তিন গোয়েন্দা – ভলিউম ২৯ – মায়াজাল
প্রথম প্রকাশ
: সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮

০১.

রবিনের টোকার সাড়া দিল না সোফি।

পাশে দাঁড়ানো মারলার দিকে তাকাল। রবিন। আবার টোকা দিল দরজায়। জবাব নেই এবারেও। উঁকি দিয়ে দেখল রান্নাঘরের টেবিলে ঘাড় গুঁজে বসে আছে সোফি। অবাক হলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

সোফির সামনে টেবিলে বিছানো একটা পত্রিকা। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস।

কি হয়েছে, সোফি? জিজ্ঞেস করল মারলা। খবর সব ভাল তো?

জবাব দিল না সোফি। দুহাতে গাল চেপে ধরে তেমনি ভঙ্গিতে বসে আছে। অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ ও, জানা আছে মারলার। তবু অবাক লাগল। আচরণটা স্বাভাবিক নয়।

সোফির পেছনে এসে পিঠে হাত রাখল রবিন, খুব খারাপ কিছু?

গাল থেকে হাত সরিয়ে মুখ তুলে তাকাল সোফি। চোখ লাল। কোন কথা না বলে কাগজের নিচ থেকে গোলাপী রঙের একটা খাম বের করল। বাড়িয়ে ধরল সেটা। হাত কাঁপছে।

কি এটা? বলতে বলতে খামটা নিল রবিন। মুখ খোলা। ভেতর থেকে বের করল একটা চিঠি। অদ্ভুত চিঠি। লিখেছে:

শোনো,
তোমার ধারণা তুমি আমাকে চেনো। আসলে চেনো না। হয়তো ভাবছ আমি তোমার বন্ধু। না, তা-ও নই। আমি তোমার তত্ত্বাবধায়ক। তোমার ভালমন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব এখন থেকে আমার। মন দিয়ে শোনো।
এই চিঠির নিচে একসারি নাম দেখতে পাচ্ছ। সবার ওপরে রয়েছে। তোমার নামটা। তুমি যে আমার বাধ্য আছ তার ছোট্ট একটা প্রমাণ দিতে হবে। তারপর তোমার নামটা সারির ওপর থেকে কেটে পাশের তারকাচিহ্নের যে কোনও এককোণার ভেতরে লিখে দেবে। একবার তারকায় ঢুকে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই, ওখানেই থাকবে তুমি, বেরোনোর প্রয়োজন হবে না।
সাবধান: আবার বলছি–তারকার কোণায় লিখবে, ভুলেও মাঝখানে নয়। তাহলে সেটাকে তোমার অবাধ্যতা ধরে নেব আমি। মারাত্মক বিপদে পড়বে। আমার কথামত কাজ সেরে তোমার পরের নামটা যার চিঠিটা ত্বর কাছে পাঠিয়ে দেবে। তোমাকে কি করতে হবে সেই নির্দেশ পাবে টাইমস পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতায় একটা বক্সের মধ্যে। তারকাচিহ্ন আঁকা থাকবে বিজ্ঞপ্তির ওপর। সুতরাং চিনতে অসুবিধে হবে না কোনটা তোমার জন্যে। অক্ষরগুলো সব উল্টোভাবে লেখা থাকবে–যেমন dog-কে লেখা হবে god। ঠিকমত সাজিয়ে নিলেই পেয়ে যাবে আসল বাক্যটা। চিঠি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে অবশ্যই তোমাকে তোমার বাধ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
তালিকায় বাকি যাদের নাম আছে ইচ্ছে করলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারো। বাধা নেই। আমার ধারণা, আমার মতই ওরাও তোমার বন্ধু নয়, মুখে যতই বন্ধু বন্ধ করুক। তালিকার বাইরে কারও সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করবে না। যদি করো, রেগে যাব আমি।
একটা কথা পরিষ্কারভাবে জেনে রাখো, তোমাদের গোপন কথাটা জানি আমি। কিন্তু সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। পুলিশকে জানাতে যাব না।
আমার কথার অবাধ্য হলে মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করবে তোমার জন্যে। ভয়ঙ্করভাবে মৃত্যু ঘটবে তোমার।
–তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক।

চিঠিটা পড়ে মারলার হাতে দিল রবিন।  

মারলা পড়ে বলে উঠল, দূর, যত্তোসব ছাগলামি। কেউ রসিকতা। করেছে। দলামোচড়া করে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, বাধা দিল রবিন, দাঁড়াও। দেখি, দাও তো। আরেকবার পড়ে দেখি।

পড়ে দেখার কিছু নেই, রাগ করে বলল মারলা। যে পাঁচজনের নাম আছে এটাতে, তাদের কেউই পাঠিয়েছে ভয় দেখানোর জন্যে। ক্লডিয়া হতে পারে।

কেন, ড্যানিয়েল নয় কেন? ভুরু নাচাল রবিন।

হ্যাঁ, ড্যানিয়েলও হতে পারে। রবিনের দিকে তাকাল মারলা। বাজে রসিকতার অভ্যাস আছে ওদের দুজনেরই। ফেলো ওটা। অ্যাই সোফি, গুম হয়ে বসে না থেকে ওঠো তো। চলো, বারগার খেয়ে আসি মলে গিয়ে। কিছু কেনাকাটাও আছে আমার।

যাও তোমরা। আমি বাড়ি যাব। সোফি, বইটা দাও তো, কাল যেটা এনেছিলে। পড়া শেষ হয়নি আমার।

ওদের কথা, যেন কানেই ঢুকল না সোফির। ফিসফিস করে বলল, উড়িয়ে দিয়ো না ব্যাপারটাকে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও কিন্তু দিয়েছে। এই দেখো।

পড়ে ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। তত্ত্বাবধায়ক লিখেছে: বৃহস্পতিবারের মধ্যে তোমার কুকুরছানাটাকে পানিতে চুবিয়ে মারো, সোফি।

বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকাল রবিন, হু, বললেই হলো। ফাজলেমি পেয়েছে। পাত্তাই দিয়ো না এসবে।

বিজ্ঞাপনটার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বলল মারলা, এ কাজ ক্লডিয়া ছাড়া আর কারও নয়। কারণ ও মানসিক রোগী।

কিন্তু রোগী হলেও ক্লডিয়া জন্তু-জানোয়ার অপছন্দ করে না, রবিন বলল। ও নিজে যখন কুত্তা পালে সোফির কুকুরটাকে মারতে বলবে, এ কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আর বললেই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে না একথাও জানে ক্লডিয়া। ভয়টা আসলে দেখাতে চেয়েছে অন্য কেউ।

আরেকবার চিঠিটার দিকে তাকাল রবিন। টাইপরাইটারে টাইপ করা। বিড়বিড় করে বলল, তত্ত্বাবধায়ক আসলে কি চাইছে বুঝতে পারছি নাঃ.

