ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর
, ১৯৮৯

গোধূলি বেলায় উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো অদ্ভুত গোঙানি!

ওই, ফিসফিস করে বললো মুসা আমান। শুরু হলো আবার!

হারভে র‍্যাঞ্চের কাছে একটা উঁচু শৈলশিরার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কয়েক শো ফুট দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তটরেখা।

আবার শোনা গেল গোঙানি। যেন কোনো দানবের দীর্ঘশ্বাস, লম্বিত, কাঁপা, ভয়াল।

ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল মুসার শিরদাঁড়া বেয়ে। কাজে আসে না বলে দোষ দেয়া যায় না র‍্যাঞ্চের শ্রমিকদের।

হয়তো লাইটহাউস থেকে আসছে, নিচু কণ্ঠে বললো রবিন। আসার পথে যেটা দেখে এলাম। ফগহর্ন।

মাথা নাড়লো কিশোর। আমার তা মনে হয় না। ফগহর্নের শব্দ ওরকম নয়। তাছাড়া এখন কুয়াশা নেই, ফগহর্ন বাজাবে কেন?

তাহলে কি…, বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।

কিশোর তার জায়গায় নেই। উঠে শৈলশিরার ডান পাশ ধরে ছুটতে শুরু করেছে। তাকে অনুসরণ করলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। পর্বতের ওধারে হারিয়ে গেছে সূর্য, আবছা বেগুনী আলো এখন উপত্যকায়।

পঞ্চাশ গজমতো এসে থেমে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। আবার সেই গোঙানি। কানের পেছনে হাত রেখে ভালো করে শুনলো শব্দটা।

চোখ বড় বড় করে মুসা বললো, কিশোর, কি করবো?

জবাব দিলো না কিশোর। হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো, উল্টোদিকে একশো গজ দূরে এসে থামলো।

এই কাজই করবো নাকি খালি আমরা। পাশে এসে বললো রবিন। পাহাড়ের ওপরে খালি হাঁটাচলা? গোয়েন্দাপ্রধানের কাণ্ড দেখে মুসার মতোই সেও অবাক হয়েছে।

এবারও জবাব দিলো না কিশোর। কান পেতে শুনলো গোঙানির আওয়াজ। শব্দটা থেমে যাওয়ার পর ঘুরলো রবিনের দিকে। বললো, না, নথি, পরীক্ষাটা শেষ করলাম।

কিসের পরীক্ষা? জিজ্ঞেস করলো মুসা। হাঁটলাম আর দৌড়ালাম তো শুধু, আর কি করলাম?

 বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শব্দটা শুনলাম, ব্যাখ্যা করলো কিশোর। মনে মনে জ্যামিতি..মানে, কতগুলো কল্পিত রেখা এঁকেছি। শব্দটা কোত্থেকে আসে তার একটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেছি। রেখা এঁকেছি মোট তিনটে। যেখানে সবগুলো এক জায়গায় ক্রস করেছে, শব্দটা সেখান থেকেই আসে।

বুঝে ফেললো রবিন। ঠিক বলেছে ও, মুসা। একে বলে ট্রাইঅ্যাঙ্গুলেশন। এঞ্জিনিয়াররা হরদম এই পদ্ধতি কাজে লাগায়।

বুঝেছো তাহলে, বললো কিশোর। নিখুঁত ভাবে করতে পারিনি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।

কিসের উদ্দেশ্য? কিশোরের সহজ ইংরেজিও এখন হীব্রু ভাষা বলে মনে হচ্ছে মুসার কাছে। কি বের করতে চাইছো?

শব্দটা কোথা থেকে আসে। পর্বতের ওই গুহা থেকে। হেনরি ফিগারোর গুহা।

এটা তো জানিই আমরা, নিরাশ মনে হলো মুসাকে। মিস্টার হারভেই বলেছেন।

মাথা নাড়লো আবার কিশোর। তাতে কি হয়েছে? ভালো গোয়েন্দা কক্ষণো অন্যের কথায় নির্ভর করে না। নিজে তদন্ত করে যাচাই করে দেখে। অন্যের চোখে দেখা আর নিজের চোখে দেখার মাঝে অনেক ফারাক। গাল চুলকে নিলো। শিওর হলাম, শব্দটা হেনরি ফিগারোর গুহা থেকেই আসে। এখন জানতে হবে গোঙানিটা কিসের, আর…

তাকে থামিয়ে দিলো সেই বিচিত্র আওয়াজ। ঘন ছায়া নামছে উপত্যকায়। গুঁড়ি মেরে যেন এগিয়ে আসছে অন্ধকারের দানব। শব্দটা শুনে এইবার গোয়েন্দা প্রধানও কেঁপে উঠলো।

ঢোক গিললো মুসা। খাইছে, কিশোর! মিস্টার হারভে আর শেরিফ গুহাটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। কিছু পাননি।

হয়তো কোনো ধরনের জানোয়ার, রবিন বললো।

জানোয়ারের মতো কি লাগছে? প্রশ্ন করলো কিশোর। আর, মি হারভে বা শেরিফ কোনো অস্বাভাবিক জন্তুর পায়ের ছাপও পাননি। ভালো করেহ জানো, ওঁরা দুজনেই অভিজ্ঞ শিকারী, দক্ষ ট্র্যাকার।

অস্বাভাবিক জন্তু? অস্বস্তি বোধ করছে মুসা।

এমন কোনো জন্তু, যার নাম শুনেনি মানুষ। মুসার দিকে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান, চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কে জানে, হেনরি ফিগারোও এসবের কারণ হতে পারে!

আঁতকে উঠলো মুসা। আল্লাহরে! বলো কি, কিশোর? ভূত-টুত তো বিশ্বাস করি না আমরা, করি?

তুমি করো, হাসলো কিশোর। কিন্তু ভূতের কথা বলছি না আমি।

তাই তো বললে। হেনরি ফিগারো মারা গেছে একশো বছর আগে, প্রতিবাদ করলো রবিন। তার ভূত না হলে আর কি?

জবাব দেয়ার সুযোগই পেলো না কিশোর। ঠিক ওই সময় উপত্যকা ছাড়িয়ে ওপাশের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লাল আলোয়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠলো যেন সমস্ত এলাকা।

কী, কিশোর? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

 মাথা নাড়লো কিশোর। জানি না।

বিস্ফোরণের আওয়াজ পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। একে অন্যের দিকে তাকালো তিন কিশোর।

নার্ভাস ভঙ্গিতে আঙুল মটকালো. রবিন। বোধহয় নেভি! ওই যে যাদের নৌবহর দেখলাম। নিশ্চয় চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এ প্র্যাকটিস করছে।

নিষ্প্রাণ হাসি হাসলো মুসা। ঠিকই বলেছো। বছরে দুবার এখানে এসে প্র্যাকটিস করে ওরা। খবরের কাগজে পড়েছি। নির্জন দ্বীপগুলোয় আস্তানা গেড়ে গোলাগুলির মহড়া চালায়।

হা, কিশোর বললো। কালকের পেপারেও ছিলো। নাইট ফায়ারিং, প্র্যাকটিস। চলো, র‍্যাঞ্চে। এই উপত্যকার কথা আরও জানতে হবে।

দ্বিতীয়বার বলতে হলো না রবিন আর মুসাকে। পেছনে, পাহাড়ের নিচে রেখে এসেছে সাইকেল, সেদিকে রওনা হলো।

হঠাৎ, উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে শোনা গেল.পাথর পড়ার ভারি শব্দ, সেই সাথে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

.

০২.

শব্দটা মিলিয়ে গেল গোঙানি উপত্যকার-মোনিং ভ্যালির বাংলা নাম রেখেছে কিশোর– ওপর দিয়ে।

ওটা তো গুহা থেকে আসেনি! বলে উঠলো মুসা।

না। একমত হলো কিশোর। মানুষের চিৎকার!

