দুর্ভোগ – গোলাম মাওলা নঈম
প্রথম প্রকাশ: ২০০২

কি ব্যাপার, লাইমি [লাইমি : ইংরেজ নাবিক, ব্যঙ্গার্থে বা তুচ্ছার্থে সম্বোধন করা হয়েছে], গরম লাগছে খুব?

সন্তর্পণে পরনের কোট খুলে চেয়ারের ব্যাক-রেস্টের সাথে ঝুলিয়ে রাখল জিম শেভার্ন। একটা সিগার ধরিয়ে প্রশ্নকর্তা, পাশের লোকটির দিকে তাকাল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে, খেলার দিকে মনোযোগ নেই তেমন, প্রায় সারাক্ষণই হেরেছে। যা গরম পড়ছে, আমার মনে হয় সবারই কোট খোলা উচিত! শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের ওপর তুলে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল শেভার্ন, চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।

উল্টোদিকের লোকটিকে প্রায় শীর্ণদেহী বলা যাবে, বিল নামে সম্বোধন করছে অন্যরা, প্রায় বোঝা যায় না এমন ভাবে ক্ষীণ একটু হাসল সে। স্রেফ অলস মন্তব্য বলে ধরে নিয়েছে শেভার্নের কথাটা। অন্যজন বেশ মোটাসোটা, শেভার্নের প্রস্তাবে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। তুমি কি বলতে চাও চুরি করছি আমরা? আচমকা তড়পে উঠল সে, চোখে চ্যালেঞ্জ।

 উঁহু, তেমন কিছু বলিনি আমি, নিরীহ সুরে সাফাই গাইল শেভার্ন; বলতে পারত সে না হলেও অন্তত একজন হাত সাফাই করছে। পরনে কোট না থাকলে কিছুটা হলেও সেই সম্ভাবনা কমে যায়।

তৃতীয় লোকটা কিছু বলল না, ইচ্ছে করেই ক্রমশ তেতে ওঠা পরিস্থিতিটায় ভ্রূক্ষেপ করছে না। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষায় আছে শেভার্ন, নাছোড়বান্দা মনে হচ্ছে ওকে-স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে কথাচ্ছলে আসলে অভিযোগই করেছে; অন্যরা কোট না খুললে চেয়ারে বসবে না, খেলাও শুরু হবে না। আচমকা নীরব হয়ে গেছে পুরো সেলুন, বারের কাছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ফিরে তাকিয়েছে পোকার টেবিলের দিকে। শেভার্নের প্রস্তাব আর মোটকুর চ্যালেঞ্জ জুয়েল পর্যন্ত গড়ালে বিস্মিত হবে না কেউ।

কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিল নামের লোকটি, ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা ক্ষীণ হাসি প্রসারিত হলো একটু। আসলেই গরম পড়ছে খুব, কোট খোলার সময় একমত হলো সে।

এখনও দাঁড়িয়ে আছে শেভার্ন। পলকের জন্যে ওর উরুতে বাঁধা জোড়া হোলস্টারের দিকে তাকাল মোটকু, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তৎক্ষণাৎ। চেয়ারে বসেই কোট খুলতে শুরু করল। অসহায় দৃষ্টিতে সঙ্গীদের দিকে তাকাল তৃতীয়জন, নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়াল কোট খোলার জন্যে।

মিনিট দুই পর খেলা শুরু হলো আবার। শেভার্ন টের পেল ঘণ্টা খানেক আগে যেমন হয়েছিল, ভাল তাস পড়ছে ওর হাতে।

বিতৃষ্ণার সাথে হাতের তাসে চোখ বুলাল তৃতীয় লোকটা, তারপর টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলল তাসগুলো। আমি আর খেলছি না, খেলা শুরুর পর এই প্রথম মুখ খুলল সে, চেয়ার ছেড়ে বারের দিকে এগোল। জায়গাটা দখল করতে আগ্রহী হলো না অন্য কেউ।

কোট খোলার পরও অনবরত ঘামছে মোট, এবং এবারও জিতেছে শেভার্ন। শার্টের কিনারা আরও তুলে দিল ও, বুঝতে পারছে ভাগ্য খুব বেশি সহায়তা করছে ওকে। সব টাকা নিজের দিকে টেনে এনে তাস শাফল শুরু করল, নিদারুণ অবহেলার সাথে কাজটা সারছে। একটু আগেও খানিকটা সন্দেহ ছিল মনে, কিন্তু এখন নিশ্চিত জানে আসলে কে চুরি করছে।

বিল নামের লোকটা এজন্যেই হাসছিল। জানত তার জোচ্চুরি ধরা পড়ে যাবে, এবং এখন ইচ্ছে করেই জিততে দিচ্ছে শেভার্নকে, যাতে দোষটা ওর ঘাড়ে চাপাতে পারে। আরও তিনটা পট জেতার পর বিলকে জিততে বাধ্য করল ও। কিন্তু বিল তাস শাফল করার পর দেখা গেল একই কাণ্ড–আবারও জিতল শেভার্ন।

তোমার সাহায্য দরকার নেই আমার, নিস্পৃহ স্বরে বলল ও।

উৎসাহী দর্শকরা বিস্মিত হলেও নির্বিকার দেখাচ্ছে বিলকে। এখনও স্মিত হাসি লেগে আছে ঠোঁটে, বুকের সাথে প্রায় লেপ্টে ধরেছে নিজের তাস। কি বলতে চাও, লাইমি? নিচু কিন্ত স্পষ্ট করে জানতে চাইল সে।

সময় নিয়ে সিগারেটের গোড়া ছাইদানিতে পিষল শেভার্ন, অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজটা করছে, একবারের জন্যেও প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকায়নি। তেমন কিছু নয়, ছাইদানি থেকে চোখ তুলে সরাসরি লোকটার চোখের দিকে তাকাল ও। বলেছি তোমার কাছে সাহায্য চাইনি আমি।

কিসের সাহায্য? একটা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল লোকটা।

ন্যাকা! বেটাচ্ছেলেও ন্যাকা সাজে, এমন পরিস্থিতিতে, লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল শেভার্ন। আড়চোখে অন্যদের গম্ভীর মুখগুলো দেখল একবার। নিজেকেই সাহায্য করছ না কেন? বিদ্রুপের স্বরে শেষে জানতে চাইল

ক্রোধে জ্বলে উঠল লোকটার চোখ, ধৈর্য হারিয়েছে এতক্ষণে। আচমকা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল হাতের তাসগুলো। তাস সরে যেতে মুঠিতে ছোট্ট একটা ডেরিঞ্জার দেখা গেল। কোন ফাঁকে বের করে এনেছে কেবল সেই জানে।

টেবিলের কিনারা থেকে গুলি করল শেভার্ন। চেয়ার সহ পেছনে ছিটকে পড়ল জুয়াড়ী, কপালে ত্রিনয়নের সৃষ্টি করেছে বুলেটটা। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল হতভাগ্য বিল।

নির্বিকার মুখে প্রতিদ্বন্দ্বীর নিথর দেহটা দেখল শেভার্ন, তারপর চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল। কি মনে হয় তোমাদের, ডুয়েলটা ফেয়ার ছিল, তাই না? হোলস্টারে পিস্তল ফেরত পাঠানোর সময় মৃদু স্বরে জানতে চাইল ও।

কেউই কিছু বলল না। স্থির হয়ে নিজের চেয়ারে বসে আছে মোটকু, হাত জোড়া টেবিলের ওপর ফেলে রেখেছে। এখন আর লালচে দেখাচ্ছে না মুখ, বরং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু চাহনিতে চাপা রাগ, সেটা বিল নাকি শেভার্নের প্রতি বোঝা যাচ্ছে না।