রেগে উঠল মারলা, এর মধ্যে বোঝাবুঝির কি আছে? স্রেফ ভয় দেখানোর জন্যে করেছে এই কাজ। সোফি ভয় পাচ্ছে ভেবে এখন নিশ্চয় একা একাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফেলো ওটা, ফেলে দাও। সোফি, ওঠো তো। চলো।

চেয়ারে বসল রবিন। চিঠির নামগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মুসার নামও আছে। কিন্তু আমারটা নেই কেন?

কিশোরেরও তো নেই। তাতে কি হয়েছে?

কিশোরের না থাকার একটা যুক্তি আছে। ও এখন রকি বীচে নেই। তা ছাড়া সেদিন রাতে আমাদের সঙ্গে গাড়িতেও ছিল না। কিন্তু আমি তো গাড়িতেও ছিলাম, বাড়ি থেকেও চলে যাইনি। আমারটা নেই কেন?

তোমার কথা ভুলে গেছে আরকি। সেজন্যেই তো বলছি, রসিকতা।

গম্ভীর হয়ে ভাবছে রবিন। তার বিশ্বাস, রসিকতা করেনি তত্ত্বাবধায়ক। যা করতে বলেছে, সত্যিই চায় সেটা করা হোক। নইলে বিপদ ঘটাবে। ওদের গোপন কথা জানে বলে কি বোঝাতে চেয়েছে? মরুভূমিতে ওরা যে। অ্যাক্সিডেন্টটা করে এসেছে সেটার কথা? এ ছাড়া আর তো কোন, গোপনীয়তা নেই ওদের।

কনসার্ট শুনতে গিয়েছিল সেদিন ওরা। চিঠিতে যাদের নাম রয়েছে, সবাই গিয়েছিল। দিন পনেরো আগে পঁচটা টিকেট এসেছিল ডাকে। কে পাঠিয়েছে জানা যায়নি। সকাল বেলা যার যার বাড়ির ডাকবাক্সে খামের মধ্যে একটা করে টিকেট পেয়েছে সবাই। সেই সঙ্গে একটা করে নোট। তাতে কার কার কাছে টিকেট পাঠানো হয়েছে, নাম লেখা ছিল। অবিকল একই ধরনের নোট পেয়েছে সকলেই।

ভেবেছে ওদেরই কোন বন্ধু মজা করার জন্যে একাজ করেছে। পরে বলে চমকে দেবে। কোনকিছু সন্দেহ না করে কনসার্ট দেখতে গিয়েছিল ওরা মরুভূমির কাছে একটা শহরে।

রাতের বেলা মরুভূমির মাঝের রাস্তা দিয়ে আসার সময় বাজি ধরে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়েছিল ড্যানি। অন্ধকারে দেখতে পায়নি লোকটাকে। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক পেরোতেই করল অ্যাক্সিডেন্ট। কিভাবে যে চাকার নিচে এসে পড়ল লোকটা বলতেও পারবে না সে। গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল। মারা গিয়েছিল লোকটা। পরিচয় জানার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে ওরা। পকেটে মানিব্যাগ ছিল না, আইডেন্টিটি ছিল না, ভিজিটিং কার্ড ছিল না লোকটার। সে যে কে, জানার কোন উপায় ছিল না। ওকে নিয়ে, কি করা যায়, একেকজন একেক কথা বলা শুরু করল। কেউ বলল পুলিশকে জানাতে, কেউ করল বিরোধিতা। পুলিশকে জানাতে গেলে বিপদে পড়ার ভয়ে শেষে মরুভূমির মাঝেই লোকটাকে কবর দিয়ে এসেছে ওরা। এ কাজে মুসা আর রবিনের একেবারেই মত ছিল না। ড্যানির আতঙ্কিত অবস্থা দেখে আর অনুরোধ ঠেকাতে না পেরে শেষে চুপ হয়ে গেছে,

 রবিনের দিকে তাকাল মারলা। তুমিও মনে হয় চিঠিটাকে সোফির মত সিরিয়াসলি নিয়েছ?

হ্যাঁ, না নিয়ে উপায় নেই। আমাদের গোপন কথা জানে বলেছে। আর গোপন কথাটা যে কি, সেটা তুমিও জানো, উঠে দাঁড়াল রবিন। মুসা আর ড্যানির সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ক্লডিয়াই বা বাকি থাকে কেন তাহলে? মারলা বলল। আমি নিজে তাকে ফোন করে জানিয়ে দেব যে তার চিঠিটা পেয়ে পেটে মোচড় দেয়া শুরু হয়ে গেছে আমাদের। হেসে আরও গড়াগড়ি খাক।

মারলার ব্যঙ্গতে কান দিল না রবিন। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে রাখল ফোনের পাশে। রিসিভার তুলে ডায়াল করল।

 বাড়িতে নেই মুসা। ওর বাবা-মাও নেই। বেড়াতে গেছেন। আরও অন্তত এক হপ্তার আগে ফিরবেন না। বাড়িতে একা থাকে মুসা। অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজটা রেখে ড্যানির নম্বরে ডায়াল করল রবিন। তাকেও পাওয়া গেল না। আবার অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রাখতে হলো। তারপর খানিকটা দ্বিধা করেই ক্লডিয়াদের বাড়ির নম্বরে ফোন করল। সে-ও বাড়িতে নেই। এই ছুটির সময়টায় কাউকে পাওয়া যায় না। সবাই যেন বাড়ি ছাড়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। অগত্যা ওখানেও অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রাখতে হলো।

