রেসের ঘোড়া – তিন গোয়েন্দা – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ ও মে, ১৯৯৩

০১.

এসে গেছি, জীপের পেছনের সিট থেকে বলল কিশোর পাশা। রুক্ষ পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছে গাড়ি। মাথা থেকে খুলে স্টেটসন হ্যাটটা কোলের ওপর রাখল সে। তাকিয়ে রয়েছে তীর চিহ্ন দেয়া নির্দেশকের দিকে। তাতে লেখাঃ ডাবল সি র‍্যাঞ্চ।

এলাম তাহলে, গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিশোরের পাশে সীট খামচে ধরে রেখেছে। যা রাস্তা। হাড্ডিমাংস সব এক হয়ে গেছে।

 সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে বসেছে রবিন। ড্রাইভ করছে ব্ৰড় জেসন। হেসে বলল, আমরা কিন্তু সব সময়ই চলি এই রাস্তায়। আমাদের কিছু হয় না।

আপনাদের তো অভ্যাস হয়ে গেছে, মুসা বলল। মনে হচ্ছে সেই কোন যুগে রকি বীচ থেকে বেরিয়েছি। এতদিনে এসে পৌঁছলাম।

মিস্টি ক্যানিয়নে স্বাগতম, ব্রড বলল। ডাবল সি র‍্যাঞ্চের কর্মচারী সে, র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। শুকনো খড় রঙা চুল। বয়েস পঁচিশ-টচিশ হবে, আন্দাজ করল কিশোর।

মিস্টি ক্যানিয়ন, বিড়বিড় করল সে। তাকিয়ে রয়েছে পাহাড়ের দিকে। রবিন আর মুসারও চোখ সেদিকে। মনটানার একটা র‍্যাঞ্চে ঢুকছে ওরা। ঘিরে থাকা পাহাড়ের কোল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে র‍্যাঞ্চের জমি। রোদ খুব গরম। বাতাস শুকনো, পরিষ্কার।

এই পাহাড়ের কোলে অনেক র‍্যাঞ্চ আছে, ব্রঙ জানাল। ডাবল সি তারই একটা। মিস্টি ক্যানিয়ন কেন নাম হয়েছে জান? একটা ঝর্নার জন্যে। পাহাড়ের গোড়ায় বইছে গরম পানির ওই ঝর্নাটা, বাষ্প ওঠে ওটা থেকে। দূরের একটা শৈলশিরার দিকে হাত তুলে দেখাল সে।

নৌকার মত দুলে উঠল জীপ। তিক্ত কণ্ঠে মুসা বলল, রাস্তারই এই অবস্থা। গরম পানির ঝর্না কেমন হবে কি জানি। পা দিলেই হয়তো ফোঁসকা পড়ে যাবে, হট বাথ আর হবে না।

বাতাসে লম্বা সোনালি চুল এসে পড়ছে রবিনের চোখে মুখে। সরিয়ে দিতে দিতে বলল, এই ঝাঁকুনিতেই এই? আসল ব্রোঙ্কোতে তো এখনও চড়ইনি।

চড়েছি। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল মুসা, যে কোন ঘোড়ায় চড়লেই হলো।

না, হলো না। ঘোড়ার নানা রকম জাত আছে, একেকটায় চড়তে একেক রকম লাগে। টাট্ট ঘোড়ায় চড়া আর মনটানার মাসট্যাঙে চড়া এক কথা নয়, ওই যেমন তোমার ঝরঝরে ভেগা আর চকচকে মার্সিডিজ কিংবা জাগুয়ার,

হয়েছে হয়েছে, রেগে উঠল মুসা, আর খোঁচা মারতে হবে না!

ওদের ঝগড়া থামানোর জন্যে হাসল কিশোর। রবিন, তুমিও ভুল করছ। র‍্যাঞ্চের সব ঘোড়াই বুনো কিংবা খেপা নয়।

ঠিক বলেছ, কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল ব্রড। হেসে অভয় দিল মুসাকে, সব রকমের আরোহীর জন্যেই ঘোড়া রাখি আমরা। একেবারে আনাড়ির জন্যেও আছে।

ভাল! নাক কুঁচকাল মুসা। আনাড়ি শুনতে ভাল লাগেনি। তবে আমার জন্যে ভাল ঘোড়াই দরকার। চড়তে জানি। বহুবার চড়েছি। নবিস নই।

বুনো মাসট্যাংও নিশ্চয় আছে আপনাদের? ব্রডকে জিজ্ঞেস করল রবিন।

সরু হয়ে এল লোকটার চোখের পাতা। বুনো?

ঝড়ো বাতাসের মত জোরাল বাতাস এসে ঢুকছে জানালা দিয়ে। বইয়ের পাতা মেলা মুশকিল। অনেক কায়দা করে ডাবল সি র‍্যাঞ্চের ঝলমলে কভার ওয়ালা ব্ৰশিয়ারটা খুলে দেখাল রবিন, একটা কালো ঘোড়ার ছবিতে আঙুল রাখল। সামনের পা তুলে দিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা, যেন পক্ষিরাজের মত আকাশে উড়াল দেয়ার মতলব।- এই যে এটার মত? ইউনিকর্ন?

ইউনিকর্ন? চোখ গোল গোল হয়ে গেল মুসার। গ্রীক মিথলজির দানব এল কোত্থেকে এখানে? এটারও শিং আছে নাকি?

বাস্তব ঘোড়ার শিং থাকে না, বলে আবার ব্রডের দিকে তাকাল রবিন, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে।

ওতে চড়ে না কেউ, কাটা কাটা শোনাল ব্রডের কণ্ঠ।

ব্রশিয়ারেও অবশ্য তাই লেখা রয়েছে। কেউ নাকি চড়তে পারে না।

 কিশোর জিজ্ঞেস করল, দেখতে পাব তো ওকে?

রিয়ারভিউ মিররে কিশোরের চোখে চোখে তাকাল ব্রড। একটা পরামর্শ দিচ্ছি, কিশোর, ইউনিকের কাছ থেকে দূরে থাকবে। মরতে না চাইলে। গ্যাস প্যাডালে চাপ বাড়াল সে। খেপা ঘোড়ার মতই যেন লাফ দিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি। এবড়োখেবড়ো পথে ঝাঁকি খাওয়া বাড়ল, পেছনে বাড়ল ধুলোর ঝড়।

বিষণ্ণ হাসি ফুটল মুসার মুখে। গাড়ি তো নয়, মনে হচ্ছে নাগরদোলায় চড়ছি।

কিশোর চুপ। ইউনিকর্নের কথা ভাবছে। ব্রডের হুঁশিয়ারি ঘোড়াটার প্রতি কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে ওর। কয়েকটা কোরাল পেরিয়ে এল গাড়ি। অনেক ঘোড়া দেখা গেল। তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে কিশোর। ইউনিকর্নকে দেখার জন্যে। মায়ের পাশে ছোটাছুটি করতে দেখল অস্বাভাবিক লম্বা পা-ওয়ালা বাচ্চা ঘোড়াকে। ধুলোয় ঢেকে রয়েছে ঘোড়াগুলোর শরীর। তৃণভূমিতে ঘোড়ার পাশাপাশি চড়ছে সাদা চৌকোণা মুখওয়ালা লাল গরু। ওগুলোর গায়েও ধুলো।

কালো ঘোড়াটাকে দেখা গেল না।

র‍্যাঞ্চের মূল বাড়িটার সামনে এনে গাড়ি রাখল ব্রড়। এক সময় সাদা রঙ করা। হয়েছিল দোতলা বাড়িটাকে। রঙ চটে গেছে এখন, জানালার কাছগুলোতে ফাটা ফাটা হয়ে আছে। লাল রঙ করা শার্সির অনেকগুলো কজা ছুটে গিয়ে কাত হয়ে। রয়েছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। টালির ছাত মেরামত করা হয়েছে বহু জায়গায়। সামনের বারান্দা বাড়িটার সমান লম্বা, এককোণ থেকে মোড় ঘুরে পাশ দিয়েও এগিয়ে। গেছে। রেলিঙের খুটি জায়গায় জায়গায় খুলে পড়ে গেছে, রেলিঙের ওপরটা দেবে। রয়েছে ওসব জায়গায়।

