০৬.

গটমট করে ঘরে ঢুকে গেল লিলি। পেছনে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা।

এটাই তোমার শেষ সুযোগ! চিৎকার করে বলল পাইক।

বোকা মেয়ে! শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল নিরেক। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে বোঝাও গে। তোমাদের তো বন্ধুই মনে হয়। বলো, পাইকের প্রস্তাব মেনে নিতে। এরকম একটা জায়গা থেকে এর বেশি আর কি আশা করে ও? শুনলাম, ঘোড়াটাও নাকি হারিয়েছে?

খারাপ কথা বাতাসের আগে চলে, আনমনেই বলল রবিন।

রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চাপল নিরেক। দামি যেটা ছিল সেটাও গেল। শুকনো কয়েকটা গর্ত আর ধসে পড়া বাড়ি ছাড়া শেষে আর কিছুই থাকবে না। ব্যাংক আর একটা কানাকড়িও দেবে না। সময় ফুরিয়েছে ওর।

ইউনিকর্নের কথা ভাবল কিশোর। সাংঘাতিক দামি একটা জানোয়ার।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে থামল নিরেক, ঘুরে তাকাল কিশোরের দিকে। শীতল এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আরেকটা কথা, ঘোড়াটা পালিয়েছে একথা আমি বিশ্বাস করি না। লিলি নিজেই চালাকি করে এ কাজটা করেছে, যাতে ওটা পালাতে পারে।

কেন একাজ করবে? প্রশ্ন করল মুসা।

পাইকের দিকে তাকাল একবার নিরেক। বীমার টাকার জন্যে। অনেক টাকা বীমা করান হয়েছে ঘোড়াটার। কিন্তু লাভ হবে না। আমি নিজে চেষ্টা করব, যাতে সমস্ত শয়তানী ফাঁস হয়ে যায়, টাকা আদায় করতে না পারে কোম্পানির কাছ থেকে। জালিয়াতিটা ব্রা পড়লে জায়গা-সম্পত্তি তো যাবেই, জেলেও যেতে হবে। ওকে।

স্থির দৃষ্টিতে লোকদুটোর নেমে যাওয়া দেখল কিশোর।

ওগুলো মানুষ না কি! ঘৃণায় মুখ বাঁকাল রবিন।

জায়গাটা ওর এত দরকার কেন? নিজেকে প্রশ্ন করল যেন কিশোর। র‍্যাঞ্চের কি অভাব পড়ল নাকি এই এলাকায়? জায়গা তো আরও আছে।

হয়ত এরকম আর নেই, মুসা বলল।

হু! দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। ইউনিকর্ন যেখানে লাফিয়ে পড়েছিল সে জায়গাটা দেখতে যাচ্ছি আমি। আসতে চাও?

নিশ্চয়, বলতে এক মুহূর্ত দেরি করল না রবিন।

মুসা মাথা নাড়ল। যাওয়ার তো খুবই ইচ্ছে। কিন্তু কেরোলিন আন্টিকে যে কথা দিয়ে ফেলেছি, বিকেলে রান্নাঘরে তাকে সাহায্য করব। পরে গেলে হয় না?

দেরি করা উচিত না, কিশোর বলল।

তাহলে আর কি করা, নিরাশ ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল মুসা। তোমরাই যাও।

 রওনা হলো কিশোর আর রবিন। গোলাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রবিন বলল, লুক যদি দেখে ফেলে কি বলব?

জানি না। তবে ওর কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমরা।

.

ঘোড়ায় করে সেই শৈলশিরায় চলে এল ওরা, যেখান থেকে হারিয়েছে ইউনিকর্ন। মাটিতে নিজের বুটের আর ঘোড়াটার খুরের ছাপ দেখা গেল। গর্তের কিনারে যেখান থেকে লাফ দিয়েছে সেখানেও রয়েছে, কিন্তু তার পরে আর নেই। একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

মুসা হলে এখন জিনভূতের কাজ বলেই চালিয়ে দিত, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল রবিন।

নদীটা না থাকলে সত্যিই অবাক হতাম। নদীর কিনার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। পানি খুব কম। এটাতে লাফিয়ে পড়ে পানিতে পানিতে হেঁটে চলে যাওয়াটা ওর মত ঘোড়ার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয়।

এই চালাকি একটা ঘোড়া করল? প্রশ্ন তুলল রবিন। তীরে উঠে আবার মুছে দিয়ে গেল সব চিহ্ন?

হোঁচট খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তাই তো! ভাল কথা বলেছ! এই কাজ মানুষ ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব না!

এরপর ভালমত খুঁজতে শুরু করল ওরা। ঘোড়ার চিহ্ন যতটা না খুঁজল তার চেয়ে বেশি খুঁজল মানুষের চিহ্ন। নদীর পাড়ে উজান ভাটিতে বহুদূর পর্যন্ত দেখল। আশপাশের ঝোপ দেখল। কিছুই পাওয়া গেল না। কিছু না। কাপড়ের একটা ছেঁড়া টুকরোও না। কাটা ঝোপে লেগে নেই ঘোড়ার লোম। নদীর পাড়ের নরম মাটিতেও নেই কোন চিহ্ন।

ইউনিকর্নকে বোধহয় এতক্ষণে পেয়ে গেছে লুক, যেন কথার কথা বলল রবিন, গলায় জোর নেই।

কিছুই পেল না ওরা। হতাশ হয়ে ফিরে এল র‍্যাঞ্চে। রান্নাঘরে মুসা তো আছেই, লিলিও আছে। গলা শুকিয়ে গেছে। দুই গ্লাস সোডা নিয়ে বসল কিশোর আর রবিন। লিলিও সঙ্গ দিল ওদেরকে। একথা সেকথা থেকে চলে এল রোডিও খেলার কথায়। রোডিও রাইডিঙের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর সব গল্প লিলির মুখে শুনতে লাগল তিন গোয়েন্দা।

খাইছে! দারুণ খেলা তো! মুসা বলল, আমারও খেলতে ইচ্ছে করছে!

 শুনতে যতটা মজা লাগছে, রবিন বলল, নিশ্চয়ই ততটা নয়। খুব কঠিন খেলা।

আসলে এগুলো একেক জনের কাছে একেক রকম। নেশার মত। নইলে এর চেয়ে বিপজ্জনক খেলা খেলে না লোকে? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও খেলে।

জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আস্তাবলের কাছে দেখা যাচ্ছে লুক। আর জনকে। ইউনিকর্ন নেই ওদের সঙ্গে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিলিও তাকাল। তার ঘোড়ার লাগামটা জনের হাতে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল লুক।

 রান্নাঘরের দরজা ঠেলে ফোরম্যান ঢুকতেই লিলি বলল, তাহলে পাওয়া যায়নি ওকে? রেসের ঘোড়া

নাহ! বুঝতেই পারছি না কোথায় গেল! রুমাল বের করে ভুরুতে লেগে থাকা ঘাম আর ধুলো মুছল লুক। রোদে শুকিয়ে গেছে চামড়া। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তো খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা করবে না, নাকি? বুঝতেই পারছ এসব তোমাদের কাজ নয়। নদীর পাড়ে তোমার বুটের ছাপই মনে হয় দেখেছি, কাল রাতের…

ও আমাদের সাহায্য করতে চাইছে লুক, লিলি বলল। আমি সাহায্য। চেয়েছি। শেরিফের অফিসে গিয়েছিলে?

না। ফোনও করিনি।

ভুরু কুঁচকে ফেলল লিলি। কেন?

