০৬.

ছায়া থেকে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল মুর্তিটা।

অবাক হলো কোরি। মিস্টার মেলবয়েস!

ঢিবির মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন তিনি। ধবধবে সাদাঁ পোশাকে ভূতুড়ে লাগছে তাঁকে। ভয়টা এখনও কাটেনি কোরির। বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যি মানুষ কিনা। পরীক্ষা করার জন্যে হাত নেড়ে ডাকল, আসুন না?

অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে নেমে আসতে শুরু করলেন ব্যারন। খাওয়া বন্ধ করে মুসাও তাকিয়ে রয়েছে হাঁ করে। ভূত বুঝলে দেবে দৌড়।

কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। হাতে একটা মদের বোতল। আরেক হাতে গ্লাস।

আন্ট জোয়ালিন এসেছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল কোরি।)

না, জবাব দিলেন ব্যারন। লঞ্চ এসেছে, কিন্তু তোমার আন্টি আসেননি। অত ভয়ের কিছু নেই। সামান্য পেটব্যথা তো, সেরে যাবে। আরও একআধ দিন বোনের ওখানে কাটিয়ে আসার ইচ্ছে।

কিন্তু ফোন করল না কেন?

সকালে ফোন যখন খারাপ ছিল তখন হয়তো চেষ্টা করেছে। ফোন খারাপ ভেবে পরে আর করেনি। আজ রাতটা যাক, তাকে আর বিরক্ত করব না। কাল সকালে যদি না করে আমরাই খোঁজ নেব। প্রসঙ্গটা বাদ দেয়ার জন্যে খাবারগুলোর ওপর চোখ বোলালেন তিনি। বাহ, উলফ তো নাস্তাটাস্তা ভালই দিচ্ছে তোমাদেরকে।

হেসে জবাব দিল কিশোর, নাস্তা নয়, একেবারে ভূরিভোজ।

উলফ কিন্তু আমাদের বাবুর্চি নয়। বাবুর্চির নাম মনিকা। আগামী শুক্রবারের আগে আসবে না। মৃদু হেসে বললেন ব্যারন, এত কাজ একহাতে করতে হচ্ছে বলে অভিযোগের পর অভিযোগ করে চলেছে উলফ। তবে রান্না করতে তার খারাপ লাগছে না এটাও বুঝতে পারছি।

সে তো বোঝাই যাচ্ছে, রুটি চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। কিন্তু এত বেশি পেট ভরিয়ে রাখছে আমাদের, আলসে হয়ে যাচ্ছি। কাল কোন কাজই করতে পারব না।

হ্যাঁ, দশ পাউন্ড ওজন বেড়ে গেছে আমার, কোরি বলল।

ভয় নেই, কালই সেটা খসিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করব, হেসে বললেন ব্যারন। চাদরের একধারে বসে বোতল থেকে মদ ঢাললেন গ্লাসে। গ্লাসটা তুলে ধরলেন ওদের দিকে। তোমাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

 লম্বা চুমুক দিলেন গ্লাসে। গম্ভীর হয়ে বললেন, মিলারও আমাদের সঙ্গে থাকলে এখন ভাল হতো, আচমকা বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। কত করে বললাম আসতে। এল না।

আপনার ভাই কি অসুস্থ? জানতে চাইল কিশোর।

প্রশ্নটা যেন অবাক করল ব্যারনকে। অসুস্থ? মোটেও না। অতিমাত্রায় বিষণ্ণ। আমরা মেলবয়েসরা এমনিতেই একটু খেয়ালী।

শুনেছি আমি, রবিন বলল। ব্ল্যাক ফরেস্টের সবাই জানে আপনার পূর্বপুরুষদের কাহিনী। আমাদের বাড়ির চিলেকোঠা থেকে মেলবয়েস ম্যানসন দেখা যায়।

চোখ বুজে যেন পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলেন। মেলবয়েস। হ্যাঁ, অনেক গল্প আছে ওদেরকে নিয়ে। ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। চোখ মেলে তাকালেন রবিনের দিকে।

একঝলক হালকা বাতাস ওদের ঘিরে নেচে নেচে বয়ে গেল।

 রোজার মেলবয়েস কি আপনার দাদা ছিলেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আরেক চুমুক মদ খেলেন ব্যারন। না। আমার দাদার ভাই। আমার গ্রেট-আঙ্কেল।

তার নামে নাম রাখা হলো কেন আপনার? জানতে চাইল কোরি।

তার নামে রাখা হয়েছে কথাটা ঠিক না, বিচিত্র হাসি খেলে গেল ব্যারনের ঠোঁটে। চাঁদের আলোয় রহস্যময় দেখাল হাসিটা। আমার বাবার নামও ছিল রোজার।

পাইনবনে ডেকে উঠল কি একটা জানোয়ার। দীর্ঘ, বিষণ্ণ চিৎকার।

তাদের সম্পর্কে বলুন না কিছু, অনুরোধ জানাল কোরি। শোনার জন্যে সামনে ঝুঁকে বসল।

হ্যাঁ, বলুন না, রবিনও আগ্রহী হয়ে উঠল। আসলে কি ঘটেছিল গোস্ট লেনের সেই পুরানো প্রাসাদটাতে?

আমিও খুব বেশি কিছু জানি না, ব্যারন বললেন। আমার জন্মের বহু আগে ঘটেছিল সেসব ঘটনা। বালির ঢিবির ওপরে হোটেলটার দিকে তাকালেন তিনি। মিলার এলে ভাল হতো। এসব গল্প আমার চেয়ে ভাল বলতে পারত সে।

আপনি যা পারেন বলুন, শোনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন। পুড়ল কি করে বাড়িটা? রোজার মেলবয়েসের সম্পর্কে যা শোনা যায় সব কি সত্যি?

শব্দ করে হাসলেন ব্যারন। গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন চাদরে। সব কটা চোখ এখন তার দিকে। বাতাসে দুলে উঠে কাত হয়ে গেল মোমের শিখা। নিভু নিভু হলো, কিন্তু নিভল না।

রবিনের দিকে তাকালেন ব্যারন, তুমি নিশ্চয় শুনেছ, ব্ল্যাক ফরেস্টে প্রথম যারা বসতি করেছিল তাদের একজন ছিলেন আমার গ্রেট-আঙ্কেল রোজার মেলবয়েস। বিরাট ধনী ছিলেন তিনি। কোথায় পেয়েছিলেন এত, টাকা কেউ জানে না। কোথা থেকে ব্ল্যাক ফরেস্টে গিয়েছিলেন তিনি, তা-ও জানে না কেউ।

দেখতে তিনি কেমন ছিলেন? জিজ্ঞেস করল কোরি। আপনার মত?

তা-ও জানে না কেউ। আমাদের পরিবারের সবারই ছবি আছে, শুধু তাঁরটা বাদে। সেটাও আরেক রহস্য।

গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন তিনি। ঠোঁট চাটলেন। তারপর বললেন, বিশাল ওই প্রাসাদ শহর থেকে এতদূরে কেন বানালেন, সেটাও রহস্য। ব্ল্যাক ফরেস্টে তখনও আজকের মত শহর গড়ে ওঠেনি, ভাল কোন রাস্তা ছিল না। বনের মধ্যেই বাড়ি বানালেন তিনি। বাড়িতে যাওয়ার একটাই পথ ছিল, গাছপালার ভেতর দিয়ে সরু একটা রাস্তা। বাড়িটা বানানোর সময় শ্রমিকেরা। যাতায়াতের জন্যে নিজেরাই তৈরি করেছিল রাস্তাটা।

গোপনীয়তা পছন্দ করতেন নাকি? জানতে চাইল কিশোর।

নাঃ…অন্তত ব্ল্যাক ফরেস্টে আসার পর প্রথমদিকে তো নয়ই। বরং রোজার মেলবয়েস আর তার সুন্দরী স্ত্রী ভেরোনিকা ছিলেন শহরের প্রাণ। সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। প্রায়ই বড় বড় পার্টি দিতেন। লোক গমগম করত বাড়িতে। মোমের আলোয় কমলা রঙ লাগছে ব্যারনের চেহারা। মেলবয়েসরা খুব বিখ্যাত ছিল তখন। লোকে পছন্দ করত তাদের। শহরটার জন্যে অনেক করেছে। লাইব্রেরির জন্যে টাকা দিয়েছেন রোজার মেলবয়েস, ব্ল্যাক ফরেস্টের প্রথম হাসপাতালটা তার করা।

গ্লাসে চুমুক দেয়ার জন্যে থামলেন ব্যারন।

কোরির দিকে তাকাল কিশোর। হতাশা দেখতে পেল ওর মুখে। যেন ভয়াবহ কোন ভূতের গল্প আশা করেছিল সে।