টেবিলের সব টাকা পকেটে ঢোকাল শেভার্ন, কেবল একটা ডাবল ঈগল বাকি রাখল। আশা করি ওর সৎকারের জন্যে বিশ ডলারই যথেষ্ট হবে। লম্বা ঝুলঅলা কোট তুলে নিয়ে কাঁধের ওপর চাপাল ও, মুহূর্তের জন্যে ভাবল পরবে। পরমুহূর্তে মেক্সিকান বুল ফাইটারদের কথা মনে পড়তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। দুঃসাহসী বুল ফাইটাররাও কোন কোন সময়ে ষাঁড়কে উত্যক্ত করতে ক্লান্তি বোধ করে। কোট কাঁধের ওপর রেখেই সেলুন থেকে বেরিয়ে এল ও, পোর্চে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে একটা সিগারেট রোল করল।

রাস্তায় নেমে কয়েক পা এগোতেই পিছু হটতে বাধ্য হলো শেভার্ন। পাশের গলি থেকে ছুটে এল তপ্ত সীসা। আনাড়ীর মত একের পর এক গুলি চালাচ্ছে কেউ। কেবল প্রথমটাই কাছ দিয়ে গেল, কানের পাশে বিচিত্র শব্দ তুলে চমকে দিয়েছে ওকে।

হয়তো তৃতীয় লোকটাই খেপে গিয়ে আক্রমণ করেছে, ধারণা করল ও। তবে সঙ্গী জুটেছে তার। কোল্ট বের করে নিশানা ছাড়াই পাল্টা গুলি করল শেভার্ন। ক্ষীণ গোঙানি কানে এল ওর, মেয়েলি কণ্ঠই বলা উচিত; তারপর যেমন শুরু হয়েছিল, আচমকা শেষ হয়ে গেল লড়াই। পিস্তল হাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকল ও, শেষে বিপদের সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে হিচিং রেইল থেকে গ্রে-টাকে মুক্ত করল।

স্যাডলে চেপে শেষবারের মত চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালাল ও, বুঝতে চাইছে আরও কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে কি-না। ঘুমে অচেতন সারা শহর, দূরে গির্জার ঘণ্টা-ঘরে একটা বাতি জ্বলছে। আর কোন আলো নেই কোথাও। অশরীরীর মত দাড়িয়ে আছে বাড়ি আর দালানগুলো, চাঁদের ম্লান আলোয় একেবারে জীর্ণ, রুগ্ন লাগছে মধ্যরাতের সোডা স্প্রিং-কে।

দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাল শেভার্ন, কয়েকশো গজ ঘোটার পর শেষ বাড়িটাও পেছনে পড়ে গেল। পেছন ফিরে দীর্ঘ মূল রাস্তার ওপর নজর চালাল ও, কেউ পিছু নেয়নি বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত মনে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিল।

নিজের প্রাণ আর হাজার খানেক ডলার নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ও। খুশি হওয়া উচিত। স্যাডল ব্যাগে মৃদু চাপড় দিয়ে নিজেকে অভিনন্দিত করল শেভার্ন, ভাগ্যিস শহর ছাড়ার আগে শেষ ড্রিঙ্ক গলায় টালার জন্যে গোল্ডেন ঈগলে গিয়েছিল! সোডা স্প্রিং-কে পুরোপুরি আদর্শ শহর বলা যাবে না, বিক্ষিপ্ত মনে ভাবল ও, কিন্তু কোন একদিন এমন একটা শহরে পৌঁছার পর হয়তো থেকে যেতে ইচ্ছে হবে। পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন আরেকটা শহরে স্রেফ নিজের ভাগ্য যাচাই করেছে, সোডা স্প্রিং-এ ওর অভিজ্ঞতাকে এটুকুই বলা যেতে পারে।

ট্রেইলটা ক্রমশ চড়াইয়ে উঠে গেছে, ঘন্টা দুই চলার পর প্রায় সমতল জমিতে পৌঁছে গেল শেভার্ন। সোডা স্প্রিং-এর আশপাশে ছিল,স্যাগুয়েরো আর শোলা ক্যাকটাসের রাজত্ব, এখানে আছে কেবল খর্বাকৃতির জুনিপার আর ক্যাকটি ঝোপ। পর্যাপ্ত ঘাস নেই, পানির উৎসও নেই। তাছাড়া এমন এলাকায় প্রচুর র‍্যাটল থাকে, ঘোড়ার জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, ওর চেয়ে স্ট্যালিয়নটারই বেশি দরকার।

শেভার্নের  থায় স্যাভিলানো হ্যাট। কালো ওটা, চওড়া ব্রিম, সমতল ক্রাউন; সাধারণত স্প্যানিয়ার্ডরাই এ ধরনের হ্যাট পরে। তলাটা, গভীর বলে ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর সময় গোল্ড প্যানের চেয়ে বেশি কাজে দেবে। কিন্তু এভাবে হ্যাটটা ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু গোল্ড প্যানের তলাও পানি ধরে রাখার মত তেমন গভীর নয়। এরচেয়ে অনাকর্ষণীয় কোন হ্যাট পরা উচিত, ভাবল শেভার্ন-যাতে ভবঘুরে বা ভ্রমণরত কোন স্প্যানিয়ার্ড মনে না হয় ওকে, কিন্তু ওর কালো চুল আর গোঁফ ধারণাটা আরও পাকা করে ফেলে; তবে এর একটা সুবিধাও আছে-ইংরেজ নয় এমন লোকের কদর বেশি এ দেশে!

ট্রেইল থেকে কিছুটা দূরে ঝোপের আড়ালে ক্যাম্প করল শেভার্ন। স্যাডল। ছেড়ে প্রথমে ঘোড়ার যত্ন নিল, স্যাভিলানোতে পানি ঢেলে খাওয়াল ওটাকে; মাথা মুছে শেষে দলাই-মলাই করে দিল। স্যাডল ব্যাগে সামান্য ওট অবশিষ্ট ছিল, তারই কিছু দিল স্ট্যালিয়নকে। তারপর বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ও। ক্লান্তি লাগছে না তেমন, তবু সুযোগটা হাতছাড়া করল না, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘোড়ার মৃদু হ্রেষাধ্বনি জাগিয়ে তুলল ওকে। প্রথমেই নড়ল না শেভার্ন, শুয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার প্রয়াস পেল। তারাজ্বলা আকাশে লেগে আছে দৃষ্টি, কিন্তু সজাগ প্রতিটি ইন্দ্রিয়। ক্ষীণ খুরের শব্দ কানে আসছে, একটা পাথর গড়ানোর শব্দ হলো কোথাও-খুবই কাছে!

গভীর রাতে যে-ই এই ট্রেইল ধরে যাতায়াত করুক, সৎ লোকও হতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে শেভার্ন, জোড়া পিস্তল চলে এসেছে ওর হাতে। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার, এবং নিঃসীম নীরবতা। কান সজাগ করে একই জায়গায় পড়ে থাকল ও, মিনিট কয়েক পর ধৈর্যের ফল মিলল-প্রথমে খসখসে একটা শব্দ, শেভার্নের সন্দেহ হলে হয়তো কোন ব্যাটলের চলার শব্দ সেটা, কিন্তু পরে স্যাড়লের খসখসে শব্দ শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল। ঝোপের কিনারে সরে এসে ট্রেইলের ওপর নজর রাখল ও, আশা করছে শিগগিরই দেখতে পাবে আগন্তুককে। 

একজন নয়, দুজন।

চোখ কুঁচকে সামনের পথ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করল ও। সোডা স্প্রিং-এ শুনেছে সামনে কোথাও বসতি আছে। এই ট্রেইল ব্যবহার করার ষোলো আনা অধিকার আছে যে কারও; কিন্তু এ মুহূর্তে কারও সঙ্গ কামনা করছে না শেভার্ন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার চিবুক চেপে ধরল ও, পাছে ওটা কোন শব্দ করে ফেলে।