করে কোন লাভ হত না। বরং খারাপ হত। গুজব ছড়াত বেশি, অনেক বেশি লোকে জানত, বদনাম বেশি হত র‍্যাঞ্চের।

কিন্তু কারও চোখে পড়লে…।

আশপাশের সব র‍্যাঞ্চারদের খবর দিয়ে দিয়েছি। কাজ হলে ওদেরকে দিয়েই হবে। লিলির দিকে তাকিয়ে কোমল হলো লুকের দৃষ্টি। ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে পাবই আমরা।

পেলেই ভাল। কোলের ওপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল লিলি।

.

ডিনার শেষে সেদিন ক্যানু রেসের জন্যে তৈরি হতে লাগল মেহমানেরা। এই সুযোগে আস্তাবলে গিয়ে একবার তদন্ত চালিয়ে আসা যায়, ভেবে খুশি হয়ে উঠল। কিশোর। সুর্য তখনও ডোবেনি। ইতিমধ্যেই কাজের গতি কমে এসেছে। শ্রমিকদের। কয়েকজন ছুটি নিয়ে শহরেও চলে গেছে। শান্ত হয়ে গেছে র‍্যাঞ্চ। মুসার কানে কানে বলল কিশোর, আমাকে কভার দাও।

কি করবে?

পাহারা দাও তুমি। কয়েক মিনিট লাগবে আমার। ইউনিকর্নের স্টলটায় ভাল করে দেখতে চাই একবার।

ছায়ার মত এসে নিঃশব্দে আস্তাবলটাতে ঢুকল কিশোর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কয়েকটা ঘোড়া। ভেতরে আলো কম, কিন্তু বাতি জ্বালল না সে। বরং পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালল।

আগের বার যেমন দেখেছিল তেমনি রয়েছে ইউনিকর্নের স্টল। কোন সূত্র নেই। সাবধানে সিমেন্টের মেঝেতে আলো ফেলে দেখতে লাগল সে। আলো ফেলল দেয়ালে, ঘরের আড়ায়। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। বেরিয়ে এসে পাশের অন্য স্টলগুলোতে অনুসন্ধান চালাল। নাকি স্বরে ডাকল কয়েকটা ঘোড়া, নাল লাগান খুর ঠকল কঠিন মেঝেতে।

ঘড়ি দেখল কিশোর। পনের মিনিট পার করে দিয়েছে। বেরিয়ে যাওয়া দরকার, নইলে সে কোথায় গেল ভেবে সন্দেহ করে বসতে পারে কেউ।

ফেরার জন্যে ঘুরল কিশোর। হারিকেনের স্টলটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির হয়ে আছে ঘোড়াটা। মাটিতে পা ঠুকছে রাগত ভঙ্গিতে।

ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে উঠল কিশোরের। রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। এরকম করছে কেন ঘোড়াটা? ওকে দেখে? নাকি অন্য কেউ আছে ভেতরে? টর্চ নিভিয়ে দিয়ে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কান খাড়া করে রেখেছে।

বাঙ্কহাউসে হাসছে কেউ। খুর দিয়ে খড় সরাচ্ছে হারিকেন, মাঝে মাঝে নাকি ডাক ছাড়ছে মৃদু স্বরে। এছাড়া আর কিছু নেই। কাউকে দেখা গেল না আস্তাবলে।

কয়েক সেকেণ্ড পরে টর্চ জ্বালল কিশোর। আলো ফেলে তাকাল হারিকেনের স্টলের ভেতর। মাথার সঙ্গে কান লেপ্টে ফেলেছে ঘোড়াটা, বড় বড় করে ফেলেছে। নাকের ফুটো, পেছনে সরে গেছে যতটা সম্ভব। ওর মুখে আলো ফেলল কিশোর, তারপর পায়ে, আরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করল হারিকেন।

পেছনে একটা শব্দ হলো। ধক করে উঠল কিশোরের বুক। ফিরে তাকাতে গেল। প্রচণ্ড আঘাত লাগল মাথায়। একই সময়ে খুলে যেতে লাগল স্টলের দরজা। চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠল যেন তার।

ফিরে তাকাল সে। মুখে এসে লাগল রুপার বালসওয়ালা একটা বেল্টের বাড়ি। লাফিয়ে পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও আঘাতটা এড়াতে পারল না।

বেহুশ হয়ে স্টলের ভোলা দরজা দিয়ে ভেতরে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দেখতে পেল, পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠছে ঘোড়াটা। প্রবল। বেগে সামনের দুই পা নামিয়ে আনবে হয়ত তার ওপর, খুর দিয়ে গেঁথে ফেলবে পেট, বুক। কিন্তু কিছুই করার নেই তার।

.

০৭.

কিশোর! কিশোর! বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল মুসার কণ্ঠ।

চোখ মেলার চেষ্টা করল কিশোর। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মাথার একপাশে। দুর্বল কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল, মুসা, আমি এখানে! স্বর বেরোল না। চোখ মেলল। আস্তাবলের একধারে উজ্জ্বল আলোর নিচে পড়ে আছে সে, মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মুসা আর রবিন।

যাক, খুলেছে, মুসা বলল। কি হয়েছিল, কিশোর?

 মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে কিশোর বলল, কে জানি বাড়ি মেরেছে।

 কে? জানতে চাইল রবিন।

চোখ কুঁচকাল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল। জানি না। কেবল একটা রুপার বাস দেখেছি। হারিকেনের স্টলের সামনে ছিলাম। দরজা খুলে গেল। ভেতরে পড়ে গেলাম।

মুসা বলল, দরজাটা এখন লাগানো। ঘোড়াটাও ভেতরেই রয়েছে।

 যে মেরেছে তাহলে সেই টেনে সরিয়ে এনেছে।

তার মানে খুন করার ইচ্ছে ছিল না, বিড়বিড় করল রবিন। ঠিক আছে, থাক, আমি ডাক্তার কাপলিংকে ডেকে আনি।

না, লাগবে না। আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মিথ্যে বলেনি কিশোর। চোখে। আলো সয়ে আসতেই মাথার দপদপানিটা কমতে লাগল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল। আরও পরিষ্কার হয়ে এল মাথার ভেতরটা।

সত্যি লাগবে না? ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

 না। মাথার ব্যথাটা থাকবে কিছুক্ষণ, বুঝতে পারছি। এক-আধটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলেই সেরে যাবে।

ডাক্তারে দেখলে অসুবিধে তো কিছু নেই? জোর করতে লাগল রবিন। কিছুতেই কিশোরকে রাজি করাতে না পেরে উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। তিনজনে বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। বিকেলের বাতাস একগোছা কোঁকড়া চুল উড়িয়ে এনে ফেলল কিশোরের মুখে। সরানর চেষ্টা করল না সে। বাতাসটা ভাল লাগছে। বলল, কেন মারা হলো আমাকে বুঝতে পারছ তো? কেউ একজন চাইছে না, আমরা তদন্ত করি। হয়ত সূত্রটুত্র রয়ে গেছিল, সরিয়ে ফেলতে এসেছে।

কে? মুসার প্রশ্ন।

সেটা তো আমারও জিজ্ঞাসা। ব্রড জেসন নয়। ক্যানু রেসের জোগাড় করতে লেকে চলে গেছে সে।

কিন্তু গেছে যে দশ মিনিটও হয়নি, রবিন জানাল। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে গেছে।

কেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর।

বাঙ্কহাউসে গিয়েছিল কিছু সেফটি ইকু্যইমেন্ট আনার জন্যে। কেউ পানিতে পড়লে নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বাড়তি লাইফ প্রিজারভার আর প্লেয়ারও নিয়েছে। সাথে গিয়েছিল বেনি আর ওর বাবা। ওরা অবশ্য এখন চলে গেছে।

চমৎকার, দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর। লুকের খবর কি?

