০৬.
রাত আটটার সামান্য পরে জিনাকে নিয়ে পিজ্জা কোভে ঢুকল মুসা। একটা টেবিলে বসে থাকতে দেখল রিকি আর লীলাকে।
রিকিকে অমন লাগছে কেন? মুসার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল জিনা।
কেমন?
বুঝতে পারছ না?
না
ঠিক বোঝাতে পারব না। মোটকথা, অন্য রকম।
পিজ্জা হাউসটায় খুব ভিড়। প্রায় সবই ওদের বয়েসী ছেলেমেয়ে। গুতোগুতি করে টেবিলে জায়গা করে নিচ্ছে। হই-হল্লা করছে।
মুসাদের দেখেই আড়ষ্ট হয়ে গেল রিকি। বোধহয় আগেই লীলাকে কিছু বলে রেখেছে, লীলাই ওদের সঙ্গে পরিচয় করে নিল, হাই, আমি লাইলাক। রিকির নতুন বন্ধু। অতএব তোমাদেরও। লীলা বলে ডাকবে।
কিন্তু নতুন বন্ধুটিকে পছন্দ করতে পারল না জিনা। লীলার বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মিলিয়ে শুকনো গলায় বলল, হাই।
মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রিকি, পিজ্জার অর্ডার দিয়ে রেখেছি।
তোমরাও কি রকি বীচ থেকে? লীলা জানতে চাইল।
হ্যাঁ, জবাব দিল মুসা।
জিনা তাকিয়ে আছে লীলার নখের দিকে। লম্বা, নিখুঁত। সুন্দর করে নেল পালিশ লাগানো। লিপস্টিকের মত একই রঙের। রিকির দিকে কাত হয়ে বসেছে সে।
রিকির এই পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেছে জিনা। মেয়েটার বেহায়াপনা সহ্য করছে কি করে রিকি?
ধাতব ট্রে তে করে গরম গরম পিজ্জা এল। ধোয়া উড়ছে। কেটে নিয়ে আসা হয়েছে। হাত বাড়িয়ে একটা করে টুকরো তুলে নিল মুসা, জিনা আর রিকি।
লীলা নিল না। তাকালই না প্লেটের দিকে। কৈফিয়ত দিল, পেট ভরে ডিনার খেয়ে এসেছি। একটা কণাও আর ঢোকানোর জায়গা নেই।
আরে একটু নাও না, অনুরোধ করল রিকি।
উঁহু, পারব না। খাও তোমরা।
খাবার দেখে হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেছে লীলা, লক্ষ করল মুসা। চোখে। ক্ষুধার্ত মানুষের দৃষ্টি। তাহলে নিচ্ছে না কেন?
জিনাও তাকিয়ে আছে লীলার চোখের দিকে। দরজার দিকে তাকিয়ে বড় বড় হয়ে যেতে দেখল ওর বাদামী চোখ।
ফিরে তাকাল জিনা। জনকে ঢুকতে দেখে তার চোখও স্থির হয়ে গেল ওর ওপর।
চোখে চোখ পড়তে হাসল জন।
মুসার গায়ে কনুই দিয়ে তো দিল জিনা। ওর সঙ্গেই কাল রাতে দেখা হয়েছিল আমার।
মুখ ভর্তি পিজ্জা চিবাতে চিবাতে ফিরে তাকাল মুসা। ও। একনজর দেখল জনকে। তারপর আবার খাবারে মন দিল।
ওদের দিকে এগিয়ে এল জন।
পরিচয় করিয়ে দিল জিনা, ও জন গুড় ওয়াকার। কাল রাতে পরিচয়।…জন, ও আমার বন্ধু মুসা। ও রিকি। আর ও লীলা, রিকির নতুন বন্ধু।
হাত মেলাল জন। একটা চেয়ারে বসল।
ট্রেটা ওর দিকে ঠেলে দিল মুসা, পিজ্জা নাও।
নো, থ্যাংকস, চেয়ারে হেলান দিল জন। এইমাত্র খেয়ে এলাম। তাকালই না খাবারের দিকে। জিনাকে জিজ্ঞেস করল, সৈকতের ধারে হাঁটতে যাবে না আজ?
জনের দিকে তাকাল জিনা। আটকে রইল চোখ। কেমন সম্মোহনী দৃষ্টি জনের চোখে। জোর করে নজর সরাতে হলো জিনাকে। মুসার দিকে তাকাল, মুসা, কি করবে?
আমি? সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যেন মুসা। তোমার কি ইচ্ছে?
হাঁটতে যেতেই ইচ্ছে করছে।
আমারও, লীলা বলল। রিকির সঙ্গে। রিকির বাহুতে হাত রাখল লীলা, রিকি, কি বলো?
ঘাড় কাত করল রিকি, ভালই হয়।
ভিডিও গেম খেলতে যাবে না?
বদ্ধ জায়গায় ঢুকতে ইচ্ছে করছে না আর আমার। হট্টগোল, মনিটরের স্ক্রীনের আলো…নাহ্! তারচেয়ে সৈকতের খোলা হাওয়া, অন্ধকারে হেঁটে বেড়ানো অনেক ভাল।
জিনার দিকে তাকাল মুসা।
মাথা নাড়ল জিনা, উঁহু, আমিও যাচ্ছি না ওই আর্কেডে। সিনেমাও ভাল লাগবে না। তারচেয়ে সাগরের খোলা হাওয়াই ভাল।
হঠাৎই আবিষ্কার করল মুসা, এখানে বড় একা হয়ে গেছে সে। ধীরে ধীরে বলল, ঠিক আছে, যাও তোমরা। দেখি, আমি বরং টনিকে খুঁজে বের করিগে। ভিডিও-গেম খেলব। ওকে না পেলে সিনেমা দেখতে যাব। একাই যাব।
দ্রুত খাওয়া শেষ করল রিকি। বেরোনোর জন্যে যেন আর তর সইছে না। ওর অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারল না মুসা। তবে বদলে যে গেছে, এ ব্যাপারে জিনার সঙ্গে এখন সে-ও একমত।
প্রায় অপরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে জিনার যাওয়াটা পছন্দ হচ্ছে না তার। কিন্তু কি করবে? যার সঙ্গে খুশি বেরোতে পারে জিনা, তাকে বাধা দেয়ার কোন অধিকার তার নেই। বাধা দিলে জিনাই বা শুনবে কেন?
খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল রিকি। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, বিল আমি দিয়ে যাচ্ছি। তুমি শেষ করেই বেরোও। জিনার দিকে ফিরল, তোমার হয়েছে?
হ্যাঁ, চলো। পেপার ন্যাপকিনে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল জিনা।
বেরিয়ে গেল চারজনে।
দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তিত ভঙ্গিতে পিজ্জা চিবাতে লাগল মুসা। কিশোর আর রবিনের অভাবটা তীব্রভাবে বোধ করল আরেকবার। দূর, একা একা কোথাও বেড়াতে বেরিয়ে আনন্দ নেই। স্যান্ডি হোলোর মত এত চমৎকার জায়গাতেও না। একমাত্র ভরসা এখন টনি। ওকে খুঁজে বের করতে না পারলে সন্ধ্যাটাই মাটি হবে।
.
০৭.