আচমকাই এল গুলিটা, নির্জন প্রান্তরের অটুট নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিল। বিচিত্র সুর তুলে কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল তপ্ত সীসা। অল্পের জন্যে ও বেঁচে গেলেও ঘোড়াটা ধরাশায়ী হলো ঠিকই। হুড়মুড় করে ঝোপের ওপর ঢলে পড়ল স্ট্যালিয়ন, গড়িয়ে সরে গেল একপাশে। দেহের কয়েকটা পেশী কেঁপে উঠল দুএকবার, তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।

বেজন্মরা ঠিকই জানে কোথায় আছি আমি, দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল শেভার্ন। গড়ান দিয়ে কয়েক হাত সরে এল ও, চোখ তুলে দেখল ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে দুই বেজন্ম-আবছা ভাবে সওয়ার সহ দুটো ঘোড়র কাঠামো চোখে পড়ছে। সামনের লোকটার বুকে নিশানা করল ও, তারপর ট্রিগার টেনে নিল।

আচমকা যেন পেছন থেকে টেনে ধরেছে কেউ, স্যাডলে স্থির হয়ে গেল লোকটা। ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে দোল খাচ্ছে দেহটা, তারপর গড়িয়ে স্যাডল চ্যুত হলো। ঘোড়াটা ছুটতেই থাকল। পিছু পিছু আসছে দ্বিতীয়জন।

অকস্মাৎ বাহুতে টান অনুভব করল শেভান, নিশানা ছুটে গেল পরের গুলি করার সময়। বিড়বিড় করে খিস্তি করল ও, দেখল সরাসরি ওর দিকে ছুটে আসছে লোকটা। সমানে কমলা আগুন ওগরাচ্ছে হাতের পিস্তল। নিজের কোল্টের নল দিয়ে লোকটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল ও, কিন্তু একেবারে কাছে চলে এসেছে সে। চোখের সামনে তীব্র আগুনের ঝলক আর হাজারটা আতশ বাতি জ্বলে উঠতে দেখল শেভার্ন, পর মুহূর্তে আগের মতই অন্ধকার নেমে এল।

কয়েক সেকেন্ড পর কপাল আর চোখে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ অনুভব করল শেভার্ন। নিথর স্ট্যালিয়নের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ঘোড়ার শরীরের। উষ্ণতা পুরোপুরি সচকিত করল ওকে। তৎক্ষণাৎ আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন। হলো, জানে একজনকে নিকেশ করেছে, কিন্তু আশপাশেই আছে অন্য লোকটা। হাত চালিয়ে চোখ থেকে রক্ত মুছে ফেলল ও, আশা করল হয়তো দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে বসেনি। সন্তর্পণে পা নাড়ল। মনে হচ্ছে সবই ঠিক আছে। কিন্তু নড়াচড়া করার আগে অন্য লোকটাকে খুঁজে বের করা দরকার।

উল্টোদিকের পাহাড়ের দিকে তাকাল ও, বহু দূরে ক্ষীণ আলোর আভা চোখে পড়ছে। কাছেই করুণ সুরে ডেকে উঠল একটা কথোট। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করল ও। একখণ্ড মেঘের আড়ালে পড়ে গেছে চাঁদ, তবে বেরিয়ে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

একটু পরেই ভুলটা বুঝতে পারল, পাহাড়টা আসলে মেঘের টুকরো। কালিগোলা অন্ধকার ওর মত কয়োটটাকেও ঠকিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আলোকিত হয়ে উঠবে বেসিনের এই অংশ, রাইফেলে নিশানা করার মত আলো পাওয়া যাবে।

চাঁদিতে জ্বালা করছে ক্ষতটা, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। রক্ত আর দৃষ্টিভ্রমের উৎপাত বন্ধ করতে রুমাল চেপে ধরল ও জায়গাটায়। কেউ নিশ্চয়ই নজর রাখছে, অপেক্ষায় আছে কখন নড়ে উঠবে নির্জীব দেহটা। পেছনে একটা ঘোড়ার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল ও চোখের কোণ দিয়ে। দেখল কাছেই জুনিপার ঝোপের পাশে বেড়ে ওঠা ঘাস মুখে টেনে নিচ্ছে একটা স্ট্যালিয়ন।

নিজেকে মাতাল মনে হচ্ছে ওর, সম্ভবত চাঁদির ক্ষতটাই দায়ী সেজন্যে। মাথাটা ভারী লাগছে, ভোঁতা যন্ত্রণার পাশাপাশি দপদপ করছে লাগাতার; সুস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারছে না। অথচ এ মুহূর্তে সেটাই জরুরী, কারণ খুব কাছেই ওঁৎ পেতে আছে বিপদ।

গত কয়েকদিনে পারতপক্ষে ঝামেলা এড়িয়ে চলেছে শেভার্ন, জানে ওর চেষ্টায় গাফিলতি হয়নি। পেছনে কঠিন কিছু মানুষকে নিয়ে ট্রেইলে চলার ইচ্ছে নেই ওর। চলার মধ্যে কেটেছে দুটো মাস-একের পর এক শহর বা বসতি পেরিয়েছে, কিন্তু কোন চিহ্ন বা শক্রতা ফেলে যায়নি পেছনে। শুধু সোডা স্প্রিং এর বেলায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।

পেছনে ঘাসের সাথে কাপড়ের খসখসে শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। নিশ্চিত। ধরে নিয়েছে আগন্তকদের দুজনই জুয়াড়ী। শোধ নিতে এসেছে, এবং ওর স্যাডল ব্যাগের এক হাজার ডলার তাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তির খাতিরে বলা যায় এখনও ওকে দেখতে পায়নি লোকটা, নইলে অনেক আগেই এক গুলিতে কাজ সেরে ফেলত। রক্তের গন্ধে নাক ঝেড়ে অস্বস্তি প্রকাশ করল স্ট্যালিয়নটা। সন্তর্পণে খানিকটা পাশ ফিরল শেভার্ন, আশা করল হয়তো শব্দ হবে না।

কিন্তু আশা পূরণ হলো না ওর। জুনিপারের শুকনো একটা ডাল ভাঙল মটু করে। তৎক্ষণাৎ শব্দের পরোয়া না করে পুরো দেহ গড়িয়ে দিল ও। ভাগ্যিস, সময় মত সরে যেতে পেরেছে। নইলে এখনই ফুটো হয়ে যেত বুক। রাইফেলের নিশানা করাই ছিল যেন, শব্দ পেয়েই ভারী ক্যালিবারের গুলি পাঠিয়ে দিয়েছে। লোকটা। আরেকটা গুলি বিধল মরা ঘোড়াটার শরীরে।

শুয়ে থেকেই পাল্টা গুলি করল শেভার্ন, রাইফেলের ঝলকের দুপাশে পালাক্রমে গুলি চালিয়ে দুটো কোটই খালি করে ফেলল। গুলির প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মাটির সাথে রাইফেলের বাটের সংঘর্ষের শব্দ এল কানে। দীর্ঘক্ষণ মরা ঘোড়ার পেছনে নিথর পড়ে থাকল ও, কোল্টে তাজা বুলেট ভরে নিয়েছে। তারপর নিশ্চিত হয়ে হোলস্টারে কোস্ট ঢুকিয়ে চাদির ক্ষতের দিকে মনোযোগ দিল।

রুমাল দিয়ে আলতো ভাবে ক্ষতটা স্পর্শ করল ও, গভীরতা মাপল। ইতোমধ্যে রক্তক্ষরণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যান্টিন থেকে পানি ঢেলে রুমাল। ভিজিয়ে শেষে ক্ষতটা পরিষ্কার করল। জানে এজন্যে পরে হয়তো আফসোস করতে হবে, কারণ কাছাকাছি পানির উৎস অন্তত পঞ্চাশ মাইল দূরে।

মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ। জুয়াড়ীদের ঘোড়া দুটো শখানেক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সন্ত্রস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। জুনিপারের পাশে গজানো জিকেটনের সদ্ব্যবহার শুরু করেছে পুরোদমে। স্থানীয় ঘোড়া, ধারণা করল শেভার্ন। ওর বিশাল গ্রে ঘোড়াটা বিরান প্রান্তরের এসব ঘাসকে তুচ্ছ মনে করেছে।

