হেল কমাণ্ডো – মেজর আনোয়ার হোসেন
অনুলিখন – এ. এইচ. রনজু

দুটি কথা

চিরবিদায় নেয়ার আগে ভাগ্নে রনজুকে বলেছিলেন মেজর আনোয়ার, তুমি সেবা প্রকাশনীর কাজী সাহেবকে গিয়ে বলবে, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে মেজর আনোয়ার হোসেনের একান্ত অনুরোধ: বইটি যেন তিনি প্রকাশ করেন।

সে অনুরোধ আমি রক্ষা করলাম।

কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, অমানুষিক পরিশ্রম ও অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন সহ্য করার পর তৈরি হয় একজন কমাণ্ডো। বাঙালী এক যুবক কখনও নেমেছে উত্তাল সাগরের অতল গভীরে, কখনও অসীম নীলাকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিচে, কখনও তুষারাবৃত পর্বত-শৃঙ্গে লড়েছে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। নিজের চামড়া পোড়ার গন্ধে সে চমকে উঠেছে, কখনও কুলকুচি করেছে বিষ্ঠাময় পানি দিয়ে, ক্ষুধার তাড়নায় খেয়েছে কুকুরের মাংস। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

আসুন, পাঠক, অবগাহন করুন।

কাজী আনোয়ার হোসেন

.

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়ানের ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন দুঃসাহসী চৌকস অফিসার। হেল কমাণ্ডো বইটি মূলত তার সৈনিক জীবনের কাহিনি নিয়েই রচিত।

অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে তিনি মুখে বলে গেছেন, আমি সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখেছি। কমাণ্ডো ট্রেনিং সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তিনিই সরবরাহ করেছেন, তবে অন্যান্য কিছু তথ্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকেই সংগ্রহ করে নিতে হয়েছে।

এ-বইটি লেখার কঠিন কাজে অনেকেই আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের মধ্যে স্মৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যতার জন্য রইল আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা।

যাঁরা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে বইটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে সাহায্য করেছেন তারা হলেন মেজর এনামুল হক খান (অব.), প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ; ক্যাপ্টেন ওকবা (অব.) জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ বিমান; মরহুম লে. কর্নেল সাইদুর রহমান, লে. কর্নেল কামরুল হাসান মুরাদ, লে. কর্নেল জাকির হোসেন, ব্রিগে. এ. কে. এম. শাহাজান ও ব্রিগে. আবদুল্লাহ আহমেদ মুসা।

আমি এঁদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞ।

এ. এইচ. রনজু।

.

০১.

গভীর রাত। আকাশে চাঁদের লুকোচুরি। চারদিকে মৃদু বাতাস। ঠিক এমনি এক মায়াময় পরিবেশে দূর কোন্ অরণ্যের মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি স্নিগ্ধ নদী। একটা স্পীডবোট–সেই নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে কোন দূর অজানায়। আর সেই স্পীডবোটের ওপর তন্ময় হয়ে বসে আছে একজন যুবক।

আনোয়ারের ঠিক এমনি একটি স্বপ্ন ছিল। এমনি এক মধুর জীবনের রঙিন কল্পনায় কার না সাধ জাগে। সাধ ছিল ছোট্ট একটি জীবনের। যেখানে সুখ আছে, দুঃখ আছে, প্রাচুর্য আছে, দৈন্যও আছে। আর আছে এগুলোকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়ার মত একজন প্রিয় সঙ্গী, যাকে নিয়ে সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে অস্তাচলগামী সূর্যকে বিদায় সম্ভাষণ জানানো যায়, যাকে নিয়ে সেই স্নিগ্ধ নদীর বুক বেয়ে দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়া যায়, যাকে নিয়ে জীবনের সবটুকু পথ অতি সহজেই অতিক্রম করা যায়।

এই রকম একটি জীবন আনোয়ারের জন্য অতিরিক্ত কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকেই কালো রঙের লম্বা গড়নের এই ছেলেটি ছিল খুব মেধাবী। দুচোখের দৃষ্টি ছিল প্রখর। তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির জন্য যে-কোন জটিল জিনিসকে সহজেই আয়ত্তে রাখাটা আনোয়ারের কাছে তেমন কোন কঠিন কাজ ছিল না। সেজন্য পড়াশোনায় ওর বেশ সুনাম ছিল। শিক্ষকরা ওর প্রতি খুবই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু কি অদ্ভুত পরিহাস! যে আনোয়ার রাতকে ভয় করত–সেই ওকেই কিনা প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে রাতের আঁধারে। কারণ কমান্ডোদের প্রতি নির্দেশই হলো: রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের মত চমক লাগিয়ে তোমার কমাণ্ডো-নাইফ দিয়ে শত্রুর ওপর হামলা করো।

ছুরি নামক বস্তুটাকে সে কতই না ভয় করত। অথচ ছুরিই হলো ওর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। একে সঙ্গে নিয়ে ও জীবনে বহু বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করেছে। বহু বিপজ্জনক যাত্রার সঙ্গী হয়েছে এই কমাণ্ডো-নাইফ। আনোয়ারের স্বপ্ন ছিল রাতের গভীরে শান্ত সমুদ্রে প্রিয় সঙ্গীকে পাশে বসিয়ে স্পীডবোট নিয়ে কোন অনাবিষ্কৃত দ্বীপের উদ্দেশে ছুটে চলা। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। ও শুধু সাগরের বুক চিরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটেই চলেনি, সাগরের অতল গভীরে ডুবও দিয়েছে। তখন ওর সঙ্গী রয়েছে ডুবুরি পোশাক, অ্যাকুয়ালাং স্পিয়ার-গান ও প্রিয় নাইফ। আর ও যে সাগরে ছুটে বেড়িয়েছে, সে সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের পরিবর্তে ছিল বিভিন্ন সাইজের ভয়ঙ্কর-দর্শন বোল্ডার, আর সঙ্গী হয়েছে কাঁধের ওপর স্ট্র্যাপ দিয়ে লাগানো ভারী ওজনের প্যাক, সাব মেশিনগান ও কমাণ্ডো-নাইফ।

অদ্ভুত পরিহাস এজন্যই বলছি, যে আনোয়ার পড়াশোনায় ভাল বলে সবাই ধরেই নিয়েছিল, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বেশ কয়েকটা লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ তো হবেই সেই সঙ্গে স্ট্যাণ্ডও করবে। হতও তাই। কিন্তু সবার সে ধারণা আনোয়ারের জীবনে সফল হয়নি। পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর অথবা এই বিভাগের বেশি জোটেনি। ফলে ছাত্র জীবন থেকেই শুরু হয়েছিল সব নাটকীয় পরিবর্তন।

তদানীন্তন পাক-বাহিনীতে আনোয়ার ছিল একটি পরিচিত নাম । আনোয়ার মানেই প্রাণোচ্ছল, কোমলে-কঠোরে মেশানো একটি মন; যে মন অন্যকে সহজেই আপন করে নিত। ও তখন ক্যাপ্টেন। পাক সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমাণ্ডো-ব্যাটালিয়নের একজন অফিসার। তার ছয় ফুট লম্বা, ১৮২ পাউণ্ড ওজনের পেশীবহুল শরীর পাক সেনাবাহিনীর অফিসারদের মুগ্ধতার কারণ ছিল। আদর করে অনেকেই ওকে হেল কমাণ্ডো বলে ডাকত। কেউ কেউ ডাকত লুমুম্বা বলে। তবে সবচেয়ে পরিচিত নাম ছিল কিলু বিলু। যে নামে ও বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহু অফিসারের কাছে পরিচিত। কমাণ্ডো বাহিনীকে যে-কোন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অভিজাত গ্রুপ বলে গণ্য করা হয়। কারণ, যুদ্ধের সময় কমাপ্তোদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভীষণ বিপজ্জনক ও ঝুঁকিতে ভরা।

ছোটবেলায় এই ধরনের বিপজ্জনক ও গুরুত্বপূর্ণ চাকরি ছিল আনোয়ারের স্বপ্নেরও অগোচরে। কারণ কমাণ্ডো হতে হলে চাই বলিষ্ঠ দেহ, যথেষ্ট শক্তি ও প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতা। কিন্তু এগুলোর কোনটাই ছোটবেলায় ওর ছিল না। ১৯৫৯ সালে আনোয়ার দশম শ্রেণীর ছাত্র। ক্যারম খেলা নিয়ে একজনের সঙ্গে তার সামান্য বিরোধ হয়। সেজন্য প্রতিপক্ষ দুষ্ট ছেলেটা ওকে ভীষণ মারপিট করে। ওর ঠোঁট কেটে, নাক ফেটে রক্ত গড়াচ্ছিল। ওর এই দুরবস্থা দেখে বরকতউল্লাহ নামে ওর এক সহপাঠী বলল, তুই ফি সারা জীবন মারই খাবি? প্রয়োজনে মারকে ঠেকাতেও পারবি না? চল, আজ থেকে তোকে আমার সঙ্গে ব্যায়াম করতে হবে। সহপাঠীর পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হলো। আনোয়ার দুর্বল শরীর নিয়ে নতুন ওস্তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলল ব্যায়াম-আখড়ার দিকে।