ধুলো ঢাকা মাটিতে লাফিয়ে, নামল গোয়েন্দারা। চত্বরে থেকেই আস্তাবল, গোলাঘর আর বাঙ্কহাউস দেখতে পাচ্ছে কিশোর। সবগুলো ঘরই সাদা রঙ করা হয়েছিল। মলিন ফেকাসে হয়ে গেছে এখন, ধূসর হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কাত হয়ে রয়েছে বেড়া। পুরো জায়গাটারই কেমন বিবর্ণ দরিদ্র চেহারা।

সাংঘাতিক মোটা, ধূসর রঙের চুলওয়ালা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দরজার কাছে। তিনিই কেরোলিন হোফারসন, এই র‍্যাঞ্চের হাউসকীপার, রবিনের মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী, স্কুলে একসাথে পড়েছেন। তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করেছেন, র‍্যাঞ্চে এসে ছুটি কাটানোর জন্যে।

ফিসফিস করে মুসা বলল, কিশোর, এ-কি! ব্রশিয়ারে কি দেখলাম, আর এসে কি দেখছি? এই অবস্থা তো কল্পনা করিনি।

রবিন! বারান্দায় দাঁড়ানো মহিলা এগিয়ে এলেন। বিশাল মুখে হাসি।

ব্যাগ হাতে দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন। আন্টি, কেমন আছেন? আমি…

আর বলতে হবে না, তুমিই রবিন। দেখেই চিনেছি।…আর তুমি কিশোর পাশা। তুমি মুসা।

গর্জন তুলে চত্বরে ঢুকল একটা ভ্যান। বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। জীপটার মতই এটার গায়েও সবুজ রঙে লেখা রয়েছে র‍্যাঞ্চের নামঃ ডাবল সি র‍্যাঞ্চ। পাশে পা তুলে দেয়া একটা কালো ঘোড়ার ছবি, র‍্যাঞ্চের মনোগ্রাম।

কয়েকজন নামল ভ্যান থেকে, তাদের মধ্যে রয়েছে এক তরুণী। বয়েস বিশ মত হবে, লাল চুল, মুখে হাসি। এগিয়ে এসে হাত বাড়াল প্রথমেই কিশোরের দিকে, হাই, আমি লিলি মরগান। তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা?

মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।

খুব খুশি হলাম তোমাদেরকে দেখে, হাসি এবং আন্তরিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে লিলির চোখ। তবে ঠোঁটের কোণে ক্লান্তির হালকা ছাপও স্পষ্ট। যাও, ভেতরে যাও। আমাদের আরও মেহমান আছে, তাদেরকে খাতির যত্ন করতে হবে আমাকে। আন্টির সঙ্গে তো পরিচয় হয়েই গেছে তোমাদের। রাঁধুনী, নার্স, অ্যাকাউনটেন্ট, হাউসকীপার, সব এক হাতেই করেন। আন্টি না থাকলে যে আমার কি দুর্গতি হত! আরেক বার হেসে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল লিলি ভ্যানের কাছে দাঁড়ান অন্য মেহমানদের দিকে।

সবই করেন তাহলে আপনি, কেরোলিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।

হাত দিয়ে ডলে অ্যাপ্রনের ভাজ সমান করতে লাগলেন তিনি। এভাবে সামনাসামনি প্রশংসায় লজ্জা পেয়েছেন। লিলির কথা আর বল না। এসো, তোমাদের ঘর দেখিয়ে দিই। হাতমুখ ধুয়ে এসো। লেমনেড খেতে দেব।

আউফ, দারুণ কথাটা বলেছেন আন্টি, মুসা বলল। এটাই চাইছিলাম এখন।

মাটিতে নামিয়ে রাখা ওর ডাফেল ব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল কিশোর। বাধা দিয়ে কেরোলিন বললেন, থাক, তোমাদের নিতে হবে না। ব্রড আর টিম আছে, দিয়ে আসবে।

হাউসকীপারের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। প্রবেশপথের মুখ থেকেই চার দিকে চলে গেছে চারটে শাখাপথ। সিঁড়ি উঠে গেছে ওগুলোর মাথা থেকে। একটা সিঁড়ির গোড়া থেকে বড় একটা হলঘর চলে গেছে বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘর পর্যন্ত। বায়ে রয়েছে ডাইনিং রুম, লম্বা লম্বা টেবিল পাতা। ওই ঘর আর রান্নাঘরের মাঝে দরজা রয়েছে, সুইংডোর লাগান। ডানে লিভিং রুম। পাইন। কাঠের প্যানেলিং করা। আসবাবপত্র সব পুরানো, মলিন, কাঠের মেঝেতে পাতা কার্পেটটাও বিবর্ণ। ছাত ধরে রেখেছে বড় বড় কড়িকাঠ। দেয়ালে আঁকা রয়েছে। ওয়াগনের ছবি। এক কোণে একটা রিভার-রক ফায়ারপ্লেস, ওটার ম্যানটেল বোঝাই হয়ে আছে নানারকম ট্রফিতে।

এসব পুরস্কার কি সব লিলি জিতে এনেছে? দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল মুসা।

সঅব। এখানে ওর মত ঘোড়ায় চড়তে পারে না আর কেউ, গর্বের সঙ্গে বললেন কেরোলিন। হাঁটতে শেখার আগেই ঘোড়ায় চড়তে শিখেছে মেয়েটা, তা ও জিন ছাড়া, ইনডিয়ানদের মত ঘোড়ার খালি পিঠে। বারো বছর বয়েসে স্থানীয় সমস্ত রোডিও প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। এর কয়েক বছর পরেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল দেশভ্রমণে। তাতেও পুরস্কার জিতে নিয়ে শেষে এসে এই– র‍্যাঞ্চের কাজে লেগেছে।

কাজে লেগেছে মানে? জানতে চাইল কিশোর।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন কেরোলিন। ওর সাহায্য দরকার হয়েছিল ওর বাবার, অ্যাক্সিডেন্টের পর। প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, এসো। ঘরে চলো। চওড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে দোতলায় নিয়ে চললেন তিনি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পাশের দেয়ালে টানানো ছবিগুলো দেখল কিশোর। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে থামল, ফ্রেমে বাঁধাই একটা সাদা কালো ছবি দেখে। কার ছবি? লিলির বাবার? কাউবয়ের পোশাক পরা একজন মানুষের ছবি, সেদিকে হাত তুলল সে।

হাসি মলিন হয়ে এল কেরোলিনের। হ্যাঁ, লিলির বাবা। মেয়েটাকে একাই মানুষ করেছেন। লিলির মা মারা গেছে ওর পাঁচ বছর বয়েসে।

মা বলে, রবিন বলল, লিলি নাকি আপনার মেয়ের মত।

বিষণ্ণতা ফুটল কিশোরের চেহারায়। তারও মা নেই। ছোটবেলায় এক মোটর দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। তারপর থেকে বড় হয়েছে মেরিচাচীর কাছে। লিলির বাবার দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল, জানতে ইচ্ছে করছে তার। জিজ্ঞেস করল, বাপ-মেয়ের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, না?

