তিন গোয়েন্দা – ভলিউম ২৯ – সৈকতে সাবধান
 
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৯৮

০১.

বিকেলটা মায়ের সঙ্গে কাজ করে কাটাল জিনা। গাড়ি থেকে মালপত্র নামানো, ব্যাগ সুটকেস খুলে জিনিসপত্র গোছানো, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ঘরগুলো সাফসুতরো করা, খাবার আর প্রয়োজনীয় জরুরী জিনিস কিনে আনা, অনেক কাজ।

জিনার বাবা মিস্টার পারকার কোন সাহায্যই করতে পারলেন না। করতে এসেছিলেন, কিন্তু কাজের চেয়ে অকাজ বেশি-উল্টোপাল্টা করে কাজ আরও বাড়াতে লাগলেন, শেষে তাকে বিদেয় করে দিয়ে রেহাই পেয়েছেন মিসেস পারকার।

বারান্দায় বসে একটা বিজ্ঞানের বইতে ডুবে আছেন এখন মিস্টার পারকার।

বালিয়াড়ির আড়ালে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। প্রবল বাতাসে নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে বাড়ির পেছনের শরবন। মিসেস পারকার রান্নাঘরে। হট ডগ আর মাংস ভাজার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

ডিনারের পর ওপরে চলে এল জিনা। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলানোর জন্যে আলমারি খুলল। অ্যানটিক ড্রেসিং টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে। তাকাল। দেরি হয়ে গেছে। মুসারা বসে থাকবে। দেখা করার কথা সাড়ে সাতটায়।

দুই টান দিয়ে পাজামা খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল সে। আলমারি ঘেঁটে বের করল একটা ডেনিম কাটঅফ।

সৈকতে যাবে না? নিচ থেকে শোনা গেল মায়ের কণ্ঠ।

নাহ। তুমি যাও, জবাব দিলেন মিস্টার পারকার। আমি এই চ্যাপ্টারটা…

একা যেতে ইচ্ছে করছে না। থাক, সকালের নাস্তার জোগাড়টা করে। ফেলিগে।

কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেও পারো। অনেক পরিশ্রম করেছ।

আগে কাজকর্মগুলো সেরে ফেলি, তারপর…

আয়নার সামনে এসে বসল জিনা। তামাটে চুল অনেক লম্বা হয়েছে। তারপরেও কাটতে ইচ্ছে করল না। ভাবতেই হেসে উঠল তামাটে চোখের বড় বড় দুটো মণি। মনে পড়ল, কয়েক বছর আগের গোবেল বীচের কথা। তখন। চুল কেটে ছেলেদের মত করে রাখতে পছন্দ করত সে। এখন রাখে লম্বা চুল। মাত্র কয়েক বছরেই কত পরিবর্তন এসে যায় একজন মানুষের। বিশেষ করে মেয়েদের। আগে হলে রাফিয়ানকে অবশ্যই সঙ্গে আনত। কোথাও বেড়াতে গেলে ওকে ফেলে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। আর এখন দিব্যি ফেলে এসেছে বাড়িতে, রকি বীচের বাড়িতে। আনাটাই বরং ঝামেলার মনে হয়েছে ওর কাছে।

 সৈকত শহর স্যান্ডি হোলোতে বেড়াতে এসেছে ওরা। গরমকালটা এখানেই কাটানোর ইচ্ছে মিসেস পারকারের। মিস্টার পারকারের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। যেখানেই যান, বই আর গবেষণায় ডুবে থাকতে পারলেই তিনি খুশি।

নিচে নেমে হাত নেড়ে মাকে গুড-বাই জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। জিনা। বাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে এসে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল বীচ হ্যাঁভেন ড্রাইভ ধরে শহরের দিকে।

বীচ হ্যাভেন ড্রাইভ!

আহা, কি নাম! কানা ছেলে তার নাম পদ্মলোচন। সরু, এবড়োখেবড়ো একটা পথ, খোয়াও বিছানো হয়নি ঠিকমত।

গুচ্ছ গুচ্ছ সামার কটেজগুলোর কাছ থেকে মিনিট দশেক হেঁটে এলে পড়বে এক চিলতে বালিতে ঢাকা জমি। চারপাশ ঘিরে জন্মেছে শরবন। তারপর বিশাল ছড়ানো প্রান্তর, ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে তাতে মাথা তুলে রেখেছে একআধটা ওক কিংবা উইলো গাছ। ওগুলো সব পার হয়ে গেলে দেখা মিলবে ছোট্ট শহরটার।

রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক এগোতেই শরবনের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে এসে সামনে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি। বাঘ আর কুকুরের মিশ্র ডাকের মত চিৎকার করে উঠল খাউম করে। হাত চেপে ধরল জিনার।

ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল জিনা। অস্ফুট একটা শব্দ করল। মুখোমুখি হলো মূর্তিটার।

 কেমন ভয়টা দেখালাম, হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুসার মুখে। ঝকঝকে সাদা দাঁত।

ভয় না, কচু! কিচ্ছ ভয় পাইনি আমি।

 তাহলে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

কোথায় চেঁচালাম?

কোথায় চেঁচালে? দাঁড়াও, সাক্ষি জোগাড় করছি। শরবনের দিকে তাকিয়ে ডাক দিল মুসা, রিকি। বেরোও।

শরবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মুসার চেয়ে অনেক খাটো, রোগা একটা ছেলে। গাজর রঙের কোকড়া চুল। নীল চোখ। লাজুক ভঙ্গি। খুব শান্ত।

ওর দিকে হাত বাড়াল মুসা, দাও পাঁচ ডলার। বলেছিলাম না ভয় দেখাতে পারব।

জিনার চোখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল রিকি। কড়া দৃষ্টি সহ্য করতে পারল না। তা তো বলেছিলে…

আমি ভয়ে চিৎকার করেছি! কোমরে হাত দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল জিনা। আমি!

অ্যাঁ!…না না.না! ভয়ে প্রায় কুঁকড়ে গেল ছেলেটা। মুসার চোখে চোখ পড়তেই আবার বলল, করেছে, কিন্তু…

নাহ্, তোমাকে আর মানুষ করা গেল না,হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল জিনা। পুরুষ মানুষ, এত ভয় পাও কেন?

জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইল রিকি।

মাস দুই হলো জিনাদের বাড়ির পাশে ওদেরই অন্য একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে রিকিরা। ভীষণ লাজুক ছেলে। দুই মাসে জিনা আর তিন গোয়েন্দা ছাড়া আর কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেনি। পড়শী বলে ওরাই যেচে পড়ে খাতিরটা করেছে, নইলে তা-ও হত না।

আজই এলে? পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইল মুসা।

আজ বিকেলে, জবাব দিল জিনা। বাড়িটা ভালই, কিন্তু পরিষ্কার করতে জান শেষ। একটা হপ্তা লাগবে।

আমাদেরটাও একই। কাল এসে তো ঢুকেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো মার। একটা জানালার কাচ ভেঙে কি জানি কি একটা জানোয়ার ঘরে ঢুকেছিল। আমাদের কার্পেটটাকে বাথরূম মনে করেছিল।

ওয়াক! থুহ! আন্টির নিশ্চয় দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল?

না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল খানিকক্ষণ। তারপর ঘুরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আর কোনদিন আসব না বলে রকি বীচে ফিরে যেতে চেয়েছিল তক্ষুণি, হাসতে হাসতে বলল মুসা। আমি আর বাবা অনেক কষ্টে ঠেকিয়েছি।

এটা রকি বীচের চেয়ে খারাপ জায়গা, পেছন থেকে বলল রিকি। জিনা আর মুসার কয়েক কদম পেছনে থেকে হাটছে।

আমার তো খুব ভাল লাগছে, মুসা জবাব দিল। দারুণ। সারাটা বিকেল সাগরে সাতরে কাটালাম, রোদের মধ্যে পড়ে থাকলাম। রাতে সৈকতে পার্টি হবে। সকালে উঠে নতুন করে আবার সব শুরু। কত মজা।

নতুন করে কি হবে?

 গাধা নাকি। বুঝলে না। আবার বেড়ানো, সাঁতার কাটা, রোদে পোড়া, রাতে পার্টি…

একঘেয়ে লাগবে না?

মোটেও না। থাকো না দুতিন দিন, বুঝবে আনন্দ কাকে বলে।

আকাবাকা কাঁচা রাস্তাটা ঘাসের মাঠ পেরিয়ে, একগুচ্ছ সাদা রঙ করা কাঠের বাড়ির পাশ কাটিয়ে চলে গেছে শহরের দিকে।

শহরের মেইন রোডের কাঠে তৈরি ফুটপাথে যখন উঠল ওরা, বাতাস তখন বেশ গরম। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ওরা।

আরে, মুসা বলল, প্রিন্সেসের পাশে আবার ভিডিও-গেম আর্কেডও খুলেছে দেখি এবার। রিকি, টাকাপয়সা কিছু এনেছ?

জিনসের পকেট হাতড়ে নীল রঙের প্লাস্টিকের বুটেন লাইটারটা শুধু বের করে আনল রিকি। সব সময় জিনিসটা তার পকেটে থাকে। মাথা নাড়ল।

এই গরমের মধ্যে ওই বদ্ধ জায়গায় ঢোকার ইচ্ছে হলো কেন তোমার? জিনা বলল। বেড়াতে এসেছি, বেড়াব। ঘরে আটকে থাকার কোন মানে হয় না, সেটা যে ধরনের ঘরই হোক। চলো, খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সৈকতে চলে যাই।

চলো, কি আর করা, আর্কেডের দিকে শেষবারের মত লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পা বাড়াল মুসা।

.

০২.

মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটছে ওরা। জিনা ভাবছে, কিশোর আর রবিন থাকলে ভাল হত। ওরা আসেনি। ইয়ার্ডে প্রচুর কাজ। এই গ্রীষ্মে মেরিচাচী আর রাশেদ পাশা কোথাও বেড়াতে যাবেন না। কিশোরকেও আটকে দিয়েছেন চাচী। আর রবিন আবার পা ভেঙেছে পাহাড়ে চড়তে গিয়ে। এখন শয্যাশায়ী। পাহাড়ে চড়া ওর কাছে নেশার মত। বহুবার পা ভেঙেছে। এমনও হয়েছে, জোড়া লাগতে না লাগতে আবার ভেঙেছে কয়েক মাসের মধ্যেই। তা-ও পাহাড়ে ওঠা বন্ধ করতে পারে না।

কিশোর অবশ্য বলে দিয়েছে, ইয়ার্ডের কাজ সেরে ফাঁক পেলেই চলে আসবে। তবে সেই ফাঁকটাই পাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে জিনার। সবাই একসঙ্গে না থাকলে জমে না। কিন্তু আসতে না পারলে কি আর করা। মেনে নিতেই হয়।

মেইন রোডের একধারে সারি সারি দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে চলল ওরা। উইন্ডোতে সাজানো জিনিসপত্র দেখতে দেখতে। টুরিস্ট সীজন সবে শুরু হয়েছে। এখনই প্রচুর ভিড়। মেইন স্ট্রীটে যানজট। ফুটপাথে মানুষের জট। একা, জোড়ায় জোড়ায়, কিংবা দল বেঁধে হাঁটছে। যার যেভাবে খুশি, যেদিকে ইচ্ছে। কারোরই কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।

খাইছে! আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা। রাস্তার অন্য পাড়ে পুরানো আমলে তৈরি সিনেমা হলটার দিকে চোখ। কি সব পোস্টার লাগিয়েছে দেখেছ? ভূতপ্রেতেরা উৎসব করছে নাকি? রিকির কাঁধে হাত রাখল সে। চলো তো, কাছে গিয়ে দেখি।

জিনা আর রিকিকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে রাস্তা পেরোল সে। আসিতেছে কিংবা আগামী আকর্ষণ লেখা পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে বলল, সব তো দেখা যাচ্ছে হরর ছবি।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ভূতপ্রেতকে ভয় পায় মুসা, অথচ ওসব ছবির প্রতিই তার আকর্ষণ বেশি।

গুঙিয়ে উঠল জিনা। মুসার যতটা পছন্দ, এধরনের ছবি তার ততটাই অপছন্দ। মুসার হাত ধরে টানল সে, এসো তো। পচা জিনিস দেখতে ভাল্লাগছে না।…ওদিকে কি হচ্ছে দেখি।

রাস্তার শেষ বাড়ি এই সিনেমা হলটা। শহরটাও যেন শেষ হয়ে গেছে এখানে।-কংক্রীটে তৈরি ছোট আয়তাকার একটা জায়গাকে পার্কিং লট করা হয়েছে। তার ওপারে ঘাসে ঢাকা মাঠ। শহরের অধিবাসীদের পিকনিক স্পট, জনসমাবেশ আর অন্যান্য কর্মকাণ্ডেও ব্যবহার হয়। আজ রাতে অনেকগুলো উজ্জ্বল স্পটলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে জায়গাটা। আলোর সীমানার বাইরে আবছা অন্ধকারে কয়েকটা ট্রাক আর ভ্যানগাড়ির কালো অবয়ব চোখে পড়ে।

