পোচার – রকিব হাসান
 প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০

মাউনটেইনস অভ দা মুন! বিড়বিড় করলো কিশোর পাশা, উত্তেজনায় মৃদু কাঁপছে কণ্ঠ।

বাংলায় কি হয়? জিজ্ঞেস করলো রবিন। চাঁদের পাহাড়?

কিংবা চন্দ্রপর্বত! বললো গোয়েন্দাপ্রধান।

নামের মতোই সুন্দর পাহাড়টা, মুসা বললো। নিচের পর্বতশ্রেণীর দিকে তাকিয়ে আছে সে।

দক্ষিণ-পুবে উড়ে চলেছে ছোট্ট বিমান। গন্তব্য, টিসাভো। লোকে বলে রহস্য আর খুনের খুনি টিসাভো। আফ্রিকার বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্ক, যেখানে জন্তুজানোয়ারেরা নিরাপদে থাকার কথা, কিন্তু থাকতে পারে না। পোচার, অর্থাৎ চোরাশিকারীরা বেআইনীভাবে মেরে শেষ করছে হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, জলহস্তী আর অন্যান্য প্রাণী। তাদের ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন গেম ওয়ারডেন ডেভিড টমসন মুসার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু পারছেন না। আর পারবেনই বা কি করে? আট হাজার বর্গমাইল বুনো অঞ্চলের কোথায় যে লুকিয়ে থাকে পোচাররা, খুঁজে বের করা কি সহজ কথা?

প্লেন চালাচ্ছেন টমসন। কপালে, গভীর ভাঁজ পড়েছে, ভাবছেন। কন্ট্রোলে। হাত। নিচে একে একে সরে গেল ভিকটোরিয়া হ্রদ, নীল নদের উৎপত্তিস্থল, সিংহের জন্যে বিখ্যাত বিশাল সেরেংগেটি অঞ্চল, তুষারের মুকুট পরা মাউন্ট কিলিমানজারো…খেয়ালই করছেন না যেন তিনি। তার মন পড়ে আছে আরও দূরের সেই রক্তাক্ত এলাকায়, যেখানে মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে রক্ত, আতঙ্ক, অত্যাচার আর মৃত্যুর রোমহর্ষক দৃশ্য।

এক অসম লড়াই, আনমনে বললেন তিনি। শত্রুরা দলে এতো ভারি, কিছুতেই পারছি না। মাত্র দশ জন লোক আমার পোচারদের তুলনায় নগণ্য। কি করে পারবো? এক জায়গা থেকে খেদাই তো পরদিনই আরেক জায়গায় গিয়ে শুরু করে। নাহ, আর পারা যায় না।

কজন গেছে আপনার? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

 বাইশ জন ছিলো। বারো জনকে মেরে ফেলেছে।

তীর দিয়ে?

হ্যাঁ। বিষ মাখানো তীর। পোচারদের সবার কাছে অস্ত্র আছে; তীর-ধনুক, বল্লম, ছুরি, কারো কারো কাছে পুরনো মাসকেট রাইফেল। আমার দুজন লোক ওদের ফাঁদে আটকা পড়েছিলো, জানোয়ার ধরার জন্যে পেতে রাখা ফাঁদ। মাসখানেক পরে ওভাবেই পেয়েছি, শুধু দুটো কঙ্কাল।

খাইছে! আঁতকে উঠলো মুসা। কঙ্কাল?

হ্যাঁ। আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না।

নিশ্চয় পানির অভাবে মরেছে? অনুমানে বললো রবিন। তারপর হায়েনারা এসে খেয়ে ফেলেছে…

আটকা পড়া জীবকে অসহায় দেখলে মরার অপেক্ষা করে না হায়েনারা। আমার বিশ্বাস, জ্যান্তই খেয়ে ফেলেছে।

শিউরে উঠলো রবিন। মুখ কালো হয়ে গেল। মুসার মুখও থমথমে। আফ্রিকায়, তার নিজের মহাদেশে বেড়াতে আসার কথাটা ভাবতে ভালো লাগছে না আর এখন। চট করে তাকালো একবার কিশোরদের দিকে। গোয়েন্দাপ্রধানকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।

এবারের ছুটিতে আফ্রিকায় বেড়াতে আসার প্রস্তাবটা মুসার। রবিন আর কিশোরও শুনেই রাজি। তিনজনে মিলে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছে মুসার বাবা মিস্টার রাফাত আমানকে। তিনি সর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডেভিড টমসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছেন, ছেলেদের পাঠাতে চান। তিন গোয়েন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও জানিয়েছেন বন্ধুকে। বন্ধুর অনুরোধ এড়াতে পারেননি। ওয়ারডেন, কিংবা এড়াতে চানওনি হয়তো, তাই তিন কিশোরকে কিছুদিন মেহমান রাখতে রাজি হয়ে জবাব দিয়েছেন চিঠির।

ছেলেদের মনমরা হয়ে যেতে দেখে হাসলেন ওয়ারডেন। কি ব্যাপার, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?

না না, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। ভয় পাবো কেন? বিপদকে ভয় পাই না আমরা।

রাফাতও তাই লিখেছে। তোমরা ভীষণ সাহসী। আমাজানের গহীন জঙ্গল থেকেও জন্তুজানোয়ার ধরে নিয়ে এসেছিলে। এসব শুনেই রাজি হয়েছি। নইলে যেখানে পোচার আছে, আসতে বলতাম না। পোচার মানেই তো বিপদ।

দশজন আছে তো, মুসা বললো। এখন ধরে নিতে পারেন তেরো জন। আমরাও আছি আপনার সঙ্গে। ওই পোচার ব্যাটাদের একটা ব্যবস্থা না করে আমরাও আমেরিকায় ফিরছি না।

দেশপ্রেম?

দেশপ্রেমিক, বুনো পশু-পাখি-প্রেমিক, অন্যায়-বিরোধী, যা খুশি বলতে পারেন। কিন্তু টিসাভোর ওই পোচারগুলোকে খতম না করে আমি মুসা আমান অন্তত ফিরছি না। 

এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে নিগ্রো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন টমসন। তারপর মাথা নাড়লেন, তোমার বাবা মিথ্যে লেখেননি। সত্যি তোমরা ভালো ছেলে।

থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার, কিশোর বললো।

ওই যে, তুষারে ঢাকা পর্বতের একটা ধার দেখিয়ে বললেন ওয়ারডেন। ওই টিসাভো।

চমৎকার দৃশ্য! কে ভাববে, ওরকম একটা জায়গায় সারাক্ষণ চলে মৃত্যুর আনাগোনা? সবুজ বন, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি, নিঝুম পাহাড়, রূপালি নদী, শান্ত হ্রদ, উজ্জ্বল রোদ, নিবিড় ছায়া-সবকিছু মিলিয়ে তিন গোয়েন্দার মনে হলো যেন পৃথিবীর কোনো জায়গা নয় ওটা।

সুন্দরের পুজারি কিশোর পাশার স্বপ্নিল চোখ দুটো আরও গাঢ় হয়ে উঠলো। ভাবছে, বাংলাদেশেও কি এতো সুন্দর জায়গা আছে?