শুরু হলো রীতিমত শরীর চর্চা। ৩৫ দিন অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর জীবনের প্রথম একটি সফল বুক ডন দিল ও। তারপর শুরু হলো অগ্রযাত্রা। দুবছর কঠোর অনুশীলনের পর তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল ক্যারম খেলার সেই সহপাঠীর সঙ্গে যার হাতে সে একদিন প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের মনে পড়ে গেল বিগত দিনের সেই স্মৃতি। ধীরে ধীরে সেই সহপাঠীর দিকে এগিয়ে গেল সে। ওকে দেখেই সেই ছেলেটা চমকে উঠল। কারণ এখন আনোয়ারকে দেখেই বোঝা যায়, সে বেশ দৈহিক শক্তির অধিকারী। মৃদু হেসে সেই সহপাঠীকে সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, ভাল তো? সহপাঠী চমকে উঠে জড়ানো গলায় বলল, হ্য, জ্বি, ভাল আছি। মানে…আপনি কেমন আছেন?

তোমার একটা পাওনা আছে আমার কাছে। সেটা সুদসহ তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর আশা করি ভাল থাকব।

সেই সহপাঠী অবাক হয়ে পাওনাটা কিসের জিজ্ঞেস করতেই প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে ছিটকে পড়ল। তারপর শুরু হলো আনোয়ারের দেনা পরিশোধের পালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ছেলেটির নাক মুখ বেয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো। তখন আনোয়ার ওকে দাঁড় করিয়ে কলার ধরে বলল, বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিলিয়ে দেখো, ঠিক আছে কিনা। নাউ ইউ গেট লস্ট।

এই সহপাঠী আনোয়ারের জীবনে দুটো জিনিসের পরিসমাপ্তি ঘটাল। তা হলো মার খাওয়া এবং মার দেয়া। এরপর ও আর জীবনে কোনদিন মারামারি করেনি এবং তার দরকারও পড়েনি। পরবর্তী জীবনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সেই প্রহারকারী এবং শুভানুধ্যায়ী বরকতউল্লাহ, দুজনের কাছেই ও হয় সমানভাবে কৃতজ্ঞ। এরপর আনোয়ার চিটাগাং গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা ভার্সিটিতে পরিসংখ্যানে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হলো। মনে মনে ইচ্ছা ছিল লণ্ডন স্কুল অভ ইকোনোমিক্স থেকে পি. এইচ. ডি. করা অথবা লণ্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারী ডিগ্রী নেয়ার। কিন্তু তখনও কি সে জানত, জীবনের মোড়টা এভাবে ঘুরে যাবে? : একদিন আকাশে একটা ফাইটার-প্লেন নানারকম ওলট-পালট করে কসরত দেখাচ্ছিল। তা দেখে আনোয়ারেরও শখ চাপল, সেও পাইলট হবে। সুযোগ বুঝে একবার ইন্টারভিউও দিল। কুইস্ট টেস্ট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সে আশাতিরিক্ত ভাল করল। কিন্তু নিয়তির সেই অদ্ভুত পরিহাস। অল্পের জন্য চোখের ডাক্তারী পরীক্ষায় ও আটকে গেল। ৬/৬ দৃষ্টিশক্তি প্রয়োজন; কিন্তু ওর হলো ৬/৯, অর্থাৎ ঠিক এক ধাপ নিচে। ডাক্তার ওর অন্যান্য পরীক্ষায় এত খুশি হয়েছিলেন যে, পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত তিনিও ওর জন্যে চেষ্টা করেন। তবুও আনোয়ার, পাইলট আনোয়ার হতে পারেনি। হবে কি করে? বিধিই বাম!. ..

১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম ব্যাচে যোগদানের চেষ্টা করল আনোয়ার। তখন প্রথম ব্যাচে ভর্তি হতে লাগত অভিভাবকের ছাড়পত্র। এ ছাড়া ভর্তি করা হত না। ছাড়পত্রের জন্যে আনোয়ার চিঠি লিখল তার বাবাকে। বাবা পত্রের উত্তরে জানালেন, তোমার অনার্স ডিগ্রী নেয়ার আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। তারপর তুমি যেখানে যাও না কেন আমি নিষেধ করব না। কিন্তু এখন অনার্স ডিগ্রী নিতেই হবে। এই কথায় হয়তো সেদিন বিধাতাও সবার অলক্ষে হেসেছিলেন। কারণ পরবর্তীতে ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী নেয়া আর সম্ভব হয়নি। আবার বাবার কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যোগদান করাও সম্ভব হলো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ৩০৬ নং কক্ষে আনোয়ার থাকত। রূমে ওকে পাওয়া যেত রাত এগারোটার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে পড়াশোনায় ওর তেমন কোন মনোযোগ ছিল না। কারণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে ওকে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখাপড়ার প্রতি ওর চরম অনীহা প্রকাশ পেতে থাকল। ক্লাসের সময় ওকে প্রায়ই দেখা যেত কমনরূম, আর্টস বিল্ডিং, ক্যাফেটেরিয়া অথবা কোন সিনেমা হলে।

অনার্স পরীক্ষার আগে আনোয়ার পরীক্ষার ফিস জমা দিতে গিয়ে চমকে উঠল। ক্লাসের হাজিরা রেজিস্টারে ও ডিসকলেজিয়েট। নিয়ম ছিল, শতকরা ষাট ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেয়া যেত। কিন্তু শতকরা চল্লিশ ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়েও পরীক্ষা দেয়া যেত না। কোন উপায় না দেখে এক বন্ধুর পরামর্শে আনোয়ার গিয়ে হাজির হলো বিভাগীয় প্রধানের বাসায়। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন একজন অবাঙালী-নাম ডক্টর আতিকুল্লাহ ডি. এস. সি. । আচার আচরণ ও কথাবার্তায় এমন একটা ভাব ছিল যে তার আশপাশে কোন ছাত্র ভিড়ত না। সেক্ষেত্রে ড. আতিকুল্লাহর বাসায় যাওয়াটা ছিল যে-কোন ছাত্রের জন্য কোন বাঘের গুহায় ঢোকার সামিল। যদিও আনোয়ার তার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। সেও এক স্মরণীয় ঘটনা।

মাঝে মাঝেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে গলা ছেড়ে গান গাইত আনোয়ার। ড. আতিকুল্লাহ একেক দিন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতেন। গান শেষ হলে মাথায় টোকা মেরে ইংরেজিতে বলতেন, হোয়াই ডিড ইউ স্টপ? কাম অন, ক্যারি অন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ড. আতিকুল্লাহ যে বিষয় পড়াতেন সে বিষয়ে আনোয়ার ছিল রীতিমত মাস্টার। কারণ পরিসংখ্যানে তাঁর সাবজেক্ট নিউমেরিক্যাল ম্যাথমেটিকসে সে কখনও ৯০% এর নিচে নম্বর পেত না। তবুও ড. আতিকুল্লাহ পুরোপুরি খুশি হতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন, আনোয়ারের ১০০% নম্বর না পেলেও ৯৯% নম্বর পাওয়া অবশ্যই উচিত। এ ধরনের পূর্ব পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তার ড্রয়িংরূমে বসে, আনোয়ারের শরীর দিয়ে ঘাম বেরুনোর উপক্রম হলো। কিছুক্ষণ পর তিনি ড্রইংরূমে প্রবেশ করলে ও ঢোক গিলতে গিলতে তাঁকে ওর ডিসকলেজিয়েট হবার কথা বলল। সব শুনে তিনি হেসে বললেন, সি মি ইন দ্য ডিপার্টমেন্ট।

এরপর ওকে সঙ্গে করে তিনি নাশতা করলেন এবং নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে ডিপার্টমেন্টে নামিয়ে দিলেন। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে সহপাঠীরা মন্তব্য করল, আনোয়রের ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট ঠেকায় কে? ফার্স্ট ও ঠিকই হয়েছিল, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় নয় হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে নীরস পার্বত্য-অঞ্চলে কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতায়, হয়েছিল পঞ্চাশজন অফিসারের মধ্যে আমেরিকায় পাথফাইণ্ডার, রেঞ্জার ও কমাণ্ডো কোর্সে সিলেক্ট হবার পরীক্ষায়।

অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। সবেমাত্র আনোয়ার তিন পেপার পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা খুব একটা ভাল হয়নি। হিসেব করে সে দেখল, গড়ে ৩০% নম্বর আশা করা যেতে পারে। চতুর্থ দিন পরীক্ষা দিয়ে দেখল, একই অবস্থা। সে তখন সামনে সীটে বসা ঘনিষ্ঠ বন্ধু আহসানকে বলল, দোস্ত, আমি আর পরীক্ষা দেব না।

