১৩.
রাত বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ভাল লাগছে না পটেটোর। বিলি ফক্স আর তার ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক খেলার ভাবনা কিছুতেই দূর করতে পারছে না। মন থেকে। মাঝেমধ্যে একআধটু উত্তেজক বিকৃত খেলা যে ভাল লাগে না। তার, তা নয়। তবে ইদানীং বড় বেশি বিকৃত খেলা শুরু করে দিয়েছে বিলি, যেটা তার সহ্যের বাইরে। এসব খেলার কথা ভাবতেও ভাল লাগছে না আর ওর।
খালি ঘর। খানিক আগে একটা ছেলে আর তার বান্ধবী এককোণে দুটো মেশিনে খেলছিল। ওরাই আজকের শেষ খেলোয়াড়। চলে গেছে। একা একা বসে এখন কমিক পড়ার চেষ্টা করছে পটেটো। মন বসাতে পারছে না।
ঠিক বারোটায় উঠে গিয়ে মেইন ব্রেকার অফ করে আলো নিভিয়ে দিল সে।
অন্ধকার হয়ে গেল আর্কেড়। তবে পুরোপুরি নয়। একধারে একটা আলো জ্বলেই রইল। ভিডিও গেম মেশিনের স্ক্রীনের আলো। সতর্ক ভঙ্গিতে পা টিপে টিপে সেটার দিকে এগোল সে। Virtual Massacre-II মেশিনটা চলছে বিদ্যুৎ ছাড়াই। পর্দায় ফাইটারদের ওপরে ফুটে উঠেছে নামের একটা স্তম্ভ। বিশটা নাম। সবগুলো একজনের-বি, পিএফ.।
এই, যাহ! লেখাগুলোকে বলল সে। যেন ধমক দিলেই কথা শুনবে মেশিন। অপেক্ষা করতে লাগল মেশিন বন্ধ হওয়ার। হলো না। বিড়বিড় করে বলল, বিলি, আমি জানি, তুমি একাজ করছ।
জবাব নেই।
হঠাৎ ঝমঝম করে বেজে উঠল জুকবক্সটা। দি নাইটওয়াকারস।
ঘটনাটা নতুন নয় পটেটোর কাছে। কিন্তু এ মুহূর্তে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। জোর করে হাসল।
কি হয়েছে বিলি? কিছু বলতে চাও? দরজার দিকে পা বাড়াল পটেটো। আতঙ্ক চেপে রাখার চেষ্টা করছে। ওর চারপাশের বাতাস ঘন, ভারী হয়ে। উঠেছে। অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ। বিদ্যুৎ-ঝড়ের পর যেমন হয়।
প্রতিটি পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে আরও বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে। এ এক ভয়ানক পরিস্থিতি। আতঙ্ক কিছুতেই বাগ মানাতে পারছে না। একটা মানুষখেকো হাঙরের সঙ্গে সাঁতার কাটছে যেন। জানে নিচের গভীর পানিতে কোনখানে রয়েছে ওটা, কিন্তু ও দেখতে পাচ্ছে না। সময়মত ঠিকই ভুস করে উঠে আসবে ওকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
দরজা খোলার জন্যে ঠেলা দিল পটেটো। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল। আবছা আলোয় অনেকটা আঙুলের আন্দাজে খুঁজে বের করল সঠিক চাবিটা। হাত ভীষণ কাঁপছে।
চিৎকার করে উঠল সে, কি করছ? বলেছিই তো ওদের কিছু বলিনি আমি!
জুকবক্সে মিউজিকের কানফাটা ঝমঝম ছাড়া কেউ জবাব দিল না তার কথার।
বাইরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কাঁপা হাতে কোনমতে চাবিটা তালায় ঢোকাল সে। তালা লাগানোর পর একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না। ছুটে নামল চত্বরে। ঝোড়ো বাতাস বইছে।
পার্কিং লটে এসেও শব্দের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেল না। এখন বাজনা বাজাচ্ছে বাতাসের শব্দ। গাছগুলোও যেন স্পীকারে পরিণত হয়েছে। আকাশে মেঘ গুমগুম করে বাজিয়ে চলেছে হেভি মেটাল মিউজিক।
ওকে ঘিরে বইছে প্রবল বাতাসের ঘূর্ণি। এখনও দেখতে পাচ্ছে না বিলিকে। চিৎকার করে বলল, বিলি, বিশ্বাস করো! আমি কিছু বলিনি ওদের! শিশুর মত অসহায় ভঙ্গিতে কেঁদে উঠল। আমি তোমার বন্ধু, বিলি! আমার সঙ্গে এমন করছ কেন?
