০৯.

মুবিন এখন বিয়ে করবে না বলে চিঠি দেওয়ার তিন মাস পর বাড়িতে এল। বড় ভাবি সুরাইয়া ছোট দেবরকে খুব স্নেহ করেন। সে এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর শ্বশুড়ী মারা গেছেন। সেই জন্য বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সবাইর দিকে লক্ষ্য রাখলেও মুবিন সবার ছোট বলে তার দিকে বেশি লক্ষ্য রাখে। শবনমকে মুবিনের সঙ্গে ভালো মানাবে ভেবে নিজেই বিয়ের কথা বলেছিল। মুবিন অমত করে চিঠি দিতে তার উপর রেগেছিল। বাড়িতে এসে সে তার সঙ্গে দেখা করতে এলে বলল, তুমি যদি এখন বিয়েই করবে না, তা হলে গতবার এসে যখন বিয়ের কথা শুনলে তখনই তা জানালে না কেন? ভাবিদের কাছে ও তার মা-বাবার কাছে আমরা যে অপমানিত হলাম, সে কথা চিন্তা করেছ?

মুবিন কি বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।

কি হল কিছু বলছ না কেন? আমার তো মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।

কি রহস্য থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

 ভোলাতে কোনো মেয়ের প্রেমে হয়তো পড়েছ।

মুবিন হেসে উঠে বলল, প্রেম কি এতই সস্তা যে, মেয়ে দেখলাম আর প্রেম হয়ে গেল।

একে অপরকে দেখেই তো ছেলে-মেয়েরা প্রেমে পড়ে।

তোমার কথা অবশ্য ঠিক; তবে আমার সেরকম কিছু হয়নি।

 তা হলে মনের মতো কোনো মেয়ের সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় হয়েছে?

তুমি আমার উপর রেগে রয়েছ, তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছ।

 রেগে থাকাটা কি অন্যায় ভাবছ?

না, সেটাই স্বাভাবিক।

তা হলে আসল কথাটা বলছ না কেন?

পরে বলব বলে মুবিন তার কাছ থেকে চলে গেল।

কয়েকদিন পর মুবিন চলে যাওয়ার জন্য যখন বড় ভাবির কাছে বিদায় নিতে গেল তখন সুরাইয়া বলল, আসল কথাটা না বলে চলে যাচ্ছ যে?

মুবিন বলল, মাফ কর ভাবি, সেটা বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, ভোলায় একটা মেয়েকে পছন্দ হলেও মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে কি না এখনো জানতে পারিনি।

সুরাইয়া বলল, তাই বল, আমিও কিন্তু ঐরকম কিছু ভেবেছি। তা মেয়েটার মনের খবর জানতে চেষ্টা করনি?

না।

কেন?

এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা আমি ভালো মনে করি না।

কিন্তু বিয়ের বয়স যে পার হয়ে যাচ্ছে, সে কথা চিন্তা করনি?

মুবিন হেসে উঠে বলল, বিয়ের কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে তাতো জানতাম না। অনেকে তো চল্লিশ পঞ্চাশ এমন কি ষাট-সত্তর বছর বয়সেও বিয়ে করে।

সুরাইয়া বুঝতে পারল, মুবিন ফাজলামী করছে। তাই সেও বলল, তা করে, কিন্তু তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়ে করে।

মুবিন হাসতে হাসতে বলল, আমি না হয়, এক সঙ্গে চারজনকে বিয়ে করব।

দেখ মুবিন ভাই, বেশি ফাজলামী করবে না। এবার গিয়ে মেয়ের মতামত নিয়ে চিঠি দিয়ে জানাবে। আমিও তোমার বড় ভাই গিয়ে বিয়ের কথাবার্তা বলে আসব।

দেখি আল্লাহপাকের যদি মর্জি হয় বলে মুবিন বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিল।

.

একদিন বিকেলে মুবিন বেড়াতে বেড়াতে এক ডজন বলপেন কেনার জন্য মার্কেটে গিয়ে একটা দোকানে ঢুকল।

একটু আগে নাসিমাও ঐ দোকানে এক ডজন বলপেন কেনার জন্য এসেছে। মুবিন তাকে লক্ষ্য না করলেও নাসিমা দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, মুবিন ভাই যে, কেমন আছেন?

নাসিমা বোরখা পরে এসেছে। দোকানে ঢুকে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে বেশ অবাক হয়ে বলল, আপনাকে চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারছি না।

নাসিমা বলল, চিনবেন কি করে, বন্ধু ভালো হয়ে যাবার পরে তো আর তাদের বাড়িতে যাননি। একদিনের পরিচয়ে কি আর চেনা যায়? তা কেমন আছেন বললেন না যে?

মুবিন এবার নাসিমাকে চিনতে পেরে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যেভাবে রাখেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত। আপনি কেমন আছেন?

আমিও আল্লাহর রহমতে এক রকম আছি। একটা প্রশ্ন করব।

করুন।

আমাদের বাড়িতে আর যাননি কেন?

এটার উত্তর এখানে বলা যাবে না। আপনার কেনাকাটা শেষ হলে চলুন, হাঁটতে হাঁটতে বলব।

 হ্যাঁ হয়েছে, এক ডজন বলপেন কিনতে এসেছিলাম। আপনি কিছু কিনবেন না কি?

মুবিন মৃদু হেসে বলল, আমিও এক ডজন বলপেন কিনতে এসেছিলাম।

 নাসিমাও মৃদু হেসে বলল, তাই।

.

মুবিন বলল, একটু দাঁড়ান। তারপর বলপেন কিনে বলল, চলুন।

রাস্তায় নেমে নাসিমা বলল, এবার বলুন।

দেখুন প্রশ্নটা খুব ব্যক্তিগত। ভাবছি, বলাটা ঠিক হবে কিনা।

নাসিমা মনে করল, তা হলে ভাইয়ার সঙ্গে কি মনোমালিন্য হয়েছে? তাই অনুমানটা যাচাই করার জন্য একটু জোর দিয়ে বলল, যতই ব্যক্তিগত হোক তবু শুনব।

শুনলে আপনি মাইন্ড করতে পারেন।

আমাকে মীন মাইন্ডেড ভাবলে ভুল করবেন।

যদি বলি আপনার জন্যই যাইনি।

নাসিমা দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমার জন্য?

 হ্যাঁ আপনার জন্য।

কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে তেমন খারাপ কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।

খারাপ কিছু না করলেও অন্য কিছু করেছেন। যার ফলে আপনার ভাইয়া নিয়ে যেতে চাইলেও যাইনি।

নাসিমা আরো অবাক হয়ে বলল, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ বলুন না কি করেছি।

শুনে মাইন্ড করবেন না বলুন।

এক্ষুণি বললাম না, আমার মন অত ছোট নয়?

প্রথম যেদিন আপনাদের বাসায় যাই, সেদিন আপনার চোখের দৃষ্টি আমার মন চুরি করে নিয়েছে।

কথাটা শুনে নাসিমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ভাইয়ার মুখে মুবিনের গুণাগুণ শুনে মনে মনে তাকে ভালবেসে ফেলে। সেই সাথে ভাইয়াকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে তার কাছ থেকে ইসলামকে জেনে সেও ঝুঁকে পড়ে এবং মুবিনকে আরো বেশি ভালবেসে ফেলে। সেই জন্য তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য ভাইয়াকে বলে। ভাইয়ার অসুখের সময় মুবিন তাকে দেখতে এলে তার মনের আশা পূরণ হয়। তারপর ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন যখন এল না তখন একদিন ভাইয়াকে বলল, তোমার বন্ধু আর আসেনি কেন? তার সঙ্গে কি তোমার মানোমালিন্য হয়েছে?

ওয়াহাব হেসে উঠে বলল, মুবিনের মতো ছেলের সঙ্গে কারো মনোমালিন্য হতেই পারে না।

তা হলে ওঁকে আর আননি কেন?

কয়েকবার আনতে চেয়েছি; প্রত্যেক বারই বলে, একটু ব্যস্ত আছি, পরে যাব। ঠিক আছে, কাল দেখা হলে তোর কথা বলব।

নাসিমা লজ্জা পেয়ে বলল, না না, আমার কথা বলবে কেন? তোমার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে কিনা জানার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম।

নাসিমার মুখে লজ্জার আভা দেখে ওয়াহাবের মনে হল, তা হলে কি মুবিনকে নাসিমা পছন্দ করে? বলল, কাল ওকে যেমন করে হোক নিয়ে আসব।

বলল আমার কথা বলবে না কিন্তু।

পরের দিন মুবিনের অপিস ছুটির সময় ওয়াহাব তার অফিসে গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, সত্যি করে বলুন তো আমাদের বাসায় যেতে চান না কেন?