পরীক্ষা তোকে দিতেই হবে। হেড অভ দ্য ডিপার্টমেন্ট থাকতে তোর চিন্তা কি? তাছাড়া তোর ছক্কা মার্কা সাবজেক্টের পরীক্ষা তো এখনও হয়নি, আহসান বলল।

কিন্তু আনোয়ার প্রথম ঘণ্টা যাবার পর খাতায় পরীক্ষা দেব। না এই জাতীয় একটা মন্তব্য লিখে বাথরূমে যাওয়ার নাম করে হল থেকে বের হয়ে এল। ও জানত পরীক্ষা না দিয়ে হলে থাকলে হেড ওকে ঘাড়ে ধরে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাবে। তাই মোহাম্মদপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিল।

এদিকে ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে পরীক্ষার হলে না পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আনোয়ারের সমস্ত সহপাঠী এমন কি ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা সুরেশ ও নিয়ামতউল্লাহকেও তিনি আদেশ দিলেন, যেভাবেই হোক আনোয়ারকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু অত বড় ঢাকা শহরে আনোয়ারকে খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বেশ কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর সে পরাজিত সৈনিকের মত বাড়ি ফিরে এল। বাবা সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে ভীষণ দুঃখ পেলেন। তবে পরবর্তীতে অনার্স পরীক্ষায় ভালমত পাস করতে পারলে তার আর কোন দুঃখ থাকবে না–একথাও আনোয়ারকে জানিয়ে দিলেন।

১৯৬৫ সাল। আনোয়ার তখন বাড়িতে বসে আছে। এই সময় পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীতে অফিসার পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হলো। ও কাউকে না জানিয়ে দরখাস্ত করল। বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে যথারীতি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে জেন্টেলম্যান ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হলো।

কিছুদিন পরের ঘটনা। আনোয়ার তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। সবার সঙ্গে দেখা করে ও গেল ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহর সাথে দেখা করতে। ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে দেখে খুশি হলেন। আরও খুশি হলেন, যখন জানতে পারলেন, ও এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি খুশিতে বলেই ফেললেন, ওয়েল ডান, আনোয়ার, ওয়েল ডান।

এরপর তিনি ওকে কফি অফার করলেন। ঢোক গিলতে গিলতে ও কোনমতে কফি পান করল। এরপর আরেক চমক! তিনি বললেন, আনোয়ার, আই থিংক ইউ স্মোক, এই বলে তিনি ওকে সিগারেট অফার করলেন। ওর তো তখন ভিরমি খাবার জোগাড়। অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি আবার বললেন, ডোন্ট বি শাই, আনোয়ার। নাউ, ইউ আর অ্যান অফিসার। কাম অন।

আনোয়ার হেডের বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে আস্তে করে একটি ফিল্টার টিপড় উঠিয়ে নীরবে ধূমপান করতে লাগল। ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে ড. আতিকুল্লাহ মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওকে দেখছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, তুম্ জবর দোস্ত স্মার্ট হোগিয়া। এই ধরনের কথোপকথন ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য ওর সহপাঠীরা (তারা তখন এম. এ., এম. এস.সি. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র হেডের পেছনের জানালা দিয়ে চোখ ছানাবড়া করে দেখছিল।

আনোয়ার অসমাপ্ত তিন পেপার পরীক্ষার নম্বর দেখতে চাইলে হেড-মার্কশীট আনালেন। মার্কশীট দেখে ও তৃতীয় বারের মত চমকে উঠল। নীরবে মার্কশীটের দিকে চেয়ে থাকল সে। একি অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ওর হিসেবে এত গরমিল? পরীক্ষার সময় ওর সব বন্ধুরা হল থেকে বের হয়ে হিসেব করেছিল, কেউ ৬০% নম্বর পাবে, কেউ ৭০% নম্বর পাবে। আনোয়ার হিসেব করেছিল সে পাবে ৩৫% নম্বর। সেজন্যেই পুরো পরীক্ষা দেয়নি সে। কিন্তু তখন কি আনোয়ার জানত যে হিসাবে কত বিরাট ভুল হচ্ছে? ওর আবাল্য অভ্যাস ছিল প্রাপ্ত নম্বর থেকে অনেক কম আশা করা। তার প্রমাণ বেশ ভাল করেই পেল এই মার্কশীট দেখে। তিন পেপারে ও পেয়েছে গড়ে ৫৮%। ড, আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ডোন্ট থিংক। আই অ্যাম উইথ ইউ। টুমি আবার পরীক্ষা ডিবে।

বিদায় নেয়ার সময় ড. আতিকুল্লাহ হ্যাণ্ডশেক করে বলেছিলেন, আই উইশ ইওর ব্রাইট লাইফ ফুল অভ জাসটিস মাই বয়।

এরপর ড, আতিকুল্লাহর চেম্বার থেকে বের হয়ে এলে বন্ধুরা ওকে বলেছিল, দোস্ত, তুই-ই দেখালি।

ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ, ১৯৬৫। ঢাকা বিমান বন্দর। সন্ধ্যা। চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত। আনোয়ার চলেছে অফিসার হবার জন্য পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলের উদ্দেশে। সেদিন ঢাকা বিমান বন্দরে ওর প্রিয় বন্ধু আহসান, সাজেদ, আহসান উল্লাহ, নাজমুল, আহসান আহমেদ সহ অনেকেই উপস্থিত ছিল। তখনও কি আনোয়ার ভেবেছিল, ওকে উত্তাল সাগরের অতল গভীরে নামতে হবে? ছুটতে হবে রাতের আঁধার পেরিয়ে প্লেন নিয়ে অজানার দিকে? লাফ দিতে হবে অসীম অনন্ত মহাশূন্যে? পেরিয়ে যেতে হবে মালাকান হিলস-এর দুর্লজ্জ প্রাচীর? ওকে হারিয়ে যেতে হবে অসীম বিস্তার মরু প্রান্তরে? দুর্যোগের রাত্রে তুষার-ঝড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হবে বরফের দেশে? দুবছরের ব্যবধানে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হবে দুহাজার মাইল দুর্গম পথ? প্রতিটি পদে অজানা রহস্য। অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। কুত্তার মাংস ভক্ষণ। চারদিকে শুধু হিম শীতল মৃত্যুর হাতছানি!

একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল আনোয়ার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল প্লেনের গ্যাংওয়ের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে শেষবারের মত সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। প্রিয় বন্ধুরা বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল অপসৃয়মান প্লেনের দিকে। প্লেন তখন চল্লিশ হাজার ফুট উপরে। ৬৫-এর যুদ্ধের কারণে শ্রীলংকার ওপর দিয়ে ওভার-ফ্লাই করে ঘণ্টায় ছশো মাইল বেগে সে এগিয়ে চলেছে করাচী বিমান বন্দরের দিকে।

.

০২.

দুই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুল। বিরাট এলাকা জুড়ে চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। সুদৃশ্য লোহার গেটে একাডেমীর উজ্জ্বল নাম ফলক। সদা সতর্ক সশস্ত্র সেন্ট্রি গেট পাহারা দিচ্ছে। এবোটাবাদ থেকে মসৃণ পীচের রাস্তা সোজা এসে গেট দিয়ে ঢুকে গেছে একাডেমীর ভিতরে। ভিতরকার এই মসৃণ রাস্তাটুকু ছাড়া বাকি সব এলাকা উঁচু-নিচু ও এবড়োখেবড়ো। তবুও ভিতরটা একেবারে নীরস নয়। মাঝে মাঝে সারি বাঁধা পাইন গাছ লম্বা হয়ে দূর আকাশের দিকে উঠে গেছে। বাইরের এলাকাটা নিষ্প্রাণ ও ধূসর। চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু পাথুরে পাহাড়।

২৮ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় এবোটাবাদ থেকে অন্যান্য নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে আনোয়ারও পৌঁছে গেল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে। বড় হল-ঘরের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ও তাকিয়ে দেখল, সামনে উজ্জ্বল ফলকে লেখা রয়েছে ক্যাডেটস্ মেস। মেসের অদূরে সুইমিং পুল। সামনে বিরাট ঝকঝকে লন। আনোয়ারের হাতে পশমী দস্তানা, মাথায় কান ঢাকা ফারের টুপি, পরনে কমপ্লিট সুট, চোখে সানগ্লাস। গোল্ড লীফের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আনমনে ধূমপান করছিল ও।