এতক্ষণে জবাব মিলল। মিউজিকের চেয়ে জোরাল শব্দে, রোদের চেয়ে উজ্জ্বল বিদ্যুতের একটা হলকা এসে লাগল ওর পিঠে। হৃৎপিণ্ডটাকে পুড়িয়ে দিয়ে বুক ভেদ করে গিয়ে ঢুকে গেল মাটিতে।
মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পটেটো। পকেট থেকে সিকিগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। পার্কিং লটে কংক্রীটের মেঝেতে ঝনঝন শব্দ তুলল। কিছুই কানে ঢুকল না তার। ঢুকবেও না আর কোনদিন।
*
আর্কেডের হাতে দাঁড়িয়ে পার্কিং লটে পড়ে থাকা ওর বন্ধুর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি। মনের মধ্যে খুঁজে দেখল, যে কাজটা করেছে তার জন্যে কোন রকম দুঃখবোধ, অনুশোচনা আছে কিনা। নেই। একটুও খারাপ লাগছে না। ভয়বাহ বিদ্যুৎ যেন তার ভেতরটাকেও পুড়িয়ে, মুছে অনুভূতি আর আবেগশূন্য করে দিয়েছে। যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলেছে। ফেরার উপায় নেই আর। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়া। যা শুরু করেছে সেটার শেষ করতেই হবে।
ভয় পায় না সে। মিলি যদি সঙ্গে থাকে দুনিয়া জয় করার চেষ্টাতেও আপত্তি নেই।
সব পারবে।
প্রবল বেগে বাতাস বইছে। উত্তরের আকাশে মেঘ জমছে। ঝড় আসবে।
দেখেও দেখল না বিলি। কেয়ারও করল না। ঝড়বৃষ্টি দেখার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ এখন পড়ে আছে তার সামনে। ছাত থেকে নেমে আসতে লাগল পটেটোর লাশটা তুলে নেয়ার জন্যে।
.
১৪.
হাসপাতালে যাওয়ার সময় সারাটা পথ আরও জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে মুসাকে তাগাদা দিতে থাকল কিশোর। পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে চলছে, তা-ও মনে হচ্ছে ওর, অনড় হয়ে আছে গাড়িটা।
মিলিকে কথা দিয়েছে, সে আর তার বাবা নিরাপদে থাকবেন। রাখার দায়িত্ব ওদের। বাঁচাতে না পারলে মিলির কাছে ছোট হয়ে যাবে তিন গোয়েন্দা। মান থাকবে না শেরিফ রবার্টসনের কাছে।
হাসপাতালের সামনে গাড়িটা পুরোপুরি থামার আগেই দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে গেল কিশোর। দৌড় দিল লিফটের দিকে। ঘন ঘন চাপ দিচ্ছে বোতামে। এলিভেটর, মুসা এবং রবিন তার কাছে একসঙ্গে পৌঁছল।
পাঁচ তলায় উঠে এলিভেটরের দরজা ফাঁক হওয়া শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ল কিশোর।
হলে ডিউটিরত বিস্মিত নার্সকে বলল, জলদি সিকিউরিটিকে ফোন করুন। বলে দিন, হাসপাতালের পরিচিত লোক ছাড়া আর কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়।
নার্স কি বলে না বলে তার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল না সে। দৌড় দিল হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে। জানালা দিয়েই মিলিকে দেখতে পেল। অস্থিরতা নেই। বসে আছে বাবার বিছানার পাশে চেয়ারে।
ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা। আস্তে করে ডাকল, মিলি!
ফিরে তাকাল মিলি। সতর্ক হয়ে গেছে মুহূর্তে। উঠে এগিয়ে এল। কি?
আমাদের সঙ্গে এখুনি যেতে হবে তোমাকে।
কোথায়? কেন?
