০৭.

একটা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে গেল মুসা। বুঝতে পারছে না দৌড়ে যাবে সাহায্য আনতে, না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে কোন অলৌকিক ক্ষমতায় আবার জ্যান্ত হয়ে ওঠে কিনা কিশোর? আরেকবার চিৎকার করে উঠল সে। বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। কিশোরের এই পরিণতি সহ্য করতে পারছে না সে।

হাটু গেড়ে বসে পড়ল বন্ধুর বাকা হয়ে পড়ে থাকা দেহের পাশে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল, কিশোর, কে তোমার এই অবস্থা করল!…বলো কে, কে করল-…ওকে আমি, আমি… মেঝেতে কিল মারতে শুরু করল সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আবার মুসা। পাগল হয়ে গেছে যেন। কিশোরের কাটা গলার দিকে তাকাতে পারছে না। কাউকে ডেকে আনবে কিনা ঠিক করতে পারছে না এখনও। নড়ছে না কিশোর, মরেই গেছে সম্ভবত…

মুসার মনে হতে লাগল, দেয়াল চেপে আসছে চারপাশ থেকে, নিচে নেমে আসছে ছাত। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিৎকার করে উঠল, কিশোর, বলো কিশোর, কে?… তাকাল কিশোরের গলার দিকে। আরি, রক্ত বেরোচ্ছে না। কেন?

বসে পড়ল আরেকবার। গলার পাশের মাটিতে আঙুল ছোঁয়াল। এক ফোঁটা রক্ত নেই, ধুলো লাগল আঙুলে। কাঁপা কাঁপা হাতে কিশোরের কাটা জায়গাটা ছুঁয়ে। দেখল।

ভেজা নয়! রবার!

মেকাপ! আরেকবার চিৎকার করল মুসা, দুঃখে নয় এবার, রাগে। কিশোরের গায়ে জোরে একটা ঠেলা মেরে খেঁকিয়ে উঠল, অনেক হয়েছে! এবার ওঠো! এত শয়তানী করতে পারো…

নড়ল না কিশোর। আরেকবার ঠেলা দিল মুসা। একই ভাবে পড়ে রইল গোয়েন্দাপ্রধান। সন্দেহ হতে লাগল মুসার। রসিকতা নয়। সত্যিই কিছু হয়েছে। কিশোরের। ভাড়াতাড়ি ওর গলার নাড়িতে আঙুল চেপে ধরে দেখল ঠিক আছে। কিনা। নাড়ি চলছে ঠিকই। নড়ছে না যখন, তার মানে বেহুঁশ হয়ে গেছে কিশোর। কি ঘটেছিল?

বসে রইল মুসা।

আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করল কিশোরের মাথা, একপাশ থেকে আরেক পাশে। মৃদু গোঙানি বেরোল শুকনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। চোখ মেলল অবশেষে।

 জেগেছ, এতক্ষণে হাসি ফুটল মুসার মুখে। ওঠো ওঠো।

মুসার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। নড়ছেও না কথাও বলছে না।

কথা বলতে ভুলে গেছ নাকি?

শশশ, চুপ করতে ইঙ্গিত করল মুসাকে কিশোর। কি ঘটেছিল, মনে করার চেষ্টা করছি।

জোরে জোরেই করো না, আমিও শুনি।

উঠে বসল কিশোর। টলছে। দাঁড়াও… জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে ভিজিয়ে নিল সে। ইনডোর শূটিঙের জন্যে যেখানে সেট ফেলেছেন রিডার, সেখানে ঘোরাঘুরি করছিলাম। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললাম। কিছু মূল্যবান তথ্য দিল ওরা আমাকে।

বেন ডিলনের ব্যাপারে?

না, শরীর ঠিক রাখার ব্যাপারে। সিনেমায় যারা অভিনয় করে, শরীরটাই তাদের প্রধান পুঁজি, নষ্ট হয়ে গেলে মরল।

ধূর! ওসব কথা শুনতে চায় কে? আমাকে জিজ্ঞেস করতে, কিভাবে ফিট রাখতে হয় আমিই বলে দিতাম।

মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। প্রোটিন মিল্ক শেক খায় ওরা, মুসা। এটা খেয়েই শরীরের ওজন কমিয়ে রাখে। ওরা বলে, সাংঘাতিক নাকি কাজের জিনিস। মনে হলো, আজ থেকেই আমিও শুরু করি না কেন? পেটে মেদ জমাকে আমার ভীষণ ভয়। চলে গেলাম স্টুডিওর কমিশারিতে এক গ্লাস মিল্ক শেক খাওয়ার জন্যে। ড্রিংক আসার অপেক্ষায় আছি, এই সময় খেয়াল করলাম বিশালদেহী, একজন লোক আমার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। এমন ভাব করে রইলাম, যেন তাকে দেখিইনি। মিল্ক শেক নিয়ে বেরোতে যাব, দরজায় দাঁড়িয়ে আমার পথ আটকাল সে।

একটা মুহূর্ত একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর সে বললঃ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমরা যেটা খুঁজে পেয়েছি সেটা নয়, যেটা আমরা খুঁজতে যাচ্ছি সেটা।

বলল ওরকম করে? মাথা নাড়তে নাড়তে বলল মুসা, তোমাকেও ধরেছে! বুঝতে পেরেছি, কে। পটার বোনহেড।

হ্যাঁ। উঠে দাঁড়াল কিলোর। এগোতে গিয়ে টলমল করে উঠল পা। কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেল। পড়ে গেলে যাতে ধরতে পারে সে জন্যে হাত বাড়িয়ে। দিল মুসা।

ঠিকই আছি, আমি পারব, কিশোর বলল, ধরতে হবে না। যা বলছিলাম। মিল্ক শেক নিয়ে তখুনি বেরোলাম না আর। মনে হলো, এই লোক আমাকে অনেক, খবর দিতে পারবে। প্রশ্ন শুরু করলাম তাকে। অনেক কথাই বলল সে, তবে। আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। শেষে কিছুটা বিরক্তই হয়ে গেলাম। ওরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বললে কি ভাল্লাগে নাকি! জিজ্ঞেস করলাম, শেষ কখন ডিলনকে দেখেছে। জবাব দিল, রোজই।

বললাম, কি আবল-তাবল বকছেন? শেষ কোথায় দেখেছেন?

জবাব দিল, আমার তৃতীয় নয়ন সারাক্ষণই দেখে তাকে।

বলো, কি রকম যন্ত্রণা! তৃতীয় নয়ন! নিজের কপালে যে দুটো আছে সে দুটোই ভালমত ব্যবহার করতে শেখেনি, আবার তৃতীয় নয়ন। হুহ! রাগ হতে লাগল। তার পরেও জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আছে এখন বেন ডিলন? ঘুরিয়েই হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময় সেখানে এসে হাজির হলেন ব্রাউন অলিংগার। চিনে ফেললেন আমাকে। কি কুক্ষণেই যে মোটুরামের অভিনয় করতে গিয়েছিলাম! বললেন, হরর ছবিতে নতুন চরিত্র যোগ করতে যাচ্ছেন তিনি, আমি ইচ্ছে করলে তার সঙ্গে কাজ করতে পারি। কাজ মানে অভিনয়, বুঝতে পারলাম।

গলা থেকে কুৎসিত কাটার দাগ আঁকা রবারটা টেনে খুলে ফেলল কিশোর। চামড়া থেকে এবার সিমেন্ট ছাড়াতে বেশ জোরাজুরি করতে হলো। কি করতে হবে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, কয়েকটা শট নেয়া হবে, তারই একটা মহড়া। চলবে। আমাকে দিয়ে হলে আমাকেই নেবে, নয় তো অন্য কাউকে। অলিংগারের সঙ্গে কথা বলা যাবে, এই লোভেই কেবল ওদের গিনিপিগ সাজতে রাজি হয়ে গেলাম। ভুল করেছি। মেকআপের ঘরে আমাকে নিয়ে গিয়ে রেখে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এলেন কাজ কতটা এগোল দেখার জন্যে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অ্যালার্ম দিতে শুরু করল ঘড়ি, প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন তিনি।