এগিয়ে গেল তিনজনে। কার্নিভলের প্রস্তুতি চলছে। শ্রমিকদের হাঁকড়াক, করাতের খড়খড় আর হাতুড়ির টুকুর-ঠাকুর শোনা যাচ্ছে অনবরত।

কেমন যেন! বাস্তব লাগছে না পরিবেশটা। স্পটলাইটগুলো আকাশের দিকে তুলে দেয়া হয়েছে। নিচে তাই আলোর চেয়ে ছায়াই ছড়াচ্ছে বেশি। ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে শ্রমিকরা। কালো, নীরব একটা দৈত্যের মত অন্ধকারে মাথা তুলে রেখেছে একটা নাগরদোলা। খুঁটি থেকে ঝুলছে রঙিন আলো। খাবার আর খেলার স্টলগুলো খাড়া করে ফেলা হচ্ছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। ছোট একটা রোলার-কোস্টার বসাতে গলদঘর্ম হচ্ছে কয়েকজন লোক।

মাঠের কিনারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল মুসা, জিনা আর রিকি।

গ্রেভিট্রন আছে নাকি ওদের কে জানে! আচমকা যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলে উঠল রিকি।

কি ট্রন? বুঝতে পারল না মুসা।

গ্রেভি। গ্রেভ থেকে গ্রেভি। গ্রেভ মানে জানো না? কবর।

ও। তো সেটা দিয়ে কি হয়? কবরে ঢোকায় নাকি?

অনেকটা এরকমই। বনবন করে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ মেঝেটা সরে যায়। সময়মত লাফ দিয়ে যদি দেয়ালের কাছে সরে যেতে পারো, বাচলে, নইলে পড়তে হবে নিচের অন্ধকার গর্তে।

বাহ, দারুণ খেলা তো, রোমাঞ্চকর মনে হলো জিনার।

 অবাক হয়ে রিকির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। এই খেলা তোমার পছন্দ?

না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল রিকি। ওটা কোন খেলা হলো নাকি? এত ভয় পেতে কে চায়? বিপদও কম না!

নাগরদোলাও আমার ভাল লাগে, অন্ধকার মাঠের দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে আছে জিনা।

ওসব পোলাপানের খেলা, মুসা বলল। এর মধ্যে উত্তেজনার কি আছে?

সব কিছুতেই উত্তেজনা দরকার হয় নাকি? খেলা খেলাই। মজা পাওয়াটা আসল কথা।

জিনার হাত ধরে টানল মুসা, দেখা তো হলো। চলো, সৈকতে। এখানে বিরক্ত লাগছে আমার।

পরিষ্কার রাতের আকাশ। উজ্জ্বল। মেঘমুক্ত। জ্যোৎস্নায় বালির সৈকতটাকে লাগছে চওড়া, রূপালী ফিতের মত।

পানির কিনার দিয়ে হাত ধরাধরি করে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে নারী পুরুষ। গোড়ালিতে মৃদু বাড়ি খাচ্ছে ঢেউ। পাউডারের মত মিহি বালিতে চাদর বিছিয়ে বসে হাসাহাসি করছে, গান গাইছে, চেঁচিয়ে কথা বলছে ছেলেমেয়েরা। কেউ বাজাচ্ছে টেপ। ড্রামের ভারী গুমগুম শব্দ তুলে বাজছে রক মিউজিক। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রেডিওর গান। ঢেকে দিচ্ছে সৈকতে ক্রমাগত আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দকে।

বালিয়াড়ির গোড়ায় আগুন জ্বেলে বসেছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে। বালির ওপর দিয়ে ওদের দিকে খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে কয়েকজনকে চিনতে পারল মুসা আর জিনা। স্যান্ডি হোলোরই বাসিন্দা ওরা। আগের বার বেড়াতে এসে পরিচয় হয়েছে।

হাই, টনি, ডাক দিল মুসা।

ফিরে তাকাল টনি হাওয়াই। আগুনের আলো আর ছায়া নাচছে ছেলেটার চোখেমুখে। বেশ লম্বা। খাটো করে ছাটা কালো চুলের গোড়া ঝাড়র শলার মত খাড়া খাড়া। মুসাকে দেখে উজ্জ্বল হলো মুখ। আরি, মুসা? কেমন আছ? এখনও ভূতের ভয়ে কাবু?

তুমিও কি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেছ? বলেই এক থাপ্পড় কষাল ওর পিঠে মুসা।

গুঙিয়ে উঠল টনি। উফ, বাপরে! গায়ের জোর কমেনি একটুও!

হেসে উঠল দুজনেই।

পরিচিত সবগুলো ছেলেমেয়ে স্বাগত জানাল জিনা আর মুসাকে। সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিল। পরিচয় করিয়ে দিল অপরিচিতদের সঙ্গে। কড়কড়, ফুটফাট, নানা রকম বিচিত্র শব্দ করছে আগুন। আরামদায়ক উষ্ণতা। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে একসঙ্গে কথা শুরু করল সবাই।

রিকির কথা মনে পড়তে ডাক দিল মুসা, আই, রিকি, বসো।

এত মানুষ দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেছে রিকি। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে আস্তে করে বসে পড়ল মুসার পাশে। দ্বিধা যাচ্ছে না কোনমতে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মুসা, ও আমার বন্ধু, রিকি শর।

কিশোর আর রবিন এল না এবার? জানতে চাইল টনি।

নাহ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, রবিন আবার পা ভেঙেছে। কিশোর ইয়ার্ডের কাজে ব্যস্ত। তবে বলেছে, সারতে পারলে, দুচারদিনের জন্যে হলেও চলে আসবে।

কিশোর নেই, বলল মুনা নামে একটা মেয়ে, তারমানে কোন রহস্য আর পাচ্ছ না তোমরা এবার।

পেলেই বা কি? নাকের সামনে পড়ে থাকলেও হয়তো দেখতে পাব না।

 হু, তা ঠিক। জিনা, কেমন আছ?

 ভাল।

নতুন আর্কেডটা দেখেছ নাকি? মুসাকে জিজ্ঞেস করল টনি। সাংঘাতিক!

