০৪.

ঘরে পিনপতন নীরবতা। হাতের কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন অলিংগার হাত দিয়ে ডলে সমান করতে লাগলেন অস্বস্তিভরে। ঘরের কারও মুখে কথা নেই।

কি লিখেছে? অবশেষে জিজ্ঞেস করল একজন।

টাকা চায়, জবাব দিলেন অলিংগার। অনেক টাকা। নইলে খুন করল বেচারা ডিলনকে।

কত টাকা? জানতে চাইলেন রিডার।

বলেনি। নিজেরাই দেখ। কাছে বসেছেন লেখক। উঠে নোটটা তার দিকে ঠেলে দিলেন প্রযোজক। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল ওটা। সব শেষে এল রিডারের হাতে। তিনি সেটা পড়ে মুসাকে না দেখিয়েই আবার ফিরিয়ে দিলেন অলিংগারকে। ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিলেন প্রযোজক।

ডিলন কিডন্যাপ হয়েছে! কথাটা ভীষণ চমকে দিয়েছে মুসাকে। যদিও এরকমই একটা কিছু ঘটেছে ভেবে খুঁতখুঁত করছিল তার মন। কি লিখেছে। নোটটাতে…

খাম থেকে একটা ফটোগ্রাফ টেনে বের করলেন অলিংগার। সর্বনাশ!

সবাই উঠে হুড়াহুড়ি করে ছুটে গেল দেখার জন্যে। মুসা এক পলকের বেশি। দেখতে পারল না, ছবিটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন প্রযোজক।

ফোনের দিকে হাত বাড়াল কালো চুল মহিলা, পুলিশকে ফোন করা দরকার।

ওর হাত চেপে ধরলেন অলিংগার। না না! পুলিশকে জানালে খুন করে। ফেলবে ওকে! ওগুলো মানুষ নয়, জানোয়ার। নিশ্চয় রসিকতা করেনি!

রসিকতা যে করেনি তাতে মুসারও সন্দেহ নেই।

মিস্টার অলিংগার, বলল সে, আমরা কি কিছু করতে পারি? এসব কাজ…

না! মানা করে দিলেন প্রযোজক, পুলিশও দরকার নেই, গোয়েন্দাও না!

বুঝতে পারছেন কি বলছেন? রিডার বললেন।

 পারছি। এক গাদা টাকা যাবে আরকি আমার!

তা তো যাবেই। আমি বলছি ছবিটার কথা। সব কাজ বন্ধ করে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে এখন আমাদের। শ্রমিকদের জানাতে হবে। আমি পারব না! মাথায় বাড়ি মারতে আসবে ওরা! কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকছে এটা জানান প্রযোজকের দায়িত্ব।

ক্লান্ত দৃষ্টি রিডারের ওপর স্থির হয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর মাথা। ঝাঁকালেন অলিংগার। ঠিক আছে, দায়িত্ব যখন, জানাব। চলো, সেটে যাই।

ডেস্কটার দিকে তাকাল মুসা, যেটাতে নোট আর ছবি রাখা হয়েছে।

প্রথমে এগোলেন অলিংগার, পেছনে রিডার, এবং তার পেছনে অন্যেরা। মুসা ইচ্ছে করে রয়ে গেল পেছনে। সবাই বেরোলেও সে বেরোল না। দরজা লাগিয়ে কয়েক লাফে চলে এল ডেস্কের কাছে। ড্রয়ার খুলে নোটটা বের করল।

খবরের কাগজের অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে লিখেছেঃ আমরা বেন ডিলনকে নিয়ে গেছি। ফেরত চাইলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। পুলিশকে জানালে তাকে আর জ্যান্ত দেখার আশা নেই। পরবর্তী নির্দেশ আসছে।

ছবিটা দেখল মুসা। ধাতব একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসিয়ে তোলা হয়েছে। হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে বাধা হয়েছে। মুখে চওড়া সাদা টেপ লাগান। পা বাঁধা হয়েছে গোড়ালির কাছে। ডিলনের বিখ্যাত নীল চোখজোড়ায় আতংক, যেন সামনে মূর্তিমান মৃত্যু দাঁড়ানো।

দেরি করল না মুসা। নোট আর ছবিটা পকেটে নিয়ে রওনা হলো হলের দিকে, সেখানে ফটোকপি মেশিন আছে, আসার সময় লক্ষ্য করেছিল। কপি করে রাখবে দুটোরই।

নোট এবং ছবিটার কয়েকটা করে কপি করে অলিংগারের অফিসে ফিরে এল আবার। সেক্রেটারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কৈফিয়ত দিল, একটা জিনিস ফেলে এসেছি। মেয়েটা বিশ্বাস করল, মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে যেতে দিল, নিজে সঙ্গে এল না। আগের জায়গায় জিনিসগুলো রেখে দিল মুসা।

এবার কি? শুধুই রহস্য নয় আর এখন, অপহরণ কেস, একজনের জীবন মরণ সমস্যা। কাজটা একা করার যতই আগ্রহ থাকুক, ঝুঁকি নেয়াটা আর ঠিক হবে না কোনমতেই। একটাই করণীয় আছে এখন, এবং সেটাই করল সে। রিসিভার তুলে ডায়াল করল।

কিশোর? মুসা। কোথাও যেও না। থাক। জরুরী কথা আছে। আমি আসছি। রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে না রাখতেই দরজা খুলে গেল।

মুসার দিকে তাকিয়ে রয়েছে অলিংগারের সেক্রেটারি। চোখে সন্দেহ। কি করছ?

জরুরী একটা ফোন। সরি। পকেট থেকে জাগুয়ারের চাবির গোছাটা বের করে ডেস্কে রাখা একটা বাক্সে ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোল মুসা। সেক্রেটারির দিকে তাকাল না আর।

গাড়ি নেই। সিনেমার একজন কর্মীর গাড়িতে লিফট নিয়ে রকি বীচে এল সে। বাড়িতে পৌঁছে নিজের গাড়িটা বের করে নিয়ে চলে এল ইয়ার্ডে। গাড়ি থেকে নেমে ওঅর্কশপের দিকে ছুটল। দরজায় হাত দেয়ার আগেই কিশোরের কণ্ঠ শোনা গেল, মুসা, সবুজ টি-শার্ট, নীল জিনস, আর বাস্কেটবল শু পরেছ।

কি করে জানলে?

