০৫.

ব্ল্যাক ফরেস্ট পার্কে বসে আছে ওরা। পার্কটা শহরের একধারে, হাই স্কুলের পেছনে। পাশ দিয়ে বইছে গ্রে উইলো রিভার। নির্জন পার্ক। বিমর্ষ, গভীর পরিবেশ।

ক্লডিয়াও এখন আছে ওদের সঙ্গে। পর্বত থেকে ফিরেছে। সেদিন সকালের ডাকে একটা চিঠি পেয়েছে ড্যানিয়েল। সোফির চিঠিটার হুবহু নকল। তফাত কেবল নামের সারিতে ওপরের নাম অর্থাৎ সোফির নাম নেই। সাঙ্কেতিক একটা বিজ্ঞপ্তিও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। লিখেছে:

ছোট বোনের ডান হাত পুড়িয়ে দাও

কে ডেকেছে এই মীটিং? জানতে চাইল রবিন। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে। তার পাশে বসে একটা ঘাসের ডগা দাঁতে কাটছে মারলা। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। খবরটা শোনার পর থেকে কারোরই মন-মেজাজ ভাল নেই।

মীটিং ডাকিনি, ক্লডিয়া বলল। সবাইকে একজায়গায় হতে বলেছি যার যা ইচ্ছে বলার জন্যে।

লাভটা কি তাতে?

যদি কোন সমাধান বেরিয়ে আসে।

ভাল কথা, রবিন বলল। তাহলে বসে আছ কেন সবাই চুপচাপ?

বুঝতে পারছি না কিভাবে শুরু করব। আজকে আর উগ্র পোশাক পরেনি ক্লডিয়া, সাধারণত যেমন পরে থাকে সে। খাটো করে ছাঁটা তুষারশুভ্র চুল। চুলের রঙ আর শার্টের রঙ এক। পরনে নীল জিনস। ঠোঁটে লিপস্টিক আছে, তবে খুবই পাতলা করে লাগানো। মেকআপ নেয়নি বললেই চলে। ওর এই মেকআপ নিয়ে মারলা তো প্রায়ই ইয়ার্কি মেরে বলে এক কেজি পাউডার আর আধা কেজি লিপস্টিক না হলে ক্লডিয়ার মেকআপই হয় না। আজ সেসব প্রায় কিছুই নেই।

নড়েচড়ে বসল ড্যানি, এরপর আমার পালা। চিঠি এবং গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে যা যা জানি সেটা নিয়ে প্রথমে আলোচনা করতে পারি আমরা। তারপর করতে পারি যা জানি না সেটা নিয়ে। কেমন হয়?

ভাল, নিচুস্বরে বলল মুসা। সবার কাছ থেকে সামান্য দূরে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে। সারারাত ঘুমায়নি। এখন সকাল এগারোটা। বাজে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কথাবার্তা শেষ হলে এখানে এই ঘাসের মধ্যে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বে।

এই চিঠি এমন কেউ লিখেছে, শুরু করল ড্যানি, যে আমাদের সবাইকে চেনে। আমাদের গোপন ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে। প্রথমে ভেবেছিলাম রসিকতা করছে, কিংবা ফাঁকা বুলি ঝাড়ছে সে। কিন্তু সোফির খুন হওয়ার পর এখন বুঝতে পারছি সে সিরিয়াস। সোফিকে তত্ত্বাবধায়কই খুন করেছে।

কি সব ছেলেমানুষের মত কথা বলছ, ড্যানির কথায় একমত হতে পারল না ক্লডিয়া। সোফি গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশের মতে এটা নিছকই দুর্ঘটনা। রাতের বেলা এত জোরে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।

এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত, রবিন বলল। ওর মনের যা অবস্থা হয়েছিল, তাতে অন্যমনস্ক থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। এর জন্যে অবশ্যই দায়ী করতে হবে তত্ত্বাবধায়ককে। তার মানে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে এই খুনের জন্যে সে-ই দায়ী।

কিন্তু বড় বেশি কাকতালীয়; মেনে নিতে পারছে না ড্যানি।

তোমার কি ধারণা অলৌকিক কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করে সোফিকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে বাধ্য করেছে তত্ত্বাবধায়ক? হাত নাড়ল রবিন, আমি, একথা বিশ্বাস করতে রাজি না।

কিন্তু একটা কথা তো ঠিক, মারলা বলল, চিঠিতে লিখেছিল ওর কথার অবাধ্য হলে মারাত্মক পরিণতি ঘটবে। সোফি অবাধ্য হয়েছে, ওর কথামত কুকুরের বাচ্চাটাকে চুবিয়ে মারেনি, অতএব তাকে মরতে হলো। আর কি। ভয়ঙ্কর মৃত্যু! ধড় থেকে মাথাই আলাদা… কেঁপে উঠল মারলা। চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠল। সোফির জন্যে থেকে থেকেই কাঁদছে। খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল।

 বেশি নাটকীয় করে ফেলছ সবকিছু, অত আবেগের ধার দিয়ে গেল না ক্লডিয়া। অ্যাক্সিডেন্ট হলে আরও কত বিকৃত হয়ে যায় মানুষের দেহ। টুকরো টুকরো হয়ে যায়, থেতলে ভর্তা হয়ে যায়। সেই তুলনায় এটা তো কিছুই না।

তা ঠিক, একমত হয়ে মাথা দোলাল ড্যানি। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক অ্যাক্সিডেন্ট বলে ধরে নেয়াই ভাল। কারণ ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক গাড়িতে ছিল না। থাকলে সে-ও বাচত না। চিঠি যখন লিখতে পারে, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ভূত নয় সে। তোমার-আমার মতই মানুষ। আমার ধারণা, সরাসরি ও খুন করেনি সোফিকে। তবে পরোক্ষভাবে যে এই খুনের জন্যে সে দায়ী, তাতেও কোন সন্দেহ নেই।