 বিপদে পড়েছে, যোগ করলো রবিন। চলো তো দেখি।

তটরেখা আর পর্বতের মাঝের উপত্যকা থেকে এসেছে শব্দটা। পর্বতের নাম ডেভিল মাউনটেইন, কারণ, দুদিকের দুটো চূড়া দূর থেকে দেখায় কল্পিত শয়তানের শিঙের মতো।

দৌড় দিলো তিন গোয়েন্দা। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে অনেকগুলো পাথর। জমা হয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়, ধুলো উড়ছে এখনও।

আআহ! যন্ত্রণায় কাতরালো কেউ।

সবার আগে লোকটার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মুসা। ধূসর চুল মানুষটার, কোমরের নিচের অংশ পাথরের তলায়। ব্যথায় মুখ বিকৃত। চুপ করে। শুয়ে থাকুন, বলে কিশোরের দিকে ফিরলো মুসা। মনে হচ্ছে পা-টা ভেঙেছে।

লোকটার পরনে পুরনো কাউবয় পোশাক। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে। কোনোমতে বললো, আ-আমি হারভে র‍্যাঞ্চে কাজ করি। মিস্টার হারভেকে গিয়ে বলো, কাউকে এখানে পাঠিয়ে দিতে। প্লীজ!

হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালো তিন গোয়েন্দা। আরেকটা দুর্ঘটনা! আহত হলো মিস্টার হারভের আরেকজন শ্রমিক!

.

হারভে দম্পতির সঙ্গে দুই হপ্তার ছুটি কাটাতে র‍্যাঞ্চে এসেছিলো মুসা। র‍্যাঞ্চটার নতুন মালিক মিস্টার হারভে। বিখ্যাত একজন রোডিয়ো-রাইডার, মুসার বাবা। মিস্টার রাফাত আমানের সঙ্গে অনেকগুলো ওয়েস্টার্ন ছবিতে কাজ করেছেন। জন্তুজানোয়ার, বিশেষ করে ঘোড়ার খেলা দেখাতেন। সেই কাজ ছেড়ে জমানো টাকা দিয়ে কিছুদিন আগে এই র‍্যাঞ্চ কিনে শেষ জীবনটা কাটাতে এসেছেন এখানে। নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো র‍্যাঞ্চটার মেরামত সবে শেষ করে এনেছেন, এই সময় শুরু হলো গণ্ডগোল।

মোনিং ভ্যালির নামকরণ হয়েছে প্রাচীন ইণ্ডিয়ানদের একটা রোমাঞ্চকর লোককাহিনী আর পুরনো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকদের নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। গুজব রটতে শুরু করেছে এখনঃ পঞ্চাশ বছর নীরব থাকার পর আবার জেগে উঠেছে মোনিং ভ্যালি, গোঙাতে আরম্ভ করেছে। র‍্যাঞ্চ শ্রমিকদের তাড়ানোর  জন্যে যেন গোঙানিই যথেষ্ট নয়, তাই ঘটতে শুরু করেছে দুর্ঘটনা।

প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটে কিছু দিন আগে। দুজন শ্রমিক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলো মোনিং ভ্যালির কাছ দিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ এক অদ্ভুত গোঙানি শুনে চমকে উঠলো তাদের ঘোড়া, ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে দিলো দৌড়। এর জন্যে তৈরি ছিলো না লোক দুজন। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। একজনের হাত ভাঙলো, আরেকজনের হাড়গোড় ঠিক থাকলেও শরীরের নানা জায়গা ছিলেছুলে গেল। দুজনেই র‍্যাঞ্চে ফিরে এলো। জানালো, ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। উপত্যকায়। তার কয়েকদিন পরে, কোনো কারণ ছাড়াই রাত দুপুরে উন্মাদ হয়ে গেল যেন র‍্যাঞ্চের গরুর পাল। নানারকম অঘটন ঘটিয়ে ছাড়লো। তারপর এক সন্ধ্যায় উপত্যকার ওদিকে বেড়াতে গিয়ে নাকি বিরাট এক দানব দেখে এলো আরেক শ্রমিক। কসম খেয়ে বললো, ডেভিল মাউনটেইনের গোড়ায় হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে বেরিয়েছে দানবটা। তার দিন কয়েক পরে, কাউকে কিছু না। জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল দুজন শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে এসে শেরিফ জানালেন, তাদেরকে সানতা কারলায় দেখা গেছে, কিন্তু অনেক শ্রমিকই বিশ্বাস করলো না। তার কথা।

দিন কয়েক র‍্যাঞ্চে থেকেই মুসা বুঝে গেল, ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। হারভে দম্পতি। ফিগারোর গুহায় অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, রহস্যময় কিছুই পাওয়া যায়নি, রহস্যেরও সমাধান হয়নি। ইণ্ডিয়ান লোককাহিনী আর ভূতের পেছনে তাড়া করার উপায় নেই, কাজেই কোনো সাহায্য করতে পারলেন না। শেরিফ। তিনি, এবং হারভে দুজনেই বিশ্বাস করেন, ভূত-ফুত সব বাজে কথা, নিশ্চয় কোনো সহজ ব্যাখ্যা আছে এসবের। কিন্তু বুঝতে পারছেন না, সেটা কী।

কিশোরকে ছাড়া হবে না, বুঝে, হারভে দম্পতির অনুমতি নিয়ে তাকে আর রবিনকে আসার জন্যে খবর পাঠালো মুসা। বাড়িতে জরুরি কাজ ফেলে ছুটে এসেছে দুজনে। এরকম একটা রহস্যের কথা শোনার পর কি আর স্বস্তিতে কাজ করা যায়? অন্তত কিশোর পাশার পক্ষে সম্ভব নয়। আর মুসা নেই, কিশোর থাকবে না, একলা কি আর মন টেকে রবিনের? গোল্লায় যাক জরুরি কাজ, বলে সোজা। রওনা হয়ে পড়লো দুজনে।

ক্যালিফোরনিয়া উপকূলে রকি বীচ থেকে একশো মাইল উত্তরে, আর। আধুনিক হলিডে রিসোর্ট সানতা কারলার মাইল দশেক দূরে এই হারভে র‍্যাঞ্চ। পার্বত্য অঞ্চল। বড় বড় পাহাড়-পর্বত, গুহা, গভীর গিরিখাত, অসংখ্য উপত্যকা আর একধারে প্রশান্ত মহাসাগর এখানে। মুসা এসেছিলো চুটিয়ে ঘোড়ায় চড়তে, সাঁতার কাটতে আর মাছ ধরতে কোনোটাই করা হলো না। জড়িয়ে পড়লো। জটিল রহস্যে, দুই দোস্তকেও ডেকে আনলো।

ভূতের আসর হয়েছে এই উপত্যকায়, বিড়বিড় করলো আহত লোকটা। আসাই উচিত হয়নি…ওই গোঙানি, গোঙানিই যতো নষ্টের মূল!

না, দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নেভির ফায়ারিঙের শব্দে কেঁপে উঠে ওই পাথরের ধস নেমেছে।

আমি বলছি সেই গোঙানি!

ওসব কথা পরে হবে, বললো মুসা। কিশোর, আগে…

তার কথা শেষ হলো না। কাছেই ডেকে উঠলো ঘোড়া। ফিরে চেয়ে দেখলো ছেলেরা, তিনজন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে। তাদের একজন রাশ ধরে টেনে আনছে চতুর্থ আরেকটা ঘোড়াকে-পিঠে আরোহী নেই; যে লোকটা পড়ে ব্যথা পেয়েছে বোধহয় তারই ঘোড়া। দলের আগে আগে রয়েছেন মিস্টার হারভে।

তোমরা এখানে? কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। লম্বা, ইস্পাতকঠিন দেহ, গায়ে উজ্জ্বল লাল শার্ট, পরনে রঙচটা নীল জিনসের প্যান্ট, পায়ে হাই-হীল কাউবয় বুট। রোদেপোড়া তামাটে চামড়া। চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ।

আহত লোকটাকে কিভাবে পেয়েছে জানালো ছেলেরা।

বেশি ব্যথা পেয়েছো, পোরটিকো? লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন মিস্টার হারভে।

হাড্ডি ভেঙে গেছে! বললো পোরটিকো। সব ওই ভূতের কারবার.. গুহার ভূত! আমি আর এখানে থাকছি না!

