০৩.

একটানে পেছনের দরজাটা খুলেই লাফিয়ে বাইরে নামল কিশোর। ছুটল চতুর ধরে, ভয় খাওয়া ঘোড়াটার দিকে। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল গাড়িটা।

ঘোড়াটার কাছে চলে এল কিশোর। জিন আঁকড়ে ধরতে গেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ওটা, চাবুকের মত শপাং করে এসে ওর মুখে বাড়ি লাগতে যাচ্ছিল ঘোড়ার মুখের লাগাম। সময়মত হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ওটা। লুক বোলান। ধমকে উঠল কিশোরের উদ্দেশ্যে, সরো! সরে যাও!

তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ল হারিকেন। লাফিয়ে উঠল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। চোখে বন্য দৃষ্টি।

দৌড়ে আসছে ব্রড জেসন। লিলি কোথায়, লিলি? যেন ঘোড়াটাকেই জিজ্ঞেস করছে সে। কাছে এসে হারিকেনকে সামলাতে লুককে সাহায্য করল সে।

কে জানে, কোথায়! লুক বলল।

আরেকবার সাদা গাড়িটার দিকে তাকাল কিশোর। দুজন লোক বেরিয়ে এল। একজনকে চিনতে পারল, খাট ফিলিপ নিরেক। লম্বা অন্য লোকটাকে চিনল না।

দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। এই, লিলিকে খুঁজতে যাও না কেউ! কিশোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এমন ভঙ্গিতে তাকালেন, যেন চাইছেন কিশোরই যাক। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এরকম করে তো কখনও বাইরে থাকে না মেয়েটা! র‍্যাঞ্চে ইদানীং বড়ই গোলমাল চলছে। কিশোর, রবিনের আম্মা তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। সে জন্যেই তোমাদেরকে পাঠাতে বলে দিয়েছিলাম ওকে। প্লীজ, লিলিকে খুঁজে আন!

চেষ্টা করব। হারিকেনকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিল লিলি, আন্দাজ করতে পারেন?

মাথা নাড়লেন কেরোলিন। জোরে জোরে হাত ডলতে লাগলেন। জানলে তো ভালই হত। অনেক জায়গা আছে এখানে যাওয়ার, ডজনখানেক পথ আছে। কোনটা দিয়ে কোথায় গেছে কে বলবে?

বেশ, তাহলে এক কাজ করি, ঝড়ের গতিতে চলছে কিশোরের মগজ। একটার পর একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। টর্চ আর ঘোড়া নিয়ে কয়েকজন চলে যাই আমরা। বনের ভেতরে খুঁজব। কয়েকজন যাক গাড়ি নিয়ে। মাঠ আর অন্যান্য খোলা জায়গাগুলোতে খুঁজবে। কোথাও হয়তো পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে এসেছে তাকে ঘোড়াটা। হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে, আসতে পারছে না।

ওহ, গড! প্রায় কেঁদে ফেললেন কেরোলিন।

আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে কিশোরের শেষ কথাগুলো শুনেছে লুক। বারান্দায় জমায়েত হওয়া মেহমানদের দিকে তাকাল একবার। কিশোরকে বলল, তোমরা মেহমান। এসব তোমাদের কাজ নয়। আমরাই যাচ্ছি খুঁজতে। ফিলিপ নিরেকের ওপর চোখ পড়তে উদ্বিগ্ন হল সে।

আমি সাহায্য করতে চাই, কিশোর বলল।

দেখো, শোনো আমার কথা! কর্কশ হয়ে উঠল লুকের কণ্ঠ। এদিককার পাহাড়গুলো ভীষণ খারাপ। তোমরা আমাদের দায়িত্বে রয়েছ। কিছু একটা হয়ে গেলে জবাব আমাদেরকেই দিতে হবে। এই রিস্ক নিতে পারি না। আমরা এখানে অনেক লোক, আমরাই পারব। মেহমানদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলল, আপনারা সব ভেতরে যান। দাবা আছে, তাস আছে, খেলুনগে। ব্রড ভাল গিটার বাজাতে পারে। বাজিয়ে শোনাবে আপনাদের।

মেহমানদের যাবার ইচ্ছে নেই, তবু এক এক করে ঢুকে গেল ভেতরে।

কিশোর দাঁড়িয়েই রইল। আমি সত্যিই সাহায্য করতে পারব।

এগিয়ে আসছে নিরেক। তার সঙ্গের লম্বা লোকটার চেহারাটা রুক্ষ। মাথায় রুপালি চুল।

আরেকটু হলেই গাড়ির ওপরই এসে পড়েছিল ঘোড়াটা! এখনও গলা কাঁপছে নিরেকের। লুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?

নেই।

ঝুলে পড়ল ব্যাংকারের চোয়াল। নেই মানে? আমি আর পাইক তো ওর সঙ্গেই দেখা করতে এলাম…

লম্বা, কঠিন চেহারার লোকটার দিকে আবার তাকাল কিশোর। এই তাহলে হারনি পাইক। লিলির সম্পত্তি যে কেড়ে নিতে চায়।

আজ বিকেলেও ফোন করেছি, নিরেক বলল। ওকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে।

বারান্দার রেলিঙে হেলান দিল লুক। অন্য সময় আসতে হবে তাহলে। খাট লোকটার ওপর থেকে লম্বাজনের ওপর সরে গেল তার নজর। লিলি নিখোঁজ।

নিখোঁজ! রেগে গেল নিরেক। আমাকে বিশ্বাস করতে বল একথা?

করলে করবেন না করলে নেই, আপনার ইচ্ছে।

আমাদের ফাঁকি দেয়ার জন্যেই লুকিয়েছে।

 কেন করবে একাজ? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

কিশোরের কথায় কানই দিল না নিরেক, তাকিয়ে রয়েছে লুকের দিকে। র‍্যাঞ্চটা যে শেষ, একথা আমার মতই তুমিও জানো৷ মিস্টার পাইক একটা লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।

পরেও লোভটা দেখাতে পারবেন তিনি, ভোঁতা গলায় বলল লুক। মেয়েটার সঙ্গে গণ্ডগোল করবেন না আপনারা, বলে দিলাম। ভাল হবে না।

রাগ ঝিলিক দিল পাইকের চোখে, দরজা দিয়ে আসা আলোয় সেটা দেখতে পেল কিশোর। ভ্রূকুটি করল। অস্বস্তিভরে আঙুল বোলাল তার ওয়েস্টার্ন টাইতে। বলল, চল, ফিলিপ। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

এই তো, ভাল কথা, লুক বলল। নিরেক কিছু বলার আগেই কিশোরের দিকে ফিরে বলল, যাও, ঘরে যাও। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলগে বসে। আমি লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা পায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

বনের ভেতর কোথায় কোন বিপদে পড়ে আছে লিলি, কে জানে! ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠেই কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল।

গাড়িতে উঠছে নিরেক আর পাইক। পাইকের খসখসে কণ্ঠ শুনতে পেল, ভেব না, ফিলিপ। নিজের কষ্টই কেবল বাড়াচ্ছে লিলি। কাজ হবে না এতে। র‍্যাঞ্চটা আমি দখল করবই।