হাজত থেকে বিলিকে ছেড়ে দিয়েছেন শেরিফ।
তাই নাকি! যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল মিলি। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। কিন্তু তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলে। বলেছ আমরা নিরাপদ।
বলেছি। হাতে সময় কম। জলদি এসো। যেতে যেতে বলব…
মাথা নাড়ল মিলি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন বাবাকে নাড়াচাড়া করা একদম উচিত হবে না। ওঁকে একা ফেলে যেতে পারব না আমি।
কিশোরের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। আমি তোমার বাবাকে পাহারা দিচ্ছি। তুমি ওদের সঙ্গে চলে যাও।
না! আমি যাব না!
জেদ কোরো না, মিলি!
বললাম তো আমি যাব না! টেবিলে রাখা হাতব্যাগটা নিয়ে এল মিলি। খুলে একটা পিস্তল বের করে দেখাল। বাবার। নিশানা খুব একটা খারাপ না। আমার। বাবাই গুলি চালানো শিখিয়েছে।
ওরকম হাজারটা পিস্তল দিয়েও বিলির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা ওর। যত তাড়াতাড়িই করো, পিস্তল তুলে গুলি করতে যেটুকু সময় লাগবে তোমার, ওর ততটা লাগবে না। মনে মনে শুধু বলবে
দপ করে নিভে গেল বাতি। কয়েক সেকেন্ড পরেই জ্বলে উঠল আবার। চালু হয়ে গেছে হাসপাতালের স্বয়ংক্রিয় জেনারেটর। ইমারজেন্সি পাওয়ার।
থাবা দিয়ে মিলির হাতের পিস্তলটা প্রায় কেড়ে নিল কিশোর। ও এসে গেছে!
*
হলের অনেক নিচে টুং করে মৃদু একটা শব্দ হলো। মিলি, কিশোর, রবিন, মুসা, সবাই শুনতে পেল সেটা। গলা লম্বা করে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল মুসা। শব্দটা কিসের বুঝতে চায়।
হল আর বেশির ভাগ জায়গাতেই ডিম লাইট জ্বলছে। সবচেয়ে বেশি। আলো আছে করিডরে, এলিভেটরের কাছে।
উঠে আসছে এলিভেটর।
সেদিকে দৌড় দিল তিনজনে।
টুং!
চারতলায় থেমেছে এলিভেটর। ঠিক ওদের নিচে। এলিভেটরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে পিস্তলটা চেপে ধরে সামনে বাড়াল কিশোর। বিলির। দিক থেকে কোন রকম ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে নির্দ্বিধায় গুলি চালাবে। তারপর যা হয় হোক।
টুং!
পাঁচতলায় থামল এলিভেটর। দরজার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে কিশোর। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। ট্রিগার ছুঁয়ে থাকা আঙুলটা চেপে বসতে প্রস্তুত।
খুলে যাচ্ছে দরজা। এলিভেটরের মেঝেতে দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ।
পিস্তল নামাল কিশোর। পড়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারল। ভিডিও আর্কেডের সেই ছেলেটা। পটেটো।
রবিনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ইশারা করল সে। বুঝতে পারল রবিন। এলিভেটরে ঢুকে পটেটোর গলার কাছে হাত দিয়ে নাড়ী দেখল। মনে পড়ল, হাজতে বসে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিল বিলি। ইস্, তখন গুরুত্ব। দেয়নি! দেয়া উচিত ছিল। এখন দেরি হয়ে গেছে অনেক।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রবিন, নেই!
এলিভেটরে ঢুকে স্টপ সুইচটা টিপে দিল কিলোর যাতে ওই তলাতেই আটকে থাকে ওটা। বেরিয়ে এল আবার।
পেছনে এসে দাঁড়াল ডিউটি-নার্স। এলিভেটরের দেহটা দেখে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ও, লর্ড!
ওর দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। এই তলায় ওঠার আর কোন উপায় আছে?