মাথা নাড়ল মুসা। কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে বসে তাড়াহুড়ো করে এক কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে গেল, জরুরী কাজ নাকি আছে। এক প্লেট পাই সাধাসাধি। করলাম, নিল না। তাকালই না বলতে গেলে।

আরও চমৎকার। ওরকম করে দেখতে গেলে সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে। কাউকে বাদ দেয়া চলবে না। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারমানে অনেক বেশি জটিল করে তুলছে রহস্যটা সবাই মিলে।

কিশোর, হেসে বলল রবিন, গোয়েন্দাগিরি যে কঠিন কাজ তোমার চেয়ে বেশি তো কেউ আর জানে না। আর যত জটিল হয় রহস্য ততই মজা, তুমিই বল?

.

পরদিন সকাল সকাল বিছানা ছাড়ল কিশোর। গোসল সেরে নিয়ে এসে নীল জিনস পরল, গায়ে চড়াল টি-শার্ট, পায়ে রানিং শু। নাস্তা করতে চলেছে, এই সময় দেখা হয়ে গেল লিলির সঙ্গে।

আমাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার, লিলি জানাল। আর বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে না।

ভাল খবর।

আবার প্র্যাকটিস শুরু করতে পারব, উজ্জ্বল হাসিতে বেরিয়ে পড়ল ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত।

একসাথে নিচে নামল দুজনে। সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল লিলি, বলল, যাবে নাকি? শ্রমিকদের কাজ দেখবে।

যাব।

গোলাঘরের কাছে এল ওরা। গরুঘোড়াগুলোকে ঠিকমত খাওয়ানো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে জেনে নিল লিলি। আরেক দিকে চলল। চোখেমুখে রোদ লাগছে, আপনাআপনি কুঁচকে গেল কিশোরের চোখ। ইতিমধ্যেই গরম হয়ে। উঠেছে সকালটা। ঘোড়ার ওষুধপত্র কোথায় রাখেন? জিজ্ঞেস করল সে।

বেশির ভাগই ট্যাক রুমে, লিলি বলল। এককোণে একটা আলমারি আছে।

কি কি রাখেন?

সব ধরনের ওষুধ, জন্তু জানোয়ারের জন্যে যা যা লাগে–ভিটামিন, অয়েন্টমেন্ট, লিনিমেন্ট, ব্যাণ্ডেজ, আরও অনেক জিনিস। জখম হলে যা দরকার, সবই আছে। সবুজ চোখের তারা স্থির হল কিশোরের মুখে। কেন বলো তো?

ভাবছি, হারিকেনের এই যে মেজাজ বদলে গেল, ওষুধের জন্যে নয় তো? ড্রাগ?

হেসে উঠল লিলি। আমার তা মনে হয় না। একাজ করতে যাবে কেন?

যাবে আপনি যাতে রোডিও খেলায় যোগ না দিতে পারেন।

আমার তা মনে হয় না। এতবড় পাষণ্ড হবে না কেউ, আমাকে ঠেকানোর জন্যে ঘোড়ার সর্বনাশ করবে।

মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। আর সেই লোকই হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে ইউনিকর্নকে।

চুরি? কে বলল? সে তো পালিয়েছে। ব্রড নিজের চোখে দেখেছে।

না দেখেনি, শব্দ শুনেছে। আমি যখন পিছু নিলাম, বনের মধ্যে ওর পিঠে মানুষ দেখলাম বলে মনে হলো।

অন্ধকার ছিল। তোমার ভুলও হতে পারে।

সেজন্যেই তো জোর দিয়ে বলতে পারছি না কিছু।

মাথা ঝাঁকি দিল লিলি। ছড়িয়ে পড়ল লাল চুল। রোদে ঝিকমিক করে উঠল। এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, কিশোর। ইউনিকের পিঠে কোন। মানুষ চড়তে পারে না। চল, নাস্তাটা সেরে নিই। তারপর পাহাড়ে যাব। কোন জায়গায় হারিয়েছে ঘোড়াটা, দেখব।

.

শৈলশিরার নিচে দিয়ে বয়ে যাওয়া, নদীটাকে এই দিনের বেলাতেও রুপালিই লাগছে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা।

তুমি বলছ, গোল গোল হয়ে গেছে রবিনের চোখ, ঘোড়াটা এখান থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়েছে? জখম হয়নি?

তা হতে পারে, জবাবটা দিল লিলি। স্টেটসন হ্যাট মাথায় দিয়েছে। কানার নিচে কাছাকাছি হল ভুরুজোড়া। তবে ওর আন্দাজ খুব ভাল। হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলে। আজ পর্যন্ত ওকে উল্টোপাল্টা পা ফেলতে দেখিনি। কিন্তু গেল কোথায়? মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর তো ফিরে আসার কথা। যত বদমেজাজীই হোক, বাড়ি ছেড়ে থাকার কথা নয়।

ফিরত, যদি চুরি না হত, কিশোর বলল।

কিন্তু কেন চুরি করবে?

আপনি না বললেন, ও আপনার র‍্যাঞ্চের সব চেয়ে দামি সম্পদ?

 লিলির চোখের পাতা সরু হয়ে এল। তাতে কি? নাহয় নিয়ে যাওয়ার কুমতলব হলই কারও, কিন্তু নিয়ে গিয়ে তো সামলাতে পারবে না। ডাবল সির হাতে গোনা কয়েকজন মানাতে পারে ওকে। তাছাড়া ইউনিকের মত একটা জানোয়ারকে চুরি করে নিয়ে বেশিদিন লুকিয়ে রাখাও অসম্ভব।

নতুন কিছু দেখার নেই। লাঞ্চের জন্যে ফিরল ওরা।

দুপুরের খাওয়ার পর ঠিক করল কিশোর, কুপারের সাথে দেখা করতে যাবে। লুকের নিষেধ মানবে না। তাকে জিজ্ঞেস করবে, সত্যিই ঘোড়াটাকে দেখছে। কিনা। দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, যেতে চাও?

মুসা বলল, পরে গেলে হয় না? আমি আর রবিন ভাবছিলাম লেকে গিয়ে সাঁতার কাটব।

প্রস্তাবটা কিশোরের কাছেও লোভনীয় মনে হলো। এই গরমে লেকের ঠাণ্ডা পানিতে বেশ আরাম লাগবে। কিন্তু কাজটা আগে করা দরকার। একাই কুপারের র‍্যাঞ্চে চলল।

চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল গটমট করে দুজন মেহমান এগিয়ে যাচ্ছে একটা কোরালের দিকে, যেখানে একটা ঘোড়া নিয়ে প্র্যাকটিস করছে লিলি। লাল হয়ে গেছে ওদের মুখ। হাত নাড়ল রাগত ভঙ্গিতে।

হলটা কি, ভাবল কিশোর। জানার জন্যে এগোল কোরালের দিকে।

বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল লিলি, সে রয়েছে ভেতরে, বাইরের দিকে দাঁড়াল মেহমানরা। একজন বলল, তুমি কি করবে না করবে জানি না। তবে এই চুরির কথা পুলিশকে জানাবই আমরা।

চুরি?

হ্যাঁ, বলল আরেক মেহমান, সে মহিলা, আমার পার্স চুরি হয়েছে, আমার স্বামীর মানিব্যাগ চুরি হয়েছে।

সত্যি?

তো কি মিথ্যে বলছি নাকি! জ্বলে উঠল মহিলার চোখ। আজ সকালেও আলমারির ড্রয়ারে দেখেছি। নিশ্চয় তোমার কোন কাউবয় ঢুকে চুরি করে নিয়ে গেছে।

ছাই হয়ে গেল লিলির মুখ। মিসেস ব্যানার, একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এখানকার সবাই খুব ভাল মানুষ।

তাহলে কে নিল? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মহিলা।

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এগিয়ে এসে হাতের জিনিসগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো খুঁজছেন তো আপনারা?

