০৩.

ওরা তিনজন একবার যদি স্টাটেন আইল্যান্ডের পশ্চিম দিকটা ঘুরে দেখে আসত তাহলে বুঝতে পারত যে এখানে উপকূল রেখা কি রকম বিপজ্জনক। সৈকত বলতে প্রায় কিছুই এদিকে নেই, অকস্মাৎ সাগর থেকে মাথাচাড়া দিয়েছে সারি সারি খাড়া পাহাড়। দ্বীপের আর সব দিকে পরিস্থিতি যখন শান্ত, এদিকে সে-সময় ঢেউ আর ঘূর্ণির ভয়ঙ্কর দাপট। প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে মুখ ব্যাদান করে আছে অন্ধকার গুহা, নেমে গেছে বোধহয় সেই একেবারে পাতালে। গুহার মুখে, চারপাশে, ছোটখাট পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে আছে পাথরের স্তূপ। এখান থেকে দ্বীপের মাঝখানে অর্থাৎ সমতলভূমিতে যেতে হলে কম করেও দুহাজার ফুট উঁচু পাহাড়চূড়া টপকাতে হবে, আর পাড়ি দিতে হবে পনেরো মাইল দুর্গম পথ। সমুদ্র এখানে এতটাই উগ্র যে এদিকটাতেও একটা বাতিঘর থাকা উচিত ছিল। আশা করা যায় আগে হোক পরে হোক তার প্রয়োজনীয়তা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবে চিলি সরকার, তারাও আর্জেন্টিনার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একদিন এখানে একটা বাতিঘর তৈরি করবে।

স্টাটেন আইল্যান্ডের দুদিকে দুটো বাতিঘর থাকলে জলদস্যুদের খুব অসুবিধে হয়ে যাবে। যারা খবর রাখে তারা জানে যে এদিকের সমুদ্রে প্রকৃতির আক্রোশে যত না জাহাজডুবি ঘটে তারচেয়ে অনেক বেশি ঘটে বোম্বেটে অর্থাৎ জলদস্যুদের নিষ্ঠুরতায়। এদিকের জলপথে বোম্বেটেদের উৎপাত রীতিমত ভয়াবহ।

বেশ কয়েক বছর আগেই ইগোর উপসাগরে ঢোকার মুখে জলদস্যুদের একটা দল নিজেদের আস্তানা তৈরি করেছে। গা ঢাকা দেয়ার জন্যে একটা গুহাকে বেছে নিয়েছে তারা। স্টাটেন আইল্যান্ডে ভুলেও কোন জাহাজ আসে না, কাজেই দ্বীপটা তাদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে। জলদস্যুরা সংখ্যায় বারোজন। সর্দারের নাম কনগ্রে। কনগ্রের প্রধান শিষ্যের নাম সেরেসান্তে। ওরা সবাই দক্ষিণ আমেরিকার লোক। চার কি পাঁচজন আর্জেন্টিনা বা চিলি থেকে এসেছে, বাকি সবাই টিয়েরা ডেল ফুয়েগোর লোক। শুরুতে এরা কেউ জলদস্যু ছিল না, কনগ্রেই তাদেরকে ফুসলে এই পথে এনেছে।

সেরেসান্তে নিজেকে চিলির বাসিন্দা বলে দাবি করে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না চিলির কোন্ গাঁয়ে তার জন্ম বা

কোন্ পরিবার থেকে এসেছে। তার বয়েস চল্লিশ, মাঝারি গড়ন, গায়ে দানবের মত শক্তি রাখে, খাটতেও পারে গাধার মত। দলের সবাই জানে দুনিয়ায় এমন কোন কুকর্ম নেই যা সেরেসান্তে করতে পারে না।

সর্দার কনগ্রে সম্পর্কে কোন তথ্যই কেউ জানে না। তাকে একটা মূর্তিমান রহস্যই বলা যায়। কোত্থেকে এল সে, কোথায় তার বাড়ি, এ-সব তথ্য কাউকে কোনদিন সে জানায় না। আসলেই তার নাম কনগ্রে কিনা, এ-ব্যাপারেও সন্দেহ আছে।

