তিন গোয়েন্দা – ভলিউম ২৯ – আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৮

০১.

ঝড় একবার হয়ে গেছে। আকাশের অবস্থা, দেখে মনে হচ্ছে শেষ হয়নি, আবারও হবে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ছোট্ট শহর হিলটাউনে দোকানপাট সব আটটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন বাজে রাত এগারোটা। তার ওপর ঝড়। ঘরের বাইরে লোকজন স্বভাবতই কম।

এখানকার স্ট্রিপ মলটা এমন আহামরি কিছু নয়। একটা লন্ড্রি, একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং একটা ভিডিও আর্কেড, ব্যস। আর কিছু নেই। স্টোরটা বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। লন্ড্রিও বন্ধ। খোলা রয়েছে কেবল ভিডিও আর্কেড। মাঝরাতের আগে কখনোই বন্ধ হয় না।

ভেজা, তেলতেলে হয়ে আছে পার্কিং লট। চকচক করছে। একটামাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আজ। একটা ক্লাসিক কনভার্টিবল। ছাতটা খোলা। যেন বৃষ্টিতে ভেজার পরোয়া নেই।

ওটার মালিক লেসলি কার্টারিসও বৃষ্টিকে পরোয়া করে না। করার উপায়ও নেই। তাহলে পেট চলবে না। ঝড়ের মধ্যেও বাড়িতে বাড়িতে পিজ্জা সাপ্লাই দিতে হয়েছে ওকে। বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই আর্কেডে এসেছে ভিডিও গেম মেশিনের ওপর রাগ ঝাড়তে।

সে ভেবেছে সে-ই একমাত্র কাস্টোমার, তাকে বিরক্ত করবে না কেউ। ভারটিউয়াল ম্যাসাকার-২ খেলছে। নিজেকে পর্দার একজন ভারটিউয়াল ফাইটার কল্পনা করে নিয়ে তাক করে লাথি মারছে শত্রুকে। যদিও হাই স্কুলের, ফুটবল ম্যাচে খেলার মত আনন্দ নেই এতে। কিন্তু স্কুলে খেলতে যাওয়ার আর উপায় নেই। দুই বছর আগেই সে পাট চুকিয়ে এসেছে।

বোতামে টিপ দিয়ে গাড়ির গিয়ারের মত করে জয়স্টিক ধরে টান দিল লেসলি। কয়েক মাস আগেই হাই স্কোর লিস্টে নাম উঠে গেছে তার। BPE নাম সই করে রেখেছে কোন একজন হেরে যাওয়া খেলোয়াড়। শয়তানি করে সমস্ত হাই স্কোর লিস্ট লক করে দিয়েছে আজকে। চাপাচাপি করে তাতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল লেসলি, কিন্তু ভরসা কম। ইতিমধ্যেই দুজন খেলোয়াড়কে হারিয়ে বসে আছে। তৃতীয়টাকেও হারাতে চলেছে

এই যে, ভাই, পেছন থেকে ডেকে বলল একটা ভোতা কণ্ঠ, আমি খেলছিলাম ওখানে।

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকাল লেসলি। ফ্যাকাসে চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। মাথায় তেলকালি লাগা বেজবল ক্যাপ। গায়ে, টি-শার্টেও কালি।

বাথরূমে গিয়েছিলাম, ছেলেটা বলল।

তো আমি কি করব? কর্কশ জবাব দিল লেসলি। দেখেই রাগ লাগছে। তার। এই ছেলেটাই বোধহয় সেই হেরে যাওয়া খেলোয়াড়। বয়েস আঠারো-উনিশ। বখাটে চেহারা। মোটেও পছন্দ হলো না লেসলির। তার ধারণা, পাড়ায় পাড়ায় মস্তানি আর মেয়েদের পেছনে লাগা ছাড়া এর অন্য কোন কাজ নেই।

পর্দার দিকে নজর ফেরাল সে। দেরি হয়ে গেছে। কারাতের কোপ মেরে তার ভারটিউয়াল ফাইটারের ঘাড় মটকে দিয়েছে শত্রুপক্ষের এক যোদ্ধা। তাকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গভরা মন্তব্য আর পিত্তিজালানো যান্ত্রিক হাসি ছুঁড়ে দিল মেশিন। আরও রাগিয়ে দেয়ার জন্যেই যেন উজ্জ্বল লাল আলোয় গেম ওভার লেখাটা টিপটিপ করতে লাগল চোখের সামনে।

বিরক্ত হয়ে মেশিনকে এক চড় মারল লেসলি। ঝটকা দিয়ে ঘুরে তাকাল হাড্ডিসার ছেলেটার দিকে। সব রাগ গিয়ে পড়ল ওর ওপর। খেলা পণ্ড করেছে বলে। গর্জে উঠল, দিলে তো!

ক্যাপের ছায়ায় মুখের অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে ছেলেটা। খেলা তো আপনি আমারটা নষ্ট করলেন। আমি ওখানে খেলছিলাম। মাঝখান থেকে আপনি ঢুকে পড়লেন।

তুমি গেলে কেন?

বাথরূম পেলে কি করব? আপনি অন্য কোন মেশিনে খেলতে পারতেন। এটাতেই কেন?

তুমি যে খেলছিলে কি করে জানব?

খেলাটা খোলা ছিল। ছিল না?

কতজনে অর্ধেক খেলে ফেলে রেখে চলে যায়…

বিলিই খেলছিল ওখানে, বলে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। আপনি ওর খেলাটা নষ্ট করেছেন।

ঘুরে তাকিয়ে মোটাসোটা একটা ছেলেকে দেখতে পেল লেসলি। লম্বা চুল। কোমরে ঝোলানো কয়েন রাখার ব্যাগ। ওর নাম উইলিয়াম গ্লেজব্রুক। কিন্তু সবাই ডাকে পটেটো। নামটা চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ডাকতে ডাকতে এটাই নাম হয়ে গেছে এখন। আসল নামে কেউ ডাকে না। লোকে জিজ্ঞেস করলে সে নিজেও এই নাম বলে। বোধহয় আসল লম্বা নামটা ভাল লাগে না তারও, খাটোটাই পছন্দ।

তুমি আবার কে? খেঁকিয়ে উঠল লেসলি। ওর চামচা?

 না, নাইট ম্যানেজার, জবাব দিল পটেটো।

মেশিনের দিকে সরে এল বিলি। সরুন।

লেসলির সন্দেহ হলো এই হাড্ডিসার ছেলেটাই মেশিনের রহস্যময় BPF। রাগ বেড়ে গেল তার। বিলির বুকে হাত রেখে জোরে এক ধাক্কা মারল।

একটা টেবিলের পায়ায় পা বেধে উল্টে পড়ল বিলি। টুপিটা খুলে পড়ে গেল। অদ্ভুত একটা দাগ দেখা গেল মাথার একপাশে।

ভুরু কুঁচকে গেল লেসলির। কিসের দাগ? মগজ অপারেশন করেছিল নাকি? ঠিক কাটা দাগের মত নয় দাগটা। বরং পোড়া দাগের সঙ্গে মিল বেশি।

হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল বিলি। লেসলির মনে হলো, একটা কিলবিলে পোকা পায়ের চাপে ভর্তা হওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে যেতে চেষ্টা করছে। নোংরা পাথরের তলায়। কল্পনাই করতে পারল না পোকাটা কি ভয়াবহ বিষাক্ত!

ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চলে গেল।

অন্ধকারে চিৎকার করে উঠল পটেটো, মানা করেছিলাম, শুনলেন না! নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনলেন! এখন আর কেউ ঠেকাতে পারবে না ওকে…

*

মাটিতে পড়ে থেকে ধীরে ধীরে লম্বা দম নিল বিলি ফক্স। রাগ কমানোর জন্যে নয়, বরং বাড়ানোর জন্যে। আর্কেড় এখন অন্ধকার। পার্কিং লটের বৃষ্টিভেজা। বাতিটা থেকে মলিন আলোর আভা এসে পড়েছে ঘরে।–

ক্যাপটা কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। শান্ত ভঙ্গিতে মাথায় পরল আবার। আগুন জ্বলছে মনে। কিন্তু প্রকাশ পেতে দিচ্ছে না। উত্তেজিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেয়ে এভাবে আস্তে আস্তে খেলে যাওয়ার মজা অনেক বেশি।

কোণের জুকবক্সটা গমগম করে বেজে উঠল হঠাৎ। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, তা ও বাজছে। কোথা থেকে শক্তি পেল ওটা বুঝতে পারল না লেসলি। দি নাইটওয়াকার বাজতে লাগল কানফাটা শব্দে। গানটা যে বিলির প্রিয় গান, তা-ও জানা নেই ওর।

লেসলির কাছে সরে এল বিলি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার দান তুমি খেলেছ। এবার আমার পালা।

বিলির কণ্ঠে এমন কিছু রয়েছে, অস্বস্তি বোধ করতে লাগল লেসলি। আর লাগার সাহস পেল না। পিছিয়ে এল। হ্যাঁ, খেয়ে আর কাজ পেলাম না, তোমার সঙ্গে ফালতু সময় করি! কণ্ঠের সেই একটু আগের জোরটাও নেই আর।

দরজার দিকে রওনা দিল সে।

*

পার্কিং লটের খোলা বাতাসে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লেসলি। আর্কেডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না সেসময়মত বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, বিদ্যুৎ ছাড়াই জুকবক্স বেজে ওঠা। কৌতূহল থাকলেও সাহস দেখাতে পারল না। বরং তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছে তাগাদা দিচ্ছে মনে।

গাড়িতে উঠে ইগনিশনে মোচড় দিল সে। ফুল ভলিউমে বেজে উঠল রেডিও। গানটা পরিচিত। অতি পরিচিত।

দি নাইটওয়াকার!

আর্কেডের জুকবক্সে এই গানই বাজছিল।

ও কিছু না! সেফ কাকতালীয়! মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। মোচড় দিয়ে অফ করে দিল রেডিওর সুইচ।

কিন্তু বেজেই চলল গান।

অসম্ভব! এ হতেই পারে না! নব ঘুরিয়ে কাটাটা পার করে দিল ডজনখানেক স্টেশন।

গান বন্ধ হলো না।

ফিরে তাকিয়ে দেখল আর্কেডের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হাড্ডিসার ছেলেটা। শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে এদিকে।

ফার্স্ট গিয়ার দিল লেসলি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল। ভেজা চত্বরে পিছলে গেল চাকা। তারপর এগোতে শুরু করল।

মনে পড়ল, কিছুদিন থেকে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটছে এই ছোট্ট শহরটাতে। রহস্যময়ভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। চৌরাস্তায় পর পর কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোও রহস্যময়। যারা ভূত বিশ্বাস করে, তাদের কেউ কেউ বলছে ভূতের উপদ্রব।

আর্কেডের ঘটনাটাও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে লেসলির কাছে। বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্র বাজে কিভাবে? বুঝে গেছে, আর্কেডের দরজায় দাঁড়ানো ওই ছেলেটার সঙ্গে এসবের নিশ্চয় কোন সম্পর্ক রয়েছে। অতএব পালাতে হবে ওর কাছ থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

গেটের কাছে এসে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। মিসফায়ার করল না। পুটপুট করল না। কোন আগাম সঙ্কেত দিল না। এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কোন রকম নিয়ম-কানুন না মেনে স্রেফ থেমে গেল। গাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

মরিয়া হয়ে ইগনিশনে মোচড় দিতে লাগল লেসলি। কাজ হলো না। চালু হলো না এঞ্জিন। কোন শব্দই করল না।

রেডিওতে বেজেই চলেছে দি নাইটওয়াকার।

দরজায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আজব ছেলেটা।

হঠাৎ আলোর বিস্ফোরণ ঘটল যেন। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। ঝট করে ঘুরে গেল লেসলির মুখ। গাড়ির অ্যানটেনায় লাগানো পিজ্জা ডেলিভারি সাইনটাতে আগুন লেগে গেছে। পরক্ষণে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা লাগল শরীরে। বুক থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হাত, পা, আর মাথায়। মনে হলো কোটর থেকে খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে চোখ। প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেতে শুরু করল দেহটা। সীটের ওপর লাফাতে লাগল পানি থেকে তোলা মাছের মত। পেশীর ব্যথা অসহ্য।

বুঝে নিল লেসলি, এই পার্কিং লট থেকে জীবন্ত বেরোতে পারবে না সে। মুঠো হয়ে গেল হাতের আঙুল। ওগুলোর মাথা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ। কোনমতে হাত বাড়িয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সে। এত বেশি হাত কাঁপছে, হাতলটাই ধরতে পারল না। কাঁপুনির চোটে মাথাটা গিয়ে বাড়ি খেল দরজার পাশে।

কিন্তু কিছুই করার নেই আর ওর!

কিছুই করার নেই মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া!

*

আর্কেডের দরজায়-দাঁড়িয়ে লেসলিকে মারা যেতে দেখল বিলি। কোন রকম আবেগ তৈরি হলো না তার মনে। করুণা জাগল না।

অবশেষে গাড়ির রেডিও থেকে তার মনো-আকর্ষণ সরিয়ে আনল সে। চুপ হয়ে গেল রেডিও। নীরব হলো পার্কিং লট। কনভার্টিবলের সামনের সীট থেকে একঝলক পোড়া ধোয়া বেরিয়ে উঠে গেল স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোর দিকে।

এতক্ষণে ঘুরে দাঁড়াল বিলি। ঢুকে গেল আবার আর্কেডের ভেতর।

পেছনে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে পটেটো। বিলি তাকাতেই হেসে একটা কয়েন বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।

কিন্তু নিল না বিলি। গেম মেশিন চালু করতে ওটার আর প্রয়োজন নেই। যে-কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র এখন তার গোলাম। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সার্কিটে ঢোকার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে ওর মনের। বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সামর্থ্য আছে।

ভুরু থেকে এক ফোঁটা ঘাম মুছে ফেলে মেশিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। তাকাল শুধু ওটার দিকে। তাতেই যেন জাদুমন্ত্রের বলে আপনাআপনি চালু হয়ে গেল মেশিন।

মুখের একটা পেশী কাঁপাল বিলি। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল নতুন খেলা। কয়েন ফেলার পর যেমন করে হয়।

ক্রমেই ক্ষমতা বাড়ছে আমার, আপনমনে বিড়বিড় করল সে। নতুন আরেক রেকর্ড তৈরি করব খুব শীঘ্রি।

.

০২.

