কুকুর খেকো ডাইনী –রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪

০১.

জুনের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। শক্তিশালী। একটা লাল কনভারটিবল গাড়ি চালাচ্ছে রবিন, এখানে আসার জন্যে ভাড়া নিয়েছে গাড়িটা। পাশে বসে তন্ময় হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে কিশোর। দু-ধারে চষা খেত। দূরে দেখা যাচ্ছে পকোনো পর্বতমালার সবুজ ঢাল। পেনসিলভানিয়া ডাচ এলাকার মধ্যে দিয়ে চলেছে ওরা।

পেছনের সীটে বসে ঝিমাচ্ছে মুসা।

হঠাৎ রসিকতার সুরে বলে উঠল রবিন, মুসা, ওই দেখো একটা। সাইনবোর্ড। ডাইনী তাড়ানোর জন্যে বসানো হয়েছে। ডাইনী আছে। এখানে।

চমকে চোখ মেলল মুসা, কই, কোথায়? দেখতে পেল নিজেই। চাষীর এক গোলাঘরের ওপর বিরাট একটা গোল জিনিস। এ রকম গোল কেন?

একে বলে হেকস্ সাইন। ডাইনী আর বজ্রপাতকে তাড়ানোর জন্যে বসানো হয়।

ডাইনী! আজকের দিনে?

কেন, ভূত যদি থাকতে পারে, ডাইনী থাকবে না কেন? কিছু কিছু ডাইনীর ক্ষমতা কিন্তু ভূতের চেয়ে বেশি, মুসাকে ভয় দেখানোর জন্যে বলল রবিন। তোমার গরুকে যদি জাদু করে দেয়, দুধ শুকিয়ে যাবে ওটার, আর দুধ দেবে না। আরও অনেক কুমন্ত্র জানে ডাইনীরা। ওসব শয়তানি যাতে না। করতে পারে সেজন্যেই বসানো হয়েছে ওটা।

ঘুম দূর হয়ে গেল মুসার চোখ থেকে। পরের দুটো গোলাবাড়ির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। নিজেকেই যেন বোঝাল, দূর, কি যে বলো, আজকাল। আর ওসব বিশ্বাস করে না কেউ! এটা বিংশ শতাব্দী। আমাকে আর ভয়। দেখানোর চেষ্টা কোরো না, বুঝলে, আমি এখন আর ডাইনী-ফাইনী বিশ্বাস। করি না।

তাই নাকি? হেসে বলল কিশোর, তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন?

কই পাচ্ছি?

যাই বলো, আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। সত্যি বলেছ, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেও হেক্স সাইন লাগায় লোকে?

খাইছে! দোহাই তোমার, কিশোর, এর মধ্যে আর রহস্য খুঁজো না তো! এই একটিবার অন্তত রক্ষা করো। এই ছুটিতে কোন গোয়েন্দাগিরি করব না আমরা, খাব-দাব আর ঘুরে বেড়াব।

শুধু ঘুরে বেড়ানোর জন্যে তোমাকে এতদূরে এত খরচ করে পাঠানো হয়েছে ভাবছ কেন?

তুমি না বললে বেড়াতে যাচ্ছি আমরা।

বেড়াতেই তো এসেছি, তবে বিনিময়ে একটা কাজ করে দিতে হবে। খামোকা কি আর কেউ কাউকে টাকা দেয়। আর আমরাই বা নেব কেন?

তা তো নেব না। কিন্তু ঘটনাটা কি খুলে বলো তো?

মিস্টার সাইমনের এক বন্ধু ক্যাপ্টেন ডেভিড রিচটনকে সাহায্য করার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাদের। ওই পর্বতের ভেতরে ব্ল্যাক হোলো নামে একটা জায়গায় তার কেবিন।

ক্যাপ্টেন রিচটন? কিসের ক্যাপ্টেন? সেনাবাহিনীর?

না, পুলিশের। পাঁচ-ছয় বছর আগেও পুলিশ চীফ ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন।

হু, বুঝেছি, আমি একটা গাধা! মুষড়ে পড়ল মুসা, এলিয়ে পড়ল আবার পেছনের সীটে, শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। আর কোন কাজ নেই কিছু নেই, শুধু বেড়াতে যাওয়ার এত আগ্রহ কেন তোমার, সেটা আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল আমার। তোমরাও কিন্তু বলোনি আমাকে।

তুমিও তো জিজ্ঞেস করোনি। বেড়ানোর নাম শুনেই লাফিয়ে উঠেছ।

 চুপ হয়ে গেল মুসা। ভিকটর সাইমন যেদিন তিন গোয়েন্দাকে তার বাড়িতে ডেকেছিলেন, সেদিন গ্যারেজে জরুরী কাজ ছিল মুসার। নিজেদের গাড়িগুলো ধুয়েমুছে সাফ করছিল। সেজন্যে যেতে পারেনি। কিশোর আর রবিন গিয়েছিল। বিকেলে খবর জানিয়েছে রবিন, আগামী দিনই নিউ জারসিতে রওনা হচ্ছে ওরা। খরচ-খরচা সব মিস্টার সাইমন বহন করবেন। বোকার মত সে ভেবেছিল, শুধু বেড়াতেই বুঝি যাওয়া হচ্ছে। তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আর কি কি জানো বলে ফেলো তো?

আর? অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটছে ব্ল্যাক হোলোতে। এ কথা মিস্টার সাইমনকে লিখে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন রিচটন। সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। তাঁকে। কিন্তু তিনি এখন ভীষণ ব্যস্ত, আরেকটা অত্যন্ত জরুরী তদন্ত করছেন। ব্ল্যাক হোলোতে যাওয়া এখন তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সেজন্যেই আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন…

তার দায়িত্বটা আমাদের ঘাড়ে চাপানোর জন্যে!

তোমার কি খুব রাগ হচ্ছে? খোঁচা দিয়ে বলল রবিন। বলো তো ফিরে যাই। কি বলো, কিশোর?

কিশোর হাসল। তাড়াতাড়ি মুসা বলল, না না, যাওয়ার আর কি দরকার, এসেই যখন পড়েছি। তা ছাড়া এতগুলো খাবার-দাবার কিনে আনলাম। সব নষ্ট হবে।

ঝলমলে বিকেল। প্যানসিলভানিয়া ডাচের চমৎকার উপত্যকা ধরে চলছে গাড়ি। সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে। পেছনে পড়েছে চাষের খেত। এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পথ, পাহাড়ের ঢালের গভীর বনের দিকে। এখানে ওখানে সবুজের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছে ধূসর পাথরের চাঙড়।

পর্বতে ঢুকলাম, ঘোষণার মত করে বলল রবিন।

একটা শৈলশিরা পেরিয়ে এসে হঠাৎ করে নেমে গেছে পথটা, পরের পাহাড়শ্রেণীতে পৌঁছে আবার সোজা উঠেছে। সামনে তাকিয়ে আছে কিশোর। বাড়িঘর চোখে পড়ল, একটা শহর।

আচমকা কানে এসে লাগল লাউড-স্পীকারে বাজানো মিউজিক আর কথার শব্দ। কান খাড়া করে ফেলল তিনজনেই, কোথা থেকে আসছে দেখার চেষ্টা করল।

দেখে ফেলেছি! বলে উঠল মুসা। কান ও চোখের ক্ষমতা অন্য দু-জনের চেয়ে তার বেশি।

ররিন আর কিশোরও দেখল, একসারি তাঁবু। উজ্জ্বল রঙের ব্যানারে লেখা রয়েছেঃ

হ্যারিজ কার্নিভ্যাল

এই, থামো তো, মুসা বলল। এদিকের কার্নিভ্যাল দেখার শখ আমার অনেক দিনের। পপকর্নের গন্ধও পাচ্ছি। টেস্টটা দেখি কেমন।

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। হেসে মাথা ঝাঁকাল গোয়েন্দাপ্রধান।

গাড়ি পার্ক করে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। কান ঝালাপালা করে ঝমঝম বাজছে মিউজিক, সেই সঙ্গে ঘোষকের চিৎকার, কোলাহল। প্রচুর দর্শকের ভিড়। বনবন ঘুরছে নানারকম নাগরদোলা, বিচিত্র ওগুলোর নাম–হুঁইপ, অকটোপাস, ম্যাড় হর্স। ওগুলোতে বসা মানুষগুলো সমানে চেঁচাচ্ছে, বাচ্চা বুড়োতে কোন ভেদাভেদ নেই। একপাশে অনেকগুলো স্টল, চিৎকার করে ক্রেতা ডাকছে মালিক আর সেলসম্যানেরা।

অন্য কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা একটা খাবারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। কিনল এক কার্টন পপকর্ন, এক ব্যাগ পানাট, একগাদা ক্যান্ডি।

একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে রবিন বলল, ওই ভাবুটাতে ঢুকলে কেমন হয়?