রোজার আর ভেরোনিকার দুটো খুব সুন্দরী মেয়ে ছিল, ব্যারন বলতে লাগলেন আবার। মেয়েদের অসম্ভব পছন্দ করতেন রোজার। অতিরিক্ত। আর দশটা মেয়ের মত লেখাপড়া শেখার জন্যে স্কুলে যেতে দেননি ওদের। বাড়িতে টিচার রেখে দিয়েছিলেন। যা চাইত ওরা, দিয়ে দিতেন তিনি। কোন কিছুতেই না করতেন না। এক বছর এক মেয়ের জন্মদিনে ইউরোপ থেকে সমস্ত জন্তু-জানোয়ার সহ একটা আস্ত সার্কাস পার্টি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।

অ্যাই, বাধা দিয়ো না তো! অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কোরি।

আমার গ্রেট-আঙ্কেল মনে করেছিলেন, এত টাকা আছে যখন, জীবনটা বুঝি সুখেই কেটে যাবে, সাগরের কালো পানির দিকে তাকিয়ে বললেন। ব্যারন। কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া। কিন্তু তা আর কাটল না। একদিন বনে খেলতে গিয়ে আর ফিরে এল না তাঁর দুই মেয়ে। রাতেই খোঁজাখুজি করা হলো। পাওয়া গেল না ওদের। পরদিন সকালেও না। সাত দিন পর বনের মধ্যে পাওয়া গেল ওদের লাশ। শরীরের মাংস আছে, কিন্তু হাড় নেই। কোন। অদ্ভুত উপায়ে আস্ত বের করে নেয়া হয়েছে কঙ্কালটা।

তা কি করে সম্ভব? বলে উঠল কিশোর।

 আমি জানি না। লোকে তো তাই বলে।

খুনীকে ধরতে পেরেছিল পুলিশ? কোরি জিজ্ঞেস করল।

আমি বলতে পারব না। পুলিশকে ওকাজ করার জন্যে আদৌ ডাকা হয়েছিল, তাই বা কে জানে, রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিলেন ব্যারন। ওই ঘটনার পর থেকে আলো নিভে গেল প্রাসাদের। রাতে আর বাড়ির জানালায় আলো জ্বলতে দেখত না কেউ। সব বদলে গেল। ভেরোনিকাকে আর কোনদিন শহরে দেখা যায়নি। লোকে বলে, পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলেন নাকি তিনি। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতেন। কখনও বেরোতেন না। রাতের বেলা বাড়ির কাছে কেউ গেলে শুনতে পেত অদ্ভুত সব চিত্তার, চেঁচামেচি। তাদের ধারণা ভেরোনিকার ঘর থেকে আসত। আর মেলবয়েস? তার যেন জীবনটাই থেমে গিয়েছিল। সমস্ত টাকা খুইয়ে ফেললেন তিনি। দামী দামী সমস্ত ছবি, জিনিসপত্র সব নীলামে উঠল, ঠেলা গাড়িতে ভরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকেও এরপর আর কোনদিন শহরে দেখা যায়নি। তারপর একদিন রহস্যময় ভাবে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল বাড়িটা।

মেলবয়েসই পুড়িয়েছিলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।

তা-ও জানি না। আসল ঘটনাটা কি ঘটেছিল, কেউ জানে বলে মনে হয় না। সবই অনুমান। কেউ বলে পাগল হয়ে গিয়ে ভেরোনিকা আগুন দিয়েছিলেন বাড়িতে। কেউ বলে মেলবয়েস নিজেই দিয়েছিলেন। অভিশপ্ত বাড়িসহ নিজেকে শেষ করে দেয়ার জন্যে। ওই বাড়ির সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা ছিল, মেলবয়েসদের প্রতিবেশী, সে তার ডায়রিতে লিখে গেছে। সেরাতে কি ঘটেছিল প্রাসাদে। লেখাটা আমি পড়েছি। রাত দুপুরে নাকি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল প্রাসাদে। কয়েক ঘণ্টা ধরে জুলল নরকের আগুনের মত। পরদিন লোকে যখন দেখতে এল, পোড়া ছাই ছাড়া আর কিছুই দেখল না।

সাগরের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন ব্যারন।

মেলবয়েস আর ভেরোনিকার কি ঘটেছিল? জানার জন্যে তর সইছে না। কোরির।

আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ভেরোনিকা, ব্যারন বললেন। ব্ল্যাক ফরেস্টের গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে তাকে। কোন নামফলক লাগানো হয়নি তাতে। আর মেলবয়েসের কি হয়েছে কেউ বলতে পারে না। তাঁকে আর কখনও দেখেনি কেউ।

বাতাসে কাত হয়ে গিয়ে আবার লাফিয়ে সোজা হলো মোমের শিখা। শীত লাগল কোরির। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গরম কাপড় নিয়ে আসিগে। কিশোর, তোমাদের জন্যে কিছু লাগবে?

উম, আমার জন্যে আনতে পারো, রবিন বলল।

ব্যারনের দিকে তাকাল কোরি, আমি না আসা পর্যন্ত আর কোন গল্প বলবেন না, প্লীজ! বালির ঢিবির ঢাল বেয়ে প্রায় দৌড়ে হোটেলের দিকে উঠে গেল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

সাংঘাতিক এক গল্প শোনালেন, কিশোর বলল। মানুষের শরীর থেকে কঙ্কাল উধাও হয়ে যায়, এরকম কথা আর শুনিনি।

ভ্যাম্পায়ারের কাজ নয়তো? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল মুসার।

ভ্যাম্পায়ার হয় কি করে? রবিন বলল, তাহলে রক্ত থাকত না শরীরে। হাড় থাকবে না কেন?

তাহলে এমন কোন ভূত হতে পারে, যে হাড় খায়! ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।

এর অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে, কিশোর বলল। কিংবা লোকে বানিয়েও বলতে পারে। সাতদিনে লাশ এতটাই ফুলে গিয়েছিল, মনে হয়েছে হাড় নেই। লোকে সেটাকে রঙ চড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে উদ্ভট এক ভয়াল কাহিনী।

এই শুরু হলো তোমার যুক্তি দেয়া, রেগে গেল মুসা। উল্টোপাল্টা যুক্তি দিয়ে কাহিনীটাকে নষ্ট করছ কেন?

উল্টোপাল্টা নয়, এটাই ঠিক। কারণ ভূত বলে কিছু নেই।

হেসে উঠলেন ব্যারন। বাতাসে দুলে উঠল তার কোটের কোণা। চাঁদের আলোয় মনে হলো ডানা মেলতে চাইছে ওটা। বললেন, লোকে তো কত কথাই বলে। রোজার মেলবয়েস ভ্যাম্পায়ার ছিলেন, একথাও বলেছে অনেকে। মুসার দিকে তাকালেন, আমি যেরকম পোশাক পরে এসেছি, আমাকেও আবার ভুত মনে হচ্ছে না তো তোমার? ন

মাথা নাড়ল মুসা। কথা বেরোল না তার মুখ থেকে।

সবাই চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙলেন ব্যারন। ঠাণ্ডা পড়ছে। ওঠা উচিত

কথা শেষ হলো না তার। শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সবাই।

আবার শোনা গেল চিৎকার। রাতের বাতাসকে চিরে দিল।

হো-হো-হোটেল থেকে আসছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

কোরি! বলল কিশোর।

.

০৭.

দমকা বাতাস নিভিয়ে দিল মোমের আলো।

বালির ঢিবি বেয়ে উঠতে শুরু করল কিশোর। পিছু নিল মুসা আর রবিন।

চিৎকার থেমে গেছে।

ওপরে উঠে ফিরে তাকাল কিশোর। ব্যারনও উঠে আসছেন। তবে ওদের চেয়ে অনেক ধীর। এখনও একশো-গজ নিচে রয়ে গেছেন।

আবার ছুটল সে। পুল হাউজের পাশ কাটিয়ে, সুইমিং পুলের ধার দিয়ে ছুটে চলল অন্ধকার বাড়িটার দিকে। পেছনের দরজা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে ছুটে আসতে লাগল ওর দিকে।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও মূর্তিটাকে চিনতে পেরে থেমে গেল। কিশোর। কোরি! কি হয়েছে?