 আচ্ছা, মুসা বলল, গাড়ির যন্ত্রপাতির মধ্যে কোন কারসাজি করে রাখেনি তো তত্ত্বাবধায়ক? যাতে ব্রেক ফেল করে…

ব্রেক ফেল করে মারা যায়নি সোফি। মনে করিয়ে দিল রবিন, পুলিশ অফিসার কি বলল? গাছের সঙ্গে তো লাগিয়েছে। তারমানে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে রাস্তা থেকে সরে ধাক্কাটা লাগিয়েছিল সোফি। এর মধ্যে জেমস বন্ড ভিলেনদের শয়তানি খুঁজে লাভ নেই।

কিন্তু শয়তানি তো কেউ একজন করছে। এই চিঠিই তার প্রমাণ।

তবে সে সোফিকে খুন করেনি, এটাও ঠিক, জোর দিয়ে বলল ক্লডিয়া।

ড্যানি বলল, আমার প্রশ্ন, এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা কে?

কেউ জবাব দিতে পারল না। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। জবাবের আশায়। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রবিন বলল, আমার কি মনে হচ্ছে জানো? মরুভূমিতে যে লোকটাকে কবর দিয়ে এসেছি আমরা, তার কোন পরিচিত লোক কিংবা বন্ধু হতে পারে।

সে কেন করবে একাজ?

প্রতিশোধ। আমরা ওর বন্ধুকে খুন করেছি। সে এখন আমাদের শাস্তি দেবে।

ব্ল্যাকমেইল?

না, তাহলে টাকা চাইত। বা অন্য কোন কিছু। সে আমাদের এমন সব কাজ করতে বলছে, যাতে আমরা ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা পাই।

সেই লোকটা কে? আবার আগের প্রশ্নে ফিরে গেল ড্যানি।

কি করে বলব? হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত তুলল রবিন। জানলে তো গিয়ে চেপেই ধরতাম। যে লোকটাকে গাড়ি চাপা দিলাম তার পরিচয়ই জানি না, আর এর কথা জানব কিভাবে?

 এখন কিশোরকে খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের, হাই তুলতে তুলতে। বলল মুসা। এত জটিল একটা ধাঁধার সমাধান ও ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।

আবার এক মুহূর্ত নীরবতার পর ক্লডিয়া বলল, আমাদের মধ্যে কেউ কাজটা করিনি তো? জোক করার জন্যে? সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে।

তুমি কিছু করেছ কিনা তুমি জানো, মারলা বলল, তবে আমি এই জঘন্য চিঠি লিখিনি। সোফিকেও আমি খুন করিনি।

আবার খুনের কথা আসছে কেন? ও তো নিজে নিজে অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। আমি বলতে চাইছি চিঠিটার কথা:..

লিখলে তাহলে তুমিই লিখেছ, রেগে গেল মারলা, তোমার মাথায়ই ছিট আছে। এখানে ছিলেও না অনেকদিন। চিঠি লিখে ডাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে। তোমার এই জঘন্য শয়তানির জন্যেই ঘাবড়ে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে সোফি মারা গেছে। ওর মৃত্যুর জন্যে তুমি দায়ী।

দেখো, মুখ সামলে কথা বোলো! আগুন জ্বলে উঠল ক্লডিয়ার চোখে। চিঠিটা যেদিন পেয়েছ তোমরা তার বহু আগে আমি শহর থেকে চলে গেছি…

আহ, কি শুরু করলে তোমরা! বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ল রবিন। নিজেরা নিজেরাই মারামারি শুরু করে দিচ্ছ! থামো! চুপ করো!

মুসা বলল, অহেতুক নিজেদের সন্দেহ করছি আমরা। আমাদের মধ্যে কেউ তত্ত্বাবধায়ক নই। আসল কথা বাদ দিয়ে বসে বসে ঝগড়া করলে কাজ এগোবে না।

সরি! নিজেকে সামলে নিল মারলা।

 ক্লডিয়ারও চোখের আগুন নিভে এল।

ড্যানি বলল, সমস্যাটা এখন আমার কাঁধে। কারণ এরপর আমাকে টার্গেট করেছে তত্ত্বাবধায়ক। যে কাজটা করতে বলেছে মরে গেলেও আমি তা করতে পারব না।

তা তো সম্ভবই নয়, মাথা নাড়ল ক্লডিয়া। যত বড় হুমকিই দিক তত্ত্বাবধায়ক, ছোট বোনের হাত পোড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।

পুলিশকে জানানো দরকার, রবিন বলল।

 মাথা সোজা করল মারলা। পাগল হয়েছ?

না, হইনি। একটা অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে গিয়েই আজ আমাদের এই অবস্থা। কেউ মানসিক শান্তিতে নেই। বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবে না ঘটনাটার পর কোন একরাত শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছে কেউ। আর সেই অপরাধটা গোপন করার কারণেই চিঠি লিখে হুমকি দেয়ার সুযোগ পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক।

পুলিশকে জানালে এখন জেলে যেতে হবে, ভোঁতা গলায় বলল ড্যানি। তাতে আমার অন্তত আপত্তি নেই। কারও থেকে থাকলে সে গিয়ে আগে একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারো।

তোমার শাস্তিটাই সবচেয়ে বেশি হবে, ড্যানি, মারলা বলল। কারণ গাড়িটা তুমি চালাচ্ছিলে। লোকটাকে তুমি চাপা দিয়েছ…

সেজন্যেই তো যেতে চাই। যতই দিন যাবে, মনের যন্ত্রণা বাড়বেই, শুধু, কমবে না। এই পনেরো দিনে সেটা ভালমতই বোঝা হয়ে গেছে আমার। কোন শাস্তির ভয়েই আর ব্যাপারটা গোপন রাখতে রাজি নই আমি।

কিশোর থাকলে আমাদের এই অবস্থা হত না, রবিন বলল। একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলত ও।