হ্যাঁ, কেরোলিনের বাড়ান হাত থেকে ছোঁ মেরে পার্স আর মানিব্যাগটা নিয়ে নিল মিসেস ব্যানার। কোথায় পেলেন?

দ্বিধা করলেন কেরোলিন। অস্বস্তিভরে তাকালেন প্রথমে কিশোরের দিকে, তারপর লিলির দিকে। কিশোরের ঘরটা পরিষ্কার করছিলাম। বিছানায় রাখা ছিল ওর ব্যাগটা। সরাতে যেতেই কাত হয়ে গেল, আর ওটার ভেতর থেকে পড়ল এদুটো।

বলেন কি? চমকে গেল কিশোর।

 শয়তানটা তাহলে তুমিই! কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল মিসেস ব্যানারের। এসব করে পার পাবে ভেবেছ? পুলিশকে অবশ্যই জানাব, যাতে তোমাকে ধরে নিয়ে যায়।

.

০৮.

এতটাই অবাক হয়েছে কিশোর, কথাই সরল না কয়েক সেকেণ্ড। তারপর কোনমতে বলল, আ-আমি কিছু জানি না….আপনার জিনিস আমার ঘরে গেল কি করে?…আশ্চর্য!

দুর থেকে দেখেই কিছু সন্দেহ করেছিল রবিন আর মুসা, এগিয়ে এল শোনার জন্যে। সব শুনে রেগে গিয়ে রবিন বলল, কিশোর চোর না! ওকে যে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মিসেস ব্যানার। তারপর পার্স আর মানিব্যাগের টাকা আর জিনিসপত্র দেখে নিয়ে বলল, সব ঠিকই আছে মনে হয়। যাই হোক, একথা আমি ভুলব না। মানিব্যাগটা স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখ, ঠিক আছে কিনা।

টাকা গুনে নিয়ে মাথা কাত করল মিস্টার ব্যানার, ঠিকই আছে।

ওরা দুজন চলে গেলে লিলি বলল, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কে ঘটাচ্ছে এসব ধরতেই হবে। পিঠ সোজা করে হেঁটে চলেছে মিস্টার আর মিসেস ব্যানার, সেদিকে তাকিয়ে বলল, এমন কাণ্ড এই র‍্যাঞ্চে কোনদিন হয়নি। কিছু বুঝতে পারছি না। 

আমি পারছি, মুসা বলল। নিশ্চয় সত্যের খুব কাছাকাছি চলে গেছে কিশোর, তাই তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা চলছে।

কিশোরের বাহুতে হাত রাখলেন কেরোলিন, বিশ্বাস করো, তোমাকে দোষ দিইনি আমি। আমিও বিশ্বাস করি না তুমি একাজ করেছ।

হাসল কিশোর। আমি কিছু মনে করিনি। তবে যে একাজ করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। ধরবই।

তাই কর, লিলি বলল।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন কেরোলিন, সর্বনাশ! এখুনি গিয়ে রান্না বসাতে হবে, নইলে রাতে ঠিকমত খাবারই দিতে পারব না।

সাহায্য-টাহায্য লাগবে আজকে? কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করল রবিন। তাহলে আমি আর মুসা করতে পারি…

বাধা দিয়ে মুসা বলল, আসলে, আমার আজ…

  করতে ভাল লাগছে না তো? মুসার ইচ্ছে বুঝতে পেরে হাসলেন কেরোলিন। কিন্তু বাবা, আজকে যে আমার সাহায্য দরকার। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বেতার ওপর স্পেশাল একটা ডিশ করতে যাচ্ছি। একা সামলাতে পারব না। একজন অন্তত এসো।

এই অনুরোধের পর আর কথা চলে না। রবিন, মুসা দুজনেই চলল কেরোলিনের সঙ্গে। ওরা রওনা হয়ে গেলে ডেকে বলল কিশোর, যাও তোমরা। আমিও আসছি।

লিলি বলল, মিসেস ব্যানারের ব্যবহারটা দেখলে? কিশোর বলল, ওরকম চুরি হলে আমিও করতাম। তাকে দোষ দিতে পারছি না। আমার কথা ভেবে যদি লজ্জা পেয়ে থাকেন, ভুলে যান। এসব অভ্যাস আছে আমার। এর চেয়ে বেশি অপমানও হয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত জবাব দিয়ে তারপর ছেড়েছি। এবারেও তাই করব। আসলে, কারও বিপদের কারণ হয়ে উঠেছি আমি। সেজন্যেই চাইছে না আমি তদন্ত করি। ভয় পেয়ে গেছে। থামাতে চাইছে। ইউনিকর্নকে কে পালাতে সাহায্য করে থাকতে পারে কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

ও একা একা পালিয়েছে এটা মেনে নিতে পারছ না?

আপনি পারছেন?

শ্রাগ করল লিলি। না, আমিও অবশ্য পারছি না। তবে পুরো ব্যাপারটাই যেন কেমন! কোন চিহ্ন নেই, কিছু নেই…একেবারে হাওয়া!

বনবন করে ঘুরছে যেন কিশোরের মগজের চাকাগুলো। দুটো ব্যাপার হতে পারে। হয় আপনাআপনিই পালিয়েছিল ইউনিকর্ন, সেটাকে কাজে লাগিয়েছে যে ওকে চুরি করেছে। পালানর পর কোনভাবে ধরে তার পিঠে চেপেছে। নয়তো পালাতে সাহায্য করেছে প্ল্যান করেই।

কাকে সন্দেহ করছ? ব্রড জেসন? নিচের ঠোঁটে কামড় দিল লিলি।

হতে পারে। কিংবা এমন কেউ হতে পারে, যে আপনাকে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিওতে শরিক হতে দিতে চায় না। আমার ধারণা, ইউনিকর্নের পালান আর হারিকেনের খেপে যাওয়ার পেছনে একই কারণ। দুটো ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক। আছে।

কি?

এখনও জানি না। কিন্তু ইউনিক আর হারিকেনকে ছাড়া আপনি না পারবেন ঘোড়ার বাচ্চা বিক্রি করে টাকা দিতে, না পারবেন রেডিওতে জিতে টাকা জোগাড় করতে। ধার আর শোধ করা হবে না আপনার। ধার যাতে শোধ করতে না পারেন তার জন্যেও এসব করা হয়ে থাকতে পারে।

হু, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি।

বেড়ায় হেলান দিল কিশোর। পাইককে বলতে শুনেছি, যেভাবেই হোক, র‍্যাঞ্চটা আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেবেই। নিরেকের কাছে বলেছে।

সে-ই এর পেছনে নয় তো?