মুসা আর কিশোরও পড়ল সাইনবোর্ডটাঃ

কর্নেল ডুম হুমবা
নির্ভীক অ্যানিমেল ট্রেনার

মাশাআল্লাহ! পপকর্ন চিবাতে চিবাতে বলল মুসা, নাম বটে। জন্তুর শিক্ষক যখন, হুমবা না রেখে হামবা রাখলেই হত, গরু, মানাত ভাল।

তাঁবুর ভেতর থেকে হিংস্র জানোয়ারের ডাক শোনা গেল। তারমানে বাঘ-সিংহ জাতীয় কিছু আছে। হুমবা কতটা নির্ভীক দেখার জন্যে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। এ

গোলাকার তাঁবুর কেন্দ্রে একটা গোল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আঁটসাট সাদা পোশাক পরা একজন মানুষ, পায়ে গোড়ালি ঢাকা চকচকে কালো বুট। ঘন, ঝাঁকড়া কালো চুল, পুরু গোঁফ, মোটা ভুরু, তীক্ষ্ণ চোখ, হাতে কালো লম্বা চাবুক যেন কর্তৃত্ব জাহির করছে। এর দরকারও আছে, কারণ কাছেই একটু পর পর সাজানো ছোট টুলে তাকে ঘিরে বসে আছে চারটে ভয়ানক জন্তু, দুটো হলদেটে, আর দুটো কালো। চারটেই জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লম্বা লেজের মাথা থিরথির করে কাঁপছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে। মানুষকে পছন্দ করে না ওরা।

পুমা, নিচু স্বরে বলল রবিন। কি বিরাট দেখেছ!

সপাং করে উঠল চাবুক। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরছে ট্রেনারের শক্তিশালী দেহটা, প্রতিটি জানোয়ারকে টুল থেকে নেমে আবার লাফিয়ে উঠে বসতে বাধ্য করছে।

নাহ, লোকটা সত্যি নির্ভীক, প্রশংসা না করে পারল না কিশোর। যে ভাবে পেছন করে দাঁড়াচ্ছে জানোয়ারগুলোকে, ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে দেখতেই পাবে না।

কিন্তু ভুল অনুমান করেছে সে। একটা কালো পুমা লাফিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হলো। এক্কেবারে সময়মত কি করে টের পেয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল ট্রেনার, হিসিয়ে উঠল চাবুক, থমকে গেল জানোয়ারটা, লাফ দেয়া আর হলো না।

খাইছে! এ তো সাংঘাতিক মানুষ! বলে উঠল মুসা।

হ্যাঁ, পাশের সীটে বসা অপরিচিত একজন দর্শক বলল, সাহস আছে। এখনও বুনোই রয়ে গেছে জানোয়ারগুলো, ওগুলো নিয়েই খেলা দেখাচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে আরেকটা ছিল, হলুদ রঙের, এমন শয়তানের শয়তান, হুমবাও বাগ মানাতে পারেনি। একদিন আরেকটু হলেই দিয়েছিল ঘাড় মটকে, শেষমেষ ওটাকে বিদেয় করতে হয়েছে।

অবাক হয়ে হুমবার খেলা দেখল তিন গোয়েন্দা। তারপর তার প্রশংসা করতে করতে বেরোল তাঁবু থেকে। আবার চড়ল গাড়িতে।

.

দুই ঘণ্টা পর, শেষ বিকেলে খাড়া কাঁচা রাস্তা বেয়ে উঠে চলল ওপর দিকে লাল গাড়িটা। দু-পাশের বনের গোড়ায় তখন কালো ছায়া পড়েছে।

মনে হচ্ছে ঠিক পথেই যাচ্ছি, কিশোর বলল। তবু, শিওর হওয়া দরকার। ওই যে একটা বাড়ি।

বাড়িটার সামনে এনে গাড়ি থামাল রবিন। অনেক পুরানো, কাঠের তৈরি ঘর। সামনের বেড়ার রঙ উঠে গেছে বহু আগে। নীরব, নির্জন।

কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, আশপাশটা দেখতে দেখতে বলল রবিন। কুকুর খেকো ডাইনী

গেটের দিকে এগোল তিনজনে। হাত তুলে বাড়ির পাশে গাছপালার ভেতর দিয়ে যাওয়া একটা রাস্তা দেখাল কিশোর। ওই যে, মানুষ আছে।

রোগাটে, ছোটখাট একজন মহিলা বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। হাত ধরে টেনে আনছে বছর সাতেকের একটা ছেলেকে। চিৎকার করে, কাঁদছে ছেলেটা। গোয়েন্দাদের দেখে এগিয়ে এল মহিলা, আমি মিসেস ভারগন। তোমাদেরকে তো কখনও দেখিনি? কি চাও?

এটা কি রিম রোড? জানতে চাইল কিশোর। ক্যাপ্টেন রিচটনের বাড়িটা খুঁজছি।

রঙ ফ্যাকাসে হয়ে আসা একটা সুতার পোশাক পরেছে মহিলা। আরেকটু এগিয়ে এসে ভালমত দেখল ছেলেদের। রিচটন? সোজা সামনে, পথের মাথার শেষ বাড়িটা। একেবারে ব্ল্যাক হোলোর কিনারে বলে আরেকবার দেখল ছেলেদের।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, কাঁদছে কেন ও? মন খারাপ? এই বাবু, একটা চকলেট খাবে? নাও।

কোন লাভ হবে না, মিসেস ভারগন বলল, ওর কান্না থামবে না। কাল রাতে ওর কুত্তা হারিয়ে গেছে। ওটা না পাওয়া পর্যন্ত আর কোন কিছু দিয়েই বন্ধ করা যাবে না।

তাই নাকি? দেখলে জানাব। কি কুকুর?

এই ছোট জাতের, বাদামী রঙ। একটা কান সাদা। গলায় কলার পরানো। তাতে ট্যাগে নাম লেখা আছে, ডব।

যাওয়ার জন্যে ঘুরল ছেলেরা। শুনতে পেল, ছেলেটাকে ধমক দিয়ে। মিসেস ভারগন বলছে, পটি, তুই কান্না থামাবি! মরে যাবি নাকি একটা কুত্তার জন্যে! তারপর আবার ডাকল গোয়েন্দাদের, এই, শোনো।

তা কিছুটা অবাক হয়েই ঘুরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। গেটের কাছে এসে দাঁড়াল মহিলা। এদিক ওদিক তাকিয়ে, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, তোমরা এখানে নতুন, বুঝতে পারছি। সাবধান করে দেয়া দরকার। ব্ল্যাক হোলোর কাছে যেয়ো না।

কৌতূহলী হয়ে উঠল কিশোর, কেন?

জায়গাটা ভাল না। ডাইনীর আসর আছে। দুশো বছর আগে এখানকার এক সুন্দরী মেয়ে ডাইনী হয়ে যায়। কুত্তা দেখতে পারত না সে, মন্ত্র পড়ে ওগুলোকে গায়েব করে দিত। তারপর কি যে করল কে জানে, জোয়ান জোয়ান মানুষগুলো হঠাৎ অসুখ হয়ে মরে যেতে শুরু করল।

ঘাবড়ে গেছে মুসা। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কেউ কিছু করতে পারল না তার?

চেষ্টা কি আর কম করেছে। লোকে ধরে আটকে রেখে দিল ডাইনীটাকে। ভাবল, এইবার শয়তানি বন্ধ হবে। কিন্তু তা কি আর হয়। একদিন উধাও হয়ে গেল সে, ঢুকে পড়ল গিয়ে ব্ল্যাক হোলোর কাছে বনে।

রাতে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াত গায়ের পথে পথে, মন্ত্র পড়ে গরুকে শুকিয়ে মারত, কুত্তা ধরে নিয়ে যেত, আর ফিরে আসত না ওগুলো। লোকের ধারণা, কুত্তা খেত ডাইনীটা। আরও যত রকমের শয়তানি আছে করত। তারপর এক রাতে ভয়ানক চিৎকার শোনা গেল। গায়ের সবচেয়ে সাহসী দু-চারজন লোক গিয়ে দেখল, একজায়গায় একটা গর্ত হয়ে আছে। মাটি পুড়ে কালো হয়ে। গেছে।

কি-ক্কি হয়েছিল! ভয়ে তোতলাতে শুরু করল মুসা।

লোকের ধারণা, স্বয়ং শয়তান বেরিয়ে এসে ডাইনীটাকে ধরে নিয়ে। গেছে মাটির তলে! ভয়ে ভয়ে আবার এদিক ওদিক তাকাল মিসেস ভারগন। এর প্রায় একশো বছর পর আবার রহস্যজনক ভাবে কুত্তা হারাতে আরম্ভ করল। গর্তটার কাছে রাতে শোনা যেতে লাগল ডাইনীর চিৎকার। যেমন হঠাৎ করে আরম্ভ হয়েছিল, কিছুদিন পর আবার হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। আরও একশো বছর পর এখন আবার যখন কুত্তা হারাতে শুরু করেছে, রাতে চিৎকার শোনা যায় শোনো, তোমাদেরকে ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে আমার, সেজন্যেই সাবধান করছি, নইলে আমার কি।

 নিগ্রো ছেলেটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখল মিসেস ভারগন। শ্বেতাঙ্গ ছেলেটার বিশেষ কোন ভাবান্তর হলো না। আর তৃতীয় ছেলেটার চোখ জুলজুল করছে।

বাড়ির ভেতরে টেলিফোনের শব্দ শোনা গেল।

কে আবার করল? যাই, দেখি। ভেবেছিল, ডাইনীর কথা শুনে ভয়ে একেবারে কাবু হয়ে যাবে ছেলেগুলো, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাবে। হলো না। দেখে খানিকটা হতাশই হলো মহিলা। ভোতা স্বরে বলল, আমার সাবধান করা দরকার করলাম, শোনা না শোনা তোমাদের ইচ্ছে।

.

০২.