ট্রেলারের দরজা খুলে দিয়ে রবিন বলল, ওপরে দেখো।

ছাতে বসান হয়েছে একটা ভিডিও ক্যামেরা। পুরানো টেলিস্কোপ সর্বদর্শনটা যেখানে ছিল সেখানে। এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশের সব কিছু দেখে চলেছে। ক্যামেরার চোখ। এটা কিশোরের নতুন সিকিউরিটি সিসটেম। এটার নামও সর্বদর্শনই রাখা হয়েছে। পুরানো পদ্ধতি সরে গিয়ে নতুনকে ঠাই করে দিয়েছে জিনিসটা, কিশোরের সামনে ডেস্কে রাখা আছে মনিটর।

খুব ভাল করেছ, হেডকোয়ার্টারে ঢুকে বলল মুসা। শোন, যে জন্যে থাকতে বলেছিলাম। খবর আছে। বেন ডিলন কিডন্যাপ হয়েছে তার মালিবু বীচের বাড়ি থেকে। একটু আগে সাফোকেশন টু ছবির পরিচালক অলিংগারের সঙ্গে মিটিঙে বসেছিলাম। তখনই এল র‍্যানসম নোট।

সময় নষ্ট না করে ভাল করেছু, কিশোর বলল। খুলে বলো।

রভিন মনিটরটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে ডেস্কের ওপরই উঠে বসল মুসা। জিনসে হাত ডলছে, অস্বস্তিতে। ইয়ে…সব কথা তোমাদের ভাল লাগবে না। রেগে যাবে আমার ওপর। আসলে, সময় অনেকই নষ্ট করেছি। কারণ…

আরে দূর! অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন, অত ভণিতা করছ কেন? বলে ফেলো না।

ডিলন সম্ভবত তিন দিন আগে কিডন্যাপ হয়েছে।

তিন দিন আগে হয়েছে, কিশোর বলল, আর তুমি জেনেছ খানিক আগে?

ঠিক তা নয়। আমি তিন দিন আগেই সন্দেহ করেছি, মুসা বলল। দেখল, কিশোরের ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আস্তে আস্তে গোল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদেরকে জানাবই না। একা একাই কেসটার সমাধান করে তাক, লাগিয়ে দেব। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে আমার।

ঠোঁট দিয়ে ফুট ফুট শব্দ করল কিশোর। শ্রাগ করে বলল, তাতে আমি মাইণ্ড করিনি। বরং আগেই কিছু তদন্ত সেরে ফেলে ভাল করেছ।

মুখ তুলে তাকাতে পারল না মুসা। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মাইণ্ড করবে, এখুনি। আমি ব্রাউন অলিংগারকে বলেছি তিন গোয়েন্দার হেড হলাম আমি। আর তোমরা দুজন আমার সহকারী। তোমাদেরকে ডাকব কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম।

হো হো করে হেসে উঠল রবিন। নতুন কার্ডে গোয়েন্দা প্রধান কে লেখা নেই। বলেই সুযোগটা নিতে পেরেছ।

শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর, র‍্যানসম নোটটা দেখেছ?

কপি করেই নিয়ে এসেছি। পকেট থেকে নোট আর ছবির কপি বের করে দিল মুসা।

ছবিটা দেখে আফসোস করে বলল রবিন, আহারে, বেচারার বড়ই কষ্ট।

ডিলনের কষ্টের কথা বলছ? কিশোর বলল, অযথা দুঃখ পাচ্ছ। ভাল করে দেখ, বুঝতে পারবে। যতটা সম্ভব খারাপ অবস্থা দেখানর ইচ্ছেতেই এরকম ভঙ্গিতে রেখে ভোলা হয়েছে এই ছবি। হাতটা কতটা পেছনে নিয়ে গেছে দেখ। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বেহুশ হয়ে যেতে বাধ্য। ওকাজ কিছুতেই করতে যাবে না কিডন্যাপাররা। যদি সত্যিই ডিলন ওদের কাছে দামি হয়ে থাকে।

আরেকটা ইনটারেসটিং ব্যাপার, নোটটা দেখতে দেখতে রবিন বলল, খবরের কাগজ থেকেই কাটা হয়েছে অক্ষরগুলো, তবে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস কিংবা হেরাল্ড এক্সামিনার থেকে নয়। অন্য কোন কাগজ। অক্ষর দেখলেই আন্দাজ করা যায়।

তোমার ধারণা, মুসা জিজ্ঞেস করল, লস অ্যাঞ্জেলেসের বাইরে কোথাও থেকে পাঠানো হয়েছে নোটটা?

সূত্র তো তাই বলে, জবাব দিল কিশোর।

এক এক করে রবিন আর কিশোরের দিকে তাকাতে লাগল মুসা। স্বীকার করল, আসলেই আমি গোয়েন্দাপ্রধান হওয়ার অনুপযুক্ত। বার বার দেখেছি। এগুলো, অথচ কিছুই বুঝতে পারিনি।

পারতে, কিশোর বলল, তুমিও পারতে, মাথা ঠাণ্ডা করে দেখলে। যাকগে। আর কিছু?

অদ্ভুত আরও কতগুলো ঘটনা ঘটেছে। শুটিং স্পটে যাওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল মুসা। প্রথম সাফোকেশন ছবির শুটিঙের সময় যেসব গোলমাল হয়েছে শুনেছে, সেসবও বাদ দিল না। সব শেষে বলল পটার বোনহেডের দেয়া স্ফটিকটার কথা। বলল, আমাকে সাবধান করে দিয়েছে সে। তৃতীয় নয়নের মাধ্যমে নাকি দেখতে পেয়েছে আমার বিপদ। বলেছে, স্ফটিকের নির্দেশ আমার শোনা উচিত।

শোনা শুরু করলেই বরং বিপদে পড়বে, কিশোর বলল, মানসিক ভারসাম্য হারাবে।

কথা বলতে বলতে কখন যে রাত হয়ে গেল টেরই পেল না ওরা। আচমকা বলে উঠল মুসা, আমার খুব খিদে পেয়েছে।

ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এসে ওর ভেগাতে উঠল তিনজনে। অন্ধকার রাত। এতক্ষণ ভূত-প্রেত, ডাইনী নিয়ে আলোচনা করে এখন সর্বত্রই ওসব দেখতে লাগল। ডাইনী, ভূত, কঙ্কাল….

অ্যাই, ভুলেই গিয়েছিলাম, মুসা বলল, আজকে হ্যালোউইন উৎসব।

 কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াল ওরা। স্কুলের কোন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কিনা দেখল। দেখা গেল অনেককেই, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আছে। নানারকম সাজে সেজেছে ওরা। সাফোকেশন ছবির জোম্বি আর ভয়ঙ্কর ভূতপ্রেতগুলোর কথাই মনে করিয়ে দিল মুসার।

একটা পিজা শ্যাকে ঢুকে পিজা খেয়ে নিয়ে আবার বেরোল ওরা। একটা স্টপ। সাইনের কাছে এসে ব্রেক করল মুসা। চালু করে দিল উইণ্ডশীল্ড ওয়াইপার। এপাশ ওপাশ নড়তে লাগল ওয়াইপার আর কাঁচে লাগতে শুরু করল ঘন রক্ত।

এটা কি? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

অবিশ্বাস্য! রবিন বলল, ওই জাগুয়ারটার মত তোমার গাড়িতেও এই কাণ্ড করেছ?

হাসল মুসা। গাড়িটা ঘুরিয়ে কাচটা এমন ভঙ্গিতে রাখল, যাতে রাস্তায় চলমান। গাড়ির আলো এসে পড়ে আর চালকদের চোখে পড়ে সেই রক্ত। চমকে যেতে লাগল লোকে।

বহু মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়ে একসময় হেডকোয়ার্টারে ফিরে এল ওরা।

দেখো দেখো! চিৎকার করে বলল রবিন, ট্রেলারের দরজার অবস্থা!

শুধু দরজাই না, সতর্ক হয়ে উঠেছে কিশোর, জানালাগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে!

তখনই বলেছিলাম, ট্রেলারটাকে জঞ্জালের নিচ থেকে বের করার দরকার নেই,মুসা বলল, এখন হলো তো! ঢুকল কি করে ব্যাটারা?