 ডাইনিং রুমেই রবিন আর মুসাকে বসে থাকতে দেখল কিশোর। এখন ওদের সঙ্গে রয়েছেন কেরোলিন।

লিলি ফেরেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

মাথা নাড়ল কিশোর। না। আমাদের এভাবে বসে থাকাটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না।

আমারও তাই মনে হয়, কেরোলিন বললেন। মেহমানদেরকে বলিগে। যারা যেতে রাজি হয়, যাবে।

আমি তো যাবই, মুসা বলল।

আমিও, বলল রবিন।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সুইং ডোরের পাল্লা। ভেতরে ঢুকল লুক। চোখে। উল্কণ্ঠার ছায়া। কেরোলিনকে বলল, আমরা লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। মেহমানরা যেন কেউ ঘর থেকে না বেরোয়। এরাও।

তিন গোয়েন্দাকে দেখাল সে। এমনিতেই যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। আবার কেউ কিছু করে বসুক…

কিন্তু এরা গোয়েন্দা…

  গোয়েন্দা-ফোয়েন্দা আমাদের দরকার নেই! রেগে উঠল লুক। এখানে খুন হয়েছে নাকি, যে তদন্ত করবে? এখন আমাদের দরকার ভাল ট্র্যাকার, যে বনের ভেতরে চিহ্ন দেখেই হারান মানুষকে খুঁজে বের করতে পারবে, গোয়েন্দা লাগবে না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর কেরোলিনকে। বলল, জন কয়েকজনকে নিয়ে দক্ষিণের পাহাড়ে চলে যাবে। আমি আর ব্রড বেরোব গাড়িতে করে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব। কিশোরের দিকে আঙুল তুলল সে। তোমরা ঘরে থাক। সাহায্য যদি করতেই হয়, বসে থাক ফোনের কাছে। বলা যায় না, লিলির ফোনও আসতে পারে। বেরিয়ে গেল সে।

কয়েক মিনিট পরে একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শোনা গেল।

লুক যা-ই বলে যাক, মানতে রাজি নয় কিশোর। ওই লোকটার আদেশ শুনবে কেন সে? এখানে বসে বসে আঙুল চুষতে একেবারেই ভাল লাগছে না তার। দুই সহকারীর দিকে তাকাল।

বসেই থাকবে? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল কিশোর। না। জেনারেলকে নিয়ে বেরিয়ে যাব পাহাড়ে খুঁজতে।

জানতাম, হাসি ফুটল রবিনের মুখে।

কিশোরও হাসল। বলল, তবে লুক একটা কথা ঠিকই বলেছে, ফোনের কাছে কাউকে থাকতে হবে।

কে থাকবে? হাসি মিলিয়ে গেল রবিনের।

তুমিই থাকো না?

হ্যাঁ, থাক, প্লীজ! অনুরোধ করলেন কেরোলিন। মেহমানদেরকেও সঙ্গ দেয়া। দরকার, মাতিয়ে রাখা দরকার, যাতে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে। একাজটা তোমার চেয়ে ভাল আর কেউ পারবে না।

কাঁধ ঝুলে পড়ল রবিনের। হতাশ হয়েছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছাহ!

গুড বয়। উঠে গিয়ে প্যানট্রিতে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি শুরু করলেন কেরোলিন। কয়েকটা পুরানো ম্যাপ এনে টেবিলে বিছালেন। আঙুল রেখে রেখে দেখিয়ে দিতে লাগলেন কোন কোন রাস্তা লিলির পছন্দ। শেষে বললেন, যে পথ ধরেই যাক, হট ম্প্রিঙের দিকেই যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওদিকটাতেই যায়। গরম পানির ঝর্নাটার কথা বললেন তিনি।

দেখেছি ওটা আজকে, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। ভাবছে, ঠিক কোন জায়গাটায় হারিকেনকে নিয়ে গিয়েছিল লিলি?

ধরো ফোন এল, কিংবা লিলি ফিরে এল, কি করব তখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

একজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে বলবে ফাঁকা গুলি করতে। তাহলেই আমি আর মুসা বুঝব, লিলি নিরাপদে আছে। ফ্লেয়ার থাকলে ভাল হত, জ্বালতে পারতে।

আছে তো, কেরোলিন বললেন। এখানে ওঁসক জিনিসের দরকার হয়। তাই রাখি। ট্যাক রুমে আছে। ফাঁকা গুলি করার জন্যে অন্য কাউকে দরকার নেই, আমিই পারব।

হাসল কিশোর। তাহলে খুবই ভাল। হট স্প্রিঙের দিকেই যাব আমরা। চল, মুসা। চেয়ারের হেলানে ঝোলান জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলল সে।

চাঁদ উঠেছে। হলুদ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। র‍্যাঞ্চের এখানে ওখানে বিচিত্র নীল আর ধূসর ছায়ার খেলা। দূরে লাল আলো নেচে নেচে এগিয়ে যেতে দেখা। গেল, নিশ্চয় লুকের গাড়ির। দক্ষিণের মাঠের দিকে চলেছে ও।

কয়েক মিনিটেই ঘোড়া বের করে জিন পরিয়ে ফেলল কিশোর আর মুসা, সকালে যে দুটো নিয়েছিল ওরা সেগুলোকেই নিল। ক্যাকটাসের পিঠে চড়ল মুসা। জিজ্ঞেস করল, ওরাতো গেছে দক্ষিণে। আমরা?

 উত্তরে, জবাব দিল কিশোর।

জেনারেলের পিঠে চড়ল সে। রাশ টেনে ইঙ্গিত দিতেই ছুটতে শুরু করল ঘোড়া। পিছু নিল ক্যাকটাস।

সকালে যে পথে গিয়েছিল ওরা সেপথেই এগোল।

ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার প্রশ্ন। গাছপালার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। রাতের বেলা এসব জায়গা ভাল না, শুনেছি…

দোহাই তোমার, মুসা, ভূতের কথা শুরু করো না আবার!

 চুপ হয়ে গেল মুসা।

তবে রাতের বেলা বনের চেহারাটা কিশোরেরও ভাল লাগছে না। টর্চের আলোয় কেমন ভূতুড়ে লাগছে পাইন গাছগুলোকে। ঠিক পথেই যাচ্ছি। সকালে এদিক দিয়েই গিয়েছিলাম।

ভাবতে ভাবতে চলেছে কিশোর। একসময় আনমনেই বলল, আশ্চর্য!

 কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এখানে আসার পর থেকেই একটার পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাল রাতে ইউনিকর্নের কোরালের গেট কেউ খুলে রেখেছিল। এখন হারিয়ে গেল লিলি। হারনি পাইক এসে হুমকি দিয়ে গেল। লুক বোলান, এমনকি ব্রডও এমন আচরণ করছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু লুকাতে চায়।

কিছু সন্দেহ করছ নাকি?