দুদিন পর। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে, হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। উঠে এসে দাঁড়াল বেডরূমের জানালার সামনে। বাইরের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করতে লাগল। পরিষ্কার আকাশ। গাছের মাথার ওপরে উঠে গেছে সূর্য। ঘরটা গরম, আঠা আঠা লাগছে।
আবার হাই তুলতে তুলতে ড্রেসারের দিকে এগোল সে। ড্রেসারের গায়ে ধাক্কা লাগল। ঘুম যায়নি এখনও। ড্রয়ার ঘেঁটে বের করল বেদিং স্যুট। টেনেটুনে পরে নিল কোনমতে।
দুপদাপ করে নেমে এল রান্নাঘরে। কাউন্টারে রাখা চাপা দেয়া এক টুকরো কাগজ দেখতে পেল। বাবা লিখে রেখে গেছেন। মাকে নিয়ে চলে গেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে। দূরে কোথাও মাছ ধরতে যাবেন সকলে মিলে। ইস, আফসোস করতে লাগল মুসা। জানলে সে-ও যেতে পারত সঙ্গে। এখানে আর কোন আকর্ষণ বোধ করছে না। রিকি যেন কেমন হয়ে গেছে। জিনার সঙ্গেও জমছে না।
গতরাতে কখন ফিরেছিল? মনে করতে পারল না মুসা। বাড়ি ঢুকে ঘড়ি দেখেনি। সিনেমা দেখে, টনি আর আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিল কার্নিভলে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে তখন। মাঠ অন্ধকার।
মাঝরাতের পরই হবে, এটা ঠিক। কারণ নাইট শো দেখেছে। তার সঙ্গে জিনা আর রিকিকে না দেখে প্রশ্ন চেপে রাখতে পারেনি টনি। জিনার কি হয়েছ, বলো তো?
কি জানি! কেন? জানতে চেয়েছে মুসা।
অন্য একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা। আমাদের চেয়ে বয়েস বেশি। এ শহরের লোক নয়। আর রিকি ঘোরে একটা মেয়ের সঙ্গে। তাকেও এ শহরের ছেলেমেয়েরা কেউ কখনও দেখেনি। ঘটনাটা কি, বলো তো?
কি জানি! যার যেখানে ইচ্ছে ঘুরুক। আমি কি ওদের গাজেন নাকি?
না, তা বলছি না। তবু…
দেখো, এ শহরের লোক নয় বলেই সন্দেহ করতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আমিও তো এখানকার লোক নই। টুরিস্ট সীজন। অপরিচিত লোক আসবেই।
আলোচনাটা আর এগোতে দেয়নি মুসা। ওখানেই চাপা দিয়েছে।
জিনার কথা ভাবতেই মনে হলো ফোন করে। দিনের বেলায়ও কি জনের সঙ্গে বেরোবে ও? কে জানে। ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। ঢকঢক করে গিলে ফেলল এক গ্লাস কমলার রস। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গলায় আটকে গেল। ব্যথা লাগল। শুকিয়ে আছে কণ্ঠনালী।
জিনাদের নম্বরে ডায়াল করল সে।
তিন-চার বার রিঙ হওয়ার পর তুলে নিলেন জিনার আম্মা। হালো?
আন্টি? আমি মুসা। জিনা কোথায়?
ঘুমোচ্ছে।
এত বেলায়? ও তো সকাল সকালই উঠে পড়ে।
কি জানি, বুঝলাম না। ঘণ্টাখানেক গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে এসেছি। ঘুমই ভাঙে না। বলল, শরীর খারাপ লাগছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। এ রকম তো কখনও হয় না।
হু! কাল রাতে কখন ফিরেছে, জনের সঙ্গে কতক্ষণ ছিল জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল মুসার। করল না। বলল, ঘুম ভাঙলে বলবেন সৈকতে যেতে। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি।
লাইন কেটে দিল সে। ঘাড়ের পেছনটা চুলকাল। রান্নাঘরের মধ্যে আরও গরম। ভারী, ভেজা ভেজা বাতাস।
বেজায় গরম তো আজকে। ঘরে কিংবা বাগানে না থেকে সৈকতে যাওয়াই ভাল।
রিকিকে ফোন করল। সবে উঠেছে সে। ওকে বলল সৈকতে চলে যেতে। সঙ্গে বুগি বোর্ড নিয়ো। সাগরের অবস্থা জানি না এখনও। ঢেউ থাকলে সার্ফিং জমবে আজ।
সৈকতে এসে দেখল ইতিমধ্যেই ভিড় জমিয়েছে সকালের সাঁতারুরা। ডোবাডুবি করছে, নীলচে সবুজ ছোট ঢেউ কেটে সাঁতরে যাচ্ছে এদিক ওদিক। হলুদ আর সাদা ডোরাকাটা একটা বড় ছাতার নিচে তোয়ালে বিছিয়ে শুয়ে আছে রিকি।
আই, রিকি, বলে এগিয়ে গেল মুসা।
কি খবর? ঘুমজড়িত কণ্ঠে জানতে চাইল রিকি।
বুগি বোর্ড আনোনি?
আস্তে মাথা তুলে তাকাল রিকি, ভুলে গেছি।
অধৈর্য ভঙ্গিতে নিজের বোর্ডটা হাত থেকে ছেড়ে দিল মুসা। বসে পড়ল বালিতে। পিঠে রোদ লাগছে। কাল রাতে কি করেছ? মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ, হাই তুলল রিকি। লীলার সঙ্গে শহরে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘোরার পর সৈকতেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজি হইনি। এত ক্লান্ত লাগছিল, সোজা বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়েছি।
ওঠো, সাঁতার কাটলেই শরীরের জড়তা চলে যাবে।
সাড়া দিল না রিকি।
অ্যাই, রিকি, চুপ করে আছ কেন?
নীরবতা।
রিকি?
মুখের ওপর ঝুঁকে ভালমত দেখে মুসা বুঝল, রিকি ঘুমিয়ে পড়েছে।
হয়েছে কি ওর? অবাক হলো মুসা। সারারাত ঘুমিয়ে সকালে সৈকতে আসতে না আসতে ঘুমিয়ে পড়ল আবার, এই হট্টগোল আর রোদের মধ্যে!
ঘুমের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিকি। গড়িয়ে গিয়ে চিত হলো।
আরও একটা ব্যাপার অবাক লাগল মুসার। কোন্ ধরনের সানট্যান ব্যবহার করে রিকি? রোদে পুড়ে চামড়া তো বাদামী হবার কথা। তা না হয়ে হচ্ছে ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য।
*
সেদিন অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লীলার দেহে। সৈকতে এসেছে খাবারের নেশায়। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে। কিন্তু কোন হোটেলে গিয়ে কিছু খেতে পারবে না। একটা জিনিস দিয়েই খিদে মেটাতে হবে।
রক্ত!
মানুষের রক্ত!
শুরু যখন করেছে, শেষ না করে উপায় নেই।
অন্যান্য রাতের মত আজও সেই উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছে। শিকার ঠিকই করা আছে। গত কয় রাত তার রক্ত পান করেই কাটিয়েছে। আজও করবে। তবে আজ শেষ। এক শিকারে বেশিদিন চালানো যায় না। বড় জোর তিন কি চারবার রক্ত পান করা যায়। এর বেশি করতে গেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিকার। মেরে ফেললে পুলিশ আসবে। তদন্ত হবে। ঘাবড়ে যাবে লোকে। রাতে আর সৈকতে বেরোতে চাইবে না। শিকার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই রিকিকে একেবারে মেরে ফেলতে চায় না সে। শেষবারের মত তার রক্ত খাবে আজ।
রিকির আসার অপেক্ষাই করছে লীলা।
আসতে দেখা গেল ওকে। হাত নেড়ে ডাকল লীলা।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে অনেকটা বুড়ো মানুষের মত ঝুঁকে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসতে লাগল রিকি।
হাঁটতে শুরু করল লীলা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল নৌকা রাখার ডকটার দিকে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। পেছনের পানিতে ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে তিনটা নৌকা। গায়ে গায়ে ঘষা খেয়ে মৃদু শব্দ তুলছে।
লীলা, কোথায় তুমি? ক্লান্তস্বরে ডাকল রিকি।
এই যে এখানে। এসো।
রিকি আরও কাছে আসতে হাত ধরে তাকে ছায়ায় টেনে নিল লীলা। গলার। শিরাটার দিকে তাকাল। দপদপ করে লাফাচ্ছে। ওটার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঘন তরল পদার্থ চুমুক দিয়ে পান করার ইচ্ছেটা পাগল করে তুলল ওকে। প্রথম প্রথম ভাল লাগত না। ঘেন্না লাগত। ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন তো বরং ভালই লাগে। নেশা হয়ে গেছে। বাঘের যেমন হয়ে যায়। আফ্রিকার মাসাইদের যেমন হয়। জ্যান্ত গুরুর শিরা ফুটো করে চুমুক দিয়ে রক্ত পান। করে ওরা।
স্থির দৃষ্টিতে রিকির শিরাটার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল লীলা, রিকি, আজ কি করতে চাও?