সমুদ্রের এদিকটায় কনগ্রে বাহিনীর কুকীর্তির কথা গোপন কোন বিষয় নয়, অনেকেই জানে। অত্যন্ত বেপরোয়া টাইপের মানুষ সে। একাই দশজন লোকের শক্তি রাখে গায়ে। তার সম্পর্কে বলা হয়, জলদস্যু না হয়ে যদি অন্য কোন পেশা বেছে নিত, তাতেও খুব নাম করত সে। কিন্তু জলদস্যুর জীবন স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে কনগ্রে। আপাদমস্তক বোম্বেটে লোকটা, সব রকম অপরাধেই হাত পাকিয়েছে। বলা হয় দ্য বৃত্তিতে তার সঙ্গে পাল্লা দিলে ওয়ালটার র‍্যালে বা ফ্রান্সিস ড্রেকও হেরে যেতেন। কেন কিভাবে কনগ্রে তার সাগরেদদের নিয়ে এই দ্বীপে আশ্রয় নিল, সেটা খুব সংক্ষেপেই বর্ণনা করা সম্ভব।

ম্যাগেলান প্রণালীর প্রধান বন্দরে দীর্ঘদিন সন্ত্রাস চালিয়েছে এই মানিকজোড়-কনগ্রে আর সেরেসান্তে। এমন সব অপরাধ সেখানে করেছে তারা, বিচার হলে কয়েকবার ফাঁসিতে ঝোলার কথা। এই ফাঁসিতে চড়ার ভয়েই পালিয়ে টিয়েরা ডেল ফুয়েগোয় চলে আসে তারা। ওখানে পৌঁছে শুনতে পায়, সমুদ্রের এদিকটায় ঘন ঘন জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। শুনে তারা ধরে নিল স্টাটেন আইল্যান্ডের চারধারে ভাঙা জাহাজ আর জাহাজের দামী সব মাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে, শুধু কুড়িয়ে ঘরে তোলার অপেক্ষা। লোভে চকচক করে উঠল কনগ্রের চোখ। দুজন মিলে তাড়াতাড়ি একটা বাহিনী তৈরি করে ফেলল। খুনী-বদমাশ বেছে বেছে দল গঠন করল তারা। তারপর রওনা হলো একটা জেলে নৌকা নিয়ে।

লেময়র প্রণালী পাড়ি দেয়ার সময় কলনেট অন্তরীপের পাহাড়ে লেগে ওদের নৌকাটা ভেঙে যায়। সাঁতরে কোন রকমে প্রাণ বাঁচায় জলদস্যুরা। ওখান থেকে ইগোর উপসাগরের কাছে আসতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। অবশ্য পৌঁছাবার পর হতাশ হতে হয়নি। সান, হুয়ান অন্তরীপ থেকে সেভারেল পয়েন্ট পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল জাহাজডুবির দামী দামী জিনিস-পত্র, সেগুলো বিনা বাধায় দখল করে তারা। অসংখ্য লোহার সিন্দুক পায়, ভেতরে ছিল তাল তাল সোনা আর রুপো৷ পিস্তল, বন্দুক, গোলাবারুদ, এ-সবও প্রচুর পরিমাণে পায়। তারপর তারা সান হুয়ান অন্তরীপের ওপর নজর রাখার জন্যে ডান দিকে সরে আসে। সেখানে গোটা বাহিনীর থাকার উপযোগী একটা গুহা আবিষ্কার করে তারা। উঃ সাগরের উত্তরে একটা টিলার পিছনে গুহাটা, তাই ঝড়ের ছোবল স্পর্শ করতে পারে না। ওই গুহাতেই তারা লুঠ করা সমস্ত জিনিস-পত্র নিয়ে আসে। সঙ্গে করে আরও আনে খাবারদাবার ও বিছানা। ধন-রত্ন পরে সরিয়ে ফেলা হয় কাছাকাছি অন্য একটা গুহায়। কনগ্রের উদ্দেশ্য, ভাল একটা জাহাজ অক্ষত অবস্থায় দখল করতে পারলে সমস্ত ধন-সম্পদ নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের কোন দ্বীপে চলে যাবে। তার দস্যু জীবনের হাতেখড়ি হয়েছে এদিকে, তাই এলাকাটার ওপর অদ্ভুত এক মায়া জন্মে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাল কোন জাহাজ দখল করতে না পারায় স্টাটেন আইল্যান্ড ছেড়ে অন্য কোথাও সে চলে যেতে পারছে না।