হিলটাউনের কাউন্টি বিল্ডিংটা আহামরি কিছু নয়। রঙ ওঠা, পুরানো। নতুন এলেও দ্বিতীয়বার ওটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথা ভাববে না কেউ। করনির্ধারক, সমাজসেবকের আস্তানা আর হলভর্তি রেকর্ডপত্র আছে ওটাতে। আর আছে কাউন্টি করোনার হিউগ ওয়াগনারের অফিস।

অস্বস্তি বোধ করছেন করোনার। যে রায় দিয়েছেন, তাতে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। জীবনে অনেক দেখেছেন, অনেক তার অভিজ্ঞতা। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে যা শুরু হয়েছে হিলটাউনে, এরকম কাণ্ড ঘটতে আর দেখেননি কোনদিন। অন্য চারটা মৃত্যুর মত লেসলি কার্টারিসের মৃত্যুটাকেও অপঘাতে মৃত্যু বলে রায় দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু খুতখুত করছে মনটা।

তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। তিনটে কিশোর ছেলে আর একজন। সুন্দরী মহিল। লাশটা দেখছে ওরা।

তিরিশ মিনিট আগে তার অফিসে ঢুকেছিল। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড আর পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের একটা প্রশংসাপত্র তার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে লাশটা দেখার অনুমতি চেয়েছিল ছেলেগুলো। মহিলা জানিয়েছে, সে একজন ডাক্তার। লাশটা পরীক্ষা করতে চায়।

একবার রায় দেয়ার পর সেটা নিয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে চান না। ওয়াগনার। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। ওরা যদি নতুন কিছু বের। করতে পারে করুক না। ক্ষতি কি?

ঘটনাটা সত্যি অদ্ভুত। নমুনা দেখে বজ্রপাতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না একে। কিন্তু লেসলি যখন মারা গেছে, তখন একবারও বজ্রপাত হয়েছে বলে রেকর্ড নেই।

লাশের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ডাক্তার এলিজা। চোখে লাগানো প্রোটেকটিভ গগলস। পেশাদারী দৃষ্টিতে তাকাল মৃত ছেলেটার বাঁ কানের ভেতর। লাশের মাথা পুরো নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে একই ভাবে দেখল ডান কানের ভেতরটাও। ভাল করে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে, যারা ওকে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছে এখানে। অবশ্য নিজেরও খানিকটা ইচ্ছা আর কৌতূহল জন্মেছিল গত কিছুদিনে হিলটাউনের অদ্ভুত মৃত্যুগুলোর কথা পত্রিকায় পড়ে।

রকি বীচ হাসপাতালের ডাক্তার এলিজা। তিন গোয়েন্দার বন্ধু। একবার একটা বিশেষ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল ওরা। সেই থেকে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

দুটো কানের পর্দাই ফেটে গেছে, তিন গোয়েন্দাকে জানাল সে। ভোতা কণ্ঠস্বর। সামান্য একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কি পড়ল না।

ডাক্তারী পাস করতে গিয়ে বহু লাশ পরীক্ষা করেছে এলিজা। অনেক ধরনের মৃত্যু দেখেছে। মানুষের শরীর অনেক কাটাকুটি করেছে। কিন্তু লাশ দেখলে তার এখনও মন কেমন করে। কেবলই মনে হয়, হাড়-মাংসে তৈরি এই নিথর দেহটাও একদিন তার মতই জ্যান্ত ছিল, চলেফিরে বেড়াত, কথা বলত। এরও আশা ছিল, নেশা ছিল, স্বপ্ন ছিল।

দস্তানা পরা হাতের আঙুল দিয়ে লাশের এক চোখের পাতা টেনে খুলল। সে। মৃত চোখের দিকে তাকাল। মণিটা একধরনের ঘোলাটে পাতলা পর্দায়। ঢাকা পড়েছে। অন্য চোখটা পরীক্ষা করেও একই জিনিস দেখতে পেল।

দুই চোখেই ছানি, কিশোর বন্ধুদের জানাল এলিজা। কণ্ঠস্বর এখনও ভোতা। কিশোর পাশার দিকে তাকিয়ে বলল, অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে হয়েছে সম্ভবত।

সম্ভবত কেন? এলিজার কথায় অবাক হয়েছে কিশোর। শিওর হতে পারছেন না?

জবাব দিল না এলিজা। কি বলবে, ভাবছে। অ্যানাটমিক্যাল স্কেলের ওপর রাখা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ তুলে নিল। মুখ খুলে ভেতরে তাকাল।

ব্যাগের ভেতরের জিনিসটাকে প্রথম দর্শনে মনে হয় পোড়া মাংসের টুকরো। পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু অভিজ্ঞ ডাক্তারের চোখ ঠিকই চিনতে পারল। জিনিসটা মানুষের হৃৎপিণ্ড। ময়না তদন্তের সময় লাশের বুক থেকে কেটে বের করে আনা হয়েছে।

বুকের মধ্যেই হার্টটা পুড়ে কাবাব হয়ে গেছে, এলিজা বলল। আশ্চর্য! করোনারের দিকে তাকাল সে। মিস্টার ওয়াগনার, আপনার কি ধারণা?

হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা আর রবিন। কিছু বুঝতে পারছে না। বোঝার জন্যে মাথাও ঘামাচ্ছে না। ডাক্তারই যখন পারছে না ওরা কি বুঝবে? তবে কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে শুনছে এলিজার কথা।

করোনার বললেন, এভাবে হার্টের টিস্যু ড্যামেজ হতে দেখিনি আর। তবে… গাল চুলকালেন তিনি। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলেন বোধহয়। বক্ষাস্থির নিচে এভাবে পুড়ে কিংবা পাজরের হাড় ফেটে যেতে পারে একটা কারণেইহাই-ভোল্টেজে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক খেলে। বজ্রপাতে…

বাধা দিয়ে বলল এলিজা, কিন্তু কোন জায়গা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবেশ করেছে। শরীরে, তার কোন চিহ্ন নেই। তারের ছোঁয়া লাগলে সেখানে দাগ কিংবা ক্ষত থাকার কথা।

আমার কাছেও এটাই অবাক লাগছে। দাগ নেই কেন?

ছেলেটা মারা গেছে ইলেকট্রিক শকে, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শকটা লাগল কোনদিক দিয়ে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

ঢোক গিললেন ওয়াগনার। আমার অনুমান, গাড়ির ছাতে পড়েছিল বজ্রটা। সেখান থেকেই কোনভাবে ছেলেটার শরীরে ঢুকেছে।

তারমানে বলতে চাইছেন ধাতব বডির ছোঁয়া? তাতেও চামড়া পুড়বে। দাগ কোথায়?

কি জানি! এই প্রশ্নটার জবাব পেলে তো সব পরিষ্কারই হয়ে যেত।

তাহলে অপঘাতে মৃত্যু রায় দিলেন যে?

তাতে ভুল করিনি। অপঘাত মৃত্যুই তো। ইলেকট্রিক শক। আমরা কেবল শিওর হতে পারছি না, শকটা লাগল কিভাবে।

করোনারের মতই এলিজাও কিছু বুঝতে পারছে না। কিশোরের দিকে তাকাল। যুক্তি যেখানে অচল সেখানে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। আর সেটা খুব ভাল পারে এই ছেলেটা। কল্পনার দৌড় আর বুদ্ধি এত বেশি, কিভাবে যেন প্রায় শূন্য থেকেও বের করে নিয়ে আসে মূল্যবান সূত্র। ইতিমধ্যেই কোন জবাব, কোন উদ্ভট ব্যাখ্যা তার মাথায় ঠাই গেড়ে ফেলেছে কিনা বুঝতে চাইল। অবাস্তব কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না কিশোর। ভূতুড়ে ঘটনাকে ভূতের কাণ্ড না ভেবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। দেখা যাক, এই ঘটনাটার কি ব্যাখ্যা দেয়।

কিশোর কিছু বলার আগেই দরজার দিকে ঘুরে গেল করোনারের চোখ। সেটা লক্ষ করে এলিজাও তাকাল সেদিকে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বিশালদেহী লোক। বুকে শেরিফের ব্যাজ।

কোন কেসের দায়িত্ব নিলে পুলিশ কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে খাতির রাখার চেষ্টা করে কিশোর। নইলে তদন্তে প্রচুর অসুবিধে হয়। শেরিফ যদি ওদের কাজে বাধা দেন, পছন্দ না করেন, তার এলাকা থেকে বের করে দেন, কিছু করার থাকবে না। হিলটাউনে যখন পৌঁছেছিল ওরা, শেরিফ ছিলেন না এখানে। জরুরী একটা কাজে পাশের শহরে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে কোন রকম বাধার মুখোমুখি না হয়ে সহজেই করোনারের অফিসে ঢুকে পড়েছিল ওরা। এখন তিনি এসেছেন। ওদের তদন্তটাকে কোন চোখে দেখবেন কে জানে। করোনারের মত এত সহজে যদি তদন্ত করার অনুমতি না দেন?

