ঈশ্বরের অশ্রু – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট
, ১৯৯২

০১.

সাবধান! তিন গোয়েন্দাকে হুঁশিয়ার করল হেনরি বেসিন, একটু এদিক ওদিক হলেই কিন্তু খেপে যাবে বুড়োটা।

এমনিতে হাসিখুশি লোক বেসিন। রসিক। কিন্তু এখন ভুরু কুঁচকে রেখেছে। ওই শকুনটা, বললো সে। এমন কিপটের কিপটে, পয়সাই ছাড়তে চায় না। তাই তোমাদের ইউনিফর্ম ঠিকমত করে দিতে পারলাম না। কিশোর, জ্যাকেটটা ঢলঢলে হয়েছে।

হাতের ট্রেটা নামাল কিশোর। চীজ পাফ আর রুমাকিগুলো সরিয়ে রাখল। তারপর তাকাল গায়ের শাদা ওয়েইটারের পোশাকটার দিকে। তার চেয়ে অনেক মোটা লোকের পোশাক এটা। সব জায়গাতেই ঢোলা। বিশেষ করে দুই কাঁধ থেকে হাতা অনেকখানি ঝুলে পড়েছে।

এর বেশি আর কিছু দিতে পারছি না, বেসিন বলল। ছোট আরেকটা আছে অবশ্য, তবে সেটা গায়েই লাগবে না তোমার। নাহ্, এভাবে আর পারা যায় না।

 কিশোরের পেছনে রয়েছে মুসা। তার হাতেও ট্রে। তাতে ক্যারট স্টিক আর ডিপ। তার জ্যাকেটটা এত খাটো হয়েছে, প্রায় কোমরের কাছে উঠে এসেছে। কনুইয়ের সামান্য নিচে হাতা, কবজি থেকে অনেক দূরে। অনেকটা কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত লাগছে তাকে।

আর রবিনেরটা তো সব চেয়ে ঢোলা। এমনকি কিশোরেরটার চেয়েও। হাতা গুটিয়ে রাখতে হয়েছে। নইলে আঙুল সহ ঢেকে যায়। হাতে ট্রে। বেঢপ লাগছে। শরীরটা পোশাকের কারণে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল বেসিন। আর কিছু করার নেই আমার। যাও, মেহমানদের খাবার দাও। লিসটারের সামনে না পড়লেই হবে। কিছু ভাঙলে নিজের দায়িত্বে ভাঙবে। আমি কিছু করতে পারব না। এক ফোঁটা চা ফেলে দিলেও মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে বুড়োটা।

 রান্নাঘরের দরজা খুলে দিল বেসিন। ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিভিং রুমের গেস্টদেরকে খাবার বিতরণ করতে লাগল। পুরনো আমলের ঘর। মানুষগুলোও পুরনো। পুরনো আসবাব আর তাক বোঝাই জিনিসপত্র কেমন অস্বস্তি জাগায়। বাগানের দিকের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোগুলো খোলা। ফুরফুর করে ঢুকছে জুনের উষ্ণ হাওয়া। গরম লাগছে তিন গোয়েন্দার। অস্বস্তিতে শক্ত হয়ে গেছে শরীর, নড়তে চাইছে না যেন হাত পা। শক্ত করে ধরে রেখেছে ট্রে, একটু খাবারও যাতে না পড়ে সেদিকে কড়া নজর। ভীষণ বদমেজাজী ডেভিড লিসটারের গালাগাল শুনতে চায় না।

মিস্টার লিসটারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি ওদের। দেখাই হয়নি। তবে তার সম্পর্কে এত কথা শুনেছে, দেখা করার প্রচণ্ড ইচ্ছে। ওয়েস্ট কোস্টের একজন কোটিপতি তিনি। রকি বীচে তার প্রতিবেশী এবং তার সঙ্গে যাদের ব্যবসার সম্পর্ক আছে, তাদের কেউই ভাল বলে না। আর এমন কিপটের কিপটে, নব্বইটা সেন্ট পেলে না খেয়ে জমিয়ে রেখে দেয় এখনও, আরও দশটা সেন্ট জোগাড় করে পুরো একটা ডলার করার জন্যে।

পার্টিতে সাহায্য করার জন্যে তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করেছে হেনরি বেসিন। কিছুটা বেপরোয়া হয়েই। কারণ ওই খরচের টাকাটাও লিসটারের কাছ থেকে আদায় করতে ঘাম ছুটবে তার। শহরের নতুন এবং সবচেয়ে অল্প বয়েসী ক্যাটারার সে। এতদিন ছোটখাট কাজ করেছে। এই প্রথম লিসটারের বাড়িতে পার্টির মত বড় একটা কাজ পেয়েছে। কাজেই নাম করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে সে। তার সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় আছে তিন গোয়েন্দার। স্যালভিজ ইয়ার্ডে পুরনো জিনিস কিনতে যায়। লিসটারের নাম তিন গোয়েন্দাও শুনেছে। কেমন লোক দেখার ইচ্ছে কিশোরের অনেক দিনের। কথায় কথায় বেসিনের কাছে যখন শুনল, পার্টিতে সাহায্য করার জন্যে লোক খুঁজছে, ওয়েইটারের কাজটা দেয়ার জন্যে চেপে ধরল তাকে। লিসটারের বাড়িতে ঢোকার এইই সুযোগ। কম পয়সায়, কাজের লোক পেয়ে বেসিনও রাজি হয়ে গেল। ওরকম কিপটে লোকের বাড়িতে যেতে মুসা প্রথমে রাজি হতে চায়নি। অনেক বলেকয়ে তাকে রাজি করিয়েছে কিশোর। রবিনের ব্যাপারটা অন্যরকম। গানের কাজ একঘেয়ে লাগতে আরম্ভ করায় কিছুদিন ছুটি নিয়েছে সে। তাছাড়া বেশ কিছুদিন থেকে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছে না। দক্ষিণ সাগরে যেতে পারেনি। এখন আবার মনপ্রাণ দিয়ে লেগে গেছে পুরনো কাজে।

হেনরি বেসিনকে কন্ট্রাক্ট করেছে লিসটার খরচ বাঁচানোর জন্যে। বড় এবং নামী ক্যাটারার ভাড়া করতে চাইলে অনেক খরচ। কড়া হুকুম দিয়ে দিয়েছে যত, কম খরচে সম্ভব পার্টি শেষ করতে হবে। ওয়েইটার নিয়ে শুরু হয়েছে খেঁচাখেঁচি। কজন লাগবে সেটা নিয়ে। অনেক চাপাচাপি করে তারপর লিসটারকে রাজি করাতে পেরেছে বেসিন। তবে এক শর্তে, সব চেয়ে কমদামী ওয়েইটার নিয়োগ করতে হবে।

তা-ই করেছে বেসিন। আর এ কারণেই বাগানে যে মেয়েগুলো টেবিল সাজাতে ব্যস্ত, ওরা সব রকি বীচ হাই স্কুলের ছাত্রী। বারটেনডারের দায়িত্বে রয়েছে যে ছেলেটা, সে লস অ্যাঞ্জেলেসের কাপ অভ চিয়ার বারটেনডিং স্কুলের একজন শিক্ষানবিস। আর পিকো নামের যে ভবঘুরে লোকটা বাসন ধোয়ামোছার কাজ করছে, তাকে রাস্তা থেকে ধরে এনেছে বেসিন। একটা মিশনারির কাছে ঘুরঘুর করছিল খাবারের লোভে।

ওয়েইটার রাখা হয়েছে তিন গোয়েন্দাকে। টাকার জন্যে আসেনি। এত কম দামে কেউ ওয়েইটারের কাজ করতে রাজি হত না। ওরা হয়েছে শুধু কৌতূহল মেটানোর জন্যে।

 ডেভিড লিসটার রহস্যময় মানুষ। রকি বীচে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। নিঃসঙ্গ মানুষ। একা থাকতে পছন্দ করেন। মকিংবার্ড লেনে তার বাড়িটা যেন একটা পোড়োবাড়ি। বাগানটাকে বলা যায় লতাপাতার জঙ্গল। আর কিছুদিন ওভাবে পড়ে থাকলে দক্ষিণ আমেরিকার ইতুরি জঙ্গল হয়ে যাবে। লোকে বলে, ঢুকলে গা ছমছম করে। ভূতের বাসা। মুসা যে রাজি হতে চায়নি আসতে এটা একটা কারণ।

