লাইট হাউজ – জুল ভার্ন – রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী

জুল ভার্ন। ইতিহাস, ভূগোল ও বিশেষ করে বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে, তার সাথে অপূর্ব কল্পনার রঙ মিশিয়ে আশ্চর্য সব রোমাঞ্চ-কাহিনী রচনা করে গেছেন জুল ভার্ন। ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন, টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী, ফ্রম দি আর্থ টু দ্য মুন, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্লড ইন এইটি ডেজ, জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দি আর্থ, মিষ্টিরিয়াস আইল্যান্ড, ইত্যাদি অমর সৃষ্টি তাকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কাহিনীর রস ও আমেজ কোনভাবে ক্ষুণ্ণ না করে বিশালাকার মূল রচনাগুলোকে কিছুটা সংক্ষেপ করে রূপান্তরিত করা হয়েছে বাংলায়।

১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের বিষ্কে উপসাগরের ফায়ে দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন জুল ভার্ন। মারা যান ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ। ভিক্টর হুগো প্রভৃতি অমর সাহিত্যিকদের যে সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর জন্য ফ্রেঞ্চ আকাঁদেমি সেই একই সম্মানে ভূষিত করেছিল জুল ভার্নকে।

.

০১.

পশ্চিমের সারি সারি পাহাড়গুলো কালো পর্দার মত ঢেকে রেখেছে আকাশটাকে। যাই যাই করছে সূর্য, এই ডোবে এই ডুবল অবস্থা। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে শেষ বিকেলের আলো। একেবারে শান্ত আবহাওয়া, এদিকে এমনটি সাধারণত দেখা যায় না। পুব আর উত্তর-পুব দিকে তাকালে আকাশ ও সমুদ্রকে আলাদাভাবে চেনা যাবে না, মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে-অন্তত দূর থেকে খালি চোখে দেখলে তাই মনে হবে। শেষ মুহূর্তের কমলা রোদ এখন শুধু ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলোর গায়েই লেগে আছে, তবে সমুদ্রের গাঢ় নীল পানিতে সেই রঙ ঝিকমিক করছে সারাক্ষণ।

সবগুলো নোঙর ফেলে ইগোর উপসাগরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সান্তা ফে। উত্তর মেক্সিকোর বিখ্যাত শহর সান্তা ফে, ওই শহরের নামেই নাম রাখা হয়েছে জাহাজটার।

জাহাজের ডেক থেকে হঠাৎ পিলে চমকানো শব্দে গর্জে উঠল একটা কামান। পরমুহূর্তে দেখা গেল আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা তরতর করে মাস্তুলের মাথায় উঠে যাচ্ছে। খোলা সাগরের বাতাস পেয়ে পতপত করে উড়তে লাগল সেটা। পরক্ষণে, যেন সাড়া দেয়ার জন্যে তৈরিই ছিল, বাতিঘর থেকে একটা রাইফেল গর্জে উঠল। গুলির শব্দ আসলে একটা সঙ্কেত, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আলোর একটা চোখ-ধাঁধানো ছটা পিছলে পড়ল ইগোর উপসাগরের পানিতে।

বাতিঘরের দুজন রক্ষী সৈকতে এসে দাঁড়াল। জাহাজ থেকে ওদেরকে দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে অভিনন্দন জানাল একজন নাবিক।

রাইফেলের আরও একজোড়া শব্দ স্টাটেন আইল্যান্ডের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করে দিল। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে সেই আওয়াজ আরও জোরাল হয়ে ফিরে আসছে।

কোথায় এই স্টাটেন আইল্যান্ড?

যেখানে দুই মহাসাগর এক হয়ে মিশেছে, আটলান্টিক আর প্যাসিফিক মহাসাগর যেখানে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আছে–হ্যাঁ, সেখানেই সবুজ অরণ্যসমৃদ্ধ মাথাটা তুলে সূর্যকে অভিবাদন জানায় স্টাটেন আইল্যান্ড।

কামান ও রাইফেলের আওয়াজ ইতিমধ্যে থেমেছে। স্টাটেন আইল্যান্ডে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল। দ্বীপটায় রক্ষী ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু ওদেরকেই বহাল করা হয়েছে কাজে। সংখ্যায় ওরা মাত্র তিনজন।

একজন এই মুহূর্তে বাতিঘরের টাওয়ারে কাজ করছে। বাকি দুজনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সৈকতে। অলস পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে তারা।

দুজনের মধ্যে একজনের বয়স কম। সে-ই কথা বলছে, সত্যি তাহলে কালকেই সান্তা কে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে? তুমি ঠিক জানো তো, বাসকেথ?

হ্যাঁ, ঠিক জানি, ফিলিপ, উত্তর দিল বাসকেথ। এসো, আমরা প্রার্থনা করি সান্তা ফে যাতে নিরাপদে দেশে ফিরতে পারে।

হ্যাঁ, অবশ্যই! মনটা খারাপ, তবু সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল ফিলিপ।

হ্যাঁ, শুধু প্রার্থনা আর আশাই করতে পারে ওরা। সান্তা ফে সত্যি সত্যি বুয়েনস আইরেসে ফিরতে পারবে এ-কথা ফিলিপ বা বাসকেথের পক্ষে জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা নির্ভর করে প্রকৃতি আর ভাগ্যের মর্জির ওপর। সমুদ্র যদি খেপে ওঠে, সান্তা ফে আশ্রয় নেবে কোথায়? টিয়েরা ডেল ফুয়েগো থেকে শুরু করে পাতাগোরিয়া পর্যন্ত উপকূলের কোথাও নিরাপদ এমন কোন জায়গা নেই যে সমুদ্রে ঝড় উঠলে কোন জাহাজ আশ্রয় পাবার জন্যে নোঙর ফেলতে পারে। ম্যাগেলান প্রণালীর এদিকটায় সামুদ্রিক তুফান শুধু যে ঘন ঘন আঘাত হানে তা নয়, তাণ্ডব সৃষ্টিতেও তার জুড়ি মেলা ভার। নাবিকরা এই জলপথটাকে নানা কারণেই সাংঘাতিক ভয় পায়। বেয়াড়া সমুদ্র প্রায়ই অসহায় জাহাজকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। ভাগ্য ভাল হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গন্তব্য থেকে অনেক দূরে চলে যায় ক্যাপটেন। আর ভাগ্য খারাপ হলে অন্তরীপ প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে সোজা পাতালে নেমে যেতে হয়। এভাবে কত জাহাজ যে ডুবেছে, তার কোন লেখাজোখা নেই। তবে এতকাল পর সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।

