বিমান দুর্ঘটনা – তিন গোয়েন্দা – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : মার্চ, ১৯৯৩

০১.

সকালের রোদে গুঞ্জন তুলে উড়ে চলেছে সেসনা। ছোট্ট বিমানটার নিচে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাডা রেঞ্জের পাহাড়ী অঞ্চল। সবুজ পাইন বনের ভেতর থেকে মাথা তুলেছে অসংখ্য লাল পাহাড়ের চূড়া।

ককপিটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রবিন। চোখে বিনোকিউলার। পাশে পাইলটের সীটে বসে তার বাবা রোজার মিলফোর্ড। সিঙ্গল-ইঞ্জিন টার্বোপ্রপেলার বিমানটাকে স্বচ্ছন্দে উড়িয়ে নিয়ে চলেছেন গ্র্যানিটের পাহাড় আর পান্না-সবুজ উপত্যকার ওপর দিয়ে।

নিচে ওটা কি? রবিন বলল। ওই তৃণভূমিটার ওপারে। দেখতে পাচ্ছ?

কিশোরকে কনুইয়ের তো মেরে চৌখ টিপল মুসা। রবিন আর তার বাবার পেছনে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে দুজনে। ওরাও তাকিয়ে নিচে। তবে খালি চোখে। সব কিছু ভাল দেখা যাচ্ছে না বলে পালা করে বিনোকিউলারটা নিয়ে দেখছে। নিচে একের পর পার হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়া।

কি আর, মুসা বলল রবিনকে। মেয়েটেয়ে হবে। সুন্দরী। তোমার মুখটা, দেখতে পেলেই হাত নাড়বে।

এবং পরক্ষণেই ফোন নম্বর চাইবে, হেসে যোগ করল কিশোর।

জিজ্ঞেস করবে, মুসা বলল, আজকে সন্ধেয় তোমার কোন কাজ আছে কি না।

 আঙ্কেল, মিস্টার মিলফোর্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ডায়মণ্ড লেকে সিনেমা হল আছে? শান্ত, নিরীহ ভঙ্গি। সন্ধ্যায় রবিনকে তো আর পাব না। মুসার আর আমার সময় কাটাতে হবে।

শব্দ করে হাসলেন মিলফোর্ড।

চোখ থেকে দূরবীন সরাল রবিন। মেয়েটেয়ে কিছু না, ওটা কুগার। ফিরে তাকাল দুই বন্ধুর দিকে। সুন্দর চেহারা, সোনালি ঘন চুল, কালচে নীল চোখ, আর। আকর্ষণীয় হাসি। যেখানেই যায়, কোথা থেকে যেন এসে উদয় হয় মেয়েরা, পিছে লাগে তার। টিটকারি তো খুব মারলে আমাকে। আমি কি একা নাকি?

আর কে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

কেন, কমিক গার্লকে ভুলে গেলে? মিরিনা জরডান? ও আমার পিছে লেগেছিল?

 কিশোরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল মুসা। কিশোর মিয়া, এইবার তোমাকে পেয়েছে…

আর আমি যা করি, মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল রবিন, সেটা স্বাভাবিক। মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যাই, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, ছবি দেখি…অ্যাটমের স্ট্রাকচার বোঝাতে বোঝাতে বিরক্ত করে ফেলি না।

মুখ তুলল কিশোর। পিস্তলের নলের মত করে রবিনের দিকে চোখা থুতনি। নিশানা করল যেন। রেগে গেছে। জিনা জানতে চাইল, আমি কি করব? ও-ই তো বলল, ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে…

ছেলেদের এই ঝগড়া দারুণ উপভোগ করছেন মিলফোর্ড। হো হো করে হেসে উঠলেন। লাল হয়ে গেল কিশোর। রবিন আর মুসাও হাসছে। শেষে সবার সঙ্গে তাল মেলাতেই যেন অল্প একটু হাসল সে-ও। মেয়েরা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু ওদের সঙ্গে সহজ হতে পারে না সে। তার প্রখর বুদ্ধিমান মগজের কাছেও যেন মেয়েরা একটা বিরাট রহস্য।

উঠে দাঁড়াল সে। সেসনার ছাত নিচু, সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। মাথা নুইয়ে রেখেই লেজের দিকে এগোল সে। ওখানে মালপত্র আর নানা রকম যন্ত্রপাতি গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়েছে।

কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

আরেকটা বিনোকিউলার দরকার, না তাকিয়েই জবাব দিল কিশোর। নিচে কে আছে দেখব। এমন কেউও থাকতে পারে, যে আগে থেকেই ই ইকোয়্যাল টু এম সি টু দি পাওয়ার টু-এর মানে জানে। আমাকে আর শেখাতে হবে না।

আরেকবার হাসল সবাই। এবার কিশোরের হাসিটা সবার চেয়ে জোরাল শোনাল। গ্রীষ্মের এই উইক এণ্ডের শুরুটা বড় চমৎকার। উজ্জ্বল রোদ। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, গাঢ় নীল। তিন দিন লাগতে পারে মিস্টার মিলফোর্ডের কাজ শেষ হতে হতে। চুটিয়ে আনন্দ করে ছুটি কাটাতে পারবে তাহলে তিন গোয়েন্দা। খবরের কাগজের একটা স্টোরি করার জন্যে ডায়মণ্ড লেকে চলেছেন তিনি।

কাজ অনেক পেছনে ফেলে এসেছে ওরা, রকি বীচে। কোন বাধা নেই, কোন দায়িত্ব নেই। মুক্ত, স্বাধীন, কয়েকটা দিনের জন্যে। হেসেখেলে কাটাতে পারবে ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে দামি মাউনটেইন রিসোর্টে। ডায়মণ্ড লেকে গলফ কোর্স আছে, বিশাল সুইমিং পুল আছে, টেনিস কোর্ট আছে। ঘোড়ায় চড়া, ক্যাম্পিং এসবের ব্যবস্থা আছে। রানওয়ে আছে, যাতে প্লেন নামতে পারে, কারণ। মাঝেসাঝেই এখানে পালিয়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচেন ভীষণ ব্যস্ত ব্যবসায়ী কিংবা সরকারী কর্মকর্তারা। কিছু দিন নির্বিঘ্নে কাটিয়ে চাঙা হয়ে আবার ফিরে যান। তাদের নৈমিত্তিক কাজে।

এটাওটা সরিয়ে জিনিসপত্রের মাঝে বিনোকিউলার খুঁজতে লাগল কিশোর। লোকটাকে হয়ত দেখতে পাব। আনমনা হয়ে বলল সে। কয়েকটা যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে একপাশে ফেলে রাখল, একটা খালি ফলের রসের ক্যান, একটা দোমড়ানো নার্ফ বল, এবং আরও কিছু বাতিল জিনিস সরাল। হঠাৎ মিস্টার মিলফোর্ডের দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল, যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, লোকটার নাম যেন কি বললেন?

কই, বলিনি তো!