মুবিন মৃদু হেসে বলল, আমি কি বলেছি যাব না।

তা অবশ্য বলেন নি; কিন্তু যান ওতো না। আপনি যান না বলে নাসিমা মনে করেছে আপনার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছে।

তাই নাকি? তা হলে তো একদিন যেতেই হয়।

একদিন কেন, আজই চলুন না।

কিছু মনে করবেন না। কাল বাড়ি যাব। আজ কিছু কেনাকাটা করব। বাড়ি থেকে ফিরে এসে একদিন যাব।

কত দিন পরে ফিরবেন?

 চারদিনের ছুটি পেয়েছি।

ঠিক আছে, ফিরে আসুন, তারপর দেখা হবে। এই কথা বলে বিদায় নিয়ে ওয়াহাব বাসায় এসে নাসিমাকে কথাটা জানাল।

নাসিমা বলল, আমার কথা বলনি তো?

প্রথমে বলিনি, যখন দেখলাম অজুহাত দেখাচ্ছে তখন তোর কথা বললাম। তোর কথা শুনেই তো ঐ কথা বলল।

নাসিমা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে মিষ্টি ধমকের সুরে বলল, তোমাকে আমার কথা বলতে নিষেধ করলাম, তবু বললে? ছিঃ ছিঃ ভদ্রলোক কি মনে করলেন?

মুবিন সে রকম ছেলেই নয় যে, কিছু মনে করবে।

কাজটা তুমি ভালো করোনি ভাইয়া বলে নাসিমা তার কাছ থেকে চলে গেল।

ছোট বোনের মুখের অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে অনুমানটা আরো গাঢ় হল। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুই আমার একমাত্র বোন, যেমন করে হোক তোর মনের আশা পূরণ করব।

এবার বাড়ি থেকে আসার পর নাসিমার কথা মুবিনের সব সময় মনে পড়ছে। তাদের বাসায়ও যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ওয়াহাব আসছে না বলে যেতে পারছে না। দশ বার দিন হল বাড়ি থেকে এসেছে। নাসিমাকে দেখার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠল। তাই একদিন ওয়াহাবের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সে অফিসের কাজে কয়েকদিন আগে ঢাকায় গেছে। ফিরতে আরো দু একদিন দেরি হবে।

আজ হঠাৎ মার্কেটে নাসিমার সঙ্গে দেখা। নাসিমাকে মন চুরি করার কথা বলার পরে তাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, মাইন্ড করলেন তো? এই জন্যে কথাটা বলতে চাইনি।

নাসিমা মাথা তুলে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, মাইন্ডের বদলে যদি অন্যকিছু করি তা হলে?

তা হলে সেটা কি বললে খুশি হব।

পরে বলব, তার আগে চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে বসে গলা ভেজান যাক।

 বেশ তো চলুন ঐ সামনের রেস্টুরেন্টে।

রেস্টুরেন্টে এসে মুবিন বলল, কি খাবেন?

 শুধু চা।

তা হতেই পারে না।

কেন?

প্রথম দিন আপনাকে শুধু চা খাওয়াতে পারব না। তারপর বেয়ারাকে ডেকে মিষ্টি ও চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, এবার বলুন।

যার চোখ আপনার মন চুরি করল, তাকে শাস্তি দিতে যাননি কেন?

প্রমাণ করার মত কোন ডকুমেন্ট ছিল না। তাই যাইনি। তবে এবার যাব।

ডকুমেন্ট পেয়েছেন?

 এতদিন পাইনি। একটু আগে পেলাম।

 তা হলে চোরকে শাস্তি দিতে যাচ্ছেন কবে।

মনে হচ্ছে, না যাওয়ায় চোর শাস্তি পাচ্ছে। ভাবছি, ওয়াহাব সাহেব ঢাকা থেকে আসার পর চোরকে প্রথমে এ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করব। তারপর আরো কঠিন শাস্তি দেব।

চোর যদি ধরা না দেয়।

 আর আমি যদি বলি চোর ধরা দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে?

নাসিমা লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, চোর কোনোদিন স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চায় না।

যেভাবে ধরা দেয়, সেই ভাবেই ধরব।

এমন সময় বেয়ারা দুটো প্লেটে মিষ্টি ও দুকাপ চা দিয়ে গেল।

মিষ্টি খাওয়ার পর নাসিমা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর আমি যদি বলি যিনি চোর ধরতে চাচ্ছেন, তিনি অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তার বোনের মন চুরি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?

তা হলে আমিও বলব, এতদিন তাকে ধরার চেষ্টা করছেন না কেন?

সে যে মেয়ে, আর চোর হল পুরুষ। মেয়েরা কি পুরুষ চোর ধরতে পারে?

 নিশ্চয়ই পারে। আজ কাল কত মেয়ে পুলিশ রয়েছে। চোর ধরা তো দূরের কথা তার চেয়ে কঠিন কাজও করছে। তা ছাড়া এখন মেয়েরা সমান অধিকারের দাবী তুলছে। একজন লেখিকা তো সে বিষয়ে অনেক বইয়ে লিখেছেন। ছেলেরা যদি যেখানে সেখানে ছোট বাথরুমের কাজ সারতে পারে, তা হলে মেয়েরা পারবে না কেন? ছেলেরা যদি স্যান্ডো গেঞ্জি পরতে পারে অথবা খালি গায়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারে, তা হলে মেয়েরা পারবে না কেন? ছেলেরা একসঙ্গে দুটো তিনটে বা চারটে বিয়ে করতে পারলে, মেয়েরা পারবে না কেন? পুরুষরা মেয়ে বেশ্যার কাছে যেতে পারলে মেয়েরা পুরুষ বেশ্যার কাছে যেতে পারবে না কেন? বিদেশের মতো এদেশেও পুরুষ বেশ্যালয় থাকা উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এমন কি আল্লাহপাক কোরআনের যে অংশগুলোতে নারীদের অধিকার সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন, সেই অংশগুলোর সংশোধন করার কথাও বলেছেন।

নাসিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ব্যাস ব্যাস, ঐ লেখিকার কথা আর বলবেন না, আমি তার কয়েকটা বই পড়েছি। পড়ে বুঝেছি ঐ লেখিকা একজন নাস্তিক, বিকৃতমনা, কুরুচীসম্পন্না ও জঘন্য ধরনের মহিলা। তাই দেশের লোক তার উপর ক্ষেপে যেতে তিনি ভয়ে সরকারের ছত্রছায়ায় বিদেশে পালিয়ে গেছেন। পত্র-পত্রিকা পড়ে জেনেছি, বিদেশেও পানি পাচ্ছেন না। তার কথা আলোচনা করতে ঘৃণা হয়। বাদ দেন ওসব কথা; কবে আমাদের বাসায় যাচ্ছেন বলুন।

মুবিন মৃদু হেসে বলল, আপনার ভাইয়া ঢাকা থেকে ফিরলে তারপর যাব।

 ভাইয়া যে ঢাকা গেছে, সে কথা জানলেন কেমন করে?

 তার অফিসে গিয়ে।

ভাইয়া না থাকলে যাওয়া যায় না বুঝি?

তা যাবে না কেন? ভেবেছি এক ঢিলে দুই পাখি মারব।

মানে?

মানে তার সঙ্গে গেলে আপনাদের বাসায় যাওয়াও হবে, আর সেই সাথে চোরকে এ্যারেষ্ট করার প্ল্যান প্রোগ্রামও করা যাবে।

নাসিমা মৃদু হেসে বলল, তাই?