স্টাটেন আইল্যান্ডে এখন বাতিঘর বসানো হয়েছে। এই বাতিঘরের আলো জাহাজগুলোকে পথ দেখাবে, সঙ্কেত দিয়ে জানাবে কোন্ দিকে কি বিপদ আছে। আশা করা যায় যতই ঝড় তুফান উঠুক, বাতিঘরের আলো আর নিভবে না। জাহাজের ক্যাপটেনরা শুধু যে দুর্যোগকে ভয় পায় তা নয়, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতকেও একই রকম ভয় পায় তারা। অন্ধকার রাতেই তো তিনটে অন্তরীপের দিকে যাবার পথ মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে এগুলো হলো সান হুয়ান অন্তরীপ, সান দিয়েগো অন্তরীপ আর ফালোস অন্তরীপ। অন্ধকার রাতে এগুলো এক একটা মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠে। বাতিঘরের আলো সেই মৃত্যুফাঁদ থেকে রক্ষা করবে জাহাজগুলোকে।

স্টাটেন আইল্যান্ডে কোন মানুষজন নেই। অথচ এই দ্বীপে ওদেরকে তিন মাস একটানা কাটাতে হবে। ব্যাপারটা যখন প্রথম ভালভাবে উপলব্ধি করল ফিলিপ, তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এই নব্বই দিন সভ্য-জগতের সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্কই থাকবে না। তিন মাস পর আরও তিনজন নতুন আলোকরক্ষী আসবে, বাতিঘরের সমস্ত দায়িত্ব ওদের কাছ থেকে বুঝে নেবে তারা। তার আগে এই কারাগার থেকে ওদের মুক্তি নেই।

কোন জাহাজে দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া তেমন কঠিন কিছু নয়, কারণ সেখানে আরও অনেক নাবিক ও কু আছে, জাহাজটাও সচল, কিছু দিন পরপর একটা করে নতুন বন্দরে ভিড়ছে। কিন্তু নির্জন এই স্টাটেন দ্বীপটাকে জেলখানাই বলতে হবে, কারণ ইচ্ছা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে এখান থেকে চলে যাবার কোন উপায় নেই। ফিলিপ যখন চাকরির জন্যে আবেদন করেছিল, এদিকটা এভাবে ভেবে দেখেনি। চাকরি নিয়ে দ্বীপে আসার পর পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার মন খারাপ হয়ে গেছে।

ফিলিপের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাসকেথ তাকে নানাভাবে খুশি রাখার চেষ্টা করছে। আরে, মাত্র তো তিনটে মাস, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া, আমরা যে সুযোগ পেয়েছি, ভেবে দেখো, এমন সুযোগ কজন পায়? ঝড়-তুফানে পড়ে মানুষ এখানে প্রাণ হারাচ্ছে। আমরা তাদেরকে আলো ফেলে পথ দেখাব, সাবধান করে দেব। এটাকে তোমার একটা মহৎ কাজ বলে মনে হচ্ছে না?

ফিলিপ ম্লান একটু হাসল শুধু, মুখ খুলল না।

দেখো, ফিলিপ, আজ চল্লিশ বছর হতে চলল সমুদ্রকেই আমি ঘর বানিয়েছি। একটা নয়, বহু জাহাজে চাকরি করেছি আমি। কোনটায় কেবিন বয় ছিলাম, কোনটায় কুক। দিনে দিনে আমার উন্নতিও হয়েছে। এক সময় নাবিক হই। তারপর অফিসার। দুনিয়ার সব সাগরই দেখা হয়েছে। এমন কোন বন্দর প্রায় নেই বললেই চলে যেখানে আমার যাওয়া হয়নি। এখন যদি বলি যে আমার অবসর নেয়ার সময় হয়েছে, খুব একটা ভুল হবে কি? অথচ কাজ ছাড়া আমি বাঁচব না। কিন্তু বুড়ো হলে কে আর কাকে কাজ দেয়, বলো? অগত্যা বাতিঘরের রক্ষীর চাকরির জন্যেই আমি আবেদন করি। এটা হলো একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, ফিলিপ। অনেকেই এই কাজটাকে ছোট মনে করতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, এটা একটা অতি মহৎ কাজ। তাছাড়া, এটাকে তুমি কিন্তু সাধারণ কোন বাতিঘর বলে ভুল কোরো না! জানোই তো, এই বাতিঘর দুনিয়ার শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে আছে।  

বাসকেথের কথা কান পেতেই শুনছে ফিলিপ। কিন্তু মনটা তার কোনমতে ভাল হচ্ছে না। বাস্কৈথের পিছু পিছু বাতিঘরে ফিরে এল সে।

সেই প্রাচীন কাল থেকেই লোকে বলে আসছে, প্রশান্ত মহাসাগরের জোয়ার নাকি তেমন জোরালো নয়। কথাটা যদি সত্যি হয়ও, আংশিক সত্যি হবারই বেশি সম্ভাবনা। বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে নির্দিষ্ট একটা এলাকার জোয়ার একটু কম শক্তিশালী হতেই পারে। তবে কথাটা বিশেষ একটা ক্ষেত্রে যে সত্যি নয়, এটা প্রমাণ সহ নিঃসংশয়ে বলা যায়। আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর যেখানে মিলিত হয়েছে, অর্থাৎ দুই মহাসাগরের সংযোগস্থল সারাক্ষণই প্রচণ্ড খেপে থাকে, আর জোয়ারের সময় তো রীতিমত প্রলয়ংকরী হয়ে ওঠে। সমুদ্র সেখানে অনবরত গর্জন করছে, ঢেউয়ের দাপটে ধারে কাছে কোন জাহাজ ঘেঁষতেই পারে না। দুই মহাসাগরের বিপুল জলরাশি এমন ভয়াবহ আলোড়ন তোলে, তার প্রভাবে সেই বহুদূর ম্যাগেলান প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত পানিপথও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

সান্তা ফে আর্জেন্টিনা নৌবাহিনীর জলযান। জাহাজটাকে শক্তি যোগায় একশো ষাট হর্সপাওয়ার। সান্তা ফে দুশো টন কার্গো বহন করতে পারে।

জাহাজের ক্যাপটেন লাফায়েত। লেফটেন্যান্ট-এর নাম রিগাল। নাবিক আর ক্রুর সংখ্যা পঞ্চাশ। সান্তা ফের কাজ হলো রিও ডে লা প্লাতার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে লেময়র প্রণালীর শেষ মাথা পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগরে নজর রাখা। আমাদের এই গল্প এমন এক সময়ের, যখন ক্রুজার বা টর্পেডো-বোট অর্থাৎ দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজ আবিষ্কৃত হয়নি। সান্তা ফের গতিসীমা ঘন্টায় নয় মাইল, সে-সময় এই গতিই প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হত।