হুম, তাহলে যার কাছ থেকে সংবাদ জোগাড় করতে যাচ্ছেন, সে একজন, পুরুষ। আমি বললাম, লোকটা, আপনি বললেন বলিনি। তার মানে স্বীকার করে। নিয়েছেন, আপনার সংবাদদাতা একজন পুরুষ। যাক, একটা সূত্র মিলল।

আরেক দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিটা লুকালেন মিলফোর্ড।

বাবা, চাপাচাপি শুরু করল রবিন, বল না। লোকটা কে? কাউকে বলব না, সত্যি।

সরি। মাথা নাড়লেন মিলফোর্ড। সুদর্শন, ভাল স্বভাবের লোক তিনি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা। রবিন এখনও তার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। চোখে কালো সানগ্লাস, মাথায় লস অ্যাঞ্জেলেস ডজারস বেসবল ক্যাপ, গায়ে নেভি ব্লু রঙের উইণ্ডব্রেকার, বুক পকেট থেকে বেরিয়ে আছে আধ ডজন পেন্সিল। বয়েস এত কম লাগছে, মনে হচ্ছে তিনি রবিনের বাবা নন, বড় ভাই।

কি ধরনের স্টোরি করতে যাচ্ছেন? মুসার প্রশ্ন। কোন সুপার অ্যাথলিটকে নিয়ে? ডায়মণ্ড লেকে পাহাড়ে ওঠার রেকর্ড ভাঙছে না তো কেউ? জাত অ্যাথলিট মুসার প্রথমেই মনে আসে খেলাধুলা আর ব্যায়ামের কথা। না না, বুঝেছি, ওসব না! আগামী মাসে স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইন্যাল যেটা শুরু হতে যাচ্ছে, তারই কোন ব্যাপার…

কিচ্ছু বলব না, আমি, মুসাকে থামিয়ে দিলেন মিলফোর্ড। পত্রিকায় বেরোনোর আগে খবর গোপন রাখা সাংবাদিকের দায়িত্ব।

সে আমরা জানি, রবিন বলল। গোপন সূত্রের সাহায্য ছাড়া,বহুবার শোনা কথাটা যেন উগড়ে দিল সে, পুরো স্টোরি জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায় সাংবাদিকের জন্যে।

আর, সুর মেলাল মুসা, সাংবাদিকরা যদি সূত্রদের নাম ফাস করত, তাহলে কেউই আর ভয়ে একাজ করতে আসত না। সূত্ররা সব শুকিয়ে যেত।

হ্যাঁ, গোপন রাখাটা যে কত জরুরী, কিশোর বলল, জানি আমরা। আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন আপনি। পেটে বোমা মারলেও মুখ খুলব না।

হাসলেন মিলফোর্ড। ঠিক। যা জানবে না তা বলতেও পারবে না।

গুঙিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। কঠিন লোক মিলফোর্ড। লস অ্যাঞ্জেলেসের এতবড় একটা নামকরা পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার খামোকা হননি। কোন স্টোরির ওপর কাজ করছেন এখন, কিছুতেই সেটা জানার উপায় নেই।

কাগজ কোম্পানির ছোট্ট একটা বিমান নিয়ে তিনি ডায়মণ্ড লেকে যাবেন, এটা নিয়ে ফোনে কার সঙ্গে যেন আলাপ করছিলেন, শুনে ফেলেছিল রবিন। গরম কোন খবর, নইলে বিমান নিয়ে এভাবে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না, বুঝতে পেরেছে। সে। কিন্তু কার ওপর, কেন স্টোরিটা করা হচ্ছে, বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারেনি।

কি করলে আমাদের সঙ্গে নিতে বাধ্য করা যাবে তোমাকে? ফোন রাখতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল রবিন।

মায়া, হেসে বলেছেন মিলফোর্ড। পঞ্চাশ ফুট দূর থেকেই যে মায়াজালে সুন্দরী মেয়েগুলোকে জড়িয়ে ফেলো তুমি, সেই মায়া দিয়ে। তবে আপাতত তোমাদের নিজেদের চরকায় তেল দেয়াটাই ভাল মনে করছি আমি। এটা তিন গোয়েন্দার ব্যাপার নয়।

ওই সময় রবিনদের বাড়িতেই ছিল কিশোর আর মুসা। আরেক ঘরে। তিন গোয়েন্দা নামটা শুনেই কান খাড়া করল কিশোর। মুসাকে নিয়ে চলে এল হলঘরে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করল রবিনকে। জানাল রবিন।

দয়া করুন আমাদের ওপর, মিনতি করে বলেছে মুসা। খাটাতে খাটাতে তো মেরে ফেলেছেন পুরো হপ্তাটা। কত কিছু করে দিলাম। বাগান সাফ করলাম, গ্যারেজ পরিষ্কার করলাম…

হ্যাঁ, অনেক কাজই করেছ, স্বীকার করলেন মিলফোর্ড।

তাহলে দয়া করুন, আবার বলল মুসা। নিয়ে চলুন আমাদের। ছুটি কাটানোর এত সুন্দর জায়গা শুনেছি আর নেই।

নেই কথাটা ভুল, শুধরে দিল কিশোর। আছে, তবে কম। হ্যাঁ, আঙ্কেল নিয়ে চলুন। বিশ্রামটাও হয়ে যাবে আমাদের, সেই সঙ্গে রিক্রিয়েশন।

ছেলেদের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না মিলফোর্ড। রাজি হয়ে গেলেন। তবে শর্ত দিলেন একটা। তার কাজে ওরা নাক গলাতে পারবে না। এবং এটা বলেই কৌতূহলী করে তুললেন কিশোরকে। ওই সময় আর কিছু বলল না সে। রাজি হয়ে গেল শর্তে।

গরমের ছুটির সময় কাজ করে কিছু পয়সা জমিয়েছে তিন গোয়েন্দা। এতে হোটেলের শস্তা ঘর ভাড়া আর খাওয়ার খরচ হয়ে যাবে। সুইমিং পুলটা বিনে। পয়সায়ই ব্যবহার করা যাবে। অল্প পয়সা দিয়ে আরও যা যা চিত্তবিনোদন করা সম্ভব, করবে।

এই, দেখ, জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে রয়েছেন মিলফোর্ড। সামনের উপত্যকার দিকে চোখ। ওদিকে দেখ কি দেখা যায়।

বিনোকিউলার দিয়ে দেখল রবিন। তাঁরপর নীরবে সেটা তুলে দিল মুসার হাতে।

আরও কাছে থেকে দেখা দরকার, মিলফোর্ড বললেন। ডায়মণ্ড লেকের কাছাকাছি এসে গেছি আমরা।

সামনের দিকে নিচু হয়ে গেল বিমানের নাক। বদলে গেল ইঞ্জিনের গুঞ্জন।

বিনোকিউলার খোঁজা বাদ দিয়ে মিলফোর্ডের সীটের পেছনে চলে এল কিশোর। সামনের সরু সবুজ উপত্যকাটার দিকে তাকাল। উপত্যকার কিনারে গ্র্যানিটের খাড়া দেয়াল লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে উত্তর দক্ষিণে। দেয়ালটার দক্ষিণ মাথায় কয়েক মাইল লম্বা একটা পাহাড়, পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে রূপালি ঝর্না।

বাহ, দারুণ! কিশোর বলল।

 উপত্যকাটার নাম কি? রবিনের প্রশ্ন।

আমারও জানতে ইচ্ছে করছে, জবাব দিলেন মিলফোর্ড। খুব সুন্দর। সামনে দেখ। সুন্দর, না? ডায়মণ্ড লেক এখান থেকে উত্তরে। চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হবে আর।

ডায়মণ্ড লেক দেখা গেল। ঘন নীল, উজ্জ্বল রোদে যেন নীলা পাথরের মত জ্বলছে। একধারে একগুচ্ছ বাড়ি, পিঁপড়ের সমান লাগছে এখান থেকে। লেকের পাড় আর পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে চলে গেছে একটা কংক্রীটের রাস্তা, সাদা সরু একটা ফিতের মত দেখাচ্ছে।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠল রবিন।