আল্লাহরে! এ-তো বেহেশত! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। সুন্দর জায়গা পৃথিবীর সবখানেই আছে। আমাদের আয়ারল্যাণ্ডেও আছে।

আছে, একমত হলেন ইংরেজ ওয়ারডেন। এবং সব জায়গাতেই শয়তানও আছে। ওরা না থাকলে…এই টিসাভোর কথাই ধরো, পোচারগুলো না থাকলে সত্যি স্বর্গ বলা যেতো জায়গাটাকে। জানোয়ারের নিরাপদ বাসভূমি, টুরিস্টদের আনন্দ। ওই যে নদীটা, একটা জায়গায় বেশি ছড়ানো দেখছো, ওখানে একটা আণ্ডারওয়াটার অভজারভেটরি আছে। ওখান থেকে নদীর নিচের দৃশ্য দেখা যায়। এখন আর সুন্দর কিছু দেখবে না, পোচাররা সর্বনাশ করে দিয়েছে। ডজন ডজন জলহস্তী মেরে… দৃশ্যটা কল্পনা করে চেহারা বিকৃত করে ফেললেন তিনি।

মেরে ফেলে ওদের কি লাভ? জানতে চাইলো মুসা।

ওদের যা দরকার নিয়ে চলে গেছে। জলহস্তীর একেকটা মাথার দাম চার পাঁচ হাজার ডলার। চামড়ার দামও অনেক। মাথা কেটে, চামড়া ছিলে, ধড়টা। ফেলে রেখে গেছে।

নরপিশাচের দল! দাঁতে দাঁত চাপলো কিশোর। খেতে যদি, তা-ও এক কথা ছিল, শুধু কিছু টাকার জন্যে এভাবে খুন করে জানোয়ারগুলোকে!

ওদের পিশাচ বললে কম বলা হয়, টমসন বললেন। জানোয়ারের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে, গেল একেকজন মানুষের জন্যে শিকার নিষিদ্ধ নয়, কোনোকালেই ছিলো না। আদিম যুগেও শিকার করতো মানুষ, মাংসের জন্যে, খেয়ে বাঁচার তাগিদে। আফ্রিকায় এখনও অনেক উপজাতি আছে, শিকার না পেলে যারা না খেয়ে মরবে। তাদের শিকারে কিছু হয় না, জন্তুজানোয়ারের বংশ। লোপ পাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বড় একটা হরিণ মারতে পারলে এক-গা লোকের খাওয়া হয়ে যায়। আর ঘরে খাবার থাকলে অহেতুক জানোয়ারও মারে না তারা। কিন্তু ওই পোচাররা তো তা করে না। পালে পালে মারে। যতো বেশি। মারতে পারবে, ততোই পয়সা। জানোয়ার খুন করার জন্যে রীতিমতো আর্মি বানিয়ে নিয়েছে ওরা, থামলেন ওয়ারডেন। তারপর বললেন, টিসাভোর পোচারদের সর্দারের নাম লঙ জন সিলভার। অবশ্যই ছদ্মনাম। ট্রেজার আইল্যাণ্ডের সেই কুখ্যাত জলদস্য সিলভারের নাম নিয়েছে। তফাত শুধু স্টিভেনসনের ডাকাতটা লুট করতে সোনার মোহর, আমাদের ডাকাতটা করে জানোয়ারের দাঁত-মাথা-হাড়-চামড়া।

সিলভারের আসল পরিচয় জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

না। পরিচয় তো দুরের কথা, তার আসল চেহারাই নাকি কেউ দেখেনি। বিদেশী, না আফ্রিকান, তা-ও জানি না। আশা করি, এই রহস্যের সমাধান তোমরা করতে পারবে।

চেষ্টা করবো।

মোমবাসা থেকে জাহাজে করে পৃথিবীর বড় বড় শহরে পাচার হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জলহস্তীর মাথা, গাদা গাদা হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিং; চিতাবাঘ, বানর, পাইথনের চামড়া। মাঝেসাঝে কিছু কিছু মাল আটক করা হয়, দুএকটা চুনোপুটি ধরাও পড়ে, কিন্তু আসল লোকটার পাত্তাও পাওয়া যায় না। যাদেরকে ধরা হয়, তারাও কিছু বলতে পারে না। হয়তো সে মোমবাসার কোনো ধনী ব্যবসায়ী, কিংবা এ-দেশের কোনো উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর্মি গড়তে তাই তার। সুবিধে হয়েছে। তবে সবই অনুমান। তাকে না ধরা পর্যন্ত কোনো কিছুই শিওর হয়ে বলা যাবে না।

.

০২.

বিমানটা জার্মানীর তৈরি, চার সীটের একটা স্টর্ক বিমান। ডুয়্যাল কনট্রোল। জয়স্টিকের এক মাথা ধরে রেখেছেন টমসন। আরেক মাথা কো-পাইলটের সীটে বসা মুসার দুই হাঁটুর ফাঁকে। সতৃষ্ণ নয়নে বার বার ওটার দিকে তাকাচ্ছে মুসা, চেপে ধরার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করছে। চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তার। কিছু দিন ধরে প্লেন চালানো শিখছে সে। ওগুলো সব আমেরিকান প্লেন, এটা জার্মান। ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের সমস্ত যন্ত্রপাতির তলায় আর মিটারের লেখা জার্মান ভাষায়, বেশির ভাগই পড়তে পারে না। তাছাড়া যন্ত্রপাতিগুলোও কেমন যেন এলোমেলো, আমেরিকানগুলোর সঙ্গে মিল কম। পারবে, ভাবলো মুসা, সময় লাগবে আরকি। প্র্যাকটিস করতে হবে।

ওই যে উঁচু পাহাড়টা, দেখালেন ওয়ারডেন। চোখা চূড়া।

হ্যাঁ, দেখছি, মুসা বললো। ওপরে প্যাভিলিয়ন মতো কি যেন।

প্যাভিলিয়নই। তাতে টেলিস্কোপ বসানো। একে আমরা বলি পোচারস লুকআউট। ওই টেলিস্কোপ দিয়ে সারাক্ষণ নজর রাখে রেঞ্জাররা, পোচার আছে কিনা দেখে।

কতদূর দেখা যায় ওখান থেকে? মুসার পেছনের সীট থেকে জিজ্ঞেস করলো রবিন।  

 বেশি না, জবাব দিলেন টমসন। মাত্র কয়েক মাইল। আরও বেশি যেতো, বন আর পাহাড়ের জন্যে পারা যায় না। চোখের সামনে বাধা হয়ে যায়। না হলেও বা আর কতদূর দেখতাম? আট হাজার মাইল এলাকা, পুরোটা দেখতে হলে কয়েক শো লুকআউট দরকার। সেটা অসম্ভব। অতো জোগান দিতে পারবে না। সরকার। লোকই দিতে পারে না। ছিলো বাইশ জন, বারো জন শেষ। এরপর কতো লেখালেখি করছি, লোকের জন্যে। অবশেষে রাজি হয়েছে। কাল-পরশু আরও বিশ-তিরিশজন পাবো আশা করি।

পাহারা দেয়া হয় তাহলে কি করে? পেছন থেকে জানতে চাইলো কিশোর। প্লেন নিয়ে ঘোরেন সারাদিন?