সরাসরি হ্যাঁ না বলে কিশোর বলল, ওর সম্পর্কে আরও জানতে হবে আমাকে।

মুখ বাঁকাল লিলি। আমি আর জানতে চাই না। যত কম জানি ততই ভাল। আমার জন্যে। ওই লোকটাকে দেখলেই ভয় লাগে আমার। কেঁপে উঠল সে। কোনদিনই র‍্যাঞ্চ আমি ওর কাছে বেচব না। আকাশের দিকে তাকাল। এক রত্তি মেঘ নেই কোথাও। আজ রাতেই আমি ঘোষণা করে দেব, আবার রোডিও খেলব। আমি। এখন কেবল ইউনিকর্নকে দরকার আমার। ওকে পেতেই হবে।

পাব। খুঁজে বের করব, কথা দিল ওকে কিশোর। ডবসি কুপারের র‍্যাঞ্চে যাব। আমি। তাকে জিজ্ঞেস করব সত্যিই ইউনিকর্নকে দেখেছে কিনা।

আমার বিশ্বাস হয় না, লিলি বলল। অন্য কোন ঘোড়া দেখেছে কুপার। ইউনিককে নয়।

তবু, কথা আমি বলতে যাবই।

যাওয়ার দরকার নেই। আজ রাতে বারবিকিউ পার্টিতে দাওয়াত করেছি, আসবে। বেড়ার ওপরের রেইলে চাপড় মারল লিলি। যাই, কাজ করিগে। পরে কথা হবে।

বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। কিছুদূর যাওয়ার পর আস্তাবলের দিক থেকে ব্রডকে যেতে দেখে সেদিকে এগোল। কাঁধের ওপর দিয়ে একবার ঘুরে তাকিয়ে গিয়ে একটা স্টেশন ওয়াগনে উঠে চালিয়ে নিয়ে চলে গেল লোকটা। আরেকবার আস্তাবলের ভেতরে দেখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

আস্তাবলের ভেতরে অন্ধকার, শান্ত, কেমন একটা তেলতেলে গন্ধ। ঘোড়াগুলো সব বাইরে। সোজা ইউনিকনের স্টলের দিকে এগোল কিশোর। সব আগের মতই রয়েছে, কিছুই বদল হয়নি। খড় ছড়ানো, খাবারের বাক্সটা অর্ধেক ভরা, হুকে ঝোলান পানির বালতি, দরজার পাল্লা ভাঙা। মেরামত করা হয়নি। একবার দেখে। ঘুরতে যাবে এই সময় মনে হলো কি যেন একটা বাদ পড়েছে। কিংবা কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, সব ঠিকঠাক নেই। ভাল করে আরেকবার দেখল সে। কই, সবই তো ঠিক আছে? সত্যিই আছে তো?

আনমনেই একবার ভ্রূকুটি করে হারিকেনের স্টলের দিকে তাকাল সে। ওটাও একই রকম রয়েছে, কেবল খড়ের রঙটা অন্য রকম লাগছে। বদলানো হয়েছে। বোধহয়।

কিশোরের মন বলছে, মূল্যবান একটা সূত্র রয়েছে আস্তাবলের ভেতরে। নজরে পড়ছে না। গভীর ভাবনায় ডুবে থেকেই আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল সে, রওনা হল বাড়ির দিকে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল কাজ করছে মুসা আর রবিন।

ময়দা মাখাচ্ছে মুসা। রবিন পেঁয়াজ কুচি করছে। সসপ্যানে মাংস ভাজছেন। কেরোলিন।

আমি কোন সাহায্য করতে পারি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নিশ্চয়, জবাব দিল রবিন। বাকি পেঁয়াজগুলো যদি কেটে দিতে… চোখ ডলতে লাগল সে। লাল হয়ে গেছে। পানি বেরোচ্ছে পেঁয়াজের ঝাঁজে।

মাংসে টমেটো সস আর বীন মেশাতে মেশাতে কেরোলিন অনুরোধ করলেন, কনগুলো যদি পরিষ্কার করে আন, খুব ভাল হয়।

যাচ্ছি। প্যানট্রিতে এসে ঢুকল কিশোর। কর্ন বের করার জন্যে হাত বাড়াতেই ঠেলা লেগে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা খবরের কাগজ। পুরানো হতে হতে হলদে হয়ে গেছে।

দূর! কাগজগুলো আবার তুলে ঠিক করে রাখতে লাগল সে।

আধ ঘন্টা পরে ডিনার তৈরি হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ঢুকল লুক বোলান। থমথমে চেহারা। জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?

মনে হয় দোতলায়, কেরোলিন বললেন।

না, এই তো, দরজার কাছ থেকে বলল লিলি। পরনে কালো জিনস, গায়ে লাল-সাদা চেক শার্ট, মাথায় টকটকে লাল হ্যাট।

খারাপ খবর আছে, লুক বলল। ইউনিককে পাইনি। মনে হয়, চিরকালের জন্যেই গেল।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল লিলি। বিড়বিড় করে বলল, বিশ্বাসই করতে পারি না!

বিশ্বাস তো আমিও করতে পারছি না, লুক বলল। শেষ পর্যন্ত শেরিফকে জানাতে বাধ্য হয়েছি। দশ মাইলের মধ্যে পাড়াপ্রতিবেশী যত আছে, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ দেখেনি ওকে।

লুকিয়ে রয়েছে হয়তো কোথাও, কিশোর বলল।

কোথায়? ভুরু কোঁচকাল লুক। কোনখানে?

এখনও জানি না। তবে কেউ ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছে ওকে।

পাগল! ফেটে পড়ল লুক, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ছেলে! শহরে তোমরা কিভাবে গোয়েন্দাগিরি কর, জানি না, তবে এখানে আমরা কোন কিছু চুরি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তারপর চোরকে ধরার চেষ্টা করি।

কিশোর তো সেটাই করতে চাইছে, লিলি বলল। ওর ধারণা, ইউনিককে চুরি করা হয়েছে।

হায় হায়, বলে কি! চোখ বড় বড় হয়ে গেল কেরোলিনের।

লুকের চোখে অবিশ্বাস ফুটল। এসব অতি কল্পনা। ঘোড়াটা পালিয়েছে, এটাই সহজ জবাব।

 তাহলে পাচ্ছি না কেন ওকে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। আটকে রাখা না হলে ও এতক্ষণে চলে আসত। গৃহপালিত কোন জানোয়ারই বাড়ি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে না।

পাগল হয়ে গেছে! মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল লুক।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন কেরোলিন। তারপর বললেন, এখানে আমিই সামলাতে পারব। তোমরা গিয়ে ঘরটর গোছগাছ কর।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অ্যাপ্রন খুলতে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। তবে রবিন বলল, তোমরা যাও। আমি আসছি।

ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল কিশোর। এসে বসল মুসার বিছানায়। বলল, সেই অনুভূতিটা হচ্ছে আবার আমার। কোন কিছু মিস করলে, ধরি ধরি করেও ধরতে না পারলে যেটা হয়। জরুরী কোন একটা সূত্র।

কি? মুসা জিজ্ঞেস করল।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। হাতের তালুতে থুতনি রাখল কিশোর। যদি খালি বুঝতে পারতাম কে ইউনিকর্নকে চুরি করেছে আর ব্যানারদের জিনিসগুলো। আমার ব্যাগে রেখেছে…।

এবং কে হারিকেনকে ওষুধ খাইয়েছে,মুসা বলল। এই তো?

যদি খাইয়ে থাকে। যাই হোক, এই মুহূর্তে এটাও প্রমাণ করতে পারছি না। আমরা।

তারমানে যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি, এগোতে পারিনি একটুও?

আলমারির আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আনমনে মাথা দোলাল, অনেকটা সেই রকমই।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল রবিন। চকচক করছে। চোখ। চিৎকার করে বলল, পেয়ে গেছি। ধরে ফেলেছি ব্যাটাকে!

সতর্ক হল কিশোর। আহ, আস্তে! দরজা লাগাও!

দরজাটা লাগিয়ে দিল রবিন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, কে সব কিছুর পেছনে বুঝে ফেলেছি!

.

০৯.