আমার রোম খাড়া করে দিয়েছে। মুসা বলল।

লো গীয়ারে গাড়ি চালাচ্ছে রবিন, ওপরের দিকে উঠছে। তুমিই না তখন বললে এই যুগে আর ডাইনী-ফাইনী বিশ্বাস করে না কেউ, তুমিও কোরো না।

কিন্তু এ জায়গাটা ভাল না। বলা যায় না, এখানে থাকতেও পারে। ঘন বন, একটা-দুটো.বাড়ি..এই কিশোর, মহিলা বানিয়ে বলেনি তো এ সব কথা? কি মনে হয় তোমার? পটির কুত্তাটা যে হারিয়েছে সেটাও তো ঠিক, নইলে অত কাদবে কেন?

হেসে বলল রবিন, এ সব গল্প এ ভাবেই ছড়ায়। রহস্যময় ঘটনা ঘটতেই পারে। আসল কারণটা না খুঁজে রঙ চড়িয়ে যার যা ইচ্ছে বানিয়ে বলে দেয়। যত দোষ ফেলে নিয়ে গিয়ে ডাইনী কিংবা ভূতের ওপর।

কিশোর বলল, কিছু বুঝতে পারছি না। চিৎকারটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, রবিন নিজে না শুনলে আমাদের আগ বাড়িয়ে এ ভাবে বলত না মিসেস ভারগন।

পাহাড়ের ওপরে উঠে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়ল, তা হলো নতুন। রঙ করা একটা লেটার-বক্স। নাম লেখা রয়েছে: ডি. রিচটন। তার ওপাশে ঘাসে ঢাকা ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গা। জায়গাটাকে দু-পাশ থেকে ঘিরে এসেছে ঘন পাতাওয়ালা হার্ডউড আর দেবদারু গাছের জঙ্গল। ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি ছোট একটা কেবিন। বাড়ির ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে আছে পুরানো একটা গাড়ির নাক।

বাহ, গাড়ির যত্ন করেন ক্যাপ্টেন, চিনতে পারল রবিন। পনেরো বছর আগের মডেল, অথচ একেবারে ঝকঝকে রেখেছেন।

বাড়ির পেছনে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ করেই যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে ঘাসে ঢাকা জায়গাটা। ওটা আসলে একটা বিরাট গর্তের কিনারা। কিনারে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, ঘাস শেষ, তার জায়গা দখল করেছে ওখানে ধূসর, মসৃণ পাথর, প্রায় খাড়া হয়ে নেমেছে বাটির মত দেখতে একটা উপত্যকায়, ঢুকে পড়েছে লতায় ছাওয়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে।

এটাই ব্ল্যাক হোলো, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আশ্চর্য! ওখানকার গাছগুলো পর্যন্ত কালো লাগছে। অথচ এ রকম লাগার মত এতটা অন্ধকার কিন্তু হয়নি এখনও।

কিন্তু ক্যাপ্টেন কোথায়? বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। আমাদের গাড়ির শব্দ নিশ্চয় শুনেছেন। আসছেন না কেন? চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন রিচটন, আমরা এসেছি! তিন গোয়েন্দা!

কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবাক হলো ওরা। আসার খবর চিঠি লিখে, জানিয়েছে ক্যাপ্টেনকে, তবে কি চিঠি পাননি? সেটা তো হতে পারে না। আর চিঠি পান বা না পান, ডাক শুনে এসে দেখার তো কথা?

এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল রবিন। ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন রিচটন।

জবাব এল না এবারও।

দরজায় তালা নেই। ঢুকে পড়ল ওরা। সুন্দর, সাজানো-গোছানো একটা ঘর, এককোণে ছোট একটা বাংক। শুধু গাড়িরই যত্ন করেন না ক্যাপ্টেন, সব জিনিসেরই করেন, বোঝা গেল। কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়?

ওপাশের ছোট রান্নাঘরটায় ঢুকল মুসা। মুহূর্ত পরেই তার চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, দেখে যাও! বন্যা হয়ে গেছে!

দৌড়ে গেল কিশোর আর রবিন। অনেক পানি জমে আছে মেঝেতে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ওই পানিটুকু বাদ দিলে রান্নাঘরটাও শোবার ঘরের মতই গোছানো, যেখানে যেটা থাকা দরকার, ঠিক সেখানেই আছে। চকচক করছে প্যান, চামচ, বাসন-পেয়ালা। পরিষ্কার পর্দাগুলোর কোথাও এতটুকু দাগ নেই।

মেঝেতে পানি এল কোত্থেকে? রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। এ রকম হওয়ার কথা নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন ক্যাপ্টেন। পানি পড়লে সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলার কথা।

 নুয়ে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল কিশোর। বরফের মত শীতল। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল এককোণে রাখা একটা পুরানো আমলের আইস-বক্সের কাছে। নিচ থেকে টেনে বের করল একটা বেসিন, পানিতে টইটম্বুর, ওটা থেকেই পানি উপচে পড়ে মেঝে ভাসিয়েছে।

 দুই সহকারীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল সে, বরফ গলে এই পানি। জমেছে।

ভুরু কুঁচকে বলল রবিন, জমতে তো অনেক সময় লেগেছে নিশ্চয়। পরিষ্কার করলেন না কেন ক্যাপ্টেন?

বেসিনের পানিটা সিংকে ঢেলে খালি করল কিশোর। বিড়বিড় করল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!

মুসা বলল, মানুষ তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে না। হয়তো তিনি। যাওয়ার পর পড়েছে।

বিছানাটাও এলোমলো, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। বাইরে গেলে এ ভাবে ফেলে যাওয়ার কথা নয়। যে রকম গোছগাছ করা স্বভাব তার, গুছিয়েই রেখে যেতেন। পানি নাহয় পরে পড়তে পারে, কিন্তু বিছানাটা তো আর। আপনাআপনি অগোছাল হতে পারে না।

হয়তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন, অনুমান করল মুসা। গোছানোর সময় পাননি?

তাহলে কি এমন কাজে চলে গেলেন, যে বিছানা গোছানোরও সময় পাননি? নিজেকেই প্রশ্নটা করল যেন কিশোর।

ব্যাপারটা খাপছাড়া লাগল গোয়েন্দাদের কাছে। বেরিয়ে এসে বাটির মত জায়গাটার কিনারে দাঁড়াল, যেখান থেকে উপত্যকায় নেমে গেছে ঢাল। মুখের কাছে হাত জড় করে চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন রিচটন! ক্যাপ্টেন রিচটন!

জবাবের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কিন্তু কোন সাড়া এল না বিরাট কালো গর্তটা থেকে, এমনকি কোন প্রতিধ্বনিও নয়।

গুরুতর কিছু একটা হয়েছে মনে হয়, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলা যায় না, কোথাও জখম হয়েও পড়ে থাকতে পারেন। খুঁজতে যাব। একপাশের জঙ্গল দেখিয়ে বলল, মুসা, তুমি আর রবিন ওদিকে যাও, আমি এদিকে যাচ্ছি।

 বনে ঢুকে পড়ল দুই সহকারী গোয়েন্দা। অনেক বড় বড় গাছের মাথা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে, রোদ আটকে ফেলে, গোড়ায় আগাছা জন্মাতে দেয় না। ফলে হাঁটা সহজ। গোধূলির কালচে-ধূসর ছায়া নেমেছে বনতলে, আর আধঘণ্টার মধ্যেই পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর মুসা বলল, রাত তো হয়েই গেল। আর খুঁজে লাভ নেই। চলো, ফিরে যাই।

আবার খোলা জায়গাটায় ফিরে এল দু-জনে। কিশোরের নাম ধরে ডাকল মুসা। জবাব পেল না।

খাইছে! গুঙিয়ে উঠল সে, এ-কি ভূতুড়ে কাণ্ড! প্রথমে ক্যাপ্টেন, এখন কিশোরও গায়েব…

খসখস শব্দ শুনে থেমে গেল সে।

শশশ! ফিসফিস করে বলল রবিন, কিসের শব্দ?

খোলা জায়গাটায়ও এখন অন্ধকার। বনের ভেতরে আবার শোনা গেল শব্দটা, নড়ছে যেন কিছু। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে।

মুসা? রবিন? ডাক শোনা গেল বনের কিনার থেকে।

ও, কিশোর! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।

কাছে এসে জানাল কিশোর, কোন চিহ্নই পেলাম না ক্যাপ্টেনের। উপত্যকায় নামার একটা পথ পেয়েছি। ওটা ধরে এগিয়েছিও কিছুদূর। এ জন্যেই দেরি হয়েছে। কিন্তু কিছু পেলাম না।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল রবিন। এক রহস্যের কিনারা করতে এসে আরেক রহস্য…চলো, আমাদের মালপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

.