সৈকতেই বসে থাকব। শহর ঘোরার কিংবা সাঁতার কাটার শক্তি নেই। কেন যেন বল পাচ্ছি না শরীরে। মাথাটাও থেকে থেকে ঘুরছে।
ধপ করে বসে পড়ল রিকি।
ওর পাশে বসল লীলা। কাঁধে হাত রাখল।
মুখ তুলে তাকাল রিকি। মলিন হাসি হাসল।
জবাবে লীলাও হাসল।
মাথার ওপর কিচকিচ করে উঠল একটা বাদুড়।
তাকাল না রিকি। চেয়ে আছে লীলার মুখের দিকে।
ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো লীলার। ঝকঝক করছে সাদা দাঁত। দুই কোণের দুটো দাঁত অস্বাভাবিক বড়। দন্ত। নেকড়ের দাঁতের মত।
এই প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ করল রিকি। শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।
কিন্তু কিছু করার নেই তার। গায়ে বল নেই। উঠে দৌড় দেয়ার ক্ষমতা নেই। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে লীলার মুখের দিকে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল মুখটা। চেপে বসল রিকির গলার শিরাটার ওপর।
কুট করে সুচ ফোঁটার ব্যথা অনুভব করল রিকি।
শেষ মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল লীলার মুখটাকে।
পারল না। অসহায়ের মত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।
চোখের সামনে দুলে উঠল আঁধারের পর্দা।
পেটের খিদেয় পাগলের মত চুষেই চলল লীলা। তার গায়ের ওপর ঢলে পড়ল রিকি। তারপরেও ছাড়ল না লীলা। টনক নড়ল, যখন আর রক্ত বেরোল না। শিরা দিয়ে বেরিয়ে এল শুধু পানির মত রস।
মুখ সরাল লীলা।
রিকির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। চাপা, গোঙানি বেরোল হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ দিয়ে। এক ফোঁটা রক্ত রাখেনি রিকির শরীরে। খেতে খেতে মেরেই ফেলেছে।
খুন!
*
ছোট্ট দ্বীপ। গাছের মাথায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে অসংখ্য বাদুড়। ছাই রঙ আকাশে বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করে ইতিউতি উড়ে বেড়াচ্ছে। নিচে খুদে সৈকতের ধারে কাঠের তৈরি কতগুলো পরিত্যক্ত কুঁড়ে। মানুষ বাসের নিদর্শন। তবে এখন আর থাকে না কেউ। চলে গেছে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের আর কোন উপায় নেই। হয়তো এ বাধ্যবাধকতার কারণেই দ্বীপটা ছেড়ে গেছে মানুষ। তারপর থেকেই এটা বাদুড়ের দখলে।
জঙ্গলের মধ্যে দ্বীপের অন্ধকার একটা ঘরে অপেক্ষা করছে জন। পুব দিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা কফিন। জানালার চৌকাঠে ভর দিয়ে চন্দ্রালোকিত আকাশে বাদুড়ের ওড়া দেখছে।
শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। মুখে মৃদু হাসি। উড়ে বেড়ানো বাদুড়ের আনন্দ যেন তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।
আবহাওয়া বেশ গরম। দুঃখের বিষয়, এ রকম থাকে না সব সময়। গ্রীষ্মকালটা যেন চোখের পলকে শেষ হয়ে যায় এই অঞ্চলে। আরও দীর্ঘ হলে সুবিধে হত। শিকার পাওয়া যেত অনেক বেশি। আরও দ্রুত কাজ শেষ হয়ে যেত ওদের।
সাগরের দিক থেকে আসতে দেখা গেল লীলাকে। ঘরে ঢুকল। ঠোঁটে রক্ত শুকিয়ে আছে। মলিন মুখে, ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।
কি ব্যাপার, লীলা? জানতে চাইল জন।
খবর ভাল না, জন, ধপ করে কফিনটার ওপর বসে পড়ল লীলা।
কি হয়েছে?
রিকিকে খুন করে ফেলেছি।
চমকে গেল জন। বলো কি!
হ্যাঁ। রক্ত খেতে গিয়ে হুশ ছিল না। এমন খাওয়াই খেয়েছি, শুষে ছিবড়ে বানিয়ে দিয়েছি ওকে।…আর আমারই বা কি দোষ বলো? পেটে এত খিদে থাকলে করবটা কি?,
সর্বনাশ করেছ! পুলিশ আসবে। তদন্ত হবে। কোনমতে আমাদের কথা জেনে গেলে আর রক্ষা নেই, ধাওয়া করে আসবে দ্বীপে।
জানবে কি করে আমরা এখানে আছি?
ভেবে দেখল জন। তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু…
তা ছাড়া আমিই যে খুন করেছি, তার কোন প্রমাণ নেই। লাশটাকে সাগরে ফেলে দিয়ে এসেছি। ওরা ভাববে ডুবে মারা গেছে রিকি। ময়না তদন্ত করে মৃত্যুর কারণ বুঝতে পারবে না। গলার ফুটো দুটো দেখে বড়জোর অবাক হবে, কিসের চিহ্ন বুঝতেই পারবে না।
আমি ভাবছি অন্য কথা। সৈকতে রহস্যময় খুন হতে দেখে রাতের বেলা যদি আসাই ছেড়ে দেয় লোকে, আমরা বাঁচব কি খেয়ে?
যা করার তো করে ফেলেছি। আগে থেকেই অত ভেবে লাভ নেই। বসে থাকি। দেখি, কি হয়।
.
০৮.