ফেলে আসা অতীত ও নতুন ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনায় ওর মন ভরপুর। কল্পনাগুলো যখন দ্রুত দানা বেঁধে উঠছিল, ঠিক তখনই আনোয়ার শুনতে পেল জীবনে শোনা সবচেয়ে কর্কশ কণ্ঠ, ইউ ব্লাডি ফুলস, হোয়াই আর ইউ পাউচিং হিয়ার, অল অভ ইউ নিউ ইন টেকস? সবাই চমকে তাকাল। সামনে তিন-চারজন তাগড়া জোয়ান দাঁড়িয়ে। ওদের সবার গায়ের রং ফর্সা। প্রত্যেকের পরনে ওভারল (প্যান্ট শার্ট এক সঙ্গে সেলাই করা)। ওদের কালো ওভারলে ধুলোবালির ছাপ। পায়ের বুট জুতোও নোংরা। দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে বুটগুলো সকালবেলায় রীতিমত পরিষ্কার ছিল। দেখতে অনেকটা কুলি বা শ্রমিকের মত মনে হচ্ছিল। সবাই পূর্বের মত যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। আনোয়ার হাত পকেটে ঢোকানো অবস্থায় সিগারেট টানছে।

হঠাৎ করে ওদের একজন আনোয়ারের সামনে এগিয়ে এল। ওভারল পরিহিত যুবকের চেহারায় ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। আনোয়ারকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে সে বলে উঠল, ইউ ফুলস, ইউ থিংক দ্যাট দিস ইজ শাহনুর স্টুডিও অভ লাহোর অর হলিউড? টেক ইওর হ্যাণ্ডস আউট অভ দ্য পকেট। আনোয়ার সহ সকলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পকেট থেকে হাত বের করল। ওদের হাতে হ্যাণ্ড-গ্লাভস্ দেখে ওভারল পরিহিত আবার চিৎকার করে উঠল, টেক অফ দ্য ব্লাডি গ্লাভস। বাইরে প্রচণ্ড হাড় কাঁপানো শীত।

আনোয়ার হাত থেকে দস্তানা না খুলে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কোন কথাই শুনতে পায়নি। আর একজন ওভারলধারী এগিয়ে এসে গর্জন ছাড়ল, ইউ ব্লাডি শিট, ইফ ইউ ডোন্ট লিসেন টু দ্য বি.এস.এম., লাইফ ইজ গোয়িং টু বি হেল ফর ইউ ইন পি.এম.এ.। পি.এম.এ. কথাটার মানে (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী) বুঝতে পারলেও সে বি.এস.এম. কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না। যাই হোক, অগত্যা সবাই যার যার হ্যাণ্ড-গ্লাভস খুলে পকেটে ভরল। এরপরই তীব্র কণ্ঠে নির্দেশ এল, টেক অফ দি ডার্টি হেড-গিয়ারস অ্যান্ড দ্য স্টুপিড সান গ্লাসেস। সবাই বিনা বাক্যে এই আদেশও পালন করল। এরপর হুকুম মত সবাই হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিল। যারা এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়েছিল, তাদেরকে দাঁড় করানো হলো দুই পায়ের ওপর। বি. এস,এম, কথাটার মানে আনোয়ার তখন বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে জানতে পেরেছিল। বি.এস.এম. অর্থাৎ ব্যাটেলিয়ন সার্জেন্ট মেজর। বি.এস.এম.-রা প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটদের নিয়ম শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। নতুন ক্যাডেটরা বাঘের মত ভয় করে এদেরকে।

এবার এক বি.এস.এম. সাহেব এগিয়ে এল আনোয়ারের দিকে। অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি। হঠাৎ চমকে দেবার মত গর্জন করে বলল হোয়াই ডোন্ট ইউ উইশ? সঙ্গে সঙ্গে ও উত্তর দিল, উইশ ইউ গুড লাক। (উইশ মানে যে স্লামালেকুম বলতে হয় সেটা তখনও আনোয়ার জানে না)। সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় গর্জন, আই সে হোয়াই ডোন্ট ইউ উইশ?

ও পুনরায় বলল: উইশ ইউ গুড লাক।

আবার গর্জন: সে স্লামালেকুম স্যার।

ও পুনরায় বলল, স্লামালেকুম।

এবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বি.এস.এম. ফেটে পড়লেন, সে স্লামালেকুম, স্যার।

ও বুঝতে পারল যে স্যার কথাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে।

আনোয়ার সাধারণ ভাবে বলল, স্লামালেকুম, স্যার। আবার বি.এস.এম.-এর হুঙ্কার, লাউডার। ও আরও একটু জোরে বলল। আবার বি.এস.এম.-এর তীব্র কণ্ঠ লাউডার। গলার স্বর বাড়িয়ে দিল সে এক ধাপ। বি.এস.এম. আবারও বলল, লাউডার। এইভাবে আনোয়ার দশ বারোবার গলার স্বর বাড়িয়ে শেষে চিৎকার করে বলতে শুরু করল, স্লামালেকুম, স্যার।

এরপর বি.এস.এম. খুব দৃঢ় অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, হুইচ প্লেস ডু ইউ ডিসগ্রেস? বুঝতে না পেরে আনোয়ার বি. এস. এম.-এর মুখের দিকে বোকার মত তাকাল। আবার বি.এস.এম.-এর প্রচণ্ড কান-ফাটানো গর্জন, হোয়্যার দ্য হেল ডু ইউ কাম ফ্রম? আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ইস্ট, পাকিস্তান। ওহ্ ওহ্, বাংগালী বাবু-বলে বি.এস.এম, একটু অন্য দিকে তাকাতেই নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো, আনোয়ারের। জনৈক মনীষীর উক্তি মনে পড়ে গেল তার, দোজ হু জয়েন দি আর্মি, নাইন আউট অভ টেন আর ফুলস, অ্যাণ্ড রিমেইনিং ওয়ান ইজ ম্যাড।

ইতোমধ্যে বহু সিনিয়র ক্যাডেটের আগমন ঘটেছে। নতুন ক্যাডেটদের এই অসহায় অবস্থা দেখে ওরা বেশ কৌতুক উপভোগ করছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে সিনিয়রদের প্রচণ্ড তর্জন গর্জন। সিনিয়র ক্যাডেটদের মধ্যে আনোয়ার হঠাৎ করে তার পূর্ব-পরিচিত ঢাকার একজনকে দেখতে পেল। তার দিকে তাকিয়ে হাসতেই বি.এস.এম. স্বভাবসুলভ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, ডোন্ট গ্রিন। গ্রিন শরে মানে বুঝতে না পেরে ও আবার হাসল। বি.এস.এম. আবার ধমকে উঠলেন, আই সে, ডোন্ট গ্রিন। এবারেও ও বুঝতে পারল না। বি.এস.এম.-এর কণ্ঠ আবার শোনা গেল, আই সে ডোন্ট শো ইওর ডার্টি টিথ। ডু ইউ আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ইউ ব্লাডি শিট অব এ মিউল?

এবারে আনোয়ার পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারল, বি.এস.এম. কি বলতে চাইছে। সে বলল, সরি, স্যার, নাউ আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ইউ। আনোয়ারের পূর্ব-পরিচিত সেই সিনিয়র ক্যাডেটের নাম আবদুল্লাহ আহমেদ মুসা (বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার)। অবস্থা বুঝতে পেরে সে আনোয়ারের দিকে এগিয়ে এসে বলল, মিস্টার, নো সরি ইন পি.এম.এ। আনোয়ার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বি.এস.এম. মুসাকে বললেন, মোজেস, ইউ বেটার টিউন আপ দিস চ্যাপ। মুসা আনোয়ারকে ফিসফিস করে বলল, তোমার জন্য কোন রূম বরাদ্দ করা হয়েছে .. ইতোমধ্যেই ওর জন্য রূম বরাদ্দ করা হয়েছিল। মুসা কাছেই একজন পোর্টারকে ডেকে আনোয়ারের মালপত্র তার মাথায় চাপিয়ে কাঠের তৈরি একটি ব্যারাকের দিকে এগোতে এগোতে বলল, চলো কেটে পড়ি। ওর জন্য বরাদ্দকৃত দশ নম্বর রূমে ঢুকে মুসা দরজা বন্ধ করে দিল। দুজনে সিগারেট ধরিয়ে শুরু করল নানা রকম গল্প। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। মুসা, কাম ইন, প্লীজ, বলে দরজা খুলে দিল। এক সিনিয়র ক্যাডেট ঘরে প্রবেশ করল। আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। সালামের উত্তরে সিনিয়র ক্যাডেট কঠিন কণ্ঠে বললেন, ডোন্ট ডিসগ্রেস ইওর সিনিয়র, হু ইজ স্ট্যাণ্ডিং উইথ ইউ। এই বলে সিনিয়র ক্যাডেট বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