লিসটারের মেয়ে এলিনার সম্মানে দেয়া হচ্ছে এই পার্টি। বৃদ্ধের একমাত্র মেয়ে সে। বোর্ডিঙে থেকে স্কুলে পড়ত। ফলে রকি বীচের ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি, বন্ধুত্ব করতে পারেনি। এখন পুবের একটা কলেজে পড়ে। গোপনে তিন গোয়েন্দাকে বলেছে বেসিন, মেয়েটা এই পার্টিতে তার এনগেজমেন্টের খবরও ঘোষণা করতে পারে। বেসিন নিশ্চিত, ভাবি জামাইকে দুচোখে দেখতে পারবেন না লিসটার। এই পার্টি দেয়ারও ইচ্ছে ছিল না তার, মেয়ের চাপে বাধ্য হয়েছেন।

সারাক্ষণ গজগজ করছে বুড়ো, বেসিন বলেছে। এসব নাকি টাকা পানিতে ফেলার ফন্দি। চাপে পড়ে রাজি হয়েছে বটে, তবে যতটা সম্ভব কম টাকা খরচ করে কোনমতে কাজটা সারতে চায়। কিছু সাধারণ খাবার আর কয়েকজন তৃতীয়। শ্রেণীর মিউজিশিয়ানকে ভাড়া করেছে, যেনতেন ভাবে মেয়েকে খুশি করতে পারলেই বাঁচে। তার ইচ্ছে, মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, মেয়ের ফিয়াশেকে ভয় দেখিয়ে, দুজনকে আলাদা করবে। তারপর ওয়াল স্ট্রীটের কোন বড় ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে। মেয়েকে ব্যবসায় ঢোকাবে। এগুলো সবই অবশ্য আমার অনুমান।

সমস্ত কথা মনে পড়ছে কিশোরের। কলরব করছে মেহমানরা। কেন যে এত কথা বলে লোকে বুঝতে পারে না সে। অহেতুক বকবক করে। চীজ পাফ সরবরাহ করতে লাগল ওদেরকে। অবাক হয়ে ভাবছে কোন মানুষটা ডেভিড লিসটার। বেশির ভাগই মাঝবয়েসী। সে শুনেছে, লিসটারের বয়েস সত্তর। মেহমানদের পরনে দামী পোশাক। দামী দরজির দোকান ঘুরে এসেছে। অনেক খরচ পড়েছে তার জন্যে। এরকম দামী পোশাক লিসটারের পরনেও থাকবে, আশা করতে পারল না সে।

হাসাহাসি করছে মেয়েরা। উচ্চকণ্ঠে কথা বলছে। চেঁচাচ্ছে। গান গাইছে। যা ইচ্ছে করছে। ওদেরই কেউ একজন হবে এলেনা লিটার। হয়ত চুলের রঙ হবে লাল, পরনে শাদা পোশাক। কিংবা হতে পারে সোনালি চুল, তাতে গোলাপী আভা। ওই যে সোনালি চুল, নীল পোশাক পরা মেয়েটা কথা বলছে ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে সে-ও হতে পারে এলেনা। কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। মহিলাকে। যখন পাশের মসৃণ চেহারার তরুণের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ঘুরল মেয়েটা, ছাতের দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে রইলেন মহিলা। অমনোযোগী। হঠাৎ হাত উঠে গেল গলার কাছে। ঈশ্বরের অশ্রু

ওপরে তাকাল কিশোর। এক কোণে মাকড়সার জাল ঝুলে রয়েছে। কে। জানি একটা শুয়াপোকা মেরেছিল, দেয়ালে লেপ্টে রয়েছে এখনও।

বিরক্তিতে কুঁচকে গেল মহিলার মুখ, দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন। হাসি চাপতে কষ্ট হল কিশোরের। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ওয়েইটারের কাজ, এখন তাই মনে হল। তবে আনন্দ পাচ্ছে।

হঠাৎ, মিউজিশিয়ানরা সবে একটা বাজনা শেষ করেছে, এই সময় একটা গেলাস ভাঙল একটা মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল কিশোর, ডেভিড লিসটার কার নাম। লম্বা, তালপাতার সেপাই, ধূসর চুল, কালো মলিন স্যুট পুরনো হতে হতে চকচকে ভাবটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এক কোণ থেকে ছুটে এলেন তিনি। রাগে চিৎকার করে ছুটলেন বাগানের দিকে। কিশোরের মনে হল, মেয়েটাকে ধরে মারবেনই বুঝি লিসটার। শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন। বকা দিলেন, গায়ে জোর নেই? খাও না? বিড়বিড় করে আরও কি বললেন, বোঝা গেল না। কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে।

আব্বা, রাগটা একটু কমাও, বলে লিসটারের দিকে এগিয়ে গেল নীল পোশাক পরা মেয়েটা।

এলেনা? মেয়েটাকে আটকানোর জন্যেই বোধহয় হাতটা বাড়িয়ে ছিলেন ধূসর চুল মহিলা, সরিয়ে নিলেন। মসৃণ চেহারার যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিক, দেখলি! একটা লোক বটে!

এগিয়ে গেল যুবক। এলেনা, দাঁড়াও। মিস্টার লিসটার, শান্ত হোন। মেয়েটা তো আর ইচ্ছে করে ফেলেনি। আপনি…

ফিরেও তাকালেন না লিসটার। গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুললেন ধাক্কা দিয়ে। দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন।

তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। সাংঘাতিক ব্যস্ত বেসিন। চুলার কাছ থেকে দৌড়ে যাচ্ছে টেবিলের কাছে, আবার টেবিল থেকে চুলার কাছে। অনেকগুলো প্লেটে খাবার সাজাতে হচ্ছে। একগাদা বাসন সিংকে ফেলে ধুচ্ছে ভবঘুরে লোকটা।

হেনরি, চিৎকার করে উঠলেন লিসটার। কোত্থেকে কি ধরে এনেছ! ওই গর্দভ মেয়েটাকে বের কর আমার বাড়ি থেকে! ওই গেলাসের দাম রেখে দেবে ওর কাছ থেকে! নইলে তোমার টাকা থেকে কাটব।

আব্বা, শান্ত হও না, আহ! পেছনে গিয়ে দাঁড়াল মেয়ে। এমন কাণ্ড শুরু করলে! আমার পার্টিই তো শেষ করবে। এসো। এই, আব্বা। প্লীজ! লিসটারের হাত ধরে টান দিল এলেনা। এ কিন্তু চিৎকার বন্ধ করার ইচ্ছে নেই লিসটারের। ফিরে তাকাল পিকো। হাতে একগাদা বাসন। তাকিয়ে রয়েছে ভদ্রলোকের চোখের দিকে। এতগুলো বাসন। একসঙ্গে নেয়াই বোধহয় ঠিক হয়নি, কিংবা অন্য কোন কারণে গেল একটা। পিছলে। ব্যস, বাকিগুলোও মেঝেতে পড়ে ভাঙল ওটার সঙ্গে সঙ্গে।

লিসটারের চিৎকারে সব আলাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। নীরবতার মাঝে প্রচণ্ড শব্দ হল বাসন ভাঙার। ঝনঝন করে।

হাঁ হয়ে গেলেন লিসটার।

আব্বা, তোমার জন্যেই এমন হল? চেঁচিয়ে উঠল এলেনা। তুমি…তুমি… আব্বা!

বুক চেপে ধরেছেন লিসটার। ভঁজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু।

আমি আগেই বলেছি। এজন্যেই রাগতে মানা করেছি। আব্বা? আব্বা? কডি, জলদি এস! বেহুশ হয়ে যাচ্ছে!

বাবার কোমর জড়িয়ে ধরল এলেনা।

.

০২.

লিভিং রুম থেকে দৌড়ে এল কালোচুল এক তরুণ। সে আর বেসিন মিলে মেঝে থেকে তুলল লিসটারকে। ডাইনিং রুম থেকে একটা চেয়ার এনে পেতে দিল। এলেনা, তাতে বসান হল তার বাবাকে।

আব্ব, কতবার মানা করলাম তোমাকে! রাগে, দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলল। এলেনা। আমি জানতাম এরকম একটা কিছু করবে।

ডাক্তার কই? চেঁচিয়ে উঠল মোটা এক মহিলা। সব কিছু ঠিক করার দায়িত্ব যেন এখন তারই। এগিয়ে এসে লিসটারের নাড়ি দেখল। টেলিফোন কোথায়? ডাক্তারকে ফোন করছি।

না! চিৎকার করে বলল লিসটার। হুশ ফিরেছে। ডাক্তার লাগবে না! লাগবে

ঝুঁকে দাঁড়াল কালোচুল তরুণ। মিস্টার লিসটার, আমরা আপনাকে সাহায্য করতেই চাইছি…

আমি বলেছি ডাক্তার লাগবে না আমার! খেঁকিয়ে উঠলেন লিসটার। ইডিয়ট!