গেট বন্ধ হওয়ার আগেই হয়ত ঢুকে বসেছিল, অনুমান করল রবিন।

গাড়ি থেকে নেমে ট্রেলারের দিকে দৌড় দিল তিনজনে। ঢুকে পড়ল ভেতরে। মেঝেতে নামিয়ে স্কুপ করে রাখা হয়েছে তিন গোয়েন্দার ফাইলপত্র। ছড়িয়ে রয়েছে কাগজ।

ব্যাটারা এখানে কিছু খুঁজতে এসেছিল! রবিনের কণ্ঠে চাপা রাগ।

মুসার মনে হতে লাগল, দেয়ালটা বুঝি তার দিকে এগিয়ে আসছে। গুঙিয়ে। উঠল সে।

কি হলো, মুসা?

 দম আটকে আসছে আমার! শ্বাস নিতে পারছি না!

দেয়ালে টেপ দিয়ে লাগান রয়েছে মেসেজ। খবরের কাগজের অক্ষর কেটে সেই একই ভাবে লিখেছে, অলিংগারের কাছে যেভাবে নোট পাঠান হয়েছিল। এগিয়ে গেল কিশোর। পড়ে দুই সহকারীর দিকে ফিরে বলল, ডিলনের ব্যাপারেই লিখেছে!

এগিয়ে এল রবিন আর মুসা। ওরাও পড়ল মেসেজটাঃ

বেন ডিলনের রক্তপাতের জন্যে তোমরা দায়ী হবে!

.

০৫.

শ্বাস নিতে পারছি না! গলায় হাত দিয়ে ঢোক গিলতে লাগল মুসা। দম আটকে যাচ্ছে আমার! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

সব তোমার কল্পনা, দ্রুত গিয়ে ট্রেলারের দরজার পাল্লা হাঁ করে খুলে দিল। কিশোর অক্টোবর রাতের তাজা বাতাস ঢোকার জন্যে। আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে বুমম করে ফাটল দুটো বাজি।

এগুলো সাফ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে! গুঙিয়ে উঠে ছড়ানো জিনিসপত্রগুলো দেখাল রবিন।

তা না হয় করলাম, কিশোর বলল। সেটা নিয়ে ভাবি না। ভাবছি আমাদের সমস্ত গোপন ফাইল দেখে গেল ব্যাটারা!

আসলে, রবিন বলল, এই হেডকোয়ার্টারে আর চলবে না আমাদের। বহু বছর তো কাটালাম পুরানো জায়গায়। এভাবে আর চলবে না। নতুন জয়িগায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতি বসাতে হবে আমাদের, চোর-ডাকাত ঠেকানর ব্যবস্থা। রাখতে হবে…

 হাঁসফাস করতে করতে মুসা বলল, কিছুই করতে হত না! ট্রেলারটা যেমন লুকান ছিল তেমনি থাকলেই ভাল হত! এত বছর তো আরামেই ছিলাম,

ছিলাম, রবিন বলল, আমাদের বয়েস কম ছিল, সেটা একটা কারণ। তেমন। মাথা ঘামাত না কেউ। ভাবত, ছেলেমানুষের খেয়াল। এখন আর আমাদেরকে দেখলে সেটা মনে করে না কেউ। সিরিয়াসলি নেয়। বড় হওয়ার এই এক যন্ত্রণা…

ব্যাটারা জানল কি করে এই কেসে কাজ করছি আমরা?

চুপ করে ভাবছে কিশোর। জবাব দিল, নিশ্চয় কিডন্যাপাররা ছবিটার সঙ্গে জড়িত সবার ওপর নজর রেখেছে। তুমিও বাদ যাওনি।

পুরানো একটা ধাতব ফাইল কেবিনেট তুলে সোজা করে রাখতে কিশোরকে সাহায্য করল মুসা। বিশ্বাস করতে পারছি না! র‍্যানসম নোটটা আজকেই এল। ভাবতেই পারিনি, আমাকেও ফলো করতে আরম্ভ করবে।

ঘরটাকে আগে গুছিয়ে ফেলি, কিশোর বলল। তারপর ভালমত আলোচনা করতে বসব কার চোখ পড়ল আমাদের ওপর।

শুধু আলোচনায় তো কাজ হবে না, রবিন বলল, ওদেরকে বের করতে হবে। কি করে করবে?

পরে ভাবব। এখন জরুরী, ভিডিও সিকিউরিটি সিসটেমটা দেখা।

 ঠিক! তুড়ি বাজাল মুসা। ক্যামেরা! লোকগুলোর ছবি নিশ্চয় উঠে গেছে ভিডিও টেপে!

তাহলে তো কাজই হবে, রবিন বলল। কিন্তু টেপ কি অতটা লম্বা ছিল? ওরা যখন এসেছে তখনও রেকর্ড করছিল?

দেখাই যাক না। টেপ রিউইণ্ড করার বোতাম টিপে দিল কিশোর। দুই সহকারীকে জানাল, সারাক্ষণ চলার মত করে সিসটেমটা তৈরি করিনি। ওই পদ্ধতি ভাল না। অন্য ব্যবস্থা করেছি। বাইরে একটা ইলেকট্রিক আই লাগিয়েছি। হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি কেউ এলে চোখে পড়ে যাবে যন্ত্রটার, চালু হয়ে যাবে ভিডিও রেকর্ডার। লোকটা চলে গেলেই অফ হয়ে যাবে ক্যামকর্ডার। আবার কেউ এলে আবার চালু হয়ে যাবে..

প্লে বাটন টিপে দিল কিশোর। মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন জোড়া চোখ। ছবি ফুটতেই আরও ভাল করে দেখার জন্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এল ওরা। ছবি দেখে ছিটকে পেছনে সরে গেল আবার।

লম্বা, পাতলা একটা মূর্তি ঝিলমিল করতে করতে বেরিয়ে এল অন্ধকার থেকে, ভরে দিল পর্দা। ট্রেলারের দিকে এগিয়ে আসছে যেন ভেসে ভেসে, হেঁটে নয়। লম্বা কালো আলখেল্লার কোণ ধরে টানছে বাতাস, বাদুড়ের ডানার মত ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

পঅজ বাটনটা টিপে দিল কিশোর। স্থির হয়ে গেল মূর্তি। ভয়াবহ মুখটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল সে।

মুখের রঙ ফসফরাসের মত সবুজ, তেমন করেই জ্বলে। লাল চোখ। গলার কাছে কালো গর্ত। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যেন অস্থির, দেহের ভেতরের সমস্ত যন্ত্রপাতি বেরিয়ে আসতে চাইছে, সেই ব্যথারই ছাপ পড়েছে মুখে।

খাইছে! নিচু গলায় বলল মুসা। জোরে বলার সাহস হারিয়েছে।

পঅজ রিলিজ করে দিল কিশোর। পেছনে, আশেপাশে তাকাতে লাগল মূর্তিটা। কয়েকবার করে তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হল তাকে কেউ লক্ষ করছে না, তখন একটা পা তুলে জোরে এক লাথি মারল ট্রেলারের দরজায়। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল লোকটা। ক্যামেরার চোখ থেকে সরে যাওয়ায় দেখা গেল না তাকে। কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে আলখেল্লার কোণ উড়িয়ে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