শেভার্ন নিশ্চিত দুজনকেই ধরাশায়ী করেছে। কিন্তু সত্যিই কি মরেছে ওরা? দ্বিতীয় লোকটা হয়তো স্রেফ আহত হয়েছে। একটু আগে শেভার্নের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ওর দেহ পরখ করতে অবহেলা করেছে সে। একই অভিজ্ঞতা অর্জন করার ইচ্ছে নেই ওর। চোখ বন্ধ করে নিঃশাস আটকে রাখল ও, মানুষের ক্ষীণ নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে চাইছে। কয়েকশো ফুট দূরে স্টীম ইঞ্জিনের মত সশব্দে শ্বাস নিচ্ছে ঘোড়াগুলো, ব্রিডলের টুংটাং আর স্টির্যাপের ভোতা, আওয়াজ ছাড়াও ঘাস টানার মচমচে শব্দ শোনা যাচ্ছে-ওসব বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল, কিন্তু ওর সমস্যার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলোকে।

জীর্ণ হ্যাটটা খুঁজে পেল ও, ঠিক চূড়ায় ফুটো হয়ে গেছে। কোল্টের নলের আগায় বসিয়ে হ্যাটটা তুলে ধরল, বিপদের আভাস পেতে এরচেয়ে ভাল কিছু আপাতত মনে পড়ছে না। কোন গুলি ছুটে এল না। বড়সড় একটা পাথর তুলে লোকটার অবস্থানের দিকে ছুঁড়ে মারল ও। এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না, ঘোড়ার সচকিত সচকিত কান নাড়ার শব্দই কেবল শুনতে পেল শেভার্ন।

চাঁদের আলোয় আরেকবার চারপাশে সতর্ক নজর চালাল ও। ক্রল করে নিঃশব্দে কয়েক গজ সরে এল মরা ঘোড়ার কাছ থেকে, তারপর সন্তর্পণে মাথা তুলল। দ্বিতীয় লোকটিকে দেখতে পেল এবার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পড়ে আছে দেহটা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাওতা দিচ্ছে না। তারপরও ক্রল করে এগোল ও, সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে দেহটার ওপর। মিনিট কয়েক পর সিদ্ধান্তে পৌঁছল অন্তত একজন আর বিপজ্জনক নয় ওর জন্যে।

আরেকজন কোথায়? অজান্তে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। তেত্রিশ চলছে ওর, বাস্তবে যতটা সাহসী তারচেয়ে বেশি সাহসী হওয়ার ভান করে রুক্ষ কঠিন পশ্চিমে টিকে আছে বললে ভুল হবে। পড়ে থাকা রাইফেলটা সন্দিহান করে তুলেছে ওকে, জানে ক্ষীণতম নড়াচড়াই একজোড়া কোল্টকে গর্জে উঠতে প্ররোচিত করতে পারে।

ক্যাকটি ঝোপের কাছাকাছি পৌঁছল ও, ধারণা করেছে এবার অন্যজনের লাশ। দেখতে পাবে। কিন্তু তেমন কিছুই নেই। চাঁদের আলো এতটাই উজ্জ্বল প্রায় দিনের আলোর মত স্পষ্ট চোখে পড়ছে সবকিছু। মনে পড়ল ওর ঘোড়াটা পড়ে যাওয়ার সময় ট্রেইলেই ছিল দুই জুয়াড়ী। অহেতুক এভাবে জুনিপার ঝোপের। আশপাশে ক্রল করতে থাকলে যে কোন সময় একটা র্যাটল ছোবল মারতে পারে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঝটিতি মাথা তুলল ও, ইচ্ছে সংক্ষিপ্ত সময়ের। মধ্যে ট্রেইলের ওদিকটা দেখে নেবে।

স্যাডল থেকে খসে পড়ার পর ক্রল করে কয়েক ফুট এগিয়েছে লোকটা, রক্তের ছোটখাট একটা পুকুর তৈরি হয়েছে শেষ অবস্থানে। হাত বাড়িয়ে লোকটার কজিতে ধমনীর স্পন্দন পরখ করল শেভার্ন, নিশ্চিত হলো আর কখনও ক্রল করতে পারবে না জুয়াড়ী। কোল্ট হোলস্টারে ফেরত পাঠিয়ে উঠে দাঁড়াল ও এবার। ভাবছে ঘোড়া দুটোকে কিভাবে বাগে আনবে।

অকস্মাৎ অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল ওর চোখে। দৃষ্টি নামিয়ে পড়ে থাকা লোকটিকে নিরীখ করল। জুনিপারের ওপাশে পড়ে আছে মোটকু, কিন্তু এ লোক একেবারেই অচেনা। অবশ্য জুয়াড়ীদের কাউকেই আগে থেকে চিনত না। বিল নামের শীর্ণ জুয়াড়ী সেলুনেই পটল তুলেছে, কিন্তু এ লোক…খেলা ছেড়ে যাওয়া লোকটার সাথে কোন মিলই নেই। প্রায় তরুণ বলা যাবে একে, সতেরো বা আঠারো হবে বড়জোর। বয়স আর কখনও বাড়বে না তার। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘোড়া ধরতে এগোল শেভার্ন।

কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে ঘোড়াগুলোর অসহযোগিতা টের পেল ও। খুব দূরে সরে যাচ্ছে না কোনটাই, একেবারে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে নিচ্ছে। নিজেকে। লাগাম ধরার চেষ্টায় ইস্তফা দিয়ে এবার ভিন্ন পথে চেষ্টা করল শেভার্ন। ভাবছে পানির লোভ দেখিয়ে কাজ উদ্ধার করবে কি-না, পরমুহূর্তে মনে পড়ল ফুটো হয়ে গেছে হ্যাটটা।

পিছিয়ে গিয়ে এক জুয়ার হ্যাট তুলে নিল ও। কিন্তু এটাও ফুটো হয়ে গেছে। নতুন ফুটো নয় অবশ্য, স্টেটসনটার দশা একেবারে যাচ্ছেতাই, এতই জীর্ণ হয়ে গেছে যে কিনারার কাছে গাঁথুনি প্রায় খুলে গেছে। অন্য জুয়াড়ীর হ্যাট আলগা খড়ের তৈরি, কাজ হবে না। তারপরই ওর মনে পড়ল পানির গন্ধ আর ক্যান্টিন ভরা পানির শব্দই যথেষ্ট হবে।

মরা গ্রে-র কাছে এসে ক্যান্টিনের খোঁজে তল্লাশি চালাল। কিন্তু এবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হলো ওকে। ঘোড়ার শরীরের নিচে পড়ে গেছে ওটা, ফেটে যাওয়ায় সব পানি বেরিয়ে গেছে। পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে সামনে কোথাও পানি পাওয়া যাবে না।

একটা উপায়ই আছে এখন-সোডা স্প্রিং-এ ফিরে গিয়ে পানি আর নতুন ঘোড়া সংগ্রহ করতে হবে, এবং তারও আগে, অন্তত একটা ঘোড়া ধরতে হবে।

ফের চেষ্টা করতে গিয়ে এবার ভাগ্যের সহায়তা পেল শেভার্ন। সরে যাওয়ার। মুহূর্তে জুনিপারের ডালে জড়িয়ে গেল লাগামের প্রান্ত, আটকা পড়ল স্ট্যালিয়নটা।

সোডা স্প্রিং-এর দূরতু মাইল দশ বা বারের বেশি হবে না। এখনই যাত্রা করলে হয়তো সূর্য তেতে ওঠার আগেই কাজ সেরে আবার ট্রেইলে নামতে পারবে ও। সোডা স্প্রিং-এর মত ছোট্ট শহরে কেউ না কেউ আছে যে এ ঘোড়ার মালিককে চিনবে, কিভাবে ঘোড়াটা ওর কাছে এল সেই ব্যাখ্যা দিতে জান পানি হয়ে যাবে। ক্লান্তিকর ব্যাখ্যা এড়ানোর একটাই উপায় আছে।

স্ট্যালিয়নের স্যাডলে চেপে অন্যটাকে তাড়া করল শেভার্ন। মিনিট দশ পর দুটো লাশই আড়াআড়ি ভাবে বেঁধে ফেলল অন্য ঘোড়ার পিঠে। তারপর ফিরতি পথে যাত্রা করল সোডা স্প্রিং-এর উদ্দেশে।

তিক্ত কিছু অনুভূতি হচ্ছে ওর, এভাবে ফিরে যাওয়া পছন্দ করতে পারছে। পোকার বা জিতে নেওয়া এক হাজার ডলার কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও উপভোগ্য একটা আমেজ সৃষ্টি করেছিল ওর মনে, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।

হয়তো শিগগিরই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, প্যাকহর্সের পিঠে চাপানো লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে এই চিন্তাটাই খেলে গেল জিম শেভার্নের মনে।

.