ছিল, সিঁড়ির মাথা থেকে জবাব দিলেন কেরোলিন।

লম্বা করিডরে মলিন কার্পেট পাতা। দোতলায়ও হলঘর আছে। এক প্রান্ত থেকে নেমে গেছে আরেকটা সিঁড়ি।

কিশোরকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেরোলিন জানালেন, ওটা দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়া যায়। আর এই যে দরজাগুলো দেখছ, এগুলো বেডরুম। মেহমানদের থাকার। সিঁড়ির ডানের একটা দরজা খুলে বললেন, এটা তোমাদের ঘর।

একটা জানালা খুললেন কেরোলিন। হুড়মুড়িয়ে যেন ঘরে ঢুকল গরম বাতাস, তাজা খড়ের গন্ধে ভারি হয়ে আছে। মুসা বলল, বাহু, গন্ধটা তো চমৎকার।

 হ্যাঁ, কেরোলিন বললেন। ভালই ছিল সব কিছু। নষ্ট করে দিল ওই শয়তান ঘোড়াটা।

শয়তান ঘোড়া? ইউনিকর্নের কথা বলছেন? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।

ওটাকে যে এখনও কেন রেখেছে লিলি বুঝি না। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। কেরোলিন। কাঁধ দিয়ে ঠেলে আরেকটা দরজা খুললেন। এখানে আরেকটা ঘর আছে। দুটো ঘরে থাকতে পারবে তো তিনজনে?,

নিশ্চয়ই, রবিন বলল। একটা হলেও পারতাম।

প্রথম ঘরটা ছোট, একটা সিঙ্গল বেড, পুরানো কার্পেট, একটা রকিং চেয়ার, আর একটা আলমারি আছে। পরের ঘরটা বড়, সবই একটা করে আছে, কেবল বিছানা দুটো। যে কোন একজনকে থাকতে হবে ছোট ঘরটায়। ওয়েস্টার্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি ঝোলানো রয়েছে দেয়ালে। জানালায় লাগানো হয়েছে ভারি কাপড়ের পর্দা।

ঘর দেখিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন কেরোলিন।

এখন কে কোনটাতে থাকবে ঠিক করতে বসল তিনজনে। মুসা প্রস্তাব দিল, টস করা হোক। কিশোর টসে জিতল। সে থাকবে ছোট ঘরটায়, একা। বড়টায় অন্য দুজন।

রবিন বলল, আমি থাকব জানালার কাছে। বলতে বলতে গিয়ে যেন নিজের জায়গা দখলের জন্যেই উঠে পড়ল দেবে যাওয়া ম্যাট্রেসে। রাতে ঝিঁঝি আর কয়োটের ডাক শুনতে পাব এখান থেকে। আমার খুব ভাল লাগে।

থাকো, আমার আপত্তি নেই, মুসা বলল।

জানালা দিয়ে মুখ বের করল রবিন। তোমরা যাই বলো, আমার কাছে। এটাকে লাগছে গোস্ট টাউনের মত। ওই যে, ওয়েস্টার্ন শহরে ভূতুড়ে শহরের কথা শোনা যায় না, সে রকম।

ঠিকই বলেছ, একমত হলো কিশোর, ও রকমই। কেমন যেন পোড়ো পোড়ো লাগে। বিছানায় উঠে এসে রবিনের পাশে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। কাজ করছে কয়েকজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ড, র‍্যাঞ্চের শ্রমিক ওরা। ঘোড়াকে ব্যায়াম করাচ্ছে কেউ, কেউ জিন আর লাগাম পরিষ্কার করছে, কেউ বা বেড়া পরিষ্কারে ব্যস্ত। তবে এতবড় একটা র‍্যাঞ্চে যত লোক থাকার কথা, যতটা সরগরম থাকার কথা, সে রকম নেই। হলোটা কি এখানে, বলো তো?

পুরোপুরি সব জানি না, রবিন বলল। মার কাছে যতটা শুনেছি। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন লিলির বাবা। অকর্মণ্য হয়ে যান। র‍্যাঞ্চের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তদারকির অভাবে। শেষে মারাই গেলেন। বাধ্য হয়ে রোডিও খেলা বাদ দিয়ে সাহায্য করতে আসতে হয় লিলিকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রূকুটি করল রবিন। তবে তখন দেরি হয়ে গেছে। আরেকটা র‍্যাঞ্চে চলে যেতে শুরু করেছে তখন মেহমানরা, টুরিস্ট, যারা এখানে বেড়াতে এলে থাকে।

বিড়বিড় করে কি বলল কিশোর বোঝা গেল না।

আমাদের পরে যে ভ্যানটা এল, দেখেছ? মুসা বলল, অনেক বড়, অনেক লোক ধরবে। অথচ নামল পাঁচজন, তা-ও একজন ড্রাইভার। ব্রশিয়ারে পড়লাম এই র‍্যাঞ্চে মেহমানই থাকতে পারে ষাটজন…আছে কজন এখন? আমাদেরকে নিয়ে বড় জোর দশ-এগারো?

কাছাকাছি হয়ে এল কিশোরের ভুরু। ভাঁজ পড়ল কপালে। এই কথাটা সে-ও ভেবেছে। বলল, হয়তো আসবে, পরে। ডিনারের এখনও দুই ঘণ্টা বাকি।

হয়তো, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তবে বিশ্বাস করতে পারছে না কথাটা।

ওদের মালপত্র নিয়ে দরজায় দেখা দিল ব্রড।

দেখি, দিন ওটা আমার হাতে, নিজের ব্যাগটা নিয়ে লোকটাকে সাহায্য করার জন্যে নেমে গেল কিশোর।

রবিন আর মুসাও এগোল।

বাপরে বাপ, কি ভারি, অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে ব্রড। সারা গরমটাই কাটাতে চলে এসেছ মনে হয়।

না, কিছু কাপড়চোপড় তো লাগেই, মুসা বলল, লাগে না?

রবিন বলল, তাছাড়া আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস দরকার হয়। অল্প অল্প নিতে গেলেও ভারি হয়ে যায়।

বেরিয়ে গেল ব্রড।

ব্যাগ খুলে তোয়ালে বের করল মুসা। তোমরা কি করবে জানি না, আমি গোসল করতে চললাম।

করগে, কিশোর বলল। আমি যাচ্ছি জায়গাটা ঘুরে দেখতে।

রবিন বলল, আমিও যাব।

ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরে এনে রাখল কিশোর। তারপর রবিনকে নিয়ে রওনা হলো নিচতলায়।

রান্নাঘরে ঢুকতেই ওদেরকে লেমোনেড দিলেন কেরোলিন।

খেতে খেতে র‍্যাঞ্চটার ব্যাপারে নানা খবর নিতে লাগল কিশোর। কেরোলিনও সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। জানালেন, কোথায় কোথায় রয়েছে। আস্তাবল, বাঙ্কহাউস, ট্যাকরুম আর ঘোড়ার বাচ্চা রাখার ছাউনি। বিশ্রাম নিয়েছে, লেমোনেড খেয়েছে। অনেকটা তাজা হয়ে বাইরে বেরোল দুই গোয়েন্দা, র‍্যাঞ্চ দেখার জন্যে।

ঘুরেটুরে দেখে এসে দাঁড়াল কাত হয়ে থাকা একটা বেড়ার কাছে। খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল একজন শ্রমিক কি করে ধূসর রঙের একটা ঘোড়ার বাচ্চাকে ট্রেনিং দিচ্ছে।

অনেক অবাধ্যতা করল বাচ্চাটা। লাফালাফি করল, ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিঠে জিন বাধতে দিতেই হলো।

কি দেখছ? ওদেরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল লোকটা। এটাকে এখন পোষ মানান হচ্ছে। পিঠে চড়ব। চেষ্টা করে দেখতে চাও? ও, আমি শেপ

আপত্তি নেই, এগিয়ে গেল কিশোর। হেসে বলল, দেখিই না পারি কিনা।

দেখো। খুব শয়তান, বলে দিলাম। হ্যাটটা ঠেলে পেছনে সরিয়ে হাত দিয়ে। কপালের ঘাম মুছল শেপ।

ইউনিকর্নের বংশধর নাকি?