লোকটা কে? রবিনের প্রশ্ন।

মানুষ তো? মুসার প্রশ্ন।

কয়েকবার করে টেপটা চালিয়ে দেখল ওরা। প্রতিবারেই নতুন কিছু না কিছু চোখে পড়ল।

ব্যাটার শ্বদন্ত আছে, রবিন বলল।

 ডান হাতের আঙুলে একটা আঙটি, বলল কিশোর। বড় একটা পাথর বসান।

অদ্ভুত মূর্তিটার সব কিছুই যখন দেখা হয়ে গেল, আর কিছুই বাকি রইল না, যন্ত্রটা অফ করে দিল কিলোর।

চালাকিটা ভালই করেছে, মুসা মন্তব্য করল। হ্যালোউইনের রাতে ভ্যাম্পায়ারের সাজ সেজে এসেছে, কেউই লক্ষ্য করবে না ব্যাপারটা। আজকের রাতে ওরকম ছদ্মবেশ পরে খুন করেও পার পাওয়া যাবে, ধরা পড়তে হবে না।

 এবার একটা প্ল্যান করা দরকার, কিশোর বলল। মুসা, কাল আমাদেরকে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে তুমি। লোকের সঙ্গে কথা বলে দেখব, ডিলনকে কে বেশি চেনে। শেষ কে দেখেছিল, জানব। বোঝার চেষ্টা করব, কার কার নাম সন্দেহের তালিকায় ফেলতে হবে।

পরদিন স্কুল শেষ করে স্টুডিওতে গিয়ে প্রথম যে মানুষটার সামনে পড়ল তিন গোয়েন্দা, তিনি মুসার বাবা রাফাত আমান। ভয়ঙ্কর একটা মুখোশ পরে স্টুডিও লট ধরে হেঁটে চলেছেন।

তোমরা? একেবারে সময়মত এসেছ, আমান বললেন। আমার ইফেক্টগুলো কেমন আসবে, দেখতে যাচ্ছি। দেখার ইচ্ছে আছে? ডেইলি।

না বলার কোনই কারণ নেই। আমানের পিছু পিছু একটা প্রাইভেট স্ক্রিনিং রুমের দিকে চলল ওরা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ডেইলিটা কি? দৈনিক কোন ব্যাপার না তো?

তা-ই। শুটিং করা প্রতিদিনকার অংশকে ডেইলি বলে ফিল্মের লোকেরা, বাবার হয়ে জবাবটা দিল মুসা। দিয়ে গর্বিত হলো, রবিনের চেয়ে এ ব্যাপারে বেশি জানে বলে। এডিট করা হয় না তখনও, প্রচুর ভুলভাল থেকে যায়।

স্ক্রিনিং রুমটাকে খুদে একটা সিনেমা হলই বলা চলে। ছয় সারি সীট। লাল মখমলে মোড়া গদি। সামনের সারির প্রতিটি সীটের ডান হাতলে রয়েছে। ইনটারকমের বোতাম। ওখানকার একটা সীটে বসে বোম টিপে দিলেন আমান। প্রেজেকশনিস্টকে ছবি চালাতে বললেন।

হলের আলো কমিয়ে দিয়ে ছবি চালানো হলো।

আগের হপ্তায় ভোলা স্পেশাল ইফেক্টের ছবিগুলো দেখতে লাগল তিন গোয়েন্দা। প্রতিটি দৃশ্যেই জ্যাক রিডারের ছাপ স্পষ্ট, ভয়ঙ্কর বীভৎস করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

একটা দৃশ্যে একটা বাচ্চা ছেলে বার বার হেঁচকি তুলছে।

কি করে সারাতে হয় জানি আমি, বলল বাচ্চাটার মা, স্বাভাবিক মানুষ নেই। আর, জোম্বি হয়ে গেছে। ভয় দেখাতে হবে। আর কোন উপায় নেই।

বলেই একটানে বাচ্চাটার একটা হাত ছিঁড়ে ফেলল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। কাঁধের কাছের ছেঁড়া জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

দেখলে তো? হেঁচকি বন্ধ।

কাট! শোনা গেল রিডারের কণ্ঠ, ক্যামেরার চোখের বাইরে থেকে। আর কবে শিখবে? কিছুই তো বলতে পারো না।

আরেকটা দৃশ্যে নাকে রুমাল চেপে হাঁচি দিল একটা লোক। তারপর আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল রুমালের দিকে, হাচির চোটে তার নিজের মগজই নাক দিয়ে বেরিয়ে এসে রুমালে লেগে গেছে।

রবিনের দিকে কাত হয়ে তার কানে কানে কিশোর বলল, জ্যাক রিডার একটা চরিত্র বটে!

স্যাডিস্ট! ফিসফিসিয়ে জবাব দিল রবিন।

তারপর বেন ডিলনের অভিনীত কয়েকটা দৃশ্য চলল। সে নিজেই জোম্বিতে পরিণত হল, চোখের কোণে কালো দাগ পড়ল। রঙ দিয়ে করা হয়েছে ওগুলো।

বাবা, পর্দায় বলছে ডিলন, তুমি আমাকে হার্ভার্ডে পাঠাতে চাও তো। যেতে ইচ্ছে করে না। আমার ভাল লাগে লোকের গলা কামড়ে ছিঁড়ে মাথা আলাদা করতে।

স্ক্রিপ্ট লিখেছে কে? জোরে জোরেই বলল মুসা, মাথায় খালি কুৎসিত চিন্তা…

চুপ, থামিয়ে দিলেন ওকে আমান। আমার চাকরিটা খাবে নাকি?

নতুন আরেকটা দৃশ্যে দেখা গেল ডিলন আর একজন সুন্দরী অভিনেত্রীকে। মেয়েটা খাট, কোঁকড়া কালো চুল, চোখের পাপড়িও কোকড়া।

অ্যাঞ্জেলা ডোভার না? সামনে ঝুঁকে আমানকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ। এই ছবির সহ-অভিনেত্রী। তবে অনেক দেখান হয় ওকে, শুরুতেই টানা বিশ মিনিট। ডেটিং করে ডিলনের সঙ্গে। এই দৃশ্যে দেখান হবে নিরীহ, গোবেচারা, ভালমানুষ, কিছুটা বোকাও। ভাবতেই পারেনি ওপরতলা থেকে দুটো। মানুষের বাচ্চাকে খেয়ে এসেছে ডিলন।

বিশ্বাস কর, ডানা, ডিলন বলছে, কেমন জানি হয়ে গেছি আমি। অদ্ভুত অনুভূতি। দম নিতে কষ্ট হয়। মনে হয়, কবরে শুয়ে আছি, বেলচা দিয়ে মাটি ছিটান হচ্ছে আমার ওপর, ঢেকে দেয়ার জন্যে। মনে হয়, একের পর এক মানুষ খুন করি।

বেন, ডিলনের বাহুতে থেকে বলল ডানা, ওসব কিছু না। শুধুই কল্পনা। একটা মাছি মারারও ক্ষমতা নেই তোমার।

কাট! চেঁচিয়ে উঠলেন রিডার, অ্যাঞ্জেলা, ওকে বেন বলছ কেন?