খানিক পরেই ছোট্ট কেবিনের রান্নাঘর থেকে মাংস আর ডিমভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। খেতে বসে গেল তিন গোয়েন্দা। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। রিচটনের উধাও হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে তিনজনে।

ঘরের দরজায় তালা নেই, গাড়িটাও রয়েছে, নিজেকেই যেন বোঝাল কিশোর, দুটো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।

হ্যাঁ, মাথা ঝকাল রবিন। হয় কেউ তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে, নয়তো তিনি নিজেই হেঁটে গেছেন। এত তাড়াহুড়া করে গেছেন, দরজায় তালা লাগানোরও সময় পাননি। হেঁটে গেলে এমন কোন জায়গায় গেছেন, যেখানে গাড়ি চলে না।

ওরকম জায়গা একটাই দেখেছি। গর্তের মত উপত্যকাটা, ব্ল্যাক হোলো।

প্লেটের খাবার চেটেপুটে শেষ করে ফেলল মুসা। রহস্য নিয়ে যত খুশি মাথা ঘামাও তোমরা, সূত্র খুঁজতে থাকো, আমি এই সুযোগে বাসন পেয়ালাগুলো ধুয়ে ফেলি। তারপর আরও কাজ আছে। তবে সেগুলো করতে পারি এক শর্তে।

কী? কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইল কিশোর।

কিছু লাকড়ি এনে দিতে হবে।

মুসার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন, ভেবেছিল কি না জানি বলবে। উঠে গেল রিচটনের জড় করে রাখা লাকডির স্তূপ থেকে লাকডি আনার জন্যে। ফিরে এল দু-জনে দুই বোঝা নিয়ে।

হ্যান্ডপাম্পটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুসা। বসে না থেকে ঘরের ভেতরে খুঁজতে শুরু করল অন্য দু-জনে–কি খুঁজছে জানে না, তবে ক্যাপ্টেনের উধাও হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু।

 কিশোর, লিভিংরুম থেকে ডাকল রবিন। গানরাকে একটা বন্দুক কম। রাইফেলও হতে পারে সেটা, কিংবা শটগান। জায়গাটা খালি।

রান্নাঘরের টেরিলে আরও মূল্যবান একটা সূত্র খুঁজে পেল কিশোর। ডাকল, রবিন, দেখে যাও।

রান্নাঘরে দৌড়ে এল রবিন।

টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া বুকসাইজ ক্যালেন্ডারটা দেখাল কিশোর। গত দুই মাসের তারিখগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার। একটা বিশেষ তারিখের নিচের লেখা দেখিয়ে বলল, এই যে দেখো, কোন জাতের কুকুর, মালিকের নাম, পরিষ্কার করে লিখেছেন। জুনের দশ, বর্ডার টেরিয়ার, মালিকের নাম জন হিগিনস।

ক্যালেন্ডারটা হাতে নিল রবিন। আরও কয়েকটা কুকুরের নাম দেখল বিভিন্ন তারিখের নিচে। একটা তারিখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। এটা দেখেছ। লিখেছেন: চিৎকার শুনলাম!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

বাসন ধুতে ধুতে ফিরে তাকাল মূসা, বাহ; চিৎকারটা তাহলে ক্যাপ্টেনও শুনেছেন! আর তো হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না!

ঠিকই বলেছ। একজন পুলিশ অফিসার, ভালমত না শুনলে লিখতেন, কিশোর বল। আনমনে বিড়বিড় করল, চিৎকার শুনেছেন, কুকুরের কথা লিখেছেন: লোকে বলে ডাইনীটা চিৎকার করে, কুকুরও ধরে নিয়ে। যায়…

পটির কথা লিখেছেন নাকি দেখো তো?

দ্রুত দেখে নিল রবিন। না। এটা মাত্র কাল রাতের ঘটনা। না লেখার আরেকটা মানে হতে পারে, তিনি এখানে তখন ছিলেন না, হয়তো আজ সারাদিনেও ফেরেননি।

হতে পারে, একমত হলো কিশোর। আমি এখন আরও শিওর হচ্ছি, বিপদেই পড়েছেন তিনি। কাল সকালে উঠেই তাকে খুঁজতে বেরোব।

আমার কাজ শেষ, টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল মূসা। হাই তুলতে তুলতে বলল, রাতে নিশ্চয় আর কিছু করবে না। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। বাংকে কে শোবে? দাঁড়াও, টস করে নিই।

টসফস লাগবে না, হেসে বলল রবিন। ইচ্ছে হলে তুমি ঘুমাওগে। আমি আর কিশোর মেঝেতেই শুতে পারব, স্লীপিং ব্যাগে।

মৃদু একটানা হিসসস আওয়াজ করে জ্বলছে হ্যাজাক লাইট। আলো জ্বেলে রাখা প্রয়োজন মনে করল না কিশোর। চাবি ঘুরিয়ে তেল বন্ধ করে দিল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কমলা রঙ হয়ে রইল ম্যানটেলটা, তারপর নিভে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল কেবিন। একেবারে নীরব হয়ে গেল। অনেক পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছে ওরা, তারপর বনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম।

মাঝরাতে ভয়াবহ একটা শব্দে চমকে জেগে গেল তিনজনেই। চোখ মেলে, কান পেতে চুপ করে পড়ে রইল অন্ধকারে, আরেকবার শব্দটা শোনার আশায়।

শোনা গেল আবার। রাতের নীরবতা খান খান করে দিল তীক্ষ্ণ, তীব্র চিৎকার, যেন ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কোন মহিলা। কেবিনের পেছনে গর্তের নিচ থেকে এল বলে মনে হলো।

চিৎকারটা মিলিয়ে গেলে ফিসফিস করে মুসা বলল, ক্যাপ্টেন কাল এই চিৎকার শুনেই দেখতে যাননি তো?

জানি না, লাফিয়ে উঠে বসল কিশোর। মনে হয় কেউ বিপদে পড়েছে। এই, জলদি কাপড় পরে নাও, দেখতে যাব।

দুই মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সন্ধ্যায় যে বুনোপথটা দেখে এসেছে কিশোর, সেটা ধরে দৌড়ে নেমে চলল উপত্যকায়। ঘন ঝোপঝাড় আর বড় বড় পাথরে পড়ে বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করছে টর্চের আলো,। একে তো অচেনা পথ, তার ওপর বেরিয়ে থাকা গাছের শেকড় বাধা দিয়ে গতি কমিয়ে দিচ্ছে।

কাউকে চোখে পড়ল না ওদের। একটা জায়গায় এসে থেমে দাঁড়াতে হলো। সামনে একটা পাহাড়ী নালা। পাথরে পাথরে বাড়ি খেয়ে যেন টগবগ করে ফুটতে ফুটতে, সাদা ফেনা তৈরি করে তীব্র গতিতে বয়ে যাচ্ছে স্রোত।

তখন এই পর্যন্ত এসেই ফিরে গেছি, পানির প্রচণ্ড শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল কিশোর। পেরোবে নাকি?

নিশ্চয়, বলেই বোকার মত পানিতে পা দিয়ে বসল রবিন। কিন্তু। স্রোতের শক্তি আন্দাজ করতে পারেনি সে, একটানে তাকে চিৎ করে ফেলল। নিজেকে সামলানোরও সময় পেল না। নিতান্তই একটা খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে চলল তাকে পানি।

.

০৩.

আলো সরাবে না! চিৎকার করে বলল কিশোর। ধরে রাখো!

রবিনের ওপর টর্চের আলো ধরে রেখে পাড় ধরে নিচের দিকে দৌড়ে নামতে লাগল দুজনে।

জবাব না দিয়ে তার টর্চটাও কিশোরের হাতে গুঁজে দিয়ে ওই স্রোতের মধ্যে নেমে গেল মুসা। বরফের মত শীতল পানি, কিন্তু গভীরতা বেশি নয়। উঠে দাঁড়াল সে, পানি বেশি না এখানে, মাত্র কোমর পানি, কিন্তু সাংঘাতিক টান, পেছন থেকে ঠেলা মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।

প্রায় বেহুশ হয়ে গেছে ততক্ষণে রবিন। নিচে নেমে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো। করে যে নেমে যাবে মুসা, তার উপায় নেই। নালার নিচটা খুব পিচ্ছিল। পা রাখাই মুশকিল। নিজেকে বোঝাল, উল্টে পড়ে বিপদ আরও বাড়ানোর চেয়ে আস্তে নামাই ভাল।

কিশোরের হাতের দুটো টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে রবিনের কাছে পৌঁছে গেল সে। একটা পাথরে ঠেকে আটকে আছে রবিন। বেহুঁশ। নাকটা কেবল রয়েছে পানির ওপরে।

পা দুটো একটা খাঁজে শক্ত করে আটকে দিল মুসা, যাতে পিছলে না পড়ে। উবু হয়ে পাজাকোলা করে তুলে নিল রবিনকে। আগুন লাগলে দমকল কর্মীরা যে ভাবে কাঁধে তুলে নেয় আক্রান্ত মানুষকে, সে-ও তেমন করে কাঁধে ফেলল অচেতন দেহটাকে।

এদিক দিয়ে উঠে এসো! আলো ফেলে পথ দেখিয়ে চিৎকার করে ডাকল কিশোর।

পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠে আসতে লাগল মুসা। কাঁধে বোঝা নিয়ে এখন পা পিছলালে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

তবে আর কোন অঘটন ঘটল না। তীরে উঠে রবিনকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বসে হাঁপাতে লাগল সে।

চোখের পলকে রবিনের ওপর এসে ঝুঁকে বসল কিশোর। অবস্থা কতটা গুরুতর দেখতে শুরু করল। নাড়ি দেখল, ঠিকই আছে। নিজের গা থেকে শার্ট খুলে নিয়ে ওটাকেই তোয়ালে বানিয়ে মুখ থেকে পানি মুছতে লাগল।

টর্চের আলোয় মাথায় একটা জখম চোখে পড়ল, রক্ত বেরোচ্ছে, পাথরে। বাড়ি খেয়ে হয়েছে ওটা। টেনে টেনে রবিনের ভেজা জামাকাপড় খুলে ফেলল সে। ভেজা গা মুছিয়ে দিল।