কি করত? ভুরু নাচাল ক্লডিয়া। এটা কোন রহস্য নয় যে তার সমাধান করবে। জলজ্যান্ত একজন লোককে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি। আমরা। কিশোর কি করবে? সবারই কমবেশি দোষ ছিল সেদিন। ড্যানি তো বলেইছিল, কনসার্ট শুনে মাথা গরম হয়েছিল ওর, চেঁচামেচিতে কানের মধ্যে ঝা-ঝা করছিল, তারপরেও ওকে গাড়ি চালাতে দিলাম কেন? দিলাম তো দিলাম, শান্তভাবে চুপচাপ বসে থাকলেই পারতাম। এমন হট্টগোল শুরু করলাম গাড়ির মধ্যে, এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগলাম, স্যান্ডউইচ নিয়ে খাবলাখাবলি শুরু করলাম যেন জীবনে খাইনিঃ…এবং তার ওপর হেডলাইট না। জেলে অন্ধকারে গাড়ি চালানোর বাজি..

থাক, ওসব স্মৃতিচারণ করে আর লাভ নেই এখন, বাধা দিল রবিন। ভাবলেও রাগ লাগতে থাকে। বরং ড্যানির ব্যাপারটা নিয়ে কি করা যায় তাই বলো।

যদি মনে করো, ক্লডিয়া বলল, তত্ত্বাবধায়কের কথা না শুনলে সত্যি সে কোন অঘটন ঘটাবে, তাহলে পুলিশের কাছে যাওয়াই ভাল।

ঘটায় কিনা সেটা দেখলে কেমন হয়? প্রস্তাবটা ড্যানিই দিল।

সত্যি দেখতে চাও?

চাই বলাটা ভুল হবে। হুকুম যা দিচ্ছে তাতে তো পরিষ্কার সে একটা উন্মাদ। কোন সুস্থ লোক এসব করার কথা বলতে পারত না। কাপুরুষ বলো আর যা-ই বলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়াই উচিত এখন। আমার, তত্ত্বাবধায়কের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কোথায় গেছি জানতেও পারবে না সে, ক্ষতিও করতে পারবে না।

.

০৬.

পুরানো প্রিয় জায়গায় ফিরে যেতে ভাল লাগে মানুষের। বিশেষ করে সেই জায়গাটা যদি কোন কারণে তার কাছে নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাহলে আকর্ষণ যেন আরও বেড়ে যায়। রকি বীচে ফিরে অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে কখন যে স্কুলের স্টেডিয়ামের কাছে চলে এল মুসা, নিজেও বলতে পারবে না। বাইরে গাড়ি রেখে মাঠে ঢুকল। বাস্কেটবল খেলতে তাকে আপাতত বারণ করে দিয়েছেন ডাক্তার। তবে এটাও বলেছেন, মেরুদণ্ড ব্যথা করলেও হালকা ব্যায়ামে কোন অসুবিধে হবে না। ভাল দৌড়াতে পারে সে। মানে, পারত। কোয়ার্টার মাইল আর হাফমাইলে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এখনও কি শরীরের সে-ক্ষমতা অটুট আছে?

শার্ট-প্যান্ট-জুতো খুলে রেখে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে মাঠের একধার থেকে দৌড়ানো শুরু করল সে। প্রথমে খুব ধীরে। গতি বাড়তে লাগল। ছন্দময় পদক্ষেপ। দেখতে দেখতে গতি উঠে গেল অনেক।

জোরে জোরে দম ফেলছে। কিন্তু পরিশ্রম লাগছে না। বাহ্, ভালই তো পারছে। যেন মুক্তির আনন্দ। ডানাভাঙা পাখির ডানা ফিরে পাওয়ার মত। মন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দুশ্চিন্তা। বিষণ্ণতা কেটে যাচ্ছে।

এক মাইল দৌড়াল সে-দুই মাইল:-তিন-চার…

থামল যখন, দেহের প্রতিটি পেশি অবশ হয়ে গেছে। ঘামছে দরদর করে। হেঁটে চলে এল মাঠের ধারে একটা গাছের নিচে। সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। আকাশ দেখতে পাচ্ছে। নীল, পরিষ্কার আকাশ। মন উড়ে গেল যেন সুদূর মহাশূন্যে। ভেসে বেড়াতে লাগল শরীরটা।

ঘুম ভাঙলে দেখল আকাশের নীল রঙ ধূসর হয়ে গেছে। ঝলমলে রোদ হারিয়ে গেছে বহু আগে। তারা ফুটবে এখনই। অন্ধকারের দেরি নেই। কি কাণ্ড! সারাটা দিন গাছের নিচে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল, অথচ মনে হচ্ছে এই তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে শুয়েছে।

উঠে বসল। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। ব্যথা করছে সর্বাঙ্গ। এত ঘুমিয়েও ঝরঝরে হয়নি। তবে দুশ্চিন্তা করল না সে। ব্যায়ামে দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আবার হঠাৎ শুরু করলে এরকমই হয়। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল কাপড়গুলো যেখানে ফেলে গিয়েছিল সেখানে। পরে নিল। ধীরেসুস্থে করছে সবকিছু। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। দিনটা.তো কাটাল। এখন কি করবে? যাবে কোথায়? বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভাবতে ভাবতে চলে এল। গাড়ির কাছে।

স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে উঠে বসল। পা দুটো আড়ষ্ট লাগছে। মাথা ধরেছে। গাড়িতে ওষুধের শিশি আছে। ব্যথা পাওয়ার পর থেকে টাইলিনল ট্যাবলেট রাখে সঙ্গে। শিশিটা বের করে দুটো ট্যাবলেট নিয়ে মুখে পুরল। চিবিয়ে গুড়ো করে পানি ছাড়াই গিলে ফেলল তেতো ওষুধ। শিশিটা আবার রাখতে গিয়ে হাতে ঠেকল একটা কাগজের টুকরো। ফেলে দেয়ার জন্যে বের করে আনল। স্ট্রীটল্যাম্পের হ্যালোজেন লাইটের আলোয় লেখার ওপর চোখ পড়তেই কাগজধরা আঙুল দুটো শক্ত হয়ে গেল। ক্রিসি ট্রেভারের ঠিকানা আর ফোন নম্বর।