কে? একসাথে জিজ্ঞেস করল কিশোর আর মুসা।

ব্রড জেসন! অ্যাপ্রনের পকেট থেকে হলদে হয়ে আসা একটা খবরের কাগজ বের করল রবিন। স্থানীয় কাগজ, নাম ক্রনিকল। বাড়িয়ে ধরল সেটা কিশোরের দিকে।

গল্পটা ছয় মাসের পুরানো। কুপার র‍্যাঞ্চের মেহমানদের টাকা আর জিনিসপত্র চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ব্রডকে। র‍্যাঞ্চ থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাকে কুপার। কুপার র‍্যাঞ্চের কথাও বিশদ লেখা রয়েছে স্টোরিটায়। অনেক বড় জমজমাট র‍্যাঞ্চ। ওটার মালিক বিখ্যাত রোডিও খেলোয়াড় বেনি কুপারের বাবা ডবসি কুপার। টুরিস্ট জায়গা দেয়া ছাড়াও রোডিও খেলার উপযোগী ঘোড়ার প্রজনন করেন। বিচিত্র সব সরীসৃপের ছোটখাট একটা চিড়িয়াখানাও আছে র‍্যাঞ্চে।

বের করলে কি করে ওটা? জিজ্ঞেস করল মুসা।

 বিছানার পাশে বসল রবিন। হাসল। প্যানট্রিতে একগাদা কাগজ দেখে কৌতূহল হল। গিয়ে দেখতে লাগলাম কাগজগুলো। কিছু পেয়ে যাব ভাবিনি, এমনিই দেখছিলাম। চোখে পড়ে গেল হেডলাইনটা।

ব্রড কেন ইউনিকর্নকে ছেড়ে দেবে? তার কি লাভ?

যেহেতু বেনি কুপার তার গার্লফ্রেণ্ড।

উজ্জ্বল হলো কিশোরের মুখ। ঠিক। লিলি প্রতিযোগিতায় নামলে বেনির সর্বনাশ। জিততে পারবে না।

কেরোলিন আন্টির কাছে শুনলাম প্রতিযোগিতাটা টেলিভিশনে দেখাবে, রবিন জানাল। যে জিতবে, তাকে নাকি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে।

বাপরে! গাল ফুলিয়ে ফেলল মুসা, বিরাট টাকার ব্যাপার!

সেই সঙ্গে সম্মান এবং খ্যাতি, কিশোর বলল।

সহজেই ধরে নেয়া যায়, রবিন বলল, বান্ধবীর জন্যে এসব অকাজ করছে। ব্রড। স্যাবোটাজ করে চলেছে ডাবল সিকে।

ওরকম জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না অবশ্য, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কারণ কিছুই প্রমাণ করতে পারিনি আমরা এখনও।

 রহস্যময় হাসি হাসল রবিন। পারিনি, করে ফেলব। ধবধবে সাদা একটা স্টেটসন হ্যাট খাঁটি কাউবয় কায়দায় মাথায় বসিয়ে দিয়ে বলল, চলো।

কোথায়? মুসার প্রশ্ন। পার্টিতে?

উঠে দাঁড়াল কিশোর। আমি যাচ্ছি ব্রড জেসন আর ডবসি কুপারের সঙ্গে কথা বলতে।

.

এক ঘণ্টা পরে বারবিকিউ সস, সদ্য বেক করা কর্নব্রেড আর স্ট্রবেরি পাইয়ের সুবাস ভুর ভুর করতে লাগল বাতাসে। খোলা একটা নিচু জায়গায় হাজির হল মেহমানেরা, যেখানে এই বিশেষ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বারবিকিউ হয়। খোলা জায়গায়। মূল খাবার হয় আস্ত গরু, ভেড়া কিংবা শুয়োরের ঝলসান মাংস। গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে চামড়া ছাড়ানো, নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে দেয়া আস্ত এক গরু। নিচে আগুন জ্বলছে। সেই আঁচে সেদ্ধ হচ্ছে মাংস, চর্বি গলছে চড়চড় শব্দ করে, কাবাবের জিভে-পানি-আসা গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে ঝুলছে অনেকগুলো লণ্ঠন। সেই সাথে অনেক মানুষের কথাবার্তার গুঞ্জন এক বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

ওখানে হাজির হলো তিন গোয়েন্দা। ডাবল সির মেহমানরা তো রয়েছেই, আশেপাশের অনেক র‍্যাঞ্চ থেকেও অনেকে এসেছে। নিয়ম হলো যার যার খাবার। প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে হবে। কিশোরও নিল। চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে পরিচিতি অপরিচিত মানুষের ওপর। বেনিকে দেখতে পেল। লণ্ঠনের আলোতেও ঝলমল করছে চুল। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন লম্বা, বলিষ্ঠ একজন মানুষ। চুল সাদা। ভারি কণ্ঠস্বর, হাসিটাও তেমনি ভারি।

আমি যাচ্ছি, রবিনের কানে কানে বলল কিশোর। লোকজনের ভেতর দিয়ে এগোল বেনির দিকে। কাছে গিয়ে হেসে হাত নেড়ে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বলল, হাই।

হাই। কিশোর পাশা না? এমন ভঙ্গিতে তাকাল, বেনি, যেন চিনতে পারছে না কিশোরকে।

হ্যাঁ, জবাব দিয়ে পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকাল কিশোর।

আমি ডবসি কুপার, বেনির বাবা, গমগম করে উঠল ভদ্রলোকের গলা। হাত বাড়িয়ে কিশোরের হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকি দিলেন। ওয়েলকাম টু মনটানা।

থ্যাঙ্ক ইউ।

শুনলাম, তুমি ডিটেকটিভ?

 ঝট করে বাবার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল আবার বেনি।

ঠিকই শুনেছেন, দরাজ হাসি হাসল কিশোর। ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি আপাতত। রাতের বেলা আস্তাবল থেকে পালিয়েছে।

 শুনেছি, কুপার বললেন। বেনির কাছেই শুনলাম। পরে আমার র‍্যাঞ্চের পশ্চিম ধারে ওরকম কালো একটা ঘোড়াকে দেখেছিও। এখন মনে হচ্ছে ওটা ইউনিকর্ন নয়। অন্য ঘোড়া। ভুলটা কিভাবে করলাম বুঝতে পারছি না। ঘোড়ার ব্যাপারে তো এরকম ভুল আমি করি না। তবে, ইউনিকর্ন আর হারিকেনকে আলাদা করে চিনতে পারব না, এটা ঠিক। দুটো ঘোড়াই অবিকল এক রকম। এত মিল কমই দেখা যায়।

আপনি কেন, বাইরের কেউই পারবে না, কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ব্রড, কিশোর কিংবা কুপার কেউই টের পাননি। ঘুরে তাকাল কিশোর। ব্রডকে যেন আর এখন চেনাই যায় না। পরিষ্কার জিনস, প্রেইড শার্ট আর রুপার বাক্স ওয়ালা বেল্ট পরেছে। ঠিক এরকম বাকলসওয়ালা বেল্টের বাড়িই সেদিন আস্তাবলে খেয়েছিল কিশোর, মনে আছে। তাহলে কি ব্রডই তাকে মেরেছিল? নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এখানে অনেকেই বেল্টে রুপার বাস লাগায়। ইউনিকনের চুরির দায়টা ওর ওপর চাপানর মতও কোন প্রমাণ তার হাতে নেই।

ব্রডকে দেখেই কঠিন হয়ে গেল কুপারের চেহারা। কিন্তু তোয়াক্কা করল না ব্রড।

মুসা তোমাকে খুঁজছে, কিশোরকে বলল সে। বেনির দিকে তাকিয়ে কোমল হল দৃষ্টি। দ্রুত হেঁটে চলে গেল আরেক দিকে।

কিশোরও সরে গেল ওখান থেকে। তবে মুসার কাছে না গিয়ে পিছু নিল ব্রডের। আস্তাবলের দিকে চলেছে লোকটা। ডাক দিল সে, এই যে, শুনুন।

থেমে গেল ব্রড। বুটের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরল। কর্কশ গলায় বলল, এখানে নয়, তোমার বন্ধু পার্টিতে।

জানি। আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছি।

কথা বলার মোটেও ইচ্ছে নেই ব্রডের। কি কথা?