রিসিভার নামিয়ে রেখে এসে বলল রবিন, কারও ফোন না আসা পর্যন্ত ভাবছি এখানেই বসে থাকব।

 কি যে বলো না, মুখ বাঁকাল মারলা। ফালতু একটা চিঠির জন্যে ঘরে বসে থাকব? সারাটা দিন নষ্ট! ঠিক আছে, তোমাদের ইচ্ছে হলে থাকো। আমি যাচ্ছি। হাত বাড়াল রবিনের দিকে, গাড়ির চাবিটা দাও। মলে আমাকে যেতেই হবে।

চুপ করে বসে থাকো তো! কিছুটা কড়া স্বরেই বলল রবিন। তোমাদের চাপে পড়ে একটা বোকামি তো করেই এসেছি সেদিন মরুভূমিতে। আর কোন কথা শুনছি না। গোপন কথা জানে যদি না বলত, পাত্তা দিতাম না। আমাদের দলের বাইরের কেউ যদি হয়ে থাকে, জেল খাঁটিয়ে ছেড়ে দিতে পারবে। রেকমেইল করে ঘুম-খাওয়া হারাম করে দিতে পারবে। এখন আমাদের সবার একসঙ্গে থাকা দরকার। কিছু ঘটলে একসঙ্গে সেটাকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

 হাল ছেড়ে দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল মারলা। অহেতুক দুশ্চিন্তা করছ তোমরা, আমি বলে দিলাম।

তোমার কথা সত্যি হলে তো বাঁচি।

এই সময় রান্নাঘরে ঢুকল সোফির কুকুরছানাটা। কাছে এসে আদর করে মনিবের হাত চাটতে শুরু করল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সোফি। মুখে। উদ্বেগের হাসি।

যে যতই বলুক আর ভয় দেখাক, দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে, টমিকে আমি চুবিয়ে মারতে পারব না।

প্রশ্নই ওঠে না, তার সঙ্গে সুর মেলাল রবিন। আরেকবার তাকাল অদ্ভুত চিঠিটার দিকে। দেখাই যাক না, কি করতে পারে সে!

.

০২.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মলে চলে এল মুসা। সেরাতে মরুভূমির ঘটনাটার পর মন প্রায় সময়ই খারাপ থাকে। খারাপ হয়ে আছে মনটা। খিদেও পেয়েছে। কিশোর নেই, নাহলে স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে আড্ডা দিতে পারত। রবিনও থাকছে ব্ল্যাক ফরেস্টে ওদের গোস্ট লেনের বাড়িতে।

রোদের মধ্যে গাড়িটা পার্ক করে রেখে একটা খাবারের দোকানে ঢুকল সে। আগে খেয়ে নেয়া যাক। তারপর ভাববে কোথায় যাবে। ম্যাকডোনাল্ডের তৈরি চিকেন বার্গার, পটেটো ফ্রাই আর কোকের অর্ডার দিল। সে। এই দোকানে পার্ট টাইম চাকরি করে সোফি। ওকে না দেখে ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করল সোফির কথা। ক্যাশিয়ার বলল, ডিউটি শেষ। করে চলে গেছে সোফি। সেদিন আর আসবে না।

খাবারগুলো নিয়ে গুডলাক ফাউনটেইনের পাশের টেবিলটায় এসে বসল মুসা। বিরাট হাঁ করে বার্গারে কামড় বসাল। চমৎকার বানায়। ওর খুব। পছন্দ। মজা করে চিবাতে চিবাতে তাকাল ঝর্নাটার দিকে। ওটার পানিতে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে কোন কিছু চাইলে নাকি ইচ্ছে পূরণ হয়। পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে ছুঁড়ে মারল সে। আস্তে করে গিয়ে অস্থির পানির নিচের ছোট গোল বেদিটাতে পড়ল পয়সাটা। ওখানে ফেলা খুব কঠিন কাজ। চাইবার মত কোন কিছু এ মুহূর্তে মনে পড়ল না মুসার। শেষে বলল, আমার মনটা ভাল হয়ে যাক।

বাহ, দারুণ হাত তত তোমার। সাংঘাতিক নিশানা, মেয়েলী কণ্ঠের হালকা হাসি মেশানো কথা শুনে ফিরে তাকাল মুসা।

পাশের টেবিলে বসে আছে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মত সুন্দরী। ঝলমলে সোনালি চুল। বড় বড় চোখের মণি সবুজ। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক। খাড়া তীক্ষ্ণ নাক। পরনে নার্সের সাদা পোশাক। কফি খেতে খেতে ম্যাগাজিন পড়ছিল। মুসার চোখে চোখ পড়তে মিষ্টি করে হাসল। মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টে বলল, কাজ হবে না। রোজই পয়সা ফেলি আমি। কোন চাওয়াই পূরণ হয় না আমার। হয় চাওয়াটা ঠিকমত হয় না, নয়তো মাত্র একটা পয়সা ফেলি বলে মন ওঠে না ঝর্নার।

মুসাও হাসল। এক পয়সায় ঝর্নার মন না উঠলে সিকি ফেলে দেখতে পারেন। বেশি ঘুষ পেলে আপনার ইচ্ছে পূরণ করেও দিতে পারে।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ঠোঁট ওল্টাল। যার পয়সায় হয়, তার সিকিতে কেন, লক্ষ ডলারেও হবে না। ইচ্ছা পূরণ হওয়ার কথা সব ফালতু। আমি আসলে পয়সা ফেলি হাতের নিশানা পরখ করার জন্যে। বেদিটাতে ফেলতে চাই। একদিনও পারিনি।

রোজ আসেন কেন?

 লাঞ্চ করতে। কাছেই চাকরি করি আমি। হাসপাতালে।

নার্স?