ঘড়ি দেখল। মোটে সাতটা বাজে। কানে বেজে উঠল ক্রিসির কণ্ঠ: বিকেলের পর আর বেরোই না আমি। তোমার ম্যাসাজ দরকার হলে ওই সময়টায় এসো।

কিন্তু আজ শনিবার। ওর মত অল্পবয়েসী একজন মহিলা কি ছুটির সন্ধ্যায় ঘরে বসে থাকবে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে না যাক, সিনেমায়ও তো চলে যেতে পারে? যাওয়ার আগে ফোন করে নেয়া দরকার।

গাড়ি চালিয়ে সবচেয়ে কাছের ফোন বুদটায় এসে ক্রিসির নম্বরে ডায়াল করল সে।

তৃতীয় রিঙে ধরল ক্রিসি। বাড়িতেই আছে। হালো?

ক্রিসি? আমি মুসা।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল ক্রিসি। তারপর ভেসে এল তার উচ্ছল কণ্ঠ, হাই, মুসা। কেমন আছ?

ভাল। আপনি কেমন?

 ভাল। একা একা ঘরে বসে অবশ্য বিরক্ত লাগছে। কি করছ?

একা একা রাস্তায় ঘুরতে আমারও ভাল লাগছে না। দিনের বেলা খুব দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। ব্যথা করছে।

তারমানে ম্যাসাজ লাগবে? হাসল ক্রিসি। নো প্রব্লেম। চলে এসো।

যে মলে ওদের দেখা হয়েছিল তার কাছাকাছিই একটা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকে ক্রিসি। মুসা বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল। কালো প্যান্ট আর সাদা ব্লাউজ পরেছে। নার্সের সাদা পোশাকের চেয়ে এই কাপড়ে অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে ওকে। সবুজ চোখে উজ্জ্বলতা। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে আন্তরিক হাসি।

এসো, ভেতরে এসো, দরজা থেকে সরে জায়গা করে দিল ক্রিসি। নোংরা করে রেখেছি। কিছু মনে কোরো না।

ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল মুসা। নোংরাটা কোথায় বুঝতে পারল না। কেবল একটা কফি-টেবিলে পড়ে থাকা দুটো পেপারব্যাক বইয়ের পাশে রাখা একটা কফির পট আর একটা মগে আধমগ কফি ছাড়া। ঘরের সমস্ত আসবাব বেশ উঁচু মানের। ক্রিসির বাবা-মা মনে হয় খুব ধনী। টাকা দিয়ে তারাই বোধহয় সাহায্য করে। হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে এত বিলাসিতায় বাস করা সম্ভব নয়।

কেমন একটা বিচিত্র ধোয়া ধোয়া গন্ধ ঘরের বাতাসে। কোন ধরনের সুগন্ধী? বুঝতে পারল না মুসা।

ওর মুখ দেখেই অনুমান করে ফেলল যেন ক্রিসি, বোঝা যায়?

যায়। কিসের? মশার কয়েল?

না না, কয়েলের এত ভাল গন্ধ হয় নাকি। ও তো দম আটকে দেয়। এটা ধূপের গন্ধ। ইনডিয়ায় খুব ব্যবহার এটার, জানো: বোধহয়। মশা তাড়াতে কাজ করে ধূপের ধোয়া। আরও নানা কাজে, বিশেষ করে দেবদেবীর পূজায় ব্যবহার করে ওরা এই জিনিস।

এখানে তো মশা নেই। আপনি কিসের পূজা করেন?

হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ক্রিসি। করি যেটারই হোক। কফি খাবে?

 দিতে পারেন। মাথাটা খুব ধরেছে।

দুধ দিয়ে না দুধ ছাড়া?

 দুধ দিয়ে। চিনি দেবেন বেশি করে যাতে তেতোটা না থাকে।

রিফ্রিজারেটরের দিকে ঘুরল ক্রিসি। আমি খাই খুব কড়া। দুধ চিনি ছাড়া। আর এত গরম, জ্বলতে জ্বলতে ভেতরে নামে। কি, অবাক লাগছে শুনতে? হাসপাতালের সব নার্সই এরকম খায়। নাইট ডিউটি করতে হয় যে।

হাসপাতালে আসলে কাজটা কি করেন আপনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এই নানা রকম টুকটাক কাজ, দুধ আর চিনি বের করে আনল ক্রিসি। একটা কাপও আনল। পট থেকে কফি ঢেলে তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে ঠেলে দিল মুসার দিকে। বাজে চাকরি। ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমি।

সেটা কি ঠিক হবে?

মুসার মুখোমুখি বসল ক্রিসি। সবুজ চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, কেন হবে না?

 ঘরের জিনিসপত্রের দিকে ইঙ্গিত করল মুসা, বেতন তো ভালই পান মনে হচ্ছে। নাকি বাবার টাকা আছে?

বাবার টাকাই বলতে পারো, মগ তুলে কফিতে চুমুক দিল ক্রিসি। দেখা হওয়ার পর থেকেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। তুমি ফোন করবে জানতাম।

কি করে জানলেন?

অনুমান। খেলোয়াড়রা চায় ওষুধপত্র খেয়ে, ম্যাসাজ করে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ আর ব্যথা কমিয়ে ফেলতে। খেলার মাঠ ছাড়া থাকতে পারে না তো।

হেসে ফেলল মুসা। ঠিকই বলেছেন। এখন কোত্থেকে এসেছি জানেন? মাঠ থেকে। দিনের বেলা এমন দৌড়ান দৌড়েছি…তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম গাছের নিচে। এক ঘুমে পার করে দিয়েছি সারাটা দিন।

হাসল ক্রিসি। কফিটা শেষ করো। তারপর শুরু করছি।

.