সময় মতই এসেছি, কিশোর বলল। লাঞ্চ ওখানে গিয়েই করতে পারব।

 এইবার একটা কথার মত কথা বলেছ, মাথা দোলাল মুসা।

এই সময় ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিল সেসনা। কিশোরের সে রকমই মনে হলো। প্রায় টেরই পাওয়া যায়নি…

তোমরা কি… কথা শেষ করতে পারল না সে।

একে অন্যের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। পরক্ষণেই একযোগে তাকাল। সামনের দিকে, যেখানে সেসনার একমাত্র ইঞ্জিনটা রয়েছে।

বদলে গেছে ইঞ্জিনের গুঞ্জন।

আঙ্কেল… চিৎকার করে উঠল কিশোর। এবারেও কথা শেষ করতে পারল না সে।

থেমে গেছে ইঞ্জিন।

 কন্ট্রোলের ওপর পাগলের মত ছোটাছুটি করছে মিলফোর্ডের আঙুল। দুই বছর হল পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছেন তিনি, বহুবার আকাশে উঠেছেন বিমান নিয়ে, কখনও কোন গোলমালে পড়েননি।

অসংখ্য সুইচ টেপাটিপি করলেন তিনি, গজগুলো চেক করলেন, তারপর যখন দেখলেন কোনটাই কাজ করছে না, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওগুলোর দিকে। কাটাগুলো সব নিথর হয়ে আছে, নড়ে না, ডিজিটাল নম্বরগুলো যেখানে ছিল সেখানেই আটকে গেছে। অলটিচিউড, এয়ার স্পীড, ফুয়েল…

ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমটা গেছে! বিড়বিড় করল রবিন।

 ইঞ্জিন? জবাব জানা হয়ে গেছে কিশোরের, তবু প্রশ্নটা করল।

ডেড! মিলফোর্ড বললেন।

.

০২.

কাগজের খেলনা বিমানের মত ভেসে চলেছে সেসনা। ইঞ্জিন স্তব্ধ। চারপাশে শিস দিচ্ছে যেন বাতাস, গোঙাচ্ছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে থাবা দিয়ে। মাইক্রোফোনটা তুলে নিয়ে সুইচ টিপলেন মিলফোর্ড।

মে-ডে! মে-ডে! তার কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু জরুরী। সেসনা নভেম্বর থ্রি সিক্স থ্রি এইট পাপা থেকে বলছি। আমাদের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। নিচে পড়ছি। পজিশন জিরো ফোর সেভেন রেডিয়াল অভ ব্যাকারসফিল্ড ভি ও আর অ্যাট সেভেন্টি ফাইভ ডি এম ই।

মাইক্রোফোনটা রবিনের হাতে গুঁজে দিয়ে আবার স্টিক ধরলেন তিনি।

একই কথা বলতে লাগল রবিন, সেসনা নভেম্বর…

হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিলফোর্ডের চেহারা। রবিন, লাভ নেই! রেখে দাও!

মানে?

অহেতুক কথা বলবে, বুঝে ফেলেছে কিশোর, লাভ হবে না। মেসেজ যাবে না কোথাও। বিদ্যুতই নেই। রেডিও অচল।

আরি, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, ইমারজেন্সি লোকেটর বিকন আছে একটা। প্লেন ক্র্যাশ করলে আপনা-আপনি চালু হয়ে যায় ওটা।

অনেক ধন্যবাদ, আমি ক্র্যাশ করতে চাই না, দুই হাত নাড়ল কিশোর। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি। নিরাপদে এখন কোনমতে মাটিতে নামতে পারলে…

হ্যাঁ, আমারও এই কথা, মুসা বলল।

 নীরবে সিটবেল্ট বাঁধতে লাগল ওরা।

গ্র্যানিটের একটা চূড়ার দিকে নাক নিচু করে ধেয়ে চলেছে বিমান। বাড়ি লাগলে ডিমের খোসার মত গুঁড়িয়ে যাবে।

মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। ভয় পেলে যা হয়। ঘামতে আরম্ভ করেছে।

মুঠো খুলে-বন্ধ করে আঙুলের ব্যায়াম করতে লাগল মুসা, আনমনে, যেন পতনের পর পরই কোন কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্যে তৈরি হচ্ছে। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে পেশী।

ঢোক গিলল রবিন। সহজ ভাবে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। যাচ্ছি কোথায় আমরা? স্বর শুনে মনে হলো গলায় ফাঁসি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

ওই তৃণভূমিটায় নামার চেষ্টা করব, মিলফোর্ড বললেন।

 তৃণভূমিটা বেশ বড়, উপত্যকার পুব ধারে।

কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আর মিনিট তিনেক।

পাথর হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। বাতাস চিরে নিচে নামছে বিমান। দ্রুত বড় হচ্ছে গাছপালা, গ্র্যানিটের চাঙড়। তৃণভূমির উত্তরের পাহাড়টা লম্বা হচ্ছে, সাদা হচ্ছে, মাথা তুলছে যেন দানবীয় টাওয়ারের মত।

মায়ের কথা ভাবল রবিন। কাগজে যখন পড়বেন, সে আর তার বাবা মারা। গেছেন বিমান দুর্ঘটনায়, দুঃখটা কেমন পাবেন? নিশ্চয় ভয়াবহ।

মাটির যত কাছাকাছি হচ্ছে ততই যেন গতি বেড়ে যাচ্ছে বিমানের।

মাথা নামাও! চিৎকার করে বললেন মিলফোর্ড। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরো। শক্ত করে!

বাবা…

জলদি করো! কথা বলার সময় নেই!

মাথা নুইয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরল, কিংবা বলা যায় বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল তিনজনে।

যাই হোক, চাকাগুলো ঠিকই আছে, বিড়বিড় করে নিজেকেই সান্ত্বনা দিল রবিন। ধাক্কা কিছুটা অন্তত বাঁচাবে।

ব্রেকের কথা উল্লেখ করল না কেউ। লাভ নেই। ইলেকট্রিক সিসটেম বাতিল, কাজেই ব্রেক কাজ করবে না।

বিমানের চারপাশে বাতাসের গর্জন বাড়ছে।

 হয়েছে! এইবার! ভাবতে গিয়ে গায়ে কাটা দিল রবিনের।

 মাটিতে আছড়ে পড়ল বিমান।

প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে ছিটকে যেতে চাইল ওদের শরীর, সীট বেল্টে টান। লেগে আবার ফিরে এসে পিঠ বাড়ি লাগল সিটের হেলানে। রবিনের মনে হলো, তীক্ষ্ণ ব্যথা যেন লাল সাদা স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে গেল চোখে।

পড়েই বলের মত ড্রপ খেয়ে লাফিয়ে উঠল বিমান, ভয়ঙ্কর গতিতে আবার আছাড় খেল। সীট বেল্টে আটকানো মানুষগুলোকে এলোপাতাড়ি ঝাঁকিয়ে দিল। আবার লাফিয়ে উঠল।

শক্ত হয়ে থাক! চিৎকার করে হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড।

তৃতীয় বার মাটিতে পড়ল বিমান। কাপল, ঝাঁকি খেল, দোল খেল, গোঙাল। তবে আর লাফ দিল না। সামনের দিকে দৌড়াল মাতালের মত টলতে টলতে।

সীট আঁকড়ে ধরেছে রবিন। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভীষণ ঝাঁকুনি লাগছে। মনে হচ্ছে, শরীরের ভেতরের যন্ত্রপাতি সব ভর্তা হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে আছে এখনও, তবে আর কতক্ষণ?

হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ, ধাতুর শরীর থেকে ধাতু ছিঁড়ে, খসে আসার আর্তনাদ। কলজে কাঁপিয়ে দেয়।

আরেকবার সামনে ঝাঁকি খেয়ে পেছনে ধাক্কা খেল ওদের দেহ, তারপর খেল। পাশে, মাথা ঠুকে গেল দেয়ালের সঙ্গে। বাতাসে উড়ছে বই, খাতা, কাগজ। কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল যন্ত্রপাতি আর ইলেকট্রিকের তার। কি যেন এসে লাগল রবিনের হাতে। ব্যথায় উহ করে উঠল সে। পাগল হয়ে গেছে যেন বিমান, এ পাশে দোল খাচ্ছে, ওপাশে দোল খাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এর মাঝে।

তারপর নামল নীরবতা। স্তব্ধ নীরবতা। দাঁড়িয়ে গেছে সেসনা।

 আস্তে মাথা তুলল রবিন।

 বাবা!

ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলে মাথা রেখে উবু হয়ে আছেন মিলফোর্ড।

 তার কাধ ধরে ঠেলা দিল রবিন। বাবা! ঠিক আছ তুমি?

কিন্তু নড়লেন না তিনি।

ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার! সামনের দুটো সীটের মাঝের ফাঁকে এসে দাঁড়াল মুসা।

দ্রুতহাতে বাবার কানে লাগানো হেডফোন খুলে নিল রবিন। মুসা খুলল সীটবেল্ট। মিলফোর্ডের কপালে রক্ত। বাড়ি লেগে গোল হয়ে ফুলে উঠেছে একটা জায়গা, লালচে বেগুনী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।, মুসার পেছন পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল রবিন, বেসামাল পায়ে দৌড়ে বিমানের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে এল আরেক পাশে। সে ভাল আছে। মুসা আর। কিশোরও ভাল আছে। নেই কেবল তার বাবা। বেহুশ হয়ে গেছেন। আঘাত কতটা মারাত্মক এখনও বোঝা যাচ্ছে না। হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাইলটের পাশের দরজাটা খুলল সে।

তার পাশে চলে এল মুসা। রবিনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাজাকোলা করে বের করে আনল মিলফোর্ডকে। নিজের গায়েও জখম আছে, ব্যথা আছে, তবে গুরুত্ব দিল না। আগে মিলফোর্ডের সেবা দরকার।

কিশোর কই? অচেতন দেহটা কোলে নিয়েই সামনের একটা উঁচু পাথরের চাঙড়ের দিকে প্রায় দৌড়ে চলল সে। ওর পাশে রইল রবিন। বাবার দিকে কড়া দৃষ্টি।

এই যে, এখানে! দুর্বল জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। বিমানের ভেতরেই রয়েছে। ধীরে ধীরে হাত-পা নেড়েচেড়ে দেখছে ভেঙেছে কি-না। নড়ছে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই, তার মানে ঠিকই আছে…

বেরোও ওখান থেকে! গ্র্যানিটের চাঙড়টার দিকে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাথরের কাছে পৌঁছে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল মিলফোর্ডকে।

হাঁটু গেড়ে বাবার পাশে বসে পড়ল রবিন। নাড়ি দেখল। ডাক দিল, বাবা, শুনতে পাচ্ছ? বাবা?

 মিলফোর্ডকে নামিয়ে দিয়েই আবার বিমানের দিকে দৌড় দিল মুসা, কিশোরের কাছে।

আসছি! দরজায় দাঁড়িয়ে বোকা বোকা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর।

নাম না জলদি, গাধা কোথাকার! ধমকে উঠল মুসা। কিশোরের হাত ধরে টান মারল। ফুয়েল ট্যাঙ্ক…

বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের চোখ। ফুয়েল ট্যাঙ্ক! ভুলেই গিয়েছিলাম…! আতঙ্ক ফুটল কণ্ঠে। আগুনের মত গরম হয়ে আছে ইঞ্জিন। ট্যাঙ্কের পেট্রল এখন তাতে গিয়ে লাগলে দপ করে জ্বলে উঠবে।

লাফ দিতে যাচ্ছিল কিশোর, এই সময় হাতে টান দিল মুসা, তাল সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে। উঠে দাঁড়াল আবার। কোথাও হাড়টাড় ভেঙেছে কিনা দেখার সময় নেই আর। দৌড়াতে শুরু করল মুসার পেছনে। যে পাথরটার আড়ালে শুইয়ে দেয়া হয়েছে মিলফোর্ডকে, রবিন রয়েছে, সেখানে চলেছে। বিমাটা বিস্ফোরিত হলেও ওখানে টুকরোটাকরা ছিটকে গিয়ে ক্ষতি করার আশঙ্কা নেই।

মিলফোর্ডের কাছে এসে ধপ করে বসে পড়ল কিশোর। পর মুহূর্তেই চিত। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঘামে চকচক করছে মুখ। তার পাশে বসে পড়ল মুসা।

বিস্ফোরণের অপেক্ষা করছে ওরা। প্রচণ্ড শব্দের পরক্ষণেই এসে গায়ে লাগবে। আগুনের আঁচ, বাতাস ভরে যাবে পোড়া তেলের গন্ধে।

গায়ের ডেনিম জ্যাকেট খুলে ফেলল রবিন। গুটিয়ে নিয়ে বালিশ বানিয়ে ঢুকিয়ে দিল বাবার মাথার নিচে। আরেকবার নাড়ি দেখে বন্ধুদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বলল, নাড়ি ঠিকই আছে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বেহুশ হয়ে গেছেন। আর কিছু না। প্রচণ্ড শক লেগেছে তো।

খুব শক্ত মানুষ! মুসা বলল।

নিজের জ্যাকেট খুলে মিলফোর্ডের গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাত টান টান করে ঝাঁকি দিল, পা ঝাঁকি দিল, পেশীগুলোকে ঢিল করে নিয়ে আবার বসল। বিমানটা এখনও ফাটছে না কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি তো ইঞ্জিন? বার বার সীটে ধাক্কা লাগায় পিঠ ব্যথা করছে, বুক ব্যথা করছে সীট বেল্টের টান লেগে।

গুঙিয়ে উঠলেন মিলফোর্ড।

 বাবা? ডাক দিল রবিন। চোখ মেল, বাবা?

আঙ্কেল, শুনছেন? উঠে বসে কিশোরও ডাকল।

 চোখ মেললেন মিলফোর্ড রবিনের মুখে চোখ পড়ল।

 হাসি ফুটল রবিনের মুখে। ল্যাণ্ডিংটা দারুণ হয়েছে, বাবা।

দুর্দান্ত হয়েছে, একমত হলো কিশোর।

তাহলে আবার কখন উড়ছি আমরা? রসিকতা করল মুসা।

 মলিন হাসি হাসলেন মিলফোর্ড। তোমরা ঠিক আছ তো?

প্লেনটার চেয়ে যে ভাল আছি, কিশোর জবাব দিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

উঠে বসতে গেলেন। ঠেলে আবার শুইয়ে দিল রবিন।

প্লেনটার কি অবস্থা! উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মিলফোর্ড। ডানাটানা আছে?

ডানা?