সেদিন রাতে, আমি যখন আস্তাবলে..

মনে আছে। অনেক প্রশ্ন করেছিলে। আমি তখন হারিকেনকে ঠাণ্ডা করছিলাম।

না না, তার পরে। আমি যখন আবার একা গেলাম…

 ভয়ানক বোকামি করেছ! এবারেও কথা শেষ করতে দিল না কিশোরকে ব্রড। হারিকেনের মেজাজ তখন চরমে!

হাল ছাড়ল না কিশোর, সেদিন রাতে ওই সময় আপনার লেকে থাকার কথা, ক্যানু রেস হচ্ছিল।

শক্ত হয়ে গেল ব্রডের চোয়াল। সরু হয়ে এল চোখের পাতা। তুমি তখন। আস্তাবলে কি করছিলে?

সূত্র খুঁজছিলাম।

অ্যাঁ! ও, শুনেছি, তোমার নাকি ধারণা ইউনিক চুরি হয়েছে, কে করেছে সেটা জানার জন্যে তদন্ত চালাচ্ছ। হেসে উঠল ব্রড। বড়ই যেন মজা পাচ্ছে এরকম। একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এখানে কোনই রহস্য নেই কিশোর পাশা, কাজেই রহস্যভেদের চেষ্টা বৃথা। আমার পরামর্শ শুনলে, বাদ দাও এসব…

ব্রডের বেশি কথাও ভাল লাগছে না কিশোরের, বলল, মেরে আমাকে বেশ করে ফেলা হয়েছিল। পেছন থেকে কে জানি এসে মাথায় বাড়ি মারল।

এতক্ষণে হাসি বন্ধ হল ব্রডের। বলো কি? কই, আমি তো কিছু শুনিনি?

কার কাছে শুনবেন? কাউকে বলিনি তো।

এরকম কিছু ঘটতে পারে না, এটাই বোধহয় বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল ব্রড। জিজ্ঞেস করল, তারপর?

আমার বন্ধুরা গিয়ে বেহুশ দেখতে পেল আমাকে।

লোকটাকে দেখেছ?

না। তবে রুপার বাল্সওয়ালা বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরেছিল, দেখেছি, আপনি যেটা পরেছেন সে রকম।

রেগে গেল ব্রড, তুমি বোঝাতে চাইছ আমি মেরেছি? নিজের বেল্টের দিকে আঙুল তুলে বলল, এটা আমি পুরস্কার পেয়েছি কয়েক বছর আগে রোডিও খেলায়। অনেকেই পেয়েছে। আজ রাতে পাটিতেই অন্তত দশবারোজনের কোমরে দেখতে পাবে।

কার কার?

লিলি, জন, লুক, ভাবছে ব্রড, এই র‍্যাঞ্চের দুজন শ্রমিক। বাইরের তো আছেই।

কুপার র‍্যাঞ্চের?

আছে।

বেনি কুপারের?

কয়েকটা আছে। বেনির কথা বলার সময় কোমল হল ব্রডের কণ্ঠ, পরের কথাটা বলতে গিয়েই নিমের তেতো ঝরল যেন, ওর বাবারও আছে।

চমৎকার, ভাবল কিশোর। ব্রডের কথা ঠিক হলে এ এলাকার অর্ধেক মানুষেরই আছে রুপার বাক্স। ওটাকে সূত্র হিসেবে ধরে তদন্ত করতে যাওয়া আর খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা একই কথা।

আস্তাবলের দিকে আবার পা বাড়িয়ে ব্রড বলল, দেখো, আমার সত্যিই কাজ আছে। ঘোড়াগুলোকে খাবার দিতে হবে…

আর একটা কথা, তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর, আপনি কুপারের ওখানে চাকরি করতেন, তাই না?

থমকে গেল ব্রড। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি করে জানলে?

কাগজে পড়েছি।

পুরানো ইতিহাস! বিড়বিড় করল ব্রড। তাহলে নিশ্চয় জানো, চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল আমাকে?

বড় শাস্তি দিতে পারেননি বলে নিশ্চয় হতাশ হয়েছিলেন মিস্টার কুপার?

আঙুল মুঠো করে ফেলল ব্রড। ওর সঙ্গে আমার কোনদিনই বনিবনা ছিল না। আমাকে পছন্দ করেনি। বেনির সঙ্গে নাকি আমাকে একেবারেই মানাবে না। মেহমানদের জিনিস চুরি করি আমি, একথাটা যেই জানল, সুযোগ পেয়ে গেল। বের করে দিল আমাকে র‍্যাঞ্চ থেকে। শাসিয়ে বলল; আর যেন কখনও বেনির। সঙ্গে দেখা না করি।

রাগটা ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছে ব্রডের।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, তারপর এখানে চাকরি নিলেন?

দেখ, উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে বসো না। লিলির সঙ্গে আমার কোন মন। দেয়ানেয়ার ব্যাপার নেই। আমাকে আর দশজন কর্মচারীর মতই কাজে নিয়েছে। কেরোলিন আন্টি বলেকয়ে রাজি করিয়েছে তাকে। তারপর থেকে আমি সৎ হয়ে গেছি। ঠিকমত কাজ করছি। সবাইকে বোঝানোর জন্যে যে, যা করেছি তার জন্যে আমি অনুতপ্ত, আর কোনদিন করব না ওরকম কাজ।

লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। তাহলে আপনি বলতে পারবেন না ব্যানারদের জিনিস চুরি করে কে আমার ব্যাগে রেখে গেল?

তোমার ধারণা আমি করেছি? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার? এখানেও ওরকম কোন বদনাম হলে র‍্যাঞ্চে চাকরির আশা আমার শেষ। কেউ আর আমাকে কাজ দেবে না। তাছাড়া এই চাকরিটা খুব ভাল। বোকামি করে মরার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। ইয়ে, ওদের ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা চুরি গেছে নাকি কিছু?

প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল।

আমি নই, এটুকু বলতে পারি। আর দাঁড়াল না ব্রড। দুপদাপ পা ফেলে আস্তাবলের দিকে রওনা হয়ে গেল।

দরজা দিয়ে ওকে ঢুকে যেতে দেখল কিশোর। ভাবছে, সত্যি বলেছে লোকটা? চুরির অভ্যাস ছিল একসময়। ইউনিকর্নকে ও-ই চুরি করল? তাহলে হারিকেনের ব্যাপারটা কি? ঘোড়াকে সত্যিই ভালবাসে ব্রড, এরকম একজন লোক ওষুধ খাইয়ে ক্ষতি করবে একটা ঘোড়ার, আতঙ্কিত করে তুলতে চাইবে? নাকি লুক বোলানের কথাই ঠিক, বদ রক্ত রয়েছে শরীরে তাই খারাপ হয়ে গেছে। হারিকেন? ইউনিকর্ন এখন কোথায়? পাহাড়ে, বনের ভেতরে লুকিয়ে আছে, নাকি কোথাও আটকে রাখা হয়েছে তাকে?

 কি ব্যাপার, পার্টিতে ফিরে আসার পর মুসা জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, মনে হয় এই দুনিয়ায় নেই?