আমার ধারণা, কিশোর বললো। ফায়ারিঙের শব্দে ধস নেমেছে।

সেটা সম্ভব, মাথা দোলালেন মিস্টার হারভে।

আহত লোকটার গায়ের ওপর থেকে পাথর সরিয়ে ফেলা হলো। দুজন লোক গিয়ে র‍্যাঞ্চের ট্রাক নিয়ে এলো। সাবধানে তাতে তোলা হলো পোরটিকোকে। তারপর রওনা হলো সানতা কারলায়, হাসপাতালে।

তিন গোয়েন্দা ফিরে চললো তাদের সাইকেলের কাছে।

 র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে পুরোপুরি আঁধার হয়ে গেল। মোট পাঁচটা বাড়িঃ শ্রমিকদের থাকার জন্যে একটা বাংকহাউস, একটা বড় গোলাঘর, একটা ছোট গোলাঘর, একটা রান্নাঘর, আরেকটা মূল বাড়ি। ওই বাড়িটা দোতলা। কাঠের বড় বড় বীম রয়েছে, অ্যাডোব আছে, আর বাড়ি ঘিরে রয়েছে চওড়া, ছাউনিওয়ালা বারান্দা। দিনের বেলায়ও সেখানে ছায়া থাকে, ঠাণ্ডা থাকে। জানালার যেখানেই সুযোগ পেয়েছে লতিয়ে উঠেছে আঙুর লতা। বাড়ির চারপাশে রক্তলাল বোগানভিলিয়ার ছড়াছড়ি। পাঁচটা বাড়ির চারপাশে তৈরি হয়েছে বেড়া দেয়া কয়েকটা কোরাল।

রান্নাঘরের কাছে লোকের হোট ঘোট জটলা। দুর্ঘটনার কথা আলোচনা, করছে। নিচু কণ্ঠ, চেহারায়.ভয় আর রাগের মিলিত ছাপ।

মূল বাড়িতে ঢুকতে যাবে, অন্ধকার থেকে শোনা গেল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ।

কোথায় ছিলে তোমরা? জানতে চাইছে র‍্যাঞ্চের ফোরম্যান ডেভিড কোহেন।

বারান্দায় মৃদু নড়াচড়া। আলোয় বেরিয়ে এলো কোহেন। দেহের তুলনায়। মুখটা ছোট, খাড়া নাক, রোদে পোড়া চামড়া। গেছিলে কোথায়? আবার জিজ্ঞেস করলো সে। জায়গা ভালো না। হারিয়ে যেতে যদি?

পাহাড়-পর্বত অনেক দেখা আছে আমাদের, মিস্টার কোহেন, জবাব দিলো কিশোর। ভাববেন না।

আরেক কদম এগোলো ফোরম্যান। তোমরা কি করতে গিয়েছে, শুনলাম। গোঙায় কিসে, জানতে। দেখো, জায়গাটা ভালো না। বাচ্চাদের জন্যে আরও খারাপ। ওই গুহার ধারেকাছে যাবে না।

ছেলেরা কিছু বলার আগেই বাড়ির একটা দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ছোটখাটো একজন মহিলা। ধূসর চুল। রোদে পুড়ে তামাটে হয়েছে এককালের লালচে চামড়া। গালের গোলাপি আভাও আর নেই এখন, হাত-পায়ের মতোই। তামাটে। কি আজেবাজে বকছো, ডেভিড? ধমক দিয়ে বললেন মিসেস হারভে। ওরা বাচ্চা নয়। আমার বিশ্বাস, অনেকের চেয়ে বুদ্ধিশুদ্ধিও বেশিই রাখে।

মোনিং ভ্যালি ভালো জায়গা নয়, মিনমিন করে বললো কোহেন।

তুমিই তো বাচ্চা ছেলের মতো কথা বলছো। ভূতের ভয়ে কাবু। গুহাটাকে ভয় পাও!

ভয় পাই না আমি! আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো কোহেন। তবে সত্যকে কিছু না বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সারা জীবন এখানে কাটালাম, জানেনই। সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি মোনিং ভ্যালির গল্প। তখন বিশ্বাস করতাম না, এখন করি।

যত্তোসব ফালতু কথা! কুসংস্কার! বললেন বটে মিসেস; কিন্তু গলায় জোর। নেই। বোঝা যাচ্ছে, তিনিও শিওর নন। কণ্ঠের উৎকণ্ঠা ঢাকতে পারলেন না।

কিশোর জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার কোহেন, গোঙানির কারণটা বলতে পারবেন?

দ্বিধা করলো ফোরম্যান। না। কেউ জানে না। আমিও অনেক খুঁজেছি, কিছু পাইনি। মানে. দেখিনি! শেষ শব্দটার ওপর বিশেষ জোর দিলো সে। আবছা অন্ধকারে চকচক করে উঠলো তার চোখ। ইণ্ডিয়ানরা বলে কেউ নাকি দেখতে পায় না। ভূ…, শুধরে নিয়ে বললো। বুড়ো মানুষটাকে!

.

০৩.

ডেভিড! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে।

পরোয়া করলো না. কোহেন। আমি ওই গল্প বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজব ঘটনা তো ঘটছে গুহায়। অস্বীকার করতে পারেন? আবার গোঙাতে শুরু করেছে। গুহাটা, কেউ জানে না, কেন। কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। বুড়ো মানুষটা না হলে আর কে?

বলে আর দাঁড়ালো না ফোরম্যান। বারান্দা থেকে নেমে সোজা বাংকহাউসের দিকে হাঁটা দিলো।

সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস হারভে। সবার মনেই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে! ডেভিডের মতো সাহসী লোক আমি কমই দেখেছি, তারই যখন এই অবস্থা…ওরকম করে কখনও কথা বলেনি।

আমাদেরকে বুড়ো মানুষটার কথা শোনালো কেন? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। কিশোর।

জোর করে উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে হাসলেন মিসেস হারভে। বোধহয় ও টায়ারড। সারাদিন এতো বেশি পরিশ্রম করতে হয়.. তো, তোমাদের খিদে পায়নি? দুধ আর বিস্কুট চলবে?

নিশ্চয়ই, তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মুসা।

আরামদায়ক লিভিংরুমে বসে খাচ্ছে ছেলেরা। সুদৃশ্য ইনডিয়ান কার্পেটে ঢাকা মেঝে, পুরনো আমলের আসবাবপত্র। মস্ত এক ফায়ারপ্লেস এক দিকের দেয়ালের প্রায় সবটা জুড়ে রয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শিকার করা হরিণ, ভালুক আর পার্বত্য সিংহের মাথা।

ওই বুড়ো মানুষটা কে? মিসেস হারভেকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। আরেকটা বিস্কুট তুলে নিলো।

ও কিছু না। ইনডিয়ানদের উপকথা। অনেক আগে স্প্যানিশরা যখন এলো, তখনকার ইনডিয়ানদের মাঝে একটা গল্প চালু ছিলো। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে একটা খাড়িতে নাকি কালো, চকচকে, একটা দানব থাকে।

চোখ মিটমিট করলো মুসা। কোহেন যে বললো: কেউ দেখেনি? দেখেই যদি থাকবে, জানলো কি করে কালো আর চকচকে! আর দানবকে মানুষই বা বলা কেন?

তাহলেই বোঝো, হাসলেন মিসেস হারভে। কোনো যুক্তি নেই। গল্প গল্পই।

দানবকে মানুষ বলে বোধহয় শ্রদ্ধা করে, কিশোর বললো। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘকে স্থানীয় লোকেরা সম্মান করে বলে বড় মিয়া। ভয়ে। তাদের বিশ্বাস, ওরকম করে ডাকলে বাঘ তাদের কিছু বলবে না! ওসব কুসংস্কার। যারা বলে তাদের কেউ কি বাঘের পেটে যায় না?