তাই তো! লক্ষ্যই করা হয়নি! তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। পাথরটার পাশে এসে তাকাল। অসংখ্য মেঠো ফুল জন্মে রয়েছে তৃণভূমিতে। মাঠের বুক চিরে চলে গেছে। একটা লম্বা দাগ, বিমানটার হিঁচড়ে যাওয়ার চিহ্ন। সেসনার ডানায় লেগে মাথা। কেটে গেছে অনেক চারাগাছের। কাণ্ডগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে রোদের মধ্যে, ওপরের অংশটা যেন মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। প্রপেলারের চার ফুট লম্বা একটা ডানা খসে গেছে, কয়েক টুকরো হয়ে এখন পড়ে আছে শখানেক ফুট দূরে। বিমানের। চলার পথে পড়ে আছে দুটো চাকা। ধারাল পাথরে লেগে ছিঁড়ে গেছে একটা ডানা। ওই পাথরটাতে বাড়ি খেয়েই অবশেষে থেমেছে বিমানটা। ডানা ছাড়া উড়তে পারবে না আর সেসনা।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে রবিন বলল, গেছে!

নামতে যে পেরেছি, এটাই বেশি, মুসা বলল।

কিশোর বলল, হ্যাঁ, অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম, জীবনটা এখানেই খোয়াতে হবে। অথচ একটা হাডিডও ভাঙল না, আশ্চর্য!

আমার ক্যাপটা কোথায়? মিলফোর্ড বললেন। ছেলেদের বাধা দেয়ার তোয়াক্কা করলেন না আর, পাথরের একটা ধার খামচে ধরে টেনে তুললেন শরীরটাকে।

বাবা!

 আঙ্কেল!

পাথরে হেলান দিলেন মিলফোর্ড। সোজা রাখলেন মাথাটা। তিক্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। মাথায় সামান্য ব্যথা, আর কোন অসুবিধে নেই।

বসে পড়ো! রবিন বলল।

 উপায় নেই, মিলফোর্ড বললেন। প্লেনটার অবস্থা দেখতে হবে।

 কিন্তু ইঞ্জিন গরম…

মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আগুন লাগার ভয় করছ? এখনও যখন লাগেনি, আর লাগবে না। বিমানটার দিকে তাকালেন। এক পা বাড়ালেন সামনে, তারপর আরেক পা। নাহ, পারছি হাঁটতে। পারব। অতটা খারাপ না। টলে উঠলেন তিনি।

খপ করে এক হাত ধরে ফেলল রবিন। মুসা ধরল আরেক হাত।

বড় বেশি গোয়ার্তুমি করো তুমি, বাবা!

তোর মা-ও একই কথা বলে, হেসে বললেন মিলফোর্ড। আমাদের এডিটর সাহেবও। সব সময়ই বলেন। আবার পা বাড়ালেন তিনি। তবে ছেলেদের সাহায্য নিতে অমত করলেন না।

পাশে পাশে চলল কিশোর। বিমানের কাছে পৌঁছে পাইলটের সীট থেকে বাবার সানগ্লাস আর ক্যাপটা তুলে নিল রবিন।

এ নীল উইণ্ডব্রেকারের পকেটে চশমাটা রেখে দিলেন মিলফোর্ড। ক্যাপটা মাথায়। দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিকমত বসার চেষ্টা করলেন, যাতে কপালে না লাগে। বসিয়ে, হাসলেন। যেন বোঝাতে চাইলেন, আমাকে অত অসহায় ভাবছ কেন? আমি এখনও সবই পারি।

আশপাশটায় চোখ বোলাল ওরা। পাহাড়ের ঢালে ঢালু হয়ে নেমে গেছে তৃণভূমি। তার পরে ঘন বন। তিন পাশেই, বেশ কিছুটা দূরে মাথা তুলেছে গ্র্যানিটের পাহাড়। রোদে চকচক করছে। পেছনে প্রায় দুশো ফুট উঁচু আরেকটা পাহাড়, দুই প্রান্তই ঢালু হয়ে গিয়ে ঢুকেছে পাইন বনের ভেতরে। উত্তরের পাহাড় চূড়ার জন্যে দেখা যাচ্ছে না তার ওপাশে কি আছে।

লোকালয়ে কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না। ডায়মণ্ড লেক এখান থেকে কম করে হলেও তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরে হবে। উত্তরের চূড়াটা না থাকলে হয়তো চোখে পড়ত। তবে আকাশ থেকে নিচের জিনিস যতটা ভালভাবে দেখা যায়, নিচে থেকে যায় না।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রবিন নিচের তরাই অঞ্চল। অন্য কোন সময় হলে, অর্থাৎ পরিস্থিতি ভাল থাকলে জায়গাকে খুব সুন্দর বলত সে। চোখা হয়ে উঠে যাওয়া চূড়া, নিচের সবুজ উপত্যকা, ঘন বন। এখন সে সব উপভোগ করার সময়। নেই। একটা কথাই বার বার পীড়িত করছে মনকে, ওরা এখানে একা। নির্জন এক পার্বত্য এলাকায় নামতে বাধ্য হয়েছে ওরা। সাথে খাবার নেই, পানি নেই। রেডিও, ক্যাম্প করার সরঞ্জাম কিছুই নেই। বাঁচবে কি করে?

যেন তার মনের কথাটাই পড়তে পেরে ক্লান্ত স্বরে মিলফোর্ড বললেন, শোনো। তোমরা, এসব বুনো এলাকায় কি করে বেঁচে থাকতে হয় জানা আছে তো?

.

০৩.

কতটা বেশি ঠাণ্ডা পড়বে এখানে? বাবাকে জিজ্ঞেস করল রবিন।

উষ্ণ রোদে আরাম করে বসে আছ দুজনে। কিশোর আর মুসা পানি রাখার জন্যে একটা পাত্র পাওয়া জায় কি-না খুঁজে দেখতে গেছে বিমানের ভেতরে। মেডিক্যাল কিটও দরকার।

 আবহাওয়া এখন ততটা খারাপ হবে না, মিলফোর্ড বললেন। আগস্ট মাস তো, ঠাণ্ডায় জমে মরার ভয় নেই। রাতে তাপমাত্রা চল্লিশের নিচে নামবে বলে মনে হয় না।

চল্লিশ! ভুরু ওপর দিকে উঠে গেল রবিনের। ঠাণ্ডাই তো!

তা একরকম ধরতে পারো, হাসলেন মিলফোর্ড। হাজার হোক ক্যালিফোর্নিয়া…

হ্যাঁ, ক্যালিফোর্নিয়া তো বটেই, মুসা বলল। বিমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এগোনোর সময় মিলফোর্ডের কথা কানে গেছে তার। যত সব গণ্ডগোলের আখড়া। আবহাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা নেই। মুসার হাতে একটা ধাতব বাক্স।

শীত সহ্য করার মত শরীর নয় আমাদের, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল রবিন সে-ই জানে।

মুসার পেট গুড়গুড় করে উঠল। ক্ষুধা সহ্য করার মতও নয়। ভাবছিলাম, ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে পেট পুরে ভেড়ার কাবাব খাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়ল সে। গেল সব!

একমত হয়ে মাথা জাঁকালেন ফিলফোর্ড আর রবিন। খিদে তাঁদেরও পেয়েছে।

ডায়েট কন্ট্রোল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।

দেখো, কিশোর কি বলে? করুণ হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। কিছু একটা আবিষ্কার করেই ফেলবে–মনে নেই, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে…

হ্যাঁ, তা তো আছেই। পিঁপড়ের ডিম আর শুয়াপোকা খাওয়াবে আর কি শেষে… বিমান দুর্ঘটনা।

বাধা দিয়ে মিলফোর্ড বললেন, অতটা নিরাশ হচ্ছ কেন? বেরিয়ে যাওয়ার একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। আমাদের মে-ডে কারও কানে যেতেও পারে। ওয়ান টোয়েন্টি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ মেগাহার্টজে এখন ব্রডকাস্ট চলছে।

আপনি শিওর? ভরসা করতে পারছে না মুসা। সত্যিই চলছে রেডিওটা?