কিছুই মনে করল না তরুণ। যেন শুনতেই পায়নি। দেখেশুনে কিশোরের মনে হচ্ছে লিসটারের স্বভাবই হল মানুষকে অপমান করা। কিন্তু একজন মেহমান এই অপমান সইবে কেন?

এই সময় নিচু গলায় একজনকে বলতে শুনল, ছেলেটার নাম কডি হোয়েরটা। লিটারের পারসনাল সেক্রেটারি।

আজকাল চাকরি পাওয়াটা বোধহয় কঠিনই হয়ে উঠেছে, শুকনো মন্তব্য করল আরেকজন।

ওপরে! লিসটার বললেন, ওপরে নিয়ে চল আমাকে! কয়েক মিনিট শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাব।

মেহমানদের দিকে তাকাল কডি। মুসার ওপর চোখ পড়ল। অস্বাভাবিক খাটো ওয়েইটারের পোশাক পরে বুফে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এই, তাকে ডাকল সেক্রেটারি। এস তো। ধর।

টেবিলে ট্রে রেখে লিসটারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। সে আর কডি মিলে লিসটারকে ধরে তুলল। ধীরে ধীরে নিয়ে চলল সামনের হলের দিকে, সেখানে রয়েছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। আগে আগে চলল এলেনা। মেহমানরা সরে পথ করে দিতে লাগল ওদেরকে।

একেবারে হালকা শরীর লিসটারের। যেন কোন ওজনই নেই। সিঁড়ি বেয়ে তুলতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না। মুসা একাই পারত। বেডরুমে নিয়ে আসা হল তাকে। ঘরটা বাড়ির সামনের অংশে। জানালা দিয়ে পর্বত দেখা যায়।

 আরাম করে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল লিসটারকে। লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে ঢুকল এলেনা, বাবাকে এক গেলাস পানি এনে দেয়ার জন্যে। পানি এনে দিলে ঠেলে সরিয়ে দিলেন লিসটার। বিছানায় ছলকে পড়ল পানি। চেঁচিয়ে উঠলেন, নিট্রো! আমার নিট্রো কোথায়?

এই যে, আছে, একটা ড্রয়ার খুলল এলেনা। একটা ওষুধের শিশি বের করল।

খোল! জলদি কর! চাবুকের মত শপাং করে উঠল যেন লিসটারের কণ্ঠ। হাঁ। করে দাঁড়িয়ে আছ কেন, বলদের মত!

আব্বা, নিট্রো নয়, একদিন বিষ খাওয়াবো তোমাকে আমি। স্ট্রিকনিন। বিশ্বাস কর। শিশি ঝাঁকি দিয়ে উপুড় করল এলেনা। বাবার মেলে দেয়া হাতে। ফেলে দিল কয়েকটা ট্যাবলেট।

তা আর করতে দিচ্ছি না, লিসটার বললেন। উইলে কি লিখেছি ভাল করেই জান। আমার অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে একটা কানাকডিও আর পাবে না তুমি।

জিভের নিচে ট্যাবলেট রেখে দিয়ে চিত হয়ে শুলেন তিনি।

বাবা-মেয়ের এই ধরনের আলোচনায় অস্বস্তি লাগছে মুসার। বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরতেই তার হাত চেপে ধরল এলেনা। তুমি থাক এখানে, আব্বার কাছে। আমি যাই। মেহমানদের দেখাশোনা করিগে। কডি, এস। আমি একা পারব না।

আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। এত বদমেজাজী অসুস্থ একজন বুড়ো মানুষের কাছে থাকার কোন ইচ্ছেই তার নেই। মিস লিটার, বলতে গেল সে। ওখানে আমার কাজ…

এটাও কাজ, বাবার মতই খেঁকিয়ে উঠল এলেনা। এখানে থাকতে বলা হয়েছে, থাক।

কিন্তু…কিন্তু যদি ওঁর…মানে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়…।

হবে না। এটা হার্ট অ্যাটাক নয়, অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল এলেনা। একে বলে অ্যানজিনা। রক্তবাহী শিরা বিদ্রোহ করেছিল বলা যায়। তাতে হৃৎপিণ্ডে ঠিকমত অক্সিজেন পৌঁছতে পারেনি। বুক ব্যথা করছে সে কারণেই। ট্যাবলেট নিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।

তোমার হলে বুঝতে! কটকট করে বললেন লিসটার, যার হয় সে-ই বোঝে। ভয়ের কিছু নেই তুমি জানলে কি করে?

জানার ব্যাপার, তাই জানলাম। গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এলেনা।

মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল হোয়েরটা, যেন তার জন্যে আফসোস হচ্ছে, তারপর বেরিয়ে গেল এলেনার পিছু পিছু।

নিথর হয়ে পড়ে আছেন লিস্টার। চোখ বোজা। বিছানার কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসল মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বৃদ্ধ মানুষটার দিকে। মুখের চামড়া ধূসর রঙের, তার মাঝে শিরাগুলো জেগে রয়েছে বেগুনী জালের মত। উঁচু, পাতলা নাক। বসা গাল। হাতের দিকে দৃষ্টি সরে গেল তার। একেবারে যেন কঙ্কাল, এক ছটাক মাংস আছে কিনা সন্দেহ। আড়াআড়ি ফেলে রেখেছে বুকের ওপর। যেন। কবর দেয়ার জন্যে শোয়ানো হয়েছে মানুষটাকে।

ভয় ধরে গেল মুসার। দ্রুত সরিয়ে নিল চোখ। দেখতে লাগল ঘরে কি আছে। গত শীতের পর বোধহয় আর পরিস্কার করা হয়নি ফায়ারপ্লেসটা। পিতলের কালো হয়ে যাওয়া বেড়ার ওধারে উঁচু হয়ে আছে ছাই। কাছে একটা পিতলের ঝুড়িতে রাখা কিছু লাকডি। আর একগাদা হলদেটে খবরের কাগজ। ওগুলো দিয়ে আগুন ধরাতে সুবিধে। ফায়ারপ্লেসের ওপরের ম্যানটেলপিসে সাজানো একটা জাহাজের মডেল, আর চীনামাটির মোমদানিতে দুটো মোম। সব কিছুতে ধুলো জমে রয়েছে। পুরু হয়ে।

লম্বা দম নিল মুসা। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। দেয়াল, ময়লা পর্দা আর রঙচটা কার্পেট থেকেই হালকা কুয়াশার মত উড়ছে ওই ধুলো-তার ধারণা।

বড় একটা ড্রেসারের ওপরে ঝুলছে একটা আয়না, দাগ পড়া, হলদেটে। পেছনে জায়গায় জায়গায় পারা উঠে গেছে। ড্রেসারের পাশে দুটো ছোট আর্মচেয়ার রাখা। গদির রঙ উঠে গেছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোরও একই রকম করুণ দশা। জাহাজ আর সাগরের ছবি–উত্তাল সাগরে চলেছে জাহাজ, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে পাথুরে উপকূলে।

আর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে যেন বুককে। দেয়াল ঘেঁয়ে, ড্রেসারের ধারে, চেয়ারের পাশে। বই উপচে পড়ছে ওসব কেসে। পেপারব্যাক, হার্ডকভার, ছোট বই, বড় বই, ভলিউম; খাড়া করে, কাত করে, শুইয়ে, যতোভাবে ঢোকানো সম্ভব, রাখা হয়েছে। আর আছে কাগজপত্র। রোল পাকিয়ে, চ্যাপ্টা করে, ভাজ করে, গুঁজে দেয়া হয়েছে বইয়ের ফাঁকে সামান্যতম জায়গা যেখানে পাওয়া গেছে। সেখানেই। আরও আছে বাদামী রঙের ম্যানিলা খাম আর ফোল্ডার, ছোট, বড়, বইয়ের মাথার ওপরের ফাঁকে, কিংবা পাশের অন্যান্য ফাঁকে। মা বিছানার দিকে তাকাল আবার মুসা। লিসটার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেমন খসখসে কাঁপা নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে নিয়মিত। হাড্ডিসর্বস্ব আঙুলগুলো এখন আর মুঠো হয়ে নেই, খুলে রয়েছে বুকের ওপর।

উঠে একটা বুককেসের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। বইয়ের পেছনের নাম পড়ল। একটার নাম ব্লাডি মার্ডার। আরেকটার নাম শার্ক হান্টার। এডগার অ্যালান পো-র গল্প সংকলন রয়েছে কিছু। আরেকটা বইয়ের নাম দেখা গেল পোলারিস। ওটা টেনে বের করে খুলল সে। নাবিকদের গাইডবুক ওটা। সমুদ্রে নক্ষত্র দেখে কি করে জাহাজ চালাতে হয় তার ওপর লেখা।

গুঙিয়ে উঠলেন লিসটার। এমন চমকে উঠল মুসা যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বইটা আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। তাকিয়ে রয়েছে বুড়ো মানুষটার দিকে। কানে আসছে নিচতলায় মেহমানদের কণ্ঠস্বর। কতক্ষণ চলবে পার্টি? কতক্ষণ তাকে আটকে থাকতে হবে এখানে, এমন একটা বিরক্তিকর কাজে?