 শিওর, এ ছবি থ্যাঙ্কসগিভিডের দিনে মুক্তি দেয়া হবে, রবিন বলল।

 কেন? মুসার প্রশ্ন।

তখন খেতে ব্যস্ত থাকবে সবাই। এই ঘোড়ার ডিমের দিকে নজর থাকবে না। এ একটা দেখার জিনিস হলো!

হাসতে শুরু করল কিশোর আর মুসা।

এতই খারাপ? জিজ্ঞেস করলেন আমান।

রবিন আর মুসা চুপ করে রইল। ভাবছে, জবাবটা কিশোরই দিক। কিশোরের বুদ্ধি বেশি, সিনেমার ব্যাপারে জ্ঞান বেশি, ঠিক জবাব সে-ই দিতে পারবে।

স্ক্রিপ্টের কোন হাতমাথা নেই, ডিরেক্টরের হয়ে আছে মাথা গরম, কিশোর বলল। রিডারের মত কম দামি পরিচালক বেশি বাজেটের ছবিতে হাত দিতে গেলে হবেই এরকম। মাথা গরম হয়ে গেছে লোকটার। মণ্ডে এসোই এখনও মাথা– থেকে নামেনি। ওই একই কাণ্ড করছে। আঙ্কেল, আপনি সত্যি কথাটা শুনতে চাইলেন, তাই বললাম।

ভাবনায় ফেলে দিলে আমাকে তুমি, কিশোর, আমান বললেন। কিশোর বুঝল, ভাবনায় তিনি আগেই পড়েছেন, তার সঙ্গে আলোচনা করে নিজের ধারণাগুলো মিলিয়ে দেখলেন আরকি।

সবগুলো ডেইলি দেখার পর উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। বাইরে গিয়ে লোকের সঙ্গে আলাপ করে ডিলন অপহরণ কেসের সূত্র খোঁজার ইচ্ছে। আটকালেন ওদেরকে আমান।

আজ সকালে ব্রাউন অলিংগার ফোন করেছিলেন, বললেন তিনি। তিনি ভয়। পাচ্ছেন, তোমরা তদন্ত করতে গিয়ে ডিলনের বিপদ বাড়িয়ে দেবে।

বাবা…

জানি, তোমরা খুব ভাল গোয়েন্দা, আমান বললেন বাধা দিয়ে, আমার চেয়ে তো আর বেশি জানে না কেউ। কিন্তু অলিংগার কিডন্যাপারদের নির্দেশ মেনে চলতে চান। তিনি বলেছেন টাকা গেলে তার যাবে, বাইরের কেউ, মানে তোমরা যাতে এতে নাক না গলাও। তোমাদেরকে চলে যেতে বলছি আমি। সরি।

কোন প্রতিবাদেই আর কাজ হবে না। রাজি করাতে পারবে না ওরা রাফাত আমানকে। অলিংগারের ওপরই রাগ হতে লাগল ওদের। গটমট করে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে রওনা হল মুসার গাড়িতে করে। সমস্ত লস অ্যাঞ্জেলেসে লাল আলো লেপ্টে দিয়েছে যেন অস্তমিত সূর্য। অন্ধকারের দেরি নেই।

ড্রাইভিং হুইলে বসেছে মুসা, রবিন তার পাশে, হাতে রেডিও, আর পেছনের সিটে বসে বকবক করে বলে যাচ্ছে কিশোর, জ্যাক রিডার কি কি ভুল করেছেন।

হঠাৎ করেই বলল, অ্যাঞ্জেলা ডোভারের সঙ্গে ডিলনের অভিনয় তাকে জেলাস করে তুলেছে।

নাকি তুমিই জেলাস হয়ে গেছ? রসিকতা করল রবিন, সেজন্যেই রিডারকে দোষ দিচ্ছ।

রবিনের কথা কানে তুলল না কিশোর। মেয়েটার চোখে ভয়াবহ আলো ফেলে শুটিঙের ব্যবস্থা করেছেন পরিচালক, ভুল অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা হয়েছে।

একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি রাখল মুসা। রেডিওর ডায়াল ঘোরাচ্ছিল। রবিন, জিজ্ঞেস করল, কি হলো?

খিদে পেয়েছে, বলল মুসা। চলো, কিছু খাই।

রবিন বলল, আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। মা বাইরে যাবে। চলো, বাড়ি গিয়েই খাব।

আধ ঘণ্টা পর রবিনদের বাড়িতে এসে রান্নাঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। প্রচুর খাবার রয়েছে টেবিলে। সেগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা।

পেট কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এলে পকেট থেকে র‍্যানসম নোটের কপিটা বের করে টেবিলে রাখল কিশোর।

সেটা দেখে রবিন বলল, কি মনে হয় তোমার? পরবর্তী নির্দেশ কি পাঠিয়েছে মিস্টার অলিংগারের কাছে?

ঠিক এই সময় রান্নাঘরে ঢুকলেন রবিনের বাবা। ওদেরকে দেখে হাত নেড়ে বললেন, খাও তোমরা। আমি শুধু কফি খাব। কাপ নিতে গিয়ে নোটটার ওপর। চোখ পড়ল তাঁর। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি?

একটা কেসের তদন্ত করছি আমরা, বাবা, রবিন বলল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে নোটটা দেখতে লাগলেন মিলফোর্ড। হঠাৎ বললেন, রবিন, ডেইলি ভ্যারাইটি থেকে কাটা হয়েছে অক্ষরগুলো, বুঝতে পেরেছ?

আপনি শিওর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নিশ্চয়ই।

কফি শেষ করে উঠে চলে গেলেন মিলফোর্ড।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করেছে কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে।

শান্ত কণ্ঠে আনমনেই বলতে লাগল একসময়, এর মানে জান তো? বেন। ডিলনকে যে কিডন্যাপ করেছে সে ফিল্মের সঙ্গে জড়িত। সাফোকেশন টু-র। কর্মচারী হলেও অবাক হব না।

.

০৬.

পুরো একটা মিনিট চুপ হয়ে রইল তিনজনেই। তাকিয়ে রয়েছে র‍্যানসম নোটটার দিকে। যেন ওটাতেই রয়েছে সমস্ত রহস্যের জবাব।

কিশোরের কথার প্রতিধ্বনি করেই যেন অবশেষে রবিন বলল, কর্মীদের কেউ বেন ডিলনকে কিডন্যাপ করেছে?

কিংবা কোন অভিনেতা, বলল কিশোর। সিনেমার লোক, এ ব্যাপারে আমি শিওর। সাধারণ চোরডাকাতে ভ্যারাইটি পড়ে না। বেশি পড়ে সিনেমার লোকে। তাদের কাছে ওটা বাইবেল। খুব জরুরী সূত্র এটা। বড় একটা ধাপ এগোলাম। T_ তার মানে, মুসা বলল, এমন একজন লোক দরকার, যার ওপর সন্দেহ হয়, যার মোটিভ আছে। আর দরকার জানা, কোথায় আটকে রাখা হয়েছে ডিলনকে।

আস্তে আস্তে, কিশোর বলল, তাড়াহুড়া করলে ভুল হয়ে যাবে। শান্ত হয়ে মাথা খাঁটিয়ে একেকটা প্রশ্নের জবাব বের করতে হবে। তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে। সাফোকেশন টু-র শ্রমিক কর্মী অভিনেতা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। জানতে হবে কে ডিলনের শত্ৰু, কে মিত্র। আমি অ্যাঞ্জেলা ডোভারকে দিয়ে শুরু করতে চাই।

করো। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন, কিন্তু আগে ওকে কেন?