হাত তুলে হলের শেষ মাথা দেখাল নার্স। সিঁড়ি। নিজেকে সামালানোর চেষ্টা করছে এখনও।
দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। মিলির কাছে থাকো। ওদের পাহারা দাও।
তুমি কোথায় যাচ্ছ? জানতে চাইল মুসা।
বিলিকে ধরতে। পটেটোর লাশটা এদিকে পাঠিয়ে আমাদের নজর সরিয়ে রাখতে চাইছে সে। সেই সুযোগে… কথা শেষ না করেই সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর।
*
সিঁড়িঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। চোখে আলো সয়ে আসার অপেক্ষা করল। মেইন লাইন থেকে বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এখানে বেশি পাওয়ারের আলোগুলোর কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিভে আছে। জ্বলছে অতি সামান্য পাওয়ারের লাল বাল্ব। বিচিত্র এক অপার্থিব লালচে আলো সৃষ্টি করেছে। সরাসরি যেসব জায়গায় আলো পড়ছে না সেই কোণগুলোতে ছায়া।
আস্তে করে গলা বাড়িয়ে কোণের দিকে তাকাল সে। সিঁড়ির ধাপ দেখল।
কেউ নেই।
যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নামতে শুরু করল সে। ধাতব সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত এবং শব্দ না করে নামা খুব কঠিন কাজ।
হাত লম্বা করে পিস্তলটা সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।
মোড় ঘুরল একটা। কাউকে দেখা গেল না।
বাকি ধাপ কটা দৌড়ে পেরোতে শুরু করল। নিচে প্রায় পৌঁছে গেছে। এই সময় একটা গুঞ্জন কানে এল। কোন ইলেকট্রিক্যাল কয়েল খারাপ থাকলে যেমন মৃদু একটা শব্দ ওঠে, তেমনি। মাঝে মাঝে চড়চড় ফড়ফড় করে উঠছে। বাকি কয়েকটা ধাপ নিঃশব্দে নেমে কান পাতল সে।
কোন সন্দেহ নেই। কানের ভুল নয় তার। লম্বা করে দম নিল। সিঁড়িতে এক ধরনের গন্ধ। ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না গন্ধের রকমটা। তবে সচল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে বোঝাই ঘরে যে রকম গন্ধ পাওয়া যায়, অনেকটা সেরকম।
উত্তেজনায় টানটান স্নায়ুগুলোকে ঢিল করার চেষ্টা চালাল সে। সেটা করা সম্ভব নয় আর এখন কোনমতেই। বরং পিস্তলটায় আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল হাতের আঙুলগুলো। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। আক্রমণ করতে আসা বিলিকে দেখামাত্র গুলি করবে।
কিন্তু কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বরং নষ্ট করে দেয়া সার্কিট ব্রেকারটা চোখে পড়ল। তারের সঙ্গে পেন্ডুলামের মত দুলছে এপাশ ওপাশ। বাক্সটা যেন প্রচণ্ড আক্রোশে টেনে খুলে আনা হয়েছে। ছেঁড়া তারের মাথা একটার সঙ্গে আরেকটা লাগলেই বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। চড়চড় ফড়ফড় আওয়াজটা হচ্ছে তখনই।
পিস্তল নামাল কিশোর। হতাশ হয়েছে। বিলি এখানে এসেছিল সন্দেহ নেই। স্পষ্ট প্রমাণ রেখে গেছে। এখন কোথায়?
*
হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের অন্ধকার করিডর ধরে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে চলেছে বিলি। ভাল বলতে আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। ওর নিজেরই মনে হচ্ছে বহুদূরে কোথাও ফেলে এসেছে সেসব। কিন্তু তাই নিয়ে কোন আফসোস নেই ওর। একটা চিন্তাই রয়েছে তার মন জুড়ে। একটা চেহারা। মিলি হাওয়ার্ড!
শিরায় বইছে প্রচুর পরিমাণে অ্যাড্রেনালিন। অতি সতর্ক করে তুলেছে তাকে। অতিরিক্ত সচেতন। অনুভব করছে বৈদ্যুতিক-জ্যোতি ঘিরে ফেলছে তাকে, অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মত। দেয়ালের ভেতরের বৈদ্যুতিক তারগুলোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে। পুঁয়াপোকা যেমন নিজের শরীরকে খোলসে আবদ্ধ করে ফেলে, ভয়ের উৎপত্তি হয় যেখান থেকে মগজের সেই অংশটাকে তেমনি ভাবে বন্ধ করে দিয়ে জোসেফ হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে এগিয়ে চলল সে।
দরজা খুলল। পর্দা সরাল।
বিছানা আছে। তাতে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে মিস্টার হাওয়ার্ডকে। কিন্তু মিলি কই?
মিলি! ডাক দিল সে। কোথায় তুমি?
পেছন থেকে কঠোর স্বরে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, নোড়ো না, বিলি! আমি রবিন বলছি! আমার হাতে পিস্তল আছে!