বলে বটে নার্স, কিন্তু কাজ করায় অন্য, মুখ বাকাল মেয়েটা। আজ সকাল থেকে খালি টেস্ট টিউবে রক্ত নিয়েছি মানুষের।

চাকরিটা মনে হয় পছন্দ না আপনার?

নাহ! এগুলো কোন কাজ নাকি?

 করেন কেন?

সময় কাটানোর জন্যে। তুমি কি করো? হাই স্কুলে পড়ে নিশ্চয়?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

 ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে?

ইচ্ছে তো হয় অনেক কিছুই। একেকবার একেকটা। কখনও মনে হয়। টীচার হব, কখনও মনে হয় দূর, ছেলে পড়িয়ে কি লাভ? তারচেয়ে মেকানিক হওয়া অনেক ভাল…

 হাসল মেয়েটা, ডিসাইড করা মুশকিল, তাই না? তোমার বার্গার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত বকবক করি আমি। আমি এখান থেকে না গেলে আর খেতে পারবে না।

আধখাওয়া বার্গারটা কখন প্লেটে নামিয়ে রেখেছিল মুসা, ভুলে গিয়েছিল। তুলে নিল আবার। হঠাৎ খেয়াল করল, মনটা আর আগের মত খারাপ নেই। কথা বলতে বলতে ভাল হয়ে গেছে।

না না, আপনি বসুন। খেতে খেতেও কথা বলতে পারি আমি। আমার কোন অসুবিধে হয় না। আপনার নামটাই কিন্তু জানা হলো না এখনও।

ক্রিসি, পাশে কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। তোমার?

মুসা আমান, বার্গারের শেষ টুকরোটা প্লেটে রেখে ক্রিসির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল মুসা। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

এসব গতবাধা কথা ন্যাকা ন্যাকা লাগে আমার।

হাসল ক্রিসি। দাঁতগুলো সাদা হলেও ঠিক স্বাভাবিক নয়, সামান্য বাঁকা। তবে দেখতে খারাপ লাগে না। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কোথাও দেখেছি। কোথায়, বলো তো?

পত্রিকায় হতে পারে, ভাবল মুসা। ওদের স্কুলের বাস্কেটবল টীমকে জিতিয়ে দিয়ে হিরো হয়ে গিয়েছিল সে। বলল, কি জানি। দেখেছেন হয়তো কোনখানে। এখানেও হতে পারে। রোজ আসেন যেহেতুএখানকার বার্গার। আমার খুব পছন্দ।

হ্যাঁ, তাই হবে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দ্রুকুটি করল ক্রিসি। তোমার ঘাড়ে কি হয়েছে? নাকি সমস্যাটা মেরুদণ্ডে?

অবাক হলো মুসা। কি করে বুঝলেন?

 ঘাড় যেভাবে শক্ত করে রাখছ।

খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। বেশি নড়াতে গেলেই খচ করে লাগে।

ডিপ-টিস্যু ম্যাসাজ নিয়ে পড়াশোনা করছি আমি। হাসপাতালে কাজ ( করায় প্র্যাকটিসের সুযোগও পেয়ে গেছি। এই ম্যাসাজে রোগীর সাংঘাতিক আরাম হয়। ব্যথা চলে যায়।

শুধু ম্যাসাজেই? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।

হ্যাঁ, হাতব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে খসখস করে ফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে মুসার দিকে বাড়িয়ে দিল ক্রিসি। এটা রাখো,। ব্যথা বাড়লে যদি প্রয়োজন মনে করো আমাকে ফোন কোরো। বাসায় চলে এলেও বিরক্ত হব না।

কাগজটা সাবধানে পকেটে রাখতে রাখতে হাসল মুসা, গিনিপিগ বানাতে চান?

সত্যি কথা বলব? ঘাড় কাত করল ক্রিসি, চাই। সব ধরনের রোগীর ওপরই পরীক্ষা চালাতে চাই আমি। এরকম মালিশে কোন কোন ব্যথা আরাম হয়, জানাটা জরুরী। ভবিষ্যতে নার্সের চাকরি ছেড়ে ম্যাসাজ পার্লার খুলে বসব।

বলা যায় না, চলেও আসতে পারি একদিন। মাঝে মাঝে ব্যথাটা যা বাড়ে..কি ম্যাসাজ বললেন?

 ডিপ-টিস্যু। ঘড়ি দেখল ক্রিসি। বাপরে, অনেক দেরি করে ফেললাম। উঠে দাঁড়াল সে। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল, মুসা..

গতবাধা কথা। ন্যাকা ন্যাকা।

 হেসে ফেলল ক্রিসি। শোধটা নিয়েই নিলে। চমৎকার কাটল সময়টা। সত্যি ভাল লাগল। বিকেলের পর আর বেরোই না আমি। তোমার ম্যাসাজ দরকার হলে ওই সময়টায় এসো।

ঘাড় কাত করল মুসা।

মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল ক্রিসি। চোখ ফিরিয়ে প্লেটের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল খানিকটা বার্গার পড়ে রয়েছে। অবাক লাগল। হলো কি আজ ওর? খাওয়ার কথা ভুলে যাচ্ছে বার বার?

.

০৩.

ড্যানিদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে সবে থেমেছে মুসা, তার পেছন পেছনই ঢুকল ড্যানির গাড়িটাও।

এগিয়ে গেল মুসা। ড্যানি গাড়ি থেকে নামতেই বলল, তার মানে বাড়ি ছিলে না। ভালই হলো, দেরি করে এসেছি। বসে থাকতে হলো না।

ড্যানি জানতে চাইল, ছিলে কোথায়? ফোন করে পাওয়া যায় না…

ড্যানিয়েল হার্বার, মুসার ক্লাসফ্রেন্ড। সব সময় হাসিখুশি থাকে। মাথায় ঘন চুলের বোঝা। নাকের ডগাটা মোটা। বড় বড় কানের দিকে ভালমত লক্ষ। করলে চেহারাটা যেন কেমন মনে হয়। কালো দুই চোখে তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছাপ। পড়াশোনায় ভাল। অ্যারোনটিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে।

 মলে গিয়েছিলাম, মুসা জানাল। বাড়িতে রান্না করে খেতে ইচ্ছে করছিল না।

গাড়ির সীটে ফেলে রাখা একটা বাদামী কাগজে মোড়া বাক্স বের করল ড্যানি। খাবারের প্যাকেট। আরেকটা ঠোঙাও তুলে নিয়ে বলল, এসো।

সামনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে। মুসা ঢুকল পেছনে। লিভিংরূমে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জয় কোথায়?