সারাদিন হয় না। শুধু আমি চালাতে পারি এটা। পোচার দেখা ছাড়াও আরও অনেক কাজ আছে আমার। তবু সময় পেলেই উড়ি।…আমাদের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। পোচারস লুকআউটের ওপাশে।

সামনে মাইল পাঁচেক দূরে কতগুলো কেবিন দেখা গেল, কুঁড়ে বলাই ভালো। খড়ের চালা, বাঁশের বেড়া। ওটাই তাহলে বিখ্যাত কিতানি সাফারি লজ! অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। টুরিস্ট মৌসুমে এখানেই এসে দলে দলে ভিড় জমায়। ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা! আর দশটা খুদে আফ্রিকান গ্রামের সঙ্গে বিশেষ, তফাত নেই ক্যাম্পটার।

 চঞ্চল হয়ে ঘুরছে মুসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বায়ে হাত তুলে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কি?

একবার চেয়েই শাঁ করে প্লেনের মুখ ঘুরিয়ে দিলেন ওয়ারডেন। উড়ে চললেন সেদিকে। তুমি খুব ভালো রেঞ্জার হতে পারবে, মুসা। চোখ আছে। ওটাটাপ লাইন।

ট্র্যাপ-লাইন?

আমি জানি ট্র্যাপ-লাইন কি, রবিন জবাব দিলো। পোচারদের পাতা ফাঁদের। সারি।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে, টমসন বললেন।

দেখে তো বেড়া মনে হচ্ছে, বললো কিশোর।

বেড়া-ই। কাঁটা ঝোপ আর বাঁশ দিয়ে বানায় পোচাররা। পঞ্চাশ গজ থেকে শুরু করে এক মাইল, দুমাইল পর্যন্ত লম্বা করে। এটা মাইল খানেকের কম হবে না। মাঝে ফাঁকগুলো দেখছে না, প্রত্যেকটা ফাঁকে একটা করে ফাঁদ পাতা আছে।

জানোয়ার ধরা পড়ে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

ধরো, তুমি একটা জানোয়ার। চরে খেতে খেতে চলে এলে বেড়ার কাছে। ওপাশে যাওয়ার ইচ্ছে হলে কি করবে? এতো লম্বা বেড়া ঘুরে যাবে না নিশ্চয়। উঁচু, লাফিয়ে যাওয়াও কঠিন। তার চেয়ে সহজ কাজটাই করবে, ফাঁক দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করবে। এমন ভাবে বেরোতে চাইবে, যাতে বেড়ার কাটা তোমার গায়ে না লাগে। জায়গা মতো লাগানো আছে তারের ফাঁস। মাথা দিয়ে ঢুকে আটকে যাবে তোমার গলায়। ভয় পেয়ে তখন টানাটানি শুরু করবে, সেটাই স্বাভাবিক। খুলবে না ফাঁস, আরও চেপে বসবে গলায়, চামড়া কেটে মাংসে বসে যাবে। রক্তের গন্ধে ছুটে আসবে মাংসাশী জানোয়ার। জ্যান্তই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।

খেয়েই যদি ফেললো আমাকে পোচাররা, আর কি পাবে?

পাবে, পাবে। তুমি হাতি হলে ওরা তোমার দাঁত পাবে, পায়ের পাতা পাবে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানোর জন্যে। লেজ দিয়ে বানাবে মাছি তাড়ানোর। ঝড়ন। হায়েনারাও ওসব খায় না; ফেলে যায়। গণ্ডার কিংবা অন্য জানোয়ার। হলেও অসুবিধে নেই। পোচারদের জিনিস পোচাররা পেয়েই যায়।

দ্রুত নামছে প্লেন।

 কি করবেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

পোচারদের ভয় দেখাবো। বোঝাবো, ওদের আড্ডা দেখে ফেলেছি। অনেক সময় ভয় পেয়ে সরে যায় ওরা, দলে লোক কম থাকলে। বেশি থাকলে অবশ্য। আক্রমণ করে বসে। ভালো করেই জানে ওরা, রেঞ্জার মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন আমাদের। তবে আরও যে আসছে, সেকথা এখনও জানে না। ওরা এলে, রাস্তা দিয়ে দল বেধে এসে ধরবো ব্যাটাদের।

 আরও নিচে নামলো বিমান। ঠিক বেড়ার ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন টমসন। দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি ফাঁকেই আটকা পড়েছে জানোয়ার। কোনোটা ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে, কোনোটা লুটিয়ে রয়েছে মাটিতে, প্রাণহীন, নিথর। বেড়ার দুপাশে ঘোরাঘুরি করছে, মারামারি কামড়া-কামড়ি করছে শবভোজী প্রাণীর দল- হায়েনা, শিয়াল, বুনো কুকুর, শকুন। প্লেনের শব্দ ছাপিয়ে কানে। আসছে ওদের চিৎকার।

একশো চল্লিশ থেকে শুধু তিরিশ মাইলে গতিবেগ নামিয়ে আনলেন টমসন। গাছের জটলার ভেতরে কয়েকটা খড়ের ছাউনি চোখে পড়লো। পোচারদের অস্থায়ী আস্তানা। মাটির পঞ্চাশ ফুট ওপর দিয়ে সেদিকে উড়ে গেল বিমান।

এতোগুলো আছে ভাবিনি! বিড়বিড় করলেন ওয়ারডেন।

হঠাৎ বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একঝক কালো মানুষ। হাতে তীর ধনুক আর বল্লম। প্লেন সই করে ছুঁড়ে মারলো। যদিও একটাও লাগলো না, বিমানের গায়ে।

বিশেষ কাজের জন্যে তৈরি করা হয়েছে এই প্লেন। সীটের নিচে পায়ের কাছে অ্যালুমিনিয়মের চাঁদরের পরিবর্তে লাগানো হয়েছে শক্ত প্লাস্টিক, যাতে নিচের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। সবই দেখতে পাচ্ছে ওরা।

আবার পোচারদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। ছুটে এলো আরও এক ঝাঁক তীর। একটা কনুই জানালার বাইরে রেখেছিলেন টমসন, ঝটকা দিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে। ভীষণ চমকে গেছেন। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। জয়স্টিক চেপে ধরলেন। দ্রুত উঁচু হয়ে গেল বিমানের নাক। সোজা ছুটলো। কিতানি সাফারি লজের দিকে।

.