তুমি তখন কি করলে? জানতে চাইল মুসা।

কমিশারিতে ফিরে গেলাম। যেখানে বোনহেড আর আমার গ্লাসটা রেখে। এসেছিলাম। গ্লাসটা ঠিকই আছে, কিন্তু বোনহেড নেই। খেয়ে গ্লাসটা খালি করে রেখে চলে এলাম এখানে। তারপর কি ঘটল, মনে নেই। চোখ মেলে দেখি তোমাকে।

ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল মিল্ক শেকে, কিশোর। বাজি রেখে বলতে পারি বোনহেডই করেছে এই অকাজ। চট করে চারপাশে চোখ বোলাল একবার মুসা।

মিল্ক শেকের গ্লাস খুঁজছ? কিশোর বলল, পাবে না। এখানে আনিইনি। কমিশারিতে বেঞ্চের ওপর রেখেছিলাম। এখন গেলে পাবে না। পটার বোনহেডের সঙ্গে আরেকবার কথা বলতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।

পটার বোনহেডকে খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। ডিরেকটরির হলুদ পাতাগুলোর একটাতে নিচের দিকে রয়েছে ওর বিজ্ঞাপন, লস অ্যাঞ্জেলেসের ঠিকানায়। ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞাপন। হেডিঙের বাংলা করলে দাঁড়ায় আধিভৌতিক পরামর্শদাতা। নিচে ফলাও করে লিখেছে, কত রকমের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার। মানুষের মনের কথা পাঠ করা থেকে শুরু করে জটিল রোগের চিকিৎসা করা পর্যন্ত সব নাকি পারে। লিখেছে পৃথিবী হল আমার জবাব জানার যন্ত্র। আমার জন্যে মেসেজ রেখে দেয়। আমার প্রশ্নের জবাব দেয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি।

ঠিকানা দেখে বেভারলি হিলের একটা র‍্যাঞ্চ হাউসে এসে পৌঁছল কিশোর আর মুসা। সাদা রঙের একটা লম্বা বাড়ি। সামনের দরজাটা খুলে আছে হাঁ হয়ে। ভেতরে দামি দামি আসবাবপত্র, ছবি রয়েছে। চোরের লোভ হতে পারে, কিন্তু পরোয়াই করে না যেন বাড়ির মালিক।

খোলা দরজার পাল্লায় টোকা দিল দুই গোয়েন্দা, সাড়া এল না। থাবা দিল, তাতেও জবাব নেই। শেষে ঢুকেই পড়ল ভেতরে, চলে এল পেছন দিকে। একটা সুইমিং পুলের কিনারে বসে সন্ধ্যার উষ্ণ বাতাস উপভোগ করছে বোনহেড। খোলা গা। সাদা একটা লিনেনের প্যান্ট পরনে। পদ্মাসনে বসেছে। চাঁদ উঠছে। বড় একটা তারা ঝিলমিল করছে আকাশে, যেন সুইমিং পুলের পানির মতই।

কিশোর, লোকটাকে কোথাও দেখেছি, মুসা বলল ফিসফিসিয়ে।

তা তো দেখেছই। কয়েক দিন আগে, শুটিং স্পটে। একটা স্ফটিক দিয়েছিল তোমাকে।

না, ওখানে নয়, অন্য কোথাও দেখেছি।

শ্রাগ করল কিশোর। পেশীবহুল শরীর লোকটার। সোনালি চুল। আস্তে আস্তে ওর দিকে এগোতে লাগল সে।

চারটে বড় নীল স্ফটিক নিজের চারপাশে রেখে দিয়েছে বোনহেড। ওগুলোর একেকটাকে একেকটা কোণ কল্পনা করে কল্পিত বাহু আঁকলে নিখুঁত একটা বর্গক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। হাতের তালুতে লাল একটা পাথর। কানের ফুটোতে দুটো সাদা পাথর, আর নাভিতে একটা সোনালি পাথর বসিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ।

মিস্টার বোনহেড, কিশোর বলল, যে আলোচনাটা শেষ করতে পারিনি। আমরা, সেটা এখন শেষ করতে চাই।

চোখ না মেলেই বোনহেড বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কানে স্ফটিক ঢোকানো রয়েছে।

নতুন যুগ। পুরানো রসিকতা, বিড়বিড় করল কিশোর।

আমার কানের স্ফটিকগুলো সমস্ত না-বোধক কাঁপন সরিয়ে রাখছে, তাতে মনের গভীরের সব বোধ সহজেই বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে। বলে দিচ্ছে, এখন যা আছি তা না হয়ে অন্য কেউ হলে কি হতে পারতাম। ওই বোধই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে, বিষ ঢুকেছে তোমার শরীরে।

স্ফটিক আপনাকে একথা বলছে, আমাকে অন্তত বিশ্বাস করাতে পারবেন না, কিশোর বলল। আমি ভাল করেই জানি, আপনিই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মিল্ক শেকের গ্লাসে কি মিশিয়েছিলেন বলুন তো?

শব্দ করে হাসল বোনহেড। পদ্মাসন থেকে উঠে নতুন করে সাজাতে লাগল চারপাশে রাখা স্ফটিকগুলো। ছটা বাজে। আমার সাঁতারের সময় হয়েছে। বলেই পুলের কিনারে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।

তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা।

পানিতে দাপাদাপি করছে বোনহেড। একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। চোখ। বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, মুখ গোল, মুখের ভেতরে পানি ঢুকে যাচ্ছে।

সাঁতার ভাল জানে না লোকটা, কিশোর বলল।

একেবারেই জানে না! বুঝে ফেলেছে মুসা। একটানে জুতো খুলে ফেলেই ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে। কয়েক সেকেণ্ডেই পৌঁছে গেল খাবি খেতে থাকা লোকটার কাছে। পেছন থেকে গলা পেঁচিয়ে ধরে টেনে আনতে লাগল কিনারে। পানিতে ডোবা মানুষকে কি করে উদ্ধার করতে হয়, ভালই জানা আছে তার।

ভারি শরীর। দুজনে মিলে কসরৎ করেও বোনহেডকে পানি থেকে তুলতে কষ্ট হলো কিশোর আর মুসার।

বোনহেড কথা বলার অবস্থায় ফিরে এলে কিশোর জিজ্ঞেস করল, একাজ করতে গেলেন কেন? আমরা না থাকলে তো ডুবে মরতেন।

গতকাল তো তোমরা ছিলে না। ঠিকই সাঁতার কেটেছি। কই, মরিনি তো।

আপনার মাথায় দোষ আছে! রাগ করে বলল কিশোর, আর একটা মিনিটও আমরা থাকব না এখানে! যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই, শুনুন, বেন ডিলনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আমার সন্দেহ, আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন। আমাদেরকে বলছেন না। না বললে নেই, আপনার ইচ্ছে। কিন্তু ভাববেন না, এতে করে আটকাতে পারবেন আমাদেরকে। ঠিক খুঁজে বের করে ফেলব। আমরা ডিলনকে।

বোনহেডের চেহারার পরিবর্তনটা মুসারও নজর এড়াল না। ঠিক জায়গায় ঘা মেরেছে কিশোর। কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিল ভবিষ্যদবক্তা। হাসি ফুটল ঠোঁটে। ডিলন কোথায় আছে আমি তোমাদেরকে বলতে পারব না। তবে ডিলন আমাকে বলতে পারবে সে কোথায় আছে।

আপনার সঙ্গে সে যোগাযোগ করবে আশা করছেন নাকি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