এলিজার এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। লাশ পরীক্ষা করতে এসেছে, করছে। করা হয়ে গেলে চলে যাবে। গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে থাকতে হবে না এখানে। অতএব শেরিফের তোয়াক্কা তার না করলেও চলবে। কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফিরে তাকাল করোনারের দিকে, এ নিয়ে এরকম মৃত্যুর ঘটনা পাঁচটা ঘটল হিলটাউনে। পত্রিকায় পড়লাম। বাকি লাশগুলোর গায়েও কি কোন রকম দাগ ছিল না?

পায়ের ওপর ভার বল করলেন ওয়াগনার। অস্বস্তিবোধটা বাড়ল। না, ছিল না। ওগুলোকেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটেছে–এই রায় দিতে বাধ্য হয়েছি আমি।

তারমানে আপনি বিশ্বাস করেন না বজ্রপাতেই মারা গেছে লোকগুলো? আচমকা যেন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল কিশোর।

অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন ওয়াগনার। জবাব দিতে পারলেন না। কিংবা আসল কথাটা স্বীকার করতে হয় বলে ইচ্ছে করেই দিলেন না।

দরজায় দাঁড়িয়ে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে কথাগুলো শুনলেন। শেরিফ। তারপর কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সবার। করোনারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা?

পরিচয় দিলেন ওয়াগনার।

হু! তাহলে তোমরা গোয়েন্দা, মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। এক এক করে নজর বোলালেন তিনজনের মুখে। তোমাদের জানা না-ও থাকতে পারে, তাই নিজের পরিচয়টা দিয়েই নিই। আমি শেরিফ মরফি রবার্টসন।

দেখেই অনুমান করে নিয়েছি, স্যার, খুশি করার জন্যে বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। রহস্যময় মৃত্যুর খবরগুলো পত্রিকায় পড়ে ইনটারেস্টেড হয়েছি। শখের গোয়েন্দা আমরা, একটা কার্ড বের করে দিল সে।

ভুরু কুঁচকে তিনটে নামের নিচে প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলোর দিকে তাকালেন শেরিফ। এগুলো কেন? নিজেদের কাজের ব্যাপারে সন্দেহ আছে নাকি?

সন্দেহ নেই, কণ্ঠস্বরটাকে বড়দের মত ভারিক্কি করে তুলে কিশোর বলল, এগুলোর মানে, যে কোন ধরনের রহস্যের তদন্ত করতে আগ্রহী আমরা। জটিল, উদ্ভট কিংবা ভুতুড়ে কেস হলে আরও ভাল। এমন অনেকগুলো কেসের কিনারা করেছি আমরা, বহুদিন ধরে পুলিশ যার কোন সমাধান খুঁজে পায়নি। এই দেখুন না, ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসাপত্রটা বের করে দেখাল সে। আমাদের সার্টিফাই করেছেন ক্যাপ্টেন নিজে।

কার্ডটা ফিরিয়ে দিতে দিতে আবার মাথা আঁকালেন শেরিফ। হু! তারপর তাকালেন ডাক্তারের দিকে।

আমি ডক্টর এলিজা, হাত বাড়িয়ে দিল এলিজা।

হাত মেলালেন শেরিফ। কি সাহায্য করতে পারি, বলুন?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। বুঝে গেল, এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে বলবেন না শেরিফ। তবে শেষ পর্যন্ত তদন্ত করতে দেবেন কিনা স্পষ্ট নয় এখনও।

কিশোরের দিকে তাকাল এলিজা। আবার ফিরল শেরিফের দিকে। এখানে গত কিছুদিনে বজ্রপাতের কারণে যেসব মৃত্যু ঘটেছে বলে বলা হয়েছে, সেগুলোর সপক্ষে তেমন কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি..

কিছু মনে করবেন না, ডাক্তার, বজ্রপাতের ব্যাপারে আপনি কতখানি জানেন?

জানি। অনেক কিছুই।

আপনি কি জানেন, বাড়িতে ঘরের মধ্যেও অনেকে বজ্রপাতের শিকার হয়? হয়তো শাওয়ারে গোসল করছিল তখন, কিংবা টেলিফোনে কথা বলছিল। এমনও দেখা গেছে, হলঘরে অনেকে মিলে নাচার সময় তাদের মধ্যে কোন একজন বাজ পড়ে মরে গেছে। বাকিদের কারও কিচ্ছু হয়নি। শিওর হয়ে কেউ বলতে পারে না কখন, কোথায় বাজ পড়বে। সাধারণ বিজ্ঞান বইতে আমরা পড়ি মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, আর তাতেই বজ্রপাতের সৃষ্টি। কিন্তু ভেতরে এত প্রশ্ন আর রহস্য রয়ে গেছে, অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীও তার জবাব দিতে পারেন না। জানেন সেটা?

আসলে আপনি কি বলতে চাইছেন, শেরিফ?

এতক্ষণে হাসি ফুটল শেরিফের মুখে। বলতে চাইছি, শরীরের দাগ নিয়ে যে প্রশ্নটা আপনি তুলেছেন, সাধারণ ইলেকট্রিক শকের বেলায় সেটা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বজ্রপাত একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার…হিলটাউনে বাস না, করলে হয়তো আপনার মতই কথা বলতাম। কিন্তু এখন আর বলব না। কারণ রোজ সকালে এখানকার বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সঙ্গে বসে আমাকে নাস্তা খেতে হয়।

চোখ মিটমিট করল এলিজা, তাতে কি?

বুঝলেন না? শেরিফের চোখ দুটোও এখন হাসছে। এখানে এই হিলটাউনে বজ্র উৎপাদন করে আমাদের বিজ্ঞানীরা। বিশ্বাস হয়?

জবাব দিল না এলিজা।

আমরা বজ্র বানাই, শেরিফ বললেন। শহরের ধারে অস্টাডোরিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরিতে। আকাশের দিকে মাথা তুলে চেয়ে থাকে ওখানে একশো আইওনাইজড রড। বিদ্যুৎকে খুঁচিয়ে বজ্র তৈরি করে ওগুলো।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল এলিজা, এখবরটা তো জানতাম না!

তারমানে ঠিকমত হোমওয়ার্ক করেন না আপনি, রসিকতা করলেন শেরিফ।

বস্ত্রের ব্যাপারে যা-ই বলেন না কেন, স্যার, এই ময়না তদন্তের রিপোর্টে গলদ আছে।

কে বলল?