কাহিনীর শুরু সে বছরের গোড়ার দিকে। আর্জেন্টিনা সরকার সান্তা ফের ক্যাপটেনকে একটা কাজ দিল। লেময়র প্রণালীর প্রবেশমুখ স্টাটেন আইল্যান্ডে একটা বাতিঘর তৈরি করা হবে, কাজটার প্রস্তুতি পর্বের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে লাফায়েতকে।

সেই থেকে লোকজন, যন্ত্রপাতি, মাল-মশলা ইত্যাদি যা যা একটা বাতিঘর তৈরি করতে লাগে সবই স্টাটেন আইল্যান্ডে এনেছে সান্তা ফে। ক্যাপটেন লাফায়েত দক্ষ নাবিক, মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত সাহসী, উত্তাল সাগর ঘন ঘন পাড়ি দিতে তার বুক কাঁপেনি। তবে আসা-যাওয়া করার সময় প্রায় প্রতিবারই মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে। জাহাজ ও মাঝি-মাল্লা সহ আজও যে তিনি বেঁচে আছেন, বলা যায় তা স্রেফ ভাগ্যেরই জোরে।

বাতিঘরটার নকশা তৈরি করেছেন বুয়েনস আইরেসের নাম করা একজন ডিজাইনার। বছরের শেষ দিকে, অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে বাতিঘর তৈরির কাজ সুষ্ঠুভাবেই শেষ হয়েছে। আজ প্রায় তিন হপ্তা হতে চলল শেষবার ইগোর উপসাগরে নোঙর ফেলেছে সান্তা ফে। ইতিমধ্যে চারমাসের উপযোগী রসদ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস বাতিঘরের স্টোরে জমা করা হয়েছে। ক্যাপটেন লাফায়েত নিশ্চিত হয়েছেন, বাতিঘরের তিনজন রক্ষী আগামী তিন মাস কোন জিনিসের অভাব বোধ করবে না। সম্ভাব্য যা কিছু দরকার হবে তাদের, সবই ভরা হয়েছে স্টোরে। সব কাজ শেষ। এবার স্টাটেন আইল্যান্ড ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

দুনিয়ার শেষ প্রান্তের এই বাতিঘরে রক্ষী হিসেবে চাকরি পাবার জন্যে বহু লোক আবেদন করেছিল। ইন্টারভিউয়ে টিকে গেছে তিনজন-বাসকেথ, ফিলিপ আর মরিস। আর্জেন্টিনা সরকার এই তিনজনকেই যোগ্য রক্ষী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি-এই তিনমাস বাতিঘর পাহারা দেবে তারা। মার্চ মাসে আবার ফিরে আসবে সান্তা ফে, সঙ্গে থাকবে তিনজন নতুন রক্ষী। তারা এসে ওদের তিনজনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবে। বাসকেথ, ফিলিপ আর মরিস ফিরে যাবে দেশে।

মিনারের নিচে রক্ষীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওদের কোয়ার্টার অত্যন্ত শক্ত কংক্রিটের পুরু দেয়াল দিয়ে মোড়া, ঝড় বা জলোচ্ছাসে যাতে কোন ক্ষতি না হয়। বসবাসের এই জায়গা আর মিনারে ওঠার সিঁড়ির মাঝখানে একটা বারান্দা আছে। সিঁড়িতে ওঠার দরজা ওই বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে। আলোকস্তম্ভটি সিঁড়ির মাথায়।

সিঁড়িটা সরু ও প্যাঁচানো। দেয়ালে প্রথমে গর্ত করা হয়েছে, গর্তগুলোয় বসানো হয়েছে পাথরের ধাপ, গাঁথনি অত্যন্ত মজবুত। সিঁড়িতে আলোর ব্যবস্থাও আছে। ছোট ছোট জানালা রাখা হয়েছে, ওগুলো দিয়ে প্রচুর আলো ঢোকে ভেতরে। বাতিঘরের একটা কামরাকে শুধু লুকআউট হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সেখানে লণ্ঠনের আতস কাঁচ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সব একেবারে নতুন, ঝকঝক করছে। গ্যালারিটা দেয়ালের গা ঘেঁষে। ওই গ্যালারিতে বসে চারদিকের সমুদ্রে নজর রাখা হবে। আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখা হয়নি। এটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বাতিঘর, বাইরের কোন সাহায্য ছাড়াই তিনমাস নিশ্চিন্ত মনে কাটিয়ে দিতে পারবে রক্ষীরা।

পরদিন সকাল থেকে সান্তা ফেতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বিকেলে জাহাজ ছাড়বে, তাই এই ব্যস্ততা। লেফটেন্যান্ট রিগালকে সঙ্গে নিয়ে তীরে নামলেন ক্যাপটেন লাফায়েত, শেষ বারের মত সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলেন। কাল যখন সান্তা ফের ডেক থেকে কামান দাগা হলো তখনই প্রথমবারের মত জ্বলে উঠেছিল বাতিঘরের আলো। বাসকেথকে ডেকে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেন লাফায়েত। না; লণ্ঠন ঠিকমতই কাজ করেছে, কাজেই চিন্তার কোন কারণ নেই। জাহাজ নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে স্টাটেন আইল্যান্ড ত্যাগ করতে পারেন তিনি।

রক্ষীদের কাজ মোটেও সহজ হবে না। পরিত্যক্ত ও নির্জন একটা দ্বীপে দিনের পর দিন বাস করতে হলে মনের ওপর একটা চাপ পড়বেই। চোখের সামনে সারাক্ষণ ভেসে উঠবে প্রিয়জনদের মুখ। বন্ধুদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দিনগুলো বিষাদে ভরে উঠবে। কাজ হয়ে উঠবে একঘেয়ে।

তবে তিনজনই ওরা সহনশীল ও দক্ষ, সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও প্রচুর। বাতিঘর পাহারা দেয়ার এই চাকরি তারা স্বেচ্ছায় নিয়েছে। একে একে অনেক জাহাজে কাজ করেছে তারা, দেহে-মনে ক্লান্তিও কম জমেনি, হয়তো সেজন্যেই কটা মাস বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এই চাকরি নিয়ে চলে আসা। বাতিঘরের কাজ খুব বেশি নয়, আবার হালকাও বটে। রুটিন-বাঁধা কাজ, কোনরকম ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। জাহাজের কাজ কিন্তু ঠিক তার উল্টো, সেখানে প্রতিটি কাজ দ্রুত ও ব্যস্ততার সঙ্গে সারতে হয়। জাহাজে কাজ করে অভ্যস্ত, তাই হয়তো বাতিঘরের কাজ ওদের কাছে আরও হালকা লাগবে, বলতে গেলে বিশ্রামই নেয়া হবে। তাছাড়া, চাকরি তো মাত্র তিন মাসের। দেখতে দেখতে দিনগুলো পার হয়ে যাবে।