একটু পরেই চোখ মিটমিট করল রবিন। তাকাল টর্চের আলোর দিকে। দুর্বল কণ্ঠে বলল, আলো সরাও।…আরি, আমার কাপড় কি করেছ তোমরা? ন্যাংটো বানিয়ে ফেলেছ…

এখানে আমরাই কেবল, অসুবিধে নেই, হাসল কিশোর। নিজের অর্ধেক ভেজা শার্টটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও, এটা পরে ফেলো। এক্ষুণি কেবিনে ফিরে গিয়ে গা গরম না করলে মরবে দু-জনেই।

চিৎকারটা কে করল…

জাহান্নামে যাক চিৎকার! কাল সকালেও সেটা জানা যাবে। ওঠো, জলদি চলো।

সে-রাতে আর চিৎকার শোনা গেল না। সকালে সোনালি রোদ এসে পড়ল কেবিনের চারপাশে ঘাসের ওপর। তখনও নীরব রইল কেবিনটা। রাতের ধকলের পর নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে তিন গোয়েন্দা।

আরও অনেকক্ষণ পর রান্নাঘরে কেটলি আর বাসন-পেয়ালার টুংটাং শোনা গেল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ডিমভাজা, প্যানকেক, আর কফির সুবাস।

একটা বাসন আর চামচ হাতে বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। বাসনটাকে ঘন্টার মত করে ধরে চামচ দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে ডাকল, অ্যাই আলসেরা, ওঠো। দশটা বাজে।

নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুটো শরীর।

আঁউ। আমার মাথাটা গেছে! উঠে বসতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল রবিন। বজ্ঞো ব্যথা!…ক্যাপ্টেন এখনও ফেরেননি, তাই না?

না, শুধু আমি আছি, আর প্যানকেক, হেসে জবাব দিল কিশোর। সারাদিন খালিপেটে থাকতে না চাইলে জলদি উঠে এসো। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার, একাই সাবাড় করে দেব দেরি করলে।

তার হুমকিতে রবিনের কিছু হলো না, কিন্তু বিছানায় তড়াক করে উঠে বসল মুসা। দৌড় দিল বাথরুমের দিকে।

খিদে তিনজনেরই পেয়েছে। রাতের ধকলই এর জন্যে দায়ী। রাক্ষসের মত গিলতে শুরু করল। খেয়েদেয়ে, তৈরি হয়ে আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে। পড়ল ক্যাপ্টেন রিটনকে খুঁজতে। মাথার যন্ত্রণা অনেক কমেছে রবিনের।

আগে আগে চলেছে কিশোর, গলায় ঝোলানো একটা শক্তিশালী দূরবীন। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে পথটা নেমেছে একেবেকে। বড় বড় গাছপালার মধ্যে ঢুকতেই রোদ সরে গেল গা থেকে, পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। একটু আধটু যা নামছে, ব্যস। বিশাল সবুজ চাদোয়া তৈরি করেছে যেন গাছের মাখাগুলো। তবে দিনের বেলা তো এখন, যথেষ্ট আলো আছে বনের তলায়। ক্যাপ্টেন রিচটনের যাওয়ার চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে এগোল ওরা।

জায়গাটার নাম ব্ল্যাক হোলো কেন হয়েছে, বুঝতে পারছি, রবিন, বলল এত কালো একটা গর্তের নাম আর কি হবে?

 চারপাশে পাহাড়ের দেয়াল, সহজে বাতাসও যেন ঢুকতে পারে না এখানে। অস্বাভাবিক নীরবতা। একটা পাতা কাপে না, কোন জানোয়ারের নড়াচড়া চোখে পড়ে না। রবিনের কথাটা এই স্তব্ধতার মাঝে বড় বেশি হয়ে কানে বাজল। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। দাঁড়াও! কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করতে লাগল। চোখ ঘুরছে আশপাশের গাছপালার মধ্যে।

কাকের ডাক, রবিন বলল। মাইলখানেক।

নাহ, অন্য একটা শব্দ শুনলাম বলে মনে হলো।

সেই নালাটার কাছে এসে কাধ থেকে দড়ির বান্ডিল খুলে নিল মুসা। আজ আর বোকামি করল না কেউ, অসাবধান হলো না। মোটা গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে চলাচলের জন্যে একটা লাইফ-লাইন তৈরি করল।

নিরাপদে পার হয়ে এল অন্য পাড়ে। এগিয়ে চলল। পেছনে ফেলে এল পানির গর্জন। আবার ওদেরকে গিলে নিল যেন থমথমে নীরবতা।

আবার দাঁড়িয়ে গেল মুসা, দাঁড়াও!

কি শুনছ? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রবিন।

কি রকম একটা খসখসানি!

 তুমিই করছ শব্দটা। জিনসের প্যান্টের পায়ে পায়ে ঘষা লাগছে…এসো। এ ভাবে বার বার থামতে হলে গর্তের তলায় আর নামতে পারব না।

এগিয়ে চলল ওরা। সন্তুষ্ট হতে পারল না মুসা। খুঁতখুতানি থেকেই গেল মনে।

দাঁড়াও? এবার থমকে গেল কিশোর।

তুমিও শুনেছ? জানতে চাইল মুসা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের বনের দিকে তাকাতে তাকাতে নিচু স্বরে বলল কিশোর, দেখিনি, তবে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ… কিছু একটা আমাদের পিছে পিছে আসছে।

তাহলে এখন কোথায় শব্দটা? রবিনের প্রশ্ন। আমরা থামলেই কি থেমে যায়? আমি তো কিছু শুনছি না!

আবার এগোল ওরা! আগে চলে এসেছে রবিন, কারণ কিশোর আর মুসা প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছের আড়ালে নজর রেখে চলেছে। কর অবশেষে শেষ হলো ঢাল। সমতল হলো পথটা। চলার গতি বেড়ে গেল। জোরে জোরে পা চালিয়ে চলল রবিন। কিছু বোঝার আগেই একটা কাঁটা ডালে আটকে গেল প্যান্ট। খুদে খুদে কাঁটা কাপড় ফুটো করে খোঁচা দিতে লাগল চামড়ায়। নিচু হয়ে সেটা ছাড়াতে যেতেই অন্য ডালের কাটায় আটকে গেল সোয়েটারের পিঠ, হাতা, হাতের খোলা চামড়ায়ও খোঁচা লাগল! একটা ছাড়াতে গেলে আরও দশটা বিঁধে যায়।

পেছন থেকে হেসে বলল কিশোর, বনগোলাপের কাঁটা, তাড়াহুড়ো করলে আরও আটকে যাবে। খুব আস্তে আস্তে ছাড়াও, একটা একটা করে।

কিশোরের পরামর্শে কাজ করে কাঁটার ফাঁদ থেকে মুক্ত হলো রবিন। তবে বেশ কিছু খোঁচা সহ্য করার পর। সতর্ক হয়ে এগোল, আর আটকাতে চায় না। কিন্তু কয়েক পা এগোতে এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হলো। কিশোর! মুসা!

কি হলো? আবার আটকেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

 হাসিমুখে ফিরে তাকাল রবিন। আমাকেও শুধু বোকা বানায়নি ওই কাঁটা, আরও একজনকে বানিয়েছে। হাত বাড়িয়ে কাঁটা থেকে একটুকরো ছেঁড়া কাপড় খুলে আনল সে। উজ্জ্বল রঙ, চেককাটা ছাপ। দেখো। শার্ট ছেঁড়া। ক্যাপ্টেনেরও হতে পারে। পুরানো নয়, তাহলে রঙ চটে যেত।

দেখি, হাত বাড়াল মূসা।

কিশোরও দেখল। একটা চিহ্ন পাওয়াতে আশা হলো ওদের, এদিক দিয়েই গেছেন হয়তো ক্যাপ্টেন। কাঁটাঝাড়ের পাশ কাটিয়ে এসে বুনোপথ ধরে প্রায় ছুটতে লাগল এখন তিনজনে।

আবার চিৎকার করে উঠল রবিন। সামনে পাথরের গা কেটে, উপত্যকার এপাশ থেকে ওপাশে বয়ে চলেছে একটা সরু নদী। নদীটার পাড়ে একটা ছোট খড়ির পাড়ে বসে পড়ল সে। তুলে আনছে কিছু।

মুসা আর কিশোর কাছাকাছি হলো তার।

 কি পেয়েছে দেখাল রবিন। একটা দেশলাইয়ের বাক্স। ভেজা, কিন্তু। রঙটা তাজা। তারমানে বেশি সময় পড়ে থাকেনি পানিতে। আজ যেন রবিনেরই দিন। একের পর এক সূত্র চোখে পড়ছে তার।

দারুণ! কিশোর বলল, ক্যাপ্টেন যদি না-ও গিয়ে থাকেন, এ পথ দিয়ে যে একজন মানুষ গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নদীর পাড় ধরে হাঁটব। দেখি, আর কি পাই?