চলার তো কথা। ব্যাটারিতে চলে। জোরে ধাক্কা কিংবা বাড়ি খেলেই আপনাআপনি চালু হয়ে যায়। এমনও শোনা গেছে, হাত থেকে টেবিলের ওপর। পড়ে গেলেও চালু হয়ে যায়।

নীল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। অনেক ওপরে ধোয়ার হালকা একটা সাদা রেখা চোখে পড়ছে। একটা জেট বিমান যাওয়ার চিহ্ন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিলফোর্ড বললেন, ওখান থেকে আমাদেরকে দেখতে পাবে না, ঠিক, তবে আমাদের এস ও এস শুনতে বাধা নেই।

অনেক দূরে চলে গেছে বিমানটা। ছোট হয়ে এসেছে, মিলিয়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল রবিন। অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন। পরিস্থিতি খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাবা এমন সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে ওর। আশা হচ্ছে এখন, ওদেরকে উদ্ধার করতে আসবেই কেউ না কেউ। মুসার হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?

ইমারজেন্সি কিট। অনেক জঞ্জালের ভেতর থেকে বের করেছি। দেখো না, কি ধুলো লেগে আছে।

হু।

বাক্সটা খোলা হলো। ভেতরে রয়েছে অ্যাসপিরিন, বায়োডিগ্রেডেবল সোপ, ব্যাণ্ডেজ, মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্কিন অ্যানটিবায়োটিক, পানি পরিশোধিত করার আয়োডিন পিল, এক বাক্স দিয়াশলাই, আর ছয়টা হালকা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট। চকচকে এক ধরনের জিনিস দিয়ে এত পাতলা করে বানানো, ভাঁজ করে নিলে খুব অল্প জায়গার ভেতরে ভরে রাখা যায়।

দিয়াশলাই! খুশি হয়ে উঠেছে রবিন, যাক, আগুনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

আয়োডিন পিল আছে যখন, মিলফোর্ড বললেন, খাবার পানিও পেয়ে যাব।

এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে মহাকাশচারীদের কাজে লাগে, একটা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট খুলল মুসা। একটা ধার ঢুকিয়ে দিল টি-শার্টের গলা দিয়ে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? রক স্টারের মত লাগছে?

জবাব দিল না রবিন। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার কপালের জখমটায় পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাধল। কাটাটা খুব বেশি না, তবে বাড়িটা লেগেছে বেশ জোরেই। অনেকখানি উঁচু হয়ে ফুলে গেছে। বেগুনী রঙ।

 ফোলা মাংসে আঙুল দিয়ে চাপ দিল রবিন। উহ করে উঠলেন মিলফোর্ড। বেশি ব্যথা লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন। বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ো। মাথায় বাড়ি লাগা ভাল না! বমি বমি লাগছে? মাথা ঘোরে…

একেবারে ডাক্তার হয়ে গেলি যে রে! হেসে বললেন মিলফোর্ড। রেড ক্রসের ট্রেনিং নিয়ে ভালই হয়েছে…।

আমারও তাই বিশ্বাস। এখন চুপ কর তো! খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।

ব্ল্যাঙ্কেটটা আবার আগের মত ভাজ করে রেখে দিল মুসা। তারপর রওনা। হলো তৃণভূমির কিনারে, আগুন জ্বালানোর জন্যে লাকড়ি জোগাড় করতে। প্রথমে। যেখানটায় আশ্রয় নিয়েছিল, বিমান বিস্ফোরিত হলে আত্মরক্ষার জন্যে, সেখানটায় এসে জড় করল কাঠকুটো। আগুন যদি জ্বালতেই হয়, জ্বালবে বিমান আর ট্যাঙ্কের পেট্রোল থেকে দূরে। সাবধান থাকা ভাল।

সেসনার ভেতরে রয়েছে এখনও কিশোর। একটা পানির পাত্র খুঁজছে। আচমকা চিৎকার উঠল, অ্যাই, শুনছ তোমরা, একটা গোলমাল হয়ে গেল!

বিমানের কাছে দৌড়ে এল মুসা আর রবিন। ওদের পেছনে এলেন মিলফোর্ড।

যন্ত্রটা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর, কাজ করছে না। মে-ডে পাঠানোর কথা যেটার।

কেন? জানতে চাইলেন মিলফোর্ড।

বাক্সটা খুলল কিশোর। লাল একটা আলো জ্বলে-নিভে সঙ্কেত দেয়ার কথা। ওটা দেখে বোঝা যায় যে, সঙ্কেত দিচ্ছে যন্ত্রটা। তারটার আর কানেকশনগুলো। ঠিকই আছে। গোলমালটা ব্যাটারির। মনে হয় ডেড।

ডেড? হতাশার ভঙ্গিতে প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন।

তার মানে সাহায্য চেয়ে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না? মুসাও খুব হতাশ। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।

ব্যাটারি না থাকলে পাঠাবে কি করে? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল কিশোর।

খাইছে! হাতের আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল মুসার। বেড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের গতি, অ্যাড্রেনালিন পাম্প করতে আরম্ভ করেছে। কি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে।

প্রথমে গেল ইলেকট্রিক সিসটেম, আনমনে মাথা নাড়ছে রবিন, এখন ব্যাটারি! অসুস্থই বোধ করছে সে।

গেলাম তাহলে আমরা! মুসা বলল।

ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম মাঝে মাঝে খারাপ হয়, মিলফোর্ড বললেন, যদিও খুব রেয়ার। কানেকশনে গোলমাল থাকলে হয়। তবে ব্যাটারি খারাপ হয় না, ফুরিয়ে যায়। বদলে নিলেই হয়। আসলে, চেক করেনি, নতুন ব্যাটারিও আর লাগায়নি। ভুলের জন্যেই এটা ঘটল।

আর এই ভুলের কারণেই মরতে বসেছি আমরা, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা।

কিন্তু কিছু করার নেই। পাইনের বন থেকে শিস কেটে বেরিয়ে আসছে বাতাস, বয়ে যাচ্ছে বিশাল ঘেসো প্রান্তরের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। ওদের পেছনে ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশে মাথা তুলে রেখেছে পর্বতের চূড়া।

বেহশত, আবার আনমনে মাথা নাড়তে লাগল রবিন সেদিকে তাকিয়ে।

দেখেই মজে যাওয়ার কোন কারণ নেই, সাবধান করলেন মিলফোর্ড। শোননি, স্বর্গেও সাপ থাকে।

আমি মজিনি, কিশোর বলল। এখানে কি কি থাকতে পারে, ভাল করেই জানি। বিষাক্ত সাপ, হিংস্র মাংসাশী জানোয়ার, ভূমিধস, দাবানল, বজ্রপাত, আর আরও হাজারটা বিপদ ওত পেতে আছে। ফল ধরে থাকতে দেখা যাবে গাছে গাছে, দেখলেই খেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু খেলেই মরতে হবে, এতই বিষাক্ত।

আচ্ছা, হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল রবিন, বাবা, ডায়মণ্ড লেকে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, সে কি করবে? সময়মত তুমি না পৌঁছলে কিছু করবে না?