বিদায় নেয়ার আগে রক্ষীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন লাফায়েত। সবশেষে উৎসাহ দিয়ে বললেন, তারা একটা মহৎ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, সেজন্যে দেশবাসী তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

বিকেলে তিন আলোকরক্ষী সৈকতে এসে দাঁড়াল। সান্তা ফে নোঙর তুলে রওনা হবে এখন। জাহাজটা চলে যাবার পর স্টাটেন আইল্যান্ডে থাকবে শুধু রাসূকেথ, ফিলিপ আর মরিস। সৈকতে দাঁড়িয়ে তিনজনই ওরা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল নাবিকদের দিকে, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে জাহাজের ডেকে তারা সবাই খুব ব্যস্ত।

বিকেল ঠিক পাঁচটায় জ্যান্ত হয়ে উঠল সান্তা ফের বয়লার। চোঙ থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে কালো ধোয়া। বাতালে ছড়িয়ে পড়ল তীক্ষ্ণ বাঁশির আওয়াজ। সেই আওয়াজ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বারবার প্রতিধ্বনি তুলল।

জোয়ার এখনও তেমন প্রবল নয়। খানিক অপেক্ষা করতে হলো। তারপর যখন জোয়ারের তোড়ে সৈকতের কাছে ফুলে কেঁপে উঠল পানি, সান্তা ফের সবগুলো নোঙর একে একে তুলে ফেলা হলো।

পৌনে ছটায় এঞ্জিনম্যানকে নির্দেশ দিলেন ক্যাপটেন লাফায়েত, তৈরি হও।

সান্তা ফের এঞ্জিন চালু হলো। লেফটেন্যান্ট রিগাল একবার দেখে এলেন অপারেটর প্রস্তুত হয়েছে কিনা।

সান্তা ফে নড়ে উঠল।

সৈকতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাল তিন রক্ষী। বাসকেথের মনে এখন কি চলছে, চেহারা দেখে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তবে তার দুই সহকারীকে রীতিমত বিচলিত দেখাল। সান্তা ফের নাবিক আর ক্রুরাও মনমরা হয়ে আছে, দুনিয়ার শেষপ্রান্তে এত বড় একটা জনশূন্য দ্বীপে তিনজনকে ফেলে রেখে চলে যেতে হচ্ছে বলে।

রওনা হয়ে গেল জাহাজটা। ইগোর উপকূলের উত্তর-পশ্চিম তীর ধরে এগোচ্ছে সান্তা ফে, গতি স্বাভাবিক। খোলা পানিতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেল। সামনে পড়ল সান হুয়ান অন্তরীপ, সেটাকে পাশ কাটাতে কোন অসুবিধে হলো না। পিছনে পড়ল প্রণালীটা, তারপরই জাহাজের গতি বেড়ে গেল, ফুলস্পীডে ছুটছে। সারাদিন ছুটল সান্তা ফে, তারপর যখন আলকাতরার মত কালো রাত নামল, ডেক থেকে স্টাটেন আইল্যান্ডের বাতিঘরের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। দিগন্তের শেষ প্রান্তে খুদে একটা উজ্জ্বল তারার মত লাগল বাতিঘরটাকে।

ইতিমধ্যে সৈকত থেকে বাতিঘরের ভেতর ফিরে এসেছে রক্ষীরা। সবাই চুপচাপ, বিষণ্ণ। ওরা একা হয়ে গেছে, সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, মন খারাপের সেটাই কারণ।

এই দ্বীপে সাংঘাতিক একটা বিপদ ও পেতে আছে, কিন্তু সেই বিপদ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ এখনও কিছু জানে না ওরা।

স্টাটেন আইল্যান্ডকে অনেক সময় স্টাটেন ল্যান্ডও বলা হয়। দ্বীপটা আমেরিকার একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম বিন্দুতে অবস্থিত, দুটো মহাসাগরের উচ্ছ্বসিত পানিতে অবগাহন করছে। কেইপ হর্ন অন্তরীপ ঘুরে যে-সব জাহাজ আসা-যাওয়া করে ওগুলোর ডেক থেকে স্টাটেন আইল্যান্ডকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত দেখায়। এদিকে মেয়র নামে একটা প্রণালী আছে-প্রণালীটা টিয়েরা ডেল ফুয়েগো থেকে স্টাটেন আইল্যান্ডকে আলাদা করে রেখেছে। টিয়েরা ডেল ফুয়েগো আর স্টাটেন আইল্যান্ডের মাঝখানে ব্যবধান, বিশ মাইল। দ্বীপের পুব দিকে রয়েছে সান অন্টারিয়ো আর কেম্প অন্তরীপ।

দ্বীপটা পুব-পশ্চিমে লম্বা-ঊনচল্লিশ মাইল। উত্তর-দক্ষিণে মাত্র এগারো মাইল। খাড়া পাহাড়গুলো আকাশ ছুঁয়েছে। গিরিখাদ আর খড়িও আছে, নাচতে নাচতে ভেতরে ঢুকে পড়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছাস। দ্বীপে গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়েরও কোন কমতি নেই। দ্বীপটাকে ঘিরে তৈরি করে রেখেছে অসংখ্য ডুবো পাহাড়। দ্বীপের আপাশে জাহাজডুবির ঘটনা সেজন্যেই খুব বেশি। এই ডুবোপাহাড়ের কারণেই শান্ত আবহাওয়াতেও দ্বীপের চারপাশে সারাক্ষণ খেপে থাকে সমুদ্র।

সমুদ্রের এই খেপামির জন্যেই দ্বীপটায় আজ পর্যন্ত কোন লোক বসতি গড়ে ওঠেনি। এখানে সবচেয়ে ভাল সময় বলতে বোঝায় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। তখন এখানে কোন রকমে বসবাস করা যেতে পারে, কারণ এই সময়টাই দক্ষিণ গোলার্ধের এই দ্বীপে গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকাল হলে কি হবে, তখনও এখানে প্রচণ্ড হাড়কাঁপানো শীত পড়ে।