ডিলন আমার ছাত্র। ছাত্র হলেই প্রথমে আমি ওদেরকে প্রয়োজনীয় স্ফটিক দিয়ে দিই। স্ফটিকগুলো সব আমার দিকে টিউন করা। কিংবা বলা যায়, আমরা। যারা এই গ্রুপে আছি, তাদের সবার দিকে টিউন করা। আমাদেরকে চেনে ওগুলো। আমাদের চিন্তা পড়তে পারে, আমাদের স্বপ্ন বুঝতে পারে। কি পোশাক আমাদের পরা উচিত তা-ও বলে দিতে পারে। আমরা বহুদূরে চলে গেলে আমাদের জন্যে মন কেমন করে ওগুলোর। নিঃসঙ্গ বোধ করে।

এতগুলো কথা তো বললেন, কিছুই বুঝলাম না! ফেটে পড়ার অবস্থা হয়েছে। কিশোরের।

ডিলনের স্ফটিকগুলো নিয়ে এসো। আমি ওগুলোকে টিউন করে, প্রোগ্রাম করে চ্যানেল করে দেব। দেখবে কি ঘটে।

যেন ক্যাবল টিভি টিউনিং করছে আরকি! আনমনে বিড়বিড় করল মুসা।

চোখ মুদল বোনহেড। স্ফটিকগুলো এনে দাও। বোনহেড কোথায় আছে বের করে দিচ্ছি।

স্ফটিক আপনাকে ডিলনের সন্ধান দেবে? মুসারও অসহ্য লাগতে আরম্ভ করেছে এ ধরনের কথাবার্তা। যদি না জানে? যদি মন খারাপ থাকে, কিংবা রেগে গিয়ে থাকে আপনার ওপর, বলতে না চায়?

স্ফটিক বলবেই।

এ ব্যাটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাগলা গারদে ভরা উচিত এখনই! ভাবল মুসা।

ওকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বলে বসল কিশোর, ঠিক আছে, ওই কথা রইল। তাহলে। আমরা স্ফটিকগুলো বের করে এনে দেব আপনাকে। যত তাড়াতাড়ি পারি।

.

০৮.

গাড়িতে ফেরার পথে সারাটা রাস্তা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল মুসা। বোনহেডের ওপর রাগ। বলল, কিশোর, ওই ব্যাটাকে আমি চিনি। দেখেছি কোথাও। মনে করতে পারছি না। আর তুমিই বা চট করে রাজি হয়ে গেলে কি করে, স্ফটিকগুলো খুঁজে দেবে? ওরকম পাগলকে শায়েস্তা করাই তো তোমার স্বভাব। ফালতু কথা তুমি কখনই বিশ্বাস করো না।

গাড়িতে উঠল কিশোর। সীটবেল্ট বাঁধল। হেসে বলল, এখনও করি না। আমাদেরকে কিছু একটা বোঝাতে চেয়েছে পটার বোনহেড, ইঙ্গিতে। কিংবা উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাদের কাছে কিছু লুকাতে চেয়েছে। যা-ই করুক, আমি তার সঙ্গে খেলা চালিয়ে যাব। দেখিই না কি বেরোয়। এমনও হতে পারে, ডিলনের স্ফটিকগুলো সত্যি কোন একটা সূত্র দিয়ে বসল আমাদের।

ডিলনের ম্যালিবু বীচের বাড়ি থেকে স্ফটিকগুলো খোঁজা শুরু করবে ঠিক করল দুজনে। মুসা গাড়ি চালাচ্ছে, কিশোর কথা বলছে। আপনমনেই বকর বকর করতে থাকল বোনহেড, রিডার, ডিলন আর অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে।

একটা চিকেন লারসেন রেস্টুরেন্টের সামনে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল মুসা। সেই যে লারসেন, মুরগীর রাজা, যার কাহিনী বলা হয়েছে খাবারে বিষ বইতে। কিশোর জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে?

না। তবে খেতে বসলে তোমার বকবকানিটা তো বন্ধ হবে। আরিব্বাপরে। বাপ, কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলল!

চুপ হয়ে গেল কিশোর।

আবার ডিলনের বাড়িতে চলল মুসা। বাড়িতে পৌঁছে ভেতরে ঢোকার সময় আর ভাল লাগল না তার। তবু কিশোরের সঙ্গে এগোতে লাগল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও। সাবধানে সদর দরজার দিকে এগোল দুজনে। এখনও খোলা, তালা নেই।

ভেতরে উঁকি দিল মুসা। আসবাবপত্র যেখানে যেভাবে পড়ে ছিল, সেভাবেই। রয়েছে, ঠিক করা হয়নি। করবেই বা কে?

কেউ কিছু ছোঁয়নি,বলল সে।

এগোও।

আবার এগোল দুজনে। মুসা আগে আগে। পায়ের তলায় মড়মড় করে কাচ গুড়ো হওয়া শুরু হয়েছে। কাচের গুঁড়োর সঙ্গে এখন মিহি বালি মিশেছে। সৈকত থেকে উড়ে এসে পড়েছে ওই বালি।

সাংঘাতিক একটা লড়াই হয়ে গেছে এখানে, মুসা বলল।

বুঝতে পারছি, কিশোর বলল। চোখ বোলাচ্ছে ঘরে। মেঝেতে পড়ে থাকা কাচের গুড়ো পরীক্ষা করে বলল, স্ফটিকের গুড়ো নয় এগুলো। অসমান। স্ফটিক ভাঙলে ছোট স্ফটিকই হয়ে যায় আবার।

তাহলে কোত্থেকে এল?

রহস্য।

ডিলনের স্ফটিক খুঁজতে লাগল ওরা। মুসা চলে এল শোবার ঘরে। খানিক পরে বাড়ির পেছন দিক থেকে কিশোরের ডাক শোনা গেল, দেখে যাও!

হল পেরিয়ে দৌড়ে পেছনের বেডরুমে চলে এল মুসা, এখান থেকে সাগর দেখা যায়। বুকশেলফের সামনে ঝুঁকে রয়েছে কিশোর, একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে।

মুসার সাড়া পেয়ে বলল, পটার বোনহেডের অটোগ্রাফ দেয়া তারই লেখা। বই। এই দেখো, অনেক বই লিখেছে, জোরে জোরে নাম পড়তে লাগল কিশোর, ইনফিনিটি স্টপস হিয়ার, আউট অভ বডি এক্সপিরিয়েনসেস, হাউ টু বি ইউর অউন বেস্ট ট্র্যাভেল এজেন্ট, দি থার্ড আই বুক অভ অপটিক্যাল ইলিউশন, গেটিং রিচ বাই গোইং ব্রোকঃ অ্যান অটোবায়োগ্রাফি।

দম নিতে কষ্ট হওয়ার অনুভূতিটা হলো আবার মুসার। বলল, স্ফটিকগুলো এখানে নেই, কিশোর। আমি গাড়িতে গিয়ে বসি। তুমি দেখে তাড়াতাড়ি চলে এসো, অন্য কোথাও খুঁজব।

গাড়িতে বসে আছে তো আছেই মুসা, কিশোরের আর দেখা নেই। তিরিশ মিনিট পরে এল সে।

এত দেরি করলে?

অ্যাঞ্জেলা ডোভারকে ফোন করেছিলাম। কিশোর জানাল, ও বলল, স্ফটিক ছাড়া কখনও কোথাও যায় না ডিলন। ভয়ের দৃশ্যগুলোতে অভিনয় করার দিন। পুষ্পরাগমণি সাথে করে নিয়ে যায় সে। রোমান্টিক দৃশ্যে নীলকান্তমণি। কোয়ার্জ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল যেদিন জ্যান্ত কবর দেয়ার দৃশ্যটা নেয়ার কথা। সেই দিনই গায়েব হয়ে গেল ডিলন। আগের দিন নাকি ওর ক্লোজ-আপ নেয়া হয়েছিল।

কোথায় যাব? মুভি স্টুডিওতে?