গত দুবছর ধরে লুঠপাট চালাচ্ছে তারা। ধনভাণ্ডার ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়ে উঠেছে। জাহাজডুবি থেকেই বেশি লাভবান হয়েছে দলটা। তবে সুযোগ পেলে হিংস্র ডাকাতি করতেও পিছিয়ে থাকেনি। ডাকাতি করার সময় দয়া ও ধর্ম সম্পূর্ণ বিসর্জন দেয় কনগ্রে আর তার দলের সদস্যরা, যাকে সামনে পায় তাকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।

দিনে দিনে ধন-সম্পদের পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। প্রশ্ন হলো, এত সম্পদ তারা ভোগ করবে কবে? এ নিয়ে প্রায়ই সেরেসান্তের সঙ্গে আলোচনা করে কনগ্রে।

আর কতদিন অপেক্ষা করব, সেরেসান্তে?

জাহাজ না পেলে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়ই বা কি।

কনগ্রে চিন্তিত হয়।

সেরেসান্তে বলে, রসদও কিন্তু একদিন ফুরিয়ে যাবে, ওস্তাদ। মাছ ধরে আর শিকার করে কিছুদিন হয়তো চলা যাবে, কিন্তু তারপর? এখানে তো আর চিরকাল আমরা থেকে যেতে পারি না। শীতের কথা মনে হলেই ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে আসে।

কনগ্রে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলেছে, হ্যাঁ, এখান থেকে যাবার একটা ব্যবস্থা এবার না করলেই নয়।  

তারপর ১৮৫৮ সালের অক্টোবর মাসে একটা ঘটনা ঘটল। যা কখনও ঘটে না হঠাৎ তাই ঘটল আর কি। একটা জাহাজ এসে ভিড়ল স্টাটেন আইল্যান্ডে। জাহাজটার মাস্তুলে পতপত করে আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ছে। জলদস্যুরা দেখেই চিনতে পারল, ওটা একটা যুদ্ধজাহাজ।

যুদ্ধজাহাজ দেখে ভয় পেয়ে যায় কনগ্রে। দল নিয়ে গুহার ভেতর লুকিয়ে পড়ে সে। তার আগে নিজেদের উপস্থিতির সমস্ত চিহ্ন সযত্নে মুছে ফেলতে ভোলেনি। শুরু হলো অপেক্ষার পালা, জাহাজটা কখন দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়।

বলাই বাহুল্য, জাহাজটি ছিল সাত্তা ফে। বাতিঘর তৈরি করা হবে, সেজন্যেই দ্বীপটা দেখতে এসেছিলেন ক্যাপটেন লাফায়েত। সেবার মাত্র দিন কয়েক ছিল জাহাজটা। বাতিঘর কোথায় তৈরি করা হবে সেটা ঠিক করেই ফিরে গেল আবার।

জলদস্যুরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তাদের অস্তিত্ব জাহাজের কারও চোখে ধরা পড়েনি। সাহস করে গুহা থেকে একবার বেরিয়েছিল সেরেসান্তে, আড়াল থেকে নাবিকদের দুচারটে কথাবার্তা শুনেছে। তা থেকেই তারা জানতে পারল যে সান্তা কে কি কারণে স্টাটেন দ্বীপে নোর ফেলেছিল।

ইগোর উপসাগরে একটা বাতিঘর বানানো হবে।

জলদস্যুরা চিন্তায় পড়ে গেল। বাতিঘর তৈরি করা হলে এই দ্বীপে তো আর তাদের থাকা চলবে না। কিন্তু এই দ্বীপ ছেড়ে তারা এখন যাবেই বা কিভাবে? যাবার আগে অন্য কোথাও একটা আস্তানা তো তৈরি করা দরকার, তাই না? যেতে হলে জাহাজও তো লাগবে একটা! কিন্তু সেই জাহাজ ওরা পাচ্ছে কোথায়? ..

অনেক ভেবেচিন্তে আপাতত স্টাটেন আইল্যান্ডে থেকে যাবারই সিদ্ধান্ত নিল কনগ্রে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অন্য একটা গুহা বের করল, সমস্ত ধন-সম্পদ সরিয়ে নিয়ে এল সেখানে। গুহাটা দ্বীপের পশ্চিম দিকে, অত্যন্ত দুর্গম এলাকায়। প্রায় বছরখানেক চলার মত রসদ-পত্রও সঙ্গে করে নিয়ে এল তারা। ঘাঁটি বদলের কাজটা খুব ব্যস্ততার সঙ্গেই সারা হলো। কারণ সেরেসান্তে জানতে পেরেছে, বাতিঘর তৈরির জন্যে প্রচুর লোকজন নিয়ে আবার ফিরে আসবে সান্তা ফে। তাড়াহুড়ো করলেও, দুটো গুহার সব জিনিস সরিয়ে আনার সময় পাওয়া গেল না। একটা গুহায় প্রচুর জিনিস রয়ে গেল। তবে সেটার মুখ বাইরে থেকে পাথর ফেলে বন্ধ করে দিয়ে এল।