০৩.

পাশে বসে মুসা দেখতে পেলো না, তার পেছনে বসে রবিনও না। কিন্তু পেছনে বসা কিশোর ঠিকই দেখলো। কালো ছোট একটা তীর বিধে রয়েছে টমসনের বাহুতে। মাংস এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে আছে তীরের চোখা মাথা।

মুসাআ! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। উনি, উনি তীর খেয়েছেন…

পাশে কাত হয়ে তীরটা দেখতে পেলো মুসা। ওরা ভয় পাবে বলে দেখাতে চাননি ওয়ারডেন, লুকিয়ে ফেলেছিলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, কিচ্ছু ভেবো না। ঘুমিয়ে পড়ার আগেই ক্যাম্পে পৌঁছে যাবো।

বিষ আছে না? অন্য দুজনের মতোই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে রবিন।

 বোধহয়।

তীরের মাথাটা ভালো করে দেখলো মুসা। মারাত্মক বিষাক্ত অ্যাকোক্যানূথেরা গাছের কালো আঠা আঠা রস মাখিয়ে নেয় জংলীরা, শুনেছে সে। তীরের মাথায় সে-রকম কিছু চোখে পড়লো না। কই, বিষ তো নেই। শুধু রক্ত।

ওখানে তো দেখবে না। ও-জায়গায় লাগায় না ওরা।

কেন?

নিজেদের গায়ে লাগার ভয়ে। পিঠের তৃণে তীর নিয়ে ঝোপঝাড়ে চলাফেরা করে, দৌড়ায়। হোঁচট খেয়ে পড়ে। তখন যে-কোনো সময় তীরের খোঁচা লাগতে পারে। যার সঙ্গে থাকে তার গায়েও, যারা সাথে থাকে তাদের গায়েও। নিজেদের বিষে নিজেরাই মরবে।

তাহলে কোথায় লাগায়?

 ডাণ্ডায়। তীরের মাথার ঠিক পেছনে।

সর্বনাশ! ওই জায়গাটাই তো ঢুকে আছে আপনার হাতে। বের করে ফেলা। যায় না?

তা যায়। কিন্তু নাগালই তো পাবে না, ঠিকই বলেছেন টমসন। তার আর কো-পাইলটের মাঝের সীটে দুই ফুট ব্যবধান। আহত হাতটা রয়েছে আরও দূরে। ওখানে পৌঁছতে হলে যন্ত্রপাতির ওপরে ঝুঁকে হাত বাড়াতে হবে, মুসাকে, প্লেন নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়বে। রবিন রয়েছে আরও দূরে, তার পক্ষে আরও কঠিন।

আমি পারবো, কিশোর বললো। বলুন, কি করতে হবে।

এক মুহূর্ত ভাবলেন- টমসন। টেনে বের করতে পারবে না, ফলা আটকে যাবে। দেখো, মাথাটা ভাঙতে পারো কিনা।

পাইলটের সীটের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এক হাতে তীরের মাথা, অন্য হাতে ডাণ্ডাটা চেপে ধরলো কিশোর। চাপ দিলো। আরে! যা ভেবেছিলো তা তো নয়। যথেষ্ট শক্ত। আরও জোরে চাপ দিলো সে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাত, পিছলে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। ঘামতে শুরু করেছে দরদর করে। না, গরমে নয়, টমসনের কি রকম কষ্ট হচ্ছে সেকথা ভেবে। নিশ্চয় ভীষণ ব্যথা পাচ্ছেন। কিন্তু টু শব্দ করলেন না তিনি।

মট করে ভাঙলো অবশেষে। আলাদা হয়ে গেল তীরের মাথা। এবারের কাজ আরও জটিল। তাড়াতাড়ি ডাণ্ডাটা বের করে আনা।

ভাণ্ডা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো কিশোর। খুললো না ওটা।

রক্তাক্ত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রবিনের দিকে ফিরলো। কিশোর। দেখো তো, ওঁর হাতটা ধরতে পারো, কিনা? নাগাল পাবে?

উঠে চেষ্টা করে দেখলো রবিন। প্লেনের ভেতরে জায়গাই নেই। পারলো না।

আবার একা কিশোরকেই চেষ্টা করতে হলো। ডাণ্ডাটা ধরে দাঁতে দাতে চেপে আবার মারলো টান। কন্ট্রোলের ওপর থেকে হাত নড়ে গেল টমসনের। দুলে উঠলো প্লেন। কিন্তু যেখানের ডাণ্ডা সেখানেই রইলো। তাড়াতাড়ি প্লেনটাকে সামলালেন তিনি।

হাড়ে আটকে গেল না তো? গলা কাঁপছে রবিনের। দেখো আরেকবার টেনে।

মুসার আশা ছিলো, বড় হয়ে সার্জন হবে, এখানেই বাদ দিয়ে দিলো সেই ভাবনাটা। মানুষের এসব কষ্ট দেখলে সহ্য হয় না তার।

তৃতীয়বার টান দিলো কিশোর। লাভ হলো না। শেষে মরিয়া হয়ে ডাণ্ডাটা ধরে ওপরে-নিচে করে, আশেপাশে নেড়ে ছিদ্রটা বড় করতে লাগলো। মানুষটাকে কতোখানি ব্যথা দিচ্ছে কল্পনা করে তার নিজেরই বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে। শেষ। পর্যন্ত আরেকবার ধরে গায়ের জোরে দিলো টান, ছাড়লো না, টানতে লাগলো।

খুলে এলো ডাণ্ডাটা।

মুখ খুললেন টমসন। কিশোর ভাবলো বজ্জাত ছেলে বলে তাকে গাল দেবেন ওয়ারড়েন। কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন শুধু তিনি, গুড বয়!

ধপ করে সীটে এলিয়ে পড়লো কিশোর। হাঁপাচ্ছে, ঘামছে। কেনিয়ার প্রচণ্ড গরম তো আছেই, সেই সাথে ভয়ানক উত্তেজনা। চোখের সামনে ডাণ্ডাটা তুলে। দেখলো সে। ভাঙার মাথার কাছে লেগে রয়েছে লাল রক্ত আর কালো বিষ।

কিন্তু এতো কষ্ট করে তীরটা খুলে লাভ হবে তো? ওয়ারডেন কি বাঁচবেন? বিষ যা ঢোকার তা তো ঢুকেই গেছে রক্তে। সবই নির্ভর করে এখন তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। এই বিষে শিশুরা কয়েক মিনিটেই মরে যায়। মহিলারা টেকে বড় জোর বিশ মিনিট। তবে, কিশোর শুনেছে, লড়াই করতে গিয়ে শত্রুর তীর খেয়ে দুই ঘন্টা বেহুশ হয়ে ছিলো একজন আফ্রিকান যোদ্ধা, তারপর ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে।

আরও একটা ব্যাপার, বিষটা কতোখানি নতুন তার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। পুরনো হলে, ধুলো-ময়লা বেশি লেগে থাকলে কার্যক্ষমতা কমে যাবে অনেকখানি। মনে মনে প্রার্থনা করলো কিশোর, খোদা, তা-ই যেন হয়!