আগের কথার খেই ধরে রবিন জিজ্ঞেস করলো, স্প্যানিয়ার্ডরা কি বলতো?

অনেক আগের কথা তো, বললেন মিসেস হারভে। তখনকার। স্প্যানিয়ার্ডরাও ওই ইনডিয়ানদের চেয়ে কিছু কম ছিলো না, কুসংস্কার ছিলো ওদের মাঝেও। মুখে বলতো বিশ্বাস করে না, কিন্তু উপত্যকার ধারেকাছেও যেতো না। হেনরি ফিগারো অবশ্য ওসব পরোয়া করতো না। সে গুহার ভেতরেও ঢুকতো।

হেনরি ফিগারোর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন? অনুরোধ করলো কিশোর।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন মিস্টার হারভে। সঙ্গে বেঁটে, রোগাটে একজন লোক। চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা। ছেলেরা আগেই পরিচিত হয়েছে তার সঙ্গে। প্রফেসর হারকসন। তিনিও এই র‍্যাঞ্চে মেহমান।

এই যে, ছেলেরা, বললেন প্রফেসর। শুনলাম রহস্যময় মোনিং ভ্যালিতে গিয়েছিলে।

রহস্য না কচু! মুখ বাঁকালেন মিস্টার হারভে। অতি সাধারণ ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দেখছে সবাই। কোনো র‍্যাঞ্চে কি দুর্ঘটনা ঘটে না, ওরকম হাত-পা ভাঙে না?

কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো, প্রফেসর বললেন। আসলে, অশিক্ষিত তো ওরা। ভাবছে, না জানি কি! ভয় পেয়ে গেছে।

কারণটা জানলেই ওদের এই ভয় ভেঙে যেতো। আজকের ঘটনায় আরও লোক হারাবো, চলে যাবে। কোনো কিছুর লোভ দেখিয়েই ধরে রাখতে পারবো না। ছেলেগুলোও বুঝতে পারছে, ভূতের কাণ্ড নয়। নেভির গানফায়ারিঙের জন্যেই ধস নেমেছে। অথচ বোকা:গাধাগুলোকে বোঝানো যাচ্ছে না। আমি শিওর, সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে ওই গোঙানির।

সেটা কি? প্রশ্ন করলেন মিসেস হারভে।

নাক টানলেন মিস্টার হারভে। পুরনো সুড়ঙ্গগুলোর ভেতর দিয়ে জোরে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় ওরকম শব্দ হয়।

হাতের বিস্কুটটা খেয়ে শেষ করলো কিশোর। আপনি আর শেরিফ নাকি ঢুকেছিলেন গুহায়? ভালোমতো দেখেছিলেন?

এমাথা-ওমাথা কিছুই বাকি রাখিনি। ভূমিকম্পে ধস নেমে কিছু কিছু সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু যেগুলোতে ঢোকা যায়, সব কটাতে ঢুকেছি।

নতুন কোনো অদল-বদল চোখে পড়েছে?

অদল-বদল? ভ্রূকুটি করলেন মিস্টার হারভে। না তো। কি বোঝাতে চাইছো?

গোঙানি শুরু হয়েছে মাত্র এক মাস আগে থেকে। পঞ্চাশ বছর পর। বাতাসের কারণেই যদি হয়ে থাকবে, এতোদিন বন্ধ থাকলো কেন? হতে পারে, সুড়ঙ্গের ভেতরে কিছু একটা বদলে দেয়া হয়েছে, যার ফলে আবার শুরু হয়েছে শব্দ।

ভালো বলেছো তো! নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠেলে পেছনে সরালেন প্রফেসর। চমৎকার যুক্তি! রক, বুদ্ধি আছে ছেলেগুলোর। মনে হচ্ছে এ রহস্যের সমাধান করেই ফেলবে।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন, আওয়াজটা সন্ধ্যায় হয় কিংবা রাতে হয়, দিনের বেলা হয় না। কেন? তারমানে শুধু বাতাস নয়, আরও কোনো ব্যাপার আছে। আরেকটা ব্যাপার, গত এক মাসে রাতে যতো দিন ঝড়ো বাতাস বয়েছে, রোজই কি ওই শব্দ শোনা গেছে?

না, যায়নি, আগ্রহী হয়ে উঠছেন মিস্টার হারভে। ঠিকই বলেছো। শুধু বাতাসের কারণে হলে, বাতাস বইলেই ওই শব্দ হতো। তা যখন হয় না, আরও কোনো কারণ নিশ্চয় আছে।

হেসে বললেন প্রফেসর, কি জানি, হয়তো হেনরি ফিগারোই এর জন্যে দায়ী। রাতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয়।

ঢোক গিললো মুসা। আপনিও বলছেন, স্যার? কিশোরও একথা বলেছে।

ভূত বিশ্বাস করো নাকি তুমি, ইয়াং ম্যান? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

না, মাথা নাড়লো কিশোর।

আমিও না, বললেন প্রফেসর। অনেকের ধারণা, বিশেষ করে এখানকার স্প্যানিশদের, দরকারের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে হেনরি ফিগারো। অনেক রিসার্চ করেছি আমি। জোর গলায় বলতে পারবো না যে সে বেরোবে।

রিসার্চ?

উনি ইতিহাসের প্রফেসর, বুঝিয়ে বললেন মিসেস হারভে। সানতা কারলায় বছরখানেক যাবত আছেন, ক্যালিফৈার্নিয়ার ইতিহাস নিয়ে স্পেশাল রিসার্চ করছেন। স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, ওর ধারণা, মোনিং ভ্যালির রহস্য ভেদ করতে পারবেন প্রফেসর।

যদিও এখনও কিছুই করতে পারিনি, স্বীকার করলেন প্রফেসর। হেনরি। ফিগারোর কথা শুনতে চাও? ওর চমকপ্রদ জীবন নিয়ে একটা বই লিখছি আমি।

শোনালে তো খুবই ভালো হয়, স্যার! সামনে ঝুঁকে বসলো রবিন।

আমিও শুনতে চাই, কিশোর বললো।

চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। শোনালেন হেনরি ফিগারোর বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনীঃ

ক্যালিফোর্নিয়ার শুরুতে আজকের এই হারভে র‍্যাঞ্চছিলো র‍্যাঞ্চো ফিগারোর একটা অংশ। স্প্যানিশ সেটলাররা তখন সবে আসতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে। সবার আগে এসেছিলো ফিগারো পরিবার, স্পেনের রাজার কাছ থেকে জমির দখল সত্ত্ব নিয়ে। বিশাল এলাকা জুড়ে বসেছিলো তারা। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে তখন ইংরেজদের ভিড়, দলে দলে এসে উপনিবেশ গড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় স্প্যানিশরা তেমন করে দল বেঁধে আসেনি; আসতো একজন, দুজন করে। ফলে কয়েক পুরুষ ধরে র‍্যাঞ্চো ফিগারোর সীমানার কোনো রদবদল হলো না।

তারপর হঠাৎ করেই পুব থেকে সেটলাররা দলে দলে আসতে শুরু করলো ক্যালিফোর্নিয়ায়। আস্তে আস্তে হাতছাড়া হতে লাগলো ফিগারোদের জমি, জবর দখল হয়ে যেতে লাগলো। মেকসিকো যুদ্ধের পর ক্যালিফোর্নিয়া যোগ হয়ে গেল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। তখন আরও বেশি আমেরিকান সেটলার চলে এলো এই এলাকায়, বিশেষ করে ১৮৪৯ সালের ঐতিহাসিক গোল্ড রাশ-এর পর। ১৯০০ সাল নাগাদ ফিগারোদের প্রায় সমস্ত জমিই হাতছাড়া হয়ে গেল, শুধু ছোট একটা অংশ বাদে, তার মধ্যে পড়লো হারভে র‍্যাঞ্চ আর ওই অভিশপ্ত মোনিং ভ্যালি।