নরম মাটিতে পুরু হয়ে পড়ে আছে বাদামী পাইন নীড়ল, পা পড়লে দেবে। যায়, মনে হয় কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছে। পায়ের ছাপ পড়ছে না। তারমানে এখানে মাটি ভেজা থাকলেও কারও ছাপ পাওয়ার আশা নেই। রাস্তা জুড়ে এক জায়গায় পড়ে আছে একটা গাছ। তার কাছে চকচকে একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল কিশোরের। ছুটে গেল সে। পাতার নিচ থেকে একটা নয়, দুটো চকচকে জিনিস বের করে আনল। শটগানের গুলির খোসা। শুকটুকে বলল, বারুদের গন্ধ আছে এখনও। যে-ই গুলি করে থাকুক, বেশি আগে করেনি।

কাপের আকৃতির দুটো গর্ত হয়ে আছে। একটাতে হাঁটু রেখে দেখল, খাপে খাপে বসে যায়। বলল, হাটু গেড়ে বসে গুলি করেছিল। ক্যাপ্টেন রিচটনের একটা বন্দুক গানর‍্যাকে নেই। তিনিও গুলি করে থাকতে পারেন। কিন্তু কাকে সই করে?

আমি কি জানি? হাত উল্টাল মুসা।

রবিন বলল, গরম হয়ে উঠছে কিন্তু ব্যাপারটা!

ওখানে আর কিছু পাওয়া গেল না। নদীর ধারের পথ ধরে এগোতে লাগল ওরা। কিছুদূর গিয়ে আবার বুনোগোলাপের ঝাড় পড়ল, পথের ওপর উঠে এসেছে, সেখানে আরেক টুকরো কাপড় পাওয়া গেল, প্রথম টুকরোটার মত। একই পোশাক থেকে ছিঁড়েছে। এ মাটিতে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। এক জায়গায় দেবে গেছে অনেকগুলো বিছুটি, কোন কোনটার গোড়া ভাঙা, ভারী কিছুর চাপে অমন হয়েছে।

খাইছে! বলতে বলতে নিচু হয়ে একটা টর্চ তুলে নিল মুসা। কাঁচটা ভাঙা। টুকরোগুলোও পাওয়া গেল ওখানেই। ক্যাপ্টেন রিচটনের, কোন সন্দেহ নেই! উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল সে। এই দেখো, তাঁর নামের আদ্যক্ষর লেখা রয়েছে, ডি আর!

বিছুটিগুলো ভাল করে দেখার জন্যে বসে পড়ল কিশোর। সিরিয়াস ব্যাপার, বুঝলে, পাতায় দেখো কিসের দাগ লেগে আছে!

রক্ত! উদ্বিগ্ন শোনাল রবিনের কণ্ঠ।

এই সময় একটা খসখস শোনা গেল! ঝট করে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, একটা পাথরের চাঙড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আছে একটা মুখ। রোদেপোড়া বাদামী চামড়া, লম্বা লম্বা চুল, কালো উজ্জ্বল চোখের তারা কেমন বন্য করে তুলেছে চেহারাটাকে। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট, বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে সে!

.

০৪.

 একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেরা, যেন জ্বলন্ত ওই চোখজোড়া সম্মোহন করছে ওদের। তারপর হঠাৎ করেই পাথরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল মুখটা।

ডাইনী! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার মুখ। ওটাই খেয়েছে ক্যাপ্টেন রিটনকে! আমাদের পিছু নিয়েছিল! বললাম না, শব্দ শুনেছি।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিশোর। এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি! জলদি এসো!

আগে আগে দৌড় দিল সে। তার পেছনে রবিন, সবশেষে মুসা। ছায়াঢাকা, প্রায় অন্ধকার বনের ভেতর দিয়ে ছুটল তিনজনে। আঁকাবাকা অচেনা পথ। কখনও সামনে পড়ছে গাছের নিচু ডাল, কখনও ঝোপঝাড়, কখনও কাঁটাঝাড়। ওগুলো এড়িয়ে চলতে গিয়ে নানা রকম কৎ করতে হচ্ছে।

সামনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে আসছে। হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল কেউ। থামল না গোয়েন্দারা। বন এক জায়গায় সামান্য হালকা, ওখানে এসে কিশোরের নজরে পড়ল, গাছের আড়ালে ঢুকে গেল গাঢ় বাদামী ফ্ল্যানেলের, ট্রাউজার আর সবুজ সোয়েটার পরা লম্বা একটা দেহ। বড় বড় গাছগুলোকে। পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটল।

ডাইনী না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। তবে ছুটতে পারে বটে!

মুসা ডাইনীর ভয়েই এগোচ্ছে না, নইলে হয়তো কাছাকাছি চলে যেতে পারত মানুষটার, কিন্তু কিশোর আর রবিন ওর সঙ্গে পারছে না। আচমকা বায়ে মোড় নিয়ে রাস্তা থেকে সরে ঘন বনে ঢুকে পড়ল সে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, বনে চলতে অভ্যস্ত।

চোখের আড়াল কোরো না! চিৎকার করে বলল কিশোর। পাহাড়ের কাছে গিয়ে কোণঠাসা করব ওকে!

কিন্তু গর্তের মত উপত্যকার গাছে ছাওয়া ঢালের কাছে পৌঁছেও থামল না। মানুষটা। গাছের শেকড়, ডাল, আর গোড়া ধরে ধরে দ্রুত উঠে চলল ঢাল বেয়ে।

 কিন্তু অভ্যাস না থাকায় ওই পথে অত তাড়াতাড়ি উঠতে পারল না। গোয়েন্দারা। দূরত্ব বাড়ছে ক্রমেই।

দেয়ালের নিচের অর্ধেকটায় গাছপালা আছে, তার ওপরে ফাঁকা, শুধু। পাথর আর পাথর। ওখানে পৌঁছে খোলা জায়গায় বেরোতে হলো লোকটাকে। গায়ে রোদ পড়ল। থামল না সে। কোণাকোণি চলে, পাথরের। পর পাথর ডিঙিয়ে হারিয়ে গেল গর্তের ওপরে উঠে।

খোলা জায়গাটায় বেরিয়ে আর পারল না গোয়েন্দারা। পাথরের ওপর। বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল।

শুনেছি, ঝাড়ুর ডাণ্ডাকে হাউই বাজি বানিয়ে তাতে বসে উড়ে চলে ডাইনীরা, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল রবিন, কিন্তু একি! এ তো পা-কেই হাউই বানিয়ে ফেলেছে!

গলা থেকে দূরবীন খুলে নিল কিশোর। চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল গর্তের কিনারে উঠে লোকটা যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সেখানটা। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। শেষে ব্ল্যাক হোলোর নিচের দিকে দূরবীনের চোখ নামাল।

কিছু দেখছ? জানতে চাইল মুসা।

 প্রচুর গাছপালা, আর কিছু না।

একপ্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে আরেক প্রান্তে নজর সরাচ্ছে কিশোর। ছোট্ট একটু খোলা জায়গার ওপর চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল হাত।

দেখেছ মনে হচ্ছে কিছু? প্রশ্নটা করল এবার রবিন।

তার হাতে দূরবীন তুলে দিল কিশোর। যেদিকে খোলা জায়গাটা আছে নীরবে সেদিকে হাত তুলে দেখাল।

প্রথমে শুধু গাছ চোখে পড়ল রবিনের। কই, কিছু তো দেখছি না।

গর্তের দেয়ালের গোড়ায় দেখো।

রবিনও দেখতে পেল। শুরুতে যেগুলোকে কেবল পাথর মনে হয়েছিল, সেগুলোকেই এখন অন্য রকম লাগল, মনে হচ্ছে কাঠ আর পাথরকে যত্ন করে সাজিয়েছে কেউ। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, আরি, এ তো ঘর। দরজাও দেখতে পাচ্ছি। এমন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছে, যাতে নজরে না পড়ে।

রবিনের হাত থেকে দূরবীনটা প্রায় কেড়ে নিল মুসা। দেখে বলল, ওরকম বাড়িতে কে বাস করে, বলো তো? ওই ডাইনীমুখো লোকটা?

হতে পারে। যে-ই করুক, ক্যাপ্টেন রিচটনের খবর হয়তো জানাতে পারবে আমাদের। কিশোর, যাবে নাকি?

চলো।

আবার নামা! আঁতকে উঠল মুসা, এই পথে নামতে গেলে এবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।

তুমি কি ভেবেছিলে চিরকালই থাকব আমরা এখানে? হেসে বলল কিশোর।

ততক্ষণে নামতে শুরু করে দিয়েছে রবিন, পাহাড়ে চড়ায় অন্য দু-জনের চেয়ে দক্ষ সে।

নিচে নেমে পায়েচলা পথটা আবার খুঁজে বের করল ওরা।

আধঘণ্টা পর বন থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গাটুকুতে। হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করল কিশোর। এত কাছে থেকেও রহস্যময় ছোট্ট বাড়িটাকে চেনা কঠিন। আগে থেকে না জানা থাকলে হয়তো চোখেই পড়ত না, অথচ রয়েছে মাত্র দশ-বারো গজ তফাতে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল ওরা। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। জানালা নেই, সামনের দিকে কেবল একটা দরজা। কাউকে চোখে পড়ল না। পা টিপে টিপে বাড়িটার দিকে এগোতে শুরু করল কিশোর, পেছনে দুই সহকারী। সামনের খোলা চত্বরটুকু পেরিয়ে এসে কাঠের দরজার সামনে। দাঁড়াল সে। একমুহূর্ত দ্বিধা করে টোকা দিল দরজায়।

বার বার টোকা দিয়েও সাড়া মিলল না।

মুসা বলল, ভেতরে কিছু নড়েছে মনে হলো।

সরে গিয়ে এককোণ থেকে উঁকি দিল সে। কাউকে দেখতে পেল না। বাড়িটার গঠন দেখে অবাক হলো। আরেক পাশে সরে গিয়ে অন্য কোণ থেকে তাকাল। কাঠ আর পাথর দিয়ে তিনদিকে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। বাকি একদিকের বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পাথরের দেয়ালটাকে। একধারে একটা খোয়াড়, ভেড়া রাখা হত বোধহয়, এখন শূন্য। একটা জানোয়ারও নেই।

দেখলে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। কেউ নেই।

তাহলে নড়ল কি?