নতুন গুহায় আশ্রয় নিল জলদস্যুরা। কয়েক দিন পর বাতিঘর তৈরির উপকরণ আর লোকজন নিয়ে আবার ফিরে এল সান্তা ফে। বাধ্য হয়েই দ্বীপের পশ্চিম দিকটায় থাকতে হচ্ছে কনগ্রেকে। কাছাকাছি একটা ঝর্ণা থাকায় পানির কোন অভাব হচ্ছে না শুরু হলো অপেক্ষার পালা, কবে বাতিঘর তৈরির কাজ শেষ হবে। কাজ সেরে সান্তা ফে ফিরে গেলে কনগ্রে তার কুকর্মে হাত দিতে পারে।

কনগ্রে আর সেরেসান্তে ধারণা করল, ডিসেম্বরের দিকে কাজটা শেষ হবে। সময়টা আন্দাজ করার পর মনে মনে কুমতলব আঁটল কনগ্রে। বাতিঘর বানানো শেষ হলে অল্প দুচারজন রক্ষীকে রেখে সান্তা ফে ফিরে যাবে। তখনই কিছু একটা করবে সে। পাহাড় চূড়ায় লোক রাখা হলো, বাতিঘরের আলো জ্বললে খবর দেবে।

ডিসেম্বরের নয় তারিখে খবর এল, বাতিঘরের আলো জ্বলছে।

কয়েকটা দিন কিছুই ঘটল না। তারপর একদিন সেরেসান্তে একটা হরিণকে গুলি করল। গুলি খেয়ে ছুটতে শুরু করে সেটা। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতিঘরের রক্ষীরা হরিণটাকে দেখে ফেলায় সেরেসান্তে আর এগোতে পারেনি। প্রায় আধ ঘণ্টা পর বাতিঘরের একজন রক্ষী হরিণটার কাছে চলে আসে।

ওই ঘটনার ফলেই রক্ষীরা জেনে গেল যে দ্বীপে তারা ছাড়াও অন্য লোক আছে। যেহেতু তারা সামনে আসছে না, আড়ালে লুকিয়ে থাকছে, কাজেই ধরে নিতে হবে তারা অবশ্যই ভাল লোক নয়। বাসকেথ তার সহকারীদের সাবানে থাকতে বলল।

ওদিকে কনগ্রে ফন্দি এঁটেছে, বাইশে ডিসেম্বরে বাতিঘর দখল করে নেবে তারা। বাইশে ডিসেম্বর রওনা হবে, ইগোর উপসাগরে পৌঁছাবে চব্বিশ তারিখে মানে বড়দিনের আগের সন্ধ্যায়। আলোকরক্ষী মাত্র তিনজন, ওদেরকে খুন করতে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হবে না। বাতিঘর দখল করার পর আগের গুহায় মাল-পত্র সরিয়ে নিতে পারবে তারা।

বাইশে ডিসেম্বর এসে গেল। সন্ধের দিকে গুহার সামনে হাঁটছে কনগ্রে আর সেরেসান্তে, দুজনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর বোলাচ্ছে সমুদ্রের ওপর। আজকের আবহাওয়া খুব একটা শান্ত নয়। দিগন্তে মেঘ জমেছে। জোরালো বাতাস বইছে উত্তর-পুবে। জলদস্যুরা রওনা হবার জন্যে তৈরি হয়েই আছে।

আমরা তাহলে এখানকার সব মালপত্র ফেলে রেখেই যাচ্ছি, কেমন?  জিজ্ঞেস করল সেরেসান্তে।

হ্যাঁ, সেটাই ভাল। ওগুলো পরে নিয়ে যাওয়া হবে। বাতিঘরটা দখল করার পর…,  কথাটা কনগ্রে শেষ করতে পারল না। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, কিছু একটা দেখে চমকে উঠেছে। এক সেকেন্ড পরই চেঁচাতে শুরু করল, সেরেসান্তে! দেখো! ওদিকে তাকাও!