 শক্ত হয়ে গেল শেপের চোয়াল। না।

ইউনিকর্ন তো এখানে বিখ্যাত, তাই না?

কুখ্যাত। হ্যাটটা আবার আগের জায়গায় নিয়ে এসে ঘোড়ার গলার রশি ধরে টান দিল। গোলাঘরের দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোরকে অবাক করে দিয়ে। কয়েক পা এগিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, পোষ মানান আরেক দিন শেখ। আজ আর এটাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কাহিল হয়ে পড়েছে। খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে।

তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সে-ও কম অবাক হয়নি। লোকটা দূরে চলে গেলে বলল, ইউনিকর্নের কথা কেউই আলোচনা করতে চায় না এখানে।

ভাবছি, কেন? আস্তাবলের দিকে তাকিয়ে গাল চুলকাল কিশোর। বিনা অনুমতিতে মেহমানদের ওখানে ঢাকার নিয়ম নেই। গেট বন্ধ। হুট করে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়তে না পারে সেই ব্যবস্থা করা আছে। ঘোড়াটাকে দেখার বড় লোভ হচ্ছে।

রবিনকে নিয়ে আবার র‍্যাঞ্চ হাউসে ফিরে চলল সে। পোশাক বদলে ডিনারের জন্যে তৈরি হতে হবে।

রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ মনে হয়? হাঁটতে হাঁটতে বলল রবিন।

 জবাব দিল না কিশোর। ভাবছে। ইউনিকনের ব্যাপারে ব্রড, কেরোলিন, এমনকি শেপের আচরণ কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে তার।

.

দ্রুত গোসল সেরে নিয়ে ধোয়া টি-শার্ট আর জিনস পরে নিচে রওনা হলো কিশোর। কয়েক ধাপ নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

নিচ থেকে শোনা যাচ্ছে একজন লোকের ভারি কণ্ঠ, রেগে গিয়ে বলছে, সময় শেষ হয়ে আসছে, লিলি, বোঝার চেষ্টা করো!

সিঁড়ির রেলিঙের কাছে এসে নিচে উঁকি দিল কিশোর। সামনের দরজায়। দাঁড়িয়ে আছে লিলি। কোমরে হাত, এদিকে পেছন করে আছে। যে লোকটা কথা বলছে সে রয়েছে বাইরে বারান্দায়, দেখা যাচ্ছে অবশ্য। বেঁটে, গোলগাল শরীর, লাল মুখ, পাতলা হয়ে এসেছে কালো চুল।

আপনার কাছ থেকে ওকথা শোনার কোন প্রয়োজন নেই আমার। লিলিও রেগে গেছে। গলা কাঁপছে ওর।

সেটা তোমার ইচ্ছে। তবে আর কোন উপায়ও নেই তোমার, লোকটার চোখজোড়ায় শীতল, কঠিন দৃষ্টি। কুকুর যেভাবে মাড়ির ওপর থেকে ঠোঁট সরিয়ে ভেঙচি কাটে, অনেকটা তেমনি করেই ভেঙচি কাটল লোকটা। বলল, দেখো, ডবসি কুপার আর হারনি পাইকের কাছে তুমি একটা মশা। টিপ দিলেই মরে যাবে। কি আছে তোমার? ছিলে রোডিও রাইডার, এখানে এসে হয়েছ একটা ধসে পড়া র‍্যাঞ্চের মালিক। সেটাও আবার বন্ধক দেয়া। তোমার ওই শয়তান ঘোড়াটারও কানা কড়ি দাম নেই। কেউ চড়তেই পারে না ওটার পিঠে, কে দাম দিতে যাবে? ভেবে দেখ আমার কথা। লিলিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জুতোর গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরল সে। গটমট করে নেমে চলে গেল বারান্দা থেকে।

 এতক্ষণ সোজা করে রাখলেও লোকটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁকা হয়ে গেল লিলির কাঁধ, যেন ভার বইতে পারছে না আর। ঘুরল। ঘুরতেই কিশোরের চোখে চোখ পড়ল।

সরি, আড়ি পেতে শুনতে চাইনি, কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তাড়াতাড়ি নেমে গেল নিচতলায়। কানে এল ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ। যেন বিশেষ কারও ওপর ঝাল দেখার জন্যেই টায়ারের শব্দ তুলে, গর্জন করে ছুটতে শুরু করল। জানালা দিয়ে লম্বা একটা সাদা গাড়ি দেখতে পেল সে।

কিছুই হয়নি এরকম একটা ভঙ্গি করল লিলি। কিন্তু চেহারার ফেকাসে ভাব দূর করতে পারল না। ওর নাম ফিলিপ নিরেক। গলা কাঁপছে মেয়েটার। ঢোক গিলল। আমার সর্বনাশ করতে চায়।

কেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

এই র‍্যাঞ্চটা চায় ও। কয়েক বছর আগে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিল আব্বা। ঘোড়ার খেলা দেখিয়ে আমিও কিছু কামিয়েছিলাম। দুজনের টাকা দিয়ে কিছু গরুঘোড়া কিনলাম, ব্যবসার জন্যে। এই র‍্যাঞ্চটা কিনলাম। অনেক বেশি খরচ করে ফেললাম আমরা। ভাবলাম, কি আর হবে, আস্তে আস্তে তুলে নেব টাকাটা। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট করে বসল আব্বা। কাজ করার ক্ষমতা রইল না। রোডিও খেলা বাদ দিয়ে চলে আসতে হলো আমাকে। তবু সামাল আর দিতে পারলাম না। একের পর এক গোলমাল হতেই থাকল।

এই ফিলিপ নিরেক লোকটা কে?

ব্যাংকের লোন অফিসার। ঋণ শোধ করার সময় শেষ হতে আরও কিছুদিন। বাকি, অথচ এখনই এসে হুমকিধামকি শুরু করেছে। বলছে কোনদিনই পারব না। র‍্যাঞ্চ বন্ধ করে দিতে।

লিলির উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। লিভিং রুমের দিকে চলল মেয়েটা। ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল কিশোর, আরও দুজন। লোকের নাম বলল শুনলাম?

হ্যাঁ। ডবসি কুপার আর হারনি পাইক। দুজনেই র‍্যাঞ্চার, ডাবল সির সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

ডবসি কুপার? নামটা পরিচিত লাগল কিশোরের। বেনি কুপারের কিছু হয় না তো? রোডিও স্টার?

বেনির বাবা। কাচের বাক্সে রাখা ট্রফিগুলোর দিকে তাকাল লিলি। আমি সরে আসতেই ও ওপরে উঠে গেল। নাম করে ফেলল। আমি থাকতে ট্রিক রাইডার আর বেয়ারব্যাক রেসার হিসেবে আমার পর পরই ছিল ও।

রোডিও খেলা দেখেছে কিশোর। রিঙের ভেতরে জিন ছাড়াই ঘোড়ার খালি। পিঠে বসে বেদম গতিতে ছুটতে থাকে খেলোয়াড়েরা। আরও নানারকম বিপজ্জনক খেলা দেখায়, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

এগিয়ে গিয়ে একটা ট্রফিতে হাত বোলাল লিলি। ফিলিপের বক্তব্য, ওই দুজন র‍্যাঞ্চারের সঙ্গে কোনমতেই এঁটে উঠতে পারবে না ডাবল সি। বিক্রি করে। দিতে বলছে হারনি পাইকের কাছে। অনেক জায়গাজমি কিনছে পাইক, মিস্টি ক্যানিয়নে হোটেল পাইকের কাছে। অনেতে পারবে না ডাবল সি বক্তব্য, ওই

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এ রকম একটা জায়গাকে কিছু বানিয়ে নষ্ট করা উচিত না।

প্রাণ থাকতে দেবও না আমি! ফুঁসে উঠল লিলি।

কি করে বাধা দেবেন?