দ্বীপের জঙ্গলে বেশ কিছু গুঅনাকো আছে। এগুলো এক আদিম তো কি হয়েছে, মাংস খুবই সুস্বাদু। শীতকালে পুরু বরফে ঢাকা পড়ে যায় দ্বীপটা, কিন্তু তারপরও হরিণগুলো খাবারের অভাবে মারা যায় না। বৈরি আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে ওগুলো। বরফের তলায় চাপা পড়া গাছপালার শিকড় আর পাতা খুঁজে বের করে খায়।

দ্বীপটাকে আসলে প্রকাণ্ড একটা পাথুরে টিলা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। প্রাণী বলতে এখানে শুধু আছে গুঅনাকো, কিছু পাখি আর কিছু মাছ। দ্বীপের মালিক চিলি ও আর্জেন্টিনা। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে একটা বাতিঘর তৈরি করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সব দেশের নাবিকদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছে আর্জেন্টিনা সরকার। এদিকের পানিতে জাহাজের খুব বেশি আনাগোনা, জলপথে সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকে। ঝড়-তুফানও খুব বেশি হয় এদিকটায়। সেজন্যেই সবার ধারণা, স্টাটেন আইল্যান্ডের বাতিঘর নাবিকদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে উঠবে।

দ্বীপটার মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে ঊষর মরুভূমি। তারপর থেকে বাকি দ্বীপের জমিন পাথুরে। উঁচু-নিচু, খানা-খন্দে ভরা, এখানে, সেখানে হাঁ করে আছে গভীর গর্ত। আর আছে ছোট-বড় টিলা। এই দ্বীপের জন্ম আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ থেকে। পুবদিকটা অন্তরীপের মত বিস্তৃত। পশ্চিম দিকটাও তাই-উঁচু-নিচু পাহাড়ী এলাকা। অ্যান্টার্কটিকায় যে-সব অদ্ভুত দর্শন গাছপালা দেখতে পাওয়া যায়, এখানেও তার কমতি নেই। তবে সমতল এলাকাটা দেখতে অনেকটাই তুন্দ্রা অঞ্চলের মত। শীতের সময় অবশ্য সবই তুষারে ঢাকা পড়ে যায়! ঝড়, বৃষ্টি আর তুষারপাত-এগুলো স্টাটেন আইল্যান্ডের নিত্যসঙ্গী।

খাড়া পাহাড় শুরু হয়েছে একেবারে তীর থেকেই। এখানে কোন নদী বা ঝর্ণা নেই। গরমের দিনে রোদের তাপে বরফ গলে, সেই বরফগলা পানি এখানে সেখানে জমা হয়, তৈরি হয় ছোটখাট ঝিল। বাতিঘর তৈরি হবার পর দেখা গেল ওই ঝিলের পানি টিলাগুলোর গা বেয়ে নেমে আসছে নিচে, তারপর মিলিত হচ্ছে ইগোর উপসাগরের নীল সাগরজলে।

স্টাটেন দ্বীপ এখন শান্ত। এই মুহূর্তে কোন ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, তুষারপাত নেই। কিন্তু তবু দ্বীপটা তিন রক্ষীদের জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়। এখানে একদল নিষ্ঠুর খুনী আস্তানা গেড়েছে। পৃথিবীর শেষ কিনারায়, বসবাসের অযোগ্য এই দ্বীপটাকে নিজেদের জন্যে নিরাপদ বলে মনে করেছে তারা। ওদের পেশাই হলো মানুষ খুন আর লুঠপাট করা।

ওরা একদল জলদস্যু।

.

০২.

সান্তা কে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর দিন কয়েক কিছুই ঘটল না। চমৎকার আবহাওয়া, তাপমাত্রাও খুব একটা নামছে না। সকাল থেকে সন্ধের আগে পর্যন্ত রোদ পাওয়া যাচ্ছে। বাতাস আছে, তবে অস্থির নয়। খুবই উপভোগ্য পরিবেশ। শুধু সন্ধের পর সামান্য শীত শীত লাগে।

বাতিঘরের চারপাশে মখমলের মত সবুজ ঘাস গজিয়েছে। ঝিলের পানিতে সাগরের দিকে নেমে যাবার টান। সোনালি দিনগুলো ভারি মিষ্টি।

সেদিন সন্ধ্যালগ্ন, বাতিঘরের আলো জ্বালবার সময়। বাতিটার সামনে বৃত্তাকার গ্যালারির কথা আগেই বলা হয়েছে, সেখানে বসে গল্প করছে ওরা তিনজন। বলাই বাহুল্য, ওরা তিনজন মানে বাসকেথ, ফিলিপ আর মরিস।

টোবাকো পাউচ থেকে তামাক বের করে পাইপে ভরছে বাসকেথ। সহকারীদের প্রশ্ন করল, বেশ কটা দিন তো কাটল, তাই না? এবার বলো দেখি, নতুন দ্বীপে কেমন লাগছে তোমাদের? সয়ে আসছে তো?

এত তাড়াতাড়ি কি একঘেয়ে লাগে! জবাব দিল ফিলিপ। আরও কিছুদিন যাক, তখন বুঝতে পারব। এই কদিন তো ভালই কাটল। কোন ঝুট-ঝামেলা নেই, শান্তিতে আছি।  

একদম আমার মনের কথা বলেছ,  তাকে সমর্থন করল মরিস। সত্যি বড় শান্তি লাগছে। যাকে বলে নিশ্চিন্ত মনে সময় কাটানো। তিনটে মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

দিগন্তে যখন কোন জাহাজের পাল অদৃশ্য হয়ে যায়, মনে হয় আমাদের অজান্তেই ঘটনাটা ঘটে গেল,  বলল বাসকেথ। এখানে আমাদের দিনগুলোও সেভাবে পার হয়ে যাবে, দেখো।

দিগন্ত আর জাহাজের কথা যখন উঠলই, প্রশ্নটা না করে পারছি না,  বলল ফিলিপ। এই কদিন আমরা কোন জাহাজ দেখিনি কেন? সবাই বলে এদিক দিয়ে নাকি প্রচুর জাহাজ আসা যাওয়া করে, বাতিঘরটা বানানোও হয়েছে সে-কারণে। কিন্তু কই, কোন জাহাজই তো চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা কি বলো তো?  