জয়স্টিকের ওপর ঢলে পড়লেন ওয়ারডেন। সঙ্গে সঙ্গে গোঁত্তা খেয়ে নাক পোচার নামিয়ে ফেললো বিমান, ধেয়ে চললো মাটির দিকে।

নিজের হাঁটুর ফাঁকে জয়স্টিকের আরেকটা অংশ ধরে জোরসে টান দিলো মুসা, সরাতে পারলো না। বেজায় ভারি টমসন। ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে আসছে। যেন ধরণী। চেঁচিয়ে উঠলো সে, জলদি সরাও ওকে!

নিচের দিকে ঝুঁকে গেছে বিমান। এই অবস্থায় কিশোর আর রবিনও সোজা হতে পারছে না। তাড়াতাড়ি সীটবেল্ট বেঁধে নিলো দুজনে। টমসনের কাধ ধরে টেনে সূরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। রবিনের নাগালের মধ্যেই আসছে না তেমন, তবু কোনোমতে ওয়ারডেনের শার্টের কলার খামচে ধরে টানলো। মুসা চুপ। করে নেই; সে টেনে ধরে রেখেছে জয়স্টিক।

আস্তে আস্তে বেহুঁশ টমসনকে টেনে তুললো কিশোর আর রবিন।

দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা লম্বা ক্যাপোক গাছ। চোখ বন্ধ করে স্টিকে টান মারলো মুসা। ভাবছে, গাছের সঙ্গে বাড়ি লাগলে মরতে কি খুব কষ্ট হবে? বাড়ি লাগলো না। শেষ মুহূর্তে শ করে গাছের ওপর দিয়ে বেরিয়ে এলো প্লেন।

ধরে না রাখলে আবার হেলে পড়ে যাবেন টমসন। দুদিক থেকে তাকে ধরে রেখেছে কিশোর আর রবিন। মুসা প্লেন সামলাতে ব্যস্ত। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের দিকে। গিজমোটা কোথায়, যেটা ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করে? জার্মান বিমানের ফুট প্যাডাল কি কি কাজ করে? চাপ দিতে গিয়েও পা সরিয়ে আনলো সে, সাহস হলো না। উড়ে চলা সহজ, কিন্তু ওঠানো নামানো খুব কঠিন কাজ। পারবে? নামাতে পারবে? এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। ওদের। চারজনের জীবন নির্ভর করছে এখন তার হাতে। যা করে আল্লাহ! ভেবে, তৈরি হয়ে গেল ল্যাণ্ডিঙের জন্যে।

ল্যাণ্ডিংফীল্ডটা খুঁজলো তার চোখ। সারি সারি কেবিন দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু অ্যাসফল্টে বাঁধানো কোনো রানওয়ে চোখে পড়লো না। অবশেষে উইণ্ড-সকটা দেখতে পেলো। উড়ে গেল সেদিকে। রানওয়ে নেই। ঘাসে ঢাকা লম্বা এক চিলতে জমি। ওটাতেই বোধহয় নামানো হয় এই প্লেন।

যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া শুরু করলো সে। কয়েক মিনিটেই অনেকখানি বুঝে ফেললো, কোনটা কি কাজ করে। ক্যাম্পের ওপর চক্কর দিলো একবার। উড়ে গেল আবার মাঠের দিকে। মনে মনে আন্দাজ করে নিলো কোন জায়গাটায় নামালে গাছের গায়ে ধাক্কা লাগবে না।

প্লেনের নাক নিচু করে ল্যাণ্ডি করতে যাবে, এই সময় এয়ারস্ট্রিপের ঘাসের মধ্যে একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো। হলুদ আর কালো রঙের কি যেন। নড়ে উঠলো আবার। কী, বোঝা গেল। সিংহের একটা পরিবার।

রোদ পোহাচ্ছে ওরা। প্লেনের আওয়াজে কর্ণপাত করছে না। মুসার জানা। আছে, প্লেন, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ির আওয়াজকে ভয় করে না সিংহ, বিশেষ করে ন্যাশনাল পার্কের জানোয়ারগুলো। ওসব যানবাহন দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে ওদের।

সিংহগুলোর জন্যে প্লেন নামানো যাবে না, ল্যাণ্ডিঙের পথ জুড়ে রয়েছে ওগুলো। কখন যাবে না যাবে তারও ঠিক নেই। দেরিও করা যাচ্ছে না। টমসনের। অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে, তাড়াতে হবে। সিংহগুলোকে।

প্রায় ডাইভ দিয়ে ওগুলোর বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো বিমান নিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে শুয়ে-বসে আছে ওরা ঘাসের মধ্যে। অল্প বয়েসীগুলো অলস চোখে তাকালো প্লেনের দিকে, বয়স্কগুলো চোখই মেললো না। কালো কেশরওয়ালা বিশাল এক পশুরাজ চিত হয়ে আছে, বাঁকা করে চার পা তুলে রেখেছে আকাশের দিকে।

মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে মাটির একেবারে কাছাকাছি, সিংহগুলোর ওপরে চলে এলো মুসা। থ্রটল পুরোপুরি খুলে রেখেছে। প্রচণ্ড গর্জন করছে এঞ্জিন। এইবার একটা সিংহীর টনক নড়লো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আর এখানে থাকা নিরাপদ মনে। করলো না। প্লেনের দিকে চেয়ে একবার মুখ ভেংচে উঠে দাঁড়ালো, তার শাবকগুলোকে জড়ো করে হেলেদুলে এগিয়ে চললো কয়েকটা গাছের দিকে।

আবার ফিরে এলো মুসা।

বিরক্ত হয়ে চোখ মেললো বুড়ো সিংহটা। বিকট হাঁ করে হুঙ্কার ছাড়লো একবার। দূর, এখানে ঘুমানো যায় নাকি? যত্তোসব! এরকম একটা ভাব করে। উঠে দাঁড়ালো। রওনা হলো সিংহীটা যেদিকে গেছে সেদিকে। পরিবারের অন্যেরাও আর থাকলো না ওখানে। বুড়োর পেছন পেছন চললো।

ল্যাণ্ড করার জন্যে তৈরি হলো মুসা। প্রথমবার মাটিতে চাকা ছোঁয়াতে গিয়েও আবার তুলে ফেললো। সাহস হচ্ছে না। যদি ঝাঁকুনিতে ভেঙে পড়ে? দ্বিতীয়বারেও, পারলো না। তৃতীয়বারে আর ভাবলো না।

জোর ঝাঁকুনি লাগলো, তবে ভাঙলো না বিমান। মোটামুটি ভালোই ল্যাণ্ড করেছে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্যাক্সিইং করে ছুটলো। খানিক দূর এগিয়ে বিশাল এক গাছের মাত্র কয়েক ফুট দূরে আরেকবার জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে দাঁড়ালো বিমান, এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।

.