আ-আমি…আমি ওকে দেখেছি! ঘোরের মধ্যে কথা বলছে যেন কোরি।

 কি দেখেছ? জানতে চাইল রবিন। হাঁপাচ্ছে। সে আর মুসা দুজনেই এসে দাঁড়িয়েছে কিশোরের পাশে।

চিৎকার করলে কেন? ওদের পেছনে শোনা গেল ব্যারনের অস্থির কণ্ঠ।

আমি ওকে দেখেছি, আবার একই কথা বলল কোরি।

 সাদা কোটের কোণা উড়িয়ে দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন ব্যারন।

উলফও বেরিয়ে এল।

আমি-আমি ভূতটাকে দেখেছি! কোরি বলল।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। কো-কো-ক্কোথায়?

এমন ভাবে চিৎকার করে উঠলে… হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলেন ব্যারন।

সরি। আপনাআপনি বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে

ভেতরে চলো সবাই। বলে ব্যারনের হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল উলফ।

ওদের অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা আর কোরি। মিনিটখানেকের মধ্যেই লবিতে জমায়েত হলো। চামড়ায় মোড়া বড় একটা চেয়ারে বসল, কোরি। তার পাশে ব্যারন। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে এখনও।

বায়ের করিডরের দিকে হাত তুলে কোরি বলল, হলঘরে দেখলাম ওটাকে। একজন মহিলার ভূত। দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে এল।

দেখতে কেমন? জানতে চাইল উলফ।

 চমকে দিল কিশোরকে। কিশোর জানত না ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা।

কপালের ওপর এসে পড়া একগাছি চুল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে। সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইল কোরি। যেন ভূতের চেহারা, মনে করার চেষ্টা করছে। পুরানো আমলের পোশাক পরা। সাদা নাইটগাউন। লম্বা কালো বেনি। বয়েস কম। খুব সুন্দরী।

চেয়ারে নড়েচড়ে বসল সে। অস্বস্তি বোধ করছে। নজর এখনও সামনের দেয়ালের দিকে। ওর চোখ দুটোই বেশি নাড়া দিয়েছে আমাকে। বাপরে বাপ! কি বড় বড়। টকটকে লাল। মুখটা ফ্যাকাশে। মোমের মত।–.. আরও কিছু বলতে চাইল সে। কথা আটকে গেল।

 আলতো করে ওর হাতটা চাপড়ে দিয়ে ব্যারন বললেন, শান্ত হও। উলফ, এক কাপ চা দাও না ওকে।

দেব। বলল, কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ল না উলফ।

লাল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে, কোরি বলল। আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে মনে হলো। বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ সবকিছু। ঘর। ঘরের বাতাস। সব। চিৎকার করে উঠলাম। দেয়ালে মিশে গেল ওটা। ঘাড়ে কিসের যেন ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগল। আবার চিৎকার করে উঠলাম।

দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চুলের গোছা আঙুলে পেঁচাতে থাকল সে।

রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। রবিন কি ভাবছে বোঝার চেষ্টা করল। ভূত দেখেছে কোরি, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নিশ্চয় কেউ ভয় দেখাতে চেয়েছে ওকে।

কেরির দিকে ফিরল সে। এখনও ভয় পাচ্ছ?

ওর কথা যেন শুনতেই পায়নি কোরি। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

হোটেলের পুরানো অংশে অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়, ব্যারন বললেন। কিন্তু…

ও আবার আসবে, আচমকা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল কোরি। ভূতটা ফিরে আসবে। আমার যেন কেমন লাগছে!

*

ঘুম আসছে না কিশোরের।

নরম বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। সিলিঙে নানা রকম ছায়ার খেলা। বাইরে কালো নির্মেঘ আকাশ, তারায় ভরা। সাদা কোমল চাঁদটা যেন ভেসে রয়েছে উপসাগরের ওপরে।

ব্যারনের গল্পটার কথা ভাবছে সে। বনের মধ্যে ফুটফুটে দুটো ছোট্ট মেয়ের লাশ। হাড় নেই। পোড়া বাড়ি। খেপা মহিলা ভেরোনিকা। উন্মাদ রোজার ডি মেলবয়েস। তার বংশধর একই নামের বর্তমান ব্যারন, মেলবয়েস ডি থার্ড। ব্যারনের চাকর উলফ। মানে নেকড়ে! রাখার জন্যে আর কোন নাম খুঁজে পায়নি যেন ওর বাবা। নামের আকাল পড়েছিল যেন। লোকটা অদ্ভুত। নেকড়ের সঙ্গে মিল নেই মোটেও। বরং চেহারার দিকে তাকালে বিখ্যাত সেই ক্লাসিক ছবির দানবটার স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–ড. জেকিল।

কোরির কথা ভাবল। সত্যি, কি ভূত দেখেছে সে? কিছু একটা তো দেখেছে নিশ্চয়। নইলে অমন করে চিৎকার করত না।

নাহ, ঘুমাতে আর পারবে না! বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। চাঁদটা চলে এসেছে যেন ঠিক তার জানালার বাইরে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। রূপালী জ্যোৎস্না ঘরে ঢুকে আলোর একটা আয়তক্ষেত্র তৈরি করেছে। কার্পেটে।

আলো মাড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে শার্টটা বের করে গায়ে দিল সে। রান্নাঘরে যাবে। কোক-টোক কিছু পায় কিনা দেখবে।

দরজা খুলে সরু হলওয়েতে বেরিয়ে এল। বাতাসে কার্পেট ক্লীনার আর পোকা মারার ওষুধের গন্ধ। খুব মৃদু আলো জ্বলছে। রাতের বেলা ডিম লাইট জেলে রেখে উজ্জ্বল আলোগুলো সব নিভিয়ে দেয়া হয়।

হেঁটে চলল সে। রবারসোল স্যান্ডেল পরা থাকায় শব্দ হলো না। দুপাশের দরজাগুলো আগের মতই বন্ধ।

মোড় নিয়ে আরেকটা করিডরে বেরোল। বিচিত্র এক রকম গন্ধ। আবছা অন্ধকার। একই রকম নিঃশব্দ। যেন স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলল সে।

ঠিক এই সময় কানে এল শব্দটা।

থমকে দাঁড়াল সে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল। মেঝের মচমচ না তো?

আবার হলো শব্দটা। আরেকটু জোরে। সেই সঙ্গে শেকলের ঝনঝনানি।

শেকল? ভুল শুনছে না তো?

আবার হলো শব্দটা। এগিয়ে এসে থেমে গেল।

আবার মচমচ। মৃদু গোঙানি। মানুষের গোঙানির মত। হালকা বাজনার শব্দ ভেসে এল। বীণা বাজাচ্ছে কেউ। ফিসফিস করে ওর নাম ধরে ডাকল কে যেন।

 দূর! সব আমার কল্পনা, নিজেকে বোঝাল সে। বাতাসের শব্দ। সরু হলওয়েতে দমকা বাতাস এসব কারসাজি করছে।

করুণ সুরে বেজেই চলল বীণা। ফিসফিস করে তার নাম ধরে ডাকল। একটা ছোট্ট মেয়ে। একেবারে কানের কাছে।

ঘটনাটা কি? মোড়ের অন্যপাশে কেউ আছে নাকি? হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। পার হয়ে এল মোড়টা। কানে এল মানুষের কণ্ঠ। জোরে জোরে কথা বলছে।

হাঁ করে ঢোক গিলে পানি খাওয়ার মত বাতাস গিলতে শুরু করল সে। যে ঘর থেকে কথা শোনা যাচ্ছে, তার দরজায় নম্বর নেই। নিচের ফাঁক দিয়ে চিলতে আলো এসে পড়েছে বাইরে।

ভূতুড়ে ফিসফিসানি থেমে গেছে।

এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান পাতল সে।

ব্যারনের কণ্ঠ। চিনতে কোন অসুবিধে হলো না। রেগে রেগে কথা বলছেন কারও সঙ্গে। তর্ক করছেন।

কিশোর অনুমান করল, এটা ব্যারনের ঘর। করিডরের শুরুতে প্রথম ঘর। পাশে চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে। মেইন লবি আর হোটেলের অফিসে যাওয়া যায় ওটা দিয়ে।

শোনো! যা বলি শোনো! চিৎকার করে উঠলেন ব্যারন।

না, আমি শুনব না! সমান তেজে জবাব দিল আরেকটা কণ্ঠ।

মহিলা কণ্ঠ।

 বিস্ময়ে নিচের চোয়াল ঝুলে পড়তে লাগল কিশোরের।

প্লীজ, আমার একটা কথা রাখো! কাঁদতে শুরু করল মহিলা, তোমার পায়ে ধরি, পার্টি দিয়ো না! প্লীজ, দিয়ো না!

দরজার বাইরে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। কিন্তু আর কিছু শোনা গেল না।

কি নিয়ে তর্ক করছে ওরা? কিসের পার্টি? মহিলাটি কে?