একটু ধৈর্য ধরো,  আশ্বাস দেয়ার সুরে বলল বাসকেথ। খুব শিগগিরই জাহাজ দেখতে পাবে। চারপাশের দশ মাইল সাগরকে আলোকিত করতে পারবে আমাদের এই বাতিঘর, তা কি শুধু শুধু তৈরি করা হয়েছে? আসলে, জিনিসটা এখনও একেবারে নতুন যে! আরও কিছুদিন গেলে মানুষজন জানতে পারবে যে এখানে একটা বাতিঘর আছে। তখন আর ঘুরপথে কেউ যাবে না, এদিকের সোজা পথ ধরে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইবে। তখন আমরা দ্বীপের পাশ ঘেঁষে সারি সারি অনেক জাহাজ চলতে দেখব। আরেকটা কথা ভাবতে হবে। বাতিঘর থাকার কথাটা জানাই যথেষ্ট নয়, এটা ভোর পর্যন্ত আলো ছড়ায় কিনা তা-ও লোককে জানতে হবে।

কিন্তু সে-কথা লোকজনকে জানাবার উপায় কি? এক শুধু সান্তা ফের লোকজনই খবরটা ছড়াতে পারে। তারমানে অপেক্ষা করতে হবে। সান্তা ফে আগে বুয়েনস আইরেসে পৌঁছাক তো।

হ্যাঁ, একটু তো সময় লাগবেই,  বলল বাসকেথ। ক্যাপটেন লাফায়েতের রিপোর্ট পাওয়া মাত্র নৌ-বাহিনীর কর্তারা জাহাজ। কোম্পানিগুলোকে খবরটা জানিয়ে দেবেন।

কিন্তু সান্তা ফে রওনাই তো হয়েছে মাত্র ছয়দিন আগে, বলল মরিস। বন্দরে পৌঁছতে এখনও অনেক দেরি

মাথা নাড়ল বাসকেথ। অনেক দেরি বুলছ কেন। আর হয়তো হপ্তাখানেক লাগতে পারে। তেমন জোরালো বাতাস নেই, সমুদ্রও শান্ত। পাল আর এঞ্জিন মিলে পুরোদমে চালালে সাতদিনের বেশি লাগার কথা নয়।

এতক্ষণে জাহাজটা নিশ্চয়ই ম্যাগেলান প্রণালী ছাড়িয়ে গেছে, বলল ফিলিপ।

আমারও তাই ধারণা, সায় দিল বাসকেথ। এখন সম্ভবত পাতাগোনিয়ার তীর ধরে ছুটছে।

স্বদেশের জাহাজ ওদেরকে এখানে ফেলে স্বদেশেই ফিরে যাচ্ছে, স্বভাবতই এত তাড়াতাড়ি সেটার কথা ওদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কথা উঠলেই সান্তা ফে প্রসঙ্গ ফিরে আসছে।

বাসকেথ হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। কি হে, ফিলিপ, আজ তোমার মাছ ধরাটা কেমন হলো বললে না তো!

ভালই মাছ পেয়েছি,  বলল ফিলিপ। তবে আশ্চর্য কি জানো? খালি হাতেই একটা কাছিমের ছানা ধরেছি আজ। প্রায় সের দেড়েক ওজন হবে। ধরতে পারলাম পানি ছেড়ে বালির ওপর উঠে আসায়।

বাহ্‌, দারুণ!  উৎসাহ দিয়ে বলল বাসকেথ। তবে তাড়াহুড়ো করে খুব বেশি মাছ বা কাছিম ধরতে যেয়ো না… সমুদ্রে ওগুলো এত বেশি আছে যে যতই ধরো কোনদিন ফুরাবে না। যতটা প্রয়োজন তার বেশি ধরবে না। শুধু লক্ষ রাখবে আমাদের টিনে ভরা মাংস যাতে কম খরচ হয়। বোঝা যাচ্ছে আমিষের কোন অভাব হবে না, কিন্তু শাক-সবজির কি ব্যবস্থা করা যায় বলো দেখি।  

আজ আমি জঙ্গলের দিকটায় গিয়েছিলাম,  বলল মরিস। মাটি খুঁড়ে নরম কিছু শিকড় এনেছি, প্লেট ভরে খেতে দেব। একবার খেলে তোমরা কেউ ভুলতে পারবে না।

বাহ্, দারুণ, তাকেও উৎসাহ দিল বাসকেথ। হোক শিকড়, টাটকা জিনিস তো, খেতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। টিনের খাবার তো অগত্যা নিরুপায় হয়ে খাওয়া।  

ফিলিপ খেদ প্রকাশ করে বলল, ইস্, যদি দুএকটা গুঅনাকো শিকার করতে পারতাম!

সুস্বাদু ঝোল টানার অনুকরণে মুখের ভেতর একটা আওয়াজ করল বাসকেথ। খবরদার, , তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি! প্রথমে গুনাকো শিকার করো, তারপর সেটা রান্না করো, তারপর আমার সামনে পরিবেশন করো–তার আগে ওই নাম আমার সামনে উচ্চারণ পর্যন্ত কোরো না! জানো, গুঅনাকোর কথা তুলে আমার তুমি কি ক্ষতি করেছ? এরইমধ্যে আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেছে!

তার কথা শুনে ফিলিপ আর মরিস গলা ছেড়ে হেসে উঠল বাসকেথ তারপর বলল, তবে মনে রেখো, সব সময় বাতিঘরের আশপাশে থাকবে, বেশি দূরে যাবে না। শিকার করে বেড়ানো আমাদের কাজ নয়। আমরা এখানে বাতিঘরের আলো জ্বেলে রাখতে এসেছি। আমাদের কাজ সাগরের ওপর নজর রাখা।

মরিস আসলে জাত শিকারী। শিকার করা তার সাংঘাতিক একটা নেশা। কিন্তু ভেবে দেখো, বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে নাদুসনুদুস একটা গুঅনাকোর মাথা দেখা গেল…।

আমি তো শিকার করতে নিষেধ করছি না,  বলল বাসকেথ। শুধু বলছি অহেতুক কোন ঝুঁকি নেবে না। আমি যতদূর জানি, এই হরিণগুলো ভীষণ পাজি টাইপের হয়। শিং দেখলেই তো বোঝা যায়, ভারী বিপজ্জনক।

.