আনোয়ার অবাক হয়ে চাইল মুসার দিকে। ব্যাপার কি? মুসা ওকে বুঝিয়ে বলল, কোন সিনিয়র-ক্যাডেটের সঙ্গে থাকা অবস্থায় অন্য কোন সিনিয়রকে সালাম দেয়া অপরাধ। কারণ তখন সবকিছুর দায়িত্ব সঙ্গের সিনিয়র ক্যাডেটের ওপর থাকে। এরপর মুসা ওকে পি,এম.এ.-র কিছু কিছু নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিয়ে বলল, প্রথমত রাস্তা দিয়ে চলার সময় খুব জোরে হাঁটতে হবে, অথবা দৌড়াতে হবে। এটা অবশ্য নবাগত ক্যাডেটদের বেলায়ই প্রযোজ্য। কোন সিনিয়রকে এক মাইল দূর থেকে দেখলেও আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে হবে স্লামালেকুম, স্যার। ইউনিফরম ছাড়া ট্রাউজার্সের দুই পাশের পকেটগুলো সেলাই করে রাখা উচিত। কারণ তা না হলে কেউ ভুলবশত পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোথাও দাঁড়িয়ে থ্রাকতে পারে। এটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। সময় সম্পর্কে ভীষণভাবে সচেতন থাকতে হবে। কেউ দরজায় কড়া নাড়লে কাম ইন, প্লীজ বলতে হবে। পি.এম. এ.-র এই ধরনের বেশ কিছু নিয়ম শিখিয়ে চলে গেল মুসা।

পি.এম.এ.-তে ছিল ক্যাডেটদের একটা ব্যাটেলিয়ন। এই ব্যাটেলিয়নের চারটি কোম্পানী-কাশেম কোম্পানী, তারেক কোম্পানী, সালাহউদ্দিন কোম্পানী ও টিপু কোম্পানী। কিন্তু জরুরী অবস্থার জন্য এই সময় আরও এক ব্যাটেলিয়ন বাড়ানো হয়েছিল। এই দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে ছিল–বাবর কোম্পানী, গজনভী কোম্পানী, আওরঙ্গজেব কোম্পানী এবং কায়েদ কোম্পানী। আনোয়ারকে আওরঙ্গজেব কোম্পানীর পাঁচ নম্বর প্লাটুনে পাঠানো হলো। একটা কোম্পানী যখন কমিশন পায়, তখন পরের ব্যাচ সিনিয়র হয়ে যায়। পাস আউট হয়ে যাওয়া কোম্পানীতে নবাগত ক্যাডেটরা সর্বাপেক্ষা জুনিয়র বলে বিবেচিত। এই সময় আওরঙ্গজেব কোম্পানী ছিল সর্বাপেক্ষা জুনিয়র। সুদৃশ্য বিল্ডিংগুলোতে কাশেম ও তারেক কোম্পানীর সিনিয়র ক্যাডেটরা থাকে। বাকি সবাই থাকে কাঠের তৈরি লম্বা ব্যারাক বা ডরমেটরীতে।

আনোয়ার রূমে বসে চুপচাপ একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছে। মালপত্র সব মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো। ওর রূমমেট তখনও ঘরে আসেনি। হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার করে কে যেন বলল, অল নিউ ইনটেকস স্ট্যাণ্ড ইনফ্রণ্ট অভ ইওর রূম অন দ্য করিডর। বাইরে প্রচণ্ড শীত। সব নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে আনোয়ারও ঘরের বাইরে, বারান্দার ওপর এসে দাঁড়াল। একজন হাবিলদার এসে সবাইকে ক্যাডেট অফিসের সামনে নিয়ে গেল, ওদেরকে দাঁড় করানো হলো সারিবদ্ধভাবে। সাধারণত ক্যাডেট অফিসকে জি.সি. অফিস বলা হয়। কারণ নতুন ক্যাডেটরা সবাই জি.সি. অর্থাৎ জেন্টেলম্যান ক্যাডেট বলে পরিচিত। জি.সি, অফিস থেকে বি.এস.এম. স্বভাবসুলভ বেপরোয়া ভাব নিয়ে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ালেন। আরও পাঁচজন সিনিয়র ক্যাডেট এসে বি.এস.এম.-এর পাশে দাঁড়াল। এরপর বি.এস.এম. ব্লাডি ফুল, শিট, ইডিয়ট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে নতুন ক্যাডেটদের উদ্দেশে যা বললেন তার মর্মার্থ এই:

আমার নাম করম খান রাজপুত। আমি পি.এম.এ.-র বি.. এস.এম.। বি.এস.এম, কি জিনিস সেটা তোমরা হাড়ে হাড়ে টের পাবে অন্তত যতদিন আমি এখানে বি.এস.এম. হিসাবে আছি। আমার সঙ্গের পাঁচজন তোমাদের পাঁচ প্লাটুনের সার্জেন্ট। সবাই যার যার সার্জেন্টকে চিনে রাখো। এই বলে বি.এস.এম. পাঁচজন সার্জেন্টকে নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর তিনি পি.এম.এ.-র নিয়মকানুন সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দিলেন:

(১) কঠোর সময়ানুবর্তী হতে হবে। কোন জায়গায় নির্দিষ্ট সময় হাজির হবার কথা থাকলে পাঁচ মিনিট আগে সেখানে পৌঁছতে হবে। কেউ চার মিনিট আগে হাজির হলেও তাকে এক মিনিট লেট হিসেবে গণ্য করা হবে।

(২) এক পায়ের ওপর ভর করে বা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো দণ্ডনীয় অপরাধ।

(৩) প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখা চলবে না।

(৪) কোন সিনিয়রকে যতদূর থেকে বা যে অবস্থায় বা যেদিক থেকে দেখা যাক না কেন, স্লামালেকুম, স্যার বলতে হবে।

(৫) কোন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটা অবস্থায় ধূমপান নিষেধ।

(৬) ভোরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় এবং সন্ধ্যায় জাতীয় পতাকা নামানোর সময় বিউগলের আওয়াজ শোনা মাত্র যে যে অবস্থায় বাইরে থাকবে, বিউগল বাজানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যাটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

(৭) সপ্তাহে একবার করে বাধ্যতামূলকভাবে চুল কাটাতে হবে।

 (৮) ইউনিফর্ম কড়া ইস্ত্রি এবং বুট বেল্ট চকচকে রাখার দায়িত্ব আদালীর হলেও বাইরে বেরুনোর সময় প্রত্যেক ক্যাডেটকে তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। আরও খেয়াল রাখতে হবে, কাপড়ের বোতাম ও সেলাই যেন নিখুঁত থাকে এবং বুটের ফিতা যেন প্যাঁচ খেয়ে না থাকে।

(৯) অনুমতি ছাড়া নতুন ক্যাডেটরা পি.এম.এ.-র ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে পারবে না।, (১০) ছুটির দিন ছাড়া প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে পড়ার টেবিলে পড়াশোনা করতে হবে। এমনকি পড়ার সময় বাথরূমে যাওয়াও চলবে না। বাথরূমের কাজ তার আগেই সারতে হবে।

(১১) পি,এম.এ.-তে সব সময় সুন্দর ছায়াছবি দেখানো হয়। কিন্তু সপ্তাহে একদিন ছায়াছবি দেখার ব্যাপারে নতুন ক্যাডেটদের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

(১২) নাস্তার সময় সকাল সাড়ে সাতটা। লাঞ্চের সময়– বেলা দেড়টা এবং ডিনারের সময় রাত নয়টা। এছাড়াও ভোর সাড়ে চারটায় বেড টি ও বিকেল চারটায় আফটারনুন টি ঘরেই পরিবেশিত হবে। খাওয়ার সময় ছুরি, কাঁটা, চামচের ব্যবহার একটু পরেই শিখিয়ে দেয়া হবে।

(১৩) সপ্তাহে একদিন করে ডিনার নাইট।

(১৪) স্যালুটিং টেস্ট পাস না করা পর্যন্ত কেউ পি.এম.এ.-র মেইন গেটের বাইরে যেতে পারবে না।

(১৫) কোন অবস্থাতেই পি.এম.এ.-র ভিতরে কোন লন মাড়ানো যাবে না। সোজা কথা নো শর্ট কাট ইন পি.এম.এ.।

এছাড়া ভবিষ্যতে আরও নির্দেশ পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। সেই সঙ্গে বি.এস.এম. এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, রিমেম্বার, গড ইজ অলমাইটি ইন স্কাই লাইন, অ্যাণ্ড মাইটি সিনিয়রস ইন পি.এম.এ.।