ঘরের মধ্যে পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। চট করে ওখান থেকে সরে এসে হলওয়ে ধরে দৌড় দিল কিশোর। যে-ই বেরোক, তার চোখে পড়তে চায় না।

.

০৮.

পরদিন। সুন্দর, ঠাণ্ডা একটা সকাল। ডাইনিং রূমের বিশাল জানালা দিয়ে সোনালি রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের ভেতর। আকাশের রঙ ঘন নীল।

নাস্তা খেতে খেতে গতরাতের কথা সঙ্গীদের জানাল কিশোর।

হু, মাথা দুলিয়ে বলল কোরি, আমার কথা তাহলে বিশ্বাস হচ্ছে এতক্ষণে।

 বিশ্বাস কাল রাতেই করেছি, কিশোর বলল। কিন্তু যাকে দেখেছ সে ভূত নয়, রক্তমাংসের জলজ্যান্ত একজন মানুষ, যে কথা বলে, তর্ক করতে পারে। মহিলাটি কে সেটাই ভাবছি এখন।

ব্যারনের রাধুনী হতে পারে, রবিন বলল, মনিকা।

 না, মনিকা নয়। ব্যারন বলেছেন শুক্রবারের আগে আসবে না সে।

ওটা ভূত ছাড়া আর কেউ নয়, জোর দিয়ে বলল কোরি। হতে পারে বহুকাল আগে মেলবয়েসদের কারও স্ত্রী ছিল ওই মহিলা। অপঘাতে মরে ভূত হয়েছেরাত দুপুরে এসে ব্যারনের সঙ্গে তর্ক জুড়েছে

উলফ এসে ঢুকল ডাইনিং রূমে। মুখ সেই একই রকম গোমড়া। হাতে একটা লাল রঙের টুলবক্স। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল। কাজ শুরু করতে চাও?

কোরি জিজ্ঞেস করল, উলফ, হোটেলে কোন মহিলা আছে?

প্রশ্নটা অবাক করল উলফকে। মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন বোলতায় কামড়ে দিয়েছে। দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, না, নেই। কেন?

ব্যারনের সঙ্গে কোন মহিলা দেখা করতে এসেছে?

চোখ দেখেই বোঝা গেল এসব প্রশ্নে খুব বিরক্ত হচ্ছে উলফ। না, কেউ দেখা করতে আসেনি। রলিন মারা যাওয়ার পর আর কোন মহিলা ঢোকেনি। ব্যারনের ঘরে। রলিন ছিল তার স্ত্রী।

টুলবক্সটা নিয়ে ঘরের পেছনের অংশে চলে গেল উলফ। কিশোরের দিকে তাকাল কোরি। চোখে বিস্ময়। কিন্তু প্রসঙ্গটা নিয়ে আলোচনা করা গেল না। আর। এখন কাজের সময়।

এখান থেকে কাজ শুরু করবে তোমরা, দেয়াল জুড়ে থাকা লাইটহাউজের বিশাল একটা পেইন্টিং সরাল উলফ। ওয়ালপেপার সরাবে। সিরিশ দিয়ে ঘষে মসৃণ করবে।

*

সারাটা সকাল কাজ করল ওরা। পুরানো বাদামী রঙ ঘষে ঘষে তুলল। গরম হয়ে উঠেছে ঘরটা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বাদামী রঙের শুকনো কণা। বাতাসেও উড়ছে। ঘামে আঠা হয়ে গেছে শরীর। উলফ ঠিকই বলেছে–পরিশ্রমের কাজ। সাগরের নোনা হাওয়া কাঠের অনেক গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রঙ, তোলা খুব মুশকিল।

 সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোরি বলল, একটা কোক খাওয়া দরকার। আন্টিকেও ফোন করতে হবে। ও মই থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল মুসা। কোরির সঙ্গে সঙ্গে এগোল। ওদের পেছনে গেল রবিন। কিশোর বলল, তোমরা যাও। আমি এটুকু শেষ করে আসি।

কথা বলতে বলতে যাচ্ছে তিনজনে। রান্নাঘরে ঢুকে যেতে আর শোনা গেল না। মইয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল কিশোর। সিরিশ দিয়ে ঘষতে ঘষতে হাতের পেশী ব্যথা হয়ে গেছে। কিন্তু থামল না। ঘষেই চলল।

দশ কি পনেরো মিনিট পর কানে এল পদশব্দ। মুসারা নিশ্চয় ফিরে এসেছে।

ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল কিশোরের হাত।

মুসারা নয়। অবিকল ব্যারনের মত দেখতে একজন অপরিচিত লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। সাদা চুল, সাদা গোঁফ। কিন্তু ব্যারনের মত হাসিখুশি নন, বরং উল্টো। পোশাকও পরিচ্ছন্ন নয়। কানা জলদস্যুদের মত এক চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা। পরনে ঢোলা জিনস। প্যান্টের হাটুতে দাগ। গায়ে। সাফারি জ্যাকেট। অসংখ্য পকেট তার। কাগজ, কলম, রুমাল আর নানা। রকম জিনিসে উঁচু হয়ে আছে সেগুলো। ডান হাতে একটা হান্টিং রাইফেল। নল ধরে বাটটা ঠেকিয়ে রেখেছেন মেঝেতে। ভয়ানক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে কাঠের মেঝেতে ঠুকঠুক শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন কিশোরের দিকে।

হাই, হাসিমুখে বলল কিশোর।

জবাবে ঘোৎ করে উঠলেন তিনি। কালো একটা চোখ মেলে তাকিয়ে। রইলেন কিশোরের দিকে।

আমি কিশোর পাশা। আশা করল নিজের পরিচয় দেবেন ভদ্রলোক। দিলেন না দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয় মিলার মেলবয়েস?

 ব্যারন মিলার ডি মেলবয়েস, রাইফেলে ভর দিয়ে কিছুটা সামনে ঝুঁকে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গলাটা তার ভাই রোজারের মত গমগমে হলেও অতটা মসৃণ নয়। আচরণ ভদ্র তো নয়ই, বুনো।

চেহারা এক, অথচ দুই ভাইয়ের মধ্যে অত অমিল হয় কি করে?–ভাবল কিশোর। বলল, আমরা বেড়াতে এসেছি এখানে। আমি আর আমার তিন বন্ধু। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করে দিচ্ছি। মিলারের দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করছে সে।

 শুনেছি, কিছুতেই সহজ হচ্ছেন না ভদ্রলোক। রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে হেঁটে গেলেন জানালার কাছে। বাইরে তাকিয়ে রইলেন। উজ্জ্বল, রোদে আরও স্পষ্ট দেখা গেল তার পোশাকগুলো। অতিরিক্ত কুঁচকানো আর ময়লা।

 রোজার বলেছেন, তাঁর ভাই বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন। কেন এই বিষণ্ণতা? আলাপ জমানোর জন্যে বলল কিশোর, দিনটা খুব সুন্দর, তাই না? জায়গাটাও দারুণ আপনাদের। মই থেকে নামবে কি নামবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে।

 কোথায় সুন্দর? বিরক্তকণ্ঠে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন মিলার। প্রচণ্ড গরম! সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকে নল ধরে ধীরে ধীরে ঘোরাচ্ছেন রাইফেলটা।

ঘরের মধ্যে গরম।

জবাব দিলেন না মিলার। অস্বস্তি আরও বাড়ল কিশোরের। ইচ্ছে করেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন তিনি যাতে সহজ হতে না পারে সে? মুসারা এত দেরি করছে কেন?

তোমার বন্ধুরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন মিলার।

কাজ করতে করতে ঘেমে গেছিল, পানি খেতে গেছে। আমি এই কোণাটা শেষ করে যাব, হাত তুলে দেখাল কিশোর।

দেখার জন্যে ঘুরলেন না মিলার। বিষণ্ণকণ্ঠে বললেন, জায়গাটা অতিরিক্ত চুপচাপ।

হবেই। এতবড় জায়গা। মাত্র পাঁচ-সাতজন লোক।

তার কথাটা মনে হয় পছন্দ হলো না মিলারের। মুখটাকে বিকৃত করে ঘনঘন রাইফেল ঠুকতে লাগলেন মেঝেতে। এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। মইয়ের কাছে।

ভয় পেয়ে গেল কিশোর। মই থেকে টান মেরে ফেলে দেবেন না তো?

কিন্তু মইয়ের ফুটখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সশব্দে নাক ঝাড়লেন, গোফ মুছলেন, রুমালটাকে দলা পাকিয়ে ভরে রাখলেন আরেক পকেটে। কিশোরের দিকে চোখ তুলে বললেন, মন দিয়ে কাজ করো।

হ্যা করছি… ভয়ে ভয়ে বলল কিশোর। কি বললে আবার খেপে যান। কে জানে।

আমার ভাইকে দেখেছ?