০৪.

মরার মতো এলিয়ে পড়েছেন টমসন। নাড়ি দেখলো কিশোর। খুব মৃদু চলছে। আশা আছে এখনও। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে মাটিতে নামালো তাঁকে। কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে দৌড়ে এলো একটা লোক। কুচকুচে কালো এক নিগ্রো। পরনে হালকা রঙের ইউনিফর্ম। মাথায় মিলিটারিদের মতো ক্যাপ, ওটার পেছনে ঝুলছে পাতলা কাপড়ের কেপি, ঘাড় ঢেকে দিয়েছে–পোকামাকড়ের জ্বালাতন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা। তিন গোয়েন্দার বুঝতে অসুবিধে হলো না, লোকটা একজন রেঞ্জার।

কি হয়েছে? ভাঙা ইংরেজিতে বলতে বলতে অচেতন দেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সে।

 বিষ মাখানো তীর, জানালো কিশোর।

 ওয়ারডেনের বুকে কান রাখলো রেঞ্জার। মরেনি। জজের কাছে নিয়ে যাবো। ঠিক করে দেবেন।

জজ দিয়ে কি হবে? ডাক্তার দরকার।

জজই ডাক্তার। ভালো করে ফেলবেন।

জজের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করলো না কিশোর। পকেট থেকে রুমাল বের করে বাধলো টমসনের হাতে, ক্ষতের কিছুটা ওপরে।

ওয়ারডেনকে বয়ে নিয়ে আসা হলো মূল কেবিনটাতে। ভেতরে কয়েকটা ভালো চেয়ার আছে, আর একটা বড় ডেস্ক। এই কেবিনেই ঘুমান তিনি, অফিসও এটাই। বিছানায় শোয়ানো হলো তাকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন ছোটখাটো একজন মানুষ।

এই যে, জজ এসেছেন, রেঞ্জার বললো। তিনি ঠিক করে দেবেন।

চেহারা আর চামড়ার রঙ দেখেই বোঝা গেল জজের বাড়ি এশিয়ায়, সম্ভবত ভারতে। অ্যাকসিডেন্ট? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

সংক্ষেপে জানালো রবিন।

আমি না থাকলে তো সর্বনাশ হতো, জজ বললেন। ভাগ্যিস এসে পড়েছিলাম। যাকগে, আর কোনো ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

চুপচাপ জজকে দেখছে কিশোর। তার মনে হলো, টমসনের ভয়ানক বিপদে জজ মোটেও উদ্বিগ্ন নন। বরং যেন কিছুটা খুশিই লাগছে তাঁকে। কি জানি, হয়তো ওরকম হাসিখুশি স্বভাবই লোকটার। কিংবা হয়তো বুঝতে পারছেন, ভয়ের কিছু নেই, সেরে উঠবেন ওয়ারডেন।

প্রথমেই হাত থেকে দ্রুত রুমালটা খুলে ফেলে দিলেন তিনি।

এটা কি করলেন? বলে উঠলো কিশোর। রক্তে বিষ আরও বেশি ঢুকে যাবে না?

যা গেছে তা গেছেই, শান্ত কণ্ঠে বললেন জজ। আরও যাতে যেতে পারে সে-জন্যে খুলোম। এক জায়গায় আটকে রাখার চেয়ে সমস্ত সিসটেমে বিষ ছড়িয়ে দেয়াটাই ভালো। অ্যাকশন কমে যায় তাতে। বিশেষ করে অ্যাকোকেনথেরার।

এরকম থিওরি জীবনেও শোনেনি কিশোর। ভাবলো, কি জানি, এখানকার বিষের ব্যাপারে নিশ্চয় জজ সাহেব তার চেয়ে ভালো বোঝেন। তর্ক করলো না। বললো, ডিসটিলড ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিলে ভালো হতো না?

খারাপ হবে আরও, খোকা, ধৈর্য ধরে ছেলেকে বোঝাচ্ছেন যেন অভিজ্ঞ পিতা। ওসব বোয়ামোছা বাদ দিয়ে আগে ইনজেকশন দিতে হবে। বিষের প্রতিষেধক।

অ্যামোনিয়াম কারবোনেট?

সরু হয়ে গেল জজের চোখ। ওই কিশোর ছেলেটা এতো কিছু জানে দেখে। অবাক হয়েছেন, যেন, কিছুটা অস্বস্তিও ফুটলো বুঝি চোখের তারায়। পরক্ষণেই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে, দূর হয়ে গেল অস্বস্তি। এইবার ঠিক বলেছো। দেখি, ডিসপেনসারিতে আছে কিনা।

ওঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে গিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকলেন জজ। কৌতূহলী হয়ে তার পিছু নিলো কিশোর। সময় মতোই গিয়ে ঢুকলো ডিসপেনসারিতে। দেখলো, তাকের সামনের সারি থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে সবগুলো সারির পেছনে রেখে দিচ্ছেন তিনি, এমন জায়গায়, সহজে যাতে চোখে পড়ে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন। অ্যামোনিয়াম নেই। পেলে ভালো। হতো। নেই যখন, কি আর করা? কোরামিনই দিতে হবে। হার্ট স্টিমুল্যান্ট। হৃৎপিণ্ডটাকে চাঙ্গা করে তুলতে হবে এখন।

একমত হলো কিশোর। জজের ওপর ভক্তি ফিরে এলো আবার! কোরামিন। খুঁজতে সাহায্য করলো তাকে।

কিশোর! ও কিশোর! রবিনের ডাক শোনা গেল। জলদি এসো! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে!

বেডরুমে ছুটে গেল কিশোর।

কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে ওয়ারডেনের চেহারা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দ্রুত গিয়ে তার মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া হলো কিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকশোর। উরুতে দ্বির, কালচে বাদাগেই হঠাৎ চালাতে শুরু করলো সে।

 চালিয়ে গেল, যতোক্ষণ না আপনাআপনি শ্বাস নিতে পারলেন টমসন। হৃৎপিণ্ডে উত্তেজক কিছু ঢোকাতে না পারলে থেমে যাবে আবার শিগগিরই। জজের হলো কি? সিরিঞ্জে কোরামিন ভরতে পারলেন না এখনও?

সিরিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকলেন জজ। টমসনের পাশে বসে সুচ লাগালেন ক্ষতে। ওখানে কে?–ভাবলো কিশোর। উরুতে দিলে ভালো হতো না? তারপর চোখ পড়লো সিরিঞ্জের ভেতরের তরল পাদর্থের ওপর, কালচে বাদামী।

 আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল কিশোর। সুচ ঢোকানোর আগেই হঠাৎ জজের কব্জি চেপে ধরলো। কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালেন জজ।

মাপ করবেন, স্যার, হাত ধরে রেখেই বললো কিশোর।

বোধহয় ভুল হয়েছে আপনার। রঙটা দেখুন। কোরামিন নয়, বরং অ্যাকোকেনথেরার মতোই লাগছে।

সিরিঞ্জের দিকে তাকালো জজ, আঁতকে উঠলো। তাই তো! ঠিকই তো বলেছো। সর্বনাশ করে দিয়েছিলাম আরেকটু হলেই। পাশাপাশি দুটো বোতল ছিলো। তাড়াহুড়োয় কোরামিন ভরতে যেয়ে ভুলে আরেকটা ভরে ফেলেছি।

প্রায় জোর করে সিরিঞ্জটা জজের আঙুলের ফাঁক থেকে বের করে নিয়ে ডিসপেনসারিতে রওনা হলো কিশোর। লোকটার ডাক্তারি বিদ্যার ওপর ভরসা নেই আর তার, সন্দেহ জাগছে। তবে ডিসপেনসারিতে ঢুকে সন্দেহ দূর হয়ে গেল। মিথ্যে বলেননি জজ। মাঝের তাকে পাশাপাশি দুটো বোতল রাখা আছে, একটাতে লেবেল লাগানো রয়েছে কোরামিন, আরেকটাতে অ্যাকো। ওভাবে রাখাটা স্বাভাবিক। কারণ একটার পর পরই আরেকটা ব্যবহার হয়। রেঞ্জাররা যখন বড় কোনো জানোয়ার ধরে, চিকিৎসা করার জন্যে, ওটাকে বেহুশ করে নিতে হয়। আগে। হাতি-গণ্ডার-জিরাফ-সিংহ কোনোটাই সচেতন অবস্থায় চিকিৎসা নিতে রাজি নয়। খুব সামান্য পরিমাণ অ্যাকোনাইট ঢুকিয়ে দেয়া হয় জানোয়ারের রক্তে। ডাটের সাহায্যে। তাতে বেহুশ হয়ে যায় জীবটা। পরে কোরামিন দিয়ে ওটাকে আবার সুস্থ করে তোলা হয়।

জজের ওপর থেকে সন্দেহ চলে গেল কিশোরের। একজন ভদ্রলোককে সন্দেহ করেছিলো বলে লজ্জা লাগলো এখন। বিষ ভরা সিরিঞ্জটা ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা সিরিঞ্জ বের করে তাতে কোরামিন ভরে নিলো। ফিরে এসে জজকে অনুরোধ করলো, আমি পুশ করি, স্যার? পারবো, ফার্স্ট এইডের ট্রেনিং আছে আমার।

নীরবে মাথা কাত করলেন জজ। সরে জায়গা করে দিলেন।

টমসনের উরুতে ইনজেকশন দিলো কিশোর। তারপর নাড়ি ধরে বসে রইলো চুপ করে। শ্বাস আর বন্ধ হলো না তার। তবে নাড়ির গতিও বাড়ছে না, খুব ক্ষীণ। আধ ঘন্টা পর বাড়তে শুরু করলো। এতো দ্রুত, প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেল। ভালো লক্ষণ নয় এটা। ঘাবড়ে গেল সে। জজকে বললো সেকথা।

পায়চারি করতে করতে থমকে দাঁড়ালেন জজ। বললেন, ভয় নেই, ঠিক হয়ে। যাবে। ওরকমই হয়।

তা-ই হলো। ধীরে ধীরে কমে আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো নাড়ির গতি।

সেকথা জানাতেই ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন জজ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। উদ্বেগ চলে গেল চেহারা থেকে। বললেন, ওকে হারালে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। ওর মতো লোক এখন দরকার, বেচারা। জানোয়ারগুলোকে বাঁচানোর জন্যে। পোচাররা শেষ করে ফেলবে সব। ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি…ও হ্যাঁ, জানো না বোধহয়, আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির আমি একজন ডিরেক্টর। ব্যাটাদের ধরতে পারলে, দাঁত কিড়মিড় করলেন তিনি। আর যদি কোর্টে আমার সামনে পাই! এমন শাস্তি দেবো…কি যে কষ্ট দিয়ে মারে জানোয়ারগুলোকে, না দেখলে বুঝবে না! চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠলো তার। তাকালেন ওয়ারডেনের দিকে। ও শুধু আমার বন্ধু না, ভাইয়ের মতো। ও না বাচলে… গলা ধরে এলো তার। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।

কারও দুঃখ সইতে পারে না মুসা। তার চোখেও পানি এসে গেল। রবিন নীরব। শুধু কিশোরের কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ তাকিয়ে আছে জজের। দিকে। চিন্তিত।

.

০৫.

নড়ে উঠলেন টমসন। দুই লাফে গিয়ে কিশোরকে সরিয়ে পাশে বসে পড়লেন জজ। ওয়ারডেনের হাত তুলে নাড়ি টিপে ধরলেন।

চোখ মেলতেই উদ্বিগ্ন, অশ্রুভেজা একটা প্রিয় মুখ দেখতে পেলেন টমসন। উষ্ণ আন্তরিক চাপ অনুভব করলেন হাতে। চুপ করে পড়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কথা বললেন। দুর্বল কণ্ঠই বুঝিয়ে দিলো কতোখানি নরম হয়ে গেছে তার। শক্তিশালী শরীরটা। থ্যাঙ্ক ইউ.. তুমি যে কতো উপকার করলে আমার! ছেলেদের ওপর নজর পড়তে বললেন, পরিচয় হয়েছে?

না, বললেন জজ। তোমাকে নিয়েই তো কাটলো। সময় আর পেলাম কই?। পোচার।

তাহলে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলাও। ও কিশোর পাশা—মুসা আমান: রবিন মিলফোর্ড। ছেলেরা, এ হলো গিয়ে আমার প্রিয় বন্ধু জজ নির্মল। পাণ্ডা। এবার নিয়ে কয়েকবার প্রাণ বাঁচালো আমার। তুমি না থাকলে, নির্মল…

আরে রাখো তো ওসব কথা, বন্ধুকে থামিয়ে দিলেন জজ পাণ্ডা। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, এমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। অবশ্য জানা থাকলে সব। সহজই মনে হয়। একটা কোরামিন ইঞ্জেকশন, ব্যস।

 অনেক কিছু জানে ও, ছেলেদের কাছে বন্ধুর প্রশংসা করলেন ওয়ারডেন। কিভাবে কি করেছে ভালোমতো দেখেছো তো? শিখে রাখলে কাজ দেবে।

হ্যাঁ, তা দেখেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব কাছে থেকেই দেখেছি, জিভের ডগায় এসে গিয়েছিলো, না দেখলে এতোক্ষণে মরে যেতেন আপনি, কিন্তু বললো না। তাড়াহুড়োয় ওরকম ভুল করতেই পারে লোকে, জজ সাহেব তো আর ডাক্তার নন। ডাক্তাররাও ভুল ওষুধ দিয়ে রোগী মেরে ফেলে অনেক সময়। তাছাড়া। মিস্টার টমসনকে খুন করে তার কি লাভ?