ফিগারোদের শেষ বংশধরের নাম হেনরি ফিগারো। দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, বেপরোয়া এক তরুণ, আমেরিকানদের দুচোখে দেখতে পারতো না। তাদেরকে চোর-ডাকাত মনে করতো। ফিগারোদের টাকার গরমও আর নেই তখন, ক্ষমতাও শেষ। প্রতিশোধের আগুন সব সময় দাউদাউ করে জ্বলতো তরুণ, হেনরির মনে। ভাবতো, যে করেই হোক আবার তার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি নিজের দখলে। আনবে। বেশ কিছু পুরনো স্প্যানিশ আর মেকসিকান পরিবার তখনও ছিলো ক্যালিফোর্নিয়ায়, তাদেরকে দলে টানার চেষ্টা করলো সে.। আমেরিকানদের বিরোধিতা করে হয়ে গেল আউট-ল, পর্বতের গভীরে ঘাঁটি করলো। স্প্যানিশদের কাছে হয়ে গেল এক নতুন রবিন হুড, আর আমেরিকানদের কাছে ডাকাত।

তাকে ধরার জন্যে অনেক চেষ্টা করলো আমেরিকানরা, পারলো না। এই অঞ্চলের পাহাড়-পর্বত সব চেনা হেনরির, কোথায় কখন লুকিয়ে থাকে বুঝতেই পারলো না কেউ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগঃ করের টাকা চুরি, ট্যাক্স কালেকটরদের ভয় দেখিয়ে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়া, আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন অফিসে চড়াও হয়ে তাদের টাকা লুটপাট, স্প্যানিশ-ভাষী ক্যালিফোর্নিয়ানদের সাহায্য করা আর আমেরিকানদের আতঙ্কিত করে রাখা।

তবে, বছর দুই পরে ১৯০৮ সালে সানতা কারলার শেরিফের হাতে ধরা পড়ে গেল সে। বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে আদালতে। বিচারে ফাসীর আদেশ হলো। তার। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। যা-ই হোক, ফাঁসীর দুই দিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল হেনরি। আদালতের ছাতে উঠে, লাফিয়ে পাশের আরেকটা ছাতে গিয়ে পড়লো। সেখান থেকে লাফ দিয়ে নামলো তার বিখ্যাত কালো ঘোড়ার। পিঠে-ঘোড়াটাকে তার জন্যেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো সেখানে।

পালানোর সময় গুলিতে আহত হলো হেনরি। পেছনে তাড়া করে এলো শেরিফ আর তার দলবল। সোজা পর্বতের দিকে ছুটলো হেনরি, মোনিং ভ্যালিতে গিয়ে ঢুকে পড়লো একটা গুহায়। শেরিফের জানামতে যতোগুলো সুড়ঙ্গমুখ ছিলো, ওই গুহা থেকে বেরোনোর, সব বন্ধ করে দেয়া হলো। ভেতরে ঢুকলো না কেউ, কিংবা ঢোকার সাহস করলো না। বাইরে পাহারায় রইলো। শেরিফ মনে করলো, হেনরি আহত, ক্ষতের যন্ত্রণা তো আছেই, তার ওপর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাহিল হয়ে এক সময় না এক সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

দিনের পর দিন বসে রইলো ওরা, হেনরি বেরোলো না। সারাক্ষণ গুহার ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এসেছে ওদের। অবশেষে তার লোকদের গুহায় ঢোকার আদেশ দিলো শেরিফ। নিজেও ঢুকলো। গুহা আর যতোগুলো সুড়ঙ্গ চোখে পড়লো সবগুলোতে খুঁজলো, চার দিন ধরে, হেনরিকে পেলো না। বেরিয়ে এসে আশপাশের এলাকায় তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। না জীবন্ত হেনরি, না তার লাশ, না তার কাপড়-চোপড়। ঘোড়া, পিস্তল, টাকা, কিচ্ছু পেলো না।

এরপর আর কেউ দেখেনি হেনরিকে। কেউ কেউ বলে, তাকে পালাতে সাহায্য করেছিলো তার প্রেমিকা নোরিটা। গোপন সুড়ঙ্গ পথে গুহায় ঢুকে বের করে নিয়ে এসেছিলো আহত মানুষটাকে। দুজনেই পালিয়ে চলে গেছে দক্ষিণ আমেরিকায়। আবার কেউ বলে, তার স্প্যানিশ-ভাষী বন্ধুরা তাকে বের করে এনে। বছরের পর বছর ধরে তাদের র‍্যাঞ্চে লুকিয়ে রেখেছিলো, আজি এখানে কাল ওখানে করে করে।

তবে বেশির ভাগেরই ধারণা, গুহা থেকে বেরোয়নি হেনরি। এমন জায়গায় লুকিয়েছিলো, আমেরিকানরা খুঁজেই পায়নি। তারপর থেকে অনেক বছর পর্যন্ত, ওই এলাকায় কোনো চুরি-ডাকাতি বা খুনখারাপ হলে আর আসামী ধরা না পড়লে সব দোষ চাপিয়ে দেয়া হতো হেনরির ঘাড়ে। অন্ধকার রাতে নাকি তার কালো ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয় সে। যে গুহাটায় থাকতো, সব সময় সেটার ভেতর থেকে শোনা যেতো বিচিত্র গোঙানির আওয়াজ।

তারপর, উপসংহার টানলেন প্রফেসর। হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল, গোঙানি। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে, এখনও নাকি ওই গুহার ভেতরেই রয়েছে হেনরি ফিগারো। তাদের বিশেষ প্রয়োজনের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। এখনও আছে!

কি করে থাকে? রবিনের জিজ্ঞাসা।

দেখো, বললেন প্রফেসর। অনেক রিসার্চ করেছি আমি, অনেক খোঁজখবর করেছি হেনরি ফিগারোর। অনেক কিছু জেনেছি। তার মধ্যে ভুল তথ্যও অনেক আছে। এই যেমন ধরো, ওর যতো পুরনো ছবি আছে, সবগুলোতে দেখা যায়। পিস্তলের খাপ কোমরের ডান দিকে ঝোলানো, অথচ আমি শিওর সে বাইয়া।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। কিংবদন্তীতে অনেক সময়ই ভুল। তথ্য থাকে। বিশেষ করে এধরনের বিখ্যাত মানুষদের সম্পর্কে।

ঠিক বলেছো, তর্জনী নাচালেন প্রফেসর। অফিশিয়াল রেকর্ড বলে, পালানোর দিনই রাতে গুহার ভেতরে মারা গিয়েছে হেনরি। ভালোমতো খুঁটিয়ে পড়েছি আমি সমস্ত রেকর্ড, গবেষণা করেছি। পরিষ্কার বুঝেছি গুলির আঘাত মারাত্মক ছিলো না। তখন তার বয়েস ছিলো আঠারো বছর। কাজেই, এখনও তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়!

.

০৪.

কি বাজে বকছো! প্রায় ফেটে পড়লেন মিস্টার হারভে। তারমানে একশোর কাছাকাছি তার বয়েস। ওরকম বয়সের একজন লোক ওভাবে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় কি করে?