গোরস্থানে।

গোরস্থান! কিশোর, কি জানি কেন, আমাদের কেসগুলো খালি গিয়ে গোরস্থানে শেষ হতে চায়! অনেক কেই তো হল! এবারেরটাও কি তাই হবে? এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, একেক সময় মনে হয়, গোরস্থানে থাকার জন্যেই যেন আমাদের জন্ম হয়েছিল। আর কোথাও গেলে হয় না এখন? কাল দিনের বেলা নাহয় যাব।

রাতে যেতে ভয় লাগছে তো? হাসল কিশোর। সাথে করে স্ফটিক নিয়ে। যাওয়ার অভ্যেস ডিলনের। অ্যাঞ্জেলার কাছে জানলাম, ছোট একটা বাক্সতে ভরে ওগুলো নিয়ে যেত সে। গত বিদ্যুৎ বারেও নিয়েছিল। অ্যাঞ্জেলা বলল, শুটিঙের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার ট্রাকগুলো এখনও গোরস্থানেই রয়েছে।

থাক। এতদিনে যদি কিছু না হয়ে থাকে, আজকে এক রাতে আর হবে না। পঞ্চাশ মাইল দূর। এখন রওনা হলেও যেতে যেতে মাঝরাত হয়ে যাবে।

কিন্তু মুসার কথা শুনল না কিশোর।

রাত এগারোটা উনষাট মিনিটে ড্যালটন সিমেট্রির পাশে এনে গাড়ি রাখল। মুসা। হেডলাইট নিভাল। নভেম্বরের শুকনো বাতাস চাবুক হেনে গেল যেন ডালে ডালে, পাতায় পাতায়। এমন ভাবে দুলে উঠে কাছাকাছি হতে লাগল ডালগুলো, মনে হল মাথা দুলিয়ে আলাপে ব্যস্ত ওরা।

আমি এখানেই থাকি, মুসা বলল। ইঞ্জিনটা চালু থাক। রেডিও অন করে দিই।

গ্রাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করে মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল। কিশোর, তোমার তো ভয় থাকার কথা নয়। নিরাপত্তার জন্যে সাথে স্ফটিক রয়েছে…

নেই। বাড়িতে রেখে এসেছি। পকেটে রাখতে পারি না। গরম লাগে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ওরা। অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদ আছে, মেঘও আছে। পাগলা ঘোড়ার মত যেন ছুটে চলেছে মেঘগুলো। ফলে ক্ষণে ক্ষণে ঢাকা পড়ছে চাঁদ, আবার বেরিয়ে আসছে। ঝিঁঝি ডাকছে। ছোট জানোয়ারেরা হুটোপুটি করছে ঝোপের ভেতর। ঢাল বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলাল কিশোর, গড়িয়ে পড়তে লাগল। ধরার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল মুসা, ফসকে গেল।

গড়ান থামল একসময়। উঠে বসে কিশোর বলল, ধাক্কা মারলে কেন?

 কই? আমি তো ধরতে চেষ্টা করলাম। কিসে হোঁচট খেলে?

 দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। কি জানি, বুঝতে পারলাম না!

দূরে ঘেউ ঘেউ শুরু করল একটা কুকুর। ব্যথা পেয়ে কেউক করে উঠে চুপ হয়ে গেল। তারপর স্তব্ধ নীরবতা।

টর্চ হাতে আগে আগে চলল মুসা। গোরস্থানের আরেক ধারে চলে যেতে হবে। সার্ভিস রোডের ধারে দেখেছিলাম ট্রাকগুলোকে। হয়তো ওখানেই আছে।

দুজনেই টর্চ জ্বেলে রেখেছে। কিশোর ধরে রেখেছে সামনের দিকে। মুসা সামনেও ফেলছে, আশপাশেও ফেলছে আলো। মাঝে মাঝে ঘুরে পেছনেও দেখছে। কাজেই, ওটা যখন ছুটে এল, দেখতে পেল না সে, ওই সময় পেছনে তাকিয়ে ছিল। বাতাসের ঝাঁপটা লাগল দুজনের গায়েই। তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ল ওটা।

বাপরে! বলে বসে পড়ল মুসা। ভূ-ভূ-ভূ-ত!

আরে দূর, পেচা! কি যে কাণ্ড করো না! খাবার পায়, দেখে চুপচাপ এলাকা, পেঁচা তো এখানে থাকবেই।

লেকচার দিতে কে বলেছে তোমাকে? থামো। সার্ভিস রোডের দিকে আলো ফেলল মুসা। একটা গর্ত পেরিয়ে যেতে হবে। কবরের মত করে খোঁড়া। ওখানে শুটিঙের বন্দোবস্ত করেছিল ওরা। আমার বিশ্বাস, থাকলে স্পেশাল ইফেক্ট লেখা ট্রাকটাতেই আছে বাক্সটা।

পথ দেখাও।

দাঁড়াও। কি যেন শুনলাম।

 এসো, সামনে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।

নরম কার্পেটের মত পায়ের নিচে পড়ছে ঘাস। বাতাসে ভেসে আসছে মিষ্টি, ভারি এক ধরনের গন্ধ, কাপড়ে লেগে আটকে যাচ্ছে যেন।

দাঁড়াও! কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরে তাকে থামাল মুসা। বললাম না, শব্দ শুনেছি!

দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। কান পেতে রইল দুজনেই। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই কানে এল না।

ভুল শুনেছ, কিশোর বলল। কল্পনা।

তুমি নিজেও শিওর নও, কিশোর, তোমার কণ্ঠস্বরই বলছে।

 চলো।

যেতে ইচ্ছে করছে না মুসার, কিশোরের চাপাচাপিতেই কেবল এগোচ্ছে। পাহাড়ী পথ। অন্ধকারে ঠিকমত দেখে চলতে না পারলে আছাড় খেয়ে পড়তে হবে। ঠিক জায়গার দিকেই এগোচ্ছে তো? সন্দেহ হলো তার।

না, ঠিকই এসেছে, খানিক পরেই বুঝতে পারল। নতুন খোঁড়া কবরটা দেখতে পেল সে। ওটার পাড়ে এসে দাঁড়াল দুজনে। ভেতরে আলো ফেলল। টর্চের আলোয় যেন হাঁ করে রইল গভীর করে খোঁড়া শিশিরে ভেজা গর্তটা। আশেপাশে কোন ট্রাক দেখা গেল না। সার্ভিস রোডটা শূন্য।

গেল কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।

এখানেই তো ছিল। সরিয়ে ফেলেছে বোধহয়।

খুব খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে এসে শেষে কিছুই না। ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। শব্দ শুনেছ বললে না…

কথা শেষ হলো না। মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। চিৎকার করে উঠল সে। মুসাকেও চিৎকার করতে শুনল। তারপরই কালো অন্ধকার যেন গিলে নিল তাকে।

.

০৯.

মাথার ভেতরে কেমন জানি করছে মুসার। কি হয়েছে কিছু বুঝতে পারছে না। কোথায় পড়েছে? কি হয়েছিল? মনে পড়ল আস্তে আস্তে। মাথায় বাড়ি লেগেছিল। শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে, ডালটাল দিয়ে। কিশোর কোথায়?