এই, কি হলো তোর? জেনারেলের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কোন কারণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা।

কর্কশ একটা ডাক শোনা গেল। ডানা ঝাঁপটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বিরাট এক পেঁচা। মাথা ঝাড়ল জেনারেল, নাক দিয়ে শব্দ করল, লাফ দিল। সামনের দুপা তুলে। এক হাতে লাগাম ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল কিশোর, আরেক হাতে টর্চ। হাত নড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও সামনের পথের ওপর নড়তে লাগল।

কি হলো? মুসার ক্যাকটাসও অস্থির হয়ে উঠেছে।

বলতে গিয়েও বলতে পারল না কিশোর, গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম একটা শব্দ করল। সামনের পথের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মূর্তি। নড়ছে না।

.

০৪.

লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে গেল কিশোর। বসে পড়ল পড়ে থাকা দেহটার পাশে। প্রথমেই নাড়ি দেখল। তারপর মুসাকে বলল, লিলি!

লিলির ওপর ঝুঁকল মুসা। বেঁচে আছে?

আছে। কাঁধ ধরে ঠেলা দিতে দিতে কিলোর ডাকল, লিলি, শুনতে পাচ্ছেন? এই লিলি?

উ! গোঙাল লিলি। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা, আবার বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর? শুকনো ঠোঁটের ভেতর দিয়ে কোনমতে ফিসফিস করে বলল সে। আবার চোখ মেলল। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে… হাত চেপে ধরল কপালে।

নড়বেন না, কিশোর বলল। হাড়টাড় কিছু ভেঙে থাকতে পারে।

না, ভাঙেনি। টর্চের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে ওর চেহারা। ইস্, মনে হচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। নড়াতে পারছি না। নড়লেই ব্যথা লাগে… চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।

বাড়িটাড়ি লাগিয়েছেন বোধহয় কোথাও। শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার কাপলিংকে নিয়ে আসি।

লাগবে না। এই প্রথম যেন অন্ধকার লক্ষ্য করল। অনেকক্ষণ ধরে এখানে আছি মনে হচ্ছে? ধরো, আমাকে, তোলো, তাহলেই হবে।

কিশোর আর মুসার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল লিলি। পা কাঁপছে। ওরা ছেড়ে দিলেই টলে পড়ে যাবে।

যেতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

পারব না কেন? কোনমতে উঠে বসতে পারলেই হয় ঘোড়ায়, কাঁপা গলায় বলল লিলি।

ক্যাকটাস শান্ত, তাই ওটার পিঠেই ওকে তুলে দিল মুসা আর কিশোর মিলে। ওরা উঠল জেনারেলের পিঠে। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে এগোল পাহাড়ী পথ ধরে।

হারিকেন কোথায়? জিজ্ঞেস করল লিলি।

 র‍্যাঞ্চে। একেবারে খেপে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে শান্ত করেছে লুক আর ব্রড।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল লিলি। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদানীং ঘোড়াগুলো কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।

কি করছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

অদ্ভুত সব কাণ্ড। গত হপ্তায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল হারিকেন। মনে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে আছে। সাধারণত ওরকম থাকে না। আজকে করল এই কাণ্ড… থেমে গেল লিলি।

আপনার কি হয়েছিল কিছু মনে আছে?

হারিকেনকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শুরু থেকেই কেমন নার্ভাস হয়ে ছিল ও, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিল। মনে হল, কোন কারণে লাগাম সহ্য করতে পারছে না। খুলে দিলাম। তারপরই মাঠের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল আমাকে এখানে। বনের ভেতরে ঢুকে আরও অস্থির হয়ে গেল। কিছু শুনেছিল বোধহয়, বিপদ-টি পদ আঁচ করেছিল। একটা পাইনের জটলার কাছে গিয়ে লাথি মারতে শুরু করল মাটিতে, পিঠ বাকা করে আমাকে ফেলে দিতে চাইল। শেষে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল। মাথায় বোধহয় ডালের বাড়িটাড়ি লেগেছিল আমার। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম তোমাদেরকে। দুজনের দিকে তাকাল সে। থ্যাঙ্কস।

র‍্যাঞ্চের আলো চোখে পড়ল। খানিক পরে অনেকগুলো কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে। একজন শ্রমিকের চোখে পড়ে গেল লিলি। ফ্লেয়ার জ্বালল লোকটা। হাউই বাজির মত আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেল ফ্লেয়ার, তীব্র নীল আলো। লিলিকে নিয়ে কিশোর আর মুসা চত্বরে ঢুকতে অনেকে এগিয়ে এল স্বাগত জানাতে।

 কয়েক মিনিট পরে লিলি যখন ঘোড়া থেকে নামছে, চত্বরে এসে ঢুকল লুকের গাড়ি। দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে এল সে। লিলিকে দেখে স্বস্তির হাসি হাসল। এসেছ! কি ভয়টাই না পাইয়েছিলে…! সব ঠিক আছে তো?

মনে হয়, জবাব দিল লিলি।

কিশোরের দিকে তাকাল লুক। মনে হচ্ছে তোমার ব্যাপারে ভুল ধারণা করেছিলাম আমি, কিশোর পাশা। বেরিয়ে ভালই করেছ। তবে, এর পরের বার আমি যা বলব, শুনবে। যা করেছ, করেছ, পরের বার আর করবে না। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারতে, তখন?

জবাব দিল না কিশোর।

হাঁ হয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দুহাতে অ্যাপ্রন তুলে সিঁড়ি বেয়ে। দৌড়ে নেমে এলেন কেরোলিন। পেয়েছে! যাক! লিলিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর ঠেলে সরিয়ে মুখ দেখতে লাগলেন। ইসসি, এক্কেবারেই তো সাদা হয়ে গেছে! যাও, সোজা ঘরে…আমি ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।… কি ভয়টাই না দেখালে

যার যার ঘোড়ার জিন খুলে ঘোড়াগুলোকে আগের জায়গায় রেখে এল কিশোর আর মুসা। লিভিং রুমে ঢুকে দেখল, পুরানো একটা কাউচে বসে ডক্টর কাপলিঙের মেয়ের সঙ্গে মিউজিক নিয়ে আলোচনা করছে রবিন। ওদেরকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?

পেয়েছি। দোতলায় চলে গেছে। ভালই আছে, জানাল কিশোর। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। চলো। শুনব।

কিশোর আর মুসাকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল সে। কাপে গরম কোকা নিয়ে একটা নিজে নিল, অন্য দুটোর একটা দিল কিশোরকে, একটা মুসাকে। বলো, কোথায় পেলে?

সব শোনার পর জিজ্ঞেস করল, হারিকেন এই শয়তানীটা কেন করল বলো। তো?