ড্যানির ছোট বোন জয়। সাত বছর বয়েস। ভীষণ ভালবাসে ওকে ড্যানি।

আছে।

একা ফেলে গিয়েছিলে!

ড্যানির বাবা-মা বাড়ি নেই, জানে মুসা। ছেলে-মেয়েকে রেখে তারাও বেড়াতে গেছেন।

কি করব? কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল ড্যানি। পেছনের উঠানে একটা পাখি কুড়িয়ে পেয়েছে। বেড়ালে বোধহয় ডানা ভেঙে ফেলেছে ওটার। তুলে এনে সেবাযত্ন শুরু করল। আমাকে হুকুম করল, জলদি দোকানে গিয়ে পাখির দানা নিয়ে এসো। ওকে সঙ্গে নিতে চাইলাম। বলে, ও না থাকলে নাকি পাখিটা মরে যাবে।

লিভিংরূমে ঢুকল জয়। ভাইয়ের বড় বড় কান পায়নি, তবে নাকটা পেয়েছে। চুলের রঙও এক রকম। দুজনের একই স্বভাব-কথা বলার সময়। অনবরত হাত নেড়ে নেড়ে নানা রকম ভঙ্গি করতে থাকে।

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছে জয়। এগিয়ে এসে ভাইয়ের হাত থেকে ঠোঙাটা প্রায় কেড়ে নিল। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, মুসাভাই, ভাইয়া তোমাকে পাখিটার কথা বলেছে? জানালার নিচে পড়ে ছিল।

বলেছে, হেসে জবাব দিল মুসা। সেবাযত্ন করে নাকি অর্ধেক ভাল করে ফেলেছ।

বাচ্চা তো। কষ্ট বেশি সেজন্যে। ঠোঙার মুখ খুলে ভেতরে তাকাল। জয়। ভাইকে জিজ্ঞেস করল, বাচ্চা পাখির দানা এনেছিস তো?

দানা তো এক রকমই রাখে দোকানে, ড্যানি বলল। বড় পাখি যা খায় ছোটগুলোও তাই খায়। আমার মনে হয় না খাবারের তফাত বুঝতে পারে ওরা।

পারে না মানে? নিশ্চয় পারে! দাঁড়া, দেখে আসি খায় নাকি। নাহলে আবার যেতে হবে তোকে দোকানে। দোকানদারকে কড়া করে বলবি যাতে বাচ্চার দানা দেয়। দৌড়ে চলে গেল জয়।

খাইছে! যদি সত্যি না খায়?

 কি আর করব? শঙ্কিত ভঙ্গিতে চুলে হাত চালাল ড্যানি। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। যেতেই হবে আবার। কিন্তু সত্যি কি বাচ্চা পাখি আর বুড়ো পাখিদের খাবার আলাদা?

মনে হয় না। কখনও খেয়াল করিনি।

মুসাকে নিজের বেডরূমে নিয়ে এল ড্যানি। ঢুকেই দেখল অ্যানসারিং মেশিনের লাল আলোটা টিপটিপ করছে।

এগিয়ে গেল ড্যানি। রিসিভার ভোলার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল, বাড়ি ফিরেই যখন দেখি কেউ আমার খোঁজ করছিল, ভাল লাগে খুব। নিশ্চয় কোন বন্ধু।

যদি ইনশুয়ারেন্সের দালাল হয়?

ওরা কখনও মেসেজ রাখে না। হুট করে বাড়িতে ঢুকে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাল করেই জানে, বলেকয়ে এলে কাউকে পাবে না। কেউ ওদের সামনে যাবে না। বাড়িতে থাকলেও নেই বলে দেবে। তবু মনে যখন করিয়ে দিয়েছ, সাবধান হওয়াই ভাল। বলা যায় নাঃ::

প্লে করল ড্যানি। একটামাত্র মেসেজ। রবিন করেছে। বেশ উদ্বিয় মনে হচ্ছে ওর কণ্ঠ। বলেছে, ড্যানি যখনই ফিরুক, সঙ্গে সঙ্গে যেন সোফিদের বাড়িতে ফোন করে।

অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকাল ড্যানি। মুসাও অবাক। জবাব দিতে পারল না। কোনমতে বলল, ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু নয় তো?

কোন… ঢোক গিলল ড্যানি। বুঝে ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে তাকাল মুসার দিকে। আমার ফোন করতে ভয় লাগছে। কি জানি কি শুনব! প্লীজ, তুমি করো!

 মুসাও দ্বিধা করতে লাগল। ঠিক আছে, করছি। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল।

একবার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নেয়ার শব্দ পেল মুসা। জবাব দিল সোফি, হালো?

মুসা। রবিন আছে?

আছে।

কি হয়েছে, সোফি?

রবিনকে দিচ্ছি, কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে সোফির, ওর কাছেই শোনো।

রিসিভার হাত বদল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল মুসা।

 কোত্থেকে বলছ, মুসা? জানতে চাইল রবিন।

ড্যানিদের বাড়ি থেকে।

ড্যানি আছে?

আছে। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছে?

দ্বিধা করতে লাগল রবিন। কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।

বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে মুসার। নিশ্চয় মরুভূমির। ব্যাপারটাই। বলে ফেলো।

মুসা?

বলো না। শুনছি তো।

লম্বা একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল রবিন। মুসা, কে জানি একটা অদ্ভুত চিঠি পাঠিয়েছে।

কি বললে? রবিনের কথাটা যেন বুঝতে পারেনি মুসা।

অদ্ভুত একটা চিঠি। না দেখলে বুঝবে না।

মরুভূমির কথা কিছু লিখেছে?