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। ঘামে ভেজা চাদরটা গায়ের ওপর থেকে টান মেরে সরিয়ে ফেলে উঠে বসল। নেমে এসে দাঁড়াল জানালার কাছে। পাখি ডাকছে। পুবের আকাশে ধূসর আলোর আভাস। ভোর হচ্ছে।
কটা বাজল? জোরে জোরেই নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
চোখ ফেরাল ঘড়ির দিকে।
সাড়ে পাঁচটা–নীরবে ঘোষণা করল যেন ঘড়িটা।
ঘুম ভাল হয়নি। সারারাত ছটফট করেছে। এপাশ ওপাশ করেছে। মনের মধ্যে কি জানি কেন একটা অশান্তি।
রিকির কথা ভেবে। জিনার কথা ভেবে। দুজনের আচরণই বিস্ময়কর। রকম বদলে গেছে।
সন্ধ্যায় সৈকত থেকে ফিরে জিনাকে ফোন করেছিল সে। খুব ব্যস্ত ছিল লাইনটা। সারাক্ষণ এনগেজ টোন। ডিনারের পর আবার করেছে। ধরেছেন জিনার আম্মা।
জিনা ঘরে নেই। বেরিয়েছে। নিশ্চয় জনের সঙ্গে, শঙ্কিত হয়ে ভেবেছে মুসা। আশঙ্কাটা কিসের, বুঝতে পারছে না।
জিনার সঙ্গে ভালমত কথা বলতে হবে–ঠিক করেছে সে। গলদটা কোনখানে জানা দরকার।
ওর চোখের সামনেই ফর্সা হতে থাকল আকাশ। পাখির কলরব বাড়ছে।
এখন বিছানায় ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। ঘুম আর আসবে না। তারচেয়ে সৈকতে গিয়ে কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে এলে অস্থির মনটা শান্ত। হতে পারে।
আলমারি খুলে একটা কালো রঙের স্প্যানডেক্স বাইসাইকেল শর্টস বের করে পরল। পায়ে ঢোকাল রানিং শূ। দক্ষ হাতে কয়েক টানে বেঁধে নিল ফিতে দুটো।
বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে টেনে দিল দরজাটা। ভোরের শীতল বাতাস শিশিরে ভেজা। একসারি কটেজের পাশ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। সাগরের দিক থেকে আসছে নোনা শুঁটকির গন্ধ।
সৈকতের কিনারে এসে পানিকে একপাশে রেখে গতি বাড়িয়ে দিল সে। কালচে-ধূসর আকাশের ছায়া পড়েছে পানিতে। কালির মত কালো লাগছে পানি। ওকে এগোতে দেখে চারদিকে দৌড়ে সরে যাচ্ছে সী গাল। বেশি কাছাকাছি হলে তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে আকাশে উঠে পড়ছে।
নির্জন সৈকত। কেউ বেরোয়নি এত ভোরে। শরীর চর্চা যারা করে, অথবা বহুমূত্র কিংবা রক্তচাপের রোগী, তারাও নয়। সে একা।
ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকা দিগন্তরেখার কাছে একটা জাহাজের কালো অবয়ব চোখে পড়ছে। কোন ধরনের বার্জ হবে। এই আলোয় কেমন বিকৃত হয়ে গেছে আকৃতিটা, ছায়ার মত কাঁপছে। বাস্তব লাগছে না। মনে হচ্ছে ভূতুড়ে জাহাজ।
গতি কমিয়ে দিল মুসা। তবে দৌড়ানো বন্ধ করার কোন ইচ্ছে নেই। এগিয়ে চলল দৃঢ়পায়ে। একটা অগ্নিকুণ্ডের পাশ কাটিয়ে এল। পুরোপুরি নেভেনি ওটা। কালো ছাইয়ের ভেতরে এখনও ধিকিধিকি আগুন। পোড়া একটা কাঠ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল সাগরে, ঢেউ আবার সেটা ফিরিয়ে এনে ফেলে রেখেছে সৈকতে। বালিতে মরে পড়ে আছে দুটো স্টারফিশ।
নোনা পানির কণা এনে চোখেমুখে ফেলছে বাতাস। ভেজা বালিতে মচমচ শব্দ তুলছে ওর জুতো। ধূসর রঙকে হালকা পর্দার মত সরিয়ে দিয়ে উঁকি দিতে আরম্ভ করেছে ভোরের রক্তলাল আকাশ। সেই রঙ প্রতিফলিত হচ্ছে সাগরেও।
দারুণ সুন্দর। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে মুসা। ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে। চোখ তুলে তাকালেই সামনে দেখা যাচ্ছে বালিয়াড়ির ওপারে কালচে পাহাড়ের চূড়াটা।
যতই এগোচ্ছে সেদিকে, পায়ের নিচে নুড়ির পরিমাণ বাড়ছে। বালি কম। মাটি শক্ত। পাহাড়ের ছায়া থেকে ঠেলে বেরিয়ে থাকা ডকটাও চোখে পড়ছে। এখন।
আরও এগোতে ডকের কাছে পানিতে কি যেন একটা ভাসতে দেখা গেল।
কোন ধরনের ছোট নৌকা? দূর থেকে ভালমত বোঝা যাচ্ছে না।
পানিতে লাল রোদের ঝিলিমিলি। স্পষ্ট হচ্ছে জিনিসটা। একটা নৌকার পাশে ডুবছে, ভাসছে।
তিমির বাচ্চা নাকি? তীরের কাছে এসে অল্প পানিতে আটকা পড়েছে? নাকি মরে যাওয়া বড় কোন মাছ?
ডকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাচ্ছে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিনিসটা কি দেখার জন্যে এগিয়ে গেল।
কয়েক পা গিয়েই যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলার কাছে আটকে আসতে লাগল দম।
পানিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। দুই হাত দুই পাশে ছড়ানো। ভঙ্গিটা মোটেও স্বাভাবিক না।
কোন চিন্তাভাবনা না করেই পানিতে নেমে পড়ল মুসা। গোড়ালি ডুবে গেল ঠাণ্ডা পানিতে। উত্তেজনায় জুতো খোলার কথাও মনে ছিল না। ভিজে গেছে। এখন আর খুলেও লাভ নেই। মানুষটার কোমর ধরে টান দিল। বেশ ভারী। মুখের দিকে না তাকিয়েই কাঁধে তুলে নিল। বয়ে নিল, এল তীরে। শুইয়ে দিল বালিতে।
প্রায় নগ্ন দেহটা কাটাকুটিতে ভরা। ডকের কাছের ধারাল পাথরে ক্রমাগত বাড়ি খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে। একটা কাটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে না।
মুখ দেখার জন্যে চিত করে শুইয়েই চিৎকার করে উঠল মুসা।
রিকি!
দ্রুত একবার পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হয়ে গেল, মারা গেছে রিকি।
ডুবল কি করে? সাঁতার তো ভালই জানত। নাকি ভাটার সময় নেমেছিল পানিতে, স্রোতে টেনে নিয়ে গেছে? জোয়ারের সময় আবার ফেলে গেছে। সৈকতে?
রিকি মৃত! নিজের অজান্তেই হাঁটু ভাজ হয়ে গেল মুসার। পা ছড়িয়ে বসে পড়ল বালিতে। বুজে এল চোখ।
ওর চেয়ে কোন অংশেই খারাপ সাঁতারু ছিল না রিকি। ডোবার কথা নয়, যদি তীব্র ভাটার সময় না নেমে থাকে। কিন্তু রাতের বেলা নামতে গেল কেন সে?
কেন, রিকি, কেন নামলে? চোখ খুলে আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা। চোখে লাগছে কমলা রঙের রোদ। আবার মুদে ফেলল চোখ।
কতক্ষণ একভাবে বসে ছিল সে, বলতে পারবে না। মানুষের কথা শুনে দ্বিতীয়বার চোখ মেলল। এগিয়ে আসতে দেখল দুজন জেলেকে।
.
০৯.