হাতের দিকে তাকাল সে। ধুলো-ময়লা লেগে গেছে। বুককেসটা কতদিন পরিষ্কার করা হয় না কে জানে। কয়েক মাস হতে পারে, কয়েক বছর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল মুসা। ওখানেও বই আছে। পুরনো আমলের বাথটাব আর ওয়াশবেসিনের পাশে একটা টেবিলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। নানা রকম গল্প আর প্রবন্ধের বইয়ের মাঝে রয়েছে কার্টুনের বই। অ্যাটমিক এনার্জির ওপর লেখা বইও আছে একটা। তার মানে যা পান তা-ই। পড়েন লিসটার, সব ধরনের বই। কিশোরকে বলার মত একটা খবর বটে।

কলের মুখ খুলে হাত ধুতে শুরু করল মুসা।

 হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেল তালা লাগানোর শব্দ।

এইই! টান দিয়ে তোয়ালে নিয়ে দরজার দিকে ছুটল সে। নব ধরে মোচড় দিল। নড়লও না। তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বাথরুমে।

নরম গলায় ডাকল সে, মিস্টার লিস্টার! মিস্টার লিসটার, দরজাটা খুলুন, প্লীজ!

কেউ জবাব দিল না।

আরও জোরে ডাক দিল, মিস্টার লিস্টার!

দরজার কাছ থেকে সরে গেল পদশব্দ। কাঠের পালায় কান রাখল মুসা। নিচতলা থেকে মেহমানদের কথা আর হাসি কানে আসছে। বাজনা বন্ধ। কাছেই

একটা দরজা খোলা হল। জোরাল হল নিচের কোলাহল।

মিস্টার লিস্টার!

 কেউ সাড়া দিল না। দরজা খুলতে এল না কেউ।

অস্বস্তি লাগছে মুসার। ভয় লাগছে। বাথরুম ব্যবহার করায় কি রেগে গেলেন লিসটার? হয়ত ভেবেছেন মুসা চোরটোর কিছু। পুলিশকে খবর দিতে গেছেন?

 বাথটাবের কিনারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল সে। পুলিশ এলে বরং ভালোই। আবার শোনা গেল পদশব্দ। একই রকম পায়ের আওয়াজ, আগের বার যেমন শুনেছিল। বাথরুমের দরজার কাছে এসে থামল। কিন্তু দরজা খুলল না।

বিচিত্র একটা শব্দ হল। মাটিতে পড়ে গেলেন বোধহয় লিসটার, কারও সঙ্গে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। গুঙিয়ে উঠল কেউ, তারপর চুপ।

লাফ দিয়ে উঠে দরজার কাছে চলে এল মুসা। থাবা দিতে দিতে চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার লিসটার!

কে এই সময় নিচে লিভিং রুমে আবার শুরু হল গানবাজনা। কোরাস গেয়ে উঠল রক দল, বেইবে, হোয়াই এইনটু ইউ মাই বেইবে নো মোর? জোরাল কণ্ঠ। সেই সাথে দ্রিম দ্রিম করে বাজছে ড্রাম।

মিস্টার লিসটার! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল মুসা, আপনি ঠিক আছেন?

বেজেই চলেছে বাজনা, গাইছে গায়কদের দল।

 ঘামছে মুসা। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। লাথি মারতে শুরু করল দরজায়।

জবাব দিচ্ছেন না কেন লিসটার? হার্ট অ্যাটাক হয়েছে? হয়ত মারা যাচ্ছেন এ মুহর্তে, এ দরজাটার ঠিক ওপাশেই।

এই কে আছ, শুনছো? চিৎকার করতে লাগল মুসা। বের কর! বের কর আমাকে।

কেউ শুনল না তার ডাক। কেউ এল না।

বেইবে, হোয়াই এইনট ইউ মাই বেইবে না মোর? প্রশ্নটা করে উপসংহার। টানল গায়কেরা, কিন্তু বাজনা বন্ধ হল না। আরেক সুরে চলে গেল। ড্রামের বিরতি নেই। গেয়ে উঠল ওরা, রকিং রকিং রকিং অল দা নাইট।

হতাশ ভঙ্গিতে দুম দুম করে দরজায় কিল মারতে লাগল মুসা। এখন কি করব? ভাবছে সে। একজন মানুষ ওদিকে মরতে বসেছে। সে জানতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। করবটা কি এখন? কিশোরটা কোথায়?

শান্ত হয়ে বস, স্মৃতিতে বেজে উঠল যেন কিশোরের কণ্ঠ। মাথা ঠাণ্ডা রেখে। ভাব।

 ঠিক! ভাবল মুসা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ছোট ঘরটায় চোখ বোলাল। জানালায় দৃষ্টি আটকে গেল।

জানালা! হ্যাঁ, জানালা! পুরনো আমলের বাথরুমটায় একটা জানালা আছে। ওটার বাইরে দেয়ালের কাছেই রয়েছে একটা গাছ। বেশ বড় একটা অ্যালডার। গাছ, বেয়ে নামা যাবে সহজেই।

জানালাটা খুলল মুসা। বইগুলো নামিয়ে রেখে টেবিলটা নিয়ে এল জানালার। কাছে। ওটাতে উঠে মাথা বের করে দিল জানালার বাইরে, তারপর বের করল। কাধ।

নিচে তাকাল। চোখে পড়ল বাড়ির একপাশ। ঠিক নিচেই রয়েছে সিমেন্টে বাঁধন পথ। পড়লে হাত-পা ভাঙার ভয় আছে।

তবে সে ভয় তেমন করল না। গাছটাছ ভালই বাইতে পারে। পড়বে না। আর পড়া চলবেও না, অন্তত এখন। মারা যাচ্ছেন লিসটার। মুসা গিয়ে দ্রুত। সাহায্য আনতে না পারলে মারাই যাবেন।

.

০৩.

যতো দ্রুত সম্ভব নামছে মুসা। কোথায় ধরছে, কোথায় পা রাখছে সেদিকেও খেয়াল নেই। বাড়ির এই পাশটা নির্জন, কাউকে চোখে পড়ছে না। কিন্তু সে মাটিতে নামতে না নামতেই একটা লাল চুল ওয়ালা মেয়ে এসে হাজির হল। বাহ, নামার বেশ ভাল উপায় বের করেছ তো! আমি তো জানতাম লোকে সিঁড়ি দিয়েই নামতে চায়।

আমিও চাই। ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করল না মুসা। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে দৌড় দিল বাড়ির অন্য পাশে যেখানে লম্বা জানালাগুলো রয়েছে সেদিকে। একটা জানালা গলে যখন ঢুকছে তখনও বাজনা বাজছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে মেহমানদের ট্রে হাতে ঘুরছে রবিন আর কিশোর, ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে।

 ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে সোজা এলেনার দিকে ছুটল মুসা। সেই ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে মেয়েটা। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে তার হাত চুল সে। ফিরে তাকিয়ে মুসাকে দেখেই ভুরু কুচকে ফেলল এলেনা। তুমি এখানে কেন? ড্রামের ভারি গমগম শব্দকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে। এ বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। এখানে কথা বলা অসম্ভব মনে হচ্ছে তার কাছে। ইশারায় এলেনাকে সরে আসতে বলল রান্নাঘরের দিকে।

ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে, যাওয়ার সময় কডি হোয়েরটাকে দেখতে পেল ওরা। ঘরের একধারে হেনরি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেটে খাবার। সাজাচ্ছে ক্যাটারার। আঙুল বাকা করে ইশারায় হোয়েরটাকে ডাকল এলেনা। খালি রান্নাঘরের দিকে এগোল। তার পেছনে নির্জন রান্নাঘরে চলে এল লোকটা। মুসা ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল যাতে বাজনার শব্দ কম শোনা যায়।

আপনার বাবা আমাকে বাথরুমে তালা আটকে রেখেছিলেন, মুসা বলল। হাত ধুতে গিয়েছিলাম আমি। দুই এক মিনিট পরেই একটা শব্দ শুনলাম। মনে হল তিনি পড়ে গেছেন। চিৎকার করে অনেক ডাকাডাকি করলাম। শুনলেনই না। জবাব দিলেন না। শেষে জানালা গলে বেরিয়ে গাছ বেয়ে নেমে এসেছি…