০২.

শেভার্ন যখন সোডা স্প্রিং-এ পৌঁছল ভোর হচ্ছে তখন, পুব আকাশে লালিমা ফুটে উঠেছে, ভোরের তাজা বাতাসে তাপদার্থ দিনের আভাস নেই। কিন্ত এখানকার অধিবাসীরা সবাই জানে ঘন্টা খানেক পরেই উত্তপ্ত হলকা ছড়াতে শুরু করবে সূর্য, তাতিয়ে উঠবে মাটির ওপর সবকিছু। উত্তাপ আর উকট ধুলোর অত্যাচারে এমনকি পশুরাও অধৈর্য হয়ে পড়বে। সেজন্যেই সাত-সকালে গেরস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই; লিভারি স্টেবল, সেলুন আর ড্যান্স হলগুলো পরিষ্কার করছে লোকজন।

 দোকানের সামনের বোর্ডওঅক পরিষ্কার করছিল মার্কেন্টাইল স্টোরের মালিক টেকো মাথার উইলিয়াম কসবি, মুঠিতে পানি ভরা একটা বোতল ধরা তার-গ্রীন রীভারের পানি। একসময় হয়তো মিষ্টি পানি ছিল নদীটায়, কিন্তু ঘোলাটে রঙের ক্ষারীয় পানি হয়ে গেছে এখন। সেজন্যেই এ শহরের নাম সোডা প্রিং। লম্বা হাতলঅলা একটা ঝড় তুলে নিয়েছে মাত্র, অভ্যাসবশত কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল শহরে প্রবেশ করাঁ আগন্তুকের দিকে, পরক্ষণে বোতলটা হাত থেকে খসে পড়ল তার।

লাশগুলো কষলে মুড়ে নিয়ে এলেই ভাল হত, উপলব্ধি করল শেভার্ন। সাত সকালে মৃতদেহ দেখতে পছন্দ করে না কেউ, সেটা যারই হোক। বাড়তি কম্বল ছিল না সঙ্গে, থাকলেও অবশ্য কিছু যে-আসত না, কারণ আগে বা পরে শহরের লোকজন ঠিকই জেনে যাবে। ছফুট দীর্ঘ দুটো দেহ একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, পা বা মাথা বেরিয়ে পড়ত।

একই ভঙ্গিতে, শরীর টান টান করে স্যাডলে বসে এগোচ্ছে ও। বাম হাতে দুটো ঘোড়ার লাগাম, কি হোলস্টারের বাকলের ওপর স্থির হয়ে আছে ডান হাত। মুখ নির্বিকার কিন্তু চোখে সতর্ক চাহনি, সোডা স্প্রিং যে ওর জন্যে বিপজ্জনক জায়গা সেটা গতকালই প্রমাণিত হয়েছে। কারও কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করছে না, বরং তা এলেই বিস্মিত হবে।

সোডা স্প্রিং-এর অধিবাসীদের কারোই বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর প্যাকহর্সের পিঠে কি জিনিস রয়েছে, কিন্তু কাউকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী মনে হলো না, এমনকি একটা প্রশ্নও করল না কেউ। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দেখল কয়েক সেকেন্ড, তারপর বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেল। অবস্থা দেখে ছেলেবেলার প্রিয় একটা খেলনার কথা মনে পড়ল শেভার্নের একটা ঘড়ি ছিল ওর, ঘন্টা দেয়ার সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত একটা কোকিল, কয়েক ডাক দিয়ে ফের সেঁধিয়ে যেত গোপন কুঠরিতে।

কিন্তু ঘড়ির কোকিলের মত, এই মানুষগুলোর যে কেউ ডাক না দিয়ে একটা রিপিটার থেকে তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দিতে পারে ওর উদ্দেশে। যে কোন খেলার মতই, দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে এভাবে এগোনোর মধ্যে মোলো আনা ঝুঁকি আছে-টোপ হিসেবে কাজ করছে এ শহরের দুজন লোকের মৃতদেহ। কিন্তু এও সত্যি স্রেফ সামান্য জুয়াড়ী বা ঝামেলাবাজ লোক এরা, সাধারণ মানুষের কোন সহানুভূতি এদের প্রতি না থাকারই কথা।

কিন্তু ওদের একজন একেবারেই তরুণ। সতেরো বছরের একটা ছেলে কতটা বিতৃষ্ণা অর্জন করতে পারে? সম্ভব, ক্যাম্পাসের কনফেডারেট পন্থী প্রভাবশালী র‍্যাঞ্চার উইলিয়াম রেনারের কথা মনে পড়ে যেতে আনমনে হেসে উঠল শেভার্ন, গৃহযুদ্ধের সময় অনেকেই এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, এক জীবনে যতটা না শত্রুতা সৃষ্টি করা সম্ভব, এক বছরে তাই করেছে। কিন্তু ওর সন্দেহ সোডা স্প্রিং-এর অধিবাসীরা সামান্য এক তরুণকে খুন করার দায়ে খেপে গেলেও ওকে হাসতে দেখলে ঠিকই বিদ্বেষ বোধ করবে। স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় করা খুনও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয় মানুষ, যদি সাথে আনুষ্ঠানিকতা বা গাম্ভীর্যের ভান থাকে।

স্টোর আর বাড়ির সামনের বোর্ডওঅক ধরে এগোচ্ছে কেউ, পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল। গতিপথ না বদলে এগোতে থাকল শেভার্ন, লোকটার পায়ের শব্দ শুনতে পেলেও হৃক্ষেপ করছে না। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ওর সমান্তরালে এগোচ্ছে লোকটি-ছোটখাট গড়ন, তরুণই বলা উচিত। যে কাজেই ছুটছে ছেলেটা, নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না। এভাবে ফিরে আসা ঠিক হয়নি, আবারও উপলব্ধি করল শেভার্ন। কোন চিহ্ন না রেখে বিদায় নিতে চেয়েছিল, কি পরিস্থিতি মোটেই সাহায্য করছে না ওকে।

যদি পানির জন্যে সোডা স্প্রিং-এ ফেরত না-ও আসত, কেউ অনুসরণ করলে লাইমি বিরক্ত হয় সেটা দেখানোও অপরিহার্য ছিল বোধহয়। তবে ভিন্ন। একটা উপায়ও ছিল, লোকগুলোর মাথা ছিলে রেখে গেলেই চলত। অ্যাপাচীদের ভাগ্যেই যত বাহবা জুটত। এবং মরা মানুষের ঘোড়া নিয়ে অন্য শহরে পৌঁছতে সরোষে নিজের উদ্দেশে বিদ্রূপ করল শেভার্ন।