পারে, পারে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন প্রফেসর। শুনলে অবাক হবে, রাশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে, ককেসাস পর্বতমালার উপজাতীয় লোকেরা একশো বছর বয়েসেও ঘোড়ায় চড়ে, লড়াই করে।

তা ঠিক, স্যার,বললো কিশোর।

কিংবা এমনও হতে পারে, বললেন প্রফেসর। হেনরির কোনো বংশধর আছে। ছেলে, কিংবা নাতি। হেনরির ইচ্ছা পূরণ করতে এসেছে।

কিছুটা বিমনা মনে হলো মিস্টার হারভেকে। হ্যাঁ, তা হতে পারে। আমাদের। আগে যারা ছিলো, তারা মোনিং ভ্যালির কাছে যেতো না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি ওখানে একটা কোরাল বানাবো। হয়তো হেনরির ছেলে বা নাতি চায় না গুহার ঐতিহ্য নষ্ট হোক।

হ্যাঁ, এটাই জবাব! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে। রক, মনে আছে, র‍্যাঞ্চের পুরনো কয়েকজন মেকসিকান শ্রমিক বিরক্ত হয়েছিলো? কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। তারা চায়নি; মোনিং ভ্যালিতে কোরাল উঠুক। তারপর থেকেই তো, শুরু হলো গোঙানি।

মনে আছে। ওরাই প্রথম গেছে। কালই দেখা করবো আমি শেরিফের সাথে। হেনরির কোনো বংশধর আছে কিনা খোঁজখবর নিতে বলবো।

একটা ছবি দেখাচ্ছি, পকেট থেকে ছোট একটা ফটোগ্রাফ বের করে দিলেন। প্রফেসর।

হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো ছবিটা। ছিপছিপে এক তরুণের ছবি। কালো চোখের তারায় যেন আগুনের ঝিলিক, গর্বিত মুখ। চওড়া কানা আর উঁচু চূড়ওয়ালা, কালো ভ্যাকুয়েরো সমব্রেরো হ্যাট মাথায়। গায়ে খাটো কালো। জ্যাকেটের নিচে কালো উঁচু কলারের শার্ট, পরনে কালো আঁটো প্যান্ট, নিচের দিকটা ছড়ানো। পায়ে কালো চকচকে পয়েন্টেড বুট। ক্যামেরায় তোলা জীবন্ত হেনরির ছবি নয়, একটা পেইন্টিঙের ফটোগ্রাফ।

সব সময়ই কি কালো পরতো? জানতে চাইলো রবিন।

সব সময়, জবাব দিলেন প্রফেসর। শোকের চিহ্ন। তার পরিবার আর দেশের জন্যে শোক করতো।

চোরের আবার দেশপ্রেম! সাধারণ একটা ডাকাত ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ব্যাটা, ক্ষোভ ঢেকে রাখতে পারলেন না আমেরিকান র‍্যাঞ্চার। বলেই বুঝলেন, কথাটা খারাপ হয়ে গেছে। হেসে সামাল দিলেন। বসে বসে কিচ্ছা শুনলে র‍্যাঞ্চ চলবে না, অনেক কাজ আছে আমার। আজ রাতেই সেগুলো সারতে হবে। ছেলেদের দিকে তাকালেন। তোমরা নিশ্চয় খুব টায়ারড। কাল খাটাবো তোমাদেরকে। মুসার বাবা বলে দিয়েছে, কি করে র‍্যাঞ্চ চালাতে হয় তার ছেলেকে যেন শিখিয়ে দিই।

মোটেই টায়ারড নই আমি, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। তোমরা?

আমিও না, রবিন বললো।

আমিও না, প্রতিধ্বনি করলো যেন মুসা।

সবে তো সন্ধ্যা হয়েছে, বললো কিশোর। আকাশও ভালো। সুন্দর রাত। র‍্যাঞ্চের আশপাশে ঘুরে দেখতে চাই। রাতের বেলা নাকি এখানকার সৈকতে নানা রকম সামুদ্রিক জীব উঠে আসে। দেখার সুযোগ কে ছাড়ে?

রাতের বেলা…, মিসেস হারভে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।

নিশ্চয়ই, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিস্টার হারভে। দেখতে এসেছে, দেখবে। ঘুমিয়ে কাটানোর জন্যে তো নিজের বাড়িই আছে, র‍্যাঞ্চে কেন?

বেশ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন মিসেস হারভে। তবে দশটার বেশি দেরি। করবে না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি আমরা এখানে।

আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ওখানে তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে এলো।

বাইরে বেরিয়েই নির্দেশ দিলো কিশোর, মুসা, গোলাঘর থেকে এক বাণ্ডিল দড়ি নিয়ে এসো। রবিন, তুমি গিয়ে আমাদের চক আর টর্চ আনো। আমি সাইকেলগুলো পরীক্ষা করে দেখি, কোনো গোলমাল আছে কিনা।

গুহায় যাচ্ছি নাকি আমরা? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

হ্যাঁ। গোঙানির রহস্য ভেদ করতে হলে গোঙানি উপত্যকায়ই যেতে হবে।

গুহায় ঢুকবে? শুকনো গলায় বললো মুসা। এই রাতে না গিয়ে দিনে গেলে হতো না?

না। রাতের বেলায়ই গোঙানি শোনা যায়। আর গুহার ভেতরে দিন-রাতের তফাৎ কি? সব সময়ই অন্ধকার, এক রকম। আজ গোঙাতে শুরু করেছে গুহাটা, কাল হয়তো থেমে যাবে। তারপর আবার কয় দিন অপেক্ষা করতে হবে ঠিক আছে? যাও।

কয়েক মিনিট পর সাইকেল চালিয়ে র‍্যাঞ্চের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো তিন কিশোর। মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে দড়ির বাণ্ডিল। সরু একটা কাঁচা রাস্তা ধরে চললো ওরা।

র‍্যাঞ্চটা সাগরের কিনারে বটে, কিন্তু বেরোলেই সাগর চোখে পড়ে না। কয়েক মাইল পর্যন্ত আড়াল করে রেখেছে উপকূলের পাহাড়। চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন পাথুরে পাহাড়ের উঁচু চূড়াগুলো। সবুজ ওক গাছগুলোকে এখন দেখাচ্ছে ফ্যাকাশে শাদা, কেমন যেন। ভূতুড়ে। সাইকেল চালাতে চালাতে ছেলেদের কানে এলো বিচিত্র শব্দ, চারণক্ষেত্রে অস্থির হয়ে উঠেছে গরুর পাল। নাক দিয়ে শব্দ করছে ঘোড়া, চঞ্চল।

হঠাৎ, কোনো রকম জানান না দিয়েই শুরু হলো গোঙানি, ছড়িয়ে পড়লো সারা উপত্যকায়।

চমকে উঠলো রবিন আর মুসা।

 গুড, বললো কিশোর। থামেনি। আজ চলবে মনে হচ্ছে।

নীরবে সাইকেল থেকে নামলো তিনজনে, স্ট্যাণ্ডে তুললো। উঁচু শৈলশিরায় উঠে তাকালো চন্দ্রালোকিত উপত্যকার ওধারে হেনরি ফিগারোর কালো গুহামুখের দিকে।

কিশোর, বলে উঠলো রবিন। কি যেন নড়ছে!

আমি খুটখাট শুনছি, মুসা বললো।

হ্যাঁ, মাথা দোলালো কিশোর। আসলে কল্পনা করছে। এরকম জায়গায় এই পরিবেশে স্বাভাবিক জিনিসকেও অস্বাভাবিক লাগাটা স্বাভাবিক, শুরু হলো তার লেকচার। অতি সাধারণ জিনিসও চমকে দেবে। আতঙ্কিত করে তুলবে। ওসব আলোচনা এখন থাক। রবিন, টর্চগুলো আরেকবার পরীক্ষা করো।

পরীক্ষা করলো রবিন। দড়ির বাণ্ডিলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁধে ঝোলালো মুসা। যার যার চক নিয়ে পকেটে ভরলো। কিশোরের শাদা চক, মুসার নীল, রবিনের সবুজ।

এসব এলাকার পুরনো গুহাগুলো খুব বিপজ্জনক, বললো কিশোর। সুড়ঙ্গের কোথায় যে চোরাখাদ লুকিয়ে থাকে বোঝা মুশকিল। পা ফেলেছে কি ধপাস, এক্কেবারে তলায়। দড়ি ছাড়া তোলা প্রায় অসম্ভব। সেজন্যেই দড়ি নিয়েছি।

চক দিয়ে চিহ্ন আঁকতে আঁকতে যাবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