শোনার জন্যে আর অপেক্ষা করল না এলেনা। পেছনের সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। তার পেছনে ছুটল হোয়েরটা।

ডাইনিং রুমে ঢোকার দরজাটা ফাঁক হল। মুখ বের করল কিশোর। তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাচ্ছে রবিন।

কি হয়েছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

বারোটা বেজেছে লিসটারের! কি হয়েছে বলল মুসা। এলেনা দেখতে গেছে বাবাকে।

ছাতের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর পেছনের সিঁড়ির দিকে। রওনা হয়ে গেল।

কোথায় যাচ্ছ? বাধা দেয়ার চেষ্টা করল রবিন, এলেনা আমাদের কুত্তার মত দূর দূর করে তাড়াবে। বাপ আর মেয়ের তো একই স্বভাব।

মিস্টার লিসটার সত্যিই অসুস্থ হয়ে থাকলে, কিশোর বলল, আমাদের সাহায্য দরকার হবে তার।

যাও, ভুরু নাচাল মুসা। মাথায় ডাণ্ডা খেতে চাইলে। কিন্তু পরক্ষণেই কিশোরের পেছনে রওনা হল সে-ও। কিছুটা কৌতূহলী হয়েই। কিশোরকে কি বলে এলেনা দেখার জন্যেই। তাছাড়া লিসটারের আসলে কি হয়েছে সেটাও দেখার ইচ্ছে।

দ্বিধা করল রবিন। তারপর সে-ও চলল দুজনের পেছনে।

ওপরের হলঘরে. যেন পালকের তুষারপাত হচ্ছে। একটা বালিশ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। খোলটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে, ভেতরের পালকগুলো উড়ছে। তার মাঝ দিয়ে ছুটে গেল এলেনা। শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল একবার, নব মোচড় দিয়ে ঠেলে খুলে ভেতরে তাকাল। চেঁচিয়ে উঠল। হোয়েরটা চেঁচাল না। তাকিয়ে রয়েছে ভেতরে।

ওখানেই কোথাও আছে! চিৎকার করে বলল এলেনা। যাবে কোথায়? যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

ঠেলা দিয়ে পাল্লা পুরোটা খুলে দিল হোয়েরটা। ভেতরটা এখন কিশোরও দেখতে পাচ্ছে। বিছানার চাঁদরে কুঁচকে রয়েছে। খানিক আগে যে ওখানে একজন মানুষ শুয়েছিল বোঝা যায়। ফায়ারপ্লেসে নাচানাচি করছে ছোট ছোট আগুনের শিখা। কাগজ পোড়া কালো ছাই, গরম বাতাসের সঙ্গে উড়ে চিমনিতে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভুরু কুঁচকাল কিশোর। গরম আবহাওয়া। এই সময়ে ফায়ারপ্লেস, জ্বালানোর দরকার পড়ল কেন?

দৌড়ে গেল সে। ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা চিমটাটা তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল আগুনের ভেতর। কিন্তু কাগজ, যা ফেলা হয়েছিল পুড়ে গেছে। চিমটার খোঁচা। লেগে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল পোড়া কাগজ।

কি করছ? কিশোরের হাত থেকে চিমটাটা টান মেরে নিয়ে নিল এলেনা। রাগত কণ্ঠে বলল, এখানে ঢুকেছ কেন? যাও, নিচে যাও!

মিস লিসটার, বেশ গঙার ভারিক্কি গলায় বলল কিশোর, আমরা থাকলে আপনার সুবিধে হতে পারে। রহস্যময়, অস্বাভাবিক ঘটনা, এসব তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি।

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল এলেনা। হাসিটা চেপে রাখল মুসা। নাটকীয় ভাবভঙ্গি করে আবার বাজিমাত করে দিয়েছে কিশোর পাশা।

শান্ত দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বোলাল কিশোর। এখনও বন্ধ রয়েছে বাথরুমের দরজা। তালায় দোকান রয়েছে পুরনো ধাচের স্কেলিটন কী। এগিয়ে গিয়ে তালা খুলে দরজাটা খুলল কিশোর। মুসা যেভাবে ফেলে গেছে সেভাবেই রয়েছে বাথরুম। জানালার নিচে টেবিলটা রয়েছে।

চাবিটা দিয়ে হলঘর আর শোবার ঘরের মাঝের দরজার তালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। লেগে গেল। এ বাড়ির যে কোন তালা এ চাবি দিয়ে খোলা যাবে মনে হচ্ছে। মিস লিসটার, পালানোর আগে মুসাকে বাথরুমে আটকেছিলেন আপনার বাবা। মেহমানদের সঙ্গে এরকম ব্যবহারই করেন নাকি উনি?

তোমার বন্ধু মেহমান নয়, কাটা জবাব দিল এলেনা। এখানে কাজ করতে এসেছে।

বেশ, তাহলে কর্মচারী। তো আপনার বাবা কি কর্মচারীদের এরকম করে বাথরুমে আটকে রাখেন?

জবাবের অপেক্ষায় না থেকে মুসার দিকে তাকাল কিশোর। তোমাকে আটকে ফেলার পর ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছ বললে। কিছু একটা পড়েছিল। মানুষ পড়ার শব্দ? মিস্টার লিসটার?

হতে পারে। আর কেউ তো ছিল না।

 মিস্টার লিসটারের কাছে যখন বসে ছিলে তখন ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছিল?

না, মাথা নাড়ল মুসা। একেবারেই আগুন ছিল না।

গরম আবহাওয়া, আনমনে বলল কিশোর। কেন আগুন জ্বালতে যাবে। ফায়ারপ্লেসে?

বিছানার দিকে তাকাল সে। হলঘরে দেখে এলাম একটা বালিশ ছিঁড়েছে। বিছানায় এখন বালিশ নেই। যেটা ছিঁড়েছে সেটা আগে থেকেই কি ফাটা ছিল? আর আরেকটা বালিশ কোথায়? বিছানায় তো সাধারণত দুটো বালিশ থাকে। কারণ এটা ডাবল বেড।

ভ্রূকুটি করল মুসা। দুটোই থাকার কথা। তবে খেয়াল করিনি আমি।

অবশ্যই দুটো ছিল, এলেনা বলল। দেখ, এসব শার্লক হোমসগিরি করে ভোলাতে পারবে না আমাকে। যাও, নিচে যাও। মেহমানদের খাবার লাগবে…

তার কথা যেন কানেই ঢুকল না কিশোরের। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, আজ এখানে কি ঘটেছে বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি। স্পষ্ট। মুসা বাথরুমে। ঢুকেছিল। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন আপনার বাবা, যাতে সে বেরোতে না পারে। তারপর কিছু পুড়িয়েছেন ফায়ারপ্লেসে।

ঘরে ঢুকল এতক্ষণে হোয়েরটা। এমন কিছু, কিশোরের সুরে সুর মিলিয়ে বলল সে, যেটা অন্য কাউকে দেখতে দিতে চাননি। গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তিনি…

দেখ, কডি, কড়া গলায় ধমক দিল এলেনা। ছেলেগুলোকে আর উসকানি দিয়ো না। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, কি করেছে আমি বলি। মূল্যবান কিছু পোড়ায়নি বাবা। ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর জন্যে কাগজ ব্যবহার করেছে। একটা বালিশ ছিঁড়েছে, আরেকটা লুকিয়েছে। নিজেও গায়েব। এসব করেছে। আমাকে রাগানোর জন্যে। কোন কিছু পছন্দ না হলেই এরকম করে। এর চেয়ে খারাপ কাজ করেছে আগেও। বিশ্বাস কর। আজকের এই পার্টি একটুও পছন্দ ছিল। না তার।

তার মানে আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন? কিশোরের প্রশ্ন। তা-ই যদি করে থাকেন এখন তিনি কোথায়?

