গাড়ি হইতে নামিয়া সে সোজা উপরে গিয়া উঠিল। প্রথমেই গেল দ্বিজদাসের ঘরে। একটা মোটা বালিশে হেলান দিয়া সে বিছানায় শুইয়া ছিল, পর্দা সরানোর শব্দে চোখ মেলিয়া উঠিয়া বসিল, বলিল, বন্ধু আপনি এলো আমার ঘরের দোরগোড়ায়।

বন্দনা বলিল, হাঁ এলোই ত। কিন্তু এমন সময়ে শুয়ে কেন?

দ্বিজদাস বলিল, চোখ বুজে তোমাকেই ধ্যান করছিলুম আর মনে মনে বলছিলুম, বন্দনা, দুঃখের সীমা নেই আমার। দেহে নেই বল, মনে নেই ভরসা, বোধ করি ঠেলতে আর পারব না, নৌকো মাঝখানেই ডুববে। ও-পারে পৌঁছনো আর ঘটবে না।

বন্দনা বলিল, ঘটতেই হবে। তোমাকে ছুটি দিয়ে এইবার নৌকো বাইবার ভার নেবো আমি।

তাই নাও। রাগ করে আর চলে যেও না।

বন্দনা কাছে আসিয়া গড় হইয়া প্রণাম করিল, তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে দুজনের চোখ দিয়াই জল পড়িতে লাগিল। এমনভাবে প্রণাম করা তাহার এই প্রথম। বলিল, তোমার চোখেও জল আসে এ আমি জানতুম না।

দ্বিজদাস বলিল, আমিও না। বোধ করি তার আসার পথটা এতকাল বন্ধ ছিল। প্রথম খুললো যেদিন মৈত্রেয়ীকে ডেকে এনে এ সংসারের ভার দিতে বলে তুমি চলে গেলে। আড়ালে চোখ মুছে ফেলে মনে মনে বললুম, এতবড় আঘাত যে স্বচ্ছন্দে করতে পারে তার কাছে কখনো ভিক্ষে চাইবো না। কিন্তু সে পণ আমার রইলো না। বৌদিদি গেলেন স্বর্গে, শশধরের সঙ্গে মামলা বাধতে মা চলে গেলেন মেয়ের বাড়িতে, দাদা জানালেন সংসার-ত্যাগের সঙ্কল্প, এক মিনিটের ভূমিকম্পে যেন সমস্ত হয়ে গেল ধূলিসাৎ। এ-ও সয়েছিল, কিন্তু শুনলুম যখন বাড়ি ছেড়ে বাসু যাবে কোন্‌ একটা অজানা আশ্রমে, সে আর সইলো না। একবার ভাবলুম যা-কিছু আছে কল্যাণীর ছেলেদের দিয়ে আমিও যাবো আর একদিকে, তখন হঠাৎ মনে পড়লো তোমার যাবার আগের শেষ কথাটা—বলেছিলে বিশ্বাস করতে, বলেছিলে আমার একান্ত প্রয়োজনে বন্ধু আপনি আসবে আমার দোরগোড়ায়। ভাবলুম, এই ত আমার শেষ প্রয়োজন, আর প্রয়োজন হবে কবে? তাই লিখলুম তোমাকে চিঠি। সন্দেহ আসতে চায় মনে, জোর করে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে বলি—আসবেই বন্ধু। নইলে মিথ্যে হবে তার কথা, মিথ্যে হয়ে যাবে বৌদিদির শেষের আশীর্বাদ। যে বোঝা তিনি ফেলে গেলেন সে বোঝা বইবো আমি কোন্‌ জোরে! বলিতে বলিতে দু’ফোঁটা অশ্রু আবার গড়াইয়া পড়িল।

বন্দনা কহিল, সবাই বলে তুমি বড় অবাধ্য। একা বৌদির ছাড়া আর কারো কথা কখনো শোননি।

দ্বিজদাস বলিল, এই তোমার ভয়! কিন্তু কেন যে শুনিনি বৌদি বেঁচে থাকলে এর জবাব দিতেন। এই বলিয়া সে নিজের চোখ মুছিয়া ফেলিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়