মাথা তোলার চেষ্টা করল মুসা। দপদপ করছে। ভীষণ যন্ত্রণা। কোনমতে তুলে দেখল কবরটার ভেতরে পড়ে আছে সে। কিশোর রয়েছে তার পাশে। অনড়। শক্তি পাচ্ছে না। আবার মাথাটাকে ছেড়ে দিল মুসা, থপ করে পড়ে গেল ওটা নরম মাটিতে। চোখের সামনে কালো পর্দা ঝুলছে যেন। ওটাকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে। বেহুঁশ হতে চাইছে না। কি হয়েছিল? আবার ভাবল। ওঠো, হুশ হারাবে না, নিজেকে ধমক লাগাল সে।

একটা শব্দ হলো। শিউরে উঠল মুসা। নিজের অজান্তেই। যে লোকটা বাড়ি মেরেছে ওদেরকে, এখনও রয়েছে কবরের পাড়ে। মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল মুসা, পারল না।

গায়ে এসে পড়ল কি যেন।

খাইছে! মাটি! বেলচা দিয়ে কবরের পাড়ের আলগা মাটি ফেলা হচ্ছে ভেতরে! জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলার ইচ্ছে!

কবরের পাড় থেকে উঁকি দিল একটা মুখ। চেহারাটা দেখতে পেল না মুসা, তবে চাঁদের আলোয় চকচক করা বেলচাটা ঠিকই চিনতে পারল। সরে গেল মুখটা। আবার এসে মাটি পড়তে লাগল কবরের ভেতরে।

চিৎকার করে উঠল মুসা। নাআআ! নিজের কানেই বেখাপ্পা, অপার্থিব শোনাল চিৎকারটী।

যত ব্যথাই করুক, কেয়ার করল না আর সে। জোরে জোরে গালমুখ ডলে আর মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরটা পরিষ্কারের চেষ্টা করল। হাতে লেগে থাকা কাদা মুখে লেগে গেল। ভেজা মাটির গন্ধ।

ওপর থেকে মাটি পড়া থেমে গেল।

হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হল মুসা। উঠে দাঁড়ানর চেষ্টা করতে লাগল। কবরের ভেজা দেয়াল ধরে ধরে উঠল অবশেষে। চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, কিশোর, ওঠ! এই কিশোর, উঠে পড়ো! কিশোর.আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে…

নড়ে উঠল কিশোর। তাকে উঠতে সাহায্য করল মুসা। শার্টের বুক খামচে ধরে টেনে টেনে তুলল।

হয়েছে…হয়েছে…, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। কোথায়…কি… কথা বলার শক্তি নেই যেন। দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধ ঝাড়া দিয়ে মাটি ফেলার চেষ্টা করছে শরীর থেকে।

কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে এর পরের জরুরি কাজটায় মন দিল মুসা। কবরের দেয়ালে হাতের আঙুল আর জুতোর ডগা ঢুকিয়ে দিয়ে বেয়ে ওঠার চেষ্টা চালাল। খুব একটা কঠিন কাজ না। মাথায় যন্ত্রণা না থাকলে এটা কোন ব্যাপারই ছিল না। তবে এখন যথেষ্ট কষ্ট হলো।

বাইরে বেরিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না। নির্জন গোরস্থান। ঝিঁঝির একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে আগের মতই। ও হ্যাঁ, আরেকটা ডাকো, কুকুরটা ডাকতে আরম্ভ করেছে আবার।

কবরের পাড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। প্রায় টেনে তুলল কিশোরকে। হাঁপাতে লাগল দুজনেই। মাথার ভেতরটা ঘোলাটে হয়ে আছে।

জলদি এসো, মুসা বলল, ব্যাটাকে ধরতে হবে। নিশ্চয় পালাতে পারেনি এখনও।

না, শার্ট থেকে মাটি সরাতে সরাতে বলল কিশোর, আড়ালে থেকে নজর রাখব আমরা। তাতে ওকে অনুসরণ করা যেতে পারে। পিছু নিয়ে দেখতে পারব কোথায় যায়।

 পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল আবার দুজনে। একটা ক্যামারো গাড়িকে ছুটে যেতে দেখল হেডলাইট জ্বেলে, লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে। মিনিট খানেক পরেই। ভেগাটা চালিয়ে মুসাও রওনা হয়ে গেল। পাশে বসেছে কিশোর। ছোট গাড়িটাকে যতটা সম্ভব দ্রুত ছোটানোর চেষ্টা করল মুসা, কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চায় না ক্যামারোটাকে।

 হান্টিংটন বীচ, লং বীচ পেরিয়ে এসে লস অ্যাঞ্জেলেসে ঢুকল গাড়ি। বেভারলি হিলের দিকে এগোল।

এলাকাটা পরিচিত লাগল মুসার কাছে। বলল, কয়েক ঘণ্টা আগেও না। এখানে ছিলাম?

স্ট্রীট লাইটের আলোয় পলকের জন্যে ক্যামারোর ড্রাইভারকে দেখতে পেল সে। বয়েস খুব কম মনে হলো, বড় জোর উনিশ, সাদা একটা হেডব্যাণ্ড লাগিয়েছে মাথায়। বায়ে মোড় নিল লোকটা। এই রাস্তাও মুসার পরিচতি। পটার বোনহেডের বাড়ির দিকে যাচ্ছে গাড়িটা।

আগের মতই এখনও খুলে রয়েছে বোনহেডের বাড়ির সদর দরজা। ক্যামারো থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা। কিশোর আর মুসাও ছুটল। পেছনে।

 ভোর হয়ে আসছে। তাজা বাতাসে অনেকটা ঠিক হয়ে গেছে দুজনের মাথার যন্ত্রণা, ঘোলাটে ভাবটা দূর হয়ে গেছে। মোমের আলো জ্বলছে বিরাট বাড়িটার ঘরে। আলো লেগে ঝিকঝিক করছে ফটিক। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢুকতে লাগল গোয়েন্দারা, বোনহেডকে খুঁজছে।

ইঁদুর মনে হচ্ছে নিজেকে, মুসা বলল, ফাঁদের দিকে যাচ্ছি।

যাইই না। পনির থাকতেও পারে।

হঠাৎ একটা দরজা খুলে গেল। বড় একটা ঘরের ভেতর শত শত মোম। জ্বলছে। সাথে করে এক যুবক আর এক মহিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এল বোনহেড। দুজনের বয়েসই বিশের কোঠায়।

এত রাতে আমাদের সাথে দেখা করেছেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, লোকটা বলল। একটা চেক বাড়িয়ে দিয়েছে বোনহেডের দিকে। যাই। আরও মক্কেল এসেছে দেখি?

সত্য সন্ধানীরা তাদের হাতঘড়ি হারিয়ে ফেলেছে, বোনহেড বলল রহস্যময়। কণ্ঠে, তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর মুসার দিকে, চোখে বিচিত্র দৃষ্টি।

আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে যদি লিখে রাখতে পারতাম, মহিলা বলল, ভবিষ্যতে কাজে লাগত। যাই হোক, আপনি যে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ। ওর জন্মদিনটা আনন্দে কাটুক, ও খুশি থাকুক, এটাই আমি চেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। গুড নাইট।

দুজনে বেরিয়ে গেলে গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হাসি হাসল বোনহেড। স্ফটিকগুলো পাওনি তোমরা। বুঝতে পারছি।

 না, পাইনি, নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই অবাক হলো মুসা, কেমন খড়খড়ে হয়ে। গেছে। গোরস্থান থেকে এলাম।

এখন এসেছি অন্য জিনিস খুঁজতে, কিশোর বলল, সাদা হেডব্যাণ্ড পরা একজন লোককে।

চারপাশে তাকাল বোনহেড। ওরকম কাউকে তো দেখছি না।

তৃতীয় নয়ন ব্যবহার করুন, মুসা বলল।

ওর পেছন পেছন এখানে ঢুকেছি আমরা, বলল কিশোর।

মুখের ভাব বদলে গেল বোনহেডের, যেন মিথ্যে বলে ধরা পড়ে গেছে। ও, তোমরা নিকের কথা বলছ বোধহয়। আমার ছাত্র। ওকে কি দরকার?

