোক দরজায় উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখেই মত বদলে ফেলেছে।

ওই লোকটা কে, মনে হচ্ছে ওকে চেনা উচিত?

এ শহরে থাকতে হবে আমার।

আমিও থেকে যেতে পারি, উপহাসের সুরে বলল ও।

গুড লাক। তোমার এবং শেরিফ, দুজনেরই সৌভাগ্য কামনা করছি।

মুখ ক্ষৌরি শেষ হওয়ার পর মিসেস বোম্যানের হোটেলের দিকে এগোল। শেভার্ন, রাস্তায় যে কোন অস্বাভাবিক নড়াচড়ার ব্যাপারে সচেতন। খাবারের ঘন্টার ঠিক আগ মুহূর্তে পৌঁছল ও। এবারও লাল-চুলো যুবতী অনুপস্থিত থাকল টেবিলে।

খাওয়া শেষ করে পোর্চে এসে দাঁড়াল শেভার্ন, চুরুট ধরিয়ে মাত্র টান দিয়েছে এসময় পাশে কারও উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন হলো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল থামের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ ম্যাকলেন্ডন, কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। উইলটা পড়ে শোনানো হবে, বলল সে।

এখন?

 নড করে পোর্চ থেকে নেমে গেল ছেলেটা।

অনুসরণ করল শেভার্ন, ল-অফিস ছাড়িয়ে অ্যাটর্নি-অ্যাট-লর অফিসের দিকে এগোল। খুশি হও, বাছা, পেছন থেকে বলল ও। তোমাকে ছাড়া খুব বেশি দূর যেতে পারিনি আমি, তাই না?

চুপ করে থাকল ছেলেটা, বোধহয় শেভার্নের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলতে পারেনি এখনও।

আগেই উপস্থিত হয়েছে লাল-চুলো। আড়ষ্ট হয়ে বসেছে চেয়ারে, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল শেরিফ।

কমবয়েসী আইনজ্ঞ ধবধবে ফর্সা, প্রচারের মতই গলে যাওয়া মোমের মত তুকের রঙ। গালে কয়েকটা লালচে দাগ। আচমকা শেভার্ন উপলব্ধি করল সোড়া স্প্রিং-এর অর্ধেক লোকই অস্বাভাবিক, তটস্থ। খারাপ পানি, বিশৃঙ্খল আইন, আড়ষ্ট মহিলা…বোধহয় এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে সবাই। স্বতঃস্ফূর্ততা। বা স্বাভাবিক স্পৃহা কারও মধ্যে নেই। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল ও। ডাক্তার।

আমার মনে হয় সবাই তৈরি আছি আমরা, গম্ভীর স্বরে বলল আইনজ্ঞ। কেউ আপত্তি না করায় উইলকারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিল সে কিছুক্ষণ।

সবিস্তারে ম্যাকলেন্ডনের যাবতীয় সম্পত্তির ফিরিস্তি দিল আইনজ্ঞ, খুব একটা ভ্রূক্ষেপ করল না শেভার্ন। অপেক্ষায় আছে কখন আসল কাজ সারবে, লোকটা। ঘোষণাটা যখন এল, কাউকেই বিস্মিত মনে হলো না। জুডাস ম্যাকলেন্ডন, এবং মেয়ে, মিসেস জুলিয়া ব্রুকসকে সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নিশ্চিত করা ছিল। জুডাসের সাবালকত্ব অর্জন এবং জুলিয়ার বৈবাহিক জটিলতা সহ সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং নিশ্চিতকরণের শর্তে মি. জিম শেভার্নকে এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়েছে।

মেয়েটা তাহলে বিবাহিতা? মি. ব্রুকস কোথায়? শেভার্নই বা এখানে কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। ভাবছে নিজের এমন কোন শশুর যদি থাকত, যে জীবনের। শেষ মুহূর্তেও চরম বিদ্রূপ করে গেছে, উইল পড়ার অনুষ্ঠানে নির্ঘাত অনুপস্থিত থাকত। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতির সাথে ওর চিন্তার খুব একটা হেরফের নেই।

কালো স্যাভিলানো হাতে তুলে উঠে দাঁড়াল ও। তোমাকে একটা দলিল লিখে দেব, মিসেস ব্রুকস, লাল-চুলোকে আশ্বস্ত করল। নিজের ভাগ গ্রহণ করার ইচ্ছে নেই আমার।

বিহ্বল দেখাচ্ছে আইনজ্ঞকে। আইন পড়েছ তুমি, মি. শেভার্ন?

কেমব্রিজে।

কিন্তু তোমার কথাবার্তা বা আচরণ মোটেই ইয়াঙ্কিদের মত নয়। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি একজন ইংরেজ।

কাকতালীয় হলেও, ইংল্যান্ডেও একটা কেমব্রিজ আছে।

আইনজ্ঞের বিভ্রান্ত মুখ দেখে বোঝা গেল ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান তার নিতান্তই কম। লোকটার প্রতি করুণা বোধ করল শেভার্ন। স্যাভিলানো মাথায় চাপিয়ে মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে বাউ করল ও, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আইনজ্ঞের দিকে ফিরল আবার। কাগজপত্র তৈরি করো, সই করে দিচ্ছি আমি।

না! তীক্ষ্ণ দৃঢ় স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস।

 নিজের সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দান করতে চাইছ তুমি?

আমার স্বামী মারা গেছে, মি. শেভার্ন। ও একটা বাধা ছিল, কিন্তু এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না আর। জুডও শিগগিরই পূর্ণবয়স্ক হতে যাচ্ছে। তবুও আমাদের বাথানে তোমাকে স্বাগত জানাতে আপত্তি নেই আমার।

<

Super User