ডিলন নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন তার সঙ্গে অভিনয় করেছে সে। আরও একটা ব্যাপার আছে। মুসার বাবা বললেন ওদের মাঝে মন দেয়ানেয়ার ব্যাপার থাকতে পারে।

পারে?

হ্যাঁ। তিনি শিওর নন।

তোমার জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে, কিশোর, মুসা বলল। অ্যাঞ্জেলা ডোভার বড়ই মুখচোরা স্বভাবের, বাবা একথাও বলেছে। সহজে কথা বলতে চায়। না। ছদ্মবেশে থাকতে পছন্দ করে। এমন ভাবে থাকে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। ফিল্ম স্টারদেরকে লোকে জ্বালাতন করে তো, বেরোতে পারে না। ঠিকমত…

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ছদ্মবেশ, না? ভাবছি, হ্যালোউইনের রাতে কোথায় ছিল সে?

.

পরদিন বিকেলের আগে সময় করতে পারল না মুসা। কমলা ভেগাটা চালিয়ে নিয়ে। এল পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে। হর্ন বাজাতে বাজাতে ডাকল, এই কিশোর! বেরোও! ওকে পেয়েছি!

ইলেকট্রনিক ওঅর্কশপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। কি হয়েছে?

এসো, গাড়িতে ওঠ। এইমাত্র একটা গরম খবর শোনাল বাবা। অ্যানহেইমের বাড়িতে গিয়ে ডুব দিয়েছে অ্যাঞ্জেলা ডোভার, পরের ছবিটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্যে।

অ্যাঞ্জেলা ডোভার? দাঁড়াও, এখনি আসছি! বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল কিশোর। দশ মিনিট পরেই ফিরে এল পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। নতুন জিনসের প্যান্ট, ইস্ত্রি করা অক্সফোর্ড ড্রেস শার্ট। চল। রবিনদের বাড়িতে গিয়েছিলে?

 ও আসতে পারবে না। ট্যালেন্ট এজেন্সিতে জরুরী কাজ আছে, খবর পাঠিয়েছেন বার্টলেট লজ। সেখানে চলে গেছে।

হু! গুঙিয়ে উঠল কিশোর। মাঝে মাঝে মনে হয়, তিন গোয়েন্দা আর নেই আমরা, দুই গোয়েন্দা হয়ে গেছি! ওর এই ট্যালেন্ট এজেন্সির চাকরিটা বাদ দিতে পারলে ভাল হত!

ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। না দিলে নেই। আমরা দুজনেই চালাব। ও তো আজকাল আর তেমন সাহায্য করতে পারে না, আমাদেরকে।

তা ঠিক, কিশোর বলল, সবাইকেই একসময় একলা হয়ে যেতে হয়। সব সময় তো আর সবাই একসঙ্গে থাকতে পারে না। এমনও হতে পারে, অন্য কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তুমিও চলে যাবে। তখন একলা চলতে হবে না আমাকে? গোয়েন্দাগিরি তো ছাড়তে পারব না কোনদিনই। আনমনা হয়ে গেল সে। ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন না, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে… বেসুরো গলায় গুনগুন করে গাইতে লাগল সে।

পুরো একটা ঘন্টা চালানর পর একটা তিনতলা বাড়ির সামনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি ঢোকাল মুসা। একটা রিটায়ারমেন্ট কমপ্লেক্স। সাইনবোর্ড লেখা রয়েছেঃ সিলভান উডস রেস্ট হোম। কিশোর বলল, সব ফাঁকিবাজি, মিথ্যে বিজ্ঞাপন। উডস মানে তো বন, এখানে বন কোথায়? সিলভানই বা কই? ওরকম। বনদেবতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। একটা ফ্রিওয়ে শুধু দেখতে পাচ্ছি।

বন, দেখতে তো আর আসিনি আমরা, মুসা বলল, নায়িকার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। অ্যাঞ্জেলা ডোভারকে পেলেই হলো। তাকিয়ে রয়েছে কিছু লোকের দিকে, সবাই বৃদ্ধ, চুল সাদা হয়ে গেছে। এখানে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা কঠিন হবে ওর জন্যে।

মনে হয়।

খুঁজতে লাগল ওরা। গেম রুম, টিভি রুম, কার্ড রুম, সব জায়গায় উঁকি দিল। হোমের বয়স্ক বাসিন্দারা হয় চেয়ারে বসে খেলছে, কথা বলছে, নয়ত ছড়ি হাতে হাঁটাচলা করছে শরীরটাকে আরও কিছুদিন সচল রাখার অদম্য আকাঙ্ক্ষায়। যতই বুড়ো হোক, মরতে তো আর চায় না কেউ। মহিলারা কেউ সেলাইয়ের কাজ করছে, কেউ বই পড়ছে, দুএকজন গিয়ে ফুল গাছের যত্ন করছে বাগানে। কিশোর আর মুসাকে সবাই দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কথা বলছে না। অন্তত শুরুতে বলতে চাইল না।

তারপর ডাক দিল একজন, এই ছেলেরা, শোনো।

ঘুরে তাকাল দুজনে। বড় একটা পাম গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে আছে এক বৃদ্ধা। ধূসর চুল ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক হ্যাঁটের নিচে। আঙুল বাকা করে ওদেরকে কাছে যেতে ইশারা করছে মহিলা। কোলের ওপর ফেলে রেখেছে হালকা একটা কম্বল, পা ঢেকে রেখেছে।

এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।

বেঞ্চে চাপড় দিয়ে ওদেরকে পাশে বসতে ইশারা করল মহিলা। মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। হাসলে সেগুলো আরও বেশি কুঁচকে গম্ভীর হয়ে যায়। বলল, আমার নাম পলি। কাউকে খুঁজছ মনে হয়?

একজন মহিলাকে খুঁজছি, কিশোর বলল।

আমিও তো মহিলা, হেসে বলল পলি। দ্রুত ওঠানামা করল কয়েকবার চোখের পাতা।

রসিকতায় কিশোরও হাসল। তা তো নিশ্চয়। আরও কম বয়েসী একজনকে খুঁজছি।

অ্যানিটার কথা বলছ না তো? ওর বয়েস কম, আটষট্টি।

আমরা খুঁজছি একজন তরুণীকে, অভিনেত্রী।

সাংবাদিক-টাংবাদিক নাকি তোমরা?

না, আমরা গোয়েন্দা, জবাব দিল মুসা।

 ও, গোয়েন্দা? সাথে হিটার আছে? রড? গ্যাট? পিস্তল-বন্দুকের পুরানো সব নাম ব্যবহার করল মহিলা। চোর-ডাকাতেরা এখনও কেউ কেউ এই নাম বলে, বিশেষ করে রড।

না, আমরা টিভি ডিটেকটিভ নই।

আমরা তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, কিশোর বলল। আমাদের সাহায্য চেয়েছে একজন। তার ব্যাপারেই আলোচনা করতাম। মহিলার চোখের দিকে তাকাল সে। আপনি আমাদেরকে সাহায্য করবেন, মিস ডোভার?