চার রাত পর। আবার ঘুম আসছে না মুসার। বিছানায় গড়াগড়ি করছে। ছটফট করছে। চাদরটা এলোমেলো। বালিশগুলো মেঝেতে। অনেক চেষ্টায় তন্দ্রামত যা-ও বা এল, দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল।
রিকিকে দেখল সে।
অনেক বড় একটা সৈকত। ঝলমলে রোদে বালিকে লাগছে সোনালি। বড় বড় ঢেউ মাথা উঁচু করে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে এসে আছড়ে পড়ছে। সৈকতে। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে মাথায় করে বয়ে আনা সাদা মুকুট।
খালিপায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির হলো রিকি। পরনে কালো রঙের সাঁতারের পোশাক। পানির কিনার ধরে দ্রুতপায়ে দৌড়াচ্ছে। কোন শব্দ হচ্ছে না। নিঃশব্দে উড়ে চলেছে যেন বালির ওপর দিয়ে।
তাকে ধরার জন্যে দৌড় দিল মুসা। ফিরে তাকাল না রিকি। মুসাকে কাছে যেতে দিল না। মুসা এগোলে সে-ও গতি বাড়িয়ে দিয়ে সরে যায়।
রোদে আলোকিত সৈকতেও রিকির মুখটা স্পষ্ট নয়। ছায়ায় ঢেকে রয়েছে, যেন।
প্লীজ, রিকি, সামনে ঝুঁকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে মুসা, একটু দাঁড়াও। তোমার চেহারাটা দেখতে দাও।
তার অনুরোধেই যেন ফিরে তাকাল রিকি।
চমকে গেল মুসা।
আতঙ্কে বিকৃত হয়ে গেছে রিকির মুখ। ঠেলে বেরোনো চোখ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে চিৎকারের ভঙ্গিতে।
হঠাৎ কালো হয়ে এল আকাশ। বিশাল ছায়া পড়ল সৈকতে।
ছায়াটা অনুসরণ করে চলল রিকিকে। এত জোরে ছুটেও কিছুতেই ওটার সঙ্গে পেরে উঠছে না সে।
এখনও রোদের মধ্যেই রয়েছে রিকি, তবে দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনছে। ছায়াটা। যেন ওকে গ্রাস করার জন্যে ছুটে আসছে।
দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে আসছে মুসার। বুঝতে পারল, ছায়াটা মেঘের নয়, হাজার · হাজার কালো প্রাণী সূর্যকে ঢেকে দিয়ে এই অবস্থা করেছে।
কালচে বেগুনী পাখা দুলিয়ে উড়ছে ওগুলো। ওড়ার তালে তালে ওঠানামা করছে মাথাগুলো। তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা করছে।
বাদুড়ের ঝাক তাড়া করেছে রিকিকে।
হাজার হাজার বাদুড় ডানা ঝাঁপটে, প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, কালো চাদর তৈরি করে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। ছায়ায় ঢাকা পড়েছে সৈকত। ওদের তীক্ষ্ণ চিৎকার ঢেউয়ের গর্জনকেও ঢেকে দিয়েছে।
গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে রিকির। চোখ বুজে ফেলল সে। কিন্তু মুখটা খোলাই রইল আতঙ্কে।
থেমো না, রিকি! মুসা বলল। দৌড়াতে থাকো!
কিন্তু কুলাতে পারল না রিকি। ধরে ফেলল ওকে বাদুড়েরা। হুমড়ি খেয়ে বালিতে পড়ে গেল সে। রাতের অন্ধকারের মত ছেকে ধরল ওকে বাদুড়গুলো।
তারপর সব কালো।
ঝটকা দিয়ে বিছানায় উঠে বসল মুসা। নিজের ঘরে রয়েছে দেখে স্বস্তির। নিঃশ্বাস ফেলল। জানালা দিয়ে ভোরের ধূসর আলো ঢুকছে।
বিছানা থেকে যখন নেমে দাঁড়াল সে তখনও ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। চোখে লেগে রয়েছে দুঃস্বপ্নের রেশ।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জানালার দিকে এগোল সে। কানে বাজছে যেন। বাদুড়ের তীক্ষ্ণ চিৎকার। চোখের সামনে দেখছে বাদুড়ের মেঘ! বাদুড়ের ঝাক! সৈকতের বালিতে হুমড়ি খেয়ে পড়া রিকিকে কালো চাদরের মত ঢেকে দিয়েছে!
জানালার চৌকাঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভয়ঙ্কর সেই দুঃস্বপ্নের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা চালাল সে।
কিন্তু বাদুড় দেখল কেন?
স্বপ্ন বিশ্বাস করে না সে। ঘুমের মধ্যে তাহলে কি তার মগজ কোন জরুরী মেসেজ দিতে চেয়েছে? এত প্রাণী থাকতে নইলে বাদুড় কেন?
তবে কি ভ্যা…একটু দ্বিধা করে জোরে জোরে উচ্চারণই করে ফেলল সে: ভ্যাম্পায়ার!
না, ভূতের কথা ভাবছে না সে। ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথা ভাবছে। ছোট্ট দ্বীপটা থেকে রাতের বেলা ঝাঁকে ঝাকে বাদুড় উড়ে আসতে দেখেছে। বেশির ভাগই নিরীহ ফলখেকো বাদুড়। তবে বড় বাদুড়ের সঙ্গে ছোট আকারের ভ্যাম্পায়ার ব্যাট বাস করাও অসম্ভব নয় ওই নির্জন দ্বীপে।
রক্তচোষা ওই ভয়ঙ্কর বাদুড়গুলোই কি হত্যা করেছে রিকিকে? অসম্ভব নয়। রাতের বেলা সৈকতের নির্জন জায়গায় চলে যেত রিকি। নিজের অজান্তেই ভ্যাম্পায়ারের শিকার হত। চুপচাপ এসে তার শরীর থেকে রক্ত খেয়ে চলে যেত ওগুলো। সেজন্যে দুর্বল বোধ করত, সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করত না। আমাজানের জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ার ধরতে গিয়ে ওই বাদুড় সম্পর্কে বিরাট অভিজ্ঞতা হয়েছে মুসার। জানে, কি রকম নিঃশব্দে এসে গায়ে বসে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। রক্ত খেয়ে চলে যায়। জানা না থাকলে, আর সজাগ এবং ওগুলোর ব্যাপারে পুরোপুরি সতর্ক না থাকলে কিছু টেরই পাওয়া যায় না।
যতই ভাবল, রিকির রহস্যময় মৃত্যুর আর কোন কারণই খুঁজে পেল না মুসা। সব খুনেরই মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকে। এ খুনের কোন মোটিভ পায়নি পুলিশ। তারমানে ভ্যাম্পায়ার। রক্ত খেয়ে খেয়ে শেষ করে দিয়েছে রিকিকে। এটাই মোটিভ। এবং জোরাল মোটিভ।
স্বপ্ন একটা বিরাট উপকার করেছে তার। সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছে।
পুরোপুরি সজাগ হয়ে গেছে মুসা। ঘুমের লেশমাত্র নেই আর চোখে। কুচকানো টেনিস শর্টসটা তাড়াতাড়ি পরে নিল। মাথায় গলিয়ে গায়ে টেনে দিল। আগের দিনের ব্যবহার করা টি-শার্ট। রওনা দিল দরজার দিকে। দাঁত ব্রাশ করার কিংবা মুখ ধোয়ারও প্রয়োজন মনে করল-না।
রান্নাঘর দিয়ে ছুটে বেরোনোর সময় নাস্তার টেবিল থেকে ডাক দিলেন তার বাবা, এই…
কিন্তু ততক্ষণে স্ক্রীনডোরের বাইরে চলে এসেছে সে। পরে কথা বলব, বলে ছেড়ে দিল পাল্লাটা। লাফ দিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল জিনাদের বাড়ির দিকে।
ধূসর রঙ আকাশের। বাতাস ভেজা ভেজা, কনকনে ঠাণ্ডা। বালি ভেজা। তারমানে আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।
বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়নি সে। বাইরের কোন শব্দই তার কানে ঢুকতে দেয়নি ভয়াবহ ওই দুঃস্বপ্ন। প্রথমে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন। তারপর বাদুড়ের বাঁশির মত তীক্ষ্ণ চিৎকার।
ভ্যাম্পায়ার ব্যাট!