দেখেছি। কিন্তু পয়সা আনিনি।

আমার কাছে আছে, হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল টনি। চলো। খেলে আসি।

উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দ্বিধা করতে লাগল মুসা। জিনার দিকে তাকাল। একসঙ্গে বেড়াতে বেড়িয়ে ওকে ফেলে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। মাথা নাড়ল, নাহ, আজ আর যাব না। এইমাত্র এলাম ওখান থেকে। দেখা যাক, কাল।

কাল তাহলে বেশি করে পয়সা নিয়ে এসো, হাসল টনি। বসে পড়ল আবার। চুটিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করল সবাই মিলে। রিকি বাদে। চুপ করে বসে আছে। চাদরের কিনারে জড়সড় হয়ে বসে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। কথা শুনছে। হাতের তালুতে আনমনে অনবরত ঘোরাচ্ছে নীল লাইটারটা।

ও যে অস্বস্তি বোধ করছে, বুঝতে পারল জিনা। বলল, রিকি, বসে থাকতে তোমার ভাল না লাগলে হেঁটে আসতে পারো ওদিক থেকে। আমরা আছি এখানে।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রিকি। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল লাফ দিয়ে।

.

০৩.

গোল ছায়ায় বসে থাকা ছোট ছোট বিন্দুগুলোকে চিনতে সময় লাগল রিকির। সাগরের মাছখেকো পাখি। টার্ন। ছোট, মসৃণ একটা পাথরের টিলায় উঠে দাঁড়িয়েছে সে।

চলতে শুরু করল বিন্দুগুলো। এগিয়ে চলল পানির দিকে। অন্ধকার গ্রাস করে নিল ওগুলোকে।

রিকির দুই হাত পকেটে ঢোকানো। পানির দিক থেকে ঘুরল। ফিরে তাকাল পাথরের পাহাড়ের দিকে। চূড়াটা একখানে সমতল একটা টেবিলের রূপ নিয়েছে। বাদুড় উড়ছে ওটার ওপরে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার। সাগরের দিকে ঘুরল সে। প্রায় অস্পষ্ট ছোট একটা দ্বীপের কালো অবয়ব চোখে পড়ছে, বাতাস নিতে ভেসে ওঠা সাবমেরিনের পিঠের মত। বাদুড়গুলো বোধহয় ওই দ্বীপ থেকেই আসে, মনে হলো তার।

এত বাদুড় এখানকার সৈকতে! মুখ তুলে বেগুনী আকাশের দিকে তাকাল সে। একটু আগেও মাথার ওপর উড়ছিল দুটো বাদুড়। এখন নেই।

সৈকতের এই অংশটুকু নৌকা রাখার উকটা থেকে দক্ষিণে। এখানে দাঁড়ালে গাছপালায় ছাওয়া নির্জন দ্বীপটা ভালমত দেখা যায়, দিনের বেলায়ই দেখেছে। দূর থেকেই দ্বীপটা পছন্দ হয়ে গেছে তার। এর কারণ বোধহয় নির্জনতা। মানুষজন বিশেষ পছন্দ করে না সে। একা থাকতে ভাল লাগে। মসূণ, শীতল পাথরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে অপলক চোখে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে রইল।

কতক্ষণ এভাবে ছিল বলতে পারবে না। হুশ হলো, যখন অস্পষ্ট হয়ে এল। দ্বীপটা। তাকিয়ে দেখল, নিচে নেমে আসছে মেঘ। চাঁদ ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগের রূপালী সৈকতটাকে লাগছে লম্বা, ধূসর একটা ছায়ার মত। বিচিত্র। অদ্ভুত। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মত পাক খেয়ে খেয়ে সাগরের দিক থেকে উড়ে আসতে শুরু করেছে কুয়াশা। বাতাস ভেজা, ঠাণ্ডা, ভারী।

মুসারা কি চলে গেছে? না বোধহয়। ওকে ফেলে যাবে না।

সুন্দর জায়গা। চমৎকার পরিবেশ। সবাই কেমন আনন্দ করে কাটাচ্ছে। কিন্তু ও পারে না। নিজের ওপর রাগ হলো রিকির। কেন মিশতে পারে না মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করতে হবে এখন থেকে। কিন্তু নিজের কথায় নিজেরই আস্থা নেই। বহুবার এরকম কথা দিয়েছে নিজেকে, চেষ্টাও করেনি তা নয়, কিন্তু পারেনি। এইবার পারতে হবে, পারতেই হবে নিজেকে বুঝিয়ে পাথর থেকে নামতে যাবে, এই সময় ফড়ফড় শব্দ হলো মাথার ওপর।

 মুখ তুলে দেখল, অনেকগুলো বাদুড় উড়ে এসেছে পাহাড়ের দিক থেকে। বিচিত্র ভঙ্গিতে ডানা ঝাঁপটে রওনা হয়েছে যেন মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

বাদুড়েরা খুব ভাল প্রাণী, নিজেকে বোঝাল সে। ওরা পোকামাকড় খায়। খেয়ে মানুষের উপকার করে।

কিন্তু বাদুড়ের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ আর তীক্ষ্ণ চিৎকার এখন ভাল লাগল না তার কাছে। মেরুদণ্ডে শিহরণ তুলল।

আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না। তাড়াহুড়ো করে নেমে এল নিচের কুয়াশা পড়া ভেজা বালিতে। নেমেই থমকে দাঁড়াল।

সে একা নয়। আরও কেউ আছে।

 ওর পেছনে। পাথরের চাঙড়ের আড়ালে।

দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পেল না। কিন্তু মন বলছে, আছে।

মাথার ওপর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ বাড়ছে। ঝাঁকে ঝাকে বাদুড় উড়ে আসছে এখন পাহাড়ের দিক থেকে। অনেক নিচ দিয়ে উড়ছে। চলে যাচ্ছে সাগরের ওপরে নেমে আসা মেঘের দিকে। ওর গায়ে এসে ঝাঁপটা মারছে নোনা পানির কণা মেশানো ঝোড়ো বাতাস।

চোখের কোণ দিয়ে নড়াচড়া লক্ষ করে ঝট করে পাশে ঘুরে গেল রিকি। দেখতে পেল মেয়েটাকে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েক ফুট দূরে একটা পাথরের ওপর দাঁড়ানো। খালি পা।

ওকে তাকাতে দেখে নড়ে উঠল মেয়েটা। নিঃশব্দে পাথর থেকে নেমে এগিয়ে আসতে শুরু করল।

সুন্দরী। খুব সুন্দরী মেয়েটা। মেঘে ঢাকা চাঁদের আবছা আলোতেও ওর রূপ যেন ঝলমল করছে। রিকিরই বয়েসী হবে। কিংবা দুএক বছরের বড়।