হ্যাটটা ঠেলে পেছনে সরাল পলি, ধূসর উইগ সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিচের কোকড়া কালো চুল। অল্প বয়েসীদের চুল আর বুড়ো মানুষের মুখ নিয়ে এখন। অদ্ভুত লাগছে তার চেহারা। কি করে বুঝলে? গলার স্বর তরুণ হয়ে গেল হঠাৎ করেই।

আপনার ডায়লগ শুনে। হিটার আছে? রড? গ্যাট? দি ফ্রেঞ্চ অ্যাজেন্ট ছবিতে আপনি ওই ডায়লগ বলেছিলেন। ছবিটা আমি দেখেছি।

চোখ কান খোলা রাখো তুমি! সোজা হয়ে বসেছে অ্যাঞ্জেলা, বুড়ো মানুষের মত কুঁজো হয়ে বসার আর প্রয়োজন নেই। কোলের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিয়েছে। নীল জিনস পরেছে।

আমার পরের ছবিটায় আমি পল্লির রোল করব, আশি বছর বয়েস। আশি বছর হলে কি করে মানুষ, না জানলে অভিনয় করতে পারব না, সে জন্যেই এখানে। এসেছি কাছে থেকে দেখার জন্যে। এখানে ওই বয়েসের প্রচুর মানুষ আছে। ভাল অভিনয় করতে হলে দেখার ক্ষমতা খুব ভাল থাকা লাগে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, অভিনয় করার কথা কখনও ভেবেছ?

ভেবেছে মানে? মুসা বলল, কিশোর তো•..

জোরে কেশে উঠল কিশোর। মুসাকে শেষ করতে দিল না কথাটা। মোটুরামের অভিনয় করেছে, এটা নিয়ে কোন গর্ব তো নেইই, শুনতেও ভাল লাগে না তার। মুসাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বেন ডিলনের ব্যাপারে কথা বলতে চাই আমরা, মিস ডোভার।..

মাথা নাড়ল অ্যাঞ্জেলা। ব্যক্তিগত আলোচনা হয়ে যাবে।

স্ক্যাণ্ডাল নয়, আমরা চাই তথ্য। শেষ কখন ডিলনের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার? কি কি কথা হয়েছে? কেউ তাকে হুমকি দিচ্ছে এরকম কি কিছু বলেছে? আপনাদের মাঝে রোমান্টিকতা কর কি আছে না আছে জানতে চাই না আমরা।

বেঞ্চে নড়েচড়ে বসল অ্যাঞ্জেলা। আঙটি দিয়ে আলতো টোকা দিতে দিতে বলল, এক বছর ধরে আমার সঙ্গে প্রেম করার পর আমাকে ফেলে গেল সে। এটা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। এতটাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কাজকর্মই বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম।

তারমানে, কিশোর বলল, ডিলন মারাত্মক বিপদে পড়লেও আপনার কিছু এসে যায় না?

তা বলিনি। বিপদ সে ইচ্ছে করে টেনে আনে। মানুষকে ভোগায়। আমাকে ভুগিয়েছে। সিনেমা কোম্পানিকে ভুগিয়েছে। মুসার দিকে তাকাল অ্যাঞ্জেলা, কি ব্যাপার, তুমি কিছু বলছ না?

কিশোরই তো বলছে। গাল চুলকাল মুসা। গত শুক্রবার সকালে ডিলনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ও বিপদে পড়েছে, বুঝতে পেরেছি।

অ্যাঞ্জেলা বলল, এর আগের রাতে আমি গিয়েছিলাম।

গিয়েছিলেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিলোর।

ডিনার খেয়েছি ওর বাড়িতে। সেদিন সাফোকেশন ছবিতে আমার কাজ শেষ হয়েছিল। তো, আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছ কেন? শেষ দেখেছি বলে?

আপনি শেষ দেখেননি। শেষ দেখা হয়েছে কিডন্যাপারদের সঙ্গে।

কিডন্যাপার! আঁতকে উঠল অ্যাঞ্জেলা, অলিংগার জানে?

তার কাছেই পাঠানো হয়েছে র‍্যানসম নোট, মুসা জানাল।

 বেচারা অলিংগার। মরেছে!

ডিলনের সঙ্গে কেমন কাটল আপনার সন্ধ্যাটা, বলবেন? অনুরোধ করল কিশোর।

চমৎকার ডিনারের ব্যবস্থা করেছিল সে। আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ভুল করেছে, একথা শুনিয়ে, বোকার মত রসিকতাও করেছে। মনমেজাজ ভালই ছিল তার।

ডিলনের বন্ধু এবং শত্রুদের কথা কিছু বলবেন?

শত্রুর নাম বলতে শুরু করলে তো মাইলখানেক লম্বা হয়ে যাবে তালিকা। তবে বেশি রেগে যাওয়ার কথা ডট কার্লসনের। সাফোকেশন টু-র নায়কের রোলটা পাওয়ার কথা ছিল তার। হঠাৎ করে ডিলনকে দিয়ে দেয়া হল। ফলে রেগে গিয়ে কিছু একটা করে বসাটা ডটের পক্ষে বিচিত্র নয়। ডিলনের গুরুটাকেও সন্দেহ করতে পার। পটার বোনহেডের কথায় ওঠবস করে ডিলন। যা করতে বলে তাই করে। বোনহেডই কিছু করেছে কিনা কে জানে।

খুব একটা সাহায্য আপনি করতে পারছেন না, কিশোর বলল।

সরি। তেমন কিছু জানিই না, কি করব বল? উইগটা ঠিক করে তার ওপর হ্যাটটা বুসিয়ে দিল আবার অ্যাঞ্জেলা, পলি সাজল। বুড়ো মানুষের গলা নকল করে বলল, ঠিক আছে, কোন কিছুর প্রয়োজন পড়লে এস আবার। দেখি তখন কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।

ওর কথার ধরনে হেসে উঠল কিশোর আর মুসা। গুডবাই জানিয়ে চলে এল নিজেদের গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে কিশোর বলল, কাল স্কুল শেষ করে প্রথমেই স্টুডিওতে যাব, তোমার বাবা যা-ই বলুন।

আমি যেতে পারব না, মুসা বলল। ফারিহার সঙ্গে দেখা করতেই হবে। ও রেগে আছে।

ফারিহার সঙ্গে দুদিন পরে দেখা করলেও চলবে। কিডন্যাপারদের কাছ থেকে হয়ত পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে গেছেন অলিংগার। তোমার কাজ তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে ব্যস্ত রাখা।

ব্যস্ত রাখব? কেন?

কারণ স্টুডিওতে আমার কিছু কাজ আছে। জানিয়ে করা যাবে না কিছুতেই।

অলিংগারকে ব্যস্ত রাখবে, পরদিন প্রযোজকের অফিসের বাইরে বসার ঘরে বসে কথাটা ভাবছে মুসা, কিন্তু কিভাবে? কথা বলে, নানা রকম কৌশল করে? সেটা রবিন আর কিশোরের কাজ, ওরাই ভাল পারে। জেদ চেপে গেল তার। ওরা পারলে সে পারবে না কেন?