 না তো। সকালে নাস্তা খেতেও আসেননি।

হু! ওর সঙ্গে কথা ছিল।

ঠিক আছে, আমার সঙ্গে দেখা হলে তাকে বলব আপনি খুঁজছিলেন।

মন দিয়ে কাজ করো! হ্যাঁ, ভাল কথা, তোমরা কি পার্টিতে যোগ দিতে এসেছ নাকি?

পার্টি! চমকে গেল কিশোর। মোচড় দিয়ে উঠল পেটের মধ্যে। গতরাতের মহিলার কথা মনে পড়ল–প্লীজ, তোমার পায়ে ধরি, পাটি দিয়ো না! কেন মানা করছিল মহিলা? পার্টিকে এত ভয় কেন তার?

কিসের পার্টি? জানতে চাইল কিশোর।

কর্কশ কণ্ঠে মিলার বললেন, থেকে যাও। পার্টিতে যোগ দিতে হবে তোমাদের। পালানোর চেষ্টা কোরো না।

*

সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা রবিনের মাথা ধরেছে। কোরির গা ম্যাজম্যাজ করছে কথাই বলতে পারল না কোনমতে খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে গেল দুজনে

এত তাড়াতাড়ি শুতে যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। মুসারও না। ডাইনিং রূমে বসে রইল ওরা।

মিলারকে কি সত্যি পাগল মনে হয়েছে তোমার, কিশোর? জিজ্ঞেস করল মুসা।

পাগল কিনা জানি না, তবে আচরণ কেমন অদ্ভুত।

সেজন্যেই কোরি ভাবছে, ও ভূত।

যা খুশি ভাবুকগে। কারও আচরণ অদ্ভুত হলেই সে ভূত হয়ে যায় না। ভুলে যাচ্ছ কেন, মিলার বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন। সে যাকগে। আন্ট জোয়ালিনের ব্যাপারটা কি বলো তো? কোরি নাকি একবারও যোগাযোগ করতে পারেনি তাঁর সঙ্গে?

এটাও আমার কাছে রহস্যময় লাগছে।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল, বাইরে একটু ঘুরে আসিগে। রঙের মধ্যে শ্বাস নিতে নিতে মাথাটা গরম হয়ে গেছে।

মুসাও বেরোল ওর সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল চন্দ্রালোকিত সৈকতে।

অপূর্ব দৃশ্য। হলদে আলোয় ঝলমল করছে বালি। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভাঁজগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে।

কি পরিষ্কার আলো দেখো, মুগ্ধকণ্ঠে বলল কিশোর। সব স্পষ্ট।

স্যান্ডেল খুলে বালিতে পা রেখে দেখো। ঠাণ্ডা। খুব আরাম লাগে।

পানির কিনারে এসে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ফিরে তাকাল হোটেলের দিকে। বালির ঢালের লম্বা ঘাসগুলোতে ঢেউ তুলছে বাতাস। মনে হচ্ছে ওগুলোও তরল পদার্থ। চাঁদের আলো সবকিছুকেই কেমন অন্য রকম করে তুলেছে।

ডকের দিকে একটা খসখস শব্দ হলো। পই করে ঘুরে তাকাল সে। ডকের ওপরে ছোট্ট পাথরের টিলার কাছে হয়েছে শব্দটা।

কিসের শব্দ? মুসাও শুনতে পেয়েছে।

কেউ নজর রাখছে নাকি? চলো তো দেখি।

আমার ভয় করছে।

ভূতের ভয়?

সবদিকে নজর থাকে ওদের। নিজে অদৃশ্য থেকে সবখানে হাজির হতে পারে একমাত্র ওরাই..

চলো তো দেখি।

বালির ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল কিশোর। নিচে কেউ থাকলে এখান থেকে দেখা যাবে।

কিন্তু অনেকখানি উঠেও কাউকে দেখতে পেল না। কোন শব্দও নেই। কেবল তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎছল আর ঢেউয়ের মধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসের কানাকানি।

ক্লান্ত লাগছে। হাঁটতে আর ভাল লাগছে না। হোটেলে ফিরে চলল। দুজনে।

.

০৯.

 পরদিন সকালে নাস্তার পর আবার কাজে লাগল ওরা।

 দেয়াল ঘেঁষে রাখা মঞ্চটাতে ওঠা দরকার। ছাতের ঠিক নিচে দেয়ালে দশ বর্গফুটমত জায়গার রঙ ঘষতে হবে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে উঠতে পারবে না ওটাতে। মাত্র দুজনের জায়গা হয়।

মুসা বলল, আমি আর রবিন উঠে ঘষতে থাকি। আমাদের হাত ধরে গেলে তোমরা দুজন উঠো।

খালি খালি বসে থাকব? কিশোর বলল। মঞ্চের পাশে একটা মই ঠেস দিয়ে তাতে উঠে কাজ করা যায়।

কোরি গেছে তার আন্টিকে ফোন করতে।

একটা ইলেকট্রিক স্যান্ডার দিয়েছে আজ উলফ। হাতে ঘষার চেয়ে এটা দিয়ে ঘষা অনেক সহজ। অনেক দ্রুত অনেক বেশি জায়গা ঘষা যায় যন্ত্রটা দিয়ে। যথেষ্ট ভারী। অন্য তিনজনের চেয়ে সহজে তুলে ধরে রাখতে পারবে মুসা, কারণ তার গায়ে শক্তি বেশি। সুতরাং ওটা নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়ল সে।

রবিন উঠল তার পাশে। মঞ্চটার অবস্থা বিশেষ সুবিধের লাগছে না আমার। নড়ছে, দেখছ? দুলছে। ভেঙে পড়বে না তো?

রবিনের সন্দেহটাকে গুরুত্ব দিল না মুসা। স্যান্ডার ঠেসে ধরতে গেল দেয়ালে। এই সময় ফিরে এল কোরি। মুখ থমথমে।

পেয়েছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। রিং হচ্ছিল ঠিকই। কেউ ধরল না। ভায়োলা আন্টি নাহয় হাসপাতালে গেছে। কিন্তু আন্ট জোয়ালিন?

রোজার মেলবয়েস কি বললেন? শোরটাউনে যাবেন?

ঠোঁট ওল্টাল কোরি, জানি না। ফোন রেখে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না।

 স্যান্ডারটা দেয়ালে ঠেসে ধরল মুসা। বিকট শব্দ করে রঙ তুলতে লাগল যন্ত্রটা। পাশে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে দেয়ালের কাগজ ছিঁড়তে শুরু করল মুসা।

যন্ত্র দিয়ে কাজ করার ফলে বাতাসে রঙের কণা এত বেশি উড়ছে, শাস নিতে কষ্ট হতে লাগল দুজনের। ব্যাপারটা লক্ষ করে একটা আলমারি থেকে গিয়ে দুটো মাস্ক বের করে আনল কিশোর। হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিল রবিনের হাতে। একটা নিজে রেখে আরেকটা মুসাকে দিল রবিন।

কাজ করতে করতে পাশে সরে গেল মুসা। দুলে উঠল মঞ্চ। কাত হয়ে যাচ্ছে একপাশে।

চিৎকার করে উঠল রবিন, আরি, পড়ে যাচ্ছে তো!

ঠেকানো গেল না কোনমতে। মড়মড় করে ভেঙে পড়ল মঞ্চ। মুসার হাত থেকে স্যান্ডারটা উড়ে গিয়ে পড়ল কিশোরের পায়ের কাছে। আরেকটু হলে তার পা-টা হেঁচত। মেঝেতে পড়ে গেল মুসা আর রবিন।

দৌড়ে এল কোরি আর কিশোর।

 কোনমতে উঠে বসল রবিন। হাতে মুঠো করে ধরা রয়েছে এখনও একটুকরো কাগজ। দেয়ালের দিকে চোখ পড়তে চিৎকার করে উঠল, আরে দেখো দেখো! একটা দরজা!

চোখ তুলে তাকাল বাকি তিনজন। দেয়ালের গায়ে যেখান থেকে কাগজ ছিঁড়েছে রবিন, সেখানে একটা দরজার খানিকটা দেখা যাচ্ছে।

এগিয়ে গেল কিশোর। টান দিয়ে নিচের দিকের বাকি কাগজটুকু ছিঁড়ে ফেলল। বেরিয়ে পড়ল পুরো দরজাটা। বিড়বিড় করে বলল, দরজা ঢেকে দিয়েছিল কেন? আশ্চর্য!