জানি না, কোকার কাপে চুমুক দিল কিশোর।

 কিশোর এতে রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, রবিনকে বলল মুসা।

 সে আমি আগেই জানি, রবিন বলল। কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি।

শ্রাগ করল কিশোর। দেখো, একটা কথা কি অস্বীকার করতে পারবে, কাল। থেকে কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে? লিলিও তাই বলছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিরেক আর পাইকের কথা আগের দিন যা যা শুনেছিল, সব দুই সহকারীকে খুলে বলল সে।

কোকা শেষ করে ওপরতলায় চলল তিন গোয়েন্দা। নিজেদের ঘরে যাওয়ার আগে লিলিকে দেখতে গেল। আস্তে করে ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে পাল্লা ঠেলে খুলল কিশোর। নাইটগাউন পরে বিছানায় বসে আছে লিলি।

ডাক্তার কি বললেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ইঙ্গিতে ওদেরকে চেয়ারে বসতে বলে লিলি বলল, ডাক্তাররা আর কি বলে? রেস্ট নিতে হবে কয়েক দিন। কিছু হলেই এছাড়া আর যেন কিছুই করার থাকে না মানুষের। আমি থাকব বসে? অসম্ভব! রোডিওর জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে। র‍্যাঞ্চটাকে বাঁচানর এটাই শেষ সুযোগ।

রবিন হেসে বলল, অত ভাবছেন কেন? আপনি যা এক্সপার্ট, কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলেই আবার চালু হয়ে যাবেন।

হাসি ফুটল লিলির মুখে। তা পারব।

হারিকেনকে নিয়ে খেলতে গেলে, মুসা বলল, কার এমন ক্ষমতা, আপনাকে হারায়?

 চুপ! আস্তে বলল, কৃত্রিম ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল লিলি, বেনি শুনতে পেলে মূৰ্ছা যাবে।

বাইরে মচ করে একটা শব্দ হলো। কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে ঘুরে তাকাল কিশোর। না, কেউ দরজা খুলছে না। আবার লিলির দিকে ফিরল সে। এই সময় বুটের শব্দ কানে এল, হালকা পায়ে হাঁটছে কেউ। কে? আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল নাকি কেউ?

রবিন আর মুসাও শুনেছে শব্দটা। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদেরকে চুপ থাকতে ইশারা করে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল কিশোর। একটানে খুলে ফেলল পাল্লা। বাইরে উঁকি দিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লিলি।

সেটাই তো জানতে চাই আমি, মনে মনে বলল কিশোর। সন্দেহের কথাটা লিলিকে জানাল না। বলল, কিছু না। মনে হলো কেউ এসেছিল। দরজার কাছ থেকে সরছে না কিশোর। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অন্যান্য ঘরে মেহমানদের কথা শোনা যাচ্ছে, চলাফেরার শব্দ হচ্ছে। লিলির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, সব ঘরেই লোক আছে নাকি?

ভাবল লিলি। বেশির ভাগ ঘরেই আছে। কেন?

রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইল লিলি। তারপর বলল, কেরোলিন তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। অনেক জটিল রহস্যের। সমাধান নাকি করেছ তোমরা।

তা করেছি, ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল কিশোর।

রহস্যের গন্ধ যখন পেয়েই গেছ, সাহায্য করো না আমাকে।

কিভাবে?

এই যে অদ্ভুত কাণ্ডগুলো ঘটল, এগুলোর জবাব চাই আমি।

আমিও চাই। আপনি বলাতে আরও সুবিধে হলো আমাদের। দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিলোর। কি বলো?

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর মুসা।

হয়তো দেখা যাবে কোন রহস্যই নেই, সব কাকতালীয় ঘটনা, লিলি বলল। তবে জানা দরকার, মন থেকে খুঁতখুতানি তো দূর হবে।

তা হবে, মাথা কাত করল কিশোর।

 আচ্ছা, র‍্যাঞ্চটাকে স্যাবটাজ করতে চাইছে না তো কেউ?

অসম্ভব কি? চাইতেই পারে, শত্রু যখন আছে… কথাটা শেষ করল না। কিশোর। তাকাল লিলির দিকে। হারিকেনের কথা বলুন। এরকম আচরণ কেন করল কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

আবার মচমচ শব্দ হলো। তারপর টোকা পড়ল দরজায়। খুলে গেল পাল্লা। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লুক বোলান। মুখে কাদা লেগে আছে। কাপড় ছেঁড়া। রাগে জ্বলছে চোখ।

কেন ওরকম করছে, আমাকে জিজ্ঞেস করো, আমি জবাব দিচ্ছি, রাগে প্রায় চিৎকার করে বলল লুক, সমস্ত ভদ্রতা দূর হয়ে গেছে কণ্ঠ থেকে, ওটা শয়তান! ভাইয়ের মত! সে জন্যেই করেছে! দুটোই শয়তান! আস্তাবলটাকে তছনছ করে। দিয়েছে! হ্যাঁ, যা বলতে এসেছি। ইউনিক শয়তানটা বেরিয়ে গেছে। ধরতে যাচ্ছি, সে কথাই বলতে এলাম।

লিলি কিছু বলার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সে। বুটের শব্দ ও তুলে চলে যেতে লাগল।

দুই লাফে দরজার কাছে চলে এল কিশোর। পাল্লা খুলে দেখল সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ফোরম্যান। পেছনে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ও ওরকম করল কেন?

ঘোড়াদুটোর ওপর ভীষণ খেপে গেছে, কিশোর বলল। শুনলে না, আস্তাবল তছনছ করে দিয়েছে বলল।

কি করবে এখন? মুসার প্রশ্ন।

 তোমরা গিয়ে লিলির কাছে বসো, কিশোর বলল, আমি আসছি।

র‍্যাঞ্চ হাউসের বাইরে চতুরে যেন পাগল হয়ে উঠেছে সবাই। বাঙ্কহাউস, আস্তাবল আর গোলাঘরে ছোটাছুটি করছে শ্রমিকরা।

এগিয়ে গেল কিশোর। একটা পিকআপে উঠতে দেখল লুককে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে গেল গাড়িটা।

কি হয়েছে? একজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড। শার্টের একটা হাতা গুটিয়ে ওপরে তুলে রেখেছে। কনুইয়ের কাছে নীল একটা দাগ, ব্যথা পেয়েছে। জায়গাটা ডলছে সে। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানাল, ইউনিক পালিয়েছে! মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে ঘোড়ার খুরের শব্দ চলে যেতে শুনলাম।

আর শোনার অপেক্ষা করল না জনি আর আরেকজন তরুণ শ্রমিক। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠল একটা জীপে। লুকের গাড়ির পিছু নিল। কিশোরও দেরি করল না। ছুটে এসে ঢুকল ট্যাক রুমে। টান দিয়ে একটা জিন নামিয়ে নিয়েই দৌড় দিল বেড়ার দিকে। ওকের জটলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঘোড়া, গোলমাল শুনে কান খাড়া করে রেখেছে।

চাঁদের আলোয় জেনারেলকে চিনতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না কিশোরের। হাত নেড়ে ডাকল, এই জেনারেল, আয়, আয়। মুখ ফিরিয়ে কিশোরের দিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর দুলকি চালে এগিয়ে এল। ওটার পিঠে জিন পরাল কিশোর। লাগামটা বেড়ার সঙ্গে বেধে আবার ছুটল ট্যাক রুমে। একটা টর্চ নিয়ে এল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, চলো, জলদি চলো। ওদেরকে ধরা চাই।

 মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল কিলোর। অনেকটা এগিয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে ইউনিকর্ন। কিন্তু সে যাচ্ছে কোণাকুণি, পথ বাঁচবে, ধরে ফেলতে পারবে হয়ত ঘোড়াটাকে। দূরত্ব আর জেনারেলের গতির ওপরই নির্ভর করছে এখন সে।

জীপের হেডলাইট দেখতে পাচ্ছে। আরও আগে সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়েছে লুকের পিকআপের আলো।

ছুটে চলেছে জেনারেল। এদিক ওদিক ঘুরছে কিশোরের চঞ্চল দৃষ্টি। হঠাৎ চোখে পড়ল ওটাকে। একটা বিশাল ঘোড়ার অবয়ব, ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের পটভূমিতে কেমন ভূতুড়ে লাগছে ইউনিকর্নের চকচকে কালো শরীর।

চল, জেনারেল, চল, তাড়া দিল কিশোর। আরও জোরে। নইলে ধরতে পারবি না।

তীর বেগে ছুটল জেনারেল।

গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ইউনিকর্ন।

বনের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল লুকের পিকআপ।

জনও ব্রেক কষল।

পেছনে আরও ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডেকে বলল লুকের খসখসে কণ্ঠ, এই কিশোর, যেও না! আর যেও না! ওদিকে পথ ভাল না! খানাখন্দে ভরা। যেও না…

শুনল না কিশোর। জেনারেলের পিঠে প্রায় শুয়ে পড়ে হাঁটু দিয়ে চাপ দিতে লাগল আরও জোরে ছোটার জন্যে। ঢুকে পড়ল বনের ভেতরে। চাঁদের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছতে পারছে না। গিলে নিল যেন তাকে রাতের অন্ধকার।

টর্চ জ্বেলে ইউনিকর্নকে খুঁজতে শুরু করল সে। পলকের জন্যে দেখতে পেল। ঘোড়াটাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। পিছু নিল জেনারেল। এরপর যতবারই ঘোড়াটার ওপর আলো ফেলে কিশোর, ততবারই দেখে মিলিয়ে যাচ্ছে ওটা। কিছুতেই কাছে আর যেতে পারছে না। খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে রেখে যাচ্ছে ইউনিকর্ন। নাকমুখ দিয়ে সেই ধুলো গলায় ঢুকে আটকে যাচ্ছে। কিশোরের, দম নেয়াটাই অস্বস্তিকর করে তুলেছে।

 জেনারেল ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। একই দিনে তিন তিনবার এভাবে ছুটতে হয়েছে তাকে। ওর ঘামে ভেজা গলা চাপড়ে দিল কিশোর। সামনে অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে গাছপালা। আবার খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। পাহাড়ের গায়ে এখন কেবল শুকনো ঘাস।

 হালকা ছায়া পড়েছে এখানে চাঁদের আলোয়, আশপাশের পাহাড় আর বনের জন্যেই বোধহয় হয়েছে এরকমটা। পাহাড়ী অঞ্চলে নানা রকম অদ্ভুত কাণ্ড করে আলো আর বাতাস, অনেক দেখেছে কিশোর, খোলা জায়গায় যেটা হয় না। সামনে দেখতে পেল এখন ইউনিকর্নকে। থমকে দাঁড়াল একবার ঘোড়াটা। বাতাস। উকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল যেন। লাফিয়ে উঠল পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে। আবার ছুটল তীব্র গতিতে।

আগে বাড়ার জন্যে লাফ দিল জেনারেলও। দম আটকে গেল যেন কিশোরের। তার মনে হলো, ইউনিকনের পিঠে চড়ে বসে আছে একজন মানুষ। মানুষটাকে দেখতে পায়নি। আন্দাজ করেছে চাঁদের আলোয় কোন ধাতব জিনিস ঝিক করে উঠতে দেখে। ওই একবারই। আর দেখা গেল না।

আবার মনে পড়ল পাহাড়ী অঞ্চলে আলোর বিচিত্র কারসাজির কথা। চোখের ভুল না তো? ইউনিকনের পিঠে আরোহী? অসম্ভব।

কিশোরের মুখ ছুঁয়ে দামাল বেগে ছুটছে রাতের বাতাস। কোন দিকেই খেয়াল নেই ওর, তাকিয়ে রয়েছে ইউনিকনের পিঠের দিকে। আবার যদি দেখতে পায়। লোকটাকে? শিওর হতে পারবে তাহলে, সত্যিই আছে।

কিন্তু গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটছে ইউনিৰ্কন। হোঁচট খেল জেনারেল। হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আরেকটু হলেই, অনেক কষ্টে সামলে নিল। শেষ মুহূর্তে জিনের একটা শিং খামচে ধরে উড়ে গিয়ে পড়া থেকে বাঁচল কিশোর। পড়লে আর রক্ষা ছিল না। এত গতিতে এরকম উঁচুনিচু শক্ত জায়গায় পড়লে ঘাড় কিংবা। কোমর ভাঙা থেকে কোন অলৌকিক কারণে রক্ষা পেলেও, হাত-পা বাঁচাতে পারত না। ভয় পেয়ে গেল সে। আর ঝুঁকি নিল না। রাশ টেনে গতি কমাল ঘোড়ার।

পাহাড়ের ঢালের পথ ধরে ছুটছেই ইউনিকর্ন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর। কোনমতে, শুধু একবার যদি কোন ভাবে দেখতে পেত আরোহীটাকে…

আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল কিশোরের। আরোহী দেখার জন্যে মনযোগ সেদিকে দিয়ে না রাখলে এটা আরও আগেই চোখে পড়ত। ইউনিকনের কিছুটা সামনে বেশ অন্ধকার, ঘাসে ঢাকা জমি থাকলে যেমন দেখায় তেমন নয়। কেমন একটা শূন্যতা।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝে ফেলল, ওখানে কিছু নেই! হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে পাহাড়, তারপরে বিশাল খাদ! এবং সেদিকেই ছুটে চলেছে ইউনিকর্ন!

গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে চলে এল যেন কিশোরের। জেনারেলের গায়ে। হাঁটু দিয়ে গুতো মারল জলদি ছোটার জন্যে। লাফ দিয়ে ছুটল ঘোড়াটা। চিত্তার করে উঠল কিশোর, থাম! থাম! বাতাসে হারিয়ে গেল তার চিৎকার। কানে ঢুকল না যেন ইউনিকনের।

খাদের কাছে পৌঁছে ব্রেক কষে দাঁড়ানর চেষ্টা করল ঘোড়াটা। পিছলে গেল পা। এত গতি এভাবে থামানো সম্ভব হলো না বোধহয়।

আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখল কিশোর, অন্ধকারে হারিয়ে গেল ইউনিকর্ন।

.

০৫.