০৭.

পার্ক থেকে ফেরার পর গুম হয়ে বাড়িতে বসে রইল রবিন। একা বাড়িতে কিছুই ভাল লাগছে না। খেতে ইচ্ছে করছে না। টিভি দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি বই পড়তেও ভাল লাগছে না। না খেলে শরীর ভেঙে পড়বে। তাই সামান্য কিছু মুখে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মুসার মতই আগের রাতটায় তারও ঘুম হয়নি।

বিকেলে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। ক্লান্ত, ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল। হালো?

ওপাশের কণ্ঠটা শুনে সচকিত হয়ে উঠল মুহূর্তে। কিশোর! ফিরেছ! কখন?

এই তো খানিক আগে। মুসাদের বাড়িতে ফোন করলাম। পেলাম না। ও কোথায়, জানো নাকি?

কিশোর, উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে রবিন। অনেক কথা আছে। তুমি তো ছিলে না, জানোও না। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। এখুনি। ইয়ার্ডে আসছি আমি। তুমি কোথাও বেরিয়ো না।

এসো। বেরোব না।

.

হু, ভাল বিপদেই পড়েছ! আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। পুলিশের কাছে না যাওয়াটাই বোকামি হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ভুল। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের কাছে গিয়ে খুলে বলতে পারতে।

কি করব? রবিন বলল। সবাই এমন বিরোধিতা শুরু করল, বাধা দিতে লাগল, কিছুই করতে পারলাম না। অ্যাক্সিডেন্টটা করে ড্যানি তো পুরোপুরি বোকা হয়ে গিয়েছিল। কথাই বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে।

স্যালভিজ ইয়ার্ডে জঞ্জালের নিচে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে মুখোমুখি বসে আছে দুজনে। কিশোর বসেছে ডেস্কের ওপাশে তার চেয়ারে। অন্যপাশে একটা টুলে পিঠ বাকা করে বসেছে রবিন।

ওই সব ঘোড়ার ডিম কনসার্টগুলো এই জন্যেই আমার ভাল লাগে না, মুখ বাকিয়ে বলল কিশোর। কোন আনন্দ তো নেইই, যত রাজ্যের হট্টগোল আর পাগলামি। গায়কদের দেখে মনে হয় না ওরা কোন সুস্থ লোক। সব যেন উন্মাদ। ওসব দেখে বেরোলে কোন লোকের মাথা ঠিক থাকে? ড্যানি তো সহ্য করতে পারে না জানোই, গাড়ি চালাতে দিলে কেন?

সেটাও হয়ে গেছে আরেক বোকামি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। যা হবার তা হয়েছে। এখন কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, তাই বলো? পুলিশের কাছে যাব?

ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। কয়েক সেকেন্ড পর মাথা ঝাঁকাল, যেতে তো হবেই। সঙ্গে সঙ্গে গেলে শুধু ড্যানির। শাস্তি হত, জেলে যেত সে একা। তবে তোমরা বেঁচে যেতে…

সেজন্যেই তো গেলাম না।

কিন্তু এখন সবাইকে জেলে যেতে হবে। ড্যানি যাবে অ্যাক্সিডেন্ট করে খুন করার অপরাধে, আর তোমরা যাবে লাশ গুম করতে তাকে সহযোগিতা আর সত্য গোপন রাখার অপরাধে। বাঁচতে আর কেউ পারবে না।

না পারলে নেই। জেলে গিয়ে বসে থাকা বরং অনেক ভাল। একে তো অপরাধ করে মানসিক চাপে ভুগছি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই তত্ত্বাবধায়কের যন্ত্রণা। সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। শীঘ্রি এ থেকে মুক্তি না পেলে পাগল হয়ে যাব।

চুপ করে ভাবতে লাগল কিশোর।

অধৈর্য হয়ে উঠল রবিন, কি ভাবছ?

উ! ঠোঁট থেকে আঙুল সরাল কিশোর। পুলিশের কাছে তো যেতেই হবে। ভাবছি, নিজেরা আগে একবার তদন্ত করে দেখলে কেমন হয়।

কি তদন্ত করবে?

 এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা যদি তোমাদের কেউ না হয়ে থাকে তাহলে বাইরের লোক। অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা সে জানে। আমার প্রথম প্রশ্ন: কি করে জানল? তোমাদের মধ্যে মুখ ফসকে কেউ বলে ফেলেছে অন্য লোকের সামনে। তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে খুন হওয়া লোকটার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়কের কোন সম্পর্ক ছিল। কিংবা অ্যাক্সিডেন্টটা সেরাতে ঘটতে দেখে। ফেলেছে সে।

না, দেখেনি, আমি শিওর। ওই সময় ত্রিসীমানায় কোন লোক কিংবা গাড়ি দেখা যায়নি। কেউ ছিল না।

তাহলে জানল কি করে? বেশ, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, যেভাবেই হোক জেনেছে…

জেনেছে তাই বা কি করে বলব? চিঠিতে তো উল্লেখ করেনি। কেবল লিখেছে: তোমাদের গোপন কথাটা আমি জানি। অনেক ব্ল্যাকমেইলারই একরম আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে কামিয়াব হয়ে যায়, সেজন্যেই বলে এমন করে।

তা হয়। কিন্তু আমাদের এই বিশেষ লোকটি আসল কথাটা জানে না এটা ভেবে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ও জানতেও পারে। তত্ত্বাবধায়ককে খুঁজে বের করতে হলে এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে সেই মৃত লোকটার পরিচয়। জানা। এমনও হতে পারে লোকটাকে ড্যানি খুন করেনি। ত্রিসীমানায় আর কোন গাড়ি দেখোনি বলছ। এমনও হতে পারে আগেই তাকে খুন করে এনে রাস্তার ওপর ফেলে রেখেছিল কেউ। এবং সেই কেউটা হতে পারে এই তত্ত্বাবধায়ক। কেবল এইভাবেই তোমাদের কথা তার জানা সম্ভব।

এতক্ষণে হাসি ফুটল রবিনের মুখে। এই না হলে কিশোর পাশা। এতদিন ধরে এই সহজ কথাটা ওদের কারও মাথায় আসেনি। তাহলে এই সম্ভাবনার কথাটা আমরা গিয়ে পুলিশকে বললেই তো পারি?