হয়তো করবে। ফোন করবে আমার অফিসে। ও না করলে আর কেউ করবে না। বাড়িতে বলে এসেছি আমরা সবাই, দিন তিনেক লাগতে পারে। তিন। দিন না গেলে কেউ খবর নেয়ার কথা ভাববেই না।

বাহ, চমৎকার! বিড়বিড় করল মুসা।

মুসা, অত ভেঙে পড়ছ কেন? এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক পড়েছ তোমরা। দুর্গম জায়গায় আটকা পড়েছ, বেঁচে ফিরেও এসেছ। এসব অবস্থায় প্রথমে কি করা উচিত?

প্রথমে দেখা দরকার, কি কি জিনিস আছে আমাদের কাছে। আমার কাছে আছে গায়ের এই পোশাক।

মুসার পরনে জিনস, পায়ে টেনিস শু, গায়ে কালো টি-শার্ট, বুকে সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখাঃ পিঙ্ক ফ্লয়েড। একটা জ্যাকেট আছে, একটা ছোট ছুরি আছে, সুটকেসে আরও কিছু কাপড় আছে। রবিন আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাছে কি আছে?

আমার কাছেও এইই, রবিন বলল। ওর জিনসে রয়েছে ক্যালভিন ক্লেইন, আর টি-শার্টে ব্যানানা রিপাবলিক মিনিস্টার অভ কালচার-এর মনোগ্রাম। ছুরিটা বাদ।

আমার কাছেও ছুরি নেই, মিলফোর্ড বললেন। তার পরনে জিনসের প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় ক্যাপ।

ক্যাম্পিঙের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ একটা ব্যাকপ্যাক থাকলে এখন খুবই ভাল হত, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তবে মনে হয় তিনটে দিন কাটিয়ে দিতে পারব কোনমতে। প্রতিকূল পরিবেশ, খাওয়াও তেমন জুটবে বলে মনে হয় না, তবু…

তেমন জুটবে, না মানে? কথাটা ধরল রবিন। তার মানে কিছু খাবার তোমার কাছে আছে?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, খাবার আমার কাছে নেই, তবে…

তবে কি? তর সইছে না মুসার। জলদি বল!

যে ভাবে বলছ, কিশোর বলল, ধরেই নিয়েছ, খাবার আছে আমার কাছে।

না হলে বললে কেন?

 হ্যাঁ, বাবাআ, মিলফোর্ডও অধৈর্য হয়ে উঠছেন, থাকলে বের কর না!

শ্রাগ করল কিশোর। আসছি, বলে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিমানের ভেতরে।

এত দেরি কেন? বাইরে থেকে ডেকে বলল মুসা, মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করছ নাকি?

একটা ডাফেল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। টকটকে লালের ওপর সাদা সাদা ডোরা। চট করে চোখে পড়বার জন্যে বেশ কায়দা করে লেখা রয়েছেঃ আই কেম ফ্রম, পিজা হ্যাঁভেন, ই। কাগজে মোড়া কিছু হালকা খাবার আর ক্যাণ্ডি বের করল সে।

দাও দাও, জলদি দাও! হাত বাড়াল মুসা। আর পারি না…

খাবারগুলো ভাগাভাগি করে নিল ওরা। সাধারণ জিনিস, এখন সেগুলোই রাজকীয় মনে হলো।

এগুলো আনতে গেলে কেন? ক্যাণ্ডিতে কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন।

মনে করলাম, কিশোরের জবাব, প্লেনে যদি খিদে লাগে। নিয়ে নিলাম।

খুব ভাল করেছ, মুসা বলল। জীবনে যে কটা সত্যিকারের ভাল কাজ করেছ, তার মধ্যে এটা একটা।

তার কথার ধরনে হাসলেন মিলফোর্ড। হ্যাঁ, বি থাকলে বুদ্ধিটাও খোলে।

সেটা খোলানর জন্যেই যেন খাওয়া শেষ করার পর বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ মুদে ভাবতে শুরু করল কিশোর।

 নিজের ভাগের খাবার চেটেপুটে খেয়ে মিলফোর্ড বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, কিশোর। খাবার যা বাকি আছে, যত্ন করে রেখে দাও। তিনদিন ধরে অল্প অল্প। করে খেতে হবে। বলা যায় না, তিনদিনের বেশিও থাকতে হতে পারে আমাদের।

ওঠা যাক এবার, মুসা বলল। বসে থাকলে হবে না। ঘুরে দেখে আসা। দরকার, আশেপাশে ঘরবাড়ি, আছে কি-না। রেঞ্জারের কেবিন থাকতে পারে। কিংবা ক্যাম্পগ্রাউণ্ড, কিংবা রাস্তা। পানিও লাগবে আমাদের। লাকড়ি কুড়ানোর সময় পানির শব্দ শুনছিলাম। কাছেই কোথাও ঝর্না আছে। হাত তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দেখাল সে। ঝর্নার ধারেই করা হয় ক্যাম্পগ্রাউণ্ডগুলো, কাজেই…

..থাকলে ওদিকটায় থাকতে পারে, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। বিমানের ভেতর থেকে দুই কোয়ার্টের একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করে এনে মুসাকে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও। পানি আনতে পারবে।

কমলার রস ছিল বোতলটায়, এখন খালি। আগ্রহের সঙ্গে সেটা হাতে নিয়ে মুসা বলল, গুড। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ওটা, ফুটোটুটো আছে কিনা। নেই। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও। সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তারপর পানি ভরবে। আয়োডিন পিল ফেলে দেবে ভেতরে, যাতে নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।

বোতলটা নিল রবিন। তুমি কি করবে?

দক্ষিণে হাত তুলল আবার মুসা। ওদিকে বনের ভেতরে একটা পায়েচলা পথ। ঢুকে গেছে দেখেছি। বুনো জানোয়ার চলার পথ হতে পারে। বলা যায় না, কপাল। খুলেও যেতে পারে। হয়ত মানুষেই তৈরি করেছে ওটা।

ভাল বলেছ, মিলফোর্ড বললেন। যাও, দেখ গিয়ে। আমি ওটাতে চড়ব। তৃণভূমির উত্তর ধার দিয়ে চলে যাওয়া গ্র্যানিটের দেয়ালটা দেখলেন তিনি। একপাশে বেশ ঢালু, চূড়ায় চড়া সহজ। ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। কি আছে না আছে দেখতে পারব।

পারবে? রবিন বলল, ভাল লাগছে কিছুটা?

 পারব।

কিশোর কি করবে সেটা জানার জন্যে তার দিকে তাকাল তিনজনে।

প্রশ্ন করতে হলো না, কিশোর নিজে নিজেই বলল, আ-আমার মনে হয়…আমার এখানে থাকাই ভাল। কেউ যদি চলে আসে, তাকে বলতে হবে তো আমরা আছি এখানে, চলে যাইনি।

আরও লাকড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ভেজা লাকড়ি। বেশি করে জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে অনেক ধোয়া বেরোবে। সঙ্কেত দিতে পারব। স্মোক সিগন্যাল। এই কাজটা তুমি করতে পার, প্লেনের কাছ থেকে দূরে যাওয়া লাগবে না। আরও একটা কাজ, আমাদের সবার সুটকেস থেকেই কিছু কাপড় বের করে তিন-চারটা গাছের মগডালে পতাকার মত উড়িয়ে দিতে পার। আরেক ধরনের সিগন্যাল হয়ে যাবে।

মুসার কথা কিশোর শুনছে বলে মনে হলো না, বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে শূন্য দৃষ্টিতে কাজ করার ইচ্ছে নেই, না গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে, বোঝা গেল না। মুসা বলেই চলেছে, তারপর, পাথর টেনে মাঠের মাঝে সেগুলো সাজিয়ে এস ও এস লিখবে, যাতে ওপর থেকে কোন প্লেনের চোখে পড়লে বুঝতে পারে এখানে গোলমাল হয়েছে।

গুঙিয়ে উঠল কিশোর। কাঠ দিয়ে একটা কেবিন বানানোর কথাটা আর বাকি রাখলে কেন?