ঘুরে তাকাল বিলি। অন্ধকারে একটা পর্দার আড়ালে মানুষ আছে, অস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। পর্দার একটা জায়গা উঁচু হয়ে আছে। পিস্তলের নল দিয়ে ঠেলে রাখলে যেমন হয়।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার অবচেতন মনের গভীরে কোথায়। যেন কে বলে উঠল, ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু পেল না সে। ভয়ের অনুভূতিটাকে ঘিরে ফেলেছে আশ্চর্য এক খোলস। কিংবা কোন ধরনের শক্তি। হতে পারে সেটা চৌম্বক ক্ষেত্র।
অন্ধকার ছায়া থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল মিলি।
গোয়েন্দা কিংবা পিস্তলের কথা মন থেকে বেমালুম উধাও করে দিল বিলি। সেসব আর কোন গুরুত্ব বহন করে না তার কাছে। এখন তার একমাত্র আকর্ষণ মিলি।
এসো, মিলি, হাত বাড়িয়ে ডাকল সে। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।
খবরদার, বিলি, পর্দার আড়াল থেকে ধমকে উঠল রবিন, ওকে ধরবে না!
মিলির সঙ্গে আমার কথা আছে। তাই না মিলি? ভাবছে বিলি, যদি ওর। ক্ষমতা প্রয়োগ করে মিলিকে কাছে টেনে নিয়ে আসা যেত, তাই করত।
যা বলার এখানেই বলো। কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না, আদেশ দিল। রবিন।
মিলির চোখের দিকে তাকাল বিলি। মুখটা রয়েছে ছায়ার মধ্যে। দেখা যায় না কিছু। সে চোখে কিসের খেলা চলছে বুঝতেও পারল না সেজন্যে। তুমি কি আসবে?
বললাম তো, ও তোমার সঙ্গে কোথাও যাবে না, রবিন বলল।
বাধ্য হয়ে আবার পর্দার দিকে ঘুরল বিলি। এত কাছে থেকে মাত্র ছোট্ট একটা ভাবনা দিয়েই শেষ করে দিতে পারে ওকে। চিৎকার করে শাসাল, দেখো, ইচ্ছে করলে এক্ষুণি তোমাকে খতম করে দিতে পারি আমি!
আমিও তোমার মাথায় গুলি করতে পারি। কাপড়ের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে। বরফের মত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রবিন, তোমাকে তিন সেকেন্ড সময় দিচ্ছি বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।…এক…
অনেক হয়েছে। চিৎকার করে উঠল বিলি। অনেক সহ্য করেছি তোমাদের জ্বালাতন! গোয়েন্দা বলে এতদিন বজ্র ছুঁড়ে মারিনি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই পারি সেটা, বিশ্বাস করো।
দুই! গুণল রবিন।
ঠিক এই সময় বিলির সামনে চলে এল মিলি। বাধা হয়ে দাঁড়াল দুজনের সামনে।
অবাক হলো না বিলি। যেন জানত, মিলি আসবে।
থামো, রবিন! পর্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মিলি। আর একটা কথাও বোলো না!
বলেই বিলির দিকে ঘুরল সে। এখন ওর চোখ দেখতে পাচ্ছে বিলি। পানি টলমল করছে সেচোখে। দেখে তার নিজের চোখেও পানি চলে এল। এই তো চেয়েছিল সে। একজনের দুঃখে আরেকজন কাঁদবে। কষ্ট পাবে। অবশেষে তাকে বুঝতে পারল মিলি। বুঝল, সে ওকে কতটা চায়।
তারপর শুনতে পেল সেই কথাটা, যেটা শোনার জন্যে গত কয়েকটা মাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে সে।
মিলি বলল, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে যাব। যেখানে যেতে বলো, সেখানেই যাব। কিন্তু কারও কোন ক্ষতি কোরো না, প্লীজ!