 মুবিনও মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই।

 চলুন এবার ওঠা যাক।

 রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে মুবিন বলল, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।

নাসিমাও তাই চাচ্ছিল; তবু বলল, শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন? আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাব।

মুবিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা খালি রিক্সা যেতে দেখে থামিয়ে বলল, নিন উঠুন।

মুবিনও হয়তো এক রিক্সায় উঠবে ভেবে নাসিমা ইতস্তত করল।

বুঝতে পেরে মুবিন বলল, ইতস্তত করার কোন কারণ নেই, আমি আপনার সঙ্গে যাব না।

নাসিমা লজ্জিত হয়ে বলল, মাফ করবেন, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। চলুন হেঁটেই যাই। মাত্র তো আধ ঘন্টার পথ।

মুবিন বলল, তা আর হয় না। আপনি রিক্সা করেই যান।

 ক্ষমা চাইলাম, তবুও রাগ করলেন।

ক্ষমা চাওয়ার মত অন্যায় করেছেন কি না জানি না, তবে আমি আমার কথার নড়চড় কোনোদিন করি না। রিক্সায় না গেলে বরং আমিই মনে কষ্ট পাব।

নাসিমা বুঝতে পারল, মুবিন খুব সেন্টিমেন্টাল ও একরোখা। ভিজে গলায় বলল, প্লীজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। কথাটা আমি এমনিই বলেছি। আপনি এভাবে নেবেন জানলে বলতাম না।

জানেন বোধ হয়, প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু দোষ থাকেই। আমারও আছে। তার মধ্যে আমার একটা বড় দোষ, আমি যা একবার না বলি, তা আর হ্যাঁ হয় না। তাই আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেও আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে কাল যদি আসেন, তা হলে কথা দিচ্ছি যাব।

নাসিমা আর কোনো কথা না বলে চোখ মুছতে মুছতে রিক্সায় উঠল।

রিক্সা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর মুবিন বাসার পথ ধরল।

সেই দিন রাতে মুবিন বড় ভাবিকে নিজের মতামত জানিয়ে নাসিমার অভিভাবকদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলে চিঠি লিখল।

পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে সেটা পোষ্ট করে দিল। গতকালের ঘটনায় মুবিনের মনে শান্তি নেই। সেই থেকে তার কেবলই মনে হয়েছে নাসিমা মনে কষ্ট পেয়েছে। ভেবেছে, কাল যদি আসে, তা হলে তাকে খুশি করার চেষ্টা করবে। অফিসে কাজ করতে করতে বার বার গতকালের ঘটনা মনে পড়ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, তাকে আজ আসতে বললাম, কিন্তু কোথায় আসবে বলিনি। ওতো আমার বাসার ঠিকানা জানে না। যদি আসে, তা হলে কি মার্কেটে ঐ দোকানে আসবে? ভেবে রাখল, ছুটির পর ঐ দোকান হয়ে বাসায় ফিরবে।

মুবিনের ছুটি হয় পাঁচটায়। আজ নাসিমার চিন্তায় পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারল না। ভাবল, সে হয়তো মার্কেটে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই চারটের সময় ম্যানেজারকে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেটের বাইরে এসেছে এমন সময় নাসিমাকে আসতে দেখে মন আনন্দে ভরে গেল।

নাসিমা গতকাল বাসায় ফেরার সময় চিন্তা করল, মুবিন ভাই যা বলল, তা সত্যি, না ডাঁট দেখাল? যদি ডাঁট দেখায়, তা হলে তো সে অহঙ্কারী। তার এক মন বলল, যা স্বাভাবিক তাই তুই বলেছিস, তাতে মাইন্ড করবে কেন? এটা সে ডাঁটই দেখিয়েছে। তা না হলে তোর মনের খবর জানার পরও ঐ সামান্য কথায় রাগ করতে পারে না। আর এক মন বলল, তা কি করে হয়? যারা ধার্মীক তারা অহঙ্কারী হতে পারে না। তারা ভঁটও দেখাতে পারে না। সত্যি সত্যি হয়তো ছোটবেলা থেকেই ঐরকম। সিদ্ধান্ত নিল, কাল তার সঙ্গে দেখা করে সত্য মিথ্যা যাঁচাই করবে।

পরের দিন বেলা আটটার সময় ওয়াহাব ঢাকা থেকে ফিরে মালপত্র অফিসে বুঝিয়ে দিয়ে একটার দিকে বাসায় এল।

ওয়াহাব খাওয়া দাওয়ার পর যখন রেস্ট নিচ্ছিল তখন নাসিমা তার কাছে এসে বলল, তুমি আজ বিকেলে বাসায় থাকবে।

কেন?

 কেন আবার থাকতে বললাম থাকবে।

 তা না হয় থাকব; কিন্তু কারণটা বলবি তো।

এখন বলব না, থাকলেই জানতে পারবে।

ঠিক আছে এখন যা একটু ঘুমাব।

নাসিমা মুবিনের বাসার ঠিকানা জানে না। তাই অফিস ছুটির আগে এসে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মুবিনকে বেরোতে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিল।

মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বলল, ক্ষমা পেয়েছি তা হলে?

নাসিমা বলল, আপনি একথা বলছেন কেন? বরং অন্যায় তো আমি করেছি। কাল ক্ষমা চেয়ে পাইনি। আজ আবার চাইতে এলাম।

মুবিন লজ্জা পেয়ে বলল, গতকালের ঘটনার জন্য সত্যি খুব দুঃখিত। চলুন কোথাও বসি।

আজ আর কোথাও বসব না বাসায় চলুন।

বেশ তাই চলুন বলে মুবিন হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এখান থেকে ওদের বাসায় হেঁটে যেতে আধ ঘন্টা সময় লাগবে। এতটা পথ নাসিমাকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া অফিস ছুটির পর তারও ক্লান্তি লাগছিল। একটা খালি স্কুটার আসতে দেখে থামাল। তারপর নাসিমাকে বলল, উঠুন।

নাসিমাও ঐ একই কথা চিন্তা করে স্কুটারের কথা চিন্তা করছিল। তাই কিছু না বলে উঠে বসে বলল, আপনি স্কুটার না থামালে আমি থামাতাম। বাসার কাছে পৌঁছে স্কুটার থেকে নেমে মুবিন ভাড়া দিতে গেলে নিজের অজান্তে নাসিমা তার হাত ধরে ফেলে বলল, আপনি দিচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে নিয়ে এসেছি।

নাসিমা হাত ধরাতে মুবিন সারা শরীরে এক অজানা শিহরণ অনুভব করে কোন কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাসিমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল। তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কোন রকমে বলল, আসুন।

এমন সময় আসরের আযান হতে শুনে মুবিন বলল, আপনি যান, আমি নামায পড়ে আসছি। নাসিমাদের বাসার পাশে মসজিদ। ওয়াহাবের অসুখের সময় এসে ঐ মসজিদে একদিন নামায পড়েছিল।

নাসিমা ঘড়ি দেখে বলল, জামাতের সময় এখনও বিশ মিনিট বাকি। ভাইয়ার সঙ্গে যাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।

মুবিন অবাক হয়ে যেতে যেতে বলল, আপনার ভাইয়া ফিরেছেন?

জ্বি, আজই ফিরেছে।

ওয়াহাব ঘুম থেকে উঠে নাসিমাকে দেখতে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, নাসিমা কোথায়?

সারা বেগম বললেন, কোথায় যেন গেল। যাওয়ার সময় বলল, ভাইয়াকে থাকতে বলো।

ওয়াহাব চিন্তা করতে লাগল, নাসিমা কোথায় গেছে? আর আমাকেই বা থাকতে বলল কেন? বলল, ভেবেছিলাম মুবিনের সঙ্গে আজ দেখা করব।

ওয়াহাব বোনের মনোভাব বুঝতে পারার পর একদিন মা-বাবাকে বলেছিল। আমি নাসিমার জন্য মুবিনকে পছন্দ করেছি। আমার এক কলিকের বাড়ি ওদের পাশের গ্রামে। তার কাছে সব খোঁজ খবরও নিয়েছি। সে বলল, মুবিনের মত ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না। ওদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো। কিছুদিন আগে দৌলতখানে বিয়ের কথা হয়েছিল। মুবিন প্রথমে রাজি থাকলেও পরে অমত করেছে। তাই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। ভাবছি, একবার ওর সঙ্গে গিয়ে সব কিছু দেখে আসব।

ওয়াহাবের আব্বা বখতিয়ার সাহেব ডিস্ট্রিক জজ ছিলেন। গত বছর রিটায়ার্ড করেছেন। ওঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে জাপানে চাকরি করতে গিয়ে সেখানে বিয়ে করে সেটেল্ড। ছোট ওয়াহাব আর মেয়ে নাসিমা।

ছেলের কথা শুনে বললেন, তোমরা দুজনই এখন আমাদের সবকিছু। আমরা মা বাবা হলেও তুমিই নাসিমাকে গাইড দিয়ে মানুষ করেছ। তার ভালো মন্দের দায়িত্বও তোমার। আমার ও তোমার মায়ের ওকে পছন্দ। কেন বিয়ে ভেঙ্গে গেল, গিয়ে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে এস।

সারা বেগম এখন মুবিনের কথা শুনে বললেন, নাসিমা তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে গেছে। ফিরার পর মুবিনের কাছে না হয় যাবি।

ওয়াহাব আযান শুনে অজু করতে যাবে। এমন সময় জানালা দিয়ে নাসিমা ও মুবিনকে উঠোনের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে খুব খুশি হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। তখন তার মনে হল, ঠিক যেন একজোড়া কপোত-কপোতি। তাদেরকে পাশাপাশি আসতে দেখে আরো মনে হল, এই বাড়ির মেয়ে জামাই আসছে। ওরা দেখতে পাওয়ার আগেই জানালার কাছ থেকে সরে গেল।

নাসিমা মুবিনকে ড্রইং রুমে বসিয়ে ভাইয়ার কাছে এসে বলল, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

ওয়াহাব অবাক হবার ভান করে বলল, তা সারপ্রাইজটা কি শুনি?