একজন ডাক্তার হিসেবে আমি বলছি। কারণ দাগ নেই…

সেই কথাটাই তো বোঝাতে চাইছি এতক্ষণ ধরে। সাধারণ শক হলে দাগ থাকত। এটা হয়তো কোন ধরনের অসাধারণ শক, তাই নেই। বজ্রপাত সম্পর্কে এখনও সব জানেন না বিজ্ঞানীরা, আগেই তো বললাম। হতে পারে, কিছু কিছু বজ্রপাতে বিদ্যুৎ এমন ভাবে ঢুকে যায় মানুষের শরীরে, ভেতরটা ঠিকই পুড়ে কয়লা হয়, কিন্তু চামড়ায় বা অন্য কোথাও কোন দাগ বা ক্ষত থাকে না…

রিমোট কন্ট্রোলড ইলেকট্রিক শক! বিড়বিড় করল কিশোর।

কি বললে? ঝট করে তার দিকে ঘুরে গেলেন শেরিফ। রিমোট? বুদ্ধিমান ছেলে! হয়তো ঠিকই বলেছ, রিমোট কন্ট্রোলড লাইটনিং। স্পর্শ ছাড়াই বিদ্যুৎ পাচার করে দেয় মানুষের শরীরে কে জানে! কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। একে একে চোখ বোলালেন রবিন আর মুসার দিকে। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন, দেখে অবশ্য চালাক-চতুরই লাগছে তোমাদের। ঠিক আছে, করো তদন্ত, বাধা দেব না। তবে এমন কিছু করবে না, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবে না, যাতে কেউ তোমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে। যদি করে, শহর থেকে তোমাদের চলে যেতে বলতে বাধ্য হব আমি।

থ্যাংকিউ, স্যার, হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। কেউ খারাপ রিপোর্ট করবে না, কথা দিতে পারি।

*

কিভাবে মারা গেছে, কি মনে হয় তোমার? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল এলিজা।

করোনারের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে একটা কফিশপে নাস্তা আর কফি খেতে বসেছে ওরা।

আমি ডাক্তার নই। আপনাদের আলোচনা থেকে যা বুঝলাম, একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, কিশোর বলল, বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটেনি। লেসলির।

মুসা বলল, শেরিফের সঙ্গে তো একমত হয়ে এলে…

বজ্রপাতে মারা গেছে এ ব্যাপারে একমত হইনি। বলেছি ইলেকট্রিক শক। বজ্রপাত আর ইলেকট্রিক শক এক জিনিস নয়।

কিন্তু বজ্রপাতে বিদ্যুতের কারণেই মারা যায় মানুষ।

তা যায়। তবে লেসলি বাজ পড়ে মারা যায়নি। কিংবা সাধারণ ইলেকট্রিক শকও খায়নি। তাহলে শরীরে দাগ নিশ্চয় থাকত।

তাহলে কিসে মরল? ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইল রবিন।

ইলেকট্রিক শকেই মরেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেই বিদ্যুটা বড় আজব! পরিবহনের জন্যে তার লাগে না এর, কোন মাধ্যম লাগে না। বাতাসের ইথারই যথেষ্ট। আরও একটা ব্যাপার। যেন মন আছে, মগজ আছে, চিন্তা-ভাবনা করে শিকার বেছে নেয়ার ক্ষমতা আছে ওটার।

এমন করে বলছ যেন ওটা একটা প্রাণী!

কেন, প্রাণীরা কি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না?

তা তো পারেই। অনেক প্রাণীই আছে যারা নিজের দেহে বিদ্যুৎ তৈরি করতে সক্ষম। চুপ হয়ে গেল রবিন।

একপাশে চেয়ারে রাখা ব্রীফকেস খুলে একটা ফাইল বের করল। কিশোর। সেটা থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে বিছাল। কি লেখা, দেখার জন্যে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন আর মুসা।

দেখুন, এলিজাকে বলল কিশোর, একটা হিসেব বের করেছি। এই এলাকায় যারা যারা বজ্রপাতের শিকার হয়েছে তাদের সবারই বয়েস সতেরো থেকে একুশ। সবাই পুরুষ। লেসলি কার্টারিসও সেই দলেই পড়ে। এর মানে। কি? মনে কি হয় না, বুঝেশুনে, শিকার বাছাই করে মৃত্যুবাণ মারছে সেই আজব বিদ্যুৎ?

 বিস্মিত হলো এলিজা। তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে।

লেসলি কার্টারিস কোন জায়গায় মারা গেছে, একবার দেখা দরকার, কিশোর বলল। আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আপনাকে না দেখালে শিওর হতে পারতাম না। যাই হোক, এবার আমাদের তদন্ত শুরু। দেখা যাক আমার যুক্তির সপক্ষে কোন সূত্র মেলে। কিনা। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে চান?

মাথা নাড়ল এলিজা, যাওয়ার তো খুবই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আরেকটা জরুরী কাজ আছে। নতুন কিছু জানলে জানাবে অবশ্যই। আমার সাহায্যের প্রয়োজন আছে বুঝলে তখন নাহয় চলে আসব। এখন তো আমাকে আর কোন দরকার নেই তোমাদের?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, নেই।

.

০৩.

স্ট্রিপ মলের পার্কিং লট থেকে এখনও বের করে আনা হয়নি লেসলি কার্টারিসের গাড়িটা। শেরিফের লোকেরা গাড়ি ঘিরে অরেঞ্জ-কোন বসিয়ে। গাড়িটাকে আলাদা করে রেখেছে। কেউ যাতে ওটার কাছে না যায়, কিছু না ধরে।

গাড়িটার পেছনে হাতখানেক দূরে ঝুঁকে বসল কিশোর। স্কিড় করে যাওয়া চাকার দাগ দেখতে পেল।

গাড়ির ভেতরে উঁকি দিচ্ছে মুসা।

একটা ফাইল হাতে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। ফাইল পড়ে বলল, রাত বারোটা সতেরো মিনিটে এই গাড়ির ভেতরে লেসলির লাশটা পেয়েছে পুলিশ। শর্ট সার্কিট হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে সমস্ত ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম। ওয়্যারিঙের তার সব পুড়ে, গলে গেছে।

কিশোরের কাছে এসে দাঁড়াল সে।

এখনও ঝুঁকে বসে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাকার দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। সেগুলো রবিনকে দেখিয়ে বলল, মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে পালাতে চেয়েছিল লেসলি।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে? কেন?

উঠে দাঁড়াল কিশোর। মলের দিকে তাকাল। কখন শেষ পিজ্জাটা ডেলিভারি দিয়েছিল লেসলি?

ফাইল দেখল রবিন। এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। কেন?

এগারোটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এখানকার সব স্টোর, ভিডিও আর্কেডের ওপর স্থির হলো কিশোরের দৃষ্টি। সম্ভবত এই আর্কেডটা বাদে।

*

আর্কেডের ভেতরের মান নীলচে আলো চোখে সইয়ে নিতে সময় লাগল তিন গোয়েন্দার। সামনের কাউন্টারে বসে কয়েন গুণে গুণে কাগজের টিউবে ভরে রাখছে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে।

দশ…এগারো-বারো… গুণছে সে। কাউন্টারে ঝুঁকে গভীর মনোযোগে কাজ করছে। প্রতিটি মুদ্রা ভালমত দেখছে। তেরো…

এক্সকিউজ মি! ছেলেটার প্রায় কানের কাছে গিয়ে বলল রবিন।

ময়লা একটা আঙুল তুলে রবিনকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে গুণে চলল ছেলেটা। তেরো…উম, চোদ্দ-..

কিশোরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রবিন

অহেতুক দাঁড়িয়ে না থেকে আর্কেডের ভেতরটা দেখতে শুরু করল কিশোর। মুসা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

ছেলেটার দিকে ঘুরল রবিন। আগের চেয়ে জোরে বলল, এক্সকিউজ মি, প্লীজ!

 ঘর্মাক্ত, গোলআলুর মত একটা গোল মুখ ঘুরল রবিনের দিকে। ছোট ছোট দুই চোখের দৃষ্টি স্থির হলো ওর মুখের ওপর। অবাক হয়ে ভাবতে লাগল। রবিন, ছেলেটার মুখ কি কোনকালে বন্ধ হয়? নাকি সব সময়ই ওরকম অর্ধেক ফাঁক হয়ে খুলে থাকে?

অপেক্ষা করছে রবিন। কি চাই, কি সাহায্য করতে পারি, এ ধরনের কোন প্রশ্নের অপেক্ষা। কিন্তু কিছুই বলল না ছেলেটা। তাকিয়ে রইল হাঁ করে। শেষে রবিনকেই কথা শুরু করতে হলো, কি নাম তোমার?

আঁ? এই একটা শব্দ উচ্চারণ করে আবারও দীর্ঘ মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে যেন কথা বের করার চেষ্টা চালাল মগজের ভেতর থেকে। শেষে কোনমতে বলল, পটেটো।

মাথা ঝাঁকাল রবিন। হাসল। চমৎকার নাম। একেবারে মানানসই। পটেটো, তোমার একটা মিনিট সময় নষ্ট করতে পারি আমি?

হ্যাঁ, মলিন হাসি হাসল পটেটো। বলো।

জ্যাকেটের পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করল রবিন। পটেটোকে দেখিয়ে বলল, আমি একজন গোয়েন্দা।

পলকে পটেটোর প্রায় ফ্যাকাসে মুখটা আরও রক্তশূন্য হয়ে যেতে দেখল সে। ইঁদুরের মত চি চি করে উঠল, তো আমি কি করব?

কার্ডটা সরিয়ে রাখল রবিন। কাল রাতেও কি এখানে তোমারই ডিউটি ছিল?

মাথা ঝাঁকাল পটেটো, হ্যাঁ। রোজ রাতেই থাকে।

একটা ছবি দেখাল রবিন, এই লোকটাকে চিনতে পারো?

ছবিটা দেখল পটেটো। কুঁচকে যাচ্ছে ভুরু। দ্রুত চিন্তা চলেছে তার মনে, মুখ দেখেই বোঝা যায়। নাহ্, অবশেষে জবাব দিল সে, কখনও দেখিনি।

এমনভাবে মানা করে দেবে ছেলেটা, ভাবেনি রবিন। বলল, দেখো না, আরেকটু ভালমত দেখো। কাল রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে এখানে এসেছিল সে।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল পটেটো। যেন কে ঢুকল কে বেরোল এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার। ভঙ্গি দেখাল যেন কথাও বুঝতে পারছে না।

এমন সরাসরি মিথ্যে বলছে ছেলেটা! এভাবে যে মিথ্যে বলে তার মুখ থেকে কথা আদায় করা কঠিন। অসহায় বোধ করল রবিন। মুসার দিকে তাকাল।

পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল পটেটোর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শোনো, আলু মিয়া, মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তোমাদের পার্কিং লটে খুন হয়েছে ছবির এই লোকটা, পড়ে থাকা আধপোড়া গাড়িটা দরজা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখিয়ে বলল, ওই যে ওটা এর গাড়ি। ওই সময় তুমি এখানে থাকলে দৃশ্যটা তোমার চোখে না পড়ার কথা নয়। একটা গাড়ি আগুনে পুড়ছে, আর তুমি কিছু দেখোনি…

তাই তো, আস্তে করে বলল পটেটো। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। ওপর-নিচে দ্রুত ওঠানামা শুরু করল তার মাথা। মুসার বাহুর শক্তিশালী পেশীর দিকে তাকিয়ে যেন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল নিগ্রো ছেলেটার ঘুসি ছুটে আসছে কিনা তার গোল নাকের ডগাটাকে ভোঁতা করে দেয়ার জন্যে। হায় হায়… গাড়ির দিকে আঙুল তুলে সেটা আবার ঠেকাল রবিনের হাতের ছবিতে, এই লোকটাই সে?

*

আর্কেডের একেবারে পেটের মধ্যে সারি সারি ভিডিও গেম মেশিনের পাশ দিয়ে চলেছে কিশোর। ওগুলোর সামনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো বেশির ভাগই তার সমবয়েসী, কেউ দুএক বছরের ছোট, কেউ বড়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ তুলে কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। হয়তো ভাবছে ওদের মতই কিশোরও ভিডিও গেম খেলতে এসেছে।

একটা ক্লাসিক উরটিজার জুকবক্সের পাশ কাটাল সে। কমপ্যাক্ট ডিস্ক লাগানো আছে ওটাতে। ভিডিও গেম মেশিনগুলোর কাছে কেমন ভারিক্কি দেখাচ্ছে ওটার চেহারা।

মেশিনগুলোর পাশ কাটাতে গিয়ে একটা মেশিন দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। থমকে দাঁড়াল। Virtual Massacre-II মেশিন। পর্দায় স্তম্ভ তৈরি করে ফুটছে খেলে রেখে যাওয়া খেলোয়াড়দের নাম, সই, তারিখ আর সময়। একটার নিচে আরেকটা।

তাকিয়ে রইল কিশোর। নামের সারি শেষ হতেই একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য, ফুটল। একজন যোদ্ধা কারাতের কোপ দিয়ে মেরে ফেলল আরেকজন যোদ্ধাকে। মুমূর্ষ যোদ্ধার মুখ থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে এল এক ঝলক রক্ত। পরক্ষণে বলে উঠল একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ: খেলবে, এসো। আমি জানি তোমার পকেটে একটা সিকি আছে:

শেষ ওকে দেখেছি এই মেশিনটাতে একটা সিকি ঢোকাতে, পাশ থেকে বলল আরেকটা কণ্ঠ।

 ফিরে তাকাল কিশোর। গোলআলুর মত মুখওয়ালা টিনেজ অ্যাটেনডেন্ট রবিনের সঙ্গে কথা বলছে মেশিনটার দিকে তাকিয়ে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা।

তারপর বেরিয়ে গেল, পটেটো বলছে। কিছুক্ষণ পর শুনলাম অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওকে দেখতে লাগল কিশোর। কিন্তু একটা চোখ রয়েছে মেশিনের পর্দায়। নামের স্তম্ভ ফিরে আসার অপেক্ষা করছে।

পটেটোর দিকে তাকাল রবিন, অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে বাইরে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার?

মাথা নাড়ল পটেটো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ মিটমিট করল। বলা কঠিন। আমি বলতে চাইছি, এতটাই শোরগোল শুরু হয়েছিল, আলাদা করে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, বলেই ঝট করে ফিরে তাকিয়ে দেখে নিল মুসাকে, সে আবার অস্বাভাবিক কিছু ঘটানোর তালে আছে কিনা। এরকম ঘটনা ঘটলে যা হয় আরকি।

কাছাকাছি এমন কাউকে দেখেছ, যে মনে করতে পারবে কোন কিছু দেখেছে?

অ্যা…না মনে পড়ছে না।

পটেটোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল কিশোর। কথা গোপন করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে টিনেজ অ্যাটেনডেন্ট, বুঝতে অসুবিধে হলো না তার। কাকে বাঁচাতে চাইছে সে? কেন? মেশিনের পর্দায় ফিরে গেল তার। দৃষ্টি। আবার ফিরে এসেছে নামের স্তম্ভ।

অই, আলু, চিৎকার করে উঠল একটা ছেলে, আমার ভাঙতি পয়সা কই?