একটু আগে আমাদেরকে জ্যান্ত কবর দিতে চেয়েছিল, ভারি গলায় বলল কিশোর। ড্যালটন সিমেট্রিতে গিয়েছিলাম ডিলনের স্ফটিকগুলো খুঁজতে। মাথার পেছনে বাড়ি মেরে আমাদের বেহুশ করে ফেলে দেয় আপনার ছাত্র, তারপর মাটি দিয়ে ভরে দিতে চায়।

নিক? মোলায়েম গলায় ডাকল বোনহেড। শুনে যাও তো?

হলের দরজায় এসে দাঁড়াল সাদা হেডব্যাণ্ড পরা যুবক।

এই লোকই, বলে উঠল মুসা। মুঠো হয়ে গেল হাত। ভদ্রতার ধার দিয়েও গেল না। চেঁচিয়ে উঠল, এই, আমাদের পিছু নিয়েছিলে কেন? বাড়ি মেরেছিলে কেন?

কি বলছ? নিক অবাক। সারারাত তো ঘরেই ছিলাম আমি। একটা মুহূর্তের জন্যে বেরোইনি।

মিথ্যে কথা! আমরা আগের বার যখন এসেছিলাম, তখনই আমাদের পিছু নিয়েছিলে!

সারারাত ঘরে ছিলাম, একই স্বরে বলল নিক। তোমরা ভুল করছ। একটি বারের জন্যেও বোনহেডের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে পিছু হেঁটে বেরিয়ে গেল

হচ্ছেটা কি এখানে? রেগে গিয়ে বোনহেডকে জিজ্ঞেস করল মুসা।

তোমার বোঝার সাধ্য হবে না, বলল বোনহেড। যতক্ষণ না মনের খোলা অংশকে আরও খুলতে না পারবে।

চোখ উল্টে দেয়ার উপক্রম করল কিশোর। গুঙিয়ে উঠে বলল, প্লীজ, আবার শুরু করবেন না ওসব কথা! বোনহেড চুপ করে আছে দেখে বলল, অনেকেই আমাদের কাছ থেকে কথা লুকানোর চেষ্টা করেছে, আগে। পারেনি। প্রতিবারেই ওদের কথা টেনে বের করেছি আমরা, মুখোশ খুলে দিয়েছি। আপনিও পারবেন না। বেন ডিলনের ব্যাপারে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছেন আপনি।

 শ্রাগ করল বোনহেড। হ্যাঁ-না কিছু বলল না। আরেক কথায় চলে গেল, ডিলনের এই গায়েব হয়ে যাওয়াটা যারা তাকে চেনে তাদের সবার কাছেই বেদনাদায়ক, ওর নিজের কাছেও। মনের খোলা অংশ আবিষ্কার করে ফেলেছিল সে। ও হলো ফাইন্ডিং দা পাথ নামের চমৎকার সেই ভাস্কর্যটার মত। ভাস্কর্যটার। চারটে পা, একেকটা একেক দিক নির্দেশ করছে।

ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল মুসা, শেষ কবে আপনি ডিলনের ম্যালিবু বীচের বাড়িতে গিয়েছিলেন?

প্রশ্নটা অবাক করল বোনহেডকে। বীচের বাড়ি? কখনও যাইনি। আমি যাব কেন? ছাত্ররাই শিক্ষকের বাড়ি আসে।

তাহলে ভাস্কর্যটার কথা কি করে জানলেন? ওটা দেখেছি ডিলনের বাড়িতে। পা উল্টে পড়ে থাকতে। আসবাবপত্রের সঙ্গে সঙ্গে ওটাকেও ভাঙা হয়েছে।

ওটার কথা আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

প্রশ্নের জবাবেই যেন বিশাল থাবার মুঠো খুলল বোনহেড। হাতের তালুতে একটা বড় বেগুনী পাথর। আবার শক্ত করে বন্ধ করে ফেলল মুঠো। মূল্যবান কাঁপুনি শুরু হয়েছে স্ফটিকের। আমি যাই।

ওদেরকে বেরিয়ে যেতে বলল বোনহেড, ঘুরিয়ে। ভারি পায়ে থপথপ করে হেঁটে চলে গেল যে ঘরে মোমবাতি জ্বলছে সেদিকে। কিশোর আর মুসা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চারপাশের মোমগুলো নিভে যাচ্ছে একের পর এক।

ডিলনের বাড়ির ভাস্কর্যটার কথা বলে একটা ভাল কাজ করেছ, কিশোর বলল।

থাক আমার সঙ্গে, রসিকতা করে বলল মুসা, দিনে দিনে আরও কত কিছু দেখতে পাবে।

প্রায় দুটো বাজে। বোনহেডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। আরেকবার মুখে লাগল রাতের তাজা হাওয়া। হাই তুলতে শুরু করল ওরা। বিশ্রাম চায়, বুঝিয়ে দিল শরীর।

সোজা এখন বিছানায়, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বলল মুসা। তোমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাব।

নিকের ব্যাপারে কি করবে? ডানের সাইড-ডোর মিররের দিকে তাকিয়ে। রয়েছে কিশোর। নিক বসে আছে ওর গাড়িতে। আমরা কোথায় যাই দেখার জন্যেই বোধহয়।

রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে তাকাল মুসা। বেশ কয়েক গজ পেছনে ছায়ায়, দাঁড়িয়ে রয়েছে নিকের ক্যামারো। মুসার মুখ থেকে হাসি চলে গেল। বেশ, পিছু নেয়ারই যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে, নিতে দেব ব্যাটাকে। আসতে থাকুক। ক্যারাবুঙ্গায় গিয়ে খসিয়ে দেব।

হ্যাঁ, তাই কর। আরাম করে সিটে হেলান দিল কিশোর।

পেছনে, কেউ লেগেছে জানলে ভুলভাল ড্রাইভিং শুরু করে লোকে, মুসা বলল।

হু! মিররের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। নিকের গাড়ির দিকে চোখ।

যে তোমাকে ফলো করছে তার সঙ্গে খুব রহস্যময় আচরণ করা উচিত তোমার। বলতে থাকল মুসা, এই যেমন ধর, হলুদ লাইট দেখলে জোরে চালিয়ে পার হয়ে যাওয়া উচিত নয়। যদি পেছনের লোকটা পেরোতে না পারে? তোমাকে হারিয়ে ফেলবে সে। মজাটাই নষ্ট। আর ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে বারবার লেনও বদল করা চলবে না। তোমার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হবে সে…

আহ, বকবকটা থামাও না! ক্যারাবুঙ্গার তিন ব্লক দূরে খসাবে।

তাহলে এখুনি গুড নাইট বলে নিতে পার নিকি মিয়াকে। একবারেই একসিলারেটর অনেকখানি চেপে ধরল মুসা। একটা ওয়ান-ওয়ে পথ ধরে ছুটল। একটা ব্লকের দিকে। ভুল পথে যাচ্ছে সে, উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ি আসতে দেখল না, তাই রক্ষা। নইলে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারত। আচমকা ডানে মোড় নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তায় লাফাতে শুরু করল গাড়ি। কয়েক গজ এগিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ করে হেডলাইট নিভিয়ে দিল। মাথা নিচু করে রইল সে আর কিশোর।

আপন গতিতেই নিঃশব্দে এগিয়ে ক্যারাবুঙ্গা মোটরসের পুরানো গাড়ির সারিতে এসে ঢুকে পড়ল মুসার ভেগা। ব্রেক কষল সে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, ব্লকটা ঘুরে আসছে নিক।

আমাদেরকে পাবে না, কিশোর বলল। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে না পেয়ে ফিরে যাবে।

মিস্টার নিক, খিকখিক করে শয়তানী হেসে বলল মুসা, এইবার আমাদের পালা। তুমি কোথায় যাও আমরা দেখব। কোন ইন্টারেস্টিং জায়গায় নিয়ে চলো আমাদেরকে।

.

১০.