জিনাকে গিয়ে বলতে হবে। বলবে, সত্যটা জেনে গেছে সে।
ঝলমলে রোদ ছিল, আকাশটা নীলও ছিল; তারপরেও রিকির মৃত্যুর পর গত চারটা দিন কেমন যেন ধূসর, বিষণ্ণ কুয়াশায় ঢেকে দিয়েছিল সব কিছু। মনটা ভীষণ খারাপ ছিল বলেই মুসার কাছে দিনগুলো এ রকম লেগেছে।
ঘটনার ছবিগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে তার মনে, কেবল চিৎকার আর শব্দগুলো গেঁথে রয়েছে স্পষ্ট–রিকির বাবা-মায়ের বুকভাঙা কান্না, পুলিশের ভারী ও চাঁপা কন্ঠ, সৈকতে বেড়াতে আসা ছেলেমেয়েদের চমকে চমকে ওঠা, ভীত কথাবার্তা।
গত চারদিনে জিনার সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে তার। জিনা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তার সঙ্গে। রিকির মৃত্যু রহস্য নিয়ে আলোচনাটা মোটেও জমেনি।
গত কয়েকদিনে বার বার কিশোর আর রবিনের অভাব অনুভব করেছে মুসা, বিশেষ করে কিশোরের। এখন ওর এখানে থাকার বড় দরকার ছিল। টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। রবিনকে পাওয়া গেছে। ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। তবে ঠিকমত হাটাচলা করতে সময় লাগবে। আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন ডাক্তার। ইয়ার্ডে পাওয়া যায়নি কিশোরকে। দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন বোরিস জানিয়েছে, রাশেদ পাশার সঙ্গে বাইরে গেছে সে, পুরানো মাল আনতে, কখন ফিরবে কোন ঠিক নেই। হতাশ হয়ে লাইন কেটে দিয়েছে মুসা।
জিনার সঙ্গে আলোচনা জমাতে না পেরে সরে চলে এসেছিল মুসা। ভেবে অবাক হচ্ছিল, কি হয়েছিল রিকির? এত রাতে সাগরে নেমেছিল কেন? মারা গেল কেন? ওই অবেলায় শুধু শুধু সাঁতার কাটতে নেমেছিল রিকি, এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না মুসা।
টাউন করোনার এটাকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু রায় দিয়েই খালাস। কিন্তু মুসা। এত সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না ব্যাপারটা। বুঝতেও পারছিল না। কিভাবে মারা গেছে রিকি।
তবে এখন জানে। স্বপ্ন তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে।
সেই জবাবটা জিনাকেও জানাতে চলেছে সে।
গ্রীষ্মবাসগুলোর পেছন দিয়ে এগোচ্ছে। সাদা সাদা কটেজগুলোর আঙিনায় চওড়া সানডেক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চেয়ার। একটা করে বড় ছাতা আর তার। নিচে টেবিল রয়েছে প্রতিটি আঙিনায়। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে জিনাকে চোখে পড়ল।
লাফ দিয়ে ডেকে উঠল মুসা। জিনার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে চলে এল পেছনের দরজার কাছে।
অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল টেবিলে বসা জিনা। কেরিআন্টি এঁটো থালা-বাসন পরিষ্কার করছেন।
দৌড়ে আসার পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে মুসা। নাস্তা করেছ? জানতে চাইলেন কেরিআন্টি। টেবিলে রাখা প্যানকেকের থালাটা দেখালেন তিনি।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে খাবারের দিকে এগোল না মুসা। জিনাকে দেখছে। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে আসা ধূসর আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে। ওর মুখ। জিনা, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নীরবে উঠে দাঁড়াল জিনা। এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
ওর পিছু পিছু ডেকে বেরিয়ে এল মুসা। কথাটা জানানোর জন্যে অস্থির। সাগর থেকে বয়ে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। আকাশের ভারী মেঘ অনেক নিচে নেমে এসেছে।
ডেকের রেলিঙে হেলান দিয়ে গাছপালার দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। ওর পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। শার্টের নিচের অংশটা ওপরে টেনে তুলে সেটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল।
গন্ধ হয়ে গেছে শার্টটায়। নাক কুঁচকাল। তাড়াহুড়ায় আলমারি থেকে থোয়া শার্ট বের করে পরার কথা মনে ছিল না, আগের দিনেরটাই পরে চলে এসেছে। এ নিয়ে মাথা ঘামাল না।
কেমন কাটছে তোমার? মেঘলা আকাশের নিচে গাছপালার কালো মাথার দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জিত স্বরেই যেন জিজ্ঞেস করল জিনা।
ভাল না।
আমারও না।
তোমাকে কয়েকটা জরুরী কথা বলতে এসেছি, জিনা, ভূমিকা শুরু করল মুসা। অস্বস্তি বোধ করছে। ও যা বলবে, সেটা যদি বিশ্বাস না করে জিনা? হাসাহাসি করে?
আমার ঘুম পাচ্ছে। তাজা বাতাসেই বোধহয়।
জিনা, আমি কি বলছি, শুনছ? রিকি কিভাবে মারা গেছে, জেনে ফেলেছি।
চোখের পাতা সরু করে ফেলল জিনা। রক্ত সরে গিয়ে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা। কিভাবে মারা গেছে, সেটা আমিও জানি, মুসা। পানিতে ডুবে।
জিনা, শোনো, প্লীজ, অধৈর্য ভঙ্গিতে নিজের শার্টের ঝুল ধরে একটানে প্রায় হাঁটুর কাছে নামিয়ে দিল মুসা। প্লীজ, জিনা!
জবাব দিল না জিনা। মুসার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জবাবটা স্বপ্নের মধ্যে পেয়েছি আমি, গলা কাঁপছে মুসার। কিন্তু আমি জানি, এটাই সত্যি।
এবারও কোন কথা বলল না জিনা। তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
ভ্যাম্পায়ারে খুন করেছে রিকিকে।
তাই! এক পা পিছিয়ে গেল জিনা। এমন করে দুহাত তুলে ধরল, যেন। মুসার কথার অস্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়।
ভ্যাম্পায়ার! জোর দিয়ে বলল মুসা। সৈকতের ওপর দিয়ে হাজার হাজার বাদুড় উড়ে যেতে দেখি রোজ। বেশির ভাগই ফলখেকো বাদুড়। আমার বিশ্বাস, ফলখেকোগুলো যেখান থেকে আসে, সেখানে ভ্যাম্পায়ার ব্যাটও আছে। রিকিকে…
মুসা, থামো। এ সব রসিকতা এখন ভাল্লাগছে না আমার, আঁঝাল কণ্ঠে। বলল জিনা। দুই হাত আড়াআড়ি করে রাখল বুকের ওপর।
জিনাকে বোঝাতে গিয়ে ওর গলার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেল মুসা। খাইছে বলে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
নানা রকম ভাবনা খেলে যেতে শুরু করল মাথায়। অদ্ভুত সব ভাবনা। সেগুলো বলতে গেলে পাগল বলবে লোকে।
উল্টোপাল্টা দেখছি নাকি আমি?-ভাবল সে। ওগুলো মশার কামড়?
জনের কথা মনে পড়ল তার। জন! এমন কি হতে পারে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট নয়, আসল ভ্যাম্পায়ারের কবলেই পড়েছে জিনা? জন কি ড্রাকুলার মত মানুষরূপী সত্যিকারের রক্তচোষা ভূত?
মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে! আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি! ভাবতে লাগল মুসা।
স্বপ্নে কি দেখেছি আমি, শোনো, আবার যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরেই কথা বলতে লাগল মুসা। মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্তাগুলো। বাদুড়ের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল রিকি, আর বাদুড়গুলো…
থামো, মুসা! ফেটে পড়ল জিনা। বললাম তো, ভাল্লাগছে না আমার!