কনগ্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেরেসান্তে তাকাল। পরমুহূর্তে সে-ও চেঁচিয়ে উঠল, ওহ, গড! জাহাজ! চোখের ভুল নয়, সত্যি এটা একটা জাহাজ!

ভাল করে দেখে বলো,  তাগাদা দিল কনগ্রে। কি মনে হচ্ছে? এদিকেই আসছে তো?  

হ্যাঁ, আসছে বলেই মনে হচ্ছে, ওস্তাদ, গলাটা উত্তেজনায় কেঁপে গেল সেরেসান্তের। সম্ভবত একটা স্কুনার, ওস্তাদ!  

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল কনগ্রে। ঠিক ধরেছ। দেড় থেকে দুশো টনের মধ্যে একটা স্কুনারই।

জলদস্যুরা গুহার সামনে জড়ো হয়েছে। তাদেরকে কনগ্রে বলল, এই সুযোগ আমরা হারাতে পারি না। আমরা একটা জাহাজ খুঁজছিলাম। ওটাই সেই জাহাজ। দেখো, দেখো-বাতাস আর জোয়ারের সঙ্গে কেমন লড়ছে জাহাজটা! বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত মজবুত। ওটাই আমাদের চাই। তোমরা কি বলো, অ্যাঁ?  

সবাই সমস্বরে জবাব দিল, আপনার কথাই শিরোধার্য, ওস্তাদ! আমরা আবার কি বলব!

রাত গাঢ় হলো। জাহাজটার পক্ষে এখন আর প্রণালীর মধ্যে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

কালও ওটাকে অন্তরীপের দিকে এগোতে দেখব আমরা, বলল কনগ্রে। তখন দেখা যাবে আমরা ওটাকে নিয়ে কি করতে পারি।  

এক ঘণ্টা পর অন্ধকারে হারিয়ে গেল জাহাজটা। এমন কি জাহাজটার কোন আলোও ওরা দেখতে পাচ্ছে না।

পরদিন ভোরে জলদস্যুরা গুহা থেকে বেরিয়ে দেখল সেইন্ট বার্থোলোমিউ অন্তরীপের একটা পাহাড় ঘেঁষে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুনারটা।

.

০৪.

জলদস্যুরা অবাক। স্কুনারটা এখানে কেন থামল? কাল খুব ঝড়ো বাতাস ছিল, সেই বাতাসের কাছে হার মেনে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে থাকলে আলাদা কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে ঝড়ো বাতাস থেমে যাবার পর খোলা সাগরে বেরিয়ে যায়নি কেন? ধীরে ধীরে তারা রহস্যটা বুঝতে পারল। স্কুনারের নাবিক আর ক্রুরা কি কম চেষ্টা করেছে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও জাহাজটাকে নড়াতে পারেনি। পারবে কিভাবে, চড়ায় আটকা পড়েছে যে!

আটকা পড়া জাহাজের ক্যাপটেন আর মাঝি-মাল্লাদের অবস্থা কল্পনা করা কঠিন নয়, তবে নিশ্চিতভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রাতের অন্ধকারে জাহাজ পাহাড়ে ধাক্কা খেতে যাচ্ছে, এই ভয়ে সবাই তারা নৌকায় উঠে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে? এরকম সত্যি যদি ঘটে থাকে, ব্যাপারটাকে নিয়তির পরিহাস বলা ছাড়া উপায় কি! জাহাজের কোন ক্ষতি হয়নি, অর্থাৎ জাহাজে তারা থেকে গেলেই পারত!

ওদের ধারণা যে সত্যি একটু পর তার প্রমাণ পাওয়া গেল। জলদস্যুরা দেখল মাইল দুয়েক উত্তর-পুবে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করছে একটা নৌকা। প্রবল বাতাসে প্রায় উল্টে যাবার অবস্থা। ছুটে চলেছে ফ্রাঙ্কলিন উপসাগরের দিকে। আচ্ছা, লোকগুলো এখনও তাহলে পটল তোলেনি!