খাদের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল জেনারেল। নিচে তাকাল কিশোর। খাদটা তেমন গভীর নয় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে ওইটুকু লাফিয়ে পড়েও আহত হতে পারে ইউনিকর্ন। খাদের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রুপালি সাপের মত চলে গেছে নদী।

জেনারেলের পিঠ থেকে নেমে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধল ওকে কিশোর। টর্চ জ্বেলে নামতে লাগল খাদের ঢাল বেয়ে। নদীর পারে এসে ইউনিকর্নের চিহ্ন খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুই পেল না।

কান পেতে খুরের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। শুনতে পেল না। ইউনিকর্ন কি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তারপর ভাটি অথবা উজানে গিয়ে উঠে পড়েছে ডাঙায়? ওর পিঠের আরোহী ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে?

দুই দিকেই টর্চের আলো ফেলে দেখল সে। শেষে হতাশ হয়ে উঠে এল। আবার ওপরে। জেনারেলকে খুলে নিয়ে ফিরে চলল র‍্যাঞ্চে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে।

বনের কিনারে যেখানে রেখে এসেছিল লুক বোলানকে, সেখানেই রয়েছে। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ব্রড় জেসন। কিশোরকে দেখে এগিয়ে এল। যাক, এসেছ। তোমার পিছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ধরতে পারলাম না। ইউনিক কোথায়?

হারিয়ে ফেলেছি। কি করে খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে। ইউনিকর্ন, খুলে বলল কিশোর।

হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল লুক। আজ আর কিছু করার নেই। অন্ধকারে পাব না। কাল দিনের বেলা খুঁজতে বেরোতে হবে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, পরের বার এসব ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে আসবে না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দেবে।

লিলি আমাকে সাহায্য করতে বলেছে, গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিল কিশোর।

বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে গিয়ে গাড়িতে উঠল লুক। মোটামুটি যা বুঝতে পারল কিশোর তা হলো, এসব অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমস্যা। এদেরকে কিছু বোঝানো যায় না। নিজের ভালমন্দ বোঝে না।

ব্রডের পাশাপাশি র‍্যাঞ্চে ফিরে চলল কিশোর।

একসময় জিজ্ঞেস করল ব্রঙকে, আপনার সামনেই আস্তাবল থেকে পালিয়েছে ঘোড়াটা?

না।

আমি মনে করলাম…

বাধা দিয়ে ব্রড বলল, লাথি মেরে ফেলে দিল আমাকে। জখমটা দেখার জন্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। আমি ওখানে থাকতেই পালাল ওটা।

তার মানে আপনি পালাতে দেখেননি?

কৌতূহল ফুটল ব্রডের চোখে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, না, তা দেখিনি।

অন্য কেউ দেখেছে?

বলতে পারব না। কেন?

 না, ভাবছি, কেউ ওটাকে চালিয়ে নিয়ে গেল কিনা।

ইউনিকর্নকে? হেসে ফেলল ব্রড। অসম্ভব। ওর পিঠে কোন মানুষ চড়তে পারে না।

সে কথা আমিও শুনেছি। আবার ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর।

চত্বরে ঢুকে ব্রড় বলল, দাও, জেনারেলকে আমিই রেখে আসি।

লাগবে না, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। ও এখন আমার দায়িত্বে আছে। আমিই দেখাশোনা করতে পারব। বহুবার বহু র‍্যাঞ্চে বেড়াতে গেছি। ঘোড়া। আমার অপরিচিত নয়।

শ্রাগ করল ব্রড। বেশ, যা ভাল বোঝে। মেহমানদের কথা আমাদেরকে রাখতেই হয়। তবে লুক যা বলেছে, মনে রেখ… উত্তেজিত ঘোড়ার পদশব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল সে। আস্তাবলের দিকে তাকাল। আবার কি হল?

ব্রডের পিছু পিছু এগোল কিশোর। আস্তাবলে ঢুকল। আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরানো বাড়ির ভেতরটা। হারিকেনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কয়েকজন। শ্রমিক।

কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করল ব্রড।

বুঝতে পারছি না, বলল একজন চোয়াড়ে চেহারার ব্র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। মনে হচ্ছে। লুকের কথাই ঠিক। বদ রক্ত বেটাদের শরীরে।

কথাটা মানতে পারল না কিশোর। কিছু বলল না।

এই থাম, থাম, চুপ কর, মোলায়েম গলায় ঘোড়াটাকে বলল ব্রড়। ধীরে ধীরে ঢুকল স্টলের ভেতর।

সেই যে খেপেছে আর থামছে না, জানাল র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ড।

এরকম করছে কেন বুঝতে পারছি না! অবাকই হয়েছে ব্রড।

লাথি মেরে মেরে খড় ছিটাচ্ছে হারিকেন।

খারাপ কিছু খেয়ে ফেলেছে বোধহয়, বলল কিশোর। ক্ষতি হয় এরকম কিছু।

ঝট করে তিনজোড়া চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। হতেই পারে না! বলল একজন, ঘোড়াকে খাওয়ানো হয় সব চেয়ে ভাল আর দামি খাবার, ঘোড়ার জন্যে যা পাওয়া যায়। নিজের হাতে খাওয়াই আমরা।  

তা তো বুঝলাম। কিন্তু হারিকেনের এই মেজাজের তো একটা ব্যাখ্যা থাকবে?

আছে, আরেকজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ড বলল, বরক্ত। আর কোন কারণ নেই।

রাতারাতি ঘোড়ার স্বভাব বদলে যেতে পারে না।

তা পারে না, ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে ব্রড। তবে। একেবারেই ঘটে না এটা ঠিক নয়।

হয়ত ওর খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়েছে, বলল আবার কিশোর।

এই র‍্যাঞ্চের কেউই কোন ঘোড়ার সামান্যতম ক্ষতি করবে না, জোর দিয়ে কথাটা বলল ব্রড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, লাথি মেরে থামিয়ে দিল হারিকেন।– ঠিকমত লাগেনি, সামান্য একটু ছুঁয়ে চলে গেল লাথিটা। সরে গেল সে। পরিষ্কার দেখতে পেল এবার কিশোর ঘোড়ার ডান খুরের ওপরে সাদা লোম।

ও যে একেবারে ইউনিকর্নের মত আচরণ করছে! বলল আরেকজন শ্রমিক।

আরে দূর, কি যে বলো, হাত নেড়ে বলল অন্য আরেকজন। ইউনিকর্ন। হ। ইউনিকর্ন যখন শান্ত থাকে তখনই এরকম শয়তানী করে।

এই, অত বকর বকর করো না, ধমক দিয়ে বলল ব্রড। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কাজ করতে হবে। লুক তোমাকে বলল না ঘোড়াটোড়া নিয়ে অত মাথা ঘামাবে না? আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও।

কথা কানেই তুলল না কিশোর। রহস্যময় ঘটনাই ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই তার।