আনমনা হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই, ব্যাপারটা শঙ্কিত করল ওকে। আগেও এমন ঘটেছে, এবং অন্য লোকের ভাগ্যে এই অবহেলার করুণ পরিণতি ঘটতে দেখেছে ও। খুন করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে মানুষ, শেষ একটা ভুল করে বসে, প্রায়শই সেটা হয় ইচ্ছাকৃত। লাগাতার সাফল্য একই সঙ্গে অহঙ্কারী ও বেপরোয়া করে তোলে মানুষকে, ভুল ধারণা চেপে বসে মনে-সবকিছুই উৎরে যাবে কোন না কোন উপায়ে। পরোয়াহীন মানুষ প্রায় কফিনের কাছাকাছি বাস করে।

কিন্তু পরোয়া করে শেভার্ন। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ছেলেটার কাছে কোন পিস্তল নেই। অন্যদের মত ভান করছে না সে, শেভার্ন বা প্যাকহর্সের জোড়া লাশ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। নিজের চামড়ার ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া লাশ দুটো পৌঁছে দেওয়ার অন্য কোন সহজ পথ আছে কি-না, আনমনে ভাবল শেভার্ন। নে, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও। মৃত মানুষের ঘোড়া রাইড করতে হলে লোকটি কিভাবে মারা গেছে সেটা প্রথম সুযোগেই স্পষ্ট করা উচিত। ১৩-দুভোগ

গোল্ডেন ঈগলের সুইং ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক, নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। ছেলেটা তাকে পেরিয়ে যেতে দৃষ্টি সরে গেল লোকটির। সতর্ক দৃষ্টিতে সেলুনটা জরিপ করল শেভার্ন, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ওখান থেকে কোন বিপদ আসবে না।

কি চায় ছেলেটা, নিজেকেই খুন করতে চাইছে? শেভার্ন আশা করছে আচমকা নায়ক হওয়ার খায়েশ হবে না কারও, এবং তারচেয়েও বেশি আশা করছে শেরিফের অফিস খুঁজে পেতে দীর্ঘ রাস্তার সবটুকু পাড়ি দিতে হবে না। ওকে।

অন্তত একটা প্রত্যাশা পূরণ হলো ওর, মেরুদণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে সোডা স্প্রিং-এর দীর্ঘ রাস্তার শেষ পর্যন্ত যেতে হলো না ওকে। আরও কয়েক গজ এগোনোর পর অফিসটা দেখতে পেল। দর্জি আর স্যাডলারির মাঝখানে সেটা, ভাঙা ফলস-ফ্রন্টের ফাঁক দিয়ে ডোবের কিনারা উঁকি দিচ্ছে। আড়চোখে দেখল শেরিফের অফিস থেকে কয়েক বাড়ি আগেই থেমে গেছে ছেলেটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যাডল ত্যাগ করল ও। রেইলে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ডেস্কের পেছনে মাঝবয়সী এক লোক বসে আছে। পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল সে, চোখে বিস্ময়। কিন্তু শেভার্ন জানে পুরোটাই ভান। বাজি ধরে বলতে পারবে অতি উৎসাহী অন্তত একজন কোকিল কুঠুরি ছেড়ে পেছন দরজা দিয়ে এখানে এসে ওর আগমনের সংবাদ ঠিকই পৌঁছে দিয়েছে শেরিফের কাছে। ঘোড়াগুলোকে স্রেফ হটিয়ে নিয়ে এসেছে ও, ওর আগেই পৌঁছতে পারবে যে কেউ।

কি করতে পারি তোমার জন্যে? নিরুত্তাপ স্বরে জানতে চাইল শেরিফ।

এই ভদ্রলোকদের কাউকে চেনো তুমি? নির্বিকার মুখে জানতে চাইল শেভার্ন, দরজা পথে প্যাকহর্সের বোঝর দিকে ইঙ্গিত করল।

এবার যেন শহরের লোকজন বুঝতে পারছে প্যাকহর্সে সামান্য কোন বোঝা নেই! তাড়িঘড়ি দরজার দিকে এগোল ল-ম্যান, এতটা ক্ষিপ্রতা শেভার্নও আশা করেনি। অফিস থেকে বেরিয়ে হিচিং র্যাকের কাছে চলে গেল সে, প্যাকহর্সের চারপাশে ভিড় করা অতি উৎসাহী কিছু বাচ্চাকে খেদিয়ে দিল। কম্বল সরিয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখ দুটো দেখল মুহূর্ত খানেক, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরল ওর দিকে। হ্যাঁ, চিনি।

কি ধরনের লোক ছিল ওরা?

তোমার মত।

নিরপরাধ পথচারীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাইনি আমি, কিংবা অন্যের ঘোড়া নিকেশ করার অভ্যেসও নেই আমার। স্থির দৃষ্টিতে শেরিফকে নিরীখ করল শেভার্ন। আমাকে খুন করতে পারলেই বোধহয় খুশি হত ওরা, চেষ্টায় গাফিলতিও ছিল না। কিন্তু আমার ঘোড়ার ওপর দিয়েই যত ঝামেলা গেছে। তোমার কাছে নিশ্চই পরিষ্কার হয়েছে লড়াইটা আত্মরক্ষার খাতিরেই করতে হয়েছে আমাকে?

প্রয়োজন নেই, ক্লান্ত স্বরে বাধা দিল শেরিফ। তোমার মত টিনহর্নরা কে কাকে খুন করল তাতে কিছু যায়-আসে না আমার। নিরপরাধ কোন লোককে যখন নিয়ে আসবে তখন দেখবে কি করি!

এটা আশা করেনি শেভার্ন। আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করছ না?

না। যে ঘোড়ায় চড়ে শহর ছেড়েছ তুমি, ওদের মাসট্যাঙগুলোর সাথে তার কোন পার্থক্য নেই, গুরুত্বও নেই। আমার ধারণা আইন ভাঙোনি তুমি। আবারও লাশ দুটো পরীক্ষা করল সে, তারপর সশব্দে তামাকের রস ফেলল মাটিতে। মনে হচ্ছে ওরা মারা যাওয়ায় তোমার মতই সোডা স্প্রিং-এরও কিছুটা লাভ হয়েছে।

রাস্তার ওপাশে ফাইন ফার্নিচার অ্যান্ড ফিউনেরালস শপ। পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন লোক, একটা কফিন ধরে রেখেছে। শেরিফ নড়া করতে এগিয়ে এসে প্যাকহর্স থেকে লাশ নামাল তারা। লাগাতার একই অবস্থানে পড়ে থাকায় শক্ত হয়ে গেছে মৃতদেহ, ঘোড়ার খুরের মত বাঁকা হয়ে গেছে। কফিনে ঢোকানো সহজ হলো না। একসময় লাশ নিয়ে কেটে পড়ল লোক দুটো, ধমকে উৎসুক বাচ্চাদের আবারও দূরে সরিয়ে দিল শেরিফ।

ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো সে, স্থির দৃষ্টিতে জরিপ করছে শেভার্নকে। নীরবতা ভাঙছে না কেউই।

পুরো একটা দিন নষ্ট হলো আমার, শেষে মন্তব্য করল শেভার্ন।

উত্তর দিল না শরিফ।

কোন সাক্ষ্য বা বিবৃতি দিতে হবে?

না। ওদের বা তোমার, কারও অভাবই বোধ করবে না এই শহর। সোড়া স্প্রিং-এর চৌহদ্দিতে তোমার ছায়াও যদি আর না দেখি তাহলে বলতে হয়, ঝামেলা চুকে গেছে।

বহুদিন পর এভাবে শেভার্নের সাথে কথা বলল কেউ জানে ভ্রুক্ষেপ না। করাই উচিত, কিন্তু শেরিফের ঔদাসীন্য ত্যক্ত করছে ওকে। ভাবছিলাম…

কি ভাবছ আবার?