আপাতত অলিংগারকে ব্যস্ত রাখার জন্যে মুসার দরকার নেই। নিজের ঘরে। ব্যস্তই রয়েছেন তিনি। রিসিপশন রুমের চারপাশে চোখ বোলাল সে। আরেকজন লোক বসে আছে, অলিংগারের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। ঘন কাল চুল, উজ্জ্বল নীল ফ্রেমের সানগ্লাস পরেছে। আঙুল দিয়ে কখনও চেয়ারের হাতলে টাট্ট বাজাচ্ছে, কখনও নিজের উরুতে। লম্বা বেশি নয়। গায়ে শক্তি আছে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে জুতোর ডগা দিয়ে যেন ঠেলে সরানর চেষ্টা করছে পুরু কার্পেট।

বেঞ্চের ফাইট কটায়? মুসাকে জিজ্ঞেস করল লোকটা, দুটো দশে?

দুটো বিশ।

কয়েক মিনিট চুপচাপ থেকে আবার তাকাল মুসার দিকে। পাঞ্জা লড়ার অভ্যেস আছে?

আছে।

এসো, হয়ে যাক…

 প্রডিসারের অফিসে?

অসুবিধে কি? বসে থাকার চেয়ে তো ভাল… বলতে বলতেই সামনের টেবিল থেকে কফি কাপ আর ম্যাগাজিন সরিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে লাগল। লোকটা। সোফা থেকে নেমে কার্পেটে হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে ডান কনুইটা রাখল টেবিলে, হাতের পাঞ্জা খোলা। ডাকল, এসো।

গিয়ে টেবিলের অন্য পাশে হাঁটু গেড়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতের কনুই টেবিলে রেখে চেপে ধরল লোকটার পাঞ্জা। চোখে চোখে তাকাল।

শুরু! বলল লোকটা।

লোকটা চেষ্টা করছে মুসার হাতকে চেপে শুইয়ে দিতে চাপের চোটে কাঁপছে টেবিলটা। মুসা বেশি চাপাচাপি করছে না, শক্তি ধরে রেখে সোজা করে রেখেছে হাত। লোকটার শরীরে শক্তি আছে বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকার ক্ষমতা নেই, এটা বুঝে ফেলেছে সে।

চোখ মিটমিট আরম্ভ হয়ে গেল লোকটার।

ক্লান্ত হয়ে এসেছে, ঢিল পড়ছে হাতের চাপে। সময় হয়েছে! আচমকা হাতের চাপ বাড়িয়ে দিল মুসা। হাত সোজা রাখতে পারছে না লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড আপ্রাণ চেষ্টা করল সোজা রাখার, পারল না, কাত হয়েই যাচ্ছে, তারপর পড়ে গেল টেবিলের ওপর। ককিয়ে উঠল সে, ব্যথায় নয়, পরাজিত হওয়ায়।

 ঠিক এই সময় দরজায় দেখা দিলেন অলিংগার। রিসিপশন রুমে দুজন লোককে ওই অবস্থায় দেখে দ্বিধায় পড়ে গেলেন।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। ছুটে গেল অলিংগারের দিকে। কত আর অপেক্ষা করবে, ব্রাউন? অনেক তো হলো।

 শান্ত হও, ডট, শান্ত হও, অলিংগার বললেন। আমার সঙ্গে ঝগড়া করে কোন লাভ হবে তোমার?

ভেবে দেখো, ব্রাউন, সময় থাকতে, বলল তরুণ লোকটা। ও-ই ডট কার্লসন, বুঝতে পারল মুসা। শুনলাম, ডিলন কেটে পড়েছে। ছবিটাকে ডোবাতে চাও?

এই অভিনেতার কথাই অ্যাঞ্জেলা ডোভার বলেছিল, প্রথমে যাকে দি সাফোকেশন টু ছবির জন্যে পছন্দ করা হয়েছিল।

ডট, আমার হাতে আর কিছু নেই এখন। তুমি জানো না। পরে কথা বলব।

ইশারায় মুসাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ডট, এ কে? ছবিতে অভিনয় করবে?

না।

আরেকবার মুসার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ডট, আসলেই তাকে অভিনয় করতে আনা হয়েছে কিনা। শ্রাগ করল। তারপর রওনা হয়ে গেল দরজার দিকে।

ক্লান্ত দৃষ্টি ফুটেছে অলিংগারের চোখে। রক্তশূন্য লাগছে চেহারা। কেমন আছ? চমৎকার কাজ করেছ গাড়িটাতে, আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?

ভারি দম নিয়ে প্রযোজকের পিছু পিছু তার অফিসে ঢুকল মুসা। টেবিলে পড়ে রয়েছে ওর বাবার হাতের আরেকটা কাজ। একটা চোখ, মণিতে কাঁটাচামচ গাঁথা। যতরকম বীভৎসতা সম্ভব, সব যেন ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে এই একটা ছবিতেই।

মিস্টার অলিংগার, বলল সে, কিডন্যাপাররা আর কোন খবর দিয়েছে?

মাথা নাড়লেন প্রযোজক। টেবিলে পড়ে থাকা তিন গোয়েন্দার কার্ডটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, তোমাদেরকে এই কেস থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম, তাই না? তাহলে ভাল হয়। কিডন্যাপাররা যা যা করতে বলে তাই আমাদের করা উচিত, তাহলে ডিলন ভাল থাকবে।

মাথা ঝাঁকাল মুসা, যেন সব বুঝতে পেরেছে। ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। সাধারণত তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করে কিডন্যাপাররা, টাকাটা নিয়ে সটকে পড়তে চায়। এরা এত দেরি করছে কেন?

কিডন্যাপারদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানো মনে হয়? হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁটগুলো বেঁকে গেল অলিংগারের, মুসার কাছে সেটাকে হাসি মনে হলো না।

কিডন্যাপ কেসের সমাধান আরও করেছি আমরা, কিছুটা অহঙ্কারের সঙ্গেই বলল মুসা। আপনি আমাকে সরে থাকতে বলেছেন। কিছু মনে করবেন না, আমার বন্ধু কিশোর পাশাকে নিয়ে এসেছি আজ স্টুডিওতে। ডিলনের পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। কিছু বেরিয়েও যেতে পারে।

পুরু একটা মিনিট ছাতের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন অলিংগার। তারপর মুখ। নামালেন। মুসা ভেবেছিল মানা করে দেবেন, তা করলেন না। আইডিয়াটা ভাল। তা করতে পার। পটার বোনহেডকে দিয়ে শুরু করগে। ওই লোকটাকে আমার বিশ্বাস হয় না।

পকেটের স্ফটিকটার কথা মনে পড়ে গেল মুসার। মনে হতে লাগল, আবার গরম হয়ে উঠছে ওটা।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অলিংগারের অফিস থেকে বেরিয়ে কিশোরকে খুঁজতে লাগল মুসা।

এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করেও ওকে পেল না সে। সাউণ্ড স্টেজে নেই, ক্যাফেটেরিয়ায় নেই। কোথায় গেল? একটা সিনারি শপের মোড় ঘুরে আরেকটু হলেই ওর গায়ে হোঁচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল মুসা। খাইছে! বলে চিৎকার। করে উঠল।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মেঝেতে চিত হয়ে আছে কিশোর পাশা। গলায় লাল, মোটা একটা গভীর ক্ষত। জবাই করলে যেমন হয়।

Super User