ঝিক করে উঠল লিলির সবুজ চোখ। আবার কাজ শুরু করব।

কাজ তো করছেন… থেমে গেল কিশোর। ও, আবার রোডিও?

কেন নয়? জুলাইয়ের চার তারিখে ইডাহোর বয়েসে একটা বিরাট রোডিওর আয়োজন করা হয়েছে। এতবড় আয়োজন এই এলাকায় আর হয়নি। পুরস্কারের টাকাও অনেক বেশি। জিততে পারলে ব্যাংকের ঋণ সহজেই শোধ করে দিতে পারব। শুধু তাই নয়, যে জিতবে তাকে বিজ্ঞাপনে এমনকি সিনেমায়ও অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে। টাকার আর অসুবিধে হবে না তখন। র‍্যাঞ্চের খরচ সহজে জোগাতে পারব। এভাবে দুচারটা টুরিস্ট মৌসুম টিকিয়ে রাখতে পারলেই বেঁচে যাবে র‍্যাঞ্চটা। নিজের আয়েই চলতে পারবে তখন।

হ্যাঁ, ভালই হবে, কিশোর বলল। আইডিয়াটা মন্দ না।

 ঘণ্টা শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে।

ঘড়ি দেখল লিলি। খাবার সময় হয়েছে। লিলিকে দেরি করিয়ে লাভ নেই। ওকে কথা দিয়েছি, আজকে খাবার টেবিলে সাহায্য করব। কিশোরের দিকে তাকাল, তোমাকে এত কিছু বলে ফেললাম, কিছু মনে করনি তো?

লিলির সঙ্গে ডাইনিংরুমে এসে ঢুকল কিশোর। ঢোকার মুখেই দেখা হয়েছে ফোরম্যান লুক বোলানের সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লিলি। কিশোরের হাসির জবাব দিয়েছে লোকটা সামান্য একটু মাথা নুইয়ে।

লম্বা একটা টেবিলে বসে পড়েছে রবিন।

 আরি, তুমি আগে? কিশোর জিজ্ঞেস করল, মুসা কোথায়?

বলতে পারব না। আমি বাথরুমে থাকতেই ও ডেকে বলল, বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে।

দেখি, খুঁজে নিয়ে আসিগে। দেরি করলে তো ডিনার মিস করবে।

দরজার দিকে ঘুরল কিশোর, বেরোনর জন্যে। আচমকা, বিকেলের শান্ত বাতাসকে চিরে দিল যেন তীব্র একটা আতঙ্কিত চিৎকার। রেসের ঘোড়া।

.

০২.

চত্ত্বর ধরে ছুটতে ছুটতে আরেকটা চিৎকার শুনতে পেল কিশোর। আস্তাবলের দিক থেকে আসছে।

বিপদে পড়েছে মুসা, ভীষণ বিপদ। কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে তাকে। কোরালের বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বাঁকা হয়ে আছে। আক্রমণের ভঙ্গিতে ওর দিকে এগিয়ে চলেছে বিরাট কালো একটা ঘোড়া। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কালো চোখের তারা, ঘামে ভেজা চামড়া চকচক করছে সিকিউরিটি ল্যাম্পের আলোয়, নীলচে দেখাচ্ছে।

ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের হৃৎপিণ্ড। ইউনিকর্ন।

পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। সামনের দুই পা গেঁথে ফেলতে চায় মুসার বুকে। কিছুই করার নেই তার। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে মাথার ওপর দুহাত তুলে তাকিয়ে রয়েছে আতঙ্কিত অসহায় দৃষ্টিতে।

কোন রকম দ্বিধা না করে লাফিয়ে কোরালের বেড়া ডিঙাল কিশোর।

সাবধান! পেছন থেকে চেঁচিয়ে হুশিয়ার করল লিলি।

মাথা ঝাড়া দিল ঘোড়াটা। পা চালাল। সামনের দুটো খুর অল্পের জন্যে লাগল না মুসার মুখে।

চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে ছুটল কিশোর। ঘোড়াটার নজর এদিকে ফেরাতে চাইছে, যাতে মুসাকে আর আক্রমণ না করে।

ফিরেও তাকাল না ঘোড়াটা। আরেকবার লাফিয়ে উঠল পেছনের পায়ে ভর দিয়ে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কিশোর। মুসার এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সরো, সরে যাও!

পেছনে এসে চিৎকার শুরু করল লিলি। ঘোড়াটার নাম ধরে ডাকতে লাগল। এই সুযোগে মুসাকে নিয়ে সরে এল কিশোর। গেটের দিকে দৌড় দিল দুজনে। ঘোড়াটা আবার এদিকে নজর দেয়ার আগেই দৌড়ে গেট পেরিয়ে এল।

লিলি লাগিয়ে দিল গেট।

 থ্যা-থ্যাঙ্কস! গলা কাঁপছে মুসার।

কিছু হয়নি তো তোমার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ন-না! ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল আবার মুসা, এখনও ফোঁস ফোঁস করছে ওটা। আরি পরে, কি জানোয়ার…

কি হয়েছে? খোয়া বিছান পথে বুটের শব্দ তুলে দৌড়ে আসছে লুক, বোলান। মুসার কাছে এসে ঝাঁজাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করছিলে?

কয়েকজন মেহমানও এসে ঘিরে দাঁড়াল ওদেরকে।

গেট খোলা দেখে ঢুকে পড়েছিলাম, মুসা বলল। ভাবলাম বাড়িতে যাওয়ার এটা শর্টকাট…

গেট খোলা ছিল? তুমি শিওর?

হ্যাঁ।

মুসার হয়ে কিশোর বলল, হয়তো হুড়কো লাগাতে ভুলে গিয়েছিল…

অসম্ভব! মানতে পারল না লুক। গেট ঠিকমত বন্ধ রাখার ব্যাপারে কড়া নির্দেশ রয়েছে এখানে। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে ফোরম্যান। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছ তো?

আছি।

গুড। মেহমানরা সব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে জোর করে হাসল লুক। আপনারা যান। ডিনারের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

 অন্যান্য মেহমানদের নিয়ে সরে গেল ব্রড জেসন, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল লুক, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?

ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে লিলি। সেদিকে তাকিয়ে কিশোর জবাব দিল, দেখি, ঘোড়াটাকে।

আর কিছু না বলে লুকও কোরালে ঢুকল, লিলিকে সাহায্য করার জন্যে।

লিলির সঙ্গে কথা আছে, ফিসফিস করে দুই বন্ধুকে বলল কিশোর।

 কি? রবিনের প্রশ্ন।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গেটটা ইচ্ছে করেই খোলা রাখা হয়েছিল, কোন কারণে। ভাবছে কিশোর। ঘোড়াটার সম্পর্কে সবারই খুব খারাপ ধারণা। সেটাই যেন প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে জানোয়ারটাকে দিয়ে মুসাকে আক্রমণ করিয়ে।

কে গেট খোলা রাখতে যাবে?