করব না, কথা দিল বিলি। তুমি যা বলবে তাই করব আমি, মিলি।
মনে হতে লাগল ওর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এটা।
কিন্তু বাদ সাধল রবিন। বলল, যা বলার এখানেই বলো, আমাদের। সামনে। এখান থেকে মিলিকে বেরোতে দেব না আমরা। আমি একা নই। মুসা আর কিশোরও আছে আমার সঙ্গে। যত শক্তিশালীই হও, তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না তুমি, বিলি।
জ্বলে উঠল বিলির চোখ। ভাবল, গাধাগুলো জানে না আমার শক্তির খবর। তিনজনকে মুহূর্তে ধোয়া বানিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি কল্পনাও করতে পারছে না।
তাড়াতাড়ি বিলির আরও কাছে চলে এল মিলি। মাথা নেড়ে চিৎকার করে উঠল, না না, বিলি! চলো, আমি তোমার সঙ্গে যাব। ওদের কথা শুনব না।
ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল বিলি। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল মনে হলো মিলির শরীরে। হাসল বিলি। লজ্জা পাওয়া শিশুর হাসি। চলো। এসো।
মিলির কোমর জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে দরজার দিকে পিছাতে শুরু করল বিলি। চোখ রবিনের দিকে। গুলি করে কিনা দেখছে। নিরাপদেই। বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। লাগিয়ে দিল দরজাটা। তারপর নবের দিকে তাকিয়ে একটা মনো-বাণ ছাড়ল। মুহূর্তে গলে গেল ধাতু। বিকৃত, অকেজো হয়ে গেল তালাটা।
কেবিনের মধ্যে আটকা পড়ল রবিন। বিলি দরজা লাগিয়ে দিতেই পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ডান হাতের তর্জনীর দিকে তাকাল একবার। যেটা পর্দায় ঠেসে ধরে পিস্তলের নল বুঝিয়ে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিলিকে।
দরজার নবের অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। মোচড় দিয়ে খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করল একবার। বুঝল, হবে না। এগিয়ে গিয়ে টিপে ধরল একটা বোতাম। ইমার্জেন্সি বাটন। টিপলেই তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসবে নার্স।
.
১৫.
বাইরে পার্কিং লটের বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। তাজা। পরিষ্কার। যেন মুক্তির গন্ধ মিশে রয়েছে তাতে। হঠাৎ করেই এই অন্ধকার রাতটা এক ধরনের অদৃশ্য আলোয় ভরে উঠল যেন, অনুভব করল বিলি। আলোটা আলো নয়, এক ধরনের আনন্দ। বিচ্ছুরিত হচ্ছে মিলির কাছ থেকে। ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বুকে কান না লাগিয়েও ডাক্তারের স্টেথো দিয়ে শোনার মত শুনতে পাচ্ছে সে। ওর মগজের পাগল হয়ে ওঠা বিদ্যুৎ-তরঙ্গও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে।
ও আমাকে ভালবাসে, ভাবল বিলি।
জীবনে তুমিই একমাত্র ভাল ব্যবহার করলে আমার সাথে, মিলিকে বলল সে। নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এতটা উষ্ণ আর কোমল কণ্ঠস্বর যে ওর গলা দিয়েও বেরোতে পারে, ভাবেনি কোনদিন। রাগ চলে গেছে। মানুষ খুনের ঘটনাগুলো যেন এখন দূর অতীতের ধোয়াটে দুঃস্বপ্ন। ওসব ভুলে যেতে চায় সে। ওগুলোর কথা আর মুহূর্তের জন্যেও মনে করতে চায় না।
সেই প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে ক্লাসে দেখা হলো আমার, মনে আছে? জিজ্ঞেস করল বিলি। সবুজ একটা ফুক পরেছিলে তুমি। বড় বড় হলুদ ফুল। কি সুন্দরই না লাগছিল তোমাকে। ছেলেমানুষের মত হেসে উঠল সে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। নামেও কি মিল, দেখছ? মিলি! বিলি!
মিলির হাতটা কাঁপছে, টের পেল বিলি। নিশ্চয় শীতে, ভাবল সে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল মিলি। কোথায় নিয়ে। যাচ্ছ আমাকে?
তাই তো! এই প্রথম মনে পড়ল বিলির, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? কখনও তো ভেবে দেখেনি। একটাই চিন্তা ছিল, কোনমতে মিলিকে হাসিল করা। সেটা করেছে। এখন কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে?
তা তো জানি না, জবাব দিল সে। তুমি যেখানে যেতে চাও, সেখানেই নিয়ে যাব। যে কোন দোকানের ক্যাশ মেশিন থেকে সহজেই টাকা বের করে নিতে পারব আমি। যে কোন গাড়ি জোগাড় করতে পারব। তুমি শুধু মুখ ফুটে বলো একবার।
সামনে একসারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর দিকে হাত তুলে বলল, দেখো। কোনটা পছন্দ? ওই অ্যাকর্ডটা? ম্যাক্সিমা? ঘুরে তাকাল মিলির দিকে। কোনটা পছন্দ?