হাই, মোলায়েম, মধুঝরা মিষ্টি কণ্ঠে ডাক দিল মেয়েটা। ডাগর কালো চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে। বড় বড় ফুল ছাপা কাপড়ে তৈরি সারং স্কার্ট পরনে, তার সঙ্গে ম্যাচ করা বিকিনি টপ। ঝাঁকি দিয়ে কাঁধে সরিয়ে দিল মুখে এসে পড়া লম্বা লাল চুল। হাসল রিকির দিকে তাকিয়ে।

হাই! বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে রিকির। সবার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবে-খানিক আগে নিজেকে দেয়া এই কথাটা বেমালুম ভুলে গেল। মানুষ! অপরিচিত! তার ওপর মেয়েমানুষ! ইস, বালি ফাঁক হয়ে যদি গর্ত হয়ে যেত এখন, তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে রেহাই পেত সে।

আমি পথ হারিয়েছি, কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। পারফিউমের গন্ধ লাগল রিকির নাকে। লাইলাক ফুলের মিষ্টি সুবাস।

আ! কি হারিয়েছেন?

পথ। আপনি আপনি করছ কেন? আমি তোমার বয়েসীই হব।

প-প-প্লথ হারিয়েছেন…মানে, হা-হা-হারিয়েছ… ঢোক গিলল রিকি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, বেড়াতে এসেছি আমরা। বাবা কটেজ ভাড়া নিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম ওইই পাহাড়ের দিকে, হাত তুলে দেখাল মেয়েটা। হাতির দাঁতের মত ফ্যাকাসে সাদা চামড়া। এখন আর বুঝতে পারছি না। কোনদিকে গেলে বাসাটা পাওয়া যাবে।

আমি..মানে… কথা বলার জন্যে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল রিকি। মনে মনে ধমক লাগাল নিজেকে-এই ব্যাটা, স্বাভাবিক হ! কথা,বল ঠিকমত! এবং ধমকের চোটেই যেন হড়হড় করে শব্দগুলো বেরিয়ে এল মুখ থেকে,

বেশির ভাগ সামার হাউসই ওই ওদিকটাতে।

ওদিকে ফিরে তাকাল মেয়েটা। দ্বিধা করছে।

 যাবে আমার সঙ্গে? ওদিকেই যাব।

থ্যাংকস, বলে রিকিকে অবাক করে দিয়ে আন্তরিকতা দেখানোর জন্যে ওর একটা হাত ধরে টান দিল মেয়েটা। চলো।

এক ঝলক কড়া মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে ঢুকল। বোঁ করে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল রিকির। অবশ হয়ে আসছে হাত-পা। জোর করে ছাড়িয়ে নেয়ার সাহস, শক্তি, কোনটাই পেল না। অদ্ভুত অনুভূতি। তাকে বাদ দিয়েই যেন পা দুটো চলতে শুরু করল মেয়েটার সঙ্গে।

এদিকে এই প্রথম এলাম। সুন্দর জায়গা। ছুটিটা এবার খুব ভাল কাটবে, মেয়েটা বলল।

অ্যাঁ!..হ্যাঁ। খুব ভাল।

 ফিরে তাকাল মেয়েটা। আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছ কেন এমন কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি তোমার?

মেয়েটার কুঁচকানো ভুরু আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকানোর সাহস হলো না রিকির। আরেকদিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, কই, না তো! অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তো, বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছে।

 হ্যাঁ, তা লাগতে পারে। ঠাণ্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে খুব। কুয়াশাও কি রকম করে ছুটে আসছে। অবাক কাণ্ডই। সন্ধ্যায় যখন বেরিয়েছি, রীতিমত গরম ছিল।

ওই পাহাড়ে গিয়েছিলে কি করতে? একা একা তোমার ভয় করে না?

না। তোমার করে?

 না। একা থাকতেই আমার বরং ভাল লাগে।

আমারও।

এই একটা কথাতেই আড়ষ্টতা অনেকখানি কেটে গেল রিকির। হয়তো। নিজের সঙ্গে মেয়েটার মিল খুঁজে পেয়েই। ভেবে নিল, মেয়েটাও লাজুক, সে ও লাজুক। যদিও আড়ষ্টতার ছিটেফোঁটাও নেই মেয়েটার মধ্যে।

 রিকির কব্জিতে চেপে বসল মেয়েটার আঙুল। মৃদু হাসল। তাহলে তো আমরা বন্ধু হতে পারি।

তা পারি, মনে মনে বলল রিকি। মুখ দিয়ে বের করতে পারল না।

কোন শহর থেকে এসেছ তুমি? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

রকি বীচ।

পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে। বালিয়াড়ির পাশ থেকে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। কথা বলতে বলতে পানির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ওকে মেয়েটা। তবে টানটা দিচ্ছে বড়ই আস্তে, হাঁটছে ধীরে ধীরে।

পানির কিনারে কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশা।

 লাইলাক ফুলের গন্ধ থেকে থেকেই নাকে ঢুকছে রিকির।

ওই দেখো, কেমন সুন্দর কুয়াশা, ঘন একটা কুণ্ডলীর দিকে হাত তুলে বলল মেয়েটা। ঢুকে দেখবে নাকি কুয়াশার মধ্যে কেমন লাগে?

রিকির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ করছে: যেয়ো না, যেয়ো না! কিন্তু বাধা দিয়ে। নিজেকে রুখতে পারল না রিকি। এড়াতে পারল না মেয়েটার হাতের টান। আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ঘন কুয়াশার মধ্যে। এতই ঘন, দুই হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না। এরই মধ্যে একটা ঝিলিমিলি ছায়ার মত মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে সে।

নাকের কাছে দুলে উঠল কি যেন। বুঝতে পারল না রিকি। লাইলাকের মিষ্টি গন্ধটা তীব্রতর হলো। তার সঙ্গে মিশে গেছে ঝাঝাল আরেকটা কি রকম। গন্ধ।

বোঁ করে আবার চক্কর দিল মাথাটা। এবার আর গেল না অদ্ভুত অনুভূতিটা। এরই মধ্যে টের পেল গলায় নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। পরক্ষণে কুট করে চামড়ায় তীক্ষ্ণ সুচ বেঁধার মত যন্ত্রণা।

একটা মুহূর্ত মাথার ভেতরে-বাইরে সমানে পাক খেতে থাকল.যেন ভেজা কুয়াশা। তারপর অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার।

.

০৪.

কোথায় ও?