কিন্তু আমি যা বলছি, ঠিকই বলছি! জিনার রাগের পরোয়া করল না মুসা। বোঝার চেষ্টা করো, জিনা। ওই বাদুড়গুলোই যত নষ্টের মূল। রিকি…ওর গলায় এত বেশি কাটাকুটি ছিল, তার মধ্যেও…
আহ, থামো না! রাগে শক্ত হয়ে গেছে জিনার শরীর। দয়া করে তোমার বকবকানি থামাও।
কিন্তু, জিনা…
থামো! গর্জে উঠল জিনা।
থমকে গেল মুসা। ভুলটা কি বলল সে? ওর কথা কেন শুনতে চাইছে না। জিনা? বিশ্বাস করুক বা না করুক, কথা তো শুনবে!
মুসা, তোমার বয়েস বেড়েছে। আগের ছোট্ট খোকাটি আর নেই তুমি যে সব সময় ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে থাকবে। এখন আর ওসব মানায় না, তামাটে চোখে রাগে যেন আগুন জ্বলছে জিনার। মুসার কাছে ওর এই আচরণ রীতিমত অস্বাভাবিক লাগল। বড় হও, জিনা বলছে। তোমার এত ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু মারা গেল, আর তুমি বসে বসে হরর ছবির গল্প তৈরি করছ!
না, তা করছি না… চিৎকার করে উঠল মুসাও।
কিন্তু তাকে কথা শেষ করতে দিল না জিনা। দেখো, জীবনটা কাহিনী নয়, বাস্তব।
আশ্চর্য! কবে এত বড় হয়ে গেল জিনা? রকি বীচ থেকে আসার সময়ও তো এরকম ছিল না। স্যান্ডি হোলোতে এসে মাত্র কদিনে…।
জীবনটা যে কাহিনী নয়, আমি জানি, তর্ক করতে গেল মুসা, কিন্তু…
রিকি আমাদের বন্ধু ছিল, চোখের কোণে পানি এসে গেছে জিনার। ওর মৃত্যুতে তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, আমারও হচ্ছে। মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু এটাই বাস্তব। চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করল না জিনা। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। কিভাবে মারা গেছে ও, ঠিক করে বলতে পারছে না কেউ। পানিতে ডুবে মরেছে, এ কথাটা মানতে না চাইলে না মানো, তাই বলে ভ্যাম্পায়ারের গল্প! ওই ছেলেমানুষী গল্প দয়া করে আমাকে শোনানোর। চেষ্টা কোরো না আর।
লেকচার তো একখান ভালই দিয়ে দিলে। কিন্তু, জিনা… থেমে গেল। মুসা। আর কি বলবে? তাকিয়ে আছে জিনার গলার দাগ দুটোর দিকে।
জন একটা ভ্যাম্পায়ার! বিড়বিড় করে বলে ফেলল নিজেকেই। জিনাকে শোনানোর জন্যে বলেনি।
কিন্তু শুনে ফেলল জিনা। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে জ্বলন্ত চোখে। তাকাল। কি বললে? পাগল হয়ে গেছ তুমি। যাও এখান থেকে। আমার। সামনে থেকে সরো। তোমাকে সহ্য করতে পারছি না।
ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জিনা। গটমট করে রওনা হলো ঘরে ঢোকার জন্যে।
মুসাও ঢুকতে গেল। দরজার কাছ থেকে তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিল জিনা। না, আসার দরকার নেই। যাও! আর কোনদিন আসবে না এখানে। তোমার মুখও দেখতে চাই না।
ভেতরে ঢুকে গেল জিনা। কেরিআন্টি বোধহয় নেই এখন ওঘরে, কিংবা ওদের কথা শুনতে পাননি, তাই কোন রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। নেমে এল ডেক থেকে। ক্লান্ত, চিন্তিত ভঙ্গিতে ফিরে চলল। সামনে দিয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেল দুটো খরগোশ। দেখলই না যেন সে।
বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অঝোরে ঝরতে শুরু করল।
মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাঁটছে মুসা। বৃষ্টিতে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। দুশ্চিন্তায় বৃষ্টির চেয়ে অনেক ভারী হয়ে আছে যেন মগজ।
পানি আর কাদায় জুতো পড়ে ছপছপ শব্দ তুলছে। ওর তারের মত চুলগুলোকে নরম করতে পারছে না পানি, লেপ্টে দিতে পারছে না। তবে শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে লেগে গেছে গায়ের সঙ্গে।
ভাবতে ভাবতে চলেছে সে। জিনা ঠিকই বলেছে, ছেলেমানুষী, উদ্ভট চিন্তা। ভ্যাম্পায়ারের কথা কি করে ভাবতে পারল? কিশোর হলে এরকম ভূতুড়ে ভাবনা কক্ষনো ভাবত না। ভ্যাম্পায়ারের কথা না ভেবে বাস্তব কিছু আবিষ্কার করত।
কিন্তু ভ্যাম্পায়ার ভূত অবাস্তব হলেও ভ্যাম্পায়ার বাদুড় তো বাস্তব। ওরা রক্ত খেয়ে রিকিকে…
তাহলে জিনার গলায় দাগ কেন? ভ্যাম্পায়ার ব্যাট রক্ত খেলে ওরকম দাগ রেখে যায় না।
মাথাটা আবার গরম হয়ে যাচ্ছে। একপাশের গাছগুলোর দিকে মুঠো তুলে আঁকাল সে, যেন শাসাল ওগুলোকে। বৃষ্টি আর বাতাসে নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে গাছের মাথা।
ঘাড় বেয়ে বৃষ্টির পানি অঝোরে ঝরে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে পিঠ। শীত লাগল ওর। গায়ে কাটা দিল।
আবার ভাবতে লাগল ভ্যাম্পায়ারের ভাবনা। জিনার গলার দাগ দুটো নিয়ে ভাবল। কাকে সন্দেহ করবে? জনকে? না ভ্যাম্পায়ার ব্যাটকে?
.
১০.
নীলচে আলোর বিকেলে গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠল জন। কফিনের ভেতরে হাত নাড়ানোর জায়গা নেই, তার মধ্যেই আড়মোড়া ভাঙল কোনমতে। ডালার বড় বড় ফুটোগুলো দিয়ে আলো আসছে। তবে এত কম, বোঝা যায় বাইরে দিনের আলো শেষ।
বড় করে হাই তুলে ডালায় ঠেলা দিল সে। কাচকোচ আওয়াজ তুলে ওপরে উঠে গেল ডালাটা। উঠে বসে চারপাশে তাকাল। তারপর বেরিয়ে এল কফিন থেকে।
হালকা স্যান্ডেলের শব্দে ফিরে তাকাল সে। ওপাশের ঘর থেকে দরজা দিয়ে এ ঘরে ঢুকল লীলা। কি খবর? ঘুম তাহলে ভাঙল।
তুমি এত আগে জেগেছ কেন?
খিদে। বড় খিদে। সহ্য করতে পারছি না। পেটে খিদে নিয়ে কি ঘুম আসে?
কি আর করা। সহ্য করতেই হবে। আগেই তো বলা হয়েছে আমাদের, এ রকমই ঘটবে…
তা হয়েছে। নাম লিখিয়েছি পিশাচের খাতায়। এখন যে বাঁচি না!
আর কোন উপায় নেই, চালিয়ে যেতেই হবে। একবার যখন ফাঁদে পা দিয়েছি, আর মুক্তি নেই। এখন বেরোতে গেলে কাউন্ট ড্রাকুলার বিশ্বাস হারাব। আর তার বিশ্বাস হারালে কি যে ঘটে, সে তো নিজের চোখেই দেখেছ। বেশি ভাবনাচিন্তা না করে তৈরি হয়ে নাও। বেরোতে হবে। শিকার তো একটাকে দিয়েছ শেষ করে। আজ কি করবে?