কিন্তু মোটেও খুশি মনে হলো না মিলিকে।
ওর হাত ছেড়ে দিল বিলি। পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, জাপানী গাড়ি পছন্দ না হলে অন্য দেশ দেখি? টরাসটা কেমন মনে হচ্ছে? কিংবা ওই ফোর্ডটা?
ফোর্ড গাড়িটার দিকে শুধু তাকিয়ে থেকেই ওটার এঞ্জিন চালু করে ফেলল সে। গাড়ির উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোয় চকচক করতে লাগল ভেজা চত্বরটা।
আনমনে মাথা নাড়তে লাগল সে। নাহ, এসব গাড়ি তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। মিলির জন্যে আরও ভাল কিছু চাই। একটা মার্সিডিজ দরকার। কিংবা ফেরারি।
দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এগুলো, নাক কুঁচকে বলল বিলি। চলো অন্য কোনখানে। চলে যাই। ভাল গাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। আপাতত এখান থেকেই কোন একটা নিয়ে কাজ চালানো যাক।
হঠাৎ নতুন একজোড়া হেডলাইটের আলো ঘুরে এসে পড়ল ওদের গায়ে। কয়েক গজ এগিয়ে থেমে গেল গাড়িটা। পুলিশের গাড়ি। লাফ দিয়ে সেটা থেকে নেমে এলেন শেরিফ রবার্টসন। হাসপাতাল থেকেই তাকে ফোন করে দিয়েছে কিশোর।
এটা কোন সমস্যাই নয় বিলির কাছে। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে। শেরিফকে। ভয় পেয়ো না, মিলি। চুপ করে খালি দেখো, লোকটার কি করি আমি।
জবাব না পেয়ে মিলি কোথায় আছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল সে।
কিন্তু মিলি নেই ওর পাশে। প্রাণপণে ছুটছে। দেখতে দেখতে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে চলে গেল অন্যপাশের ঘাসে ঢাকা মাঠে।
না! মিলি! যেয়ো না! চিৎকার করে উঠল বিলি।
ওর স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে দূরে। সইতে পারছে না সে। নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল আবার।
*
অ্যাই বিলি, দাঁড়াও! নড়বে না বলে দিলাম! যেন মানুষ নয়, একটা পাগলা, কুত্তার উদ্দেশে ধমকে উঠলেন শেরিফ।
কিন্তু দাঁড়াল না বিলি। বুনো জানোয়ারের মত ঘুরে দৌড় মারুল। নজর অনেক সামনে। পলকের জন্যে দেখল একটা ঝোপ পার হয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ছে মিলি।
কোথায় যাচ্ছে, নিজেও জানে না মিলি। একটাই চিন্তা, ওই দানবটার। কাছ থেকে সরে যেতে হবে যত দূরে পারা যায়। বাঁচতে হলে ওর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে হবে। অন্ধকার রাত। কুয়াশা পড়ছে। বনের মধ্যে আরও বেশি অন্ধকার। এখানে হয়তো ওকে দেখতে পাবে না বিলি। কিন্তু বলা যায় না কিছু। দেখার অলৌকিক চোখও থাকতে পারে ওর, কে জানে!
ঠিক এই সময় ঝোপের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে এসে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি। ওকে জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাচ্ছিল মিলি। মুখ চেপে ধরল। সাড়াশির মত কঠিন আঙুল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ওকে ঘন ঝোপের মধ্যে।
কোনমতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মিলি। ভেবেছিল বিলির জলন্ত চোখে চোখ পড়বে। কিন্তু তার বদলে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ফুটতে দেখল আকাশের পটভূমিতে। চুলগুলো যেন কেমন। চেহারার কিছুই বোঝা গেল না। দানবের হাত থেকে ভূতের খপ্পরে এসে পড়ল নাকি!
ফিসফিস করে বলল ভূতটা, ভয় পেয়ো না, মিলি! আমি মুসা। একদম চুপ করে থাকবে। টু শব্দ কোরো না। কাছাকাছিই আছে ও।
ঝোপের মধ্যে মিলিকে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল মুসা। মাঠ পেরিয়ে