সেটাই জানার চেষ্টা করব। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে মুসা, ওকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সত্যিই তোমার কোথাও লাগেনি তো?।

নাহ্, মাথা নাড়ল মুসা। তবে তোমরা আসতে আরেকটু দেরি করলেই হগেছিলাম। বাপরে বাপ, এরকম সাংঘাতিক জানোয়ার আর দেখিনি! এমন ভাবে আটকে ফেলল আমাকে কিছু করতে পারলাম না। হাসল মুসা। বড্ড খিদে পেয়েছে। কি দিয়েছে টেবিলে, দেখেছ? ডাবল চিজ আর পেপারোনি পিজা হলে খুব ভাল হত।

পুরোপুরিই স্বাভাবিক হয়ে গেছে মুসা, কথাতেই বোঝা গেল। হাসল রবিন। মুসাকে হতাশ করার জন্যেই যেন বলল, না, ওই জিনিস এখানে পাবে না। খেতে হবে মোষের কাবাব আর কালো কফি, ওয়েস্টার্ন কাউবয়দের মত।

মুখ বাঁকাল মুসা। আরে না, কি যে বলো। তার চেয়ে ভাল জিনিস নিশ্চয় বানাবেন কেরোলিন আন্টি। মেহমানরা কি আর অত বাজে খাবার খেতে পারে নাকি।

কিশোরও হাসল। তোমার জন্যে একলা যদি বানায়। আন্টির সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছ এসেই, খেয়াল করেছি।

ও, রান্নাঘরে কাজ করেছি দেখে? তা তো করতেই হবে। আমাদেরকে তো বলাই হয়েছে, যতদিন থাকব, র‍্যাঞ্চের কাজ করতে হবে। তাহলে থাকা-খাওয়া ফ্রি…তোমরা দুজন বেরিয়ে গেলে, আমিই তোমাদের হয়ে…

কেন যে রাজি হলাম, গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওসব রান্না-ফান্না এখন ভাল লাগে না আমার…।

কেন রাজি হয়েছি, খুব ভাল করেই জান তুমি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তুমিই তো অনুরোধ করলে আমাদেরকে আসতে…

করলাম তোমার কথায়। আমি কি আর জানি নাকি এতটা খারাপ অবস্থা। বেহমার বাল্যবন্ধুর অনুরোধ রাখতে এসে শেষে কোন্ হেনস্তা হতে হয়। কে জানে!

চোখ মিটমিট করল কিশোর। তা বোধহয় হব না। আর অবস্থা অতটা। খারাপও বোধহয় নয়, খালি রান্নাঘরেই বসে থাকতে হবে না।

 ভুরু কুঁচকে তাকাল রবিন, কেন, রহস্য পেয়ে গেলে নাকি এরই মধ্যে?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুজনকে বলল কিশোর, এক কাজ করো, তোমরা চলে যাও। আমি আসছি।

কি করবে? মুসা জানতে চাইল।

কাজ আছে। তোমরা যাও। পরে বলব সব।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল রবিন আর মুসা।

কোরালের বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল কিশোর। তার দিকে কড়া চোখে তাকাল একবার লুক। কেয়ারই করল না কিশোর, তাকিয়েই রয়েছে। খেপা ঘোড়াটাকে কিভাবে সামলাচ্ছে লিলি, দেখছে। কিছুতেই দড়ির বাঁধনে আটকা পড়তে চাইছে না ইউনিকর্ন, লাথি মারছে মাটিতে, মাথা ঝাড়ছে, ফোঁস ফোঁস। করছে। মোলায়েম গলায় কথা বলছে লিলি।

অবশেষে ধরা দিতেই হলো ঘোড়াটাকে।

কিশোরের দিকে এগিয়ে এল লুক। সাংঘাতিক বোকামি করে ফেলেছিল তোমার বন্ধু। ওটা ঘোড়া তো না, একটা শয়তান। খুনী।

খুনী? মানে?

লুক জবাব দেয়ার আগেই ঘোড়ার দড়ি ধরে ফিরে তাকিয়ে লিলি বলল, অহেতুক দোষ দিচ্ছ কেন? ইউনিক কাউকে খুন করেনি।

নাকি সুরে ডেকে উঠল ঘোড়াটা।

সরু হয়ে এল লুকের চোখের পাতা। কিশোরকে বলল, একটা কথা বিশ্বাস, করতে পারো, ভয়ানক বদমেজাজী জানোয়ার ওটা। একটু আগে নিজের চোখেই। তো দেখলে। ওটার কাছ থেকে দূরে থাকবে। লিলির দিকে এগিয়ে গেল সে। ওর হাত থেকে দড়িটা নিয়ে বলল, এই শয়তানটাকে আমি সামলাচ্ছি। তুমি যাও। কিশোর তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।

দড়ি হাতবদল হতেই দ্বিধায় পড়ে গেল ইউনিকর্ন। নেচে উঠল। দড়ি ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ওকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করল লুক। টেনে নিয়ে চলল।

বেড়ার বাইরে এসে কিশোরের কাছে দাঁড়াল লিলি। মুসার কিছু হয়নি তো?

না। ভয় পেয়েছিল, সেরে গেছে।

পাবেই। বড় বড় র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ডদের ভয় পাইয়ে দেয় ইউনিক, আর মুসা তো… কথা শেষ না করেই কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল লিলি। তবে খুনী নয়। ঘোড়াটা, একথা বিশ্বাস করতে পার। লুক বাড়িয়ে বলেছে। এটা ওর স্বভাব। কিছু গড়বড় হয়ে গেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, অযথা দোষ দিতে থাকে একে ওকে। তাছাড়া ইউনিককে ও দেখতে পারে না।

দেখতে পারে না কেন?

আব্বার মৃত্যুর জন্যে ও ইউনিককে দায়ী করে। কিশোরের মতই লিলিও বেড়ায় হেলান দিয়ে তাকাল লুকের দিকে, জোর করে টেনে টেনে ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কেন? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।

সে অনেক কথা। ভীষণ বদমেজাজ ঘোড়াটার। কয়েক বছর আগে, রোডিও খেলার জন্যে নেয়া হয়েছিল ওটাকে। প্রচুর বদনাম কামিয়ে বিদেয় হতে হয়েছে। কারোরই চড়ার সাধ্য হয় না ওটার পিঠে। আব্বা তো ঘোষণা করে দিয়েছিল, যে। এক মিনিট ইউনিকনের পিঠে চেপে থাকতে পারবে, তাকে মোটা টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। অনেক কাউবয় চেষ্টা করেছে, কেউ পারেনি। উড়তে শুরু করে ঘোড়াটা। ধোয়াটে হয়ে এল লিলির চেহারা। শেষে আব্বা নিজেই একদিন চেষ্টা করল। ছুঁড়ে ফেলে দিল ওকে ইউনিক। জন্মের মত পঙ্গু হয়ে গেল আব্বা।

তাই? বিড়বিড় করল কিশোর। তারপরই বুঝি আপনাকে রোডিও ছাড়তে হল?

মাথা ঝাঁকাল লিলি। আমাকে আসতে বাধ্য করেছে আসলে লুক। ওকে এমনি দেখে যাই মনে হয়, মনটা ওর খুবই ভাল।

এ ব্যাপারে একমত হতে পারল না কিশোর। তাহলে অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে ইউনিককেই দায়ী করে লুক?

 হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াটাকেও দোষ দেয়া যায় না পুরোপুরি। আব্বা তো জানতই ওটা বদমেজাজী, কাউকে পিঠে চড়তে দেয় না, তারপরেও বোকামি করতে গেল কেন? লুকের তো একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বা শুনল না ওর কথা। অ্যাক্সিডেন্টের পর লুক চেয়েছিল ওরকম একটা বাজে জানোয়ারকে মেরেই ফেলা হোক। খামাখা বিপদ পুষে রেখে লাভ কি। যুক্তি আছে অবশ্য ওর কথায়। এই যেমন আজ আরেকটু হলেই মারা পড়েছিল মুসা। বাতাসে উড়ে এসে পড়া চুল। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল লিলি। আব্বা লুকের কথায় কানই দেয়নি। তার ধারণা ছিল, ইউনিক এই র‍্যাঞ্চের জন্যে একটা অ্যাসেট। চড়তে না দিলে না দিল, প্রজনন তো করতে পারবে। ওর যেসব বাচ্চা হবে, একেকটা সোনার টুকরো।

হয়েছে নাকি?