জোয়ার প্রবল হয়ে উঠলেও স্কুনারের কাছে পৌঁছানো জলদস্যুদের জন্যে কঠিন হবে না। মাত্র তো আধ মাইল দূরত্ব। কয়েকটা টিলা আর বালিয়াড়ি পেরুনো এমন কি শক্ত কাজ। সময় নষ্ট না করে পৌঁছে গেল তারা।

উঁচু একটা কলির চড়ায় আটকা পড়েছে স্কুনার। জোয়ার শুরু হোক, পানি সাত-আট হাত ফুলে উঠুক, তখন জাহাজটাকে চড়া থেকে সরিয়ে আনা বা চালিয়ে আনা কোন সমস্যাই হবে না। কনগ্রের হিসাবে কোন ভুল নেই, জাহাজটা আসলেও একশো ষাট টনী। ওটাকে ঘিরে একবার চক্কর দিল কনগ্রে। গায়ে নাম লেখা রয়েছে, পড়ল সে-মউল, ভালপারাইসো।

তারমানে এটা চিলির জাহাজ।

এটাই আমাদের দরকার, কি বলো, ওস্তাদ? জিজ্ঞেস করল সেরেসান্তে।

হ্যাঁ, মন্দ নয়, শিষ্যদের কেউ একজন মন্তব্য করল। তবে দেখতে হবে তলাটা ফুটো হয়ে গেছে কিনা।

হোক না ফুটো, মেরামত করে নিতে কতক্ষণ,  বলল কনগ্রে। স্কুনারটা হাতছাড়া করতে রাজি নয় সে।

জাহাজটা একটু কাত হয়ে আছে, উঠতে, বেশ খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হলো। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সব কিছুই অটুট আর অক্ষত রয়েছে। ক্যাপটেনের কেবিনে ঢুকে অনেকগুলো দেরাজ হাতড়ে জাহাজ সম্পর্কিত এক গাদা কাগজ-পত্র বের করে আনল কনগ্রে। সেগুলোর মধ্যে লগবুকও রয়েছে। ওগুলো নাড়াচাড়া করে স্কুনারটা সম্পর্কে যা কিছু জানার সব তারা জেনে নিল।

স্কুনার মউল রওনা হয় চিলির ভালপারাইসো বন্দর থেকে। কার্গো বহনের ক্ষমতা একশো সাতান্ন টন। দুজন নাবিক আর সারেঙকে নিয়ে ক্যাপটেন ফকল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল ২৩ শে নভেম্বর। কেইপ হর্ন অন্তরীপকে পাশ কাটাতে মউলের কোন সমস্যাই হয়নি। বিপত্তি ঘটেছে লেময়র প্রণালীতে ঢোকার সময়। স্টাটেন আইল্যান্ডের বালিয়াড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

জাহাজের ভেতরটা একদম ফাঁকা, মাল-পত্র বলতে কিছুই নেই। সেজন্যে অবশ্য কনগ্রের কোন দুঃখ নেই। দ্বীপ ছেড়ে পালাবার উপযোগী একটা জাহাজ পেয়েই খুশি সে। এখন তার একমাত্র কাজ বালিয়াড়ি থেকে জাহাজটাকে উদ্ধার করে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া।

জোয়ার শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ডান হাত সেরেসান্তেকে কনগ্রে বলল, , জোয়ার শুরু হবার আগেই নিশ্চিত হতে হবে মউল পানিতে ভাসার উপযোগী আছে কিনা। মেরামতির কাজ থাকলে আগেই সেরে ফেলা দরকার।

জাহাজ জখম হয়ে থাকলে জোয়ার শুরু হলেই তা জানা। যাবে, ওস্তাদ,  বলল সেরেসান্তে। জোয়ারের পানিতে যদি ভেসে ওঠে, সব সমস্যার সমাধান আপনা থেকেই হয়ে যাবে। আর না ভাসলে বোঝা যাবে কেন ভাসছে না, তখন কোথায় কি মেরামত। লাগে দেখব। আমাদের আর কি কাজ তাই বলো।

তবু আগে থেকে সাবধান হতে তো দোষের কিছু নেই। যদি ভাসে, আমাদের প্রথম কাজ হবে ওটাকে গুহার কাছে নিয়ে যাওয়া। ওদিকের পানি যথেষ্ট গভীর।

তারপর?

এত দিন ধরে আমরা প্রচুর ধনরত্ন জমিয়েছি, সব ওই জাহাজে তুলতে হবে।

তারপর?