দেখি, নতুন কাউকে ধরার চেষ্টা করতে হবে।
কাকে? পরিচিত কাউকে?
ঠিক করিনি এখনও। ভেবে দেখতে হবে।
*
সারাটা দিন কি করে কাটালে? উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে বালিয়াড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল টনি।
সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসের ডগায় পানি লেগে আছে। হাঁটতে গেলে নাড়া লেগে পায়ে পড়ে পা ভেজে। মুসার মনে হলো, বোকামি হয়ে গেছে। শর্টস না পরে জিনস পরে আসা উচিত ছিল। বিড়বিড় করে বন্ধুর কথার জবাব দিল, কিছুই না।
আসলেই কিছু করেনি সে। বেশির ভাগ সময় লিভিং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেছে, পায়চারি করেছে, রিকির লাইটারটা বের করে হাতে নিয়ে দেখেছে, স্বপ্নের কথা ভেবেছে, জিনা ওর কথা না শুনে তাড়িয়ে দেয়ায় দুঃখ পেয়েছে।
লাইটারটা এখনও হাতেই আছে ওর। রাখতে ভাল লাগছে। বন্ধুর একমাত্র স্মৃতি।
বালি শুকিয়ে যাচ্ছে দেখো, কত তাড়াতাড়ি, স্যান্ডেলের ডগা দিয়ে খোঁচা দিল টনি, কি আশ্চর্য, তাই না? সারাটা দিন ধরে বৃষ্টি হলো, আর কত সহজেই না সেটা শুষে নিল বালি।
সাগরের দিকে তাকাল মুসা। সন্ধ্যার শুরুতে মেঘগুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে। রাতের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দিগন্তে ফ্যাকাসে চাঁদের চারপাশ ঘিরে পানির একটা নীলচে বৃত্ত তৈরি হয়েছে।
কি ভাবছ এত? মুসাকে জবাব দিতে না দেখে জিজ্ঞেস করল টনি।
টান দিয়ে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কাটতে শুরু করল মুসা।
কি, বলছ না যে? অ্যাই, মুসা?
কি বলব?
যা ভাবছ।
বললে বিশ্বাস করবে না। হয় হাসবে, নয়তো জিনার মত রেগে গিয়ে দর্শন শোনাতে শুরু করবে।
মানে?
স্বপ্ন দেখে একটা কথা মাথায় এসেছিল। জিনাকে বলতে গিয়েছিলাম। দূর দূর করে খেদিয়েছে আমাকে।
আমি ওরকম কিছু করব না। নিশ্চিন্তে বলে ফেলো।
তা-ও দ্বিধা করতে লাগল মুসা। টনির চাপাচাপিতে শেষে বলতে বাধ্য। হলো স্বপ্নের কথা, রিকি কিভাবে মারা গেছে, সেই সন্দেহের কথা। ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথাই শুধু বলল সে। জনকে যে ভ্যাম্পায়ার ভাবছে এ কথা চেপে গেল।
নিজে হাসল না টনি, যেহেতু কথা দিয়েছে। তবে জিনার কথা বলল, হাসবেই তো। ছেলেমানুষের মত কথা বললে কে না হাসে।
তুমিও বললে ছেলেমানুষ! জানো, স্বপ্ন অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। অনেক আবিষ্কার, অনেক যুদ্ধ।
থামো, থামো, হাত তুলল টনি, ওসব আমি জানি। ওগুলো ছিল সব বাস্তব
এটা অবাস্তব, এই বলবে তো? কিন্তু টনি, ভুলে যেয়ো না, রিকির মৃত্যুটা বাস্তব।
কে ভুলে যাচ্ছে? রিকির মৃত্যুটা বাস্তব। আর বাস্তব কারণেই সেটা ঘটেছে, পানিতে ডুবে। তুমি কি ভেবেছ, জিনা আর আমি শুনলেই তোমার কথায় লাফিয়ে উঠব? ভ্যাম্পায়ারে রক্ত শুষে খেয়ে খেয়ে খতম করে দিয়েছে। রিকিকে-দারুণ এই আবিষ্কারের জন্যে তোমাকে বাহবা দিতে থাকব, পিঠ চাপড়াব?
টনির দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। আহত স্বরে বলল, জিনাকে আমি বলতে গিয়ে বোকামি করে ফেলেছি, এটা ঠিক। সেই দুঃখ ভোলার জন্যে কারও ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলাম, সে তুমি। কিন্তু তুমিও যে এভাবে হাসাহাসি শুরু করবে…
হাসি মুছে গেল টনির মুখ থেকে। তাড়াতাড়ি বলল, সরি। তোমাকে দুঃখ দেয়ার জন্যে বলিনি কিন্তু।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দে মুখ তুলে তাকাল মুসা। দুটো বাদুড় উড়ে চলেছে বালিয়াড়ির দিকে।
বিজ্ঞানের ক্লাসে স্যার বলেছেন, বাদুড় খুব ভাল প্রাণী, ঘাসের ডগা চিবাচ্ছে টনি, কথা স্পষ্ট হলো না। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যে ওদের প্রয়োজন আছে। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ওরা আমাদের উপকার করে। বাদুড়ের মল দিয়েও ভাল সার হয়।
ওই সার তুমি গিয়ে জমিনে ফেলোগে! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। আর জাহান্নামে যাক তোমার বিজ্ঞানের ক্লাস।
রাগ করল না টনি। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। রিকির– কথাটাও মন থেকে সরাতে পারছি না। বেচারা! তা ছাড়া জিনার সঙ্গে ওই অপরিচিত লোকটার খাতির..
বাদ দাও ওসব কথা, হাত নেড়ে বলল মুসা। নিজের কর্কশ স্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। ভাল্লাগছে না শুনতে!
কোন কথা বলেই আর জমানো যাবে না বুঝতে পেরে টনি বলল, তারচেয়ে চলো প্রিন্সেসে চলে যাই। মন ভাল হবে। যাবে?
মাথা নাড়ল মুসা, না। তুমি যাও। আমি বরং হাঁটাহাঁটি করে মগজটাকে সাফ করা যায় নাকি দেখি।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টনি। ঠিক আছে, মন ভাল করার চেষ্টা করতে থাকো তুমি। আমি গেলাম।
জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল সে। কিছুদূর গিয়ে মুসার দিকে ফিরে হাত নাড়ল একবার।
বালিয়াড়ির দিকে হাঁটতে থাকল মুসা। চিন্তায় ভারী হয়ে আছে মন। সামনে কতগুলো ছেলেমেয়েকে জটলা করতে দেখে আর সেদিকে এগোল না। ঘুরে গেল পাহাড়টার দিকে। রাতের পরিষ্কার আকাশের পটভূমিতে বিশাল একটা স্তম্ভের মত লাগছে পাথরের কালো চূড়াটা।
জিনার কথা ভাবল। সকালে হয়তো ওর মেজাজ খারাপ ছিল। সেজন্যে কোন কথা শুনতে চায়নি। আবার কি যাবে ওকে বোঝাতে?
নাহ, যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। গিয়ে কোন লাভ নেই। ওর কথা শুনবে না জিনা।
কিন্তু ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই হবে। জন যে ভ্যাম্পায়ার এ বিশ্বাসটা মনে বদ্ধমূল হচ্ছে ক্রমেই। ওর খপ্পর থেকে জিনাকে সরিয়ে আনতে না পারলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যাবে জিনা।
আনমনে ভাবতে ভাবতে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলল সে। গভীর চিন্তায় ডুবে না থাকলে আরও আগে দেখতে পেত। চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়াল। কাপুনি শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে।
একটা উঁচু বালির ঢিবিতে পড়ে আছে কালোমত কি যেন। নিথর।
খাইছে! কি ওটা? আবার লাশ!