সরো! সরো ওটার কাছ থেকে! চিৎকার করে উঠল কোরি। আমি পড়েছি, ভূতের উপদ্রব ঠেকানোর জন্যে ভূতুড়ে ঘর কিংবা সুড়ঙ্গের দরজা এ ভাবে ফুলআকা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তাহলে নাকি ওসব দরজা দিয়ে। আর বেরোতে পারে না ভূত।

 রসুনের মালা ড্রাকুলার মত ভূতকে ঠেকায় শুনেছি, কিন্তু ফুলআঁকা কাগজ দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল কিশোর।

দেখো, আমি তোমাকে মানা করছি! সাবধান করল কোরি। যেয়ো না! বের করে এনো না ভূতটাকে…

চকচকে মসৃণ কাঠের দরজাটার একপাশে ফ্রেমে বাঁধাই একটা ছোট ছবি ঝোলানো। মঞ্চের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল। সেটাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখেই কোণা ধরে সামান্য সরাতে বেরিয়ে পড়ল দরজার নব। হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। নব ধরে মোচড় দিতে খুলে গেল দরজার পাল্লা।

কোরির দিকে ফিরে তাকাল সে। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে।

ঢুকো না! কোরির দুচোখে ভয়। আমি এখনও বলছি, ভাল চাইলে বন্ধ করে দাও ওই দরজা!

মুসার দিকে তাকাল কিশোর।

হ্যাঁ-না কিছু বলল না মুসা। কোরির ভয়টা তার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। ঢোকা উচিত কিনা বুঝতে পারছে না।

রবিন বলল, খুলেই যখন গেছে, চলো দেখি কি আছে?

ওর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার দিয়ে ফড়ফড় করে বেরিয়ে এল কি যেন।

লাফ দিয়ে সরে গেল কোরি। মুসা হতভম্ব।

জানালার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রবিন, বাদুড়। ওই জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসতে হাসতেই বলল, কোরি, ভ্যাম্পায়ার নয়, শিওর থাকতে পারো। দিনে বেরোয় না ভ্যাম্পায়ারেরা। সূর্য ডোবার আগে বেরোতে পারে না।

ইয়ার্কি মেরো না! ঝাঁঝিয়ে উঠল কোরি। যখন পড়বে ভূতের খপ্পরে তখন বুঝবে মজা!

যত ভয়ই পাক, কিশোর, রবিন আর মুসাও যখন ঢুকে গেল ভেতরে, আগ্রহ এবং কৌতূহল কোনটাই ঠেকাতে না পেরে কোরিও ঢুকে পড়ল ওদের পেছনে। অন্ধকারে আবার কিচকিচ করে উঠল কয়েকটা জীব। ফড়ফড় করতে লাগল মাথার ওপর। চামচিকে আর ছোট জাতের বাদুড়ে বোঝাই হয়ে। আছে জায়গাটা।

বাদুড় আমার সাংঘাতিক ভয় লাগে, অন্ধকারে ফিসফিস করে বলল কোরি। মাকড়সা আর তেলাপোকাকেও।

শুয়াপোকাকে ভয় লাগে না? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন। বড় কালো কালো শুয়াপোকা? লম্বা লম্বা কাটার মত লোম, কিলবিল করে

মাগো! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কোরি। দোহাই লাগে। তোমার রবিন, আর বোলো না..প্লীজ! উফ, দেয়ালেই হাত দিতে পারব না। আর।

ওর চিৎকারে মাথার ওপর ফড়ফড় করতে লাগল আবার বাদুড়ের ঝাক।

শক্ত করে গলার লকেটটা চেপে ধরল কোরি। অন্ধকারে কেউ দেখতে পেল না সেটা।

ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। পেছনের খোলা দরজাটা দিয়ে অতি সামান্য আলো আসছে। আবছামত দেখা যাচ্ছে এখন ভেতরটা। কংক্রীটে তৈরি সরু, নিচু ছাতওয়ালা একটা সুড়ঙ্গে ঢুকেছে ওরা।

মুসা, কিশোর বলল, আলমারিতে টর্চ আছে। নিয়ে এসো তো দুটো। ঢুকেছি যখন ভাল করেই দেখে নিই কি আছে না আছে?

 ভয়ের ভান করে রবিন বলল, না না, এগিয়ে না আর! বলা যায় না, কখন কাউন্ট ড্রাকুলার কফিন চোখে পড়ে যায়! এ ফালতু কথা বোলো না তো! লাফ দিয়ে দরজার দিকে সরে গেল কোরি। আমি যাব না!

ওর পাশ কেটে বেরিয়ে গেল মুসা। আলমারি খুঁজে দুটো টর্চ বের করে নিয়ে এল।

মুসার কাছ থেকে একটা টর্চ নিল কিশোর। আগে আগে এগোল।

যাব না বললেও কৌতূহল দমাতে পারল না কোরি। এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।

রোজার এসে যদি জিজ্ঞেস করেন, কাজ ফেলে কোথায় গিয়েছিলাম। আমরা, রবিন বলল, কি জবাব দেব?

সত্যি কথাই বলব, জবাব দিল কিশোর। সুড়ঙ্গটা দেখে কৌতূহল হয়েছিল। ভেতরে কি আছে দেখতে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক কৌতূহল এটা। তিনি কিছু মনে করবেন না। একটু চিন্তা করে বলল, তবে একটা কথা ভাবছি। এটার কথা কি উলফ জানে?

শুকনো গলায় কোরি বলল, আমার ভয় লাগছে!

 সেটা তো বুঝতেই পারছি।

শূন্য সুড়ঙ্গ। পায়ের নিচে কংক্রীটের মেঝে। দেয়াল ছুঁয়ে দেখল কিশোর। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা।

ওই দেখো! হাত তুলল মুসা।

ওর বলার ভঙ্গিতে চমকে গেল কোরি। আবার চিৎকার করে উঠল। তাকিয়ে দেখল দেয়াল বেয়ে এগিয়ে আসছে একটা বড় পোকা। গোঁ গো শুরু করল সে। যেন চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যাবে। ওয়াক ওয়াক করে বলল, আমার বমি আসছে!

নাহ, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোই তো মুশকিল! বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর। যাও, তুমি চলে যাও, আমাদের সঙ্গে আর যাওয়া লাগবে না!

ঠিক আছে, আর চেঁচাব না। কিন্তু আধমিনিট পরেই বড় একটা মাকড়সা দেখে আবার চিৎকার করে উঠল কোরি। টারান্টুলা! ব্ল্যাক উইডো। স্পাইডার! পিষে ফেলো! কামড়ে দিলে সর্বনাশ!

আরে কিসের টারান্টুলা? ধমক লাগাল কিপোর। খেয়ে আর কাজ পেল না। এখানে টারান্টুলা আসবে কোত্থেকে? না চিনেই চেঁচামেচি। একেবারে সাধারণ মাকড়সা।

ডানে মোড় নিল সুড়ঙ্গ। ঢালু হয়ে গেছে মেঝে। গলিঘুপচির অভাব নেই। ওসবের মধ্যে না ঢুকে সোজা এগিয়ে চলল ওরা।

মুসা বলল, আমার মনে হয় সাগরের দিকে গেছে সুড়ঙ্গটা। পানির ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে।

বানিয়েছিল কারা? রবিনের প্রশ্ন। জবাবটাও নিজেই দিল, বোধহয় প্রাচীন চোরাচালানির দল। রাতে জাহাজ থেকে গোপনে মাল খালাস করে। এনে হোটেলে লুকিয়ে রাখত।

টর্চের আলো সামনে ধরে রেখে সাবধানে নিচে নামতে লাগল কিশোর। আরও কয়েক মিনিট এগোনোর পর দেখা গেল দুভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। মূল সুড়ঙ্গটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে সোজা এগিয়েছে। ওটা থেকে বেরিয়ে আরেকটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে ডানে।

রসিকতা করে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কোনদিকে যাব এবার, ক্যাপ্টেন কিড?

চলো আগে ডানেরটা ধরেই যাই, কোরি বলল।

কেন, কোন বিশেষ কারণ?

না না, তাড়াতাড়ি জবাব দিল কোরি, কোন কোন ভূত বিশেষজ্ঞ বা দিকটাকে অশুভ মনে করে তো…

আর কিছু বলা লাগল না। মুহূর্তে ডান দিকে ঘুরে গেল মুসা।

 কয়েকশো গজ এগোনোর পর চিৎকার করে উঠল কোরি।

কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।

মুখে কি জানি লাগল!

আলো ফেলল কিশোর। মাকড়সার জাল। তুমি কি ভেবেছিলে?