সত্যিই ঝামেলা চুকে গেছে কি-না।

ওদের কিছু বন্ধু আছে অবশ্য। কয়েকটা দিন ঘোরাঘুরি করো, দেখবে ঠিকই তোমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওরা।

তেমন কিছু ভাবছি না আমি, শেভার্ন জানে মুখ বন্ধ রাখা উচিত ওর। গ্রাহ্য করলেই হয়, কিন্তু মোটা গোঁফের ল-ম্যান অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত করছে ওকে, এতটা যে নিজের কাছেই মানতে পারছে না। এরকম বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে শেরিফ হিসেবে তোমার আচরণ সত্যিই আন্তরিক! একজন আগন্তুককে যেহেতু পক্ষপাতই দেখাচ্ছ, আশা করি কয়েকটা সুবিধাও দেবে আমাকে?

বলে যাও।

ধরে নিচ্ছি চলে যেতে অসুবিধে নেই আমার। নিশ্চই বুঝতে পেরেছ পানি বা সাপ্লাই দরকার না হলে লাশগুলো ফেরত দিতে আসতাম না আমি। সাপ্লাই জোগাড় করার আগে শহর ছাড়ছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চই শহরের লোকজনের পেশের মুখোমুখি হতে হবে। এ অবস্থায় আমাকে কোন পরামর্শ দিতে পারো?

তেমন কিছু মাথায় আসছে না আমার।

তাই? হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে রেইল থেকে লাগাম খুলতে শুরু করল ও। পাত্তা দিয়ো না, বেটা ভুড়ো ভামকে পাত্তা দেয়ার দরকার কি? শহর ছেড়ে চলে যাও! এক ধরনের অনীহা পেয়ে বসেছে ওকে, কিন্তু শেরিফের পরবর্তী মন্তব্যে সেটাও চলে গেল-উল্লাস বোধ করল শেভার্ন।

আসলে তুমি কি চাও, লাইমি? থমথমে মুখে জানতে চাইল শেরিফ।

 টিনহর্ন বলে ডেকো আমাকে। তুমিই যেহেতু নামটা দিয়েছ…

 বাজে প্যাচাল বন্ধ করো!

আমাকে তাড়ানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহী মনে হচ্ছে তোমাকে, যেন ভয়ে ভয়ে আছ পাছে কোন কিছু আবিষ্কার করে বসি কি-না।

সরু হয়ে গেল শেরিফের চোখ। আসলে তুমি কি চাও?

রিওয়ার্ডের টাকা।

শেরিফের চোখে-মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল শেভার্ন-প্রসঙ্গটা এখনই চেপে যাওয়া উচিত, এবং দুই জুয়াড়ীর জন্যে কোন রিওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়নি।

নিচু স্বরে কিন্তু শুনতে অসুবিধে হবে না এমন ভাবে বিষোগার করল শেরিফ। তুমি তো দেখছি আস্ত হারামী! ঘন্টা খানেকের মধ্যে এই শহরের। লোকেরা হয়তো মত বদলে একটা নেক-টাই পার্টির আয়োজন করে ফেলবে, তার আগেই সাপ্লাই নিয়ে কেটে পড়ছ না কেন?

স্যাভলে চেপে বসল শেভার্ন। হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে আলতো ভাবে স্পর দাবাল, মূল রাস্তা ধরে মার্কেন্টাইল স্টোরের দিকে এগোল ঘোড়া দুটো।

একবারের জন্যেও সরাসরি ওর দিকে তাকাল না টেকো দোকানি, ওকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে তার, যেন আশা করছে ছুটে এসে স্টোরে ঢুকবে কেউ। যত দ্রুত সম্ভব সাপ্লাই সগ্রহ করল শেভার্ন, এ নিয়ে একই জিনিস দুবার কিনতে হয়েছে ওকে। কিন্তু দুটো ঘোড়া নিয়ে রাইড করবে ও এবার, দেখা যাবে গ্রে-র চেয়ে স্থানীয় এই ঘোড়াগুলো দ্রুত ছুটতে পারে কি-না।

গ্রীন রীডারের এক বোতল পানি কিনল ও। এক হাতে প্যাকেট ভরা জিনিসপত্র নিয়ে দরজার দিকে এগোনোর সময় আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, তোমাদের শেরিফ কি সৎ লোক?

মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা, করল দোকানি। ইউনিয়নের পক্ষে লড়াই করেছিল মি. বেলহ্যাম।

জিম শেভার্নের জানা মতে বহু পাজি লোকই তাই করেছে। মন্তব্যটা প্রশংসাসূচক বলে ধরে নিল ও। নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হলো এবার, কিন্তু ঘুরে পোর্চে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। পাজি লোকের সমালোচনা করে কার্যত কোন লাভ হয় না। শেরিফ যদি সত্যিই সম্মানিত লোক হয়ে থাকে, তাহলে শেভার্নের পরোক্ষ অপমান বুঝতে অসুবিধে হত না তার, এবং নির্ঘাত উপযুক্ত জবাব দিত। নিকুচি করি এসব ফিটফাট ভদ্রলোকের! হাসিটা ম্লান হলো না ওর, পোর্চ ছেড়ে রৌদ্রোজ্জ্বল রাস্তায় পা রাখল।

মি. শেভার্ন!

ক্ষীণদেহী লোকটি এত আচমকা নড়াচড়া করেছে যে আরেকটু হলে মালপত্রের প্যাকেট ফেলে পিস্তল তুলে নিয়েছিল শেভার্ন। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও। উজ্জ্বল আলোয় চোখ সইয়ে নেওয়ার পর শেরিফের কথার সত্যতা উপলব্ধি করল-আরেকটু হলে সদ্য কৈশোর পেরুনো এক তরুণকে গুলি করে বসত। খুব বেশি হলে সতেরো হবে বয়েস, ভাল করে দাড়ি-গোঁফও গজায়নি। কি ব্যাপার, বাছা, মৃদু স্বরে জানতে চাইল ও। কি হয়েছে?

তোমার হয়ে ঘোড়াগুলোর ওপর নজর রাখছি আমি।

কিন্তু হিচিং রেইলটা যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে এই কাজ করছে, নিরুত্তাপ সুরে বলল শেভার্ন। এই ছেলেটাই একটু আগে বোর্ডওঅক ধরে শেরিফের অফিসের দিকে ছুটছিল। রাস্তার দুদিকেই সতর্ক দৃষ্টি চালাল ও, দ্রুত হাতে প্যাকহর্সের স্যাডল ব্যাগে জিনিসপত্র ঢোকাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওর ব্যাপারে মুখ খোলেনি শেরিফ, অন্তত শহরের কাউকে প্ররোচিত করেনি। কে যে কাকে ভুল বুঝেছে, আনমনে ভাবল শেভার্ন।

মালপত্র গুছিয়ে দেখল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। বিরক্তি লাগছে শেভার্নের, তরুণের গায়ে পড়া ভাব পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু আরেকবার পিস্তল নিয়ে কোন তরুণের মুখোমুখি দাঁড়ানোরও ইচ্ছে নেই। পকেট। থেকে দুটো কয়েন বের করে ছুঁড়ে দিল ও।

না, স্যার,কয়েন দুটো ফেরত দিয়ে দিল ছেলেটা।

স্যাডলে চেপে বসেছে শেভার্ন। তাহলে কি চাও তুমি?

তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও আমাকে।

আমার সঙ্গে! কোথায়?

 যেখানে খুশি-এখান থেকে চলে যেতে পারলেই হলো!

ওহ, জেসাস! তেত্রিশ চলছে শেভার্নের, ছেলেটার বয়সে নিজে কেমন ছিল। প্রায় ভুলতে বসেছে-কয়েকটা যুদ্ধ ওর তারুণ্যের অস্থিরতাকে প্রশমন করেছে। কেন আমার সঙ্গে যেতে চাইছ?