এর কিছুক্ষণ পর বেলা প্রায় বারোটার দিকে সব নবাগত ক্যাডেটদের স্টোরের সামনে জমায়েত হবার নির্দেশ দেয়া হলো। স্টোর থেকে বুট, মোজা, গরম ফুল আণ্ডারওয়ার, পশমী গেঞ্জি, বেল্ট, ব্যারেট ক্যাপ, ফিল্ড সার্ভিস মার্চিং অর্ডার (একটা বড় প্যাক, দুটো অ্যামুনিশন পাউচ, একটা পানির বোতল), বাঙালী ক্যাডেটদের জন্য ছয়টা করে কম্বল, পশ্চিমা ক্যাডেটদের জন্য তিনটা করে কম্বল, খাকি পুলওভার, মাঙ্কি ক্যাপ, তিনটে সাদা বিছানার চাদর, দুটো বাথ টাওয়েল, দুটো হ্যাণ্ড টাওয়েল প্রভৃতি প্রত্যেক নবাগত ক্যাডেটদের জন্য ইস্যু করা হলো।

ইতোমধ্যে লাঞ্চের সময় হয়ে এল। কয়েকজন সিনিয়র ক্যাডেট চিৎকার করে নির্দেশ দিল প্রত্যেককে ডাইনিং রূমের পাশে অ্যান্টি রূমে প্রবেশ করতে। কিছুক্ষণ পর বি.এস.এম. এসে কঠোর কণ্ঠে আবার নির্দেশ দিলেন, অ্যান্টি রূমে ঢোকার আগে প্রত্যেককে বাথরূমে গিয়ে হাত-মুখ পরিষ্কার করে ধুয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতে হবে। বেল্ট ও ক্যাপ খুলে বাইরে স্ট্যাণ্ডে রাখতে হবে। অ্যান্টি রূমের দেয়ালে প্রেসিডেন্ট এবং বিভিন্ন নেতৃবর্গের ছবি টাঙানো আছে। সেজন্যে এ-ঘরে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কেউ ইচ্ছে করলে এখানে খবরের কাগজ, দেশী-বিদেশী ম্যাগাজিন পড়তে পারবে এবং রেডিও বা স্টেরিওগ্রামে গান শুনতে পারবে।

অ্যান্টি রূম হয়ে ডাইনিং রূমে ঢুকতে হবে। চেয়ার টানার কোনরকম আওয়াজ না করে টেবিলে বসতে হবে। (বাথরূম ছাড়া সব কামরাগুলো কার্পেটে মোড়া)। খাবার সময় ছুরি, কাঁটা, চামচ দিয়ে প্লেটের সঙ্গে কোনরকম টুং টাং আওয়াজ করা চলবে না । মাংসের হাড্ডি চিবানো নিষেধ। খাবার চিবানোর সময় কোনরকম চপ চপ আওয়াজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ । প্লেট থেকে চামচ দিয়ে সুপ উঠানোর সময় প্লেটের কাছের কোনা উঠিয়ে কাত করে সুপ ওঠাতে হবে। যাতে সামনে বসা কোন ক্যাডেট প্লেটের তলা দেখতে না পায়। কোনরকম হাঁচি বা ঢেকুর উঠলে পাশের জনকে হেল কমাণ্ডো এক্সকিউজ মি বলতে হবে। লবণ বা সস চাইতে হলে মে আই হ্যাভ দ্য সল্ট অর সস বলতে, হবে। ওয়েটার বাদিকে দাঁড়ালে খাবার নিতে হবে।

প্রথমে ভাত বা পোলাও এবং পরে মাংস, রোস্ট ইত্যাদি। রুটি থাকলে একটার পর একটা নিতে হবে। তরকারি নিতে হবে পরে খাওয়া শেষ হলে কাটা, চামচ, ছুরি প্লেটের ওপর রাখতে হবে সমান্তরালভাবে। খাওয়া শেষ না হলে ওগুলো প্লেটের ওপর রাখতে হবে ক্রস করে। তাহলে ওয়েটার পুনরায় খাবার পরিবেশন করবে। ডাইনিং রূমে কোনরকম জোরে আওয়াজ করা চলবে না। ওয়েটারদের ডাকতে হবে ইশারায়। কেউ কিছু চাইলে ওহ্ শিওর বা প্লীজ বলে এগিয়ে দিতে হবে।

ইতোমধ্যে সব নবাগত ক্যাডেটদের ফুল প্লেট, হাফ প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট কাঁটা, ছুরি, চামচ, পানির গ্লাস, ন্যাপক্লিন ইত্যাদির ব্যবহার শিখিয়ে দেয়া হলো। লাঞ্চ শেষে এক কাপ কাওয়া বা সবুজ চা পান করে আনোয়ার ছুটল বিশ্রাম নেবার জন্য ওর রূমের দিকে।

রূমে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়াল সে। ভিতরে বাঘের মত একজন সিনিয়র দাঁড়ানো। সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ও চিৎকার করে উঠল স্নামালেকুম, স্যার। ঘরের ভিতর ভাল করে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেল, ওর রূম-মেটকে বিরাট আলমারির মাথার ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। সিনিয়র সালামের জবাবে বলে উঠলেন, দেয়ার কামস অ্যানাদার জনি। কাম ইন, কাম ইন অ্যাণ্ড উড ইউ মাইণ্ড টু গেট ইনসাইড দি আলমীরা? বিনা বাক্যে আলমারির ভিতরে প্রবেশ করল আনোয়ার। আলমারির মাথার ওপর বসিয়ে রাখা আনোয়ারের রূম-মেটকে সিনিয়র বলল, ইউ আর অ্যানাউন্সার অব রেডিও পাকিস্তান কাকুল, অ্যাণ্ড দি ইডিয়ট ইনসাইড ইজ রেডিও সিঙ্গার। নাউ স্টার্ট রেডিও প্রোগ্রাম। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের রূম-মেট শুরু করল, দিস ইজ রেডিও পাকিস্তান, কাকুল। ওয়েস্ট পাকিস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম ২-৩০ পি.এম.। আওয়ার স্পেশাল প্রোগ্রাম স্টার্টস। লিসেন টু আওয়ার ফেমাস সিঙ্গার আনোয়ার। শুরু হলো আনোয়ারের বাংলায় অকথ্য গালাগালি (যা জীবনে উচ্চারণও করেনি ইতোপূর্বে) মিশিয়ে গর্দভ রাগিণী । মাঝে মাঝে আলমারির দরজা ফাঁক করে সে দেখছে, বাঘ-বাবাজী দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেট টানছেন।

হঠাৎ দরজায় নক হলো। সিনিয়র কাম ইন প্লীজ বললেন। ঘরে প্রবেশ করল আরও দুজন যমদূত। ওরা বেশ কিছুক্ষণ আনোয়ারের গর্দভ রাগিণী শ্রবণ করার পর আলমারির ভিতর থেকে ওকে বের করে আনল। তারপর ওকে ফায়ার প্লেসের ওপর দুপা শূন্যে উঠিয়ে দুহাতে মেঝেতে ভর করতে বলা হলো। এবং ওই অবস্থায় শুরু হলো ইন্টারভিউ । নিজের নাম কি, বাপের নাম কি, বাড়ি কোথায়, বিয়ে করেছে কিনা, মেয়ে বন্ধু আছে কিনা, থাকলে সে দেখতে কেমন ইত্যাদি হাজারো রকম আবোল তাবোল প্রশ্ন। ইতোমধ্যে আনোয়ারের দুহাতের পেশী ব্যথায় ও চাপে ফুলে উঠেছে। শরীরের সমস্ত রক্ত মনে হচ্ছে নিচের দিকে নেমে আসছে দ্রুত। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল ওর। মাথার ভেতর দপ দপ করছে। আগুন ধরে গেছে যেন।

হঠাৎ দুহাত ভয়ানকভাবে থর থর করে কাঁপা শুরু করল । সেদিকে সিনিয়র যমদূতদের কোন খেয়াল নেই। ওরা সবাই খোশগল্পে মগ্ন। আনোয়ার নিজের রূম থেকেই বুঝতে পারল, এ ধরনের রগড় অন্যান্য ক্যাডেটদের নিয়েও চলছে। হঠাৎ তিন যমদূতের একজনের মনে বোধহয় সামান্য করুণার উদ্রেক হলো। সে এগিয়ে এসে বলল, গেট ডাউন অ্যাণ্ড স্ট্যাণ্ড অন ইওর ফিট। যাক, এযাত্রা রেহাই পাওয়া গেল। আনোয়ার তাড়াতাড়ি উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, থ্যাংক ইউ, স্যার। সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো ধমক, নো থ্যাংকস ইন পি.এম.এ.।