জবাব দিল না কোরি।

কি আর ভাববে, হাসতে হাসতে বলল রবিন, ভ্যাম্পায়ারের ছোঁয়া।

জালে দুলন্ত হালকা বাদামী মাকড়সাগুলো দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর, সৈকতে বাস করে এসব মাকড়সা, পানির কিনারে। তারমানে বাইরে থেকে এসেছে এগুলো। আর বাইরে থেকে যেহেতু এসেছে, ঢোকার পথ আছে। এবং ঢোকার পথ মানেই বেরোনোর পথও।

গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।

আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের আরও কয়েকটা মোড় ঘুরে এসে দাঁড়াল একটা কাঠের দরজার সামনে। কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে। ওপাশে ঘন অন্ধকার।

দরজায় হাত রাখল কিশোর। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ঠেলা দিল। কাচকোচ আওয়াজ তুলে খুলে গেল পাল্লা। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছোট একটা ঘর। মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল। দুই পাশে বেঞ্চ পাতা। টর্চের আলোয় দেখা গেল দেয়ালগুলোতে লাল রঙ লেগে আছে। যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

টেবিলের দিকে চোখ পড়তে খাইছে! বলে উঠল মুসা। হাত থেকে খসে গেল টর্চ।

কিশোরের টর্চটা জ্বলছে।

বিড়বিড় করে কোরি বলল, মরার খুলি!

এগিয়ে গেল কিশোর। চটচটে কি যেন লেগে রয়েছে। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। আঠা আঠা জিনিস। গন্ধ শুকল। কিছু বুঝতে পারল না।

প্রোটোপ্লাজম! ফিসফিস করে বলল কোরি। ভূতেরা যেখান দিয়ে চলে, সেখানে নরকঙ্কাল দেখলেই তাতে লাগিয়ে রেখে যায়। এবার তো বিশ্বাস করবে আমার কথা? খানিকক্ষণ আগে এখানে বসে ছিল একটা ভূত, মরার খুলিতে করে নিশ্চয় কফি কিংবা চা খেয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।

হেসে ফেলল রবিন, অতিরিক্ত ভূতের সিনেমা আর ভূতের গল্প পড়ার ফল এসব। ধরতে গেল খুলিটা। নাড়া লাগতেই গড়িয়ে গেল ওটা। চোখ দুটো ওর ঘুরে গেল সে দিকে। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনল সে।

মাগো! খেয়ে ফেলল! বলে চিৎকার দিয়েই পেছন ফিরে দৌড় মারতে গেল মুসা।

খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। আরে থামো! কি করছ। পাগলের মত?

মুসাকে শান্ত হওয়ার সময় দিল সে। আগেই লক্ষ করেছে দরজার পাশে সুইচবোর্ড আছে। আলো জ্বেলে দিল। তুলে নিল মাটিতে পড়ে যাওয়া টর্চটা।

আর কিছু দেখার নেই। ফিরে চলল ওরা ডাইনিং রূমে।

সুড়ঙ্গটা যেখানে দুভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে রবিন জিজ্ঞেস করল, বাঁয়েরটায় ঢুকবে না?

ঘড়ি দেখল কিশোর, নাহ, এখন আর সময় নেই। কাজে অনেক ফাঁকি দিয়েছি। মিস্টার রোজার জানতে পারলে রাগ করবেন।

যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সেটার কাছে ফিরে এল ওরা।

 কিন্তু দরজা বন্ধ। শত ঠেলঠেলিতেও খুলল না। আটকে গেছে কোন কারণে। এই সময় লক্ষ করল কিশোর, আলো কমে এসেছে টর্চের। ফুরিয়ে এসেছে ব্যাটারি।

শঙ্কিত কণ্ঠে রবিন বলল, আটকা পড়লাম না তো!

*

দরজায় দুই হাতে কিল মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল কোরি, অ্যাই, শুনছেন? কেউ আছেন ওপাশে? দরজাটা খুলুন!

জবাব দিল না কেউ।

পদশব্দের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কেউ এগিয়ে এল না।

বাইরে থেকে তালা আটকে দেয়নি তো? ককিয়ে উঠল কোরি।

দরজার কাছ থেকে সরে গেল কিশোর। বেরোনোর অন্য কোন পথ নিশ্চয় আছে। সময় থাকতে থাকতে সেটা খুঁজে বের করা দরকার। টর্চ নিভে গেলে মহাবিপদে পড়ব।

কি করবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।  

সুড়ঙ্গের অন্য মাথা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করব।

মৃদু প্রতিবাদ করতে চাইল কোরি, কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। ফিরে চলল আবার ওরা।

সুড়ঙ্গের মাথাটা যেখানে দুই ভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে এবারও ডানের সুড়ঙ্গটায় ঢুকল ওরা। কারণ কিশোরের ধারণা এটা দিয়ে সৈকতে বেরোনো যাবে। প্রায় গা ঘেঁষাঘেষি করে এগোল সরু সুড়ঙ্গ ধরে। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবার ভয়ে একনাগাড়ে জ্বেলে না রেখে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মুসা আর কিশোর।

পার হয়ে এল দরজাটা।

কিছুদূর এগোনোর পর আবার ভাগ হয়ে গেল সুড়ঙ্গ।

 ডানেরটা দেখিয়ে বলল কোরি, এটাতেই ঢুকি, কি বলো?

সেটাতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগোনোর পর মনে হলো অনেক বড় বাক নিয়েছে,সুড়ঙ্গটা। ঘুরে এগোচ্ছে। ছাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছে কংক্রীটের মেঝেতে। অসংখ্য মাকড়সার জাল। হাতে, মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে।

চলেছে তো চলেছেই। পথ আর ফুরায় না। রবিন বলল, এ কোথায় চলেছি? বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে তো?

কোথাও না কোথাও পথ একটা নিশ্চয় আছে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ সুড়ঙ্গগুলো মানুষের তৈরি।

আই, কোরি বলল, পথ ভুল করে একই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘুরে মরছি না তো আমরা? বার বার একই জায়গায় ঢুকছি না তো?

পথ হারিয়েছি বলতে চাও? শঙ্কিত স্বরে বলল মুসা।

কিংবা এমনও হতে পারে ফাঁদ পেতেছিল কেউ আমাদের জন্যে। সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছি আমরা। সুড়ঙ্গগুলো সব একই রকম লাগছে দেখতে। কোনদিনই আর এখান থেকে বেরোতে পারব না আমরা।

.

১০.

পারতেই হবে; দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। বেরোনোর পথ না পাওয়া পর্যন্ত এগিয়েই যেতে হবে আমাদের। নানা রকম প্রশ্ন মনে–কে বন্ধ করল দরজাটা? কেন করল? কি লাভ তার? কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন।

একটা মোড় ঘুরে অন্যপাশে আসার পর দেখা গেল ক্রমশ খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এটা? বেরোনোর পথ সত্যি পাওয়া যাবে তো? সন্দেহ দেখা দিল কিশোরের। শুধু শুধু ঘুরে মরছে না তো?

আতঙ্ক এসে চেপে ধরতে শুরু করল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। হৃৎপিণ্ডটা।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়, টর্চের আলো ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে বলল মুসা। আলো কমে যাওয়ায় চারপাশে ছায়া বাড়ছে এখন। উলফ আমাদের খোঁজাখুঁজি করবে।

কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল রবিনের কণ্ঠ।

তোমার কি মনে হয় সে-ই দরজাটা আটকে দিয়েছে? বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি চেপে ধরেছে কোরি। ভেজা বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে।

অসম্ভব কি?

সামনে কমে আসছে অন্ধকার। একটা মোড় ঘুরতেই আলো দেখা গেল। আলোর দুটো ঝিলমিলে বর্শা তেরছা হয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে। দেখেই দৌড় দিল মুসা। পেছনে ছুটল অন্যরা।

ছোট একটা দরজা। তার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। ঠেলে খুলতে দেরি হলো না। হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে এসে চোখই মেলতে পারল না প্রথমে।

কিশোরের অনুমান ঠিক। সৈকতে বেরিয়েছে ওরা। উঁচু একটা ঢিবির ঢালে এমন জায়গায় এমন ভাবে রয়েছে সুড়ঙ্গমুখটা, সাগর থেকে দেখা যাবে না। নিচে সৈকতে দাঁড়িয়েও নয়। দেখতে হলে ঢাল বেয়ে উঠে আসতে হবে।

তাজা বাতাস কেমন লাগছে? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

রোদ যে এত চমৎকার বুঝতে পারিনি কোনদিন, আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল রবিন।

এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদ আর বাতাস খেলে পেট ভরবে না, তাগাদা দিল মুসা, হোটেলে যাওয়া দরকার।

হাসাহাসি করতে করতে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে মুখে যেন খই ফুটছে। উঠে এল হোটেলের পেছনের নির্জন। আঙিনায়। সুইমিং পুলের পাশ কাটাল। কাচের দরজা ঠেলে পা রাখল ঘরের ভেতর।

ডাইনিং রূমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চটার দিকে। যেখানে ছিল ওটা সেখানে নেই। ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুড়ঙ্গে ঢোকার দরজার কাছে।

কেন খোলা যায়নি দরজাটা বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। মঞ্চটা দিয়ে ইচ্ছে করেই আটকে দেয়া হয়েছে যাতে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে শত ঠেলাঠেলিতেও না খোলে।

বোঝা গেল না কে করেছে এই অকাজটা।

*

বিকেলটা সৈকতে কাটিয়ে উত্তেজনা দূর করার চেষ্টা করল ওরা। পারল না। থেকে থেকে মনে আসছে কেউ একজন ইচ্ছে করে ওদেরকে সুড়ঙ্গে আটকে মারতে চেয়েছিল। কে লোকটা? উলফ? মিলার?

