বন্দনা চুপ করিয়া কয়েক মুহূর্ত তাহার প্রতি চাহিয়া বলিল, জবাব পেয়েছি তোমার, আর আমার শঙ্কা নেই। এই বলিয়া সে দ্বিজদাসের হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আবার কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া বলিল, কেবল তোমার চারপাশেই যে ভূমিকম্প হয়েছে তাই নয়, আমার মধ্যেও এমনি প্রবল ভূমিকম্প হয়ে গেছে। যা ভূমিসাৎ হবার তা ধূলোয় লুটিয়েছে, যা ভাঙবার নয়, টলবার নয়, সেই অটলকেই আজ ফিরে পেলুম। এবার যাই দাদার কাছে। যাবার দিনে আমাকে তিনি আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, বন্দনা, যে তোমার আপন, আমার আশীর্বাদ যেন তাকেই একদিন তোমার হাতে এনে দেয়। সাধুর বাক্য আমি অবিশ্বাস করিনি, নিশ্চয় জেনেছিলুম এ কথা তাঁর সত্য হবেই। শুধু ভাবিনি, সে আশীর্বাদ এমন দুঃখের ভেতর দিয়ে সেই আপনজনকে এনে দেবে। যাই গিয়ে তাঁকে প্রণাম করি গে।
দ্বিজু, বন্দনা এসেচে না? এই বলিয়া সাড়া দিয়া অন্নদা আসিয়া প্রবেশ করিল।
এসেচি অনুদি, বলিয়া বন্দনা ফিরিয়া চাহিল। অন্নদার গভীর শোকাচ্ছন্ন মুখের প্রতি চাহিয়া বন্দনা চমকিয়া উঠিল, কাছে গিয়া তাহার বুকের উপর মাথা রাখিয়া অস্ফুটে কহিল, তোমার ও-মূর্তি আমি ভাবতেও পারিনি অনুদি। তার পরেই হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। অন্নদার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল। ধীরে ধীরে বহুক্ষণ পর্যন্ত তাহার পিঠের উপর হাত বুলাইয়া মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল, হঠাৎ আর চলে যেও না দিদি, দিন-কতক থাকো। আর তোমাকে কি বলবো আমি।
বন্দনা কথা কহিল না, বুকের উপর তেমনি মুখ লুকাইয়া মাথা নাড়িয়া শুধু সায় দিল। এমনিভাবে আবার বহুক্ষণ গেল। তার পরে মুখ তুলিয়া আঁচলে চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাসু কোথায় অনুদি?
চাকরেরা তাকে পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে গেছে।
তাকে রেঁধে দেয় কে?
অন্নদা কহিল, দ্বিজু। ওরা দুজনে একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে শোয়। বলিতে বলিতে আবার তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল, মুছিয়া কহিল, মা ত শুধু বাসুর মরেনি, ওরও মরেছে। আবার চোখ মুছিয়া বলিল, সবাই বলে অকালে অসময়ে বাড়ির বৌ মরেছে, ছেলেমানুষের শ্রাদ্ধে এত ঘটা কেন? ওরে সবাই করে মানা,—বাহুল্য দেখে তাদের গা যায় জ্বলে, ভাবে, এ যে বাড়াবাড়ি! জানে না ত সে ছিল ওর আর এক জন্মের মা। কোন ছলে সে মর্যাদায় ঘা লাগলে ও সইবে কি করে?
দ্বিজদাস বন্দনাকে ইঙ্গিতে দেখাইয়া কহিল, আর ভয় নেই অনুদি, বন্দনা এসেছেন, এবার সমস্ত বোঝা ওঁর মাথায় ফেলে দিয়ে আমি আড়াল হয়ে যাবো।
অন্নদা বলিল, পরের মেয়ে এত বোঝা বইবে কেন ভাই?
পরের মেয়েরাই ত বোঝা বয় অনুদি। ওঁকে ডেকে এনে বলেছি, এত দুঃখের ভার বইতে আমি পারবো না, এর ওপর বাসু যদি যায় ত, রইলো তোমাদের বলরামপুরের মুখুয্যেবাড়ি, রইলো তাদের সাতপুরুষের অভিমান, শশধরের ছেলেদের ডেকে এনে সংসারে আমি ইস্তফা দেবো। দাদাই শুধু পারে তাই নয়, দ্বিজুও পারে। সন্ন্যাস নিতে পারবো না বটে, ও আমি বুঝিনে—কিন্তু টাকাকড়ির বোঝা অনায়াসে ফেলে দিয়ে যাবো।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 26 Page: 146
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 187