 নিশ্চয়ই। ওর কয়েকটা বাচ্চার বয়েস তিন বছর হয়ে গেছে। ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওগুলোকে। ঘোড়া যারা চেনে তাদের ধারণা রোডিও খেলার জন্যে খুবই ভাল জানোয়ার হবে ওগুলো। আব্বার আশা ছিল, ইউনিকের বাচ্চা বিক্রি করেই র‍্যাঞ্চের ধার শোধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু তার আশা পূরণ হওয়ার আগেই চলে গেল অন্য দুনিয়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিলি।

সরি, সহানুভূতি জানাল কিশোর।

র‍্যাঞ্চিং ব্যবসা খুব ভাল বুঝত আব্বা। তার কাছেই কাজ শিখেছে লুক। সে ও ভাল বোঝে। হঠাৎ কি মনে হতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, লিলি। চলো, তোমাকে। একটা জিনিস দেখাব। রেসের ঘোড়া

লিলির পিছু পিছু আস্তাবলে ঢুকল কিশোর। আলো জ্বালল লিলি। নাক দিয়ে শব্দ করল কয়েকটা ঘোড়া। স্টলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় গলা বাড়িয়ে দিতে লাগল ওগুলো, ওদের নাম ধরে ডাকল সে, আদর করে হাত বুলিয়ে দিল। মাথায়। কিশোরও কোন কোনটাকে আদর করল, দেখল ওগুলোর টলটলে বাদামী চোখ।

স্টলের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল ওরা। খড়ের বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল ইউনিকর্নের মত দেখতে আরেকটা ঘোড়া। শান্ত সুবোধ, চোখে আগুন নেই। ওর নাম হারিকেন, ঘোড়াটার গলায় হাত বোলাতে লাগল লিলি। ইনডিপেনডেন্স ডে রেডিওতে এটার পিঠেই চড়ব আমি। হারিকেন নামটা ওর জন্যে ঠিকই হয়েছে, ঝড়ের মতই গতি। ওকে ছাড়া জেতার আশা কমই আমার।

দেখতে তো একেবারে…

 ইউনিকের মত।

 যমজ।

রেয়ার, তবে হয়। মেজাজ একেবারে বিপরীত দুটোর। এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে হারিকেন, কিন্তু খেলার সময়… ওরিব্বাপরে, না দেখলে বিশ্বাসই করবে না। পকেট থেকে একটা আপেল বের করে ঘোড়াটাকে খেতে দিল লিলি।

আলাদা করে চেনেন কি করে দুটোকে?

চেনা খুবই কঠিন, তবে আমি পারি। সামনের ডান পায়ের খুরটা দেখো। সামান্য ওপরে একটুখানি জায়গার নোম সাদা দেখতে পাচ্ছ না? শুধু এটারই আছে, ইউনিকের নেই।

গলা বাড়িয়ে দেখল কিশোর। খুব ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না, সাদা অংশটা। হারিকেন নিশ্চয় খুব দামি?

 তা তো বটেই। কিন্তু আমার মতে ইউনিকের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত। ওর একেকটা বাচ্চা যা হয় না, আগুন।

এক পা এগিয়ে এসে রেইলের ওপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিল হারিকেন। কুচকুচে কালো রঙ, অনেক উঁচু, একটা দেখার মত জানোয়ার। ওর মসৃণ গলায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর। ঘোড়াটাও বাহুতে নাক ঠেকিয়ে দিয়ে আদর নিতে লাগল।

লিলি হাসল। ও তোমাকে পছন্দ করেছে।…চলো, আর দেরি করব না। আলো নিভিয়ে দিল সে।

চত্বর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, গেটটা কে খুলে রাখল, বলুন তো?

কি জানি, মাথা নাড়ল লিলি।

এরকম আর হয়েছে?

হয়েছে, দুএকবার। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহমানরা ঢোকে, তারপর লাগাতে ভুলে যায়। ব্যাপারটা নিছকই অ্যাক্সিডেন্ট। বলল বটে লিলি, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে মনে হল না একথা বিশ্বাস করে সে। যত যাই বলো, আমার ভাই সাহস হচ্ছে না, ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে। রয়েছে মুসা। আগের সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারছে না।

ভয় নেই, হেসে বলল কিশোর। ভাল ঘোড়াই দেয়া হবে তোমাকে। শয়তানী করবে না।

পরদিন সকালে আস্তাবলের কাছের বড় কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। অন্য মেহমানরাও রয়েছে কাছাকাছি।

যার যার দায়িত্বে চড়বেন, ব্রড বলল। কি করে জিন পরাতে হয়, লাগাম লাগাতে হয় শিখিয়ে দেব। কারও চড়ার অভ্যেস আছে?

চড়েছে, জানাল তিন গোয়েন্দা। ওদেরকে সরিয়ে দেয়া হল বোসটনের ডক্টর কাপলিঙের পাশে। ডক্টরের স্ত্রী এবং কন্যাকে সরিয়ে আনা হলো কানসাসের একটা পরিবার আর শিকাগোর দম্পতি মাইক ও জেনি এজটারের পাশে, এরা কেউই চড়তে জানে না।

সবাইকেই একটা করে ঘোড়া আর জিন দিল ব্রড। কিশোরকে দেয়া হলো। একটা জেলডিং ঘোড়া। হরিণের চামড়ার মত ফুটফুটে চামড়া। নামটা বিচিত্র, জেনারেল উইলি। সবচেয়ে ভাল ঘোড়াগুলোর একটা দিলাম তোমাকে, ব্রড বলল। দেখো চড়ে, মজা পাবে। লিলি বলছিল ঘোড়ারা নাকি তোমাকে পছন্দ করে।

ব্রডকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘোড়াটার মণ চামড়ায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর।

জিন পরাতে শুরু করল সে। রবিন, মুসা আর ডক্টর কাপলিংও যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগলেন।

রবিনকে দেয়া হয়েছে একটা মাদী ঘোড়া, কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের, জিন। পরাতে গেলে কেবলই পাশে সরে যেতে চায়। নাম, স্যাণ্ডি। মুসার ঘোড়াটাও একটা প্যালোমিনো মাদী ঘোড়া, শান্ত, নাম ক্যাকটাস।

নিজের ঘোড়ায় পিঠ সোজা করে বসল ব্রড। পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে চলল ধুলোঢাকা একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে। দুধারে পাইনের ঘন জঙ্গল। কিছুদূর। এগিয়ে একপাশে দেখা গেল একটা পাহাড়ী নালা বয়ে চলেছে। পানি বেশি না। পরিচিত পথ ধরে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে ঘোড়ার মিছিল।

ফেরার পথে যার যেভাবে ইচ্ছে ঘোড়া চালানর অনুমতি দিল ব্রড।

লাফ দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের জেনারেল উইলি। মসৃণ গতি। সামনের দিকে ঝুঁকে রইল কিশোর। বাতাসে উড়ছে ঘোড়ার ঘাড়ের লালচে চুল। অন্যদের, এমনকি ব্রডেরও অনেক আগেই কোরালের কাছে পৌঁছে গেল ঘোড়াটা। গর্ব হতে লাগল কিশোরের।

ভাল চালাতে পার তো তুমি, পাশে এসে ওর প্রশংসা করল ব্রড।

আসলেই ঘোড়াটা ভাল, জেনারেলের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বলল কিশোর।

কোরালের ভেতরে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল তার। ভেতরে ছোটাছুটি করছে ইউনিকর্ন। পিঠে আরোহী নেই। এই দিনের আলোয়ও ভয়ঙ্কর লাগছে। ঘোড়াটাকে। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, কাল কে গেট খোলা রেখেছিল জানেন?