বাচল যেন পটেটো।এক্সকিউজ মি বলে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল, সেদিকে।

রবিন, এদিকে এসো, হাত নেড়ে ডাকল কিশোর। পর্দার দিকে হাত তুলল, দেখো।

কি? চোখের পাতা সরু করে তাকাল রবিন।

 ফাইল। বজ্রপাতের শিকার অন্য ছেলেগুলোর নাম কি ছিল?

ফাইল খুলল রবিন। একটা লিস্ট দেখল। হ্যারি গাটস… মরিস নিউম্যান..বিলি ফক্স বব-..

দাঁড়াও দাঁড়াও! বিলি ফক্স। ওর মিডলনেমটা কি? লেখা আছে?

 আছে।

 বিলি পিটার ফক্স?

হ্যাঁ।

বজ্রপাতের শিকার হয়েছিল পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন বেঁচে গিয়েছিল। তার নাম বিলি পিটার ফক্স। তাই তো?

ফাইলের দিকে আরেকবার তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ। তুমি জানলে কি করে?

ওই দেখো, আবার পর্দার দিকে হাত তুলল কিশোর। হাই স্কোরারদের মধ্যে ওর নাম সই করা আছে নামের আদ্যক্ষর। বি পি এবং এফ। কি দাঁড়াল? বিলি পিটার ফক্স।

পর্দার কাঁচে সইটার ওপর আঙুল রাখল সে। ধীরে ধীরে পাশে সরাল আঙুলটা। তারিখ এবং সময় লেখা আছে। লেসলি কার্টারিসের নাম আছে। কখন খেলেছে, সময় লেখা আছে

পর্দা থেকে হাত সরিয়ে এনে দৃনে দুই সহকারীর মুখোমুখি হলো। কিশোর। এর একটাই মানেনসৰি কাৰ্টারিস খুন হওয়ার সময় বিলিও–এখানে ছিল।

.

০৪.

ওয়াকম্যানের হেডফোন কানে লাগিয়ে একটা বুইক গাড়ির পেটের নিচে ঢুকে, কাজ করছে বিলি ফক্স। এ শহরের অর্ধেক ছেলেই মেকানিক। বিলিকে যা দিচ্ছেন তার অর্ধেক বেতনে ওর চেয়ে দক্ষ মেকানিক রাখতে পারতেন জোসেফ হাওয়ার্ড। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে মায়া হয়েছে। তাই ইচ্ছে করেই বেতন বেশি দিচ্ছেন।

চিত হয়ে থেকেই পিঠ উঁচু করে পিঠের নিচের গদিটা টেনে ঠিক করল বিলি। পাশে হাত বাড়াল রেঞ্চের জন্যে। পেল না। কোথায় ওটা দেখার জন্যে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে পড়ল একজোড়া সুন্দর পা।

 হাসিতে ঠোঁটের একটা পাশ নিচে নেমে গেল ওর। যে কোন জায়গায় লক্ষ পায়ের মধ্যে ওগুলোকে চিনে নিতে পারবে সে। স্কুলে, এখানে ওখানে, নানা জায়গায় ওই পা আর পায়ের মালিককে হাজার বার দেখেছে। জীবনে। এক জিনিস বলতে সবচেয়ে বেশি দেখেছে বোধহয় ওই পা-জোড়া।

 গ্যারেজের কংক্রীটের মেঝেতে হাই-হীলের খটখট শব্দ তুলে গাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে পায়ের মালিক। চিত হয়েই হাত আর পায়ের সাহায্যে নিজের শরীরটাকে মুচড়ে গাড়ির নিচ থেকে বের করে আনল বিলি। স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ওকে হঠাৎ এভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে চমকে গেল হাই-হীলের মালিক। পিছিয়ে গেল এক পা।

তাড়াতাড়ি কানের ওপর থেকে হেডফোন সরিয়ে নিল বিলি। বেজবল ক্যাপটা টেনে ঢেকে দিল মাথার কাটা দাগ। তার সবচেয়ে মধুর আর মোলায়েম হাসিটা উপহার দিয়ে বলল, মিলি, কেমন আছ?

ওফ, বিলি, যা কাণ্ড করো না! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!

কথা হারিয়ে ফেলল বিলি। ভয় দেখানো দূরে থাক, কোনমতেই সামান্য চমকে দিতেও চায় না সে মিলিকে।

সরি, মিলি, মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে। তার মতে পুরো কাউন্টিতে এত সুন্দর চোখ অন্য কোন মেয়ের নেই। হয়তো পুরো আমেরিকাতেও এত সুন্দরী নেই আর কেউ। এটাও কেবল ওর ধারণা। মিলি হলো বিলির বয়েসী একেবারে নিখুঁত সুন্দরী একটা মেয়ে।

 নিজের হাতের দিকে তাকাল সে। তেলকালি মাখা। গ্যারেজে থাকলে সব সময়ই হাতে ময়লা লেগে থাকে। হাত দুটো সরিয়ে নিল।

বাবা কোথায়? জানতে চাইল মিলি।

 প্রশ্নটা নিরাশ করল বিলিকে। সে ভেবেছিল শুধু তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে মিলি। ওর সঙ্গে কথা বলতে।

একটা নষ্ট গাড়ি আনতে গেছেন।

মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিলি। ওকে সামনে দেখলে কিছুতেই, চোখ সরাতে পারে না। লক্ষ করেছে এতে অস্বস্তি বোধ করে মিলি। কিন্তু সে সরাতে পারে না, কি করবে? এত সুন্দর একটা মুখের ওপর থেকে চোখ সরায় কি করে মানুষ? শিল্পীর হাতেগড়া চেহারা!

আর কি করতে পারি তোমার জন্যে? জিজ্ঞেস করল বিলি।

আর কিছু না। বাবা বলেছিল, আজ একসঙ্গে লাঞ্চ খাব আমরা।

দ্রুত ভাবনা চলল বিলির মাথায়। মিস্টার হাওয়ার্ড যখন নেই, সে নিজেও তো খাওয়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে মিলিকে। ও নিশ্চয় সেটা পছন্দ করবে।

তোমার কি খিদে পেয়েছে? জানতে চাইল বিলি। তোমাকে আমি খাওয়াতে পারি। কি খাবে? হেসে বলল, আমার কাছে জেলি ডোনাট আছে। কালকের বানানো। তবে এখনও তাজা। খাবে একটা?

নিজের অজান্তেই এক পা আগে বাড়ল সে।

পিছিয়ে গেল মিলি। মাথা নাড়ল।

বিলি মনে করল তার নোংরা পোশাক দেখেই সরে গেছে মিলি। ওর ঝলমলে জামাকাপড় আর চকচকে জুতোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বিলির বুক থেকে। খাবে না কেন? কালকের বলে?

এই সময় একটা টো ট্রাক ঢুকতে দেখা গেল গ্যারেজের গেট দিয়ে। এসে গেছেন মিস্টার হাওয়ার্ড–মিলির বাবা এবং বিলির বস।

ট্রাকটাকে দেখামাত্র তাড়াতাড়ি দুই পা পিছিয়ে গেল বিলি।

কাছে এসে দাঁড়াল ট্রাক। ক্যাব থেকে বেরিয়ে এলেন জোসেফ হাওয়ার্ড লম্বা, সুদর্শন। মিলির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, সরি, দেরি হয়ে গেল। অনেকক্ষণ এসেছিস?