না, মাথা নাড়ল কিশোর, আমি বিশ্বাস করছি বলেই যে ওরাও করবে, তা না-ও হতে পারে। করাতে হলে এর স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা দরকার।

কি করে করবে? কোন সূত্রই তো নেই।

পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ওদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি। গত এক মাসে যত লোক নিখোঁজ হয়েছে, তাদের লিস্ট বের করব। ওদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করব আমাদের বিশেষ লোকটাকে। এখন ওর চেহারা-সুরৎ সম্পর্কে যতটা পারো, জানাও আমাকে। কবর দেয়ার আগে দেখেছ তো?

মাথা ঝাঁকাল, রবিন। যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে লোকটার চেহারার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করুল রবিন। বয়েস সাতাশ-আটাশ, ককেশিয়ান, সুদর্শন। গায়ে। ছিল তামাটে স্পোর্টস কোট আর হালকা বাদামী স্ন্যাকস।

হু, চমৎকার, একটা পেপারওয়েট নিয়ে উল্টো করে গোল মাথাটা টেবিলে রেখে ঘোরাতে লাগল কিশোর। আচ্ছা, ড্যানি সত্যি সত্যি শহর ছেড়ে চলে যাবে তো?

তাই তো বলল।

 কোথায় যাবে কাউকে কিছু বলেছে?

জানি না। মুসাকে বলতে পারে। ওর সঙ্গে খাতির বেশি।

না বললেই ভাল করবে, পেপারওয়েটটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল কিশোর।

কেন? মুসা মরে গেলেও কাউকে বলবে না।

জবাব না দিয়ে আচমকা উঠে দাঁড়াল কিশোর। চলো, বেরোই। পুলিশ। অফিসে যেতে হবে।

.

০৮.

 রকি বীচ পুলিশ স্টেশনের কম্পিউটার রূমটা বেশ সাজানো-গোছানো। ঢোকার মুখে ডেস্কে বসে কাজ করছেন একজন অফিসার। তিন গোয়েন্দাকে চেনেন। কম্পিউটার থেকে কিছু তথ্য নিতে চায় জানাল কিশোর।

কেন, কোন কেসের তদন্ত করছ নাকি?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।

কি কেস?

এখনও বলার সময় আসেনি।

কিশোর পাশার স্বভাব জানা আছে অফিসারের। হেসে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দিলেন।

ঘরটা এখন খালি। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। কোন কাজ না পড়লে, অর্থাৎ তথ্যের দরকার না হলে কেউ ঢোকে না এখানে। সারাক্ষণ বসে ডিউটি দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

ঢুকেই রবিনের উদ্দেশ্যে লেকচার শুরু করল কিশোর, কম্পিউটার হলো আগামী প্রজন্মের ডিটেকটিভ। সঠিক প্রোগাম আর সঠিক ডাটা সরবরাহ করতে পারলে যে কোন ধাঁধার জবাব দিয়ে দিতে পারে কম্পিউটার। রহস্য সমাধান করতে চাইলে এর চেয়ে যোগ্য গোয়েন্দা আর কোথাও পাবে না। এর জন্যে কয়েকটা প্রোগ্রামও লিখেছি আমি। আমার নিজস্ব উদ্ভাবন। কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছিলাম। পেয়ে গেছি আজ। আমি যেটা ব্যবহার করব, একধরনের ফিল্টার বা ছাঁকনি বলতে পারো একে। আসল লোকটাকে ছাড়া বাকি সব বাদ দিয়ে দেবে। এটা করতে পারা খুব জরুরী। সময় বাঁচবে অনেক। প্রতিমাসে লস অ্যাঞ্জেলেসে কত লোক যে নিখোঁজ হয়, হিসেবটা শুনলে তুমি আঁতকে উঠবে।

যায় কোথায় ওরা? জানতে চাইল রবিন।

কোথায় আর যাবে? বেশির ভাগই পালায়। অসুখী স্বামী কিংবা স্ত্রী। পালিয়ে বাঁচে।

হুহ

হাসছ?

তো কি করব? খুনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। এদের কেউ কেউ খুনও হয়ে যায়। এখানকার কেসফাইলগুলো যদি সব পড়তে তাহলে হাসি মুছে যেত মুখ থেকে। মনে হত দুনিয়াটা বড় বিশ্রী জায়গা। এখানে হাসির কিছু নেই।

তোমার লেকচারটা একটু থামাও না দয়া করে।

 কেন, ভাল লাগছে না?

 মানুষের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে আমার ভাল লাগে না।

বলো কি! মানুষ নিয়ে গবেষণা করাটাই তো সবচেয়ে মজার। এত রহস্যময় আর বিচিত্র প্রাণী সারা দুনিয়ায় আর একটাও খুঁজে পাবে না তুমি। মানুষ যে কি করে আর করে নাঃ অত

 দোহাই তোমার, কিশোর, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে দুহাত তুলল রবিন, কচকচি ভাল্লাগছে না! যা করতে এসেছ, করো।

চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে মাথা দোলাল কিশোর, হু, তোমার মনমেজাজ এখন খুব খারাপ। দুশ্চিন্তায় ভরা। এসব কথা এখন তোমার ভাল লাগবে না।

একটা কথা সত্যি করে বলো তো। মানুষ জাতটাকে কি তুমি পছন্দ করো না?