আর্কেডের ভেতরের সরু গলি ধরে এগিয়ে চলল জিনা। গিজগিজে ভিড়। বোমা বিস্ফোরণ, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি, মহাকাশ যুদ্ধ আর রেসিং কার ছুটে চলার শব্দে ছোট্ট, স্বল্পালোকিত ঘরটায় কান পাতা দায়।

এখানে নেই।

 কোথায়?

আর্কেডের পেছনে পিনবল মেশিন নিয়ে যেখানে খেলা চলছে সেখানেও নেই।

রাস্তায় বেরিয়ে এল জিনা। খোলা বাতাসে বেরিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাচল। অত বদ্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন মজা যে পায় ওই ছেলেগুলো! ভিডিও গেম খেলার নেশাটা আগে ছিল না মুসার, ইদানীং ধরেছে। কিশোর আর রবিনের কথা ভেবে আরেকবার আফসোস করল জিনা। ওরা থাকলে এই একাকিত্বে ভুগতে হত না। মুসাও নিশ্চয় খেলা নিয়ে মেতে উঠত না এতটা।

মুসাকে দোষ দিল না সে। মেয়েমানুষের সঙ্গে সারাক্ষণ যদি থাকতে না চায়, কিছু বলার নেই। আর তার নিজের মুশকিল হলো, সে নিজে মেয়ে হয়েও মেয়েদের সঙ্গ তেমন পছন্দ করে না।

দূর! কাজ নেই, কর্ম নেই, কথা বলার মানুষ নেই; এই বেড়ানোর কোন মানে হয় নাকি? রকি বীচে ফিরে যাবে কিনা ভাবতে শুরু করল সে।

সাগর থেকে ভেসে আসছে কুয়াশার কুণ্ডলী। অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পথের ওপর। রাস্তার আলোর আশেপাশে বিচিত্র ছায়া তৈরি করছে। মেইন রোডের পাশের দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোর দিকে তাকাল। জিনা। প্রচুর ভিড়। কুয়াশার মধ্যে মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে দল বেঁধে উড়ছে।

ঘন হচ্ছে কুয়াশা। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢেকে ফেলবে সব কিছু। প্রিন্সেস শপিং মলের পাশে আইসক্রীম পারলারটার দিকে এগোল সে।

পেল না এখানেও। আশ্চর্য! মুসারও দেখা নেই, রিকিরও কোন খবর নেই। গেল কোথায় ওরা? আশেপাশেই তো থাকার কথা। এ সময় বাসায় ঘরে বসে আছে, এটাও বিশ্বাস করতে পারল না। ভুল করেছে। মুসাদের কটেজটা হয়ে এলে পারত।

হাই, জিনা!

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল জিনা।

না, মুসা নয়। আগের রাতে সৈকতে আগুনের ধারে পরিচয় হওয়া একটা ছেলে। সঙ্গে আরেকজন। দুজনেই ওর দিকে হাত নেড়ে চলে গেল সামনের দিকে। হারিয়ে গেল ঘন কুয়াশায়।

বাড়ি থেকে বেরোতে বোধহয় দেরি করে ফেলেছে মুসা। চলে আসবে এখুনি, ভেবে, একটা স্ট্রীটল্যাম্পের নিচে গিয়ে দাঁড়াল জিনা। হঠাৎ বিচিত্র এক অনুভূতি হলো-কেউ নজর রাখছে ওর ওপর।

ফিরে তাকাতে দেখল, ঠিক ছায়া থেকে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। ওর চেয়ে বছর দুতিনের বড় হবে। তরুণই বলা চলে। হালকা-পাতলা শরীর, তবে রোগা বলা যাবে না। গায়ে কালো সোয়েটশাট, পরনে গাঢ় রঙের মোটা সূতী কাপড়ের প্যান্ট। ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল। কাছে এসে দাঁড়াল। অপূর্ব সুন্দর কৌতূহলী দুটো কালো চোখের দৃষ্টিতে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দেখল, জিনাকে। সিনেমার নায়ক কিংবা দামী মডেল হবার উপযুক্ত চেহারা। হেসে জিজ্ঞেস করল, কারও জন্যে অপেক্ষা করছ বুঝি?

এক পা পিছিয়ে গেল জিনা।

ও। সরি। বিরক্ত করলাম, তাড়াতাড়ি বলল ছেলেটা। এ শহরের বাসিন্দা। নয় ও, চামড়াই বলে দিচ্ছে। ফ্যাকাসে সাদা। এখানকার মানুষের চামড়া রোদে পুড়ে পুড়ে সব তামাটে হয়ে গেছে।

না না, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বলল জিনা। এই কুয়াশার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে না। সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। আটকাতে চাইল ছেলেটাকে, আপনি এখানে এই প্রথম এলেন?

তুমি করেই বলো। আপনি শুনতে ভাল্লাগে না। মাথা নাড়ল, না, আরও বহুবার এসেছি।…দেখো, কি কুয়াশা! এ রকম আর কখনও দেখিনি এখানে।

আমিও না, হাত বাড়িয়ে দিল জিনা, আমি জরজিনা পারকার। জিনা বললেই চলবে।

জন গুডওয়াকার, জিনার হাত চেপে ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিয়েই ছেড়ে দিল ছেলেটা।

এতই ঠাণ্ডা, জিনার মনে হলো বরফের ছোঁয়া লেগেছে ওর হাতে। অনেক পুরানো নাম। তোমার পোশাকও খুব পুরানো আমলের।

মাথা ঝাঁকাল জন, হ্যাঁ। পুরানো আমলই আমার পছন্দ। এখনকার কোন কিছু ভাল লাগে না।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল দুজনে।

ঘড়ি দেখল জিনা। পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তোমার বন্ধু আসবে তো? জিজ্ঞেস করল জন। এখানেই দেখা করার কথা?

মাথা ঝাঁকাল জিনা, হ্যাঁ, আর্কেডের সামনেই থাকতে বলেছে। শহরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সৈকতে যাওয়ার কথা আমাদের। কি হলো ওর বুঝতে পারছি না!