 নাক দিয়ে খোঁৎখোঁৎ শব্দ করল এলেনা। খুঁজতে শুরু করল। তার সঙ্গে যোগ দিল হোয়েরটা। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে তিন গোয়েন্দাও যোগ দিতে গেল। বাধা দিতে গিয়েও দিল না এলেনা, বরং বলল, ঠিক আছে, খেজ। বেশি লোকে খুঁজলে তাড়াতাড়ি বের করা যাবে।

বিরাট বর্গাকার শোবার ঘরগুলোয় পুরু হয়ে ধুলো জমে রয়েছে। নোংরা। সাফ। করা হয় না। কয়েকটাতে বিছানা আর ড্রেসার রয়েছে। বাকিগুলোতে ছাত সমান উঁচু শেলফে রয়েছে গাদাগাদা বই আর কাগজপত্র।

বই সংগ্রহের বাতিক ছিল, মন্তব্য করল কিশোর।

এটা একটা রোগ, এলেনা বলল। বিশ্বাস কর। আব্বার জন্যে এটা রোগ।

শুধু বইই সংগ্রহ করেননি ডেভিড লিসটার। অনেক ধরনের ট্রফিও রয়েছে। দূরদূরান্তে জাহাজে করে ঘুরে বেড়ানোর প্রমাণ ওগুলো। তুর্কি টুপি, হুকের নল, একজোড়া চামড়ার চটি দেখিয়ে এলেনা বলল, ওগুলো মিশরের বাজার থেকে আনা হয়েছে। আফ্রিকা থেকে এসেছে হাতির দাঁতে খোদাই করা জিনিস। মারাকে থেকে একটা পিতলের ল্যাম্প। পেনসিলের বাক্স আর পুরনো ম্যাগাজিনের পাশে তাকে অগোছাল হয়ে রয়েছে জাহাজ চালনার যন্ত্রপাতি।

কোন জিনিস ফেলে না আব্বা। পরিষ্কার করতেও দেয় না। তার ভয়, কাউকে ঢুকতে দিলেই জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে পালাবে।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। তার জন্যে খারাপই লাগল তিন গোয়েন্দার। বাবা আর মেয়ের স্বভাবে অনেক অমিল। আর তার জন্যে নিশ্চয় মনোকষ্টে ভুগতে হয় মেয়েকে। মেয়ে চায় সাফসুতরো থাকতে, আর বাবাটা একদম নোংরা। এলেনার নিজের ঘরটা ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার।

দোতলায় আরও একটা ঘর পরিষ্কার আছে, সেটা কমপিউটার রুম। ধুলো ময়লা সহ্য করতে পারে না ওই যন্ত্র, তাই বাধ্য হয়েই সাফ রাখতে হয়। ঘরটা লিসটারের শোবার ঘরের পাশেই। এয়ারকুলার লাগানো। শাদা দেয়াল। লাল রঙ করা ইস্পাতের ফ্রেমের চেয়ার। আর দুটো কমপিউটার কনসোল রয়েছে ঘরে।

একটা সেট রাখা হয়েছে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে, হোয়েরটা জানাল। বাইরে বেরোতেই চান না মিস্টার লিসটার। যোগাযোগ রাখার জন্যে তাই কমপিউটার ব্যবহার করেন। কর্মচারীদের হুকুম দেন এই যন্ত্রের সাহায্যে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে চান না। কমপিউটারে আরেকটা মস্ত সুবিধে রয়েছে। কেউ আদেশ পালন না করলে কিংবা কাজে ভুল করে ফেললে রেকর্ড থেকে যায়, কোন ভাবেই ফাঁকি আর দিতে পারে না।

গোলমালটা কোনখানে হয়, সেটা আগে খুঁজে বের করতে চায় আব্বা, এলেনা বলল। যাতে খুব তাড়াতাড়ি সেটা মিটিয়ে ফেলা যায়। ঠোঁট কামড়াল। কই, এখানেও তো নেই!

 চিলেকোঠা আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

আছে। তাতেও বই, বাক্স আর স্যুভনির। অতীতের সাক্ষি। তবে ডেভিড লিসটার নেই।

ওপরতলায় খোঁজা শেষ। কিশোরের দিকে তাকাল এলেনা। বেশ, বল এবার, কোথায় আব্বা? খুব তো চালাকি জাহির করেছিলে। এখন বল, সে কোথায়?

অনেক সম্ভাবনাই আছে। তবে আপাতত সেসব বলছি না, কিশোর বললো। একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। তিনি হেঁটে বেরিয়ে গেছেন সামনের দরজা দিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে। মেহমানরা আলাপে ব্যস্ত, তাকে দেখতে পায়নি…

বাধা দিল এলেনা। আমার তা মনে হয় না। আমি সিঁড়ির দিকে মুখ করে ছিলাম। নামলে দেখতে পেতামই।

তাহলে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে? অনুমান করল হোয়েরটা। ওখান দিয়ে নেমে সেলারে চলে যেতে পারেন। পেছনের আঙিনায় বেরোতে পারেন। কেউ দেখতে পাবে না।

বালিশ নিয়ে? কিশোরের প্রশ্ন।

বালিশের কথা বার বার কেন বলছো? জিজ্ঞেস করল এলেনা।

 কারণ, আমার মনে হচ্ছে ওটা একটা বড় সূত্র।

পেছনের সিঁড়ির কাছে চলে এল ওরা। যে ভবঘুরে লোকটাকে ধোয়ামোছায় সাহায্য করার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছিল সে সিংকে ব্যস্ত।

এই, আমার আব্বাকে এখান দিয়ে যেতে দেখেছ?

 এলেনার দিকে ঘুরে তাকাল, লোকটা। বয়েস পঞ্চাশ, এমনকি ষাটও হতে পারে। বয়েসের তুলনায় স্বাস্থ্য বেশ ভাল, শক্তসমর্থ, পেশিবহুল। ডান বাহুতে একটা ড্রাগন আঁকা উল্কি দিয়ে। কিশোরের মনে হল মুখটা বেশি গোমড়া করে রেখেছে লোকটা। শুধু মাথা নেড়ে এলেনার কথার জবাব দিয়ে আবার তার কাজে মন দিল।

ডাইনিং রুম থেকে এল হেনরি বেসিন। কিছু হয়েছে?

আব্বাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

সেলারে খুজল তিন গোয়েন্দা। আছে ভাপসা গন্ধ, পুরনো ট্রাঙ্ক আর মাকড়সার জাল। বেরিয়ে এসে বাড়ির বাইরেটা ঘুরে দেখতে লাগল। বড় বড় ঘাস। ঝোপঝাড়। অযত্ন আর অবহেলার ছাপ সর্বত্র। বাগানে টেবিল পেতে দেয়া। হয়েছে। তাতে বসে খাচ্ছে মেহমানরা। কিন্তু লিসটারকে দেখা গেল না ওদের। মাঝে।

অবশেষে সব জায়গায় খোঁজা হয়ে গেল, আর কোন জায়গা বাকি রইল না।

হু, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল এলেনা। বেরিয়েই চলে গেছে। আমাকে ফেলে, রেখে। আমার বিয়েতে মত ছিল না, তাই ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েছে। যাতে আমি কিছু করতে না পারি। ভেবেছে, এরকম করলে বেকায়দায় পড়ে যাব আমি। এনগেজমেন্ট আর করতে পারব না আজ…

তা না-ও হতে পারে, কিশোর বলল। বালিশের কথা ভুলে যাবেন না। চলে। যাওয়ার ইচ্ছে হলে একজন বয়স্ক লোক বালিশ সঙ্গে নিয়ে যাবেন কেন? সেই গল্পটার কথা মনে হচ্ছে, লিনুস আর কম্বলের কথা। আরেকটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। ধুপ করে একজন মানুষকে পড়ে যেতে শুনেছে মুসা। আর ফায়ারপ্লেসে। আগুন জ্বলারই বা অর্থ কী?

কি অর্থ? ভাবতে লাগল, এলেনা। আর ওই শব্দ…ওটা হতে পারে, তার পরিকল্পনারই একটা অংশ। এরকম সে করতেই পারে। তার কাছে ওটা খেলা। আমাকে রাগানোর চেষ্টা। যাতে মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসি, আর সে সুযোগ পায়।

মাথা নাড়ল কিশোর। তার চেয়ে আরও সহজ যুক্তিতে আসুন না। কারও হাত থেকে বাঁচানর জন্যে কোন একটা জিনিস ফায়ারপ্লেসে পুড়িয়েছেন আপনার আব্ব। আর সেই লোকটাই তাকে ধরে নিয়ে গেছে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে, যাতে চিৎকার করতে না পারেন।

স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল এলেনা। রক্ত সরে যাচ্ছে মুখ থেকে। তুমি বলছ কিডন্যাপ করা হয়েছে?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

পুরো এক মিনিট চুপ করে রইল এলেনা। ভাবল। তারপর বলল, পুলিশকে খবর দেয়া দরকার!

.

০৪.