তারপর কি করা হবে পরে বলব।  নিজের প্ল্যানটা এখুনি ফাস করতে রাজি নয় কনগ্রে।

সেরেসান্তের নির্দেশে জলদস্যুরা কাজ আরম্ভ করে দিল জোয়ার শুরু হবার আগেই। কাজ মানে স্কুনারটাকে সাগর পাড়ি দেয়ার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। পানি ফুলতে শুরু করার আগেই শেষ হলো তা। জোয়ারের আর দুএকটা তোড় এলেই বালিয়াড়ি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। কনগ্রে আর সেরেসান্তে ছয়জন জলদস্যুকে নিয়ে স্কুনারে রয়ে গেল। বাকি সবাই পায়ে হেঁটে গুহায় ফিরে যাচ্ছে।

কনগ্রের ভাগ্যটা সত্যি ভাল। ভরা জোয়ারে বালিয়াড়ির ফাঁদ থেকে মুক্তি পেল মউল, আর সেই সঙ্গে তার পালে লাগল হঠাৎ শুরু হওয়া জোরালো বাতাস। কনগ্রে কল্পনাও করেনি ভাগ্য তাকে এতটা সাহায্য করবে।

তবে উদ্বেগ একটা, থেকেই গেল। স্কুনারের খোলের তলায় কোন ফুটো তৈরি হয়নি তো? ফুটো থাকলে সাগর আর পাড়ি দিতে হবে না, সবাইকে নিয়ে ডুবে মরতে হবে এখানেই। রেইলিঙে ভর দিয়ে জোয়ারের ফুলে ওঠা পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল জলদস্যুরা। তবে না, বিপদের কোন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না এখনও। কাত হয়ে থাকা জাহাজধীরে ধীরে সিধে হলো। উল্লাস চেপে রাখতে না পেরে কনগ্রে চেঁচিয়ে উঠল, নেই! জাহাজে কোন ফুটো নেই!

জোয়ার শুরু হয়েছে আড়াই ঘণ্টা হলো। এতক্ষণে বুঝি ফাঁদ থেকে পুরোপুরি ছাড়া পেয়ে পানিতে ভাসছে মউল। উত্তেজনায় কাঁপা গলায় নির্দেশ দিল কনগ্রে, নোঙর তোলো!  

তোলা হলো নোঙর। কিন্তু জাহাজ নড়ছে না। কি ব্যাপার? ব্যাপার বোঝার জন্যে চারপাশে তীক্ষ্ণ চোখ বোলাচ্ছে সেরেসান্তে। তার চোখে ধরা পড়ল, জাহাজ এখনও পুরোপুরি ভেসে ওঠেনি, খানিকটা অংশ বালিয়াড়িতে আটকে আছে। তবে সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আপনা থেকেই আটকে থাকা অংশটা মুক্ত হলো। সেই সঙ্গে হঠাৎ ঘুরে গেল জাহাজ, মুখ ফেরাল সাগরের দিকে।

উত্তর-পুব আকাশে মেঘ জমেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বীপের পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে হবে মউলকে, তা না হলে ঝড়-তুফানের মধ্যে পড়তে হবে। প্রবল বাতাসে প্রণালীর মধ্যে জাহাজ চালানো সম্ভব হবে না। আবার একটা দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল ওদেরকে। পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। একটু পরই তো শুরু হয়ে যাবে ভাটা। পানি সয়ে যাওয়ায় আবার বালিয়াড়ি মাথাচাড়া দেবে। সেই বালিয়াড়ি আবার আটকে ফেলবে জাহাজটাকে।

সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। ছুটোছুটি করে সবার কাজ তদারক করছে কনগ্রে। সবাই মিলে চেষ্টা করছে মউলকে সাগরের দিকে নিয়ে যেতে। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করার পর সামান্য একটু নড়ল জাহাজ। কনগ্ৰে চেঁচিয়ে উঠল, মারো জোয়ান, হেইয়ো! আউর ভি হোড়া; হেইয়ো!  

অবশেষে সচল হলো জাহাজ। ছিটকে বেরিয়ে এল গভীর পানিতে। জলদস্যুরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। কনগ্রে ওদেরকে বিশ্রাম নিতে নিষেধ করল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মউলকে গুহার সামনে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বাজিমাত।

জাহাজটাকে কনগ্রে নিজেই চালাচ্ছে। বেশিক্ষণ লাগল না, আধ ঘণ্টার মধ্যেই মউল পৌঁছে গেল গুহার সামনে, পেঙ্গুইন, টিলার কাছে। সেরেসান্তেকে নির্দেশ দিল সে, নোঙর ফেলো!

<

Super User