এর সমাধান করতেই হবে। সোজা এগিয়ে গেল ইউনিকর্নের স্টলের দিকে। ওটা খালি। লাথি মেরে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে খড়। ভেঙে ফেলা হয়েছে একটা স্টলের দরজা। ভাঙা কাঠে লেগে রয়েছে কালো কয়েকটা লোম, ঘোড়ার লোম। নাল পরান খুরের দাগ পড়েছে কয়েক জায়গায়। তবে যে বাক্সটায় খাবার। দেয়া হয় সেটা ঠিকই আছে দেখা যাচ্ছে। খড়, একটা ফিড ব্যাগ, একটা পানির বালতি, আর অর্ধেক খাওয়া একটা আপেল।

সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। তাড়াতাড়ি রওনা হলো জেনারেল উইলি কেমন আছে দেখার জন্যে।

দিগন্তের দিকে হেলে পড়ছে চাঁদ। ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে মুখে। অবাক হয়ে ভাবছে, কেন ওরকম খারাপ হয়ে গেল একটা ঘোড়া? কি কারণে হতে পারে? অসুখ-টসুখ করেছে? নাকি কেউ আতঙ্কিত করে দিয়েছে হারিকেনকে।

ভালই আছে জেনারেল। ঘরে চলল কিশোর।

রান্নাঘরের দরজা ঠেলে খুলে দেখল টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে রবিন, মুসা, লিলি আর কেরোলিন। ওকে দেখে হাসল সবাই। রবিন বলল, এতক্ষণে এলে।

লিলিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার তো এখন শুয়ে থাকার কথা?

ঠিক বলেছ, সুর মেলালেন কেরোলিন। ডাক্তার কাপলিং জানলে রেগে। যাবেন।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। সবই বুঝি, কিন্তু বিছানায় থাকতে যে ইচ্ছে করে না!ইউনিকর্নকে ছাড়া রেখে কি ঘুম আসে? উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকাল সে। টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা তুলল, হাত কাঁপছে। কিশোরকে বলল, এইমাত্র এসেছিল লুক। বলল, তুমি নাকি ইউনিকের। পিছু নিয়ে বনে ঢুকেছিলে। খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে ও।

সে রকমই মনে হলো, একটা চেয়ার টেনে বসল কিশোর। কি কি করে। এসেছে বলতে লাগল। বলা শেষে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করল লিলিকে। নিজেও গেল সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে কম্বলে গা ঢেকে লিলি বলল, কি বলে যে ধন্যবাদ দেব। তোমাকে…

শেষ করতে দিল না ওকে কিশোর, কি আর দেবেন? ধন্যবাদ পাওয়ার কাজ এখনও তো করতেই পারলাম না। ইউনিককে হারানো উচিত হয়নি আমার।

ওকে খুঁজে বের করবই আমরা, ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল লিলি। করতেই হবে।

নিজের ঘরে ফিরে এল কিশোর। অনেকক্ষণ ধরে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ক্লান্তি অনেকটা দূর করে এসে ঢুকল রবিন আর মুসার ঘরে।

ওরা তখনও ঘুমায়নি।

 কি ব্যাপার? ঘুম আসছে না? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তোমরাও তো জেগে আছ।

তা আছি, হাই তুলল মুসা। আর বেশিক্ষণ থাকব না। তা কি ভেবে আবার এলে?,

এলাম। মনে উত্তেজনা থাকলে ঘুম আসতে চায় না তো, তাই…

তা বটে। ও, হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, তুমি যাওয়ার পর ফিলিপ নিরেক ফোন করেছিল। লিলিকে চেয়েছিল। ওকে কি বলল সে জানি না, তবে মুখ কালো হয়ে যেতে দেখলাম লিলির। কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করেছি, বলল না। বলল, ও কিছু না। শুধু বলল, আগামী দিন পাইককে নিয়ে নিরেক এখানে আসবে কথা বলতে।

আরও খবর আছে, চোখ নাচিয়ে বলল মুসা।

তার মানে তোমরাও বসে থাকোনি, খুশি হয়ে বলল কিশোর। কি খবর?

কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে অনেক কথা বলেছি আমি, রান্নাঘরে, মুসা বলল। ব্রড জেসন নাকি মহিলার বোনের ছেলে।

তাতে কি? রবিনের প্রশ্ন।

গাল চুলকাল মুসা। হয়তো কিছুই না। কিন্তু ডবসি কুপারের ওখানে কাজ করে এসে যদি আবার এখানে ঢোকে, খটকা লাগে না মনে? শুরু থেকেই তো ওর খালা ছিল এখানে, তখন ঢুকল না কেন?

হ্যাঁ, সত্যি খটকা লাগে, মুসার সঙ্গে একমত হয়ে বলল কিশোর।

কেরোলিনের আন্টি আরও বলেছেন, নিজের আঙুলের নখ দেখতে দেখতে বলল মুসা, কিছু দিন ধরেই নাকি অদ্ভুত আচরণ করছে ঘোড়াগুলো।

শুধু ঘোড়াই না, কিছু কিছু শ্রমিকও করছে, হাই তুলল কিশোর। এমন ভাব করছে, বোঝানর চেষ্টা করছে, যেন এক রাতেই নষ্ট হয়ে গেছে হারিকেন। ওদের এই কথা মানতে রাজি নই আমি। এবং ওরা যে ভুল করছে এটা প্রমাণ করে ছাড়ব।

.

পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দেখতে লাগল ব্রডের কাজ। একটা ঘোড়ার বাচ্চাকে আরোহী নিতে শেখাচ্ছে। পিঠ বাঁকিয়ে, নেচেকুদে, ঝাড়া দিয়ে অনেক চেষ্টা করছে ঘোড়াটা ওকে পিঠ থেকে ফেলার, পারছে না।

কয়েক বছর আগে ব্রড ব্রংকো রাইডার ছিল, মুসা বলল। কিছু কিছু লোকাল রোডিওতে ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছে। কেরোলিন আন্টি বলেছেন আমাকে।

ছেড়ে এল কেন? জানতে চাইল কিশোর।

বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। জানার চেষ্টা করব নাকি?

কর। আস্তাবলের দিকে তাকাল কিশোর। ওখানে ঢুকে তদন্ত করে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন গিয়ে সুবিধে করতে পারবে না। অনেক লোক কাজ করছে ভেতরে বাইরে। ইউনিকনের স্টলে তদন্ত করতে হলে একা একা গিয়ে করতে হবে। কাউকে দেখান চলবে না। লুক আর জন গিয়ে ইউনিককে পেল কিনা কে জানে।

এই সময় দেখল লম্বা পাওয়ালা একটা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে আসছে বেনি কুপার।

ব্রডের দিকে হাত নেড়ে ঘোড়া থেকে নামল বেনি। লাগামটা বাঁধল বেড়ায়। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?