আপনার বাবা হারিয়ে গেছেন? সত্যি? বড় বড় হয়ে গেল লালচুল মেয়েটার চোখ। মুসাকে গাছ বেয়ে নামতে দেখে মজা পেয়েছিল। এখন এলেনার কথা শুনে অবাক হল।

নিচের হলঘরে ঢুকেছে এলেনা। টেলিফোন রিসিভারে হাত। রকি বীচ পুলিশকে ফোন করেছে।

এটা একটা খেলা, তাই না? লালচুল মেয়েটা বলল আবার। অনেক পার্টিতেই, এরকম খেলা হয়। কেউ একজন খুন হয়ে যাওয়ার ভান করে। অন্যদেরকে তখন বলতে হয় কে খুন করেছে।

আহ, চুপ কর তো, নিনা, বিরক্ত হয়ে বলল এলেনা। এটা খেলা নয়।, কিন্তু মেয়েটা শুনল না। আমাদের বলতে হবে আপনার বাবা কোথায় লুকিয়েছেন, তাই না? কিংবা কে তাকে লুকাতে সাহায্য করেছে। তাই তো? বলতে হবে মোটিভটা কি।

নিনা, তোমার মাথায় গোবর আছে!

মসৃণ চেহারার যে যুবক যাকে কিছুক্ষণ আগে এলেনার সঙ্গে দেখা গিয়েছিল সে বেরিয়ে এল লিভিং রুম থেকে। অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। কিশোর জেনেছে ওই যুবকই এলেনার হবু বর। যাকে মেয়েটা বিয়ে করতে চায়। নাম নিকিনজা ভিশন। একই কলেজে পড়ে দুজনে। ধূসর সিল্ক পরা মহিলা তার মা। বোস্টন থেকে ছেলের সঙ্গে এসেছেন পার্টিতে যোগ দিয়ে এনগেজমেন্টের ঘোষণা শোনার জন্যে।

বিকেলে কিশোর দেখছে, জানালার চৌকাঠে আঙুল ছুঁইয়ে ধুলো পরীক্ষা করছেন মহিলা। ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে খুশি হয়েছেন কিনা কে জানে। লিসটারের মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তার ছেলে, এতেও কতটা খুশি হয়েছেন বোঝার উপায় নেই। কিশোর অন্তত বোঝেনি এখনও।

কোথায় ছিলে? এলেনাকে জিজ্ঞেস করল নিক। সবাই তোমাকে খুঁজছে।

আব্বাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

ও। কেন? এখনও রাগ পড়েনি? ভুলে যাও ওসব।

কাছেই দাঁড়িয়ে রইল কিশোর, কথা শোনার জন্যে।

কড়া চোখে নিকের দিকে তাকাল এলেনা। দেখ, তুমি পছন্দ কর আর না-ই কর, সে আমার বাবা। লিভিংরুমে এসে ঢুকল সে। চেঁচিয়ে বাদকদেরকে বলল বাজনা থামাতে।

একবার বললে শুনল না। ক্রমেই গলা চড়িয়ে মোট তিনবার বলতে হল। এলেনাকে। পুরোদমে গলা আর বাদ্যযন্ত্রের ওপর গায়ের ঝাল মেটাচ্ছিল যেন। বাদকের দল। অবশেষে শুনতে পেয়ে. থামল।

মেহমানদের দিকে ফিরল এলেনা। আমার আব্বা-আমার আব্বার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন…এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। কেউ দেখেছেন? সিঁড়ি দিয়ে নামতে?

গুঞ্জন উঠল। একে অন্যের দিকে তাকাতে শুরু করল মেহমানেরা। কয়েকজন শ্রাগ করল। কয়েকজনকে মুচকি হাসতে দেখল কিশোর, দৃষ্টিতে ব্যঙ্গ। তবে কথা। বলল না কেউই। ডেভিড লিসটারকে দেখেনি কেউ।

ড্রাইভওয়েতে ইঞ্জিনের শব্দ হল। সামনের দরজায় দেখা দিল দুজন পুলিশ। অফিসার। সরে তাদেরকে ঢোকার জায়গা করে দিল মুসা। এগিয়ে নিয়ে এল। এলেনা আর নিক।

আবার উত্তেজিত গুঞ্জন উঠল মেহমানদের মাঝে। মোটা বয়স্ক একজন লালমুখো মানুষ বেশ জোরেই বলল, বাহ, চমৎকার!

এই পিটার, চুপ, তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে বলল তার পাশে দাঁড়ানো। মহিলা। কি বলবে বুঝতে পেরেছি।

 কি বলব? পকেট থেকে চুরুট বের করল পিটার। বুড়ো জলদস্যুটা অবশেষে ধরা পড়তে যাচ্ছে একথা বলতে মানা করছ?

চুপ! সিগারেট খেতে হলে বাইরে গিয়ে খাও। যাও! হাতে হাতব্যাগ, তাই শুধু হাতটা নাড়তে পারল না, ব্যাগসহই নাড়ল। আরেকটু হলেই লোকটার মুখে বাড়ি লাগত।

ধূসর রঙের চুলওয়ালা একজন লোক মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসল। ডেভিড লিসটার জলদস্যু ছিলেন, সত্যি?

এইই, ডোপ, বলল আরেকজন। রিমলেস চশমার পেছনে চকচক করছে তার চোখ, তুমি না তার উকিল? তোমার মুখে এসব মানায় না কিন্তু। বেশ মজাই পাচ্ছে যেন লোকটা।

তুমিও তো তার ম্যানেজার, খোঁচা দিয়ে বলল উকিল, ব্যাপারটা কি। এনথনি? হঠাৎ এত ভদ্র হয়ে গেলে কিভাবে? নাকি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছ?

উকিলের কণ্ঠটা কেমন যেন ভোঁতা লাগল কিশোরের কাছে। অবাক হয়ে ভাবল, অনেক বেশি গিলে ফেলল না তো? মাতাল?

কি বলতে চাও? রেগে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যেন এনথনি।

বলতে চাই, লিসটারের কিছু হয়ে গেলে তোমার তো আর কিছু হবে না। বরং তোমার তখন পোয়া বারো…

ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগল অন্যেরা। কয়েকজন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কান তবু চলেই গেল ওদের কথায়। রুমাল দিয়ে বার বার কপাল মুছতে লাগলেন নিকের মা মিসেস ভিশন। বললেন, নিক, ভীষণ গরমরে এখানে। আমি বাইরে যাচ্ছি।

নিক যেন তার কথা শুনতেই পেল না। বেসিন হাসল। হাসিটা কেমন যেন বাকা। ইতিমধ্যেই মেহমানরা তার বুফের বেশির ভাগটাই সাবার করেছে। কাজেই দরজায় এসে দেখার সুযোগ পেল তরুণ ক্যাটারার, কি নিয়ে এত উত্তেজনা।

সাউথ’স স্পেশালিটি স্টোরের ম্যানেজার ছিলে যখন, ডোপ বলছে। কন্ট্রাকটরদের সঙ্গে তোমার গোপন চুক্তি হত। ভাবছ ভুলে গেছি। পোমোনার ওই নতুন ব্রাঞ্চটা খোলার সময় তো রীতিমত তাদেরই একজন হয়ে গিয়েছিলে তুমি। অবশ্য বেশি টাকার প্রয়োজন হলে আর ওরকম সুযোগ পেলে কে না কাজে লাগায়। বল। কন্ট্রাকটররা তো মানুষকে টাকা দেয়ার জন্যে মুখিয়েই থাকে।

মিথ্যে কথা! প্রায় চিৎকার করে উঠল এথনি। নিজে যেমন অন্যকেও তেমনই ভাবে সবাই। এসব কাণ্ড নিশ্চয় তুমিই করতে, তাই না, ডোপ?

চুপ করে আছে ডোপ। কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসল এন্থনি। স্টক মার্কেটে দ্রুত বেশ কিছু কামিয়ে নিলে, সেটা নিশ্চয় সৎ উপায়ে নয়। ঠিক বলছি না? লিটারের সন্দেহ ছিল, মক্কেলের গচ্ছিত টাকা তাদেরকে না জানিয়ে বিনা অনুমতিতে নিজের ব্যবসায় খাঁটিয়েছ।

থাম! চেঁচিয়ে উঠল ডোপ। চুপ কর!

লিসটারের টাকাও নষ্ট করেছিলে নাকি? ধরা পড়ে গেছ? তার ওপর সে কারণেই রেগেছ… আচমকা থেমে গেল এনথনি। চারপাশে তাকিয়ে যেন এই প্রথম খেয়াল করল ঘরে আরও লোক রয়েছে, তাদের উত্তপ্ত বিতণ্ডা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে।

সিগার ধরিয়েছে যে লোকটা সে ঘড়ির দিকে তাকাল। আরে, এত্তো দেরি হয়ে। গেছে। জোরেই বলল কথাটা। স্পষ্টই বুঝিয়ে দিল, যথেষ্ট হয়েছে, এই বিচ্ছিরি পরিবেশে আর থাকতে চায় না। যাওয়া দরকার। পুলিশ কি বেশি দেরি করবে?