তবে, খুন করার ইচ্ছে থাকলে মস্ত একটা সুযোগ গেছে। ক্ষতের মধ্যে রয়েছে। অ্যাকো বিষ, রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আরও খানিকটা ইনজেক্ট করে ঢুকিয়ে দিলে কেউ ধরতে পারতো না, এমনকি ময়না তদন্তেও ফারাকটা বোঝা যেতো না। দূর, কি আজেবাজে কথা ভাবছে! নিজেকে ধমক দিয়ে জোর করে ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে দিলো কিশোর। ওই তো বসে আছেন হাসিখুশি ছোট্ট মানুষটা, নিষ্পাপ চেহারা, বন্ধুর জন্যে জান কোরবান।

শুনে খুশি হবে, নির্যাল, ওয়ারডেনের গলার জোর কিছুটা বেড়েছে। ছেলেগুলোর সুনাম আছে আমেরিকায়। এই বয়েসেই তুখোড় গোয়েন্দা হয়ে। গেছে। এমনকি পুলিশের চীফ পর্যন্ত ওদেরকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে। বেড়াতে এসেছে এখানে। খুব রেগেছে পোচারদের কথা শুনে। আমাদের সাহায্য করবে কথা দিয়েছে।

আচ্ছা! তাই নাকি? মিষ্টি করে হাসলেন জজ। খুব ভালো কথা। তবে ছেলেরা, সাবধান করে দিচ্ছি। এটা আমেরিকা নয়। আর হারানো আঙটি কিংবা বাচ্চার পুতুল খুঁজে দেয়ার ব্যাপারও নয়। এখানে একদল খুনীকে নিয়ে কারবার। এই তো, একটু আগেই তো দেখলে, ওয়ারডেনকেই শেষ করে দিচ্ছিলো।

নির্মল, এতো ছোট করে দেখোনা ওদের। অনেক অভিজ্ঞতা আছে, খুনে বদমাশও ধরেনি তা নয়। আমাজানের গভীর জঙ্গল থেকেও ঘুরে এসেছে ওরা, নরমুণ্ড শিকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসেছে, ধরে নিয়ে এসেছে অনেক দুর্লভ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার।

কিন্তু তবু, নরম গলায় প্রতিবাদ করলেন জজ। পোচারদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।

সেটা ঠিক। তবে আমরা নরম হয়ে আছি লোকবল নেই বলে। কাল থেকে বোধহয় আর থাকবে না।

কেন?

আরও জনা তিরিশেক রেঞ্জার আসছে।

কখন?

আশা করছি কাল দুপুরে।

হঠাৎ কি মনে পড়তে যেন চমকে উঠলেন জজ। হায় হায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। জরুরী কাজ আছে, ভুলেই গেছি। নাইরোবিতে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, পথেই যখন পড়লো দেখা করে যাই। মনে হয় তোমার ভাগ্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। যাকগে, উঠি, নইলে রাতের আগে পৌঁছতে পারবো না। ও, আসল। কথাটাই এখনও জানা হয়নি। তীরটা কোন জায়গায় খেলে?:

পশ্চিমে ক্যাম্প করেছে ব্যাটারা। এখান থেকে মাইল সাতেক হবে।

তাহলে তো কাছেই। লোকও যখন পাচ্ছো, আশা করি ধরে ফেলতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বয়েজ। আবার সাবধান করছি। মনে। রেখো, এটা আমেরিকার আধুনিক শহর নয়, বলে, আবার একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন জজ।

দিন একটা গেল বটে তোমাদের! জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন জজ। আমার জন্যে আর ভেবো না, ঠিক হয়ে যাবো। যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিছু দরকার হলে যে-কোনো একজন রেঞ্জারকে ডেকে বলো। ওদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে।

কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখলো ওরা, একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। নিশ্চয় জজ নির্মল পাণ্ডার গাড়ি। ভুরু কুঁচকে তাকালো কিশোর। ওদিকে যাচ্ছে কেন? নাইরোবির সড়ক তো উত্তরে। ওটা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে!

পড়ন্ত বেলার রোদ লাগছে চোখেমুখে। চোখ ছোট ছোট করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা, যতোক্ষণ না ওটা ছায়াঢাকা বুনোপথে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে, গেল।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে নয়।

লোকটার আচরণ ভারি অদ্ভুত লেগেছে আমার, রবিন বললো।

কিশোর কিছু বললো না। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। পোচার

***

কেবিন, বা কটেজের আফ্রিকান নাম, ব্যাণ্ডা। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় বেশ বড় একটা লিভিংরুম আছে, বড় বড় চেয়ারে আরাম করে বসা যায়। ওপর দিকে তাকালেই চোখে পড়বে খড়ের চালায় অসংখ্য টিকটিকি, মাছি পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ধরে খেয়ে ফেলছে। পাশেই বেডরুম, তাতে তিনটে বিছানা পাতা। গোসলখানা আছে, ভাড়ার ঘর আছে। সব চেয়ে লোভনীয় মনে হলো ওদের কাছে, রেলিঙে ঘেরা বেশ ছড়ানো একটা বারান্দা। ডাইনিং টেবিল আছে ওখানে, আর কিছু ক্যাম্প চেয়ার বসে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। জন্তুজানোয়ার আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারবে। যতো খুশি।

 তিরিশ ফুট দূরে আলাদা একটা কুঁড়েতে রান্নাঘর বানানো হয়েছে। একটা আফ্রিকান ছেলে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, খাবার লাগবে কিনা। হাসি এসে গেল মুসার।

খোলা জায়গায় বসে খাওয়া আর চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা চললো একই সঙ্গে। সবুজ উপত্যকার পরে লাল পাহাড়, দূরে নীলকিলিমানজারো পর্বতের উনিশ হাজার ফুট উঁচু তুষারে ঢাকা চূড়া।

উপত্যকা থেকে রোদ চলে গেছে। নামছে গোধূলির আবছা অন্ধকার। কিন্তু সূর্য যে একেবারে ডুবে যায়নি, কিলিমানজারোর চকচকে চূড়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সাদা তুষার এখন গাঢ় লাল। সূর্য যতোই দিগন্তের নিচে হারিয়ে যেতে লাগলো, ফ্যাকাসে হয়ে গেল লাল রঙ, শেষে আর কিছুই থাকলো না। ঝুপ করে হঠাৎ যেন নেমে এলো অন্ধকারের চাদর। আকাশে ফুটলো বড় বড় উজ্জ্বল তারা।

 দূরে দূরে ছিলো এতোক্ষণ জন্তুজানোয়ারেরা,রাত নামতেই খাবারের গন্ধে আর পানির লোভে পায়ে পায়ে এসে হাজির হলো অনেকে।

বসে বসে কিছুক্ষণ দেখলো ছেলেরা। সারা দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ। বসে থাকতে পারলো না আর। উঠে, শুতে চললো।

<

Super User