করব না কেন? নিজেও তো মানুষ। মানুষের স্বভাব জানার এত আগ্রহ কেন আমার জানো? ওদের সাহায্য করার জন্যে। মানুষ যেসব অপরাধ করে, কেন করে সেটা যদি না জানো, ভাল গোয়েন্দা তুমি কোনদিনই হতে পারবে না।

একটা কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসে পড়ল কিশোর। নিখোঁজ মানুষদের ফাইলটা খোলার নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে। যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল রবিন, ফাইল খুলতে তারচেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে দিল কম্পিউটার। ফাইলগুলো সব একজায়গায় নেই। বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবগুলোকে জোগাড় করে একখানে এনে খুলতে সময় লাগবেই। অপেক্ষা করতে হবে।

নামগুলো সব লাইন দিয়ে ফুটে উঠলে এক এক করে বাছাই শুরু করল কিশোর। রাশি রাশি নাম থেকে বাছাই করে রাত এগারোটায় ছয়টা নামে এনে ঠেকাল। কমে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দুজনেই।

এবার কি করবে? জানতে চাইল রবিন।

দুটো কাজ, দুই আঙুল তুলল কিশোর। এক, ফোন বুক দেখে ঠিকানা জেনে নিয়ে ওদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। হয়তো দেখা যাবে ছয়জনের মধ্যে কয়েকজনই আর নিখোঁজদের মধ্যে নেই, বাড়ি ফিরে গেছে। তালিকা থেকে বাদ যাবে ওরা। আরও কমে আসবে নিখোঁজের সংখ্যা। দ্বিতীয় কাজটা করতে পারি পত্রিকা দেখে। বিজ্ঞাপনের পাতার নিখোঁজ সংবাদে ওদের নাম-ঠিকানা দিতে পারে। তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। মাইক্রোফিল্ম করে কম্পিউটারে ভরে রাখা প্রতিটি পাতা দেখে দেখে ওই ছয়জনের নাম-ঠিকানা বের করতে সারারাতও লেগে যেতে পারে। তারপরেও কথা আছে, যদি পত্রিকায় থাকে। নইলে কষ্টটাই সার হবে।

কিন্তু এখন তো বাজে রাত এগারোটা। এত রাতে মানুষের বাড়িতে ফোন করবে?

 উপায় কি? সময় এখন অতি মূল্যবান। কথা না বলে এসো হাত লাগাও। সেরে ফেলি। পত্রিকায় খোঁজার চেয়ে ডিরেক্টরিতে খোঁজাই সহজ হবে।

আসলেই সহজ হলো। পনেরো মিনিটেই ছয়জনের মধ্যে চারজনেরই ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। দেরি না করে ফোন শুরু করল। প্রথমজন কিশোর দুটো কথা বলার আগেই ফোন রেখে দিল। দ্বিতীয়জন মহিলা। নিখোঁজ লোকটার কথা বলতেই কাঁদতে শুরু করল। শিকারে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তার স্বামী। কয়েকদিন পর ভালুকের গুহার সামনে পাওয়া যায় তার। ক্ষতবিক্ষত লাশ। তৃতীয়জনও মহিলা। তার বাড়ির নিখোঁজ লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতেই রেগে উঠল। জানাল, আরেক মহিলার কাছে চলে গেছে। তার স্বামী। খোঁজ পাওয়া গেছে। চতুর্থ নম্বরটায় রিঙ হয়েই চলল, হয়েই চলল। ধরল না কেউ।

কয়েকবার চেষ্টা করে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মনে হয় বাড়ি নেই। দেখা যাক, খানিক পরে আবার করব।

বাকি দুজন?

নামের তালিকার দিকে তাকাল কিশোর। ডেভন ব্রেক আর ইয়ান জোসেফ। ডিরেক্টরিতে তো পেলাম না।

ভুরু নাচাল রবিন, কি করবে?

 ডিরেক্টরিতে যখন পেলাম না, পত্রিকাতেই দেখতে হবে।

খুব বেশিক্ষণ লাগল না প্রথম নামটা বের করতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডেভন ব্রেকের ওপর লেখা একটা প্রতিবেদন পেয়ে গেল রবিন। ছবি সহ। দেখেই চোখ কপালে। সেই চেহারা। মরুভূমিতে চিত হয়ে পড়ে থাকা লাশের মুখটা ভেসে উঠল কল্পনায়। একই পোশাক। তামাটে রঙের স্পোর্টস কোট। যেটা সহ ওকে কবর দিয়েছিল ওরা। ছবির সঙ্গে লাশটার তফাত কেবল ওটার ঠোঁটের কোণে রক্ত ছিল, এটার নেই। কম্পিউটারের পর্দার, দিকে কাঁপা কাঁপা তর্জনী তুলে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এই সেই লোক!

তুমি শিওর?

ঢোক গিলল রবিন, এই চেহারা জীবনে ভুলব না।

প্রতিবেদনটা একই সঙ্গে পড়তে শুরু করল দুজনে। লিখেছে:

‘ব্যবসায়ী নিখোঁজ

তেত্রিশ বছর বয়স্ক ডেভন ব্রেক, একজন দোকানদার, সাত দিন ধরে নিখোঁজ। সান্তা মনিকার স্থায়ী অধিবাসী তিনি। দোকানটা তাঁর বাবার। প্রায় বাইশ বছর চালিয়েছেন। গানের ক্যাসেট, রেকর্ড, এসব বিক্রি হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলে দোকান চালাত। তাঁর মা মিসেস ড্রেক একজন টীচার। অবসরে সমাজ-সেবার কাজ করেন। ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াতে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। হুট করে কোথায় গেছে, বা কোথায় যেতে পারে তাঁর ছেলে, এ সম্পর্কে কোনই ধারণা নেই তার। ওয়েস্টউড বুলভারে তাদের বাড়ি। গত দশ বছর ধরে সমাজ-সেবার কাজ করে আসছেন মহিলা। তাদের বিরুদ্ধে। কখনও কোন অভিযোগ শোনা যায়নি, কেউ কখনও বদনাম করেনি। ডেভন ব্রেকের কোন খোঁজ যদি কারও জানা থাকে, দয়া করে নিচের ঠিকানায় খবর দিলে বাধিত হবেন মিসেস ব্রেক।‘