ষোলোই ডিসেম্বর। রাত ছটা থেকে দশটা পর্যন্ত বাতিঘরের আলো জ্বেলে রাখার দায়িত্ব পড়েছে মরিসের ওপর। আলো জ্বেলে সমুদ্রের ওপর নজর রাখছে সে। হঠাৎ পাঁচ-ছয় মাইল পুবে একটা আলো দেখা গেল। নিশ্চয়ই কোন জাহাজেরই আলো হবে। উত্সাহ আর উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠল মরিস। বাতিঘর তৈরি হবার পর স্টাটেন আইল্যান্ড থেকে আজ এই প্রথম কোন জাহাজ দেখা যাচ্ছে।

বাসকেথ আর ফিলিপ অন্য ঘরে বসে গল্প করছে। মরিস সিদ্ধান্ত নিল, তাদেরকেও খবরটা জানানো দরকার। ওরা দায়িত্ব নেয়ার পর এই প্রথম একটা জাহাজের দেখা পাওয়া গেল, এত বড় একটা সুখবর চেপে রাখে কিভাবে! তাড়াতাড়ি ওদেরকে ডাকতে চলে এল সে। খবরটা শুনে ওরা দুজনও উত্তেজিত হয়ে পড়ল, ছুটে লুকআউটে চলে এল তখুনি। পুবদিকের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে টেলিস্কোপে চোখ লাগাল তিনজনই।

বেশ কিছুক্ষণ আলোটা পরীক্ষা করে বাসকেথ বলল, সাদা আলোর অর্থ বোঝো তো? কোন স্টীমারের সামনের দিকের আলো ওটা।

স্টীমারটি দ্রুতবেগে সান হুয়ান অন্তরীপের দিকে ছুটে আসছে। পরবর্তী আধ ঘণ্টার মধ্যে ওটার গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেল ওরা। বাতিঘরকে দক্ষিণ-পশ্চিমে রেখে লেময়র প্রণালীতে ঢুকেছে ওটা। আরও খানিক পর স্টীমারের লাল আলো দেখতে পাওয়া গেল। এক সময় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেটা অন্ধকারে।

আমাদের বাতিঘর দুনিয়ার শেষ মাথায়, তার আওতার মধ্যে ওই জাহাজটাই প্রথম এল, মন্তব্য করল ফিলিপ।

হ্যাঁ,  বলল বাসকেথ। আশা করি ওটাই শেষ জাহাজ নয়।

পরদিন বিকেলের দিকে বিশাল পাল তোলা একটা জাহাজ দেখা গেল দিগন্তরেখার কাছে। ফিলিপই প্রথম দেখতে পেল।

আবহাওয়া আজ শান্ত, আকাশ পরিষ্কার। মৃদু-মন্দ বাতাস বইছে। আকাশে মেঘ নেই, দ্বীপের ওপর কুয়াশাও ঝুলে নেই। জাহাজটা দশ মাইল দূরে হলেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে বাসকেথ আর মরিসের নাম ধরে হাঁক ডাক শুরু করল ফিলিপ।

সবাই তখুনি ছুটে এল বাতিঘরে, টেলিস্কোপে চোখ রেখে জাহাজটাকে দেখছে। ফুলস্পীডেই আসছে সেটা, তবে এখনও বোঝা যাচ্ছে না কোন্ দিকে যাবে-উত্তরে না দক্ষিণে। এই নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল তিনজন।

মরিসের কথা হলো, আমার ধারণা, জাহাজটা প্রণালীর দিকে আসবেই না।

দেখা গেল তার কথাই ঠিক হতে যাচ্ছে। পাল-তোলা জাহাজটা আকারে বিশাল। আন্দাজ করা হলো, কম করেও আঠারোশো টন ভার বইতে পারে। গোটা আমেরিকায় এত দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজ খুব বেশি নেই।

বাসকেথ বলল, ওটা যদি নিউ ইংল্যান্ডের জাহাজ না হয়, টেলিস্কোপের ওপর আমার আস্থা থাকবে না।

ক্যাপটেন কি তার জাহাজের নম্বরটা আমাদেরকে জানাবেন? জিজ্ঞেস করল মরিস। তোমার কি ধারণা?

রক্ষীদের প্রধান বাসকেথ বলল, জানানোই তো উচিত। এটা তার কর্তব্য।

জাহাজের ক্যাপটেন তার কর্তব্য ঠিকমতই পালন করলেন। একটু পরই দেখা গেল জাহাজের ওপর পত পত করে সিগন্যাল ফ্ল্যাগ উড়ছে। ওটার নামও জানা গেল-মনডাঙ্ক। রওনা হয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার বোস্টন বন্দর থেকে। আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের ফ্ল্যাগ উড়িয়ে ওরাও পাল্টা সংকেত দিল। ধীরে ধীরে স্টাটেন আইল্যান্ডের দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে মানাঙ্ক। এক সময় ওয়েবস্টার অন্তরীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল, ওরা তিনজন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল জাহাজটার দিকে। বিড়বিড় মরে শুভেচ্ছা জানাল বাস্কৈথ, মানডাঙ্ক, তোমার যাত্রা শুভ হোক। ঈশ্বর, তুমি মানডাঙ্ককে কেপ হর্নের ঝড়ের মধ্যে ফেলো না।

পরবর্তী কয়েক দিন আবার খালি থাকল দিগন্ত। শুধু পুবদিকে, বহু দূরে, পাল-তোলা দুএকটা..না, জাহাজ নয়, ওই শুধু পালই দেখা গেল। তারপর কিছু জাহাজকে যেতে দেখা গেল স্টাটেন আইল্যান্ডের দশ মাইল দূর দিয়ে। এই জাহাজগুলো এদিকে আসবে না বা থামবে না-বাসকেথের ধারণা, ওগুলো অ্যান্টার্কটিকায় মাছ ধরতে যাচ্ছে। আরও কিছু ছোট আকৃতির জাহাজ চোখে পড়ল, আসছে নিরক্ষরেখার ওদিক থেকে। সেগুলোও কাছাকাছি এল না। পয়েন্ট সেভারেল হয়ে, যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে হারিয়ে গেল।

বিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত খাতায় লিখে রাখার মত উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ঘটল না। আবহাওয়া একটু একটু করে বদলাচ্ছে। আগে উত্তর-পুবে বাতাস বইছিল, এখন বইছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। কয়েকটা ঝড়ও উঠল, তবে জোরালো নয় একটাও।

একুশে ডিসেম্বর সকালে মুখে পাইপ গুঁজে হাঁটাহাঁটি করছে ফিলিপ, হঠাৎ সাগরের তীর ঘেঁষা জঙ্গলে একটা জানোয়ার দেখতে পেল। পুরো দেহটা দেখেনি, শুধু তার মুখ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সচেতন হয়ে তাকিয়ে থাকার পর আর কিছু দেখতে পেল না। কয়েক মিনিট পর টেলিস্কোপ রূমে চলে এল সে। টেলিস্কোপে চোখ লাগাতে জন্তুটিকে আবার দেখতে পেল। হ্যাঁ, ওটা একটা গুঅনাকোই। ফিলিপের হাত নিশপিশ করে উঠল। গুলি করার এই সুযোগ কি ছাড়া উচিত?