পরিষ্কার করে বলেনি। তবে মনে হয় ওই কথাটাই বলতে চেয়েছে। ড্যানিকে জিজ্ঞেস করো তো, ও আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে লিখেছে কিনা?

ও কেন দেখাবে? করল তো ও-ই।

তবু…

আচ্ছা, করছি! জিজ্ঞেস করল মুসা, ড্যানি, সোফিকে ভয় দেখানোর জন্যে কোন চিঠি লিখেছ?

ভুরু ওপরে উঠে গেল ড্যানির, না তো!

সত্যি?

মিথ্যে বলব কেন?

না, কোন চিঠিটিঠি লেখেনি, রবিনকে জানাল মুসা।

 ঠিক বলছে তো?

ড্যানির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। উদ্বিগ্ন লাগছে ড্যানিকে। না, বলছে না। চিঠিটা পড়ো তো শুনি।

পড়ে শোনাল রবিন। কোন পোস্ট অফিসের সিল আছে জানাল। মুসা চুপ করে থাকায় জিজ্ঞেস করল, মুসা, শুনছ?

হ্যাঁ। ঢোক গিলল মুসা। বুকের দুরুদুরু আরও বেড়েছে।

চিঠির কথামতই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, রবিন জানাল। সাঙ্কেতিক ভাষায়। লিখেছে: সোফির কুকুরের বাচ্চাটাকে ওর নিজের হাতে চুবিয়ে মারতে হবে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে।

দম বন্ধ করে ফেলল মুসা। বলো কি?

মুসা, কেউ জোক করেনি তো? ক্লডিয়া? কিংবা অন্য কেউ?

 কি জানি। জিজ্ঞেস না করে বলি কিভাবে। ওকে ফোন করেছিলে?

নাহ। ভাবলাম তুমি করলেই ভাল হয়। তোমার সঙ্গে খাতির বেশি।

বেশি আর কই…

তবু

ঠিক আছে। করব।

মুসা, নামের সারিতে আমার নামটা নেই।

তাই নাকি?

ইন্টারেস্টিং, তাই না?

না, ডেঞ্জারাস! সোফি আবার ভাবছে না তো তুমি লিখেছ?

না, ভাবছে না।

 ভাবনা চলেছে মুসার মাথায়। চিঠিতে যে কজনের নাম লেখা আছে, সবার এই বিপদের জন্যে ড্যানি দায়ী। গাড়িটা সে চালাচ্ছিল। আহাম্মকি করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টটা করেছে।

মুসা?

বলো।

খুব মুষড়ে পড়েছে সোফি।

পড়বেই। প্রথম পরীক্ষাটা ওকেই দিতে হবে। জোক, না সত্যি, এটা আগে ওকেই প্রমাণ করতে হবে। কুকুরের বাচ্চাটাকে না মারলে হয়তো সত্যি সত্যি বিপদে পড়তে হবে তাকে। এখনও কিছুই বলা যাচ্ছে না কি ঘটবে!

ডিসাইড করতে পারছে না ও কি করবে।

পারা সম্ভবও নয়। ঠিক আছে, আমি এখনই ক্লডিয়াকে ফোন করছি। দেখি কি বলে?

যা বলে জানিয়ো। তাড়াতাড়ি। ওকে না পেলেও জানিয়ো। রাখব?

রাখো।

লাইন কেটে দিয়ে ড্যানিকে সব জানাল মুসা।

গম্ভীর হয়ে গেল ড্যানি। পায়চারি শুরু করল। ফিরে তাকিয়ে বলল, ক্লডিয়া যদি না লিখে থাকে তো ভয়ের কথা। বাইরের কেউ লিখেছে। অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা জানে। জানল কি করে?

 সেটা পরেও ভাবা যাবে। ক্লডিয়াকে ফোন করে দেখো আগে কি বলে।

আবার রিসিভার কানে ঠেকাল মুসা।

ফোন ধরলেন মিসেস নিউরোন, ক্লডিয়ার আম্মা। জানালেন, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পর্বতের ওদিকে বেড়াতে চলে গেছে সে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল মুসা।

কি বলল? মুসার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানি।

 বেড়াতে চলে গেছে। ইয়োজিমাইটে। বৃহস্পতিবারের আগে ফিরবে না।

হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার পায়চারি শুরু করল ড্যানি। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। মুসা, কি মনে হয় তোমার? ক্লডিয়াই একাজ করেছে?

কি জানি। তবে না করার সম্ভাবনাই বেশি। কেন করবে? সে নিজেও এতে জড়িত। পুলিশকে না জানানোর জন্যে চাপাচাপিটা সে-ই বেশি। করেছিল। সে নিজে যে ব্যাপারে ভয়ে অস্থির, সেটা বলে সোফিকে ভয় দেখানোর কথা ভাবাটাই অর্থহীন। তা ছাড়া রবিন বলল, খামের ওপর। লোকাল পোস্ট অফিসের সিল মারা। ক্লডিয়া গেছে সাতদিন আগে। চিঠিটা। এসেছে আজকে। যদি সত্যিই ও লিখে থাকত, ইয়োজিমাইট পোস্ট অফিসের সিল থাকত।

তা ঠিক। আচ্ছা, সোফি, মারলা আর রবিন মিলে আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছে না তো? ভয় দেখানোর জন্যে?

রবিনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কানে বাজতে লাগল মুসার। উঁহু! রবিন তো এ ধরনের রসিকতা করবেই না। সোফি আর মারলাও করবে না। তা ছাড়া। ক্লডিয়ার মতই ওদেরও করার কোন যুক্তি নেই।

সেটাই তো কথা। তাহলে?

উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ড্যানি। বাইরে তাকাল। ভাল এক ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি আমরা। তত্ত্বাবধায়ক–কি অদ্ভুত নাম! নির্ঘাত লোকটা উন্মাদ। বিকৃত মস্তিষ্ক। ভয়ানক নিষ্ঠুর। নইলে একটা কুকুরের বাচ্চাকে চুবিয়ে মারার কথা কল্পনাও করতে পারত না।

তোমার কি ধারণা সোফি সত্যি বিপদের মধ্যে আছে? আমার ফোনের অপেক্ষা করছে ওরা। একটা কিছু বলতে হবে।

মলিন হাসি হাসল ড্যানি। বাচ্চাটাকে মেরে ফেললে অবশ্য সোফির আর কোন রকম বিপদের আশঙ্কা থাকে না।

তা থাকে না। কিন্তু ওকাজ কি আর করা যায় নাকি!

যায় না। আমি হলে অন্তত পারতাম না। বলো, ক্লডিয়া বেড়াতে গেছে। ওর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কিংবা বলতে পারো, আমাদেরও অনুমান চিঠিটা ক্লডিয়াই লিখেছে। সবার মুখ থেকে এক কথা শুনলে সোফি খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারবে।

তা পারবে না। ও নিশ্চিত হতে চাইবে।

জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে মুসার মুখোমুখি দাঁড়াল ড্যানি। একটা কথা বলি?

বলো।

এভাবে সর্বক্ষণ একটা দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপের মধ্যে না থেকে পুলিশের কাছে চলে যাই। সব খুলে বলি। আমার একার জন্যে তোমাদের সবাইকে এভাবে ভোগানোর…

অনেক দেরি করে ফেলেছি। সোজা নিয়ে গিয়ে জেলে ভরবে পুলিশ এখন। তা ভরুক..তবে ভাবছি, পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। সবাই যখন এতে জড়িত, সবার একসঙ্গে বসে আলোচনারও দরকার আছে।

তাহলে তো ক্লডিয়াকেও থাকতে হবে মীটিঙে। কবে আসছে ও?

বললাম না বৃহস্পতিবার।

 সোফিকে কবে পর্যন্ত সময় দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক?

বৃহস্পতিবার।

তারমানে কুকুরের বাচ্চাটাকে না মারলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেঁচে থাকছে সোফি। তাহলে আর অত চিন্তার কিছু নেই। তত্ত্বাবধায়ক কিছু ঘটানোর আগেই মীটিঙে বসার সময় পাচ্ছি আমরা।

.

০৪.

ওদের জন্যে বৃহস্পতিবারটা এল আর গেল কোন রকম নতুনত্ব না নিয়ে। ক্লডিয়া ফিরল না। অতএব আলোচনায় বসাও আর হলো না।

সারাদিন সাফির সঙ্গে কাটাল মারলা। মলে কেনাকাটা করল। সিনেমা দেখতে গেল। সারাটা দিন মোটামুটি শান্তই রইল সোফি। রাত বারোটা পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গে রইল মারলা। রাতেও থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু সোফি বলল লাগবে না। তার আম্মা ফিরেছেন।

সকালে ফোন করে খবর নেবে বলে বাড়ি ফিরে গেল মারলা।

কথামত পরদিন সকালে ফোন করল সে। ভালই আছে সোফি।

খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিল মারলা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। যাক, চিঠিটা আসলেই একটা ফালতু রসিকতা ছিল।

ক্লডিয়ার ফেরার অপেক্ষায় রইল সবাই। কিন্তু ফিরল না সে। মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল আরও একদিন দেরি হবে।

শুক্রবার রাত।

সকাল সকাল শুয়ে পড়ল রবিন। মাথা ধরেছে। গত কদিন ধরে যা উত্তেজনা যাচ্ছে। শোয়র সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। নানা রকম অদ্ভুত স্বপ্ন। দেখতে লাগল। কানের কাছে দমকলের ঘন্টা শুনে যেন ঘুম ভেঙে গেল ওর। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল বিছানায়।

ফোন বাজছে। চমকে গেল। এতরাতে কে? বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল যেন ওর। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। হালো?

রবিন?

হ্যাঁ। কে?

মিসেস হল।

ধড়াস করে এক লাফ মারল রবিনের হৃৎপিণ্ড। দম আটকে এল। সোফির কি হয়েছে? ভাল আছে ও?

ফুঁপিয়ে উঠলেন সোফির আম্মা। জানি না। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সোফি। আমাকে এখুনি যেতে বলেছে। সোফির বাবা বাড়ি নেই। আমিও চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না। রবিন, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে? এই অবস্থায় আমি গাড়ি চালাতে পারব না।

এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছেন মহিলা, ভুলে গেছেন বহুদুরে থাকে রবিন। গাড়িতে করে যেতেও অন্তত একটি ঘণ্টা লাগবে ওর।

নিশ্চয় পারব, বলল রবিন, তবে আমার আসতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তারচেয়ে মুসাকে ফোন করে দিচ্ছি, সে আপনার অনেক কাছাকাছি থাকে। আমিও আসছি। হাসপাতালে দেখা হবে।

আচ্ছা, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন মিসেস হল। মেয়ে কেমন আছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম। কোন জবাব দিল না হাসপাতাল থেকে। ও মরে যায়নি তো?

না, মিসেস হল। সোফির অবস্থা সম্পর্কে এখনও শিওর না হয়তো ওরা। সেজন্যেই কিছু জানাতে পারেনি। ভাববেন না। কিছু হয়নি সোফির। কোন্ হাসপাতালে নিয়েছে?

জেনে নিয়ে মুসাকে ফোন করল রবিন।

অবাক কাণ্ড। একবার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নিল মুসা। যেন তৈরি হয়ে বসেছিল ফোনের কাছে। ঘুমায়নি, ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারল রবিন। ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে একটা। কি করছে মুসা?

মুসা?।।রবিন। খারাপ খবর আছে।

সোফির?

তুমি কি করে জানলে?

অনুমান। কি হয়েছে ওর?

 মিসেস হল ফোন করেছিলেন, কি হয়েছে মুসাকে জানাল রবিন।

দশ মিনিটের মধ্যেই চলে যাচ্ছি আমি।

তুমি খারাপ খবর শোনার জন্যে বসে ছিলে, তাই না? ঘুমাওনি কেন?