বলব না, ড্রইং রুমে যাও। আমি আসছি বলে নাসিমা নিজের রুমে চলে গেল।

ওয়াহাব পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?

 ওয়াহাবও আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, বাড়ির সব খবর ভালো?

আল্লাহর রহমতে ভালো। জামাতের সময় হয়ে গেছে, নামায পড়ে আসি চলুন।

 হ্যাঁ তাই চলুন।

নামায পড়ে এসে দু বন্ধুতে বসেছে। এমন সময় নাসিমা কাজের মেয়েকে নিয়ে নাস্তা পরিবেশন করতে করতে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি তো তোমার বন্ধুকে আনতে পারনি। কাল মার্কেটে ওঁর সঙ্গে দেখা। বাসায় আসতে বলাতে বললেন, আজ আমি যদি আনতে যাই, তা হলে আসবেন। তুমি আজ এসে পড়লে। তাই ভাবলাম, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

ওয়াহাব বলল, সারপ্রাইজটা আজ তোকেই আমি দেব বলে ভেবেছিলাম। আল্লাহর মর্জি অন্য রকম। তাই বিপরীত ঘটনা ঘটল। তারপর মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, নিন শুরু করুন।

নাস্তা খাওয়া হয়ে যেতে নাসিমা পট থেকে কাপে চা ঢেলে প্রথমে মুবিনকে দিল। তারপর ভাইয়াকে দেওয়ার সময় বলল, তোমার বন্ধুকে বল, উনি আজ রাতের খাবার খেয়ে যাবেন।

ওয়াহাব বলল, আমি বলব কেন? তুই গিয়ে নিয়ে আসতে পারলি, আর এই কথাটা বলতে পারলি না?

নাসিমা বলল, তুমি না থাকলে বলতাম।

ওয়াহাব মুবিনকে বলল, শুনলেন তো, আজ রাতে খেয়ে তারপর যাবেন।

মুবিন বলল, দাওয়াত কবুল করা যখন সুন্নত কখন তো আর না করতে পারি না। তবে আপনার বোন অফিস থেকে আমাকে ধরে এনেছেন। এখন বাসায় যাই। পরে আসব।

ওয়াহাব বলল, ঠিক আছে, তাই আসবেন।

রাতে খাওয়া দাওয়া করে ফেরার সময় মুবিন ওয়াহাবকে বলল, কিছু যদি মনে না করেন, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।

ওয়াহাব বলল, মনে করার কি আছে? আপনি বলুন।

 কিছুদিন আগে অভিভাবকরা এক জায়গায় আমার বিয়ের কথাবার্তা বলেছিলেন, কোনো কারণে আমি সেখানে বিয়ে করতে রাজি হইনি। এবার বাড়ি যেতে তারা আবার মেয়ে দেখার কথা বললে আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। অবশ্য একথাও বলেছি আপনাদের মতামত জেনে তাদেরকে জানাবার পর যেন তারা আসেন।

ওয়াহাব বোনের মনের খবর আগেই বুঝতে পেরেছিল। এখন মুবিনের মনের খবর বুঝতে পেরে খুশিই হল। বলল, কথাটা বলে ভালই করলেন। আপনাকে আমাদের সবাইয়ের পছন্দ। এখন আপনি না বললে, আমি দু একদিনের মধ্যে বলব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু আল্লাহপাক তার আগেই আপনাকে দিয়ে কথাটা বলালেন। আপনি চিঠি দিয়ে আসতে বলুন।

মুবিন বলল, একটা অনুরোধ করব।

বলুন।

আল্লাহপাকের ইচ্ছায় যদি সব কিছু ঠিক হয়ে যায়: তবু আপনার বোন যেন না জানে আমার সঙ্গে তার বিয়ে হবে।

তা কি করে সম্ভব? আব্বা-আম্মা থাকলেও আমিই ওর অভিভাবক। আমি ওকে খুব। আদরে মানুষ করেছি। আমরা ভাইবোন হলেও খুব ফ্রিভাবে যে কথাবার্তা বলি, তা তো। আপনি নিজের চোখে দেখলেন। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেছি শুনলে আমার উপর ভীষণ রাগ করবে এবং মনে কষ্ট পাবে। নাসিমা বড় অভিমানী। আপনার অনুরোধ রাখতে। গেলে হিতে বিপরীত ঘটিয়ে ফেলব। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনি যে কারণে ওকে জানাতে নিষেধ করলেন, সে ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হবে না। ও বরাবরই খুব ফ্রি। আগে সবার সঙ্গেই ফ্রিভাবে মিশতো। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার পর কারো সঙ্গে মিশে না। তবে আমার মনে হয়, বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার পরও আপনার। সঙ্গে মেলামেশা করতে কোনো দ্বিধা করবে না।

মুবিন লজ্জা পেয়ে বলল, আপনারা দুই ভাইবোন খুব চালাক।

ওয়াহাব বলল, আমার তো মনে হচ্ছে, আমরা তিনজনেই চালাক।

এই কথায়, দুজনেই হেসে উঠল।

 হাসি থামিয়ে ওয়াহাব বলল, এবার আমি কিছু বলব, মাইও করবেন না তো?

মুবিন হাসতে হাসতে বলল, আপনার কথাতেই উত্তর দিচ্ছি, মাইণ্ড করার কি আছে? বলুন।

আপনাকে আমার পছন্দ হওয়ার পর নাসিমার মনের খবর জানার চেষ্টা করি। পজেটিভ জানতে পেরে আপনার ফ্যামিলীর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, সবকিছু ভালো; কিন্তু কিছুদিন আগে আপনার বিয়ে ঠিক ঠাক হয়েছিল, মানে যে কথা আপনি একটু আগে নিজেই বললেন। শুনেছি, ঐ বিয়েতে আপনি প্রথমে রাজি ছিলেন, পরে অমত করেছেন। অমতের কারণটা বলবেন?

মুবিন আহত স্বরে বলল, আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করেন?

ছিঃ ছিঃ এ আপনি কি বলছেন? অবিশ্বাস করতে যাব কেন? যদি করতাম, তা হলে সব কিছু জানার পর আপনার সঙ্গে নাসিমার ব্যাপারে কোনো কথাই বলতাম না। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। অভিভাবক হিসেবে আপনার সব কিছু জানা কি আমার উচিত নয়?

মুবিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম, ক্ষমা করে দিন।

ওয়াহাব বলল, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ক্ষমা চাওয়ার মত ভুল আপনি করেননি।

মুবিন বলল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, মেয়েটি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। অপছন্দ করার মত মেয়ে নয়। তাই প্রথমে অমত করিনি, পরে ঐ মেয়ের সম্পর্কে এমন কিছু জানতে পারি, যার কারণে সব কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়ার পরও আমি অমত করি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। প্লিজ এ ব্যাপারে আমাকে আর কোনো কথা। জিজ্ঞেস করবেন না।

ওয়াহাব বলল, ঠিক আছে, যা জানার জানা হয়ে গেছে।

মুবিন বলল, এবার তা হলে আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

ওয়াহাব যখন মুবিনকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল তখন নাসিমা চুপে চুপে তাদের পিছনে পিছনে এসে গেটের কাছে আড়ালে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের কথোপকথন শুনছিল। মুবিন চলে যেতে তাড়াতাড়ি করে ফিরে এল। সে রাতে নাসিমা শোকরানার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে মনের কামনা-বাসনা জানাল। তারপর আনন্দের চোটে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারল না।

পরের দিন দুটোর সময় কলেজ ছুটির পর তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এল। বাসায় না গিয়ে রিক্সায় করে মুবিনের ব্যাংকের গেটে এসে যখন নামল তখন মুবিন হোটেল থেকে খেয়ে ফিরছিল। নাসিমাকে দেখে অবাক হলেও আনন্দিত হল। সালাম বিনিময় করে বলল, কি ব্যাপার আজ আবার এলেন যে।

নাসিমা বলল কেন, আসতে নেই বুঝি?

