অন্নদা বন্দনার হাত-দুটি ধরিয়া কহিল, পারবে না দিদি বিপিনের মত করতে? পারবে না বাসুকে বাড়িতে রাখতে?
পারবো অনুদি।
আর এই যে বাধলো সর্বনেশে মামলা জামাইবাবুর সঙ্গে, পারবে না থামাতে?
হাঁ, এ-ও পারবো অনুদি। ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিল, উনি কোনদিন আমার অবাধ্য হবেন না, এই শর্তেই এ বাড়ির ছোটবৌ হতে রাজী হয়েছি অনুদি।
কথাটা অন্নদা ভাল বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। বন্দনা বলিল, যা গেছে সে ত গেছেই। এর উপর কি মাকেও হারাতে হবে? মকদ্দমা না থামালে তাঁকে ফিরিয়ে আনবো আমি কি করে?
দ্বিজদাস বালিশের তলা হইতে চাবির গোছাটা বাহির করিয়া বন্দনার পায়ের কাছে ফেলিয়া দিয়া কহিল, এই নাও। অবাধ্য হবো না সেই শর্তই তোমার কাছে আজ করলুম।
বন্দনা চাবির গুচ্ছ তুলিয়া লইয়া আঁচলে বাঁধিল।
এইবার অন্নদা ইহার তাৎপর্য বুঝিল। বন্দনাকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া স্থির হইয়া রহিল, তাহার দুই চোখ বাহিয়া শুধু বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
বন্দনা বিপ্রদাসের ঘরে ঢুকিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। বলিল, বড়দা, এলুম।
এই নূতন সম্বোধন বিপ্রদাসের কানে ঠেকিল। কিন্তু এ লইয়া কিছু না বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, শুনেছিলুম তুমি আসচো, তোমার বাবার তার পাওয়া গিয়েছিল। পথে কষ্ট হয়নি ত?
না।
সঙ্গে কে এল?
আমাদের দরোয়ান আর আমার বুড়ো চাকর হিমু।
বাবা ভালো আছেন?
হাঁ।
বিপ্রদাস একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, দ্বিজু কি পাগলামি করচে দেখলে?
বন্দনা কহিল, আপনি শ্রাদ্ধের কথা বলচেন ত? কিন্তু পাগলামি হবে কেন? আয়োজন এত বড়ই ত চাই। এ নইলে তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতো যে!
কিন্তু সামলাতে পারবে কেন বন্দনা?
উনি না পারলেও আমি পারবো বড়দা।
বিপ্রদাস হাসিয়া কহিলেন, সে শক্তি তোমার আছে মানি, কিন্তু মেজাজ বিগড়োলেই মুশকিল। হঠাৎ রাগ করে চলে না গেলে বাঁচি।
বন্দনা বলিল, সেদিন এসেছিলুম পরের মত, মাথায় কোন ভার ছিল না। কিন্তু আজ এসেছি এ বাড়ির ছোটবউ হয়ে। রাগিয়ে দিলে রাগ করতেও পারি, কিন্তু আর চলে যাবো কেমন করে? সে পথ বন্ধ হয়ে গেল যে! এই বলিয়া সে চাবির গোছা দেখাইয়া কহিল, এই দেখুন এ বাড়ির সব আলমারি-সিন্দুকের চাবি। আপনি তুলে নিয়ে আঁচলে বেঁধেচি।
আনন্দ ও বিস্ময়ে বিপ্রদাস নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন। বন্দনা বলিতে লাগিল, আপনাকে আমার লজ্জা করে বলবার, গোপন করে বলবার কিছু নেই। ভগবানের কাছে যেমন মানুষের নেই লুকোবার ঠিক তেমনি। মনে পড়ে কি আপনার আশীর্বাদ? যাবার দিনে আমাকে বলেছিলেন, যে তোমার যথার্থ আপন তাকেই তুমি পাবে একদিন। সেদিন থেকে গেছে আমার চঞ্চলতা, শান্তমনে কেবল এই কথাই ভেবেচি, যিনি জিতেন্দ্রিয়, যিনি আজন্ম শুদ্ধ সত্যবাদী সাধু, তাঁর আশীর্বাদে আর আমার ভয় নেই। যিনি আমার স্বামী তাঁকে আমি পাবোই। দুই চক্ষু তাহার অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 26 Page: 147
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 162