দেখোগে, দেরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখানে তোমাকে পাবে না ভেবে সরাসরি সৈকতেই চলে গেছে।

তাই তো! একথাটা তো ভাবেনি এতক্ষণ।

আজ রাতে বেশি ভিড় থাকবে না সৈকতে, আবার বলল জন। অনেকেই কুয়াশা পছন্দ করে না। ওকে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে না।

তা ঠিক, জিনার কণ্ঠে অনিশ্চয়তা। কিন্তু যা অন্ধকার…

চলো, আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে। আমার কোন কাজ নেই। ঘুরতেই বেরিয়েছিলাম…

কিন্তু…

আরে, চলো। এই এলাকা আমার মুখস্থ। দশ মিনিটও লাগবে না ওকে খুঁজে বের করতে।

কোন রকম প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে জিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল জুন।

পথের মোড় ঘুরে ডিউন লেনে পড়ল ওরা। সোজা এগোল সাগরের দিকে। অবাক লাগল জিনার, যতই সৈকতের কাছাকাছি হচ্ছে, পাতলা হচ্ছে কুয়াশা।

জিনার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন জবাব দিল জন, স্যান্ডি হোলো শহরটা অনেক নিচুতে, অনেকটা গিরিখাতের মত জায়গায়। এতে হয় কি, সাগর থেকে কুয়াশা এসে একবার চড়াও হলে বদ্ধ জায়গায় আটকে যায়, আর সরতে চায় না।

তুমি কি ভূগোলের ছাত্র?

 নাহ। ব্যাপারটা জানি আর কি।

সৈকতের কিনার থেকে সাগরের বেশ খানিকটা ভেতর পর্যন্ত আকাশে ভারী, ধূসর মেঘ। কিন্তু কুয়াশা প্রায় নেই। বড় বড় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে তীরে। অন্ধকারেও ঢেউয়ের মাথার সাদা ফেনা চোখে পড়ছে।

পানির কিনারে হাঁটছে কয়েক জোড়া দম্পতি। খানিক দূরে পানির বেশ কিছুটা ওপরে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে কতগুলো ছেলেমেয়ে। উঁচুস্বরে টেপ আর রেডিও বাজছে।

কাছে গিয়ে দেখল জিনা। মুসাও নেই, রিকিও না।

তাতে হতাশ হলো না দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল জিনা। তারমানে জনের সঙ্গ তার খারাপ লাগছে না। পানির কিনার ধরে পাশাপাশি হেঁটে চলল দুজনে। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে জন। অনেক কিছু জানে। একটা তিমির গল্প বলল। পথ হারিয়ে বসন্তের শুরুতে নাকি তীরের একটা অল্প পানির খড়িতে এসে আটকে গিয়েছিল। ওটার বন্দি চেহারার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে ছবিটা দেখিয়ে দিল জিনাকে। শহরের লোকে বহু কষ্টে খোলা সাগরে বের করে দিয়েছিল আবার তিমিটাকে।

কথা বলতে বলতে কখন যে ওরা দক্ষিণের পাহাড়ের দিকে ঘুরে গেছে, বলতে পারবে না। হঠাৎ লক্ষ করল জিনা, পানির ধার থেকে তীরের অনেক ভেতরে চলে এসেছে। সামনেই পাথরের পাহাড়।

একপাশে বেশ খানিকটা দূরে বোট ডক। ঢেউয়ের গর্জন বেড়েছে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জিনা। এত নির্জনতা তার পছন্দ হচ্ছে না।

কই, সমস্ত সৈকতই তো চষে ফেললাম, যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই সহজ কণ্ঠে বলল জন। তোমার বন্ধুকে তো পাওয়া গেল না। বেরোয়ইনি হয়তো বাড়ি থেকে।

চলো, ফিরে যাই, পা বাড়াতে গেল জিনা।

দাঁড়াও না, ভালই তো লাগছে। থাকি আরেকটু।

 নাহ, আমার ভাল লাগছে না।

সামনে এসে দাঁড়াল জন। মুখোমুখি হলো। হাতটা চলে এল জিনার নাকের কাছে।

অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে ঢুকল জিনার। বডি স্প্রের নয়। আফটার শেভ লোশন? হবে হয়তো। কোন্ ব্র্যান্ডের লোশন ব্যবহার করে জন, জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল জিনা, এই সময় চোখ চলে গেল ওপর দিকে। মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে যেতে দেখল কয়েকটা বাদুড়কে।

এখানে অতিরিক্ত বাদুড়!

বাদুড়কে ভয় পাও নাকি?

 মুখ নামাল জিনা। ভয় পাব কেন?

না, এমনি। বাদুড়ের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের সম্পর্ক আছে কিনা। স্যান্ডি হোলোতে কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের গুজব আছে। মানুষকে আক্রমণ করার কথাও শোনা যায়।

দূর, ওসব ফালতু কিচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি না।

যখন পড়বে ওদের কবলে, তখন বুঝবে মজা, রহস্যময় কণ্ঠে বলে হাসতে লাগল জন। আবার হাত বাড়াল জিনার নাকের কাছে।

মিষ্টি গন্ধ পেল জিনা। কিসের গন্ধ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে এবারও জিজ্ঞেস করা হলো না। কথা শোনা গেল। বাকের আড়াল থেকে বেশ জোরেই কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এল একজোড়া দম্পতি। ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। জিনা আর জনের উদ্দেশে হাত নাড়ল মহিলা।

জিনাও হাত নেড়ে জবাব দিল। জনের হাত ধরে টানল, এসো। এখানে। আর ভাল লাগছে না আমার।

মনে হলো, দম্পতিরা আসাতে নিরাশ হয়েছে জন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, চলো।

.

০৫.

সাগরের কি অবস্থা? জানতে চাইলেন মিস্টার আমান। পরনে বেদিং স্যুট। রান্নাঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাপে কফি ঢালছেন। চোখে এখনও ঘুম।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল মুসা। বাবা-মা তখনও ঘুমে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সৈকতে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি সেরে সবে ফিরেছে।

সাংঘাতিক, বলে, টান দিয়ে ফ্রিজের ডালা খুলল মুসা। কমলার রসের প্যাকেট বের করল।

কফির কাপে চুমুক দিলেন মিস্টার আমান। সাংঘাতিক মানে? খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। পরিষ্কার আকাশ। ঝলমলে রোদ। ঝড়ের তো কোন লক্ষণ দেখছি না।

ঝড়ের কথা বলিনি। বড় বড় ঢেউ। বিশাল একেকটা। প্যাকেটের কোণা দাঁত দিয়ে কেটে ফুটো করে মুখে লাগাল মুসা। এক চুমুকে অর্ধেকটা খতম করে ফেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে তাকাল। বাবা, কখন উঠেছ?

দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালেন মিস্টার আমান। সাড়ে নটা বাজে। এই বিশ মিনিট। কেন?

রিকি ফোন করেছিল?

 না, হাই তুললেন মিস্টার আমান। টেনিস খেলতে যাবে নাকি?