 তা কেন, মানে …….।

তাকে থামিয়ে দিয়ে নাসিমা বলল, থাক আর মানে করা লাগবে না। আসুন আমার সঙ্গে।

এক মিনিট বলে মুবিন ভিতরে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বলল, চলুন।

নাসিমা হাঁটতে শুরু করে বলল, বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন তো?

 মুবিন মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ।

মুবিনকে হোটেলের দিকে যেতে দেখে নাসিমা বলল, এদিকে যাচ্ছেন কেন?

মুবিন বলল, আপনি কলেজ থেকে এসেছেন, আগে আপনার কিছু খাওয়া দরকার।

নাসিমা শুকরিয়া জানিয়ে বলল, আপনি দুপুরে কোথায় খান?

 হোটেলে।

হোটেলে খেলে তো গ্যাস্টিক হবে।

এছাড়া যখন কোন উপায় নেই তখন হলে কি আর করব। তবে এবার একটা ছেলে ঠিক করেছি। সে সামনের মাস থেকে বাসা থেকে ভাত নিয়ে আসবে। হোটেলে এসে জিজ্ঞেস করল, ভাত খাবেন, না অন্য কিছু?

নাসিমা বলল, আমি হোটেলে কোনোদিন ভাত খাইনি। আজ খেয়ে দেখব, হোটেলের রান্না কেমন?

মুবিন নাসিমার জন্য ভাতের অর্ডার দিয়ে নিজের জন্য একটা চা দিতে বলল।

 হোটেল থেকে বেরিয়ে মুবিন বলল, কোথায় যেন যাবেন বলছিলেন?

 যদি বলি বাসায়।

আপত্তি নেই, তবে কথাটা ঠিক বলেননি।

আপনার অনুমান ঠিক। কোথায় যাব, সেটাও অনুমান করে বলুন।

মুবিন বুঝতে পারল, নাসিমা তাকে নিয়ে বেড়াবে বলে এসেছে। তাই দুষ্টুমী করে বলল, মনে হচ্ছে, চোর জানতে পেরেছে ধরার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাই শাস্তির ভয়ে ধরাপড়ার আগে দোষ স্বীকার করতে এসেছেন।

নাসিমা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, চোরের বয়েই গেছে দোষ স্বীকার করতে। তারপর বলল, চলুন নদীর ধারে বেড়াতে যাই।

দুটো শর্তে যেতে পারি।

 আগে শর্ত দুটো বলুন। তারপর ওয়াদা করব।

একটা হল, প্রতিদিন পাঁচটার সময় ব্যাংকের গেটে আসবে, অন্যটা হল, এখন থেকে তুমি করে বলবে।

নাসিমা বলল, বিয়ে না করেই বৌ পেতে চাচ্ছেন?

তা হলে চল এক্ষুনি কাজি অফিসে যাই।

নাসিমা হেসে উঠে বলল, তা সম্ভব নয়, ভাইয়া মনে ভীষণ ব্যাথা পাবে, তারপর বলল, ঠিক আছে, দুটো শর্তই মেনে নিলাম।

.

১০.

গুপ্তগঞ্জের রাস্তায় আতাহারের সঙ্গে শবনমের দেখা হওয়ার পর আজ পনের দিন হতে চলল আর দেখা হয়নি। শবনম মনে করল, দেখা করার কোনো উপায় না পেয়ে আতাহার ঢাকায় চলে গেছে। তবু একদিন মেজ ভাইকে আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করল।

নাসির উদ্দিন বলল, আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুনেছি দশ বার দিন আগে ঢাকায় চলে গেছে।

শুনে শবনমের চোখে পানি এসে গেল। মুখ নিচু করে তার কাছ থেকে সরে গেল।

এর দুদির পর আলমাস চৌধুরী হুজুরের হুকুমে শবনমদের বাড়িতে এসে উঠানের পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন, সাখাওয়াত সাহেব বাড়িতে আছেন?

তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। শবনম আর তার মা ছিল। আব্বার নাম ধরে বাড়ির বাইরে কেউ ডাকছে শুনে শবনম মাকে বলল, কেউ যেন আব্বাকে ডাকছে।

যুবাইদা খানম বললেন, গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে গিয়ে দেখে আয়।

শবনম গায়ের ওড়না দিয়ে মাথা ও শরীর ঢেকে বেরিয়ে এসে আলমাসকে চিনতে পারল। খুব অবাক হয়ে সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি?

হ্যাঁ মা, তুমি তা হলে সাখাওয়াত সাহেবের মেয়ে?

জ্বি।

চৌধুরী হুজুর তোমার আব্বাকে দেখা করতে বলেছেন?

 আব্বা তো বাড়িতে নেই। চিটাগাং এ থাকেন।

চৌধুরী হুজুর বলেছেন, উনি বাড়িতে না থাকলে বাড়িতে আসার পর যেন ওনার সঙ্গে দেখা করেন।

ঠিক আছে বলব। তারপর বলল, আপনি বসুন চাচা।

না মা বসতে পারব না। চৌধুরী হুজুর খবরটা দিয়েই চলে যেতে বলেছেন। কথা শেষ করে আলমাস চলে গেল।

শবনম মায়ের কাছে এসে আলমাস যা যা বলে গেল, তা বলল।

যুবাইদা খানম স্বামীর কাছে চৌধুরী হুজুর যে বুজুর্গ লোক, তা শুনেছেন। বললেন, তোর আব্বা হয়তো সামনের সপ্তাহে আসবে। আমার মনে থাকে কি না থাকে, তুই মনে করে বলিস।

সেই দিন বিকেলেই সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি এলেন। ছেলের বিয়ের আর মাত্র দশ দিন বাকি। তাই এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছেন। সামসুদ্দিনকেও সঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এত আগে সে ছুটি পেল না। বিয়ের তিন দিন আগে আসবে।

সন্ধ্যের পর যুবাইদা খানম চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা স্বামীকে বললেন।

সাখাওয়াত হোসেন বললেন, উনি তা হলে এখন এখানে আছেন। কাল সকালেই ওঁর কাছে যাব। সামসুদ্দিনের বিয়ের কথা বলে দাওয়াতও দেব।

পরের দিন নাস্তা খেয়ে চট্টগ্রাম থেকে আনা কিছু ফল ও মিষ্টি নিয়ে সাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী হুজুরের কাছে গেলেন।

সালাম বিনিময়ের পর চৌধুরী হুজুর তাকে বসতে বলে বললেন, আপনি শবনমের বিয়ের ব্যাপারে কোনো চেষ্টা করবেন না। আল্লাহপাক যখন রাজি হবেন তখন হবে।

সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, হুজুর আমার মেয়েকে চেনেন দেখছি? তারপর বললেন, তাই হবে হুজুর।

চৌধুরী হুজুর বললেন, আর একটা কথা, এই ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না। এমন কি আপনার স্ত্রী বা ছেলে মেয়েদেরকেও না। এবার আপনি আসুন।

সাখাওয়াত হোসেন বললেন, হুজুর আমার বড় ছেলে সামসুদ্দিনের চৌদ্দ দিন পর বিয়ে। যদি মেহেরবানী করে দাওয়াত কবুল করতেন।

চৌধুরী হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, দাওয়াত কবুল করা সুন্নত। আল্লাহপাক যদি অতদিন আমাকে এখানে রাখেন, তা হলে ইনশাআল্লাহ যাব।

সাখাওয়াত হোসেন সালাম বিনিময় করে চলে এলেন। আসার পথে চিন্তা করলেন, উনি শবনমকে চিনলেন কেমন করে? আবার তার বিয়ে না দিতে এবং ওঁর কথা কাউকে বলতেও নিষেধ করলেন। তা হলে কি ওঁর হাতে কোন পাত্র আছে? যাই হোক হুজুর যখন বলেছেন তখন নিশ্চয় এর ভিতর কোনো ভেদ আছে।

শবনম নাসির উদ্দিনের মুখে আতাহারের ঢাকা চলে যাবার কথা শুনে সেই দিনই চিঠি লিখে তাকে পোস্ট করতে দেওয়ার সময় বলল, তোর নামে চিঠি দিতে বলেছি। চিঠি এলে আমাকে দিবি। কিন্তু এক মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও চিঠির উত্তর এল না। এই ভাবে তিন মাস চিঠি দিয়েও যখন আতাহারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না। তখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। নাসির উদ্দিনকে প্রায় চিঠির কথা জিজ্ঞেস করে।

নাসির উদ্দিন বলে, আতাহার ভাই চিঠি দেয়নি। দিলে তোকে ঠিক দিতাম।

এদিকে এস, এস, সির রেজাল্ট বেরোল। শবনম ও নাসির উদ্দিন ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছে। নাসির উদ্দিন দৌলতখান আবু আব্দুল্লাহ কলেজে আর শবনম দৌলতখান মহিলা কলেজে ভর্তি হল।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শবনম আতাহারকে চিঠি দিয়ে তার কলেজের ঠিকানায় চিঠি দিতে জানাল। ভেবেছিল, নাসির উদ্দিন হয়তো তার চিঠি মেরে দেয়। এবার নিশ্চয় আমি পাব। কিন্তু মাস গড়িয়ে বছর পার হয়ে যেতেও যখন আতাহারের চিঠি পেল না তখন তার মনে সন্দেহ হল। ভাবল, তা হলে কি সে আমাকে ভুলে গেল। কথাটা ভেবে মনে ভীষণ ব্যথা পেল। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তকদিরের কথা চিন্তা করে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ তুমি আমার তকৃদিরে যদি এটাই লিখে রেখেছিলে, তা হলে আতাহারকে ভালবাসার সুযোগ কেন দিলে? একদিন নাসির উদ্দিনকে বলল, আতাহার ভাই বাড়িতে এলে তোর সঙ্গে দেখা হয়?