এটা সূচনা। বিরক্ত প্রায় সবাই হয়েছে। হাত মেলাতে শুরু করল বয়স্ক মেহমানেরা। গুডবাই জানিয়ে বিদায় নিতে লাগল। একসাথে লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে। দিন ঠিক করছে দুজন লোক, শুনে ফেলল কিশোর। এলেনার অল্পবয়সী বন্ধুরাও লম্বা জানালা দিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেল, সেখান থেকে হেঁটে বাড়ির বাইরে।

পার্টি শেষ। অধিকাংশ মেহমানই চলে গেছে। বেসিন আর তার সহকারীরা মিলে টেবিলগুলো পরিষ্কার করতে লাগল। টেবিল থেকে গোলাপী রঙের টেবিলক্লথগুলো নিয়ে বাগানে চলে গেল ধোয়ামোছার জন্যে যে লোকটাকে রাখা হয়েছে সে। সেখান থেকে ছোট একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে গেল পেছনের হলঘরে। বারের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকটা খালি বোতল ভরতে লাগল বাক্সে।

ফোল্ডিং চেয়ার আর টেবিলগুলো ভাজ করে বয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে তুলতে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। গিয়ে দেখল, টেবিলক্লথ ঝেড়ে পরিষ্কার করে ভাজ করে বয়ে নিয়ে এসেছে ধোয়ামোছার লোকটা, ট্রাকে তুলছে কাপড়গুলো।

পুলিশের সঙ্গে যখন বেরিয়ে এল এলেনা, তখনও ট্রাকে মাল তোলায় ব্যস্ত তিন গোয়েন্দা। সিঁড়ির দিকে দেখাল মেয়েটা। হোয়েরটাকে সাথে করে উঠে গেল দুই অফিসার। হলের ভেতর দিয়ে লিভিং রুমে চলে এল এলেনা।

উসখুস করছে নিক। যেন এখানে থাকার কথা নয় তার। এলেনা, তুমি ঠিক আছ তো? বলল কোনমতে।

আছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলেনা। বু-বুঝতে পারছি না কি করব। ভয় পাব না। কি করব। আব্বা ইচ্ছে করে একাজ করে থাকতে পারে। পার্টি দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। আমার চাপাচাপিতেই করেছে। মেহমানরা চলে গেলেই এসে ঢুকবে হয়ত, চওড়া হাসি দেবে আমার দিকে তাকিয়ে। তাহলেও ভাল হত। কিন্তু যদি সত্যিই বিপদে পড়ে থাকে?

পুলিশ কি বলে?

কি আর বলবে। তদন্ত করবে। ওরা এখনও ভাবছে না আব্বার খারাপ কিছু হয়েছে। গেছে যে বেশিক্ষণ হয়নি। তাছাড়া খামখেয়ালি মানুষ, শুনেছেই তো। জিজ্ঞেস করেছে আব্বর শত্রু আছে কিনা। তাদের নাম জানি কিনা। কি আর বলব বল। আমার আব্বার শত্রুদের নাম? লস অ্যাঞ্জেলেসের পুরো টেলিফোন ডিরেকটরিটাই দিয়ে দিতে হয় তাহলে!

অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

এগিয়ে আসতে দেখা গেল মিসেস ভিশনকে। মুখে হাসি। যেন সব কিছু ঠিক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর কোন অসুবিধে হবে না, হাসিতেই বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। কাছে এসে বললেন, এলেনা, মা, কিছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে দরকার হলে একটুও দ্বিধা না করে মোটেলে ফোন করো।

থ্যাঙ্ক ইউ, বলল এলেনা।

 দস্তানা পরতে শুরু করল্লেন নিকের মা। চমৎকার একটা পার্টি দিলে, সত্যি। বলেই বুঝলেন ভুল করে ফেলেছেন, রুটিন মাফিক সৌজন্য দেখানো অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে চলবে না, শুধরে দেয়ার জন্যে বললেন, মানে হতো আরকি। যদি তোমাদের যাকগে। কিচ্ছু ভাববে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। নিক, আয়। মেয়েটা একা থাকুক কিছুক্ষণ। রেস্ট নিক।

আমি ফোন করব, এলেনাকে কথা দিল নিক।

হ্যাঁ, বিড়বিড় করে বললেন মিসেস ভিশন। অবশ্যই করবে। করতে তো হবেই।

ঘুরে তাকাতেই কিশোরের ওপর চোখ পড়ল এলেনার। কী? কিছু লাগবে?

ইয়ে…মিস লিসটার…আমি দুঃখিত, বলল, কিশোর।

হ্যাঁ, সবাইই দুঃখিত। কিন্তু তাতে আমার কি উপকার হবে?

এই মুহূর্তটার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল কিশোর। পকেট থেকে বের করল তিন গোয়েন্দার কার্ড। বাড়িয়ে দিল এলেনার দিকে। দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল রবিন আর মুসা।

হেসে উঠল এলেনা। তিন গোয়েন্দা! প্রাইভেট ডিটেকটিভ! হাহ হাহ!

তিনজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে। অনেক ধন্যবাদ। গোয়েন্দার দরকার হলে প্রফেশনাল লোককেই ভাড়া করতে পারব আমি, নবিসকে নয়।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিছুটা হতাশই হয়েছে এলেনার আচরণে। যদিও মানুষের এই আচরণ নতুন নয় তার কাছে। তবে একেবারে নিরাশ করেনি তাকে– মেয়েটা। কার্ডটা ফিরিয়ে দেয়নি কিংবা ফেলে দেয়নি। ল্যাম্প রাখা আছে যে টেবিলটায় তার ড্রয়ারে গুঁজে রেখে দিল।

বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। হেনরি বেসিনের গাড়িতে করে চলল। তার দোকানে গিয়ে তার নিজস্ব জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করবে। তারপর ট্রাকটা। নিয়ে চলে যাবে পিকো। ডেকোরেটরের টেবিল চেয়ার আর টেবিলক্লথ ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। বেসিনের দোকান থেকে, তাদের সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরবে ছেলেরা।

ডিনারের পর মুসাদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে, সেটাতে যোগ দিতে হবে। তাকে। তার দাদার জন্মদিনের পার্টি। কিন্তু রবিনের তেমন কোন কাজ নেই। কিশোরের সঙ্গে ইয়ার্ডে যেতে অসুবিধে নেই তার।

বেসিনের ওখানে কাজ সেরে বাড়ি রওনা হল তিন গোয়েন্দা। কিছুদূর এসে মোড় নিয়ে একদিকে চলে গেল মুসা, কিশোর আর রবিন আগের পথেই রইল। চলে এল স্যালভিজ ইয়ার্ডে। ওয়ার্কশপে সাইকেল রেখে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ট্রেলারে ঢুকল, তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার। বিকেলের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনার জন্যে।

তো, কি ভাবছ? কথা শুরু করল রবিন। মিস্টার লিসটার কি সত্যিই পাগল?

খামখেয়ালি তো বটেই। এবং নিষ্ঠুর। একটা বিশেষ ভঙ্গিতে বলল কিশোর। যখন কোন রহস্যের সমাধান খোঁজে কিংবা প্রশ্নের জবাব বের করতে চায় তখন এভাবে কথা বলে সে। নইলে পার্টি থেকে ওরকম করে চলে গিয়ে মেয়েকে অপদস্ত করার কি মানে? পাগল না হলে করে কোন ভদ্রলোক?

একটা প্যাডে আনমনে আঁকতে শুরু করল গোয়েন্দাপ্রধান। পার্টির মেহমানরাও অদ্ভুত। কেমন যেন। শুধু একটা ব্যাপারেই ওদের মিল দেখতে পেলাম, লিসটারকে কেউ পছন্দ করে না। তাদের অনেকেই নিশ্চয় তার কর্মচারী। ওই যে উকিল আর অন্য লোকটার মাঝে বিশ্রী আলোচনা হল..

জঘন্য! মুখ বিকৃত করল রবিন। কোন ভদ্রলোক যে ওভাবে কথা বলতে পারে…তবে এলেনার কলেজের বন্ধুরা কিন্তু ভাল, অন্তত স্বাভাবিক বলা চলে। অবাক ব্যাপারই। ওরকম বদমেজাজী একটা মেয়ের সঙ্গে যে কারও বন্ধুত্ব হয়। বিশ্বাস করা কঠিন।

টেলিফোন বাজল।

তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর। বলুন।

রবিন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে।

ও, কিশোর বলল, তাই!

আরও কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনল। তারপর বলল, বেশ।

রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। এলেনা লিসটার। এখুনি যেতে বলেছে আমাদের। তার বাবাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

<

Super User