ঘরে।

গিয়ে ওকে বলা দরকার, ইউনিকর্নকে দেখেছে আব্ব।

কোথায়? একসাথে জিজ্ঞেস করল তিন গোয়েন্দা।

আজ সকালে, আমাদের র‍্যাঞ্চের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ে চলেছিল আব্বা তখন।

ও পালিয়েছে জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ব্রডের দিকে তাকাল বেনি। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, লুক বোলান ফোন করেছিল। ইউনিকর্নই কিনা শিওর না আব্বা, তবে ওরকমই, কালো, বিরাট একটা ঘোড়া।

চলো, রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।

গিয়ে কি করবে? ব্রড বলল, কয়েকজনকে নিয়ে লুক চলে গেছে অনেক আগেই।

আরও কয়েকজন গিয়ে খুঁজলে ক্ষতি হবে না।

কপালের ঘাম মুছল ব্রড। চলো, আমিও যাব।

তুমি থাক না? বেনি অনুরোধ করল।

 দ্বিধায় পড়ে গেল ব্রড। ইতস্তত করে বলল, না, যাওয়াই উচিত। হাজার হলেও এই র‍্যাঞ্চে চাকরি করি আমি, যাওয়াটা আমার দায়িত্ব।

মিনিট বিশেক পরে পশ্চিমে কুপারদের র‍্যাঞ্চের দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর, মুসা আর ব্রড। কুপার র‍্যাঞ্চের পশ্চিমের পাহাড়ে কয়েক ঘন্টা ধরে খুঁজেও পেল না ঘোড়াটাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে ব্রড বলল, বুঝতে পারছি না। গেল কোথায়?

সীমাহীন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। যে দিকেই তাকায়। সেদিকেই ঘন বন। এরকম জায়গায় সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে একটা ঘোড়া। মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ওসব করতে যেও না, তাড়াতাড়ি বলল ব্রড। যা করার লিলিই করবে।

কেন, আমি করলে দোষ কি?

অস্বস্তিতে পড়ে গেছে যেন ব্রড। চোয়াল ডলল। তারপর বলল, কয়েক বছর ধরেই দুটো র‍্যাঞ্চের সম্পর্ক খারাপ। ডাবল সির কোন মেহমান গিয়ে কথা বলবে, এটা নিশ্চয় ভাল চোখে দেখবেন না মিস্টার কুপার। পারলে লিলি কিংবা লুক গিয়ে বলুকগে, তোমার দরকার নেই।

র‍্যাঞ্চে ফিরে এল ওরা। লুক ফিরছে। ইউনিকর্নকে আনতে পারেনি। কুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে আগেই, বেনি যা বলেছে মিস্টার কুপারও একই কথা বলেছে।

লুককে বলল ব্রড, কিশোর মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

শক্ত হয়ে গেল লুকের ঠোঁট। দেখো, কিশোর, তুমি সাহায্য করতে চাইছ বুঝতে পারছি, কিন্তু এটা তোমার কাজ নয়। আমার। কাজেই যা কিছু করার দায়িত্ব আমারই। লিলির আব্বা মরার সময় আমাকে এ-দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আরেকটা কথা, আমি চাই না, এখানে যে গোলমাল হচ্ছে এটা কুপার জেনে ফেলুক।

কেন?

তাহলে পেয়ে বসবে। আমাদের এখানে গোলমাল আছে শুনলে ঘাবড়ে যাবে মেহমানরা, থাকতে চাইবে না। কুপারের র‍্যাঞ্চে গিয়ে উঠবে। এটা হতে দিতে পারি না আমরা।

কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল লুক।

.

সেদিন বিকেলে ডাক্তারের আদেশ অমান্য করে নিচে নেমে এল লিলি। ঠিকমত পা ফেলতে পারে না, শক্ত হয়ে গেছে যেন জোড়াগুলো। ক্লান্তি আর উল্কণ্ঠায় চেহারা ফেকাসে। তবে আগের রাতের তুলনায় ভালই মনে হচ্ছে তাকে।

চলো, বারান্দায় বসে লেমোনেড খাই, তিন গোয়েন্দাকে প্রস্তাব দিল সে। বিছানায় আর যেতে পারব না।

বারান্দায় চেয়ার পেতে বসল চারজনে। গ্লাসে কয়েকবার চুমুক দিয়ে মুখ ফেরাল লিলি। বলল, শেরিফকে ফোন করে ইউনিকের কথা বলতে হবে। কারও চোখে পড়লেই তাহলে খোঁজ পেয়ে যাব আমরা।

যদি সেই লোকটা গিয়ে শেরিফকে বলে, কিশোর বলল। ডবসি কুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন?

বলেছি। তবে আমার মনে হয় না ইউনিককে দেখেছ। কিশোরের চোখ দেখেই যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলল লিলি, মাথা নেড়ে বলল, না না, যা ভাবছ তা নয়। মিথ্যে বলেনি। তবে যেটাকে দেখেছে সেটা ইউনিক নয়, হয়তো কোন বুনো মাসট্যাংকে দেখেছে।

 নাহ, কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না, বিড়বিড় করে বলল রবিন। ইঞ্জিনের শব্দ শুনে তাকাল রাস্তার দিকে। ওইযে আসছে, আরও গোলমাল!

লম্বা সাদা একটা গাড়িকে আসতে দেখা গেল। ছুটে এসে বারান্দার কয়েক ফুট দূরে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। গাড়িটা দেখেই লিলির চেহারা আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

 দরজা খুলে নামল ফিলিপ নিরেক আর হারনি পাইক। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল একজনের পেছনে আরেকজন।

লিলির সঙ্গে কথা বলার আগে কিশোরদের দিকে তাকিয়ে নিল একবার নিরেক, সুস্থ হয়ে গেছ নাকি।

অনেকটা, লিলি বলল।

নিরেকের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাইক। স্টেটসন হ্যাঁটের কানাটা যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর তার বন্ধুদের দিকে, চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। কত হলে জায়গাটা কিনতে পারব, শোনা যাক, জ্যাকেটের পকেট থেকে চেক বই বের করল সে। একলা কোথাও কথা বলা যাবে?

লিলিকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে সে, বুঝতে পারল লিলি। বলল, দরকার হবে না। আমার কোন আগ্রহ নেই।

 কঠিন হয়ে গেল পাইকের চোয়াল। কিন্তু দামটা এখনও শোনইনি।

শুনতে চাইও না, চাঁছাছোলা জবাব দিল লিলি। এটা আমার বাপ-দাদার জায়গা, কোন কিছুর বিনিময়েই কারও কাছে বেচব না, যত দামই দিক না কেন।

কাজটা কিন্তু ঠিক করছ না, হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে বলল নিরেক।

উঠে দাঁড়াল লিলি। আপনাকে আমি বলেছি, ব্যাংকের ধার আমি শোধ করে দেব। সময় শেষ হয়নি, এখনই চাপাচাপি করছেন কেন? যান, জুলাইর পাঁচ তারিখে দিয়ে দেব।

কি করে দেবে? ঘোড়ায় চড়ার অবস্থা আছে নাকি তোমার?

আজ নেই, তবে যেদিন দরকার সেদিন ঠিকই থাকবে, সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, রেগে গেল লিলি। চোখ থাকলেই দেখতে পাবেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে। কঠোর কণ্ঠে নিতান্ত অভদ্র ভাবেই বলল, যান, বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে! এক্ষুণি!

Super User