মিস্টার রোজারকে কথাটা জানানো দরকার, কিশোর বলল। সবাই একমত হলো ওর সঙ্গে।

কিন্তু ডিনারের সময় পাওয়া গেল না ব্যারনকে। খেতে এলেন না তিনি। চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে সবে মুখে দিয়েছে কিশোর, এই সময় রাইফেলে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন মিলার। রাগে মুখ। লাল। এলোমেলো চুল। সেই সাফারি জ্যাকেটটাই পরে আছেন এখনও। বুকের কাছে ভোলা। নিচে হলদে স্পোর্টস শার্টের দুটো বোম নেই।

মিস্টার মিলার…এই যে, আমার বন্ধুরা:…সকালে দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে, অস্বস্তি কাটানোর জন্যে কথা শুরু করতে গেল কিশোর।

এমন ভঙ্গিতে তাকালেন মিলার, যেন ওকেও চিনতে পারছেন না। মুসা, রবিন আর কোরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে।

আনমনে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন কেবল মিলার। হাত মেলালেন না। বিড়বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না। রাইফেলটা মেঝেতে শুইয়ে রেখে তার ভাই রোজারের চেয়ারটায় বসে খাবারের প্লেট টেনে নিলেন। হাপুস হুপুস করে খেতে শুরু করলেন নিতান্ত অভদ্রের মত।

সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুপ শেষ করে সালাদের বাটিটা টেনে নিলেন। চামচের পর চামচ মুখে পুরে আধ চিবান দিয়ে দিয়েই গিলে ফেলতে লাগলেন।

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ভয়ানক অস্বস্তি দূর করার জন্যে কথা শুরু করল কিশোর, আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? …তিনি খেতে আসবেন না?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখভর্তি খাবার চিবাতে থাকলেন মিলার। গিলে নিয়ে কোনমতে বললেন, না, রোজার এখানে নেই, বলেই আবার বড় এক চামচ সালাদ মুখে পুরলেন।

কোথাও গেছেন?

মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিলেন মিলার। সশব্দে সালাদ চিবাতে লাগলেন।

অবাক লাগছে কিশোরের। এত বুনো কেন এই লোক? ভাইয়ের ঠিক উল্টো! দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে স্বভাবের এতটা পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না।

কিশোরকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবশেষে ঘোৎ-ঘোৎ করে বললেন মিলার, রোজার গেছে শহরে। শোরটাউন। তারপর আরও কি যেন বললেন, এতই অস্পষ্ট, বোঝা গেল না কিছু।

আমার আন্টির খোঁজ নিতে গেলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।

ভাল একটা চোখের দৃষ্টি কোরির ওপর স্থির করে মিলার বললেন, আন্টি? হ্যাঁ, তোমার আন্টি।

আবার খাওয়ায় মন দিলেন তিনি। সালাদ শেষ করে আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট আর আলুভাজার বাটিটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কারও জন্যে একটুও অবশিষ্ট না রেখে শেষ করে ফেললেন পুরোটাই।

তার এই কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সবাই।

কিন্তু কারও পরোয়া করলেন না তিনি। কোন রকম ভদ্রতার ধার ধারলেন না। খাওয়া শেষ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাত হয়ে তুলে, নিলেন রাইফেলটা। চেয়ার থেকে উঠে সেটাতে ভর দিয়ে চলে গেলেন ডাইনিং রুম থেকে।

হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন সবাই।

এ তো রাক্ষস, বলে উঠল মুসা। এর সঙ্গে খেয়ে আমিও পারব না।

রোজার না বললেন বিষণ্ণতা রোগ আছে? কোরি বলল।

আছেই তো, কিশোর বলল, নইলে এমন আচরণ করে নাকি কেউ!

বিষণ্ণতা না ছাই! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। আস্ত এক উন্মাদ!

মিলারের সমালোচনা চলছে, এই সময় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল উলফ। মুখটা আগের চেয়ে গোমড়া। বলল, কি, বলেছিলাম না এখানে থাকা নিরাপদ নয়? এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও।,

আর না পালালে? ভুরু নাচাল মুসা। ভূত ছাড়া আর কিছুকে ভয় পাই না আমি। সত্যি করে বলুন, ভূত আছে কিনা? আপনাদের ওই মিলার ভূতফুত না তো?

দেখো, আমার কথা না শুনে ভুল করছ তোমরা… দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল উলফ। বড় বড় হয়ে গেল চোখ।

ফিরে তাকাল কিশোর। রাইফেলে ভর দিয়ে ফিরে আসছেন মিলার। উলফের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, থামলে কেন? চালিয়ে যাও তোমার বক্তৃতা।

কুঁকড়ে গেল উলফ। জ্যাকেটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে চাইল যেন শরীরটা। না, স্যার, আমি তো কিছু বলছি না…

জ্বলন্ত এক চোখ মেলে উলফের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিলার। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না উলফ। চোখ নামাতে বাধ্য হলো।

বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় মিলার বললেন, তোমার ডিউটি রান্নাঘরে, সেখানেই যাও।

যাচ্ছি, স্যার! ভীত ইঁদুরের মত রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল উলফ। পালিয়ে বাচল যেন।

সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মিলারের ঠোঁটে। উলফকে ভয় দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখল কিশোর। উলফ এত ভয় পায় কেন মিলারকে? রোজারকে পায় না। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।

এমনকি অনেক সময় চাপাচাপিও করে। তাতে মনে হয় মনিব-ভূতের স্বাভাবিক সম্পর্কের চেয়ে কিছুটা বেশিই সম্পর্ক রোজারের সঙ্গে। অথচ তারই ভাই মিলারকে দেখলেই যেন গুটিয়ে যায় উলফ।

উলফকে তাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে ঘুরলেন মিলার। পলকে মিলিয়ে গেল হাসিটা। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একভাবে তাকিয়ে থেকে রাইফেলে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন আবার ঘর থেকে।

*

খাওয়ার পর ডাইনিং রূমের বড় জানালাটার ধারে বসে কথা বলছে ওরা। ঘণ্টাখানেক পর ঘরে ঢুকলেন রোজার। সেই সাদা পোশাক পরনে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ তোমরা? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, শোরটাউনে গিয়েছিলাম।

 হ্যাঁ, মিস্টার মিলার বলেছেন আমাদের, কোরি বলল। আন্টি কেমন। আছে?

ভাল। ফোন করেছিলেন। মিলার ধরেছিল। আমরা হোটেল বন্ধ করে দিয়েছি জেনে আর আসেননি। দুদিন ভালমত বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থেকে গেছেন। তোমরা কাজ করছ এখানে, সেটাও জানানো হয়েছে তাঁকে। সবই করেছে মিলার, কেবল তোমাদের বলতে ভুলে গেছে, খবরটা। দুশ্চিন্তায় রেখে দিয়েছে। আজকাল আর কোন কথা মনে থাকে না ওর।

যাক, আন্টি তাহলে ভালই আছে। একটা দুশ্চিন্তা গেল। কিন্তু আমি যে ফোন করলাম, ধরল না কেন? বাড়িতে কেউ ছিল না নাকি?

কি জানি, জিজ্ঞেস করিনি। ভায়োলা চলে যায় হাসপাতালে। তোমার আন্টিও বোধহয় সাগরের ধারে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, তুমি যখন ফোন করেছিলে ওই সময়।

তাই হবে। খবরটা এনে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ও ঠিক আছে। কোন খবর না পেয়ে দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছিল। জোয়ালিন বললেন, কাল-পরশু নাগাদ চলে আসবেন এখানে।…তো ঠিক আছে, তোমরা গল্প করো। আমি যাই।

Super User