বুশ হ্যারল্ড আর রোয়ান প্যান্টেলকে মেরেছ তুমি, আমার ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছ।

এই প্রথম লোকগুলোর নাম শুনল শেভার্ন। হাসি চাপতে কষ্ট হলো ওর। কোন একদিন নিশ্চই খাঁটি জিনিসে পরিণত হবে এই ছেলে-ততদিন যদি বেঁচে থাকে। প্রায়ই ওর জোড়া কোল্টের দিকে চলে যাচ্ছে ছেলেটার চকিত চাহনি। মনে হচ্ছে পরিবার বলতে কেউ নেই, তোমার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ও। নাকি তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে ওরা, কখনও তোমার চরিত্রের সৎ দিকটা উপলব্ধি করতে পারেনি?

বিস্ফারিত হলো ছেলেটার চোখ। ঠিক!

স্রেফ অভিমান করে এক আগন্তুকের সঙ্গে অজানার পথে পা বাড়াবে? নীরস একঘেয়ে জীবন ছেড়ে চলে যেতে চাইছ, কিন্তু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মুছে শেষে বিপজ্জনক এক পেশায় নাম লেখাবে?

হাঁ হয়ে গেছে ছেলেটার মুখ, মুখে কথা সরছে না।

রাস্তা ধরে ল-অফিসের দিকে তাকাল শেভার্ন, পুরো শহরের ওপর তীক্ষ্ণ নজর চালাল ফের। মনে পড়ল শহরের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন বিপদ হয়নি ওর, শুধু অভব্য শেরিফ সামান্য অপমান করার চেষ্টা করেছে ওকে। নিজস্ব ঘোড়া আর অস্ত্র আছে তোমার?

নড করল তরুণ।

স্যাডল এবং আর সব জিনিসপত্র?

এবার আর ততটা আত্মবিশ্বাসের সাথে নড় করল না ছেলেটা। তার মানে-শেভার্নের ধারণা-জিনিসগুলো কোত্থেকে চুরি করবে জানা আছে তার। পকেট থেকে ফের কয়েন দুটো বের করে তরুণের উদ্দেশে ছুড়ে দিল ও। একটা খাম আর এক তা কাগজ নিয়ে এসো।

মুহূর্তের মধ্যে কাজ সেরে মার্কেন্টাইল স্টোর থেকে ফিরে এল তরুণ। কাগজে লিখতে গিয়েও মত বদলে ফেলল শেভার্ন, কোটের পকেট থেকে একতাড়া তাস বের করে একটার ভেতরের পিঠে নোট লিখল, তাসটা খামে ভরে মুখ বন্ধ করে দিল। শেরিফ জেসনকে দিয়ে এসো এটা, ছেলেটার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলল ও। ফিরে এসে যোগ দিয়ে আমার সঙ্গে।

প্রথমে আনন্দিত হলেও, শেষে দ্বিধা দেখা গেল তরুণের চাহনিতে। আমি কি এখনই আসতে পারি না?।

আগে নোটটা দিয়ে এসো, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ও। একটা ঘোড়ায় রাইড করবে তুমি। অনায়াসে আমাকে ধরে ফেলতে পারবে।

বিষণ্ণ মুখে নড করল ছেলেটা, তারপর ল-অফিসের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল। স্পর দাবিয়ে এগোল শেভার্ন, ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেল শহর ছেড়ে। সকাল নটা বাজে তখন।

কেউ পিছু নিচ্ছে কি-না জানা নেই ওর, তবে সূর্য আছে ওর পেছনে। আগামী চার ঘণ্টায় যাত্রাপথে কোথাও ছায়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অন্তত আশা করছে না শেভার্ন। লিভারি স্টেবলের সামনে থেমে ক্যান্টিন ভরার ফাঁকে ঘোড়াগুলোকে পর্যাপ্ত পানি পান করার সুযোগ দিল। দূরে ল-অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ছেলেটা, শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল ও। চার ঘণ্টা পর সূর্যের অবস্থান বদলে যাবে, অন্তত সরাসরি ওর পিঠে অত্যাচার করতে পারবে না আর। বিকেল নাগাদ টানা এগোনোর ইচ্ছে আছে ওর।

নিকুচি করি কাঠখোট্টা শেরিফের! কি করে এতটা উদ্ধত হয় সে? অবশ্য ল ম্যান যে পুরোপুরি ভুল করেছে তা বলা যাবে না। আইন পড়া জিম শেভার্ন কি ধরনের মানুষ, বা ওর ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছে জানছে কে!

একটা শিশু নিখাদ সারল্য আর নিষ্পাপ মুখচ্ছবি নিয়ে জন্মায়, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সে মুখটা বদলে যায়যা হওয়া উচিত, তাই হয়-কর্মফলের বহিঃপ্রকাশ।

তেত্রিশ চলছে আমার, নিজের বিবেকের সাথে তর্ক করল শেভার্ন।

যথেষ্ট কাছাকাছি, বলল ওর সত্তা।

কিন্তু আমি কোন টিনহর্ন নই।

উঁহু, বরং তারচেয়ে খারাপ।

কারণটা যুদ্ধ। একজন দেশপ্রেমিক ছিলাম আমি।

পাজি লোকের মল মাত্র, ড. জনসনের উক্তির প্রতিধ্বনি করল ওর বিবেক।

এখনও হইনি, স্বস্তির ব্যাপার অতীত জীবনের কিছু মানবীয় গুণাবলীর ছাপ রয়ে গেছে ওর মুখে। এবার সামলে নেওয়ার সময়, থিতু হওয়ার পালা। মানব গোষ্ঠীর সাথে শামিল হওয়ার উপযুক্ত সময়, পরিণতি ভাল বা মন্দ যাই হোক। হয়তো একটা সুযোগ পাবে ও।

ফেরার পথে অনেক কম বোঝা বইতে হচ্ছে মাসট্যাঙটাকে, ওর গ্রে-টা এরচেয়ে বেশি ওজন নিয়ে চলেছে। কিন্তু বেটা যেন মরুভূমির প্রখর তাপ উপভোগ করছে খুব। আর প্যাকহর্সটা ঠিক উল্টো মেজাজের, সকালে দুটো লাশ বয়ে নিয়ে গেছে ওটা, কিন্তু একবারের জন্যেও লীড রোপে টান পড়তে দিচ্ছে না। ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল শেভার্ন। ট্রেইল আর শহর দুটোই চোখে পড়ছে। তরুণের চিহ্নও নেই।

একটা লড়াই কি যথেষ্ট নয়?

যথেষ্ট, যদি আমরা জিততে পারি, জবাবে বলল শেভার্ন।

 এখানেও কি দেশপ্রেমিক ছিলে তুমি?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। ইদানীং প্রায়ই তর্কে হেরে যাচ্ছে। আজকে অন্তত ভাল একটা কাজ করেছি, সাফাই গাইল ও।

পেছনে, সোডা স্প্রিং-এ ওর ভাল কাজের নমুনা তখন ফলতে শুরু করেছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে তরুণ, বুঝতে পারছে না জিম শেভার্নের পিছু নেবে নাকি শেরিফের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বোনকে খুলে বলবে সব। লোকটার পিছু নিলে ঘোড়া চুরি করতে হবে, আবার শেরিফের প্রস্তাব মানলে নিজের ইচ্ছেকে গলা টিপে হত্যা করতে হবে।

ক্রমে খেপে উঠছে সে। সবকিছু বড় অস্বাভাবিক, অন্যায্য মনে হচ্ছে। ওর সম্পর্কে নোটে কি লিখেছে মি. শেভার্ন? নিশ্চই ডাহা মিথ্যে হবে। শেরিফকে এমন

খেপে উঠতে আর দেখেনি ও, রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ।

তরুণের উদ্দেশে বাঁকা দৃষ্টি হেনে ফের নোটের ওপর চোখ বুলাল শেরিফ জেসন বেলহ্যাম, দ্বিতীয়বারের মত পড়ল নোটটা:

শেরিক দয়া করে তোমার ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন শহরের এই নাগরিককে দেখে-শুনে রেখো, যতক্ষণ না আমার দুষ্ট এবং সংক্রামক সঙ্গ নিরাপদ দুরতে চলে যেতে পারে। আশা করি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে পারবে।
—জিম শেভার্ন

<

Super User