না, আছি। ভাবছিলাম, আশপাশের র‍্যাঞ্চ মালিকদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ওর কথার শেষ অংশটা শুনে ফেলল লিলি। বলল, যাওয়ার আর দরকার কি? এখানেই অনেকে আছে। বলে ফেললেই পারো।

কয়েকজনের সাথে কথা বলল কিশোর, লাভ হলো না, জানতে পারল না। নতুন কিছু। পালিয়ে যাওয়ার পর ইউনিকর্নকে দেখেইনি কেউ। তবে এলসা কারমল নামে এক বিধবা মহিলা একটা মূল্যবান কথা বললেন। স্বামীর রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তির মালিক। কুপার র‍্যাঞ্চের পশ্চিমে তাঁর জমি। বললেন, দেখো, ইউনিকর্নের মত শয়তানেরও দিনে দুবেলা খাবার দরকার পড়ে। বড় জানোয়ার, বেশি খাবার দরকার। ওদিকে, যেদিকে ঘোড়াটা লুকিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেদিকে হাত তুলে তিনি বললেন, খাবার খুবই কম। ঘোড়ারা বুদ্ধিমান জানোয়ার, লুকিয়ে পড়ার ওস্তাদ, কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, কে জানে। ওই যে, ব্যাণ্ড শুরু হলো।

একটা কাঠের মঞ্চে উঠে বাজনা শুরু করেছে তিনজন স্থানীয় বাজনদার। সেদিকে এগিয়ে গেল কিশোর। বেনির সঙ্গে কথা বলছে ওখানে লিলি। বেনি বলছে, সত্যিই আবার রোডিওতে ফেরত যাবে?

চাইছি তো। ভাবছি, ইনডিপেনডেন্স ডে থেকে শুরু করব।

 বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না? এক বছর ধরে প্র্যাকটিস নেই, পারবে?

 পারতে হবে। টাকা দরকার আমার।

বড় বেশি ঝুঁকি নিতে যাচ্ছ। একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে…

 হারিকেন পাগল নয়।

আব্বাকে লুক বলেছে ঘোড়াটা পাগল হয়ে গেছে। ব্রডও বলেছে। আমি হলে ওরকম একটা বদমেজাজী ঘোড়ার পিঠে কখনই চড়তাম না।

আর কোন কথা হল না। চলে গেল বেনি।

কিশোরের ওপর চোখ পড়ল লিলির। বলল, দেখলে, কেমন করে চলে গেল?

দেখলাম। বেনির ওপর নজর কিশোরের। ব্রডের হাত ধরেছে গিয়ে মেয়েটা। কাছেই রয়েছেন তার বাবা, পরোয়াই করল না। গম্ভীর হয়ে গেছেন কুপার, ভূতপূর্ব কর্মচারীর সঙ্গে নিজের মেয়ের এই আচরণ সহ্য করতে পারছেন না। তিনি। লিলির দিকে ফিরল কিশোর। শুনলাম, কুপার র‍্যাঞ্চে নাকি কাজ করত ব্রড।

মাথা ঝাঁকাল লিলি। কেন বের করে দিয়েছে জানো?

জানি।

ও, জান। আমি আরও ভাবলাম, তোমাকে বলব, ওর চুরির স্বভাব ছিল। তবে এখন ও ভাল হয়ে গেছে। ব্যানারদের জিনিস ও চুরি করেনি। ইউনিকের নিখোঁজ হওয়ার পেছনেও তার হাত নেই। অহেতুক আর এখন ওর অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা ঠিক হবে না।

পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে বাজনা। আঞ্চলিক গানের সুর বাজাচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ শুনে আবার বলল লিলি, এই বাজনার পরেই আমি রেডিওতে যোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করব।

গুড লাক, শুভেচ্ছা জানাল কিশোর। হঠাৎ বলে উঠল, আরি!

কি? কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে লিলিও দেখতে পেল লম্বা সাদা সেডান গাড়িটা, র‍্যাঞ্চে ঢুকছে। আবার এল!

আরও খানিকটা এগিয়ে থামল গাড়িটা। বেরিয়ে এল ফিলিপ নিরেক। অন্য পাশের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে পাইক, নামল না। সোজা লিলির দিকে এগিয়ে এল নিরেক। কাছে এসে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল, যা বলেছিলাম। এটাই ঘটবে।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লিলি।

কি আর? ব্যাংক সময় দিতে পারবে না। এক মাসের সময় আছে আর। এর। মধ্যে হয় সব টাকা শোধ করবে, নয়ত জায়গা ছাড়বে। এই যে, চিঠি।

এসব আপনি করেছেন! সব আপনার শয়তানী! লিলির চিল্কারে বাজনা থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল বাদর্কেরা। মেহমানদের চোখও ঘুরে গেল এদিকে।

বেশ, আমি করেছি, তাতে কি? নির্লজ্জের মত বলল নিরেক। ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গেও কথা বলেছি। ওরা বলেছে, ইউনিকনের জন্যে পয়সা দেবে না। যে যে কারণে টাকা দেয়ার কথা তার কোনটাই ঘটেনি বলে তাদের বিশ্বাস। মরেনি, জখম হয়নি, চুরি যায়নি। ওদের ধারণা, তুমিই কোথাও নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছ।

শক্ত হয়ে গেছে লিলির কাঁধ। টাকা কি চাইতে গেছি নাকি আমি ওদের কাছে? কথাই বলিনি।

বললেও দেবে না। ঘুরে গাড়ির দিকে রওনা হলো নিরেক।

তাড়াহুড়া করে লিলির কাছে এসে দাঁড়ালেন কেরোলিন। একটা গোলমাল হয়ে গেছে। বিকেলে দোকান থেকে সোডা আনতে ভুলে গেছে ব্রড। চা-ও নেই। ডেরিককে ফোন করেছিলাম। দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিল, বলেছে আমাদের জন্যেই খোলা রাখবে।

মেহমানদের ওপর চোখ বোলাল লিলি। বেশ, যাচ্ছি।

যেতে আসতে কতক্ষণ লাগে? জানতে চাইল কিশোর।

এই মিনিট বিশেক।

তাহলে আমিই যাই। আপনার বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছে, আপনার। এখানে থাকা দরকার।

তুমি যাবে?

যাই না, অসুবিধে কি?

বেশ। দোকানদারের নাম ডেরিক লংম্যান। শহরের ধারেই দেখতে পাবে। মার্কেটটা। জিনসের পকেট থেকে চাবি বের করে দিয়ে লিলি বলল, আমার স্টেশন ওয়াগনটা নিয়ে যাও। ফিরে তাকিয়ে বাদকদেরকে ইশারা করল। মাথা ঝকাল দলপতি। আবার শুরু হল বাজনা।

রবিনকে কাছাকাছি দেখে সেদিকে এগোল কিশোর। তোমরা থাকো, আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছ?

দোকানে। কয়েকটা জিনিস ফুরিয়ে গেছে।

 চলো, আমিও যাব।

যাবে? ঠিক আছে। মুসাকে বলে এসো। নইলে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করবে। আর আসতে চাইলে আসুক। আমি গাড়ি বের করিগে।

মুসা এল না। খেতে ব্যস্ত। রবিন আর কিশোরই চলল। পার্টির জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে রাখা হয়েছে গাড়িটা। পুরানো ঝরঝরে একটা স্টেশন ওয়াগন। গায়ে আঁকা রয়েছে ডাবল সি র‍্যাঞ্চের নাম আর মনোগ্রাম–একটা কালো ঘোড়ার ছবি।

ভাবছি, কিশোর বলল, ইচ্ছে করে ভুল করেনি তো ব্রড? সোডা আনতে ভুলে যায়নি তো?

তা কেন করবে?

জানি না, গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল কিশোর। হয়তো গোলমাল আরও বাড়ানর জন্যেই। ইগনিশনে মোচড় দিল সে।

কেশে উঠে চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। গিয়ার দিল কিশোর। একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এল। মাথার ভেতর বেজে উঠল ওয়ার্নিং বেল। খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরে আরেক হাত বাড়াল দরজা খোলার জন্যে। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি বেরোও…!

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বোমা ফাটার মত আওয়াজ হলো।

Super User