চেয়ারে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল রবিন, তারমানে ভাল মানুষটাকে খুন করলাম আমরা।

তোমরাই তার মৃত্যুর কারণ কিনা এখনও জানো না, কিশোর বলল। বলেছি না, এমনও হতে পারে আগেই তাকে কেউ খুন করে নিয়ে গিয়ে মরুভূমির ধারের ওই রাস্তায় ফেলে এসেছিল।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, গোপনে ওকে কবর দেয়াটা যে কত দিক থেকে ভুল হয়ে গেছে: ইস! পুলিশকে যদি জানাতাম, মহিলা জেনে যেতেন এতদিনে তার ছেলের কি হয়েছে। ইস্, মহিলা নিশ্চয় রোজ ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। তার ছেলে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না জানলে এই পথ চাওয়ার কষ্ট থেকে বাঁচতেন।

আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না লোকটাকে তোমরা খুন করেছ। ও চাপা পড়ার সময় চিৎকার শুনেছ?

না। চিৎকার করার কোন সুযোগই হয়তো পায়নি সে।

যে ভাবে চাপা পড়েছে বলছ, তাতে মনে হয় রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ করে চাকার নিচে চলে এসেছিল সে। সেটা কি সম্ভব? ভেবে দেখো, হাঁটার সময় কারও গায়ে ধাক্কা লাগলে শব্দ হবে, লোকটা চিৎকার করবে সেসবও কোন কিছুই শোনোনি তোমরা।

গাড়ির মধ্যে এত বেশি চেঁচামেচি করছিলাম আমরা, শোনার সুযোগই ছিল না…

কি জানি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একটা ভুলের শিকার হয়েছ তোমরা। ভয় তোমাদের স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতাও নষ্ট করে দিয়েছে। যেহেতু কবর দিয়ে ব্যাপারটা গোপন করে ফেলেছ, ওর মাকে কষ্ট দিয়েছ, সেটা পূরণের এখন সবচেয়ে ভাল উপায় হলো আসল খুনীকে ধরে আদালতে সোপর্দ করা। রাত দুপুরে ওই মরুভূমিতে কি করতে গিয়েছিল তার ছেলে, সেটা জানতে হবে আগে।

কিছুটা শান্ত হলো রবিন। কি করে জানব কে খুন করেছে?

অবশ্যই তদন্ত করে। আজ রাতে আর কিছু করার নেই আমাদের। বাড়ি গিয়ে ভালমত একটা ঘুম দাও। কাল সকালে উঠে ব্রেকের দোকানে যাব। ঠিকানা যখন জেনে গেছি, খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে না। ওর মার। সঙ্গে দেখা করে কথা বলব।

কি লাভ হবে? নিখোঁজ সংবাদটা দেখে তো মনে হয় না ছেলে কোথায় যেতে পারে এ ব্যাপারে মিসেস ব্রেকের কোন রকম ধারণা আছে।

অনেক সময় জানলেও চেপে যায় মানুষ। নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এমন সব কারণ থাকে, যেগুলো লজ্জা কিংবা অস্বস্তিতে পড়ার ভয়ে ফাস করতে চায় না। যে নিখোঁজ হয়েছে তার খোঁজ পাওয়ার জন্যে যতটুকু দরকার, তার বেশি বলে না। রবিনকে কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটা থেকে সরিয়ে তাতে বসল কিশোর। আবার খুলল ডেভন ব্রেকের ফাইলটা। হাতের তালুতে থুতনি রেখে পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল।

কি দেখছ? জানতে চাইল রবিন।

জবাব না দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কনসার্টের দিনটা কত তারিখ। ছিল?

জুলাইর শেষ দিন। একতিরিশ।

কিন্তু এই প্রতিবেদনটার তারিখ দেখো। জুলাইর মাঝামাঝি। বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে তোমরা ওকে ধাক্কা দেয়ার দুই হপ্তা আগে। ওর ঠোঁটের কোণে তাজা রক্ত দেখেছ তোমরা। তারমানে মারা গেছে সে একতিরিশ তারিখেই। বাড়ি থেকে বেরোনোর প্রায় পনেরো দিন পর।

ইনটারেসটিং তো!

গুড। মাথায় তাহলে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। আমি ভাবছি ওই দুটো হপ্তা কোথায় ছিল ডেভন? কার সঙ্গে? পর্দার দিকে আঙুল তুলল কিশোর। যেন জবাব চায় কম্পিউটারের কাছে। সেটা জানলে খুনী কে সেটাও জানতে পারব সহজেই।

*

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিশোর কোথায় যাবে জানতে চাইল রবিন। কিশোর বলল, রকি বীচে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে। গোস্ট লেনে ওদের বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করল রবিন। কিশোর বলল, জরুরী কাজ আছে। সকালে উঠেই তাকে বেরোতে হবে। গোস্ট লেন থেকে বেকায়দা। রকি বীচে যাওয়াই ভাল।

আর কিছু বলল না রবিন। চুপচাপ গাড়ি চালাল।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কিশোর, আংকেলরা কবে ফিরবেন?

দেরি হবে।

হু

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার রবিন কথা বলল, কিশোর, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চিঠিতে আমার নাম নেই। গাড়িতে সেরাতে আমরা যারা যারা ছিলাম, তাদের মধ্যে শুধু আমার নামটাই নেই।

ঝট করে সোজা হলো কিশোর। আগে বলোনি কেন?

ভুলে গিয়েছিলাম। কেন লিখল না বলো তো? এত কিছু যখন জানে তত্ত্বাবধায়ক, নিশ্চয় জানে আমি কে?

তা তো জানেই। সব জানে সে। সেজন্যেই তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।

কেন?

নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে ওর। অকারণে করছে না এসব। আমি শিওর, কারণটা ভয়ানক কিছু।

Super User