 ঘুম আসছিল না।

কি মনে হয়, মুসা? সোফি কি মারা গেছে?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। জানি না! আজকাল আর কোন কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না…অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে কোন কিছু বেশি। ভাবলেই মাথা ধরে…

আমারও!

.

সোফি মারা গেছে!

খবরটা একই সঙ্গে শুনল ওরা তিনজন। রবিনদের গোস্ট লেনের বাড়ি থেকে হাসপাতাল অনেক দূর। তবু মুসার গাড়িটা যখন হাসপাতালের পার্কিং লটে ঢুকল, তার মিনিটখানেক পর রবিনও ঢুকল। মুসা ঠিকমতই সোফিদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণে নানা রকম অঘটন ঘটিয়ে বেরোতে দেরি করে ফেলেছেন মিসেস হল।–

হাসপাতালে মেয়ের খবর শুনে বেহুশ হয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি নার্সরা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল তাকে। রবিনের মাথা ঘুরছে। যে ডাক্তার ওদের খবরটা দিলেন, বলার ভঙ্গিতে মনে হলো মৃত্যু নয়, সাধারণ সর্দি লাগার খবর দিচ্ছেন যেন। মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, সবুজ সার্জিক্যাল গাউনে রক্ত লেগে আছে। ইমার্জেন্সি রূমে ডিউটি করেন। সারাক্ষণ জখমী রোগী আসতেই আছে। গাড়ি দুর্ঘটনা, ছুরি মারামারি, গুলিতে আহত রোগী, আসে বিরামহীনভাবে। এত দেখতে দেখতে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে ডাক্তারের। মৃত্যু আর কোন প্রতিক্রিয়া করে না তার মনে। কাউকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শোনাতে বিন্দুমাত্র মুখে আটকায় না আর।

অ্যাক্সিডেন্টটা হলো কিভাবে? হাঁটু কাঁপছে রবিনের। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

মাথা নেড়ে বললেন ডাক্তার, শুনিনি। পুলিশকে জিজ্ঞেস করে দেখো।

বোকার মত প্রশ্ন করে বসল রবিন, সত্যি মারা গেছে, নাকি ভুল হয়েছে। আপনাদের? মানে, আমি বলতে চাইছি এখনও কোন সম্ভাবনাঃ…ভালমত চেষ্টা করলে এখনও হয়তো বাঁচানো যায়…

শূন্য দৃষ্টি ফুটল ডাক্তারের চোখে। হাসপাতালে আনার অনেক আগেই মরে গেছে। হাত ছোঁয়ানোরও সুযোগ পাইনি আমরা।

পুলিশ চলে যাওয়ার আগেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুসার দিকে তাকাল রবিন। মুখের যা ভঙ্গি করে রেখেছে মুসা, তাতে বোঝা যায় ওর মানসিক অবস্থাও সুবিধের না। তাকে নিয়ে পার্কিং লটে বেরিয়ে এল রবিন। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে সোফিকে আনা হয়েছে, তার ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসার।

এগিয়ে গেল রবিন। এক্সকিউজ মি, অফিসার, বলল সে। কার অ্যাক্সিডেন্ট করা যে মেয়েটাকে এক্ষুণি নিয়ে এলেন আপনারা, আমি তার বন্ধু। ডাক্তারের কাছে শুনলাম মারা গেছে। আপনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন?

 তরুণ অফিসার। সুন্দর করে ছাঁটা বাদামী গোফ। নীল ইউনিফর্ম চমৎকার ফিট করেছে। গাড়ি ঘেষে দাঁড়িয়ে রবিনের দিকে তাকাল। ডাক্তারের মত ভাবলেশহীন মুখ নয়। অন্তত খানিকটা অনুভূতি এর আছে।

 হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, রবিনের বাহু স্পর্শ করল অফিসার। তোমার বন্ধুর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। এত অল্প বয়েসেই শেষ হয়ে গেল বেচারি।

কিভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করল?,

গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়েছিল। রাস্তার ধারের একটা অলিভ গাছ। এমন গুতেই মেরেছে, গাছটাও শেষ, গাড়িটাও ভর্তা।

ব্রেক ফেল করেছিল নাকি? না চাকা পিছলে গিয়েছিল?

কোনটাই না। চাকা পিছলালে ব্রেক করত। তাতে স্কিড মার্ক থাকত। ওরকম কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। নেশার ঘোরে থাকলে কিংবা ঘুম পেলে অনেক সময় স্টিয়ারিঙে হাত ঠিক থাকে না। তীব্র গতির সময় স্টিয়ারিং সামান্য ঘুরলেও গাড়ি অনেক সরে যায়। রাস্তায় সামান্য পরে পরেই গাছ। গুতে লাগিয়েছে বোধহয় ওসব কোন কারণেই। গাড়ির অবস্থা দেখে মনে হয় ষাট মাইল বেগে ছুটছিল।

ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে?

পায়ের ভার বদল করল অফিসার। অস্বস্তি বোধ করছে। কোন সন্দেহ নেই তাতে।

এত শিওর হচ্ছেন কি করে?

শুনলে ভাল লাগবে না তোমাদের।

 গোলাপী কাগজে লেখা চিঠিটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল রবিনের। তবু, বলুন।

মুখ নিচু করল অফিসার। দেখো, সত্যি ভাল লাগবে না।

আমি জানতে চাই।

জানালা ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল ওর মাথা। গাছের ডালে গলা টান লেগে ঘাড় ভেঙেছে। প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে…

বলুন? কি হয়েছিল প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে?

গাল চুলকাল অফিসার। দেখো, অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ মারা গেলে লাশের চেহারা আর চেহারা থাকে না। তার ওপর যদি ধড় থেকে গলা ছিঁড়ে গিয়ে মাথাটা…

আর সহ্য করতে পারল না মুসা। কপাল টিপে ধরল।

 রবিনও কাঁপতে শুরু করেছে।

আগেই বলেছিলাম তোমাদের, সহ্য করতে পারবে না, অফিসার বলল। বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার পাশের একটা ঝোপে পাওয়া গেছে ওর মাথাটা।

Super User