গলা ছেড়ে বাসকেথ আর মরিসকে ডাকল সে। চিৎকার শুনে তখুনি ছুটে এল তারা। সব শুনে ওরাও তার সঙ্গে একমত হলো, এই সুযোগ হাতছাড়া করা চলে না। হরিণটাকে মারতে পারলে মুখের স্বাদ বদল করা যায়। টিনের খাবার খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে।

দ্রুত একটা প্ল্যান করা হলো। উপসাগরের দিকে যাবার পথে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ফিলিপ। বন্দুক হাতে গুঅনাকোকে ধাওয়া করবে মরিস। অবশ্য খুবই সাবধানে, পা টিপে টিপে যেতে হবে তাকে তা না হলে হরিণটা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। কাছাকাছি পৌঁছে ওটাকে ফিলিপের দিকে ছোটানোর চেষ্টা করবে সে।

বাসকেথ দুজনকেই সাবধান করে দিল। ভুলো না যে এই হরিণগুলোর ইন্দ্রিয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। একবার যদি কোন রকমে দেখে ফেলে বা গায়ের গন্ধ পায়, এমন ছোটাই ছুটবে যে কার সাধ্য তাকে ধরে। তখন এমন কি গুলি করেও কোন লাভ হবে না।  

আচ্ছা, ঠিক আছে, মনে থাকবে,  বলল মরিস।

বাসকেথ আবার টেলিস্কোপে চোখ লাগাল। দেখাদেখি, ফিলিপও। আশ্চর্যই বলতে হবে, হরিণটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই এখনও দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়েনি।

যাও, তাড়াতাড়ি যাও তোমরা, তাগাদা দিল বাসকেথ। ওটা আমাদের গুলি খাবার অপেক্ষায় নড়ছে না!  

ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল মরিস আর ফিলিপ।

.

বাতিঘর থেকে বাসকেথ দেখল, জঙ্গলের দিকে হাঁটছে মরিস। একটু পর জঙ্গলের ভেতর ঢুকল সে। এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। বাসকেথের মনে হলো, আড়াল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে হরিণটার পিছনে ঠিকই পৌঁছাতে পারবে মরিস। তারপর ধাওয়া করলে ওটা ছুটে আসবে ফিলিপের দিকে। ফিলিপও ইতিমধ্যে উপসাগরে যাবার পথটার ওপর পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে।

আধ ঘণ্টা হয়ে গেল, জঙ্গল থেকে মরিস বেরুচ্ছে না। হরিণটা সেই আগের মতই স্থির দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়ছে না। দূর থেকে দেখে ঠিক বোঝা যায় না, তবে মনে হলো চওড়া একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সে যেন বিশ্রাম নিচ্ছে। খানিকটা করুণা বোধ করল বাসকেথ। হরিণটার ভাগ্যই আসলে খারাপ। তা না হলে বিশ্রাম নেয়ার আর জায়গা পেল না। কিন্তু আধ ঘণ্টার বেশি হতে চলেছে, মরিসকে দেখা যাচ্ছে না কেন? আড়াল থেকে সুযোগ পাচ্ছে যখন, গুলি করে হরিণটাকে ফেলে দিলেই তো পারে!

এদিকে বাসকেথ, ওদিকে ফিলিপ, দুজনেই গুলির শব্দ শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে আছে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার, কোন গুলি হচ্ছে না। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, হঠাৎ গুঅনাকোটা একটা পাথরের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মরিস। সোজা হেঁটে এসে হরিণটার কাছাকাছি থামল সে। তার ভাব দেখে মনে হলো, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে। বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে হরিণটাকে। তারপর কি হলো

কে জানে, হঠাৎ হরিণটার দিকে পিছন ফিরে খিচে দৌড় দিল। দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করে ডাকছে বাসকেথ ও ফিলিপকে।

বাতিঘর থেকে বাসকেথও চিৎকার করে ডাকল ফিলিপকে। ফিলিপ, ফিরে এসো! নিশ্চয়ই অদ্ভুত কিছু একটা ঘটেছে!  

বাতিঘর থেকে বেরিয়ে ছুটছে বাসকেথ। ফিলিপও ছুটে ফিরে আসছে। একটু পরই তিনজন এক হলো। মরিস রীতিমত হাপরের মত হাঁপাচ্ছে।

বাসকেথ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, মরিস? কি হয়েছে তোমার? ওখানে তুমি কি দেখলে? হরিণটা হঠাৎ ওভাবে পড়ে গেল কেন?

কি হয়েছে আমার সঙ্গে এলেই দেখতে পাবে,  বলে ঘুরল মরিস, আবার ছুটল।

তার পিছু নিয়ে ওরা ছুটছে। একটু পরই হরিণটার কাছে চলে এল নিজন। আঙুল তাক করে মরিস বলল, দেখো!

ফিলিপ বলল, দেখার কি আছে? হরিণটা পড়ে আছে। তারমানে নিশ্চয়ই মারা গেছে।

হ্যাঁ, মারাই গেছে। তবে…

তবে কি? জিজ্ঞেস করল বাসকেথ। নিশ্চয়ই হার্টফেল করেছে, তাই না? বুড়ো হয়ে গিয়েছিল…

না। হার্টফেল করেনি। মরিস এখনও হাঁপাচ্ছে, তবে পরিশ্রমে নয়, উত্তেজনায়। আমি কি বলতে চাইছি বোঝার চেষ্টা করো তোমরা। হরিণটার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ওটাকে কেউ হত্যা করেছে।

হত্যা করেছে? কি বলছ! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!

না, মাথা খারাপ হয়নি, বলল মরিস। তার প্রমাণ, ওই দেখো গুলির দাগ।

গুলি! আঁতকে উঠল বাসকেথ + বিস্ময়ে চোখ জোড়া:বড় বড় হয়ে উঠল তার। ভয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল।

হ্যাঁ, গুলি করেই মারা হয়েছে ওটাকে। এবং গুলিটা আমি করিনি।  

হরিণটাকে আরও ভাল ভাবে পরীক্ষা করে রাসূকেথ ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, তাই তো! গুলিরই তো দাগ। ওহ্, গড! এর মানে কি?

ওরা দুজন তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

গলা আরও খাদে নেমে গেল বাসকেথের। এর মানে দ্বীপে আরও লোক আছে। সে-ই শিকার করেছে এই হরিণটা। কিন্তু কে সে? সে না তারা?  কথা শেষ করে ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল।

<

Super User