নাসির উদ্দিন বলল, হয়, তবে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। একদিন তাকে বলেছিলাম, আমি কি তোর দুশমন। আমাকে দেখলে তুই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাস কেন? বলল, তোর কোনো কথার উত্তর দিতে পারব না বলে চলে যাচ্ছিল। আমি তার পথ আগলে বললাম, আমার কথার উত্তর না হয় নাই দিতে পারলি; কিন্তু আজ এক বছর হয়ে গেল, শবনমের চিঠির উত্তর দিস না কেন? তোর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, সে কথাও বলতে পারব না। তারপর হন হন করে চলে গেল। আমার মনে হয়, এমন কিছু একটা হয়েছে, যে জন্যে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

শবনম বলল, খেয়াল রাখবি, এবারে আতাহার ভাই এলে যেমন করে হোক তার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। আর সে ব্যাপারে তোকে সাহায্য করতে হবে।

আতাহার নাসির উদ্দিনকে এড়িয়ে চললেও এবং নাসির উদ্দিন তার বোনদের পড়ান বন্ধ করে দিলেও সে স্কুলে কুলসুমের সঙ্গে দেখা করে। একদিন আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করতে কুলসুম বলল, বেশ কিছুদিন থেকে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে কোথাও যায় না। এমন কি মসজিদেও নামায পড়তে যায় না। দুএকদিন থেকে চলে যায়। সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গেও আগের মত হেসে কথা বলে না। ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে আম্মা একদিন জিজ্ঞেস করতে বলল, আমি একটা সাধনা করছি। তুমি দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে সফলতা দেন। আম্মা বলল, তা না হয় দোয়া করব; কিন্তু তুই বাড়িতে দুএকদিনের বেশি থাকতে চাস না কেন? ভাইয়া বলল, বেশি দিন ছুটি পাই না তাই। সেদিনের পর থেকে নাসির উদ্দিন কুলসুমকে আর আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তবে তার ও খদিজার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে বুঝতে পারে। আতাহারের আয় বেড়েছে। এখন শবনমের কথা শুনে বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করব।

পরের দিন নাসির উদ্দিন স্কুলে গিয়ে কুলসুমকে বলল, আতাহার বাড়িতে এলে আমাকে বলবে, আমি তার সাথে দেখা করব।

কুলসুম বলল, ভাইয়াতো আজ এসেছে। কাল হয়তো চলে যাবে।

নাসির উদ্দিন বলল, তা হলে তো আজকেই তার সঙ্গে দেখা করতে হয়?

কুলসুম বলল, আমি কি তোমার কথা ভাইয়াকে বলব।

না, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সন্ধ্যের পর তোমাদের বাড়িতে যাব। এখন আসি বলে নাসির উদ্দিন চলে এল।

বাড়িতে এলেই শবনমকে দেখার জন্য আতাহারের মন পাগল হয়ে উঠে। তাই বেশি দিন থাকে না। মসজিদ শবনমদের ঘরের কাছে। নামায পড়তে গেলে শবনমের ভাই-বোনর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া নাসির উদ্দিন যদি নামায পড়তে আসে, তবে তার সাথে দেখা হবেই। এই সব কারণে মসজিদে না গিয়ে সে ঘরেই নামায পড়ে। আজ মাগরিবের নামায পড়ে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াচ্ছিল। এমন সময় নাসির উদ্দিনের গলা শুনতে পেল, আতাহার ঘরে আছিস? আতাহার চমকে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় শবনম পাঠিয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করবে কিনা চিন্তা করতে লাগল। নাসির উদ্দিনের গলা আবার শুনতে পেল, আতাহার আমি নাসির উদ্দিন, ঘরে থাকলে একটু বাইরে আয়। আতাহার বেরিয়ে এল।

তাকে দেখে নাসির উদ্দিন সালাম দিল।

 আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, চল বাইরে কোথাও বসি।

ওদের বাড়ির অল্প দূরে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। তারপর ধানের মাঠ। রাস্তায় এসে নাসির উদ্দিন বলল, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে, মাঠে গিয়ে বসি চল।

মাঠে এসে দুবন্ধুতে আজ প্রায় দেড় বছর পর মুখোমুখি বসল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। তার আলোতে নাসির উদ্দিন দেখল আতাহারের চোখে পানি চিক চিক করছে। বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দিবি?

আতাহার মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানাল।

বাল্যবন্ধু হয়েও কি তোর ভালো-মন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না? কি হয়েছে যদি বলতিস, তা হলে সাহায্য করতে না পারলেও মনে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।

আতাহার চোখ মুছে বলল, বলার মতো হলে নিশ্চয় বলতাম। বাল্য বন্ধুর দাবিতে আমি তোর কাছে দাবি করছি, আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না। আর …….।

নাসির উদ্দিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু শবনম যে তোর চিন্তায় নিজে যেমন পাগল হচ্ছে তেমনি আমাকে তোর কথা জানার জন্য অস্থির করে তুলছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক, কলেজে ওকে চিঠি দিয়ে জানা। এই দেড় বছরে তোকে পাগলের মত চিঠি দিয়ে যাচ্ছে, আর তুই কিনা তাকে একটারও উত্তর দিসনি। আমার তো ভয় হয়। শবনম আত্মহত্যা না করে ফেলে। আচ্ছা, তোদের মধ্যে কি কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে? অথবা কোনো ঝগড়া।

আতাহার তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুই চুপ কর নাসির তুই চুপ কর। আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। আর শবনম কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি বলছি বলে বলবি না। তুই তাকে বলবি, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি। কিন্তু সে তোর সঙ্গে অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও দেখা করতে চায়।

না-না, তা কখনই সম্ভব নয় বলে আতাহার দ্রুত উঠে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

নাসির উদ্দিন তার পিছু নিয়ে বলল, আতাহার যাসনে শোন।

 আতাহার যেতে যেতেই বলল তুই চলে যা, আমার কাছে আর আসবি না।

নাসির উদ্দিন ঘরে এসে সব কথা শবনমকে বলল।

শবনম শুনে ফুঁপিয়ে উঠল।

নাসির উদ্দিন বলল, কাঁদছিস কেন? সে তোকে শুধু বলতে বলল, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি।

শবনম সামলে গিয়ে বলল, হ্যাঁ কথাটা আতাহার ভাই প্রায় আমাকেও বলত।

সেইদিন রাতে শবনম আতাহারকে শেষ বারের মতো চিঠি লিখতে বসল।

আতাহার ভাই,

প্রথমে তোমার পদপ্রান্তে শত কোটি সালাম ও অন্তর উজাড় করে ভালবাসা জানালাম। এই দেড় বছর ধরে তোমাকে যে কত চিঠি দিয়েছি, তা তুমিও জান। এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি। আজ মেজ ভাইয়ের কাছে তোমার সব কথা শুনলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেন যে তুমি নীরব হয়ে গেলে আল্লাহ মালুম। আমাকে কোনো কারণে ঘৃণা করে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ কিনা অথবা অন্য কোনো কারণে তোমার এই নীরবতা, তা জানার বড় ইচ্ছা হয়। জানি এই চিঠির উত্তরও আমি পাব না। কারণ আমার মন বলে, এই দেড় বছরে যত চিঠি তোমাকে দিয়েছি সেগুলো পড়নি। হয় জ্বালিয়ে ফেলেছ, না হয় ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছ।

যা কিছুই কর না কেন? আমি তোমার কথা আমরণ মনে রাখব। আল্লাহ ছাড়া কোনো মানুষ আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারবে না। যে উদ্দেশ্যে তুমি নীরব হয়ে গেছ, সেই উদ্দেশ্য আল্লাহ তোমার পূরণ করুক, এই দোয়া চেয়ে শেষ করছি-আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোমার শুধু তোমারই শবনম।

 এতদিন শবনম যত চিঠি দিয়েছে, আতাহার একটাও পড়েনি। সব বাক্স বন্দী করে রেখেছে। কারণ পড়লে শবনমের চিন্তা তাকে পাগল করে দেবে। তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনকে শক্ত করে বাক্সে তুলে রাখে আর ভাবে, আল্লাহ যে দিন তাদের মিলনের বাধা দূর করে দেবেন, সেদিন শবনমকে দিয়েই তার চিঠি পড়াবে। এবারে ঢাকায় ফিরে শবনমের এই চিঠিটাও বেদনা ভরা মনে আগের গুলোর সঙ্গে রেখে দিল।

.