 নিকের সঙ্গে চলল দুই গোয়েন্দার ইঁদুর-বেড়াল খেলা। ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে খেলাটা। রাত দুটোর বেশি। এই সময় রাস্তায় যানবাহনের ভিড় খুব কম। নিকের অগোচরে থাকার জন্যে কয়েক ব্লক দূরে থেকে অনুসরণ করতে হচ্ছে মুসাকে।

এত কষ্ট তো করছি, হাই তুলে বলল সে, ফল পেলেই হয় এখন।

আমি কি ভাবছি জানো? কিশোর বলল, নিক আমাদেরকে ডিলনের কাছে নিয়ে যাবে। যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।

সোজা হয়ে বসল মুসা। গতি বাড়িয়ে ক্যামারোর দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। বোনহেড আর নিক এই কিডন্যাপে জড়িত?

শীতল, ভোতা গলায় জবাব দিল কিশোর, ওরা মিথ্যুক।

লস অ্যাঞ্জেলেসের সম্ভ্রান্ত এলাকা বেল এয়ারে এসে ঢুকল ওরা। তিনতলা গোলাপী রঙ করা একটা কাঠের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল নিক। টালির ছাত বাড়িটার। চাঁদের আলোয় উইলো গাছ বিচিত্র ছায়া ফেলেছে, যেন বাড়িটার পটভূমিতে ঘাপটি মেরে রয়েছে একটা বেড়াল।

গাড়ি থেকে বেরোল নিক। ঘুমন্ত অঞ্চলটার ওপর চোখ বোলাল। গাড়ি থেকে কালচে রঙের একটা ব্যাকপ্যাক বের করে পিঠে বেঁধে সাবধানে এগোল অন্ধকার বাড়িটার দিকে। ওর আচরণেই বোঝা যাচ্ছে, সিকিউরিটি সিসটেমে পা দিয়ে। বসার ভয় করছে।

চুরি করে ঢোকার তালে আছে, ফিসফিস করে বলল মুসা। নইলে দরজায় টোকা দিত।

ওরাও বেরোল গাড়ি থেকে। অনেক বেশি সতর্ক হয়ে আছে। সিকিউরিটি সিসটেম চালু করে বিপদে পড়তে চায় না ওরাও। নিকের হাতে ধরা পড়তে চায় না।

বাড়ির সামনের দিকে এগোল নিক, প্রতিটি জানালা দেখতে দেখতে।

পুরানো মোটা একটা গাছের আড়ালে লুকাল কিশোর আর মুসা।

কি করছে? মুসার প্রশ্ন।

জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, কিশোর বলল। বাড়িতে কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখো, ঘোট একটা জিনিস ধরে রেখেছে মুখের কাছে। নিশ্চয় টেপ রেকর্ডার। কথা বলছে।

কথা বলা শেষ করে একটা ক্যামেরা বের করে অন্ধকার জানালার ভেতর দিয়ে ছবি তুলতে লাগল নিক। তারপর গিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।

বোনহেডের ওখানেই গেল, হতাশ ভঙ্গিতে বলল মুসা। যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম আমরা। এগোতে আর পারলাম না।

চুপ করে রয়েছে কিশোর। কিছু বলছে না।

গাড়িতে উঠেও চুপ হয়ে রইল সে। সীটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।

পরদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে বসেছে তিন গোয়েন্দা। রবিনও এসেছে। আগের রাতের ঘটনাগুলোর কথা তাকে বলছে অন্য দুজন।

সাংঘাতিক কাণ্ড করে এসেছ, রবিন বলল। কিন্তু ডিলনের হলোটা কি? তাকে কি বের করা যাবেই না?

কাল রাতে পাইনি বলে যে কোনদিনই পাব না, তা হতে পারে না, কিশোর বলল। একটা জরুরী কথা জানতে পেরেছি কাল। ডিলনের ওপর বোনহেডের খুব প্রভাব।

এবং বোনহেড মিছে কথা বলেছে, যোগ করল মুসা। বলেছে, ডিলনের বাড়িতে কখনও যায়নি, অথচ ওই বাড়িতে যে একটা ভাস্কর্য আছে সেটা জানে।

ছাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কিছু ভাবছে। বিড়বিড় করে বলল, মনে হয় ভুল লোকের পিছে ছুটেছি আমরা…

ট্রেলারের দরজায় টোকা পড়ল। ক্ষণিকের জন্যে জমে গেল যেন সবাই। দরজা খোলার আগে শার্টটা প্যান্টের ভেতরে গুঁজে নিল কিশোর।

হাই, বলল একটা মেয়ে। ওর লম্বা, সোনালি চুল এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। সবুজ চোখ। রবিন আছে?

অ্যাঁ! অস্বস্তি আরম্ভ হয়ে গেছে কিশোরের। পেছনে তাকিয়ে রবিনের মুখ দেখে নিল একবার। তারপর মেয়েটার দিকে ফিরে ডাকল, এসো, ভেতরে।

আই, রবিন, একটা হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা, বেশি তাড়াতাড়ি চলে এলাম?…বাপরে, কি জায়গা!

তাড়াতাড়ি? না না, আসলে আমিই ভুলে গিয়েছি। জরুরী আলোচনা চলছে। তো…পরিচয় করিয়ে দিই। আমার বন্ধু কিশোর পাশা…

সুন্দর নাম তো, মেয়েটা বলল। নিশ্চয় আমেরিকান নয়?

না। বাংলাদেশী..আর ও মুসা আমান।

 হাই, বলল মুসা। কোন হাই স্কুল?

হলিউড হাই, হেসে বলল রবিন, মেয়েটার হয়ে। ওর নাম চায়না।

মেয়েটাও হাসল। হাসার সময় নিচের ঠোঁটে কামড় লাগে তার। রবিনকে জিজ্ঞেস করল, আরও দেরি হবে?

 না, অস্বস্তি বোধ করছে রবিনও। যাওয়ারও ইচ্ছে আছে, আবার এখানেও থাকতে চায়। আমতা আমতা করে শেষে বলে ফেলল, কিশোর, আজ রাতে চায়নাদের বাড়িতে পার্টিতে একটা ব্যাও গ্রুপ পাঠাতে হবে। আমাকে যেতে হচ্ছে এখন।

 যেতে হলে যাও, ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।

আর কদিন পরে তোমার চেহারাই ভুলে যাব আমরা, বিষণ কণ্ঠে বলল মুসা। কেন যে বড় হতে গেলাম! ছোট ছিলাম আগে, সে-ই ভাল ছিল…

হ্যাঁ, সময় তো আর সব সময় এক রকম যায় না, কষ্ট রবিনেরও হচ্ছে। ভাবছি ট্যালেন্ট এজেন্সির চাকরিটাই ছেড়ে দেব। আমার লাইব্রেরিই ভাল। দেখি…

অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে চায়না। কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারছে না।

তোমরা চালিয়ে যাও, বেরোনোর আগে বলল রবিন। জরুরী প্রয়োজন পড়লে ফোন করো আমাকে।

দুজনে বেরিয়ে গেলে কিশোর বলল, মেয়েটাকে দেখলে?

ভালমত, জবাব দিল মুসা।

ভাবতে অবাক লাগে, বুঝলে, এই সেই আমাদের মুখচোরা রবিন! কি স্মার্ট হয়ে গেছে। আর মেয়েগুলোও যেন সব ওর জন্যে পাগল। আচ্ছা, আমাদের দিকে তাকায় না কেন, বলো তো?