কি জানি!

বাড়িটার গঠন কিশো; আর রবিনও দেখল। রবিন বলল, আরেকটা। দেয়াল বানাতে কি এমন কষ্ট হত? আলসে নাকি লোকটা? নাকি কোন কারণ আছে এ ভাবে বানানোর?

একটা কারণ হতে পারে, ক্যামোফ্লেজ, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। এভাবে তৈরি করাতে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, সহজে চোখে পড়ে না।

হু। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, তারচেয়ে চলো বাড়িটা কার জানার চেষ্টা করি। ব্ল্যাক হোলোর মালিক কে, সেটা জানাও বোধহয় জরুরী।

বেরিয়েছি কিন্তু রিটনকে খুঁজতে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। এই বাড়ির মালিক, কিংবা যে লোকটা আমাদের ওপর চোখ রাখছিল, তার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের নিখোঁজ হওয়ার কোন সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। একটা ব্যাপারে এখন শিওর হয়ে গেছি আমরা, এখানে, এই গর্তের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে তার। শেরিফকে জানাতে হবে খবরটা।

একঘণ্টা জোরকদমে চলার পর গর্তের উল্টোধারের দেয়ালের ওপরে। এসে উঠল ওরা আবার, রিচটনের কেবিনের কাছে। একবাক্স বিস্কুট আর তিনটে আপেল বের করে নিল মুসা। ইতিমধ্যে ছোট্ট একটা নোট লিখে টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল কিশোর, ক্যাপ্টেন ফিরে এলে দেখতে পাবেন; জানবেন, ওরা এসেছে।

আবার এসে গাড়িতে উঠল ওরা। ফরেস্টবার্গে শেরিফের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

.

০৫.

গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। ভারগনদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল সামনের চত্বরে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে পটি।

ওর কুত্তাটা খোঁজার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা।

রবিন বলল, যাবে আর কোথায়, হয়তো ফেরত চলে এসেছে।

আমার মনে হয় না, কিশোর বলল। এলে ওভাবে মন খারাপ করে বসে থাকত না। কুকুরটাও থাকত তার সঙ্গে।

বাকি কুত্তাগুলোর ব্যাপারে কি মনে হয় তোমার? হারিয়েছে যে বলল। মিসেস ভারগন? কোনও পশু চোরের কাজ?

চোরটা কে, জানি আমি, জবাব দিল মূসা। সেই ডাইনী।

রবিন ভেবেছিল, উড়িয়ে দেবে কিশোর, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে। বলল গোয়েন্দাপ্রধান, আমার ধারণা, ডাইনী আর কুকুর-নিখোঁজ রহস্যের। মধ্যে যোগাযোগ আছে। ক্যাপ্টেনও এটা সন্দেহ করেছেন। নইলে ক্যালেন্ডারে লিখে রাখতেন না।

কিশোরের কথায় মুসাও অবাক, ডাইনী আছে তুমি বিশ্বাস করো?

না।

আমিও না, রবিন বলল। তবে এখানকার লোকে যে করে তাতে সন্দেহ নেই। করার কারণ, পেনসিলভানিয়া ডাচেরা আসলে ডাচ নয়, জার্মান। দু-তিনশো বছর আগে ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্যে দেশ ছেড়ে এসে বসতি করেছিল এখানে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ডাইনী, রক্তচোষা ভুত, জাদুমন্ত্র এসবের গল্প। ওদের অনেকেই এখনও এসব উদ্ভট গল্প সত্যি বলে মানে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ওসব আছে।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা, মিসেস ভারগনও তো করে।

ডাইনীর গল্প অবশ্য আরও অনেক দেশে আছে। নিউ ইংল্যান্ডের পিউয়ারিটনরাও বিশ্বাস করে ডাইনী আছে।

চুপ করে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।

কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

অ্যাঁ! হ্যাঁ। রবিন, তোমার কি মনে হয়নি, কুত্তা চুরি করে কেউ ডাইনীর এই কিংবদন্তীটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে?

করতে পারে। তবে কেন করবে এই কাজ, কিছু বুঝতে পারছি না।

সরু একটা পথ চলে গেছে ফরেস্টবার্গের দিকে। আশোঁপাশে বসতি খুব কম। প্রায় দুই ঘণ্টা একটানা চলার পর পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে একটা চৌরাস্তা পড়ল। অন্য যে পথটা আড়াআড়ি কেটে চলে গেছে মূল রাস্তাটাকে, তার একটা প্রান্ত উঁচু হয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে, অন্য প্রান্তটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে একটা পার্বত্য নদীর দিকে। নেমে যাওয়া দিকটার দু-দিকে অনেকগুলো। কাঠের তৈরি বাড়িঘর চোখে পড়ল। পুরানো একটা আঁতাকলও আছে।

ম্যাপ দেখে কিশোর বলল, ওটাই ফরেস্টবার্গ। ঘোরো।

গাড়ি ঘোরাল মুসা।

আগের দিনে ওটা দিয়ে গম ভাঙাত লোকে, আঁতাটা দেখিয়ে রবিন বলল। তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে ওটা ঘোরানো হত।

একটা বাড়ির ডিসপ্লে উইন্ডোতে বড় বড় করে লেখা রয়েছে: অ্যাংগাস জেনারেল স্টোর। আকৃষ্ট করল মুসাকে। ছাউনি দেয়া বারান্দায় পড়ে আছে দড়ির বান্ডিল, হাতুড়ি-বাটাল, খন্তা-কুড়াল জাতীয় যন্ত্রপাতি, আর গম-আটার। বস্তা।

আমি ঢুকব ওখানে, ঘোষণা করল সে। গোয়েন্দাগিরিতে অনেক পরিশ্রম, অনেক ক্যালোরি খরচ হয়, ঠিকমত না খেলে শরীর টিকবে না।

হেসে ফেলল রবিন। মুসা দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলে সে বসল ড্রাইভিং সীটে। ড্রাইভ কিশোরও করতে পারে, কিন্তু গাড়ি চালাতে ভাল লাগে না তার। ছুটন্ত গাড়িতে আরাম করে বসে দু-ধারের দৃশ্য দেখাই, তার বেশি পছন্দ।

কেনাকাটা করার জন্যে মুসাকে রেখে কাউন্টি কোর্টহাউসে রওনা হলো। অন্য দু-জন। সাদা একটা কাঠের বাড়ি, সামনে ছড়ানো বারান্দার ওপরে। কাঠের খুঁটি দিয়ে ধরে রাখা চালা।

কাউন্টি ক্লার্কের অফিসে ঢোকার আগে দরজায় থাবা দিতে গেল কিশোর। কিন্তু পাল্লাটা ভোলা, চাপ লাগতেই ফাঁক হয়ে গেল। ভেতরে ঢুকল

সে আর রবিন। বিশাল, পুরানো আমলের একটা রোল-টপ ডেস্ক রয়েছে। ঘরে, ওটার খোপগুলোতে ঠেসে ভরা রাখা হয়েছে দলিলপত্র। টেবিলের ওপরেও গাদা গাদা কাগজ, বড় বড় পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া।

কেউ নেই ঘরটায়। ওপাশের দরজাটার কাছে এসে সবে টোকা দিতে যাবে কিশোর, এই সময় খুলে গেল ওটা। বেরিয়ে এল চশমা পরা এক মধ্যবয়েসী মহিলা। কি চাই? ক্লার্ক মিস্টার রেনসন বাইরে গেছেন। আমাকে দিয়ে কোন সাহায্য হবে?

ব্ল্যাক হোলোতে ক্যাম্পিং করতে যেতে চাই আমরা, জবাব দিল কিশোর। জায়গাটার মালিক কে জানতে পারলে তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিতাম।

বহুবছর ধরে মহিলা এই এলাকার বাসিন্দা, এক অফিসে কাজ করতে করতে অনেক কিছু মুখস্থ হয়ে গেছে। ফাইল কিংবা রেজিস্টার দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। জবাব দিয়ে দিল, পুরো উপত্যকাটারই মালিক আরিগনরা। যদূর জানি, এখনও যারা বেঁচে আছে, সবাই যার যার মত অন্য জায়গায় চলে গেছে। ওদের কেউ ওখানে এখন বাস করে কিনা বলতে পারব না।

আরিগন নামটা নোটবুকে টুকে নিল রবিন।

মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল দু-জনে।

শেরিফের অফিসের দরজায় গিয়ে টোকা দিল কিশোর।

 ভেতর থেকে ভারি গলায় ডাক শোনা গেল, আসুন।

খাটো, ভারি শরীর, ধূসর রঙের পুরু গোঁফওয়ালা একজন মানুষ টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ওয়েস্টকোটের বোতাম খোলা, বলিষ্ঠ বাহুর ওপরে গুটিয়ে রাখা শার্টের হাতা। খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে তাকে। সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে ডেস্কের ওপর দিয়ে তাকালেন ছেলেদের দিকে।

দ্রুত নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর। শেরিফের নাম জানতে পারল, টোনার।

কি দরকার? জানতে চাইলেন শেরিফ।

সংক্ষেপে ক্যাপ্টেন রিচটনের নিখোঁজ সংবাদ জানাল কিশোর। তার যে খারাপ কিছু হয়েছে, এই সন্দেহের কথাও বলল।

ভুরু কুঁচকে নীরবে সব শুনলেন শেরিফ। কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কি করতে বলো?