এরপর আনোয়ার এবং ওর রূমমেটকে দাঁড় করানো হলো, মুখোমুখি। একে অপরের টাই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে পরস্পর পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে ওঠা বসা করার হুকুম হলো। শুরু হলো এক বিচিত্র ভঙ্গিতে ওঠা-বসা। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে ওঠ বোস করার পর ঘরে প্রবেশ করল আরও এক ইবলিস। ঘরে। ঢুকেই সে বলে উঠল এহ্ এহ্ রিলাকসিং? টেক দেম আউট। বাইরে প্রচণ্ড কনকনে শীত। ঠাণ্ডায় পানি জমে বরফ হয়ে আছে। তার ওপর হচ্ছে তুষারপাত। রূমমেট ও আনোয়ারকে বাইরে এনে দাঁড় করানো হলো বরফের ওপর। শুরু হলো স্পিনিং (সামনে ঝুঁকে পড়ে দুই হাত পায়ের পাতার সঙ্গে ঠেকিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোরা), ডিগবাজি ও ক্রলিং। রাস্তায় মাঝে মাঝে বরফ গলে কাদা হয়ে আছে। এই তীব্র কনকনে শীতের মধ্যে কাদা, পানি ও বরফে সমস্ত শরীর একাকার হয়ে গেল। আনোয়ারের চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিকেলের গেমসের সময় হয়ে এলে ওদের নিষ্কৃতি দিয়ে তিন যমদূত মাঠের দিকে চলে গেল।

ঘরে ফিরে এল আনোয়ার। শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি । ভিজে কাপড়চোপড় বদলে গরম প্যান্ট, শার্ট ও পুলোভার পরে নিল সে। ফায়ার প্লেসের আরামদায়ক উষ্ণতায় প্রচণ্ড শীতে জমে যাওয়া শরীরটা গরম হয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু এ সুখ বেশিক্ষণ সইল, না। আবার ফিরে এল সিনিয়ররা। শুরু হলো নিষ্ঠুর অমানুষিক কৌতুক । সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পরিত্রাণ পেল ওরা। নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো আনোয়ারের । ও যেন সিনিয়রদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। পি,এম.এ. তো, অদ্ভুত জায়গা।

রাত প্রায় নয়টা। ডিনার টাইম, আসন্ন। আনোয়ার পুনরায় প্যান্ট, শার্ট, টাইয়ের সঙ্গে খাকি পুলোভার জার্সি পরে ডিনারের জন্য ডাইনিংয়ে গেল। ডিনার শেষে হঠাৎ একজন সিনিয়র ক্যাডেট ঘোষণা করলেন, ডিনার শেষে প্রত্যেক ক্যাডেটকে, জি.সি, অফিসের সামনে হাজির হতে হবে। ডিনার শেষ হলো । আনোয়ার দ্রুত এক কাপ গ্রীন টি ও একটা সিগারেট শেষ করে অন্যান্য ক্যাডেটদের সঙ্গে ছুটল জি. সি. অফিসের দিকে। চারদিকে তুষারপাত হচ্ছে। দূরের সব জিনিস অস্পষ্ট, ঝাঁপসা। বি, সি, অফিসের সামনে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরু বরফের আস্তরণ। প্লাটুন সার্জেন্টের নির্দেশে সব ক্যাডেটরা লাইনবন্দী হয়ে ফল নি হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জি. সি. অফিসের ভিতর থেকে, বি.এস,এম, বেরিয়ে এসে সব নবাগত ক্যাডেটদের উদ্দেশে সুমধুর কন্ঠে ভাষণ দিলেন :

ব্লাডি ইডিয়টস, ইউ হ্যাভ কাম টু পি.এম.এ. নট টু বিকাম সফট ফিল্ম হিরোজ। অল অভ ইউ উইল বি অফিসার্স ইন পাকিস্তান আর্মি। বাট আই হ্যাভ নোটিসশ্‌ থ্রু আউট দ্য ডে দ্যাট ইউ শিটস হ্যাড বিন স্নাউচিং। নাউ অল অফ ইউ উইল রাশ টু ইওর রূমস অ্যাণ্ড কাম ব্যাক উইদিন টুয়েনটি মিনিটস অ্যাজ আই টেল ইউ নাউ। ড্রেস: হাফ শার্ট উইদাউট ভেস্ট। শর্টস উইদাউট আণ্ডারওয়্যার। পিটি সুজ উইদাউট স্টকিং। ইকুইপমেন্টস স্টীলমেড বাথ টাব ফুল অভ ওয়াটার অন হেড। নাউ বাজ অফ।

আনোয়ারের রূমমেট বলে উঠল, দোস্ত, এই পোশাকে ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় শীত লাগছে। বাইরে তুষারপাতের মধ্যে মাথায় ঠাণ্ডা পানির টাব নিয়ে দাঁড়ালে না জানি আমাদের প্রত্যেকের অবস্থা কি হবে। মানসিক অবস্থা আনোয়ারের এমনিতেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর রূমমেটের এই কথায় মন আরও দমে গেল।  যথাসময়ে আনোয়ার নির্দেশিত পোশাকে এবং ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়া পানি ভর্তি টাব মাথায় ছুটল জি.সি. অফিসের সামনে। রূমের বাইরে আসতেই দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে লাগল। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। তার ওপর ঠাণ্ডা টাব মাথার ওপর ধরে রাখার জন্য দুটো হাত প্রায় অনুভূতি শূন্য হতে চলেছে। তবুও কোনমতে টলতে টলতে জি.সি. অফিসের সামনে পৌঁছাল সে। প্রত্যেক ক্যাডেট মনে মনে বি.এস.এম. এ-র গুষ্টি উদ্ধার করছে। আর বি.এস.এম. গরম পোশাকে সাথীদের নিয়ে ফায়ার প্লেসে শরীর গরম করছেন আর বাইরে এসে এই প্রাণান্তকর দৃশ্য বেশ কৌতুকের সঙ্গে উপভোগ করছেন। ক্ষণিকের মধ্যেই সমস্ত ক্যাডেটদের হাল শোচনীয় হয়ে পড়ল। এর কিছুক্ষণ পর শুরু হলো সত্যিকার করুণ ও বীভৎস অবস্থা।

ঝুরঝুর করে তুষার ঝরছে আকাশ থেকে। ঠাণ্ডা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রত্যেক ক্যাডেটের শরীর প্রায় অনুভূতিশূন্য। অনেকের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। শুরু হলো ঠাণ্ডা পানি ভর্তি টাব মাথায় নিয়ে একের পর এক পতন। সবাই যেন একে একে মৃত্যুর দিকে নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য আনোয়ারের হৃৎপিণ্ডটাকে হঠাৎ করে চমকে দিল। ওর চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে সে। কিন্তু শরীরটা ভয়ানকভাবে বিরোধিতা শুরু করল। অসাড়, অবসন্ন, প্রচণ্ড নির্যাতনে ক্লান্ত শরীরটা নরম তুষারের ওপর শুয়ে পড়তে চাইছে। মাথাটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল ভীষণভাবে। কাটা কলাগাছের মত আনোয়ার নরম তুষারের ওপর আছড়ে পড়ল। সেই সঙ্গে টাবের পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেল তার সারা শরীর। বোধশক্তি প্রায় অবলুপ্ত ।

ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার ছদ্মবেশে মৃত্যু যেন অতি সন্নিকটে। আনোয়ারের মনে হলো, বি.এস.এম. এগিয়ে এসে ওর বুকের দুপাশে পা রেখে দাঁড়ালেন। বাঘের মত দুই চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। বি. এস. এম.-এর সত্যিকার সুদর্শন চেহারাটা কুৎসিত কদাকার হয়ে দেখা দিল ওর চোখে। হাতের আঙুলগুলো সাড়াশির মত বাঁকা করে বি. এস. এম. ধীরে ধীরে ঝুঁকছেন ওর হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে নেবার ভঙ্গিতে। শেষ সময় উপস্থিত। নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছে। আব্বা, আম্মা ও প্রিয়জনদের মনে মনে বিদায় জানিয়ে অজানা মৃত্যুর কোলে নিজেকে সঁপে দেবার জন্য তৈরি হলো আনোয়ার।

প্রচণ্ড ধমকে ছিন্ন হয়ে গেল চিন্তাটা। গেট আপ-বলে চিৎকার করে উঠলেন বি.এস.এম.। আনোয়ারের মনে হলো, বহুদূর থেকে কে যেন ডাকছে। বি.এস.এম.-এর কর্কশ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ওর অসাড় শ্রবণশক্তিতে মৃদু আঘাত করল। স্লো-মোশন ছায়াছবির মত পৃথিবীটা আবার সচল হয়ে উঠল ওর কাছে। সভয়ে চোখ খুলল। তারপর শুরু হলো উঠে দাঁড়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। শেষে বহু কষ্টে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেতসপত্রের মত কাঁপতে শুরু করল সে। সবাই উঠে দাঁড়ালে বি.এস.এম. সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন:

ব্লাডি সফটিজ, ইউ কান্ট স্ট্যাণ্ড দিজ। হাউ উইল ইউ ফেস বুলেটস ইন দ্য ফিল্ড। অল অভ ইউ উইল বি সীটিং গ্রীন। নাউ ড্যাশ অফ টু ইওর রূম অ্যান্ড বি হিয়ার অ্যাট ফাইভ মিনিটস বিফোর সিক্স ইন দ্য মর্নিং।

রাত তখন প্রায় দশটা। বহু কষ্টে বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেল । আনোয়ার এবং ওর রূমমেট ঘরে ঢুকে টাবটা বাথরূমে রেখে ভিজে কাপড় বদলে স্লিপিং সুট পরে নিল। ঘরে অপেক্ষা করছিল আদালী। তাড়াতাড়ি গরম চা এনে দিল। পরম তৃপ্তিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজন ফায়ার প্লেসের আগুনে গরম করতে শুরু করল ঠাণ্ডা শরীর। এরপর শুরু হলো কথোপকথন। প্রথমেই ওরা বি.এস.এম. ও সিনিয়র ক্যাডেটদের বাপ-মা তুলে কষে গালাগালি দিল। বেশ কিছুক্ষণ গল্পের পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আনোয়ারের রূমমেট বলল, পার্টনার নাউ লেটস গো টু বেড, অ্যাজ উই হ্যাভ টু গেট আপ আর্লি ইন দ্য মর্নিং। লেট আস রিল্যাক্স অ্যাজ মাচ অ্যাজ পসিবল অ্যাণ্ড গেট প্রিপেয়ার্ড ফর টুমরোজ বাগারী!