হেসে উঠল অন্য দুজন, রবিন আর তার বাবা।

লাকড়ি কুড়াতে রাজি আছি আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল কিশোর। আর কিছু পারব না।

তাহলে অনেক বেশি করে আনতে হবে, মুসা বলল। কম হলে চলবে না। অনেক বড় ধোয়া হওয়া চাই…

আসলে আমার বসে থাকাটা সহ্য করতে পারছ না তুমি…

কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রবিন বলল, মুসা, তুমি আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছ। আমাদেরকে খাইয়েছে ও। কাজেই এখন ওর কাজগুলো ভাগাভাগি করে আমাদেরই করে দেয়া উচিত। না কি বলো?

তাই তো। এতক্ষণে যেন টনক নড়ল মুসার। চুপ হয়ে গেল। মাথা চুলকে আমতা আমতা করতে লাগল, ইয়ে…মানে…ইয়ে…

হেসে ফেলল এবার কিশোর। মুসাও হাসল। চলি।

হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড, চিহ্ন দিয়ে দিয়ে যেও কিন্তু। নইলে বনের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলবে।

তৃণভূমির কিনারে এসে আলাদা হয়ে গেল রবিন আর মুসা। দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে পাইন বনে ঢুকে পড়ল রবিন। পানির মৃদু শব্দ কানে আসছে তার। সেদিকেই চলল। মুসা ঢুকল দক্ষিণ-পুবের সরু পায়ে চলা পথটা ধরে।

মা বাবার কথা মনে আছে রবিনের। চিহ্ন রেখে যাওয়া দরকার। আশপাশে কোথায় কি আছে না আছে ভাল করে দেখে দেখে চলতে হয়, বনে চলার এটাই নিয়ম, বিশেষ করে অপরিচিত এলাকায়। একটা ট্রিপল পাইন চোখে পড়ল তার। একই জায়গা থেকে তিনটে চারাগাছ গজিয়েছিল, একই গোড়া থেকে, গায়ে গায়ে লেগে সেগুলো এখন একটা হয়ে গেছে। এটা একটা ভাল চিহ্ন। ওরকম ট্রিপল পাইন খুব কম দেখা যায়। তারপর সে পেরোল একটা চ্যাপ্টা পাথর, মাঝখানটা। গামলার মত, বেশ বড়। আদিম ইণ্ডিয়ানরা সম্ভবত পাথর দিয়ে ওখানে কোন ধরনের বাদাম গুড়ো করে আটা তৈরি করত। আরও কিছু চিহ্ন মনে গেঁথে রাখল। সে। অবশেষে খুঁজে পেল পথটা। দেখেটেখে মনে হল জানোয়ারই চলাচল করে। সেই পথ ধরে এগোল সে। কানে আসছে পানির শব্দ, বাড়ছে ক্রমেই।

তারপর হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটা, বিশ ফুট চওড়া অগভীর একটা নদী। পানিতে বড় বড় পাথর আর ডালপালার ছড়াছড়ি, নদীর বুকে বিছিয়ে রয়েছে নুড়ি। যেখানটায় রোদ পড়ছে চকচক করছে পানি, আর বনের ভেতর দিয়ে যেখানে গেছে, গাছপালার ছায়া পড়েছে, কালো হয়ে আছে সেখানে। টলটলে পরিষ্কার পানি, নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় মনে হয়।

বায়োডিগ্রেডেবল সাবান দিয়ে কমলার রসের বোতলটা ভালমত ধুয়ে নিল রবিন। ঝাড়া দিয়ে ভেতরের পানির কণা যতটা সম্ভব ফেলে দিয়ে পরে রোদে শুকিয়ে নিল। পানি ভরে তাতে আয়োডিন পিল ফেলে দিল।

উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী নদীর এপাশ ওপাশ ভাল করে দেখতে লাগল সে। লোকজন কি আছে? ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকলে নদীর পাড়েই কোথাও আছে। কোথায়? উজানে, না ভাটিতে?

বিমান থেকে দেখা উপত্যকাটার কথা ভাবল সে। তৃণভূমির পশ্চিমেই কোথাও রয়েছে। ওর অনুমান ঠিক হলে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উত্তরে থাকবে উপত্যকাটা। এত সুন্দর একটা জায়গায় ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকাটা স্বাভাবিক।

উজানের দিকে রওনা হল রবিন। নদীর তীর ধরে। বড় পাথর আর গাছপালা পড়ছে মাঝে মাঝেই, ঘুরে ওগুলো পার হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও জন্মে আছে কাটাঝোপ, কোথাও বা জলজ উদ্ভিদ পানি থেকে উঠে এসেছে পাড়ের ভেজা মাটিতে। যতই এগোচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে।

 কয়েকটা লাল ম্যানজানিটা গাছ জটলা করে জন্মে রয়েছে এক জায়গায়, সেটার পাশ ঘুরে একটুকরো খোলা জায়গায় বেরোল সে। নদীতে এখানে তীব্র স্রোত। ওপর থেকে অনেকটা জলপ্রপাতের মত ঝরে পড়ছে পানি।

অপরূপ দৃশ্য। কোটি কোটি মৌমাছির মিলিত গুঞ্জন তুলে পড়ছে পানি, অসংখ্য ঘূর্ণিপাক তৈরি করে ছুটে চলেছে ভাটির দিকে।

বাতাসে পানির কণা। ভেজা বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে রবিনকে। জলপ্রপাত থেকে ধীরে ধীরে ওপর দিকে দৃষ্টি ভুলতে লাগল সে। নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রপাতের দুদিক থেকে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়া। কঠিন পাথরে গভীর নালা কেটে দিয়েছে পানি।

বিমান থেকে দেখা প্রপাতটা যদি এটাই হয়, তাহলে উপত্যকাটা রয়েছে। পাহাড়ের ওই পাশেই। দেখতে হলে ওই পাহাড়ে চড়তে হবে, পাথরের দেয়াল বেয়ে। প্রশ্ন হলো, কোনখান থেকে শুরু করবে?

গ্র্যানিটের দেয়ালে একটা জায়গা দেখা গেল, যেখানে পাথরে চিড় ধরে আছে, পা রাখা যাবে ওখানটায়। পানির বোতলটা রেখে, পাথরের একটা স্তূপ পেরিয়ে চিড়টার কাছে চলে এল সে। উঠতে শুরু করল দেয়াল বেয়ে। পা লাগলেই খসে যাচ্ছে আলগা পাথর, ঠোকর খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে নিচে। পা ফসকালে রবিনকেও ওভাবেই পড়তে হবে, কাজেই সাবধান রইল। খুব ধীরে, দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড় ধরে, পাথরের খাঁজে পা রেখেই উঠে চলল সে।

হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা।

ওপর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট নুড়ি এসে পড়ল তার মাথায়। গুমগুম শব্দ কানে এল।

ওপরে তাকাল সে। বিশাল এক পাথর নেমে আসছে, সঙ্গে নিয়ে আসছে ছোট বড় আরও একগাদা পাথর, মাটি, ধুলো, ওর সামান্য ডানে।

ধস নেমেছে পাহাড়ে! ধেয়ে আসছে তাকে থেঁতলে দেয়ার জন্যে।

Super User