জীবানন্দ। কিছু না। শুধু যতক্ষণ আছ সঙ্গে থাকব, তার পর যখন সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব। যাবার দিন আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। আমার আয়ুর দাম জানো, হয়ত আর দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কতরকমে দয়া করে গেলে, শেষদিন পর্যন্ত আমি সেই কথাই স্মরণ করব।
ষোড়শী। আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে।
[রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে গিয়া ষোড়শী প্রণাম করিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল]
জীবানন্দ। তোমাকে আমার প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। একটা দিন?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তবে সকল অপরাধ আমার এইখানে দাঁড়িয়ে আজ ক্ষমা কর!
ষোড়শী। কিন্তু তাতে কি আপনার প্রয়োজন আছে?
জীবানন্দ। এর উত্তর আজ দেবার আমার শক্তি নেই। এখন কেবল এই কথাই আমার সমস্ত মন ছেয়ে আছে অলকা, কি করলে তোমাকে একটা দিনও ধরে রাখতে পারি। উঃ—নিজের মন যার পরের হাতে চলে যায়, সংসারে তার চেয়ে নিরুপায় বুঝি আর কেউ নেই।
[ষোড়শী জীবানন্দের কাছে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া নীরবে দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (দাঁড়াইয়া) আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ অলকা, সবাই জানবে আমি শাস্তি দিয়েছি, তুমি সহ্য করেছ, আর নিঃশব্দে চলে গেছ। এতবড় মিথ্যে কলঙ্ক আমি সইব কেমন করে? তাও সয় যদি একটি দিন—শুধু কেবল একটি দিনও তোমাকে কাছে রাখতে পারি।
ষোড়শী। (পিছাইয়া গিয়া) চৌধুরীমশাই, কিসের জন্যে এত অনুনয়-বিনয়? আপনার পাইক-পেয়াদাদের গায়ের জোরের ত আজও অভাব হয়নি। আপনি ত জানেন, আমি কারো কাছে নালিশ করবো না।
জীবানন্দ। (পথ ছাড়িয়া সরিয়া) তা হলে তুমি যাও। অসম্ভবের লোভে আর তোমাকে আমি পীড়ন করব না। পাইক-পেয়াদা সবাই আছে অলকা, তাদের জোরের অভাব হয়নি। কিন্তু যে নিজে ধরা দিলে না, জোর করে ধরে রেখে তার বোঝা বয়ে বেড়াবার জোর আর আমার গায়ে নেই।
ষোড়শী। (গড় হইয়া প্রণাম করিয়া জীবানন্দের পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া) আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ—
জীবানন্দ। কি অনুরোধ অলকা?
[বাহিরে গরুর গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ হইল]
ষোড়শী। দয়া করে একটু সাবধানে থাকবেন।
জীবানন্দ। সাবধানে থাকব! কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরে কে দুজন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে শপথ করে গেল, তাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে, তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না,—আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সব শুনলাম—দুদিন আগে হলে হয়ত মনে হতো আমিই বুঝি তাদের লক্ষ্য—দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হলো না—কি অলকা? চমকালে কেন?
ষোড়শী। (পাংশু-মুখে) না কিছু না। এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।
জীবানন্দ। (অন্যমনস্কতায়) কাজ নেই?
ষোড়শী। কৈ আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।
জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিয়া) কিন্তু তুমি ত অসতী নও!
[গাড়োয়ানের প্রবেশ]
গাড়োয়ান। মা, আর কি বেশী দেরি হবে?
ষোড়শী। না বাবা, আর বেশী দেরি হবে না।
[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল
চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে তা বলে দিচ্ছি।
নাটক : ষোড়শী Chapter : 3 Page: 44
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 190