ঘরের মেইন লাইট নেভাননা। শুধু টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঠাণ্ডা বিছানা আস্তে আস্তে গরম হয়ে এল। সারাদিনের ভৌতিক অবস্থার কথা ওরা যেন ভুলে গেল। দুজনে গরম বিছানায় শুয়ে তৃপ্তির সঙ্গে রাতের শেষ সিগারেট টানছে। হঠাৎ ওদের মনে হলো পি.এম.এ.-তে কষ্ট যতই থাক না কেন, আরামেরও যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত আছে। সিগারেট শেষ হয়ে এলে অ্যাশট্রেতে গুঁজে আনোয়ার হাত বাড়াল টেবিল ল্যাম্পের সুইচের দিকে। কিন্তু হাত টেবিল ল্যাম্পের সুইচ পর্যন্ত পৌঁছাল না। তার আগেই দরজায় টোকা পড়ল–টক, টক, টক, টক। দুজন একই সঙ্গে অফিসার সুলভ মনোভাব নিয়ে কাম ইন প্লীজ বলে উঠল । দরজা ঠেলে প্রবেশ করল দুজন সিনিয়র। ওদের দেখেই আনোয়ার ও রূমমেট দুজনের কণ্ঠচিরে বেরিয়ে এল চিৎকার স্লামালেকুম, স্যার শুরু হলো আবার সেই নিষ্ঠুর কৌতুক। প্রচণ্ড শীতের মাঝেও ওদের সমস্ত শরীর ঘামে চুপসে গেল । অমানুষিক অত্যাচার। অসহ্য। এহেন পশুসুলভ আচরণে ক্রমশই ওদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে নিষ্কৃতি পেল ওরা।

তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দুজন টাওয়েল দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে ফেলে, আবার বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড ক্লান্তি ও অবসাদ থাকা সত্ত্বেও ওদের ঘুম এল না। কারণ বাইরে থেকে ভারী বুটের মচ মচ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কখন যে ওদের চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে এল, খেয়াল নেই। একটি দুঃস্বপ্নের রাতের কোলে মাথা রেখে নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল ওরা দুজন।

এই যে এত সব ব্যাপার-স্যাপার–তা সেটা প্রাথমিক অভ্যর্থনাই হোক বা উঠতে বসতে শুতে হাঁটতে প্রতিপদে আইন কানুন, নিয়ম-বিধি-বিধানের কড়চাই হোক সবকিছুর পেছনেই । একটা উদ্দেশ্য আছে, যদিও প্রাথমিক দৃষ্টিতে নির্মমতা ও কৌতুক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।

একবার এক স্পেশাল গ্যাদারিং-এর সহজ পরিবেশে এক জুনিয়র ক্যাডেট একজন সিনিয়রকে প্রশ্ন রেখেছিল, স্যার, অপরাধ করে শাস্তি পেলাম, সেটা ক্লিয়ার; কিন্তু কথা হচ্ছে অযথা বা বিনা কারণে শাস্তি পেলে সেটা কেমন হলো? এর জবাবে সিনিয়র মহোদয় যা বলেছিলেন তা মোটামুটিভাবে এই: অযথা বা বিনা কারণে তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হয় না। অন্য কোন কারণ না থাকলেও একটা কারণ সব সময়ই রয়েছে, তা হচ্ছে, তোমরা জুনিয়র। এটা কেমন যেন একটা গায়ের জোরে মার্কা অযৌক্তিক কথা মনে হয়। আসলেই কি তাই? জুনিয়ররা বলবে, অবশ্যই। অথচ সিনিয়ররা বলবে, নেভার। এর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা অনেকটা নিম্নরূপ:

সাধারণ নাগরিক জীবন ও সামরিক জীবনের মধ্যে ঢের পার্থক্য বিদ্যমান। একজন নতুন ক্যাডেট (জুনিয়র ক্যাডেট) যখন প্রথম এই পার্থক্যের বিপাকে পড়ে, তখন তাকে খাবি খেতে হয়, বৈ কি? এরই নাম ডিসিপ্লিনারি ট্রেনিং-যার তাৎক্ষণিক বা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক: যেমন সারাদেহে বেদনানুভূতি, মেজাজ খিঁচড়ে যাওয়া, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি; কিন্তু চূড়ান্ত ফল ইতিবাচক–যখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুনভাবে আত্মনির্ভরশীলতা, নিজের ওপর আস্থা, যে-কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করার ক্ষমতা, জীবনে চলার পথে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাব ইত্যাদি যার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

নিয়ম শৃঙ্খলা-সময়ানুবর্তিতা, ঊর্ধ্বতন কমাণ্ডোর আদেশ নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলা ইত্যাদি শুরুতেই শক্তহাতে শেখানোর চেষ্টা করা হয়, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন ক্যাডেটের সুপ্ত নিষ্ক্রিয় শক্তি-ক্ষমতা ও উদ্যমকে জোর করে জাগিয়ে তোলা। প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও পরে সে বুঝতে পারে এর সুফল সাধারণ নাগরিক জীবন যাপনকালে মানুষের পক্ষে অসম্ভব বলে যতগুলো ব্যাপার থাকে, সামরিক-প্রশিক্ষণ শেষে সেগুলোর সংখ্যা বহুলাংশে কমে আসে। আবেগের ফুলঝুরি চূর্ণ করে পুরোপুরি নিষ্ঠুর বাস্তবের কাছাকাছি সে পৌঁছে যায়।

কোনকিছুকে চট করে সে অসম্ভব ভাবতে পারে না। মাতৃভূমি রক্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এদের রক্তে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সাধারণ মানুষের চেয়ে এদেরকে অনেক বেশি কর্মক্ষম করে। গড়ে তোলার জন্যই যাবতীয় পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন, ডিফেন্স, অ্যাটাক, ওয়্যার ট্যাকটিক্স ক্লোজ কোয়ার্টার ব্যাটল ইত্যাদির পাশাপাশি ইতিহাস, ভূগোল এমনকি অর্থনীতি বিষয়েও এদেরকে পাঠ নিতে হয়। এছাড়া খেলাধুলা-শরীরচর্চাও বাধ্যতামূলক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে হয় বলে গড়পড়তা যে-কোন সাধারণ মানুষের চেয়ে এদের গড়পড়তা রেটিং অনেক উন্নত। মোদ্দা কথা হচ্ছে এহেন বহুমুখী ও অক্লান্ত চেষ্টার মাধ্যমে যেন এক একটা মূল্যবান প্রতিভা সৃষ্টি করা হয়-যারা প্রয়োজনে জুতো সেলাই থেকে মানুষ খুন সবই অবলীলাক্রমে করতে পারবে।

আর এই শেখা, জানা ও পারার ব্যাপারটা এত ব্যাপক যে প্রথম থেকে শক্ত পাল্লায় না পড়লে সারাজীবন ধরেও বোধহয় তা আয়ত্ত হবে না। যার জন্য প্রথম পর্যায়ে করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এই বোধ জাগানোর প্রচেষ্টা করা হয়। সেখানে কেন জাতীয় কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। পরবর্তীতে চলে অনুশীলন, এবং বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রশিক্ষণ, অনুশীলন বা প্রয়োগ কোন ক্ষেত্রেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে বলা হয় মা–দুঃসাধ্যকে সাধন করতে বলা হয়। আর তাতে নির্দ্বিধায় প্রবৃত্ত হওয়ার প্রশিক্ষণও ইতোপূর্বেই তারা পেয়ে থাকে। এখানেই একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের পার্থক্য।

আর সবার সঙ্গে আনোয়ারের সময়গুলোও একই ধারায় বইছিল।

<

Super User