নিশ্চয়।

 চলো। গেলে আর দেরি করে লাভ নেই।

হ্যাঁ, চলো।

ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো ওরা, উপত্যকায়।

আবার সেই অদ্ভুত গোঙানি ঢেউ তুললো যেন রাতের শান্ত নীরবতায়।

গুহার কাছাকাছি চলে এলো ওরা। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে। লাগলো। হাঁ করে থাকা কালো সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে টর্চ জ্বাললো কিশোর, ঠিক এই সময় কানে এলো চাপা শব্দ।

কিসের? চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।

বাড়ছে শব্দটা, জোরালো হচ্ছে। উপত্যকার চারপাশেই ঘিরে আছে পাহাড়, সেগুলোতে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুললো। ফলে বোঝা গেল না ঠিক কোনখান থেকে আসছে। মনে হচ্ছে, চার পাশ থেকেই হচ্ছে শব্দ।

ওই দেখো! ওপর দিকে হাত তুলে জোরে চিৎকার করে উঠলো মুলা।

ডেভিল মাউনটেইনের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে বিশাল এক পাথর, ওটার ধাক্কায় ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরতে আরম্ভ করেছে অসংখ্য ছোট পাথর।

সরো! আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

পাথরটা ওদের ওপরই পড়বে মনে হচ্ছে। এক লাফে পাশে সরে গেল রবিন।

কিশোর দাঁড়িয়েই রইলো, যেন জমে গেছে। চেয়ে রয়েছে পাথরটার দিকে। তার ওপরেই এসে পড়বে।

.

০৫.

ঝাঁপ দিলো মুসা। কিশোরকে নিয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ধুড়ুম করে পড়লো। পাথরটা। গুহামুখের কাছ থেকে সরতে আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই ভর্তা হয়ে যেতো গোয়েন্দাপ্রধান।

এই, এই তোমাদের কিছু হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

না, আমার কিছু হয়নি, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দিলো মুসা। কিশোর?

খুব ধীরে ধীরে উঠলো কিশোর। কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়লো। চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এ-জগতে নেই সে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম বিড়বিড় করে বললো। হয় এরকম। আশ্চর্য এক মানসিক প্রতিক্রিয়া। সাময়িক ভাবে পঙ্গু করে দেয় শরীরকে। শিকার ধরার আগে ছোট ছোট জানোয়ারকে এভাবেই সম্মোহিত করে ফেলে বিশাল সাপ…

আরে ধ্যাত্তোর! রাখো তোমার লেকচার! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা। বলি, ঠিকঠাক আছে? না ভেঙেছে কিছু?

ফিরেও তাকালো না কিশোর। চাঁদের আলোয় আলোকিত ডেভিল মাউনটেইনের ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে, চোখে পলক পড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে অনেক আলগা পাথর আছে ওখানে, আনমনে বললো সে। পাহাড়ের ঢালও খটখটে শুকনো। এখানে ওভাবে পাথর গড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। বহু জায়গার পাথরই বোধহয় আলগা করে দিয়েছে নেভির কামান।

তিনজনেই এগোলো বিশাল পাথরটার দিকে। সুড়ঙ্গমুখের কয়েক গজ দূরে। মাটিতে বসে গেছে।

দেখো, দাগ; পাথরটা দেখিয়ে বললো রবিন। কিশোর, কেউ ঠেলে ফেলেনি তো?

কিছু দাগ আছে, ভালোমতো পাথরটা দেখে সোজা হলো কিশোর। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

পড়ার সময় ঘষা খেয়েছে, মুসা বললো। দাগ তো হবেই।

ওপরে কিন্তু কাউকে দেখিনি আমরা, বললো রবিন।  

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দেখিনি। দেখা দিতে চায়নি বলেই হয়তো। দেখিনি।

ফিরে গিয়ে দেখবো নাকি আবার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

না। আরও সাবধান থাকতে হবে আমাদের। গুহার ভেতরে অবশ্য সে-ভয় নেই। অন্তত মাথার ওপর পাথর খসে পড়বে না।

গুহায় ঢুকলো তিনজনে। কিশোর আগে আগে রয়েছে। দেয়ালে আশ্চর্যবোধক আর একটা তীর চিহ্ন আঁকলো রবিন। সুড়ঙ্গমুখের কাছেই।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, লম্বা অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ সোজা ঢুকে গেছে। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে। মসৃণ দেয়াল। ছাত মুসার মাথার চেয়ে সামান্য উঁচুতে। কিশোর আর রবিন তার চেয়ে বেঁটে, ফলে হাঁটতে অসুবিধে হলো না কারোই।

চল্লিশ ফুট মতো সোজা এগিয়ে গেল পথটা। শেষ মাথায় বিরাট এক গুহা।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে দেখলো ছেলেরা। যেমন বড় ঘর, তেমনি উঁচু তার ছাত। আবছা দেখা যাচ্ছে ওপাশের দেয়াল।

আরিব্বাবা! বললো রবিন। এতো বড় গুহা আর দেখিনি। কেমন যেন শূন্য, দূরাগত শোনালো তার কথাগুলো।

হাল্লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।

হাল্লো.. হাল্লো…হাল্লো-ও-ও-ও-ও-ও! প্রতিধ্বনি হলো।

হেসে উঠলো মুসা। রবিনও। মজা পেয়ে দুজনেই হাল্লো হাল্লো শুরু করলো। গুহাটাও যেন রসিকতা শুরু করলো তাদের সঙ্গে।

কিশোর ওদের সঙ্গে যোগ দিলো না। টর্চের আলোয় গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছে। ডাকলো, এই, দেখে যাও।

ওদের বায়ে, দেয়ালে কালো একটা ছোট ফোকর। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ। ওরকম আরও অনেকগুলো ফোকর দেখতে পেলো ওরা। কমপক্ষে দশটা সুড়ঙ্গ ঢুকেছে গিয়ে পর্বতের ভেতরে।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কোনটা দিয়ে যাবো?

 সব কটা ফোকরই প্রায় একরকম। মুসার সমান উঁচু, চার ফুট চওড়া।

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। মনে হচ্ছে সারা পর্বতের তলায়ই ছড়িয়ে আছে সুড়ঙ্গ।

এ-জন্যেই বোধহয় ফিগারোকে খুঁজে পায়নি শেরিফ। এতো সুড়ঙ্গ, কয়টাতে খুঁজবে? ওরা একদিকে গেলে ফিগারো আরেক দিকে সরে গেছে। লুকিয়ে থেকেছে।

হতে পারে।

 এই গুহা আর সুড়ঙ্গ তৈরি হলো কিভাবে? অবাক হয়ে দেখছে মুসা।

পানি, বললো রবিন। বইয়ে পড়েছি। নানারকম পাথর দিয়ে তৈরি হয় এসব পর্বত। কিছু পাথর শক্ত, কিছু নরম। পানিতে ক্ষয় হয়ে, কিংবা গলে গিয়ে ধুয়ে চলে যায় নরম পাথরগুলো, শক্তগুলো থেকে যায়। ফাঁকগুলোতে তৈরি হয়েছে সুড়ঙ্গ। কোটি কোটি বছর লেগেছে এসব হতে। অনেক অনেক আগে এই এলাকার বেশির ভাগ অঞ্চলই পানির তলায় ছিলো।

তবে সব সুড়ঙ্গই যে প্রাকৃতিক, কিশোর বললো। তা নয়। মানুষেও বানিয়েছে কিছু। হয়তো হেনরি ফিগারোর লোকেরা।

কিংবা মাইনাররা। সোনার লোভে খুঁড়েছে।

এক ফোকর থেকে আরেক ফোকরে আলো সরাচ্ছে মুসা। কোনটা থেকে শুরু করবো?