ভুল বললে। তোমার দিকে তো তাকায়ই, তুমিই তাকাও না। মেয়েদের সামনে মুখ ওরকম হাঁড়ির মত করে রাখলে কি আর পছন্দ করবে ওরা? তোমার কথাবার্তাও বড় বেশি চাছাছোলা। আসলে একমাত্র জিনাই সহ্য করতে পারে তোমাকে, তুমিও পারো। দুজনেরই স্বভাব এক তো…

হাত নাড়ল কিশোর। বাদ দা ও মেয়েদের আলোচনা। আসল কথায় আসি…আমাদের কেস…

পরদিন শনিবার। সৈকতে সাঁতার কাটতে গেল তিন গোয়েন্দা। নভেম্বর সাঁতারের মাস নয়। কেবল মুসার মত পানি-পাগল কিছু মানুষ ছাড়া সাগরে যেতে চায় না। আবহাওয়াটা সেদিন ভাল বলে কিশোর আর রবিনকে রাজি করাতে পেরেছে সে। কিন্তু সৈকতে এসে মত পরিবর্তন করল দুজনে। শেষে একাই গিয়ে। পানিতে নামতে হলো মুসাকে। খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে ভাল না লাগায় উঠে এল। ইয়ার্ডে ফিরে চলল ওরা।

পরদিন শনিবার। হেডকোয়ার্টারের বাইরে দুটো পুরানো চেয়ারে বসে কথা বলছে কিশোর আর মুসা। এই সময় রবিনের গাড়িটা ঢুকতে দেখা গেল।

গাড়ি থেকে নামল রবিন আর চায়না।

এই সেরেছে রে! বলে উঠল মুসা, একেবারে বান্ধবীকে নিয়েই হাজির!

বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকাল কিশোর। কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল রবিন আর, চায়নার দিকে।

এগিয়ে এল রবিন। বুঝলে কিশোর, খুব ভাল গাইতে পারে চায়না। গত রাতে পার্টি ও একাই মাত করে রেখেছিল।

 তাই নাকি? খুব ভাল, দায়সারা জবাব দিয়ে চুপ হয়ে গেল কিশোর।

আরও একটা ভাল ব্যাপার আছে, হেসে বলল রবিন। কিশোরের চুপ হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে। পটার বোনহেডের ব্যাপারে আর আগ্রহ আছে?

ঝট করে মুখ তুলল কিশোর। কেন? কিছু জেনেছ নাকি?

 চায়নার দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, তুমিই বলো?

বোনহেডের সমস্ত বই আমি পড়েছি। একটা চেয়ারে বসল চায়না। ঝুঁকি দিয়ে মুখ থেকে চুল সরাল। একটা মেটাফিজিক্যাল মিনিকিউব। তবে এই বয়েসেও বাদিং সুটে ভালই লাগে ওকে।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝকাল রবিন। দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে চায়নাদের বাড়ির সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে নেমেছিল বোনহেড।

পুরো সতর্ক হয়ে গেছে কিশোর।

প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা, কিন্তু ও তো সাঁতার জানে না!

সেটা কি আর মানতে চায়, রবিন বলল। মনের খোলা অংশ না কি ঘোড়ার ডিম নিয়ে লম্বা এক লেকচার ঝেড়ে দিল। ছয় জন লোক গিয়ে তুলে এনেছে তাকে, নইলে ডুবেই মরত। ওস্তাদ শোম্যান বলতে হবে। একজন বৃদ্ধার দিকে তার নজর, মহিলা সাংঘাতিক ধনী। আরও কি করেছে, শোনো। দাঁড়াও, দেখাই, একটা ছোট নুড়ি কুড়িয়ে আনল রবিন। একটা স্ফটিককে এরকম করে হাতের তালুতে রেখে বিড়বিড় করে কি পড়ল। তারপর মহিলার কপালে ছোঁয়াল, এমনি করে, বলে চায়নার কপালে পাথরটা ছুঁইয়ে দেখিয়ে দিল কি ভাবে চুঁইয়েছে। বোনহেড। ভারি গলায় বলতে লাগল, লোকটার স্বর নকল করে বলার চেষ্টা করল রবিন, মিসেস অ্যাণ্ডারসন, আপনার সঙ্গে আগে কখনও দেখা হয়নি আমার। অথচ আমি অনুভব করছি, আমাদের পথ দুদিক থেকে এসে এক জায়গায় মিলিত হতে যাচ্ছে।

আর চুপ থাকতে পারল না চায়না। মিসেস অ্যাণ্ডারসনের অনুকরণে বলল, কি যে বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার বাড়ির দেয়ালে, বোনহেডকে অনুকরণ করল। রবিন, শুগলের আঁকা একটা ছবি ঝুলছে। কাঠের ফ্রেম। ডান দিকে নিচের কোণটা ভাঙা। পড়ে গিয়েছিল হয়তো।

ঠিক, ঠিক বলেছেন! আপনি জানলেন কি করে? চায়না বলল।

ওর কপালে নুড়িটা আলতো করে চুঁইয়ে চোখ মুদল রবিন। আরও অনেক কিছুই জানি আমি। একটা অ্যানটিক সিরামিক বাউলে একটা বেড়াল ছানা ঘুমিয়ে আছে!

আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! চিৎকার করে উঠল চায়না, দক্ষিণাঞ্চলীয় টানে। অবশ্যই টানটা মিসেস অ্যাণ্ডারসনের।

আবার চায়নার কপালে পাথর ছোঁয়াল রবিন। উইলো গাছটাও দারুণ। বাড়ির ওপর ছায়া ফেলেছে এমন করে, মনে হচ্ছে একটা বেড়ালের ছায়া।

উইলো গাছ? বেড়ালের ছায়া? চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। নিক!

তার দিকে তাকাল না রবিন। অভিনয় চালিয়ে গেল। চায়নার দিকে মাথা সামান্য নুইয়ে বাউ করে বলল, আশা করি ঠিক ঠিক বলতে পেরেছি সব।

তাহলে এই ব্যাপার, মাথা দুলিয়ে বলল কিশোর। সে রাতে মিসেস অ্যাণ্ডারসনের বাড়িতেই গিয়েছিল নিক, তথ্য জোগাড় করতে, চায়নাদের পার্টিতে মহিলাকে তাজ্জব করে দেয়ার জন্যে।

করতে পেরেছে, রবিন বলল। গেঁথে ফেলেছে মহিলাকে। পরামর্শ দাতা হিসেবে বোনহেডকে বহাল করতে রাজি হয়ে যাবে মিসেস অ্যাণ্ডারসন। বললেই মোটা অংকের চেক লিখে দেবে।

শয়তান লোক! ঠগবাজ!

ডিলনের বাড়িতে না গিয়েও এভাবেই ভাস্কর্যটার কথা জেনেছে বোনহেড, মুসা বলল।  নিশ্চয় ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল নিক।

আমিও তখনই বুঝতে পেরেছি, ঠকাচ্ছে, রবিন বলল। মুখের ওপর বলার সাহস হয়নি। গায়ের জোরে পারতাম না। কারাত-ফারাত কিছু খাটত না ওর সঙ্গে, পিষে ফেলত আমাকে।

 আমি হলাম একটা গাধা! জোরে জোরে কপালে চাপড় মারল মুসা। রামছাগল! নইলে ভুললাম কি করে!

কি ভুলেছ?

বলেছি না, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা, বোনহেডকে আগেও কোথাও দেখেছি, শুটিং স্পটে দেখার আগে। ও হল টমি দা টু-টন টিটান! অনেক বছর আগে টিভিতে দেখতাম ওকে, রেসলার ছিল। রিঙে উঠত দুটো কাল ধাতুর টুকরো নিয়ে। গুল মারত একেকটা টুকরো একেক টন। সে জন্যেই নাম হয়েছে টু-টন। আরও চাপাবাজি করত। বুকে চাপড় মেরে বলত, আমি হলাম পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী রেসলার।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে কিশোর। রবিন আমার বিশ্বাস, মুসা কাল রাতে ভজঘট করে দেয়ার পর আর ফোন ধরবে না ডিলন। তার সঙ্গে। যোগাযোগ করতে হলে তখন অলিংগারকে বেরোতেই হবে। যেখানে লুকিয়ে আছে ডিলন। আমরা তখন তার পিছু নেব।

Super User