ব্ল্যাক হোলোতে গিয়ে খুঁজে দেখার জন্যে যদি কাউকে পাঠাতেন…

মাথা নাড়লেন শেরিফ, সম্ভব না। আজ তো নয়ই, কালও পারব কিনা? জানি না। আমার সমস্ত লোক এখন হাইজ্যাকারদের পেছনে ব্যস্ত। ইন্টারস্টেট ট্রাক থেকে মাল হাইজ্যাক হয়ে গেছে। কদিন ধরেই উৎপাত। করছে খুব, মাঝে মাঝেই মালবাহী গাড়ির ওপর চড়াও হয়ে লুটপাট চালাচ্ছে। ব্যাটাদের ধরতেই হবে।

কিন্তু স্যার, মিস্টার রিচটনের ব্যাপারটাও কম জরুরী না, আবার বলল কিশোর। দেরি হলে আরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তার। প্রাণের ওপরও আঘাত আসতে পারে।

শোনো, ভারিক্কি ভঙ্গিটা কোমল করার চেষ্টা করলেন শেরিফ, এত ভাবার কিছু নেই। এসব এলাকায় মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যায় লোকে। বেড়াতে বেরোয়, ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় বহুদূরে, আবার একদিন ফিরে আসে। ক্যাপ্টেনও হয়তো তাই করছেন। শুধু সন্দেহের বশে আমার লোকদের জরুরী কাজ থেকে সরিয়ে আনতে পারি না, কোন প্রমাণ নেই…

আছে স্যার, প্রমাণ আছে, জোর দিয়ে বলল রবিন। তার ভাঙা টর্চটা আমরা পেয়েছি। গুলির খোসা, পাতায় রক্ত, শার্টের ভেঁড়া কাপড়..এসবকে কি প্রমাণ বলবেন না?

চুপ করে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। ভুরু কুঁচকে বললেন, এত কিছু পেয়েছ! তাহলে তো সিরিয়াস ব্যাপারই মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও… অসহায় ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, আজ লোক দেয়া সম্ভব নয়। কাল একটা সার্চ পার্টি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব, তবে কথা দিতে পারছি না।

এখানে আর এমন কেউ কি আছে, যে আমাদের খুঁজতে সাহায্য করতে পারে? জানতে চাইল কিশোর।

সামনের রিপোর্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছেন ততক্ষণে শেরিফ, কিশোরের কথায় চোখ তুলে তাকালেন, মিস্টার আরিগনের কথা ভাবছি। ওই হোলোতে বাস করে। ওখানকার প্রতিটি ঝোপ, প্রতিটি পাথর তার চেনা। জন্মের পর থেকে বাস করেছে ওই অঞ্চলে। তোমরা গিয়ে বললে খুশি হয়েই তোমাদের সাহায্য করবে। ওই রকমই মানুষ, সবাইকে সাহায্য করার জন্যে যেন তৈরি হয়েই থাকে। ভাল লোক।

আরেকবার দৃষ্টি বিনিময় করল দুই গোয়েন্দা। আবার টোনারের দিকে তাকাল কিশোর। ওই উপত্যকাতেই থাকে বলছেন?

হ্যাঁ, সে-রকমই তো শুনেছি, একটা কেবিনে। আমি কখনও যাইনি। তোমরা গিয়ে খোঁজো, বের করে ফেলতে পারবে।

কোর্টহাউস থেকে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গাড়ি নিয়ে চলে এল জেনারেল স্টোরের সামনে। বাইরে অপেক্ষা করছে মুসা। পায়ের কাছে নানারকম প্যাকেট, টিন আর বোতলের স্তূপ। পারলে পুরো দোকানের সব খাবারই যেন কিনে ফেলত। গাড়িতে উঠেই বলল, আগে কোথাও গাড়ি রেখে খেয়ে নেব।…তো, কি জেনে এলে তোমরা?

ভোঁতা গলায় জানাল রবিন, শেরিফ সাংঘাতিক ব্যস্ত। মনে হচ্ছে আমাদেরই সব করতে হবে। কিশোর, মিস্টার সাইমনের সাহায্য চাইব?

মন্দ হয় না। সাহায্য না দিতে পারেন, পরামর্শ হয়তো দিতে পারবেন।

টেলিফোনে কথা বলতে চাও তো? সে আশা বাদ রাখো, মুসা বলল। দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজারই করেছি শুধু ভেব না, গোয়েন্দাগিরিও করেছি। এই শহরের অনেক কথা জেনেছি। জানো, সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় এখানে কাকে নিয়ে? মিসেস অ্যাংগা, জেনারেল স্টোরের মালিকের স্ত্রী। বেশি বকর বকর করে কে? মিসেস অ্যাংগা। টেলিফোন অপারেটর কে জানো? মিসেস অ্যাংগা। এখান থেকে টেলিফোনে যত গোপন কথাই বলো সেটা আর গোপন থাকবে না, চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়বে। সারা শহরে।

হুঁ, বুঝেছি, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। রবিন ঠিকই বলেছে, যা করার সব আমাদের করতে হবে। শেরিফ বলেছেন, কাল সকালে সার্চ পার্টি পাঠানোর চেষ্টা করবেন। যদি না পাঠান, মিস্টার আরিগনকে খুঁজে বের করব আমরা। তার সাহায্য চাইব।

আচ্ছা, রবিন বলল, গর্তের নিচের ওই আজব ঘরটাতে থাকেন না তো তিনি?

থাকতে পারেন। আর কোন বাড়ি তো চোখে পড়েনি ওখানে।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। একটা কাফের সামনে এনে গাড়ি রাখল। বলল, টিনের খাবার পরেও খেতে পারব। রান্না করা কিছু খেয়ে নিই এখন।

খাবার খুব ভাল কাফেটার। স্থানীয় পত্রিকাটা টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। আচমকা চিবানো বন্ধ হয়ে গেল তার। বলল, জন্তু জানোয়ারের নিলাম হবে, সেখানে যাব আমরা।

অবাক হলো রবিন, জানোয়ার নিলাম!

কোথায়? মুসাও অবাক।

পরের শহরে। এই যে, বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আজকেই হবে, এবং আধঘণ্টার মধ্যেই।

কিন্তু ওখানে আমরা কি কিনতে যাব? গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস দুটোই নিয়েছি, জ্যান্ত পশু আমাদের দরকার নেই।

আছে। কুকুর। ডাইনীর জন্যে ফাঁদ পাততে হলে কুকুরের টোপ দরকার। ক্যাপ্টেন রিচটনের কেবিনে নিয়ে যাব ওটাকে আমরা। কুত্তা চোর যদি থেকেই থাকে ওখানে, নিতে আসুক আমাদেরটা, তৈরি হয়ে বসে থাকব আমরা।

হাসি ছড়িয়ে পড়ল রবিনের মুখে, ভাল বুদ্ধি করেছ!

চোরটা যদি সত্যি ডাইনী হয়? মুসা খুশি হতে পারছে না। অহেতুক একটা জানোয়ারকে…

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ভয় নেই, পাহারায় থাকব আমরা। কুকুরটার ক্ষতি করতে দেব না ডাইনীকে। বরং ডাইনী ধরার চেষ্টা করব। হেসে রসিকতার সুরে বলল, একটা ডাইনীকে যদি ধরে নিয়ে যেতে পারি আমরা, ভাবতে পারো কি ঘটবে? ওটা শো করার ব্যবস্থা করব। টিকেট বেচেই বড়লোক হয়ে যাব আমরা।

খাওয়া শেষ হলো। কয়েক মিনিট পর আবার গাড়িতে এসে উঠল ওরা।

ম্যাপ দেখে রাস্তা বলে দিতে লাগল কিশোর। শহর ছাড়িয়ে আসতে খুব খারাপ হয়ে গেল পথ। এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে।

খাইছে! শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে মুসা, কবে বানিয়েছিল এই রাস্তা! আমার তো বিশ্বাস, সেই ওয়াইল্ড ওয়েস্টের যুগে, ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া যখন আর কিছু চলত না।

একেই খারাপ, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে রাস্তার অবস্থা আরও করুণ হয়ে আছে। মাটি গলে সরে গিয়ে নিচের পাথর বেরিয়ে পড়েছে। টায়ারে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে চলেছে ওগুলো।

চুলের কাঁটার মত অনেকগুলো তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার পর আরেকটা বাকের কাছে এসে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল:

গতি কমান!
সামনে পুল
ভারি গাড়ি নিষিদ্ধ।

 মোড় পেরোলে কাঠের ব্রিজটা চোখে পড়ল। দু-পাশে লোহার রেলিঙ আছে বটে, তবে এতই হালকা, কোন গাড়ির পতন রোধ করতে পারবে না ওগুলো। নিচে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদীর স্রোত।

বোকামি করে বসল মুসা। ভাবল, পেরিয়ে যেতে পারবে, কিশোর বাধা দেয়ার আগেই গাড়ি তুলে দিল ব্রিজে। অর্ধেক যেতে না যেতেই মড়মড় করে উঠল নিচের তক্তা, গাড়িটার ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ছে।

চিৎকার করে উঠল কিশোর, থেমো না, থেমো না, চালিয়ে যাও!

<

Super User