হাসি মলিন হয়ে গেল ব্রডের। আমি কি করে জানব? আমি তো ডিনারে বসেছিলাম।

সব মেহমানরাই বসেছিল।

নতুন কয়েকটা ছেলেকে আনা হয়েছে কাজ করতে, ওদের কেউ হতে পারে। কিংবা তোমার বন্ধুও খুলতে পারে।

 পাশে এসে দাঁড়াল রবিনের ঘোড়া, স্যাণ্ডি। লাফিয়ে নামল রবিন। নাচতে লাগল চঞ্চল ঘোড়াটা, কিছুতেই যেন স্থির থাকতে পারে না।

মুসা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

থাবা দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে রবিন বলল, পেছনে। মুসা আর ডক্টর, দুজনকেই পেছনে ফেলে এসেছে স্যাণ্ডি। ধুলো খাচ্ছে ওরা।

কপালে হাত রেখে শুকনো মাঠের ওপর দিয়ে তাকাল ব্রড। হলোটা কি? ওদের তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। যাই, দেখি কি হলো? তোমরা তোমাদের ঘোড়াগুলোকে ঠাণ্ডা করতে পারবে?

তা পারব। আমরা আসব, দরকার হবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। লিলি জিজ্ঞেস করলে বল কোথায় গেছি। এখনই চলে আসব। ঘোড়া চালিয়ে রওনা হয়ে গেল ব্রড।

 ঘোড়ার লাগাম ধরে টানতে টানতে ওগুলোকে গোলাঘরের কাছে নিয়ে চলল দুই গোয়েন্দা। কিশোর বলল, রবিন, বলো তো কাল কে কোরালের গেট খুলে রেখেছিল? এ ব্যাপারটা কি? কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, সত্যিই রহস্য পেয়ে গেলে মনে হচ্ছে?

হচ্ছে, যদিও নিশ্চিত হতে পারছে না কিশোর। সোনালি চুল, লম্বা, বেনিরই বয়েসী একটা মেয়েকে আসতে দেখল। পরনে জিন্স, গায়ে সিলভার-ট্রিম ওয়েস্টার্ন শার্ট, গলায় লাল রুমাল, মাথায় সাদা হ্যাট।

হাই, আরেকটু কাছে এসে ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল মেয়েটা, ব্রডকে দেখেছ? আমি বেনি কুপার, ওর বন্ধু।

নিজের আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর। তারপর বলল, এই একটু ওদিকে গেছে। এখুনি চলে আসবে।

গামলার কাছে এনে জেনারেলকে পানি খেতে দিল সে। খাওয়া হয়ে গেলে কোরালে ঢুকিয়ে দিয়ে এল অন্যান্য ঘোড়ার সঙ্গে।

অপেক্ষা করছে বেনি। ঘড়ি দেখল। সময় নেই আমার। আব্বাকে বলে এসেছি, শিগগিরই গিয়ে প্র্যাকটিস করব। মাঠের ওপাশে তাকাল ব্রডকে দেখার আশায়।

স্যাণ্ডিকে ঢোকানর জন্যে গেট খুলছে রবিন। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে আপনিও খেলবেন নাকি?

খেলব। কোমরের বেল্টের রূপার বাকলসের মতই চকচক করল বেনির হাসিটা। এই সময় লিলিকে আসতে দেখা গেল।

হাই, বেনিকে বলে কিশোর আর রবিনের দিকে ফিরল লিলি। আর সবাই কোথায়?

আসছে। কিশোর তাকিয়ে রয়েছে বেনির দিকে, লক্ষ্য করল, কি করে দ্রুত মিলিয়ে গেল মেয়েটার হাসি। ব্রড চলে এসেছিল আমার সঙ্গে। আবার গেছে দেখতে কোন গোলমাল হলো কিনা।

তাই নাকি?

 কি শুনছি, লিলি? বেনি জিজ্ঞেস করল, আবার নাকি ব্লেডিওতে ঢুকবে?

আর কোন উপায় নেই, উদ্বিগ্ন হয়ে দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে লিলি। বয়েসের ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিও দিয়েই শুরু করব আবার। বিকেলের উজ্জ্বল রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে চোখের পাতা মিটমিট করছে সে। যাই। দেখা দরকার, কি হলো।

আবার ঘড়ি দেখল বেনি। ওকে বল আমি এসে খুঁজে গেছি। গুডবাই না বলেই ঘুরে দাঁড়াল বেনি, গটগট করে হাঁটতে লাগল তার পিকআপের দিকে।

আপনি আবার খেলবেন শুনে খুশি হতে পারেনি ও, কিশোর বলল।

হবে কি করে? আমার কাছে হেরে যাওয়ার ভয় আছে না। ছোটবেলা থেকেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী। নাকের ডগা চুলকাল লিলি। ব্রডের সাথে বেশ ভাব মনে হয়! ও আসার পর থেকে প্রায়ই আসে আমাদের এখানে।

ওই যে, আসছে, চিৎকার করে বলল রবিন।

মাথা ঘুরিয়ে কিশোরও দেখতে পেল। আসছে দলটা।

এগিয়ে এল মুসা। চোখ বড় বড়। মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ছে। উত্তেজিত লাগছে তাকে।

কি ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।

ডক্টরের জিন ঢিল হয়ে গিয়েছিল, কাছে এসে বলল মুসা। ক্যাকটাসের পিঠ থেকে নেমে ডলে দিতে শুরু করল ওর চামড়া। তার জন্যে থামতেই হলো আমাদের।

চড়লে কেমন? জিজ্ঞেস করল।

দারুণ! ক্যাকটাসের জিন খোলায় ব্যস্ত হল মুসা। ঘোড়াটাও খুব ভাল। জিন খুলে নিয়ে ওটার পেছনে চাপড় দিয়ে বলল সে, যা, যা। কোরালের দিকে দুলকি চালে এগিয়ে গেল প্যালেমিনো।

.

আগের দিনের চেয়ে আধঘন্টা পরে ডিনারের ঘন্টা পরল এদিন। টেবিলে রবিন আর মুসার পাশে বসল কিশোর। দেখল, লিলির চেয়ারটা খালি। নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে কয়েকজন শ্রমিক। স্পষ্ট শোনা যায় না সব। কান। খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল কিশোর।

এখনও আসছে না কেন? ফোরম্যান লুক বোলান বলল।

আসবে, বলল ব্রড। ও তো আর শিশু নয়, ঠিকই চলে আসবে। কাজেটাজে গেছে হয়তো কোথাও।

বড় বেশি উল্টোপাল্টা ব্যাপার ঘটছে ইদানীং র‍্যাঞ্চে, বলল আরেকজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল।

গোলমাল হয়েছে, ফিসফিস করে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। দেখতে যাচ্ছি।

বেশি চিন্তা করছ, মুসা বলল। দেখগে, কোথায় কি কাজ করছে।

ডিনারের পরও করতে পারত। কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করব। তোমরা এখানে থাক, আর কিছু বলে কিনা ওরা শোন।

রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। অস্থির লাগছে কেরোলিনকে। কিছু করতে হবে নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

পারবে? সত্যিই সাহায্য চান মহিলা। বার বার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছেন। বাইরে। রাতের অন্ধকার নামছে। এভাবে এতক্ষণ তো দেরি করে না কখনও লিলি?

শহরে যায়নি তো? বড় একটা ট্রেতে চকলেট কেকের প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল কিশোর।

না, গেলে বলে যেত। ঘণ্টা দুই আগে হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়েছে। এক্সারসাইজ করাতে। বলেছে, খাওয়ার আগেই চলে আসবে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল মহিলার মুখে। কি যে করবে বুঝতে পারছি না… থেমে গেলেন আচমকা। এ কি হয়েছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল কিশোর। সাদা হয়ে গেছে কেরোলিনের মুখ। জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। কি দেখেছে দেখার জন্যে ছুটে এল সে জানালার কাছে। ধক করে উঠল বুক। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে হাত-পা।

একটা গাড়ি আসছে। পেছনে আসছে কালো একটা ঘোড়া। পিঠে জিন বাঁধা, অথচ আরোহী নেই।

Super User