১১.

চার বছর পরের ঘটনা। নাসির উদ্দিন বি, এ, পাশ করে তার বাবার পোস্টে কাজ করছে। সাখাওয়াত হোসেন রিটায়ার্ড করে দৌলতখান বাজারে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়েছেন। সামসুদ্দিন তিন বছরের একটা ছেলে ও এক বছরের একটা মেয়ের জনক হয়েছে। কলিম উদ্দিন এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। আসমা নাইনে পড়ছে। শবনমের সঙ্গে আতাহারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। সে কথা তাদের দুই পরিবারের সবাই জেনে। গেছে। স্বামীকে শবনমের বিয়ের ব্যাপারে যুবাইদা খানম বার বার বলেন। সাখাওয়াত হোসেন মিথ্যে করে বলেন, চেষ্টা তো কম করছি না। কিন্তু ভালো ছেলে তো পাওয়া যাচ্ছে না। উনি মাঝে মাঝে কলাকোপায় গিয়ে চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সাহস করে শবনমের বিয়ের কথা বলতে পারেন না। চৌধুরী হুজুরও কিছু বলেন না। মজিদ শালীর জন্য এবং সামসুদ্দিন বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু শবনমের উপযুক্ত কোনো ছেলে পাচ্ছে না।

এতদিনে কুলসুমের সঙ্গে নাসির উদ্দিনের সম্পর্ক আরো গম্ভীর হয়েছে। সে কথা এরা দুজন ছাড়া অন্য কেউ না জানলেও শবনম জানে। শবনম বি, এ, পাশ করার পর আব্বা বড় ভাই ও মেজ ভাইয়ের সাহায্যে উঠোনের একপাশে ঘর উঠিয়ে বয়স্ক মেয়েদের জন্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছে। সেখানে গ্রামের মেয়েদেরকে ইসলামিক জীবন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। সেই সঙ্গে কোরআন ও নামায পড়া শেখায়। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ায় এবং বিভিন্ন মাসালা-মাসায়েলও শিক্ষা দেয়।

আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা মতো চলে বি, এ, পাশ করার পর আগের অফিসেই উঁচু পদে চাকুরী করছে। ঘরের সংস্কার করিয়েছে। কুলসুম কে এস, এস, সি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। খদিজা এইটে পড়ছে। আর তার ছোট ভাই আনোয়ার এ বছর সেভেনে উঠেছে।

এবারে বাড়িতে এসে আতাহার শুনল, নদীতে চর জেগেছে। সরকার থেকে চরের জমি বিলি হচ্ছে। যাদের জমি জায়গা সেখানে ছিল, তারা চরের দখল নেবার জন্য। সরকারী লোকের কাছে কাগজ-পত্র নিয়ে ছুটোছুটি করছে। চৌধুরী হুজুর আতাহারকে জানিয়েছিলেন, আমি না জানান পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে না। এই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে উনি পাঁচ বার দেখা করতে বলেছিলেন। এখন চরের জমির ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করবে কিনা দুদিন ধরে চিন্তা করে কাটাল।

তৃতীয় দিন সকালে নাস্তা খেয়ে উঠেছে এমন সময় ছোট ভাই আনোয়ার এসে বলল, আলমাস নামের একজন লোক আপনাকে ডাকছে।

আতাহার বাইরে এসে আলমাস কে দেখে সালাম দিয়ে বলল, কি খবর চাচা।

আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তোমাকে চৌধুরী হুজুর দেখা করতে বলেছেন। উনি এখন কলাকোপায় আছেন। একজন লোক এসে খবরটা দিয়ে গেল। আমি খবরটা পেয়েই তোমাকে বলতে এলাম।

আতাহার বলল, ঠিক আছে চাচা, এক্ষুণি আমি রওয়ানা দেব। আপনি বসবেন আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।

আলমাস বলল, না বাবা, এখন চা খাবার সময় নেই। আরো এক জায়গায় যেতে হবে।

আতাহার আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করে ঘরে এসে মাকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা বলে কলাকোপায় রওয়ানা দিল।

আতাহার চৌধুরী হুজুরের বাড়িতে পৌঁছে দেখল, অনেকে বসবার রুমে বসে রয়েছেন। প্রতিদিন যারা ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন, খাদেম তাদেরকে একটা রুমে বসিয়ে চা-নাস্তা খাওয়ায়। তারপর একজন একজন করে সিরিয়াল মত পাশের রুমে হুজুরের সঙ্গে দেখা করে। পাঁচ জনের পর আতাহরের সিরিয়াল এল। আতাহার রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।

চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, নদীতে চর জেগেছে। এর মধ্যে অনেকে কাগজ পত্র দেখিয়ে দখল পেয়েছে। তুমিও তাই কর। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় এখন তুমি স্বাবলম্বি হয়েছ। দোয়া করি, আল্লাহ আরো ত্বরক্কী দিক। তোমাকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য যে সব শর্ত দিয়েছিলাম তা রহিত করা হল। এখন থেকে তুমি স্বাধীন। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত তুমি শবনমের সঙ্গে দেখা করবে না। তবে চিঠি পত্র দিতে পার। আর ইনশাআল্লাহ তোমাদের বিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে হবে। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ, চাকরি করছে শুনে খুশি হয়েছি। দোয়া করি, ভবিষ্যতে দুনিয়াবী ও আখেরাতের সমস্ত পরীক্ষায় তোমাকে আল্লাহ উত্তীর্ণ করাক। এবার তুমি এস।

কৃতজ্ঞতায় আতাহারের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে কদমবুসি করে বলল, আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?

চৌধুরী হুজুর মৃদু হেসে বললেন যখন আল্লাহ পাকের মর্জি হবে। সব সময় মনে রাখবে, আল্লাহ পাকের মর্জি ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছুই হয় না। এবার তুমি যাও, আরো অনেকে অপেক্ষা করছে।

আতাহার সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে বসবার রুমে সাখাওয়াত হোসেনকে দেখতে পেল। উনি তখন হুজুরের রুমে ঢুকতে যাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আতাহার সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি? কেমন আছেন?

সাখাওয়াত হোসেন সেই ছোট বেলায় আতাহারকে দেখেছিলেন। তারপর এতদিন আর দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না।

আতাহার বলল, আমাকে চিনতে পারলেন না চাচা? আমি আতাহার, মোজাম্মেল খন্দকারের ছেলে।

সাখাওয়াত হোসেন খুব অবাক হয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলেন। সেই একটু খানি ছেলে আজ কত সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হয়েছে। বললেন, ঠিক আছে, তুমি একদিন দোকানে আমার সঙ্গে দেখা করো। তারপর হুজুরের রুমে ঢুকে সালাম দিলেন।

চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আতাহারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

এই কথা শুনে সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, জ্বি হয়েছে।

কেমন দেখলেন?

সাখাওয়াত হোসেন থতমত খেয়ে বললেন, জ্বি? জ্বি ভালো।

এখন তা হলে আর ওর সঙ্গে শবনমের বিয়ে দিতে অমত করবেন না?