মাথা নাড়ল মিলি, না, এই এলাম।

ওই অভাগা পিজ্জা-বয়টার পোড়া গাড়িটা আনতে আনতে দেরি হয়ে। গেল।

মেয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে বিলির দিকে তাকালেন হাওয়ার্ড। বিলি, পোড়া গাড়িটার একটা ব্যবস্থা করো। তাড়াহুড়ো নেই। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, রেডিওতেই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কয়েকটা ছেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। শখের গোয়েন্দা। আমাকে এসে ধরল। বললাম, আমার গ্যারেজেই কাজ করে। ছেলেগুলোকে ভাল মনে হলো আমার। বলে দিলাম, তুমি অবশ্যই দেখা করবে।

বিষণ্ণ, গভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বিলি। মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে, গোয়েন্দা, না? আমার কাছে কি কাজ ওদের? গাড়ি সেরে দেয়ার জন্যে ভাল মেকানিক চায়?

কিন্তু নিশ্চিত জবাবটা পেল না। ESR।

মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন হাওয়ার্ড। সেদিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে টো ট্রাকটার দিকে পা বাড়াল সে।

*

হু, এই বোকাটাই তাহলে মারা পড়েছে?

লেসলি কার্টারিসের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল বিলি। লেসলির স্কুল জীবনের ছবি। ঝাকড়া চুল, সুন্দর স্বাস্থ্য, মিষ্টি হাসিতে দুনিয়া জয় করার ভঙ্গি। এধরনের মানুষকে অপছন্দ করে বিলি, দুচোখে দেখতে পারে না। নিজের চেয়ে ভাল স্বাস্থ্য আর সুন্দর চেহারার কাউকে দেখলেই ঈর্ষা হয় তার। ঘৃণা হয়। একে শেষ করে দিয়েছে বলে অনুশোচনা তো দূরে থাক, খুশি হলো মনে মনে।

ঘটনাটা খুব দুঃখজনক, নীরস কণ্ঠে বলল সে।

ছবিটা দিয়েছে কিশোর। কিন্তু রবিনের হাতে ফিরিয়ে দিল বিলি। কিশোরের তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। দৃষ্টি তো নয়, যেন ধারাল ছুরি। অন্তরের অন্তস্তলটা পর্যন্ত যেন দেখে নেয়। রবিন কিংবা মুসার দিকেও তাকাল না সে। যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটুরখাটুর শুরু করল। অনুভব করল, তিন জোড়া চোখ এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিচের দিকে মুখ নামিয়ে রেখে কাজ করার ভান করতে করতে জানতে চাইল, কি করে মারা গেল?

শেরিফ আর করোনারের কাছে শুনলাম বজ্রপাতে, জবাব দিল কিশোর।

না হেসে পারল না বিলি। হ্যাঁ, এরকম ঘটনা এখানে আজকাল হরহামেশাই ঘটে। মোড়ক খুলে একটা চিউঙিং গাম মুখে ফেলে চিবাতে শুরু করল। কোথায় মরল?

 ভিডিও আর্কেডের বাইরে, জানাল কিশোর। লোকটা যখন মারা গেছে। আকাশে মেঘ থাকলেও একবারও বিদ্যুৎ চমকায়নি। বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়নি।

বিলির ওপর থেকে ক্ষণিকের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না সে।

অস্বস্তি বোধ করতে লাগল বিলি। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন ছেলেটা? কিছু আঁচ করে ফেলেছে? নাকি কায়দা করে ওর পেটের কথা বের করার চেষ্টা এটা?

কাল রাতে তুমি ওখানে গিয়েছিলে, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ, সত্যি জবাবটাই দিল বিলি। নিজেকে বোঝাল, মিথ্যে যত কম বলে পার করা যায়, ততই মঙ্গল। এই ছেলেটাকে ফাঁকি দেয়া সহজ হবে না।

তাহলে নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার?

মাথা নাড়ল বিলি। দেখো, আমি যখন খেলা নিয়ে মেতে থাকি, দুনিয়ার কোন কিছুই চোখে পড়ে না আমার। অ্যাটম বোমা ফাটালেও শুনতে পাব না

আমি কেন, কালা নাকি মোটর মেকানিক বিলি। চট করে ভা।

 কেন, কালা নাকি ব্যাটা তুই? মনে মনে রেগে উঠল মুসা। প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করেছে এই মোটর মেকানিককে।

যেন তার মনের কথাটাই শুনে, ফেলল বিলি। চট করে চোখ তুলে তাকাল মুসার দিকে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে নিগ্রো ছেলেটা। তবে কোঁকড়া-চুল ছেলেটার মত দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা নেই এর, আছে ঝাজ।

আবার চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দেয়ার ভান করল বিলি।

কিশোর বলল, বিলি, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি? নিজেকে কি ভাগ্যবান মনে করো তুমি?

আমি? নিজের বুকে হাত রাখল বিলি। মনে মনে বলল, বেকুবটা বলে কি? আমি ভাগ্যবান হলে দুনিয়ায় হতভাগা মানুষ আর কে? নাহ, চোখ দেখে যতটা মনে হয়েছে, ততটা বুদ্ধিমান তো নয়। জবাব দিল, না, সেটা মনে করবার কোন কারণ নেই।

কেন ভাগ্যবান, বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি। তোমার মাথায়ও বাজ পড়েছিল। কিন্তু বেঁচে গেছ। বাকি সব কজন মারা গেছে। ওদের চেয়ে তুমি ভাগ্যবান নও?

 হঠাৎ মাথার কাটা দাগটা চুলকাতে শুরু করল বিলির। বাজ পড়েছিল ঠিক ওখানটাতেই। অন্য যে কেউ হলে সঙ্গে সঙ্গে পরপারে চলে যেত। কিন্তু সে তো যায়ইনি, বেঁচে গেছে, আগের চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছে আরও। ওর বেঁচে যাওয়াটা ডাক্তারদের কাছে একটা বিস্ময়।

হ্যাঁ, সেদিক থেকে আমাকে ভাগ্যবান বলতে পারো অবশ্য। প্রশ্নটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বিলিকে। কিশোরকে বিদেয় করার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করল সে।

কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আগুন! তোমার পকেটে ধোয়া!

চট করে চোখ ফেরাল কিশোর। সত্যিই তার জ্যাকেটের পকেট থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে।

হাসি ঠেকানোর জন্যে জোরে জোরে চিউয়িং গাম চিবাতে লাগল বিলি।

পকেট থেকে সেলুলার ফোনটা টেনে বের করল, কিশোর। ধোয়া বেরোচ্ছে ওটা থেকে।

আগুন লাগল কি করে? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মুসা। ব্যাটারি কখনও এভাবে পোড়ায় বলে তো শুনিনি!

হাতে ছ্যাকা লাগতে তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা ফেলে দিল কিশোর। মাটিতে পড়ে গলতে শুরু করল ওটার প্লাস্টিক বডি। ধোয়া বেরোচ্ছে অনবরত। হাতের তালুতে আঙুল বোলাতে লাগল সে।

 পুড়ে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়ার ভঙ্গি করল। বিলি, এসব আধুনিক যন্ত্রপাতির ওপর বিশ্বাস নেই। কখন যে কোন অঘটন ঘটাবে কিশোরের দিকে এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল সে। তোমাদের কথা শেষ হলে যেতে পারো। আমার জরুরী কাজ পড়ে আছে।

গম্ভীর হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। তারপর বলল, সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। অনেক বিরক্ত করলাম তোমাকে।

না-না, ও কিছু না।

একটা এঞ্জিন খোলায় মন দিল বিলি।

Super User