সবগুলো দেখতে হলে তো কয়েক মাস লেগে যাবে।

কাজেই সবগুলোতে দেখা যাবে না, বললো কিশোর। শুধু যেটা থেকে গোঙানি আসে সেটায়। প্রত্যেকটা ফোকরের কাছে গিয়ে কান পাতবো। যেটা থেকে শোনা যাবে…

কিশোর! বাধা দিলো রবিন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি? গুহায় ঢোকার পর থেকে আর শুনছি না!

স্থির দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলো তিনজনে। রবিন ঠিকই বলেছে। কবরের নীরবতা গুহার মধ্যে। কোনো শব্দ নেই।

এর মানে কি? মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি।

এর পর আরও দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। গোঙানি শোনা গেল না।

পাথর পড়ার পর থেকেই আর আওয়াজটা শুনিনি, রবিন বললো।

হ্যাঁ, বললো কিশোর। এতো বেশি উত্তেজিত ছিলাম, খেয়ালই করিনি কখন থেমে গেছে।

কি করবো এখন? মুসার প্রশ্ন।

শুরু হতে পারে আবার, আশা করলো কিশোর। মিস্টার হারভে বলেছেন আওয়াজটা অনিয়মিত, নির্দিষ্ট সময় পর পর শুরু হয় না। না হোক, ইতিমধ্যে যে কটা সুড়ঙ্গ পারি দেখে ফেলি আমরা। ১৭৬

মুসা আর রবিন রাজি। এই দুঃসহ অন্ধকারে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে যা-ই হোক কিছু একটা করা ভালো। একটা সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে চক দিয়ে দেয়ালে চিহ্ন এঁকে দিলো রবিন।

সাবধানে এগোলো ওরা। অন্ধকারের কালো চাদর ফুঁড়ে বেরোচ্ছে যৈন টর্চের আলো। তিরিশ ফুট মতো এগিয়েই শেষ হয়ে গেল সুড়ঙ্গটা। সামনে দেয়াল নয়, পাথর পড়ে বন্ধ হয়েছে।

গুহায় ফিরে এলো ওরা।

পাশাপাশি চারটে সুড়ঙ্গে ঢুকে দেখলো। ঢোকার আগে অবশ্যই মুখের কাছে চক দিয়ে চিহ্ন এঁকে রাখলো। কোনোটা দিয়েই বেশি দূরে এগোতে পারলো না। পাথর পড়ে পথ বন্ধ।

অযথা সময় নষ্ট করছি, অবশেষে বললো কিশোর। এক কাজ করা যাক। তিনজনে একসঙ্গে না ঢুকে আলাদা আলাদা সুড়ঙ্গে ঢুকি। তাতে সময় বাঁচবে, দেখাও হবে বেশি। ভোলা সুড়ঙ্গ যে-ই দেখতে পাবো, ফিরে এসে অপেক্ষা করবো। এখানে অন্য দুজনের জন্যে।

তিনজনে ঢুকে পড়লো তিনটে সুড়ঙ্গে।

কিশোর যেটাতে ঢুকলো, শুরুতে সেটা প্রাকৃতিকই মনে হলো। অল্প কিছু দূর। পর্যন্ত তারপর চোখে পড়লো কড়ি-বরগা আর থাম। মাইন শ্যাফট। খনির কাজে খোঁড়া হয়েছিলো। সাবধানে এগিয়ে গেল আরও কয়েক গজ।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। সামনে বন্ধ। পাথরের স্তূপ। পড়ে থাকা একটা পাথর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার। এখানকার অন্যান্য পাথরের চেয়ে আলাদা। তুলে নিয়ে ওটা পকেটে রেখে দিলো, পরে ভালোমতো দেখার জন্যে।

এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। কিশোর! রবিন! জলদি এসো!

.

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে রবিন তখন আরেকটা গুহায় ঢুকেছে। এটাও প্রথম গুহাটার মতোই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। এটাতেও প্রথমটার মতোই অসংখ্য সুড়ঙ্গমুখ। ফেরার জন্যে সবে ঘুরেছে, এই সময় কানে এলো মুসার চিৎকার। দিলো দৌড়।

কিশোরও দৌড় দিয়েছে। আচমকা অন্ধকার থেকে কি যেন একটা এসে পড়লো তার ওপর। চিত হয়ে পাথুরে মেঝেতে পড়ে গেল সে। তার গলায় খামচি মারার চেষ্টা করলো কয়েকটা আঙুল।

বাঁচাও! বাঁচাও! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলো একটা কণ্ঠ।

রবিন! আরে আমি, কিশোর।

ঢিল হলো আঙুলগুলো। একে অন্যের ওপর টর্চের আলো ফেললো ওরা।

আমি ভাবছিলাম, কিসের গায়ে জানি পড়লাম! বললো রবিন।

আমিও তাই ভেবেছি। মুসার চিৎকারে চমকে গিয়ে…চলো, চলো।

মুসা যে-সুড়ঙ্গে ঢুকেছে সেটাতে ঢুকলো দুজনে। এ-পর্যন্ত যে-কটাতে ঢুকেছে ওরা, সবগুলোর চেয়ে এটা লম্বা মনে হলো। সামনে টর্চের আলো নাচছে। মুসার হাতে।

এই যে, আমি এখানে, ডাকলো সে।

আরেকটা বড় গুহায় এসে ঢুকলো কিশোর আর রবিন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। চেহারা ফ্যাকাশে। টর্চের আলো ফেলেছে বা দেয়ালে।

ওখানে…ওখানে কি যেন দেখলাম! কালো! চকচকে!

 রবিন আর কিশোর আলো ফেললো। কিছুই দেখলো না।

আমি শিওর দেখেছি, জোর দিয়ে বললো মুসা। ঢুকে প্রথমে আওয়াজ শুনলাম। লাইট ফেলে দেখি..ওটা! ওই দেয়ালের কাছে। বিরাট। হাত থেকে টর্চ পড়ে গিয়েছিলো আমার। আবার তুলে আলো ফেলে দেখলাম, নেই!

সন্দেহ জাগলো রবিনের। কল্পনা করেছে। বেশি নার্ভাস হলে হয় এরকম। আলাদা হওয়া উচিত হয়নি আমাদের।

দেয়ালটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। নিচু হয়ে কি দেখলো। মুসা ভুল দেখেনি, রবিন। দেখে যাও।

দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন আর মুসা। পাথুরে মেঝেতে বড় বড় দুটো দাগ। পায়ের ছাপ। টর্চের আলোয় চকচক করছে।

কি…, কেঁপে গেল রবিনের গলা। কি ওগুলো, কিশোর?

 ভেজা ভেজা লাগছে, জবাব দিলো কিশোর। পানি।

খাইছে! জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজালো মুসা।

সমস্ত মেঝেটায় আলো ফেলে ফেলে দেখলো কিশোর। আর ছাপ নেই। ছাতে আলো ফেললো। খটখটে শুকনো।

পানির চিহ্নও তো দেখছি না। এলো কোত্থেকে? বললো সে। মুসা ঠিকই বলেছে। কিছু একটা দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানে। ভেজা ছাপ রেখে গেছে।

এতো বড়? রবিন বললো। দু-তিন ফুটের কম লম্বা হবে না।

বড়, ভেজা, চকচকে। দেখে মনে হয়…

দানবের! কিশোরকে কথা শেষ করতে দিলো না মুসা।

বুড়ো মানুষটা! বললো রবিন।

পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা। চোখে অস্বস্তি। দানবে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাহলে ছাপগুলো কার?

তীব্র আলো এসে পড়লো তিনজনের গায়ে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন ওরা।

আলোর পেছনে থেকে শোনা গেল খসখসে কণ্ঠ, কি, হচ্ছে কি এখানে?

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো একটা মূর্তি। সামান্য কুঁজো, বাঁকা পিঠ। শাদা। ধবধবে লম্বা চুল-দাড়ি, উসকো-খুসকো, বহুদিন ওগুলোতে চিরুনি কিংবা নাপিতের কাঁচি লাগেনি।

হাতে লম্বা নলওয়ালা পুরনো আমলের রাইফেল।

<

Super User