আতাহারকে চিনতে পারার পর সাখাওয়াত হোসেন বেশ অবাক হয়েছিলেন। এখন হুজুরের কথা শুনে আরো বেশি অবাক হয়ে হাঁ করে হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চৌধুরী হুজুর বললেন, অত অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহ পাকের ঈশারা মানুষের বোধগম্য নয়। আমি একদিন আপনাকে শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলাম। আজ ডেকে পাঠিয়েছি, বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর পাত্র হল আতাহার। সে এখন বি, এ, পাশ করে চাকরি করছে। তার মতো ছেলে আর পাবেন না। শবনম সুখী হবে। আর শুনুন, আপনি তো চরের জমি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, সেই সঙ্গে আতাহার যাতে তার বাবার চরের সম্পত্তি ফিরে পায়, সে জন্য তাকে সাহায্য করবেন। আতাহার ছেলে মানুষ। কাগজপত্র তেমন বুঝবে না। আপনি সাহায্য করলে অনেক উপকার হবে।

সাখাওয়াত হোসেনের বরাবর ইচ্ছে ছিল, আতাহারের সঙ্গে শবনমের বিয়ে দেওয়ার। স্ত্রী ও বড় মেয়ে এবং বড় ছেলের কথার চাপে সে কথা প্রকাশ করতে পারেননি। তার উপর আতাহারের নামে নানা রকম দুর্নাম শুনে মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে বুঝতে পারলেন, কেন উনি শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলেন। হয়তো এটাই আল্লাহ পাকের ঈশারা। বললেন, আপনি যা বলবেন তাই করব হুজুর।

যা বলার আমি বলেছি। এবার আপনি আসুন।

ওদের বিয়ের সময় আপনাকে থাকতে হবে।

খবর দেবেন, আল্লাহপাক রাজি থাকলে নিশ্চয় থাকব।

চৌধুরী হুজুরের কথা শোনার পর থেকে আতাহারের মনে আনন্দের বান বইতে শুরু করেছে। ফেরার সময় সারা পথ শবনমের চিন্তায় ডুবে রইল। বাস থেকে দৌলতখান নেমেই মসজিদে গিয়ে শোকরানার নামায পড়ল। তারপর বাড়িতে এল।

রফিকা বেগম অনেক দিন ছেলের মুখে হাসি দেখেননি। আজ আগের মতো তার মুখে হাসির আভা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?

আতাহার কি বলবে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তোমাকে বলিনি, উনি মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে পাঠাতেন এবং আমি গেলে অনেক সৎ উপদেশ দিতেন। আজও সেজন্যে ডেকেছিলেন। বিয়ের কথাটা লজ্জায় বলতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।

তাকে লজ্জা পেতে দেখে ও তার কথা শুনে রফিকা বেগমের মনে সন্দেহ হল। ভাবলেন, শুধু ভালো উপদেশ শুনে আতাহার এত খুশি হতে পারে না এবং মুখেও লজ্জা ফুটে উঠতে পারে না। নিশ্চয় উনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা লজ্জায় বলতে পারছে না। বললেন, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি তোর আম্মা, আমার কাছে বলতে তোর লজ্জা কিসের?

আতাহার বলল, উনি এবার আমাকে বিয়ে করতে বললেন?

রফিকা বেগম হেসে ফেলে বললেন, এই কথায় এত লজ্জা পাবার কি আছে? উনি ভালো কথাই বলেছেন। কয়েকদিন আগে ফজল ঘটক এসেছিল। আমিও এবার তোর বিয়ের কথা চিন্তা করে তাকে ভালো মেয়ে দেখতে বলেছি।

আতাহার বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর বললেন, মেয়ের বাবা নাকি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। আমার কি মনে হয় জান আম্মা, উনি হয়তো কোনো মেয়ের বাবাকে পাঠাবেন।

রফিকা বেগম বললেন, তা হলে তো ভালই হল। উনার পছন্দের উপর তো কোনো কথাই নেই।

আজ আলমাস আতাহারকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠানোর কথা বলে সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাকেও একই কথা বলেছিল। কলাকোপা যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রীকে সে কথা বলে গিয়েছিলেন।

স্বামী ফিরে আসার পর যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?

সাখাওয়াত হোসেন কি বলবেন, আসার পথে ভেবে রেখেছিলেন। বললেন, তিনি আমাদের পরিবারের সব খবর জানেন। শবনমের বিয়ে যাতে তাড়াতাড়ি হয় সে জন্যে তদবিরের কথা বলতে বললেন, তদবির লাগবে না। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় অতি সত্ত্বর ওর বিয়ে হবে। তারপর আতাহারের কথা বলে বললেন, শবনমের উপযুক্ত হল আতাহার। আল্লাহ চাহে তো আপনার মেয়ে সুখী হবে। আমাকে চিন্তিত দেখে আবার বললেন, চিন্তা করছেন কেন? আপনারা হয়তো জানেন না, আতাহার বি, এ, পাশ করে ভালো চাকরি করছে। এই জমানায় ওর মতো ভালো পাত্র আর পাবেন না। আপনি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। আরো বললেন, আতাহারের বাবার চরের জমির ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে।

স্বামীর কথা শুনে যুবাইদা খানম এত অবাক হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। এক দৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সাখাওয়াত হোসেন মৃদু হেসে বললেন, তুমি খুব অবাক হচ্ছ, তাই না? হওয়ারই কথা। চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে আমার অবস্থাও তোমার মতো হয়েছিল। আমি চিঠি দিয়ে সামসুদ্দিন, নাসির উদ্দিন, খালেদা ও জামাইকে আসতে বলি। তাদেরকে চৌধুরী হুজুরের কথা বলে তাড়াতাড়ি শবনমের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

শবনমও জানত, আব্বা চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তাই ফিরে এসে আম্মার সঙ্গে কথা বলতে দেখে দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথাবার্তা শুনছিল। ঐ পর্যন্ত শুনে সে আর স্থির থাকতে পারল না। নিজের রুমে এসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল। তারপর দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়ে চিন্তা করল, আতাহার ভাই তা হলে আমাকে পাওয়ার জন্য এতদিন সাধনা করেছে। কিন্তু আমার দেওয়া কয়েকশ চিঠির উত্তর দিল না কেন? অন্ততঃ একটা চিঠি দিয়ে আমাকে জানাতে পারত। নাসির উদ্দিন তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানে, তার কাছেও বলতে পারত।

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কয়েকশো চিঠি দিয়ে যখন শবনম একটা চিঠিরও উত্তর পেল না। তখন মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মনের কামনা-বাসনা জানিয়েছে এবং সবর করার তওফিক চেয়েছে। আজ আব্বার মুখে তার কথা এবং তার সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে একদিকে যেমন আনন্দে আত্মহারা হল, অপর দিকে তেমনি চিঠির উত্তর না দেওয়ার জন্য আতাহারের উপর প্রচন্ড অভিমান হল। ভেবে রাখল, আল্লাহপাকের ঈশারায় সময় হলে এর প্রতিশোধ নেবে।

আতাহার এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর শবনমকে চিঠি লিখতে বসল।

 প্রাণ প্রিয়া শবনম,

প্রথমে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো। আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর কেন তোমাকে চিঠি লিখছি তা চিঠিটা পড়লেই বুঝতে পারবে। এই পাঁচ বছর ধরে তুমি আমাকে যে কয়েকশ চিঠি দিয়েছ, সেগুলো পড়া তো দূরের কথা একটার মুখও না খুলে রেখে দিয়েছি। আল্লাহপাক রাজি থাকলে, তোমার সামনে খুলে পড়ব। কেন চিঠিগুলো পড়িনি সে কথা বলতে আমি অপারগ। সে জন্য এবং তোমার সঙ্গে এতদিন কোনো যোগাযোগ না রেখে যে অপরাধ করছি, তার জন্যও ক্ষমা চাইছি। আমি জানি তুমি আমার উপর যতই রাগ বা অভিমান করে থাক না কেন? এই চিঠি পাওয়ার পর সে সব কর্পূরের মত বাতাসে উড়ে যাবে। চিঠিতে বিস্তারিত কিছু লিখব না। শুধু এতটুকু লিখছি, ইনশাআল্লাহ আমাদের মনের বাসনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূরণ হবে। তার আগে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমার সঙ্গে আমার দেখা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ চাহে তো, এবার আর লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ নয়, একেবারে বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে এনে বাসর ঘরে সারারাত তোমাকে দেখব। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও আমি জানি, আমার মতো তুমিও ঐ রাতটার জন্য সবর করে অধীর আগ্রহে দিন যাপন করছ। আল্লাহ তাড়াতাড়ি আমাদের মনো বাসনা পূরণ করুক এবং আমাদেরকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে হেফাজত করুক, এই দোয়া করে শেষ করছি-আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক
আতাহার।

চিঠিটা শেষ করে ভেবে রাখল, কাল কুলসুমকে দিয়ে এটা শবনমের কাছে পাঠাবে।

Super User