দ্বিজদাস বলিল, কি করে করছিলেন এতক্ষণ এই ত আশ্চর্য শশধরবাবু।

কল্যাণী কাঁদিয়া বলিল, ছোড়দা, অবশেষে তুমিই কি আমাদের মারতে চাও? মায়ের পেটের ভাই তুমি, তুমিই করবে আমাদের সর্বনাশ?

দ্বিজদাস বলিল, তুই ভাবিস চোখের জল ফেলে বার বার এড়ানো যায় সর্বনাশ? কোথাও বিচার হবে না, তোদেরই হবে বারংবার জিত? দাদা নেই বটে, তবুও খেতে যখন পাবিনে আসিস আমার কাছে, তখন তোর কান্না শুনবো,—এখন নয়।

দয়াময়ী নিঃশব্দে অনেক সহিয়াছিলেন, আর পারিলেন না, চীৎকার করিয়া উঠিলেন, দ্বিজু, তুই যা এখান থেকে। এমনি করে গালিগালাজ করতে কি বিপিন তোরে শিখিয়ে দিয়ে গেল?

কে শিখিয়ে দিয়ে গেল বলচো? বিপিন?

হাঁ, সে-ই। নিশ্চয় সে।

দ্বিজদাসের ওষ্ঠাধর মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, বলিল, আমি যাচ্চি। কিন্তু মা, নিজেকে অনেক ছোট করেচো, আর ছোট করো না। এই বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

নিজের ঘরে আসিয়া দ্বিজদাস চুপ করিয়া বসিয়া ছিল, ঘণ্টা–দুই পরে মৈত্রেয়ী আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহার হাতে খাবারের পাত্র, বলিল, খাবার সব নতুন করে তৈরি করে নিয়ে এলুম, খেতে বসুন। এই ঘরেই ঠাঁই করে দিই।

এ আপনাকে কে বলে দিলে?

কেউ না। কাল থেকে আপনি খাননি সে কি আমি জানিনে?

এত লোকের মধ্যে আপনার জানার প্রয়োজন?

মৈত্রেয়ী মাথা হেঁট করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। জবাব না পাইয়া দ্বিজদাস বলিল, আচ্ছা, ঐখানে রেখে যান। এখন ক্ষিদে নেই, যদি হয় পরে খাবো।

মৈত্রেয়ী ঘরের একধারে আসন পাতিয়া, খাবার রাখিয়া সমস্ত সযত্নে ঢাকা দিয়া চলিয়া গেল। পীড়াপীড়ি করিল না, বলিল না যে ঠাণ্ডা হইয়া গেলে খাওয়ার অসুবিধা ঘটিবে।

রাত্রি বোধ করি তখন বারোটা বাজিয়াছে, দ্বিজদাস চেয়ার ছাড়িয়া উঠিল। সামান্য কিছু খাইয়া শুয়ে পড়িবে এই মনে করিয়া হাতমুখ ধুইতে বাহিরে আসিয়া দেখিল দ্বারের বাহিরে কে-একজন বসিয়া আছে। বারান্দার স্বল্প আলোকে চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

আমি মৈত্রেয়ী।

দ্বিজদাসের বিস্ময়ের সীমা নাই, কহিল, এত রাতে আপনি এখানে কেন?

খেতে বসে যদি কিছু দরকার হয় তাই বসে আছি।

এ আপনার ভারী অন্যায়। একে ত প্রয়োজন নেই, আর যদিই বা হয় বাড়িতে আর কি কেউ নেই?

মৈত্রেয়ী মৃদুকণ্ঠে বলিল, ক’দিনের নিরন্তর পরিশ্রমে সকলেই ক্লান্ত। কেউ জেগে নেই, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

দ্বিজদাস বলিল, আপনি নিজেও ত কম খাটেন নি, তবে ঘুমোলেন না কেন?

মৈত্রেয়ী উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল।

দ্বিজদাসের অপেক্ষাকৃত রুক্ষ স্বর এবার অনেকটা নরম হইয়া আসিল, বলিল, এভাবে বসে থাকাটা বিশ্রী দেখতে। আপনি ভেতরে এসে বসুন, যতক্ষণ খাই তদারক করুন। এই বলিয়া সে মুখহাত ধুইতে জলের ঘরে চলিয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়