না। সাঁতার। বডিসার্ফিং। যা ঢেউ একেকখান, খুব মজা হবে। ওয়ালফোনের কাছে এসে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মুসা। নম্বর টিপতে যাবে, এই সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন আমান, দেখো দেখো, একটা হামিংবার্ড!

রিসিভার রেখে লাফ দিয়ে এগিয়ে এল মুসা। কই? কোথায়?

ওই তো, ওই ফুলটার কাছে ছিল। মিস করলে।

কত্তবড়?

 মৌমাছির সমান।

এখানে সবই মৌমাছির সমান নাকি? কাল রাতে আমার ঘরে কতগুলো নীল মাছি ঢুকেছিল। মৌমাছির সমান। এত্তবড় মাছি আর দেখিনি।

এত্ত ছোট পাখিও আর দেখিনি, ফুলগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। আমান। পাখিটাকে খুঁজছে তাঁর চোখ।

মুসাও তাকিয়ে আছে।

কফি শেষ করে কাপটা কাউন্টারে রেখে ফিরে তাকালেন আমান, রিকিকে ফোন করছিলে নাকি?

হ্যাঁ

এত সকালে? এখানে এত তাড়াতাড়ি তো কেউ ওঠে না।

রিকি আমার চেয়েও সকালে ওঠে।

 আবার গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল মুসা।

অনেকক্ষণ রিঙ হওয়ার পর ধরলেন রিকির আম্মা।

আন্টি, আমি মুসা। রিকি কোথায়?

অ, তুমি। বাগান থেকে রিঙ হচ্ছে শুনলাম। এসে ধরতে দেরি হয়ে গেল।…রিকি তো এখনও ওঠেনি। কাল রাতে দেরি করে ফিরেছে। দাঁড়াও, দেখে আসি।

আলসেমি রোগে ধরল নাকি ওকে! আনমনে বলল মুসা। ঘড়ির দিকে তাকাল। সব সময় ভোরে ওঠা রিকির অভ্যেস। পৌনে দশটা পর্যন্ত কখনও বিছানায় থাকে না।

রিসিভার ধরেই আছে মুসা। অনেকক্ষণ পর পায়ের শব্দ শুনল। খুটখাট শব্দ। ভেসে এল রিকির ঘুমজড়ানো, খসখসে ভারী কণ্ঠ, হালো!

রিকি? ঘুম থেকে উঠে এলে নাকি?

 নীরবতা। হ্যাঁ। হাই তোলার শব্দ।

 কাল রাতে কোথায় ছিলে?

গলা পরিষ্কার করে নিল রিকি, একটা মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

খাইছে! কি বললে? বিস্ময় চাপা দিতে পারল না মুসা।

মেয়েটা অদ্ভুত, বুঝলে। ওর সঙ্গে হাঁটতে, কথা বলতে, একটুও সঙ্কোচ হচ্ছিল না আমার।

তোমাদের হলো কি! তুমি গেলে একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে, জিনা গেল একটা ছেলের সঙ্গে হ্যাঁ, তারপর?

ঘুমজড়িত কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠল রিকি।

আই রিকি, শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ। কি জানি হয়েছে আমার। কিছুতেই চোখ টেনে খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম যাচ্ছেই না।

জাহান্নামে যাক তোমার ঘুম। মেয়েটা কে?

লীলা। খুব ভাল মেয়ে। না দেখলে বুঝবে না। আমার সঙ্গে এত ভাল আচরণ করল। আমাকে ব্যঙ্গ করল না, ইয়ার্কি মারল না। ওর সঙ্গে কথা বলতে কোন অসুবিধেই হয়নি আমার।

ভাল। তা-ও যে আড়ষ্টতাটা দূর হচ্ছে তোমার..সৈকতে যাবে না?

নাহ। পারব না। শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। দুর্বলও লাগছে খুব। রাতে কুয়াশার মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছি অনেক। জ্বরটর আসবে নাকি বুঝতে পারছি না। এলে বিপদে পড়ে যাব।

কিসের বিপদ?

লীলাকে কথা দিয়েছি, আজ রাতে ওকে নিয়ে শহরে ঘুরতে বেরোব। তুমি আর জিনাও চলে এসো।

আসব। তোমার শরীর কি খুবই খারাপ? যা দারুণ ঢেউ দেখে এলাম। সার্ফিঙে না গেলে মিস করবে।

পারছি না, ভাই। সত্যি খুব দুর্বল লাগছে। এত ঘুম আমার জীবনেও পায়নি। রিসিভার ধরে রাখতে পারছি না। রাখি, আঁ? রাতে দেখা হবে।

মুসা জবাব দেয়ার আগেই লাইন কেটে গেল।

রিসিভার রেখে ভাবতে লাগল মুসা, কার সঙ্গে সার্ফিঙে যাওয়া যায়? টনির কথা মনে পড়ল।

ফোন করল। কিন্তু বহুক্ষণ চেষ্টা করেও পেল না ওকে। ফোন ধরল না কেউ টনিদের বাড়িতে।

তারপর করল জিনাকে। জিনার আম্মা ধরলেন। জানালেন, জিনা। বাথরূমে। দিনের বেলা কোথাও বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। ঘরের কাজ আছে। এত বেশি জঞ্জাল, সাফ করতে করতেই বেলা গড়াবে।

হতাশ হয়ে শেষে জানালার কাছে এসে দাঁড়লি সে। বাবা বাগানে ফুলগাছগুলোর কাছে ঘোরাঘুরি করছেন। হামিংবার্ডটাকে আবার দেখার আশা ছাড়তে পারেননি এখনও। মনেপ্রাণে তিনি একজন নেচারালিস্ট। জন্তু জানোয়ার ধরতে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে কত জায়গায় যে গিয়েছেন। আমাজানের জঙ্গলেও গিয়েছিলেন একবার।

বাইরে বেরোল মুসা। আর কোন উপায় না দেখে বাবাকেই পাকড়াও করল। বাবা, সাঁতার কাটতে যাবে না? এক মিনিট দাঁড়াও। আমি স্যুটটা পরে আসি।

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন মিস্টার আমান। ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে, কেন, কাউকে জোগাড় করতে পারলে না। সাগরে যখন ঢেউ বেশি, সাঁতার কাটতে না-ই বা গেলাম আজ। বরং এক কাজ করি চলো। হামিংবার্ড আর প্রজাপতির ছবি তুলেই কাটাই। একটা দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতিও দেখলাম ওদিকের ঝোপটায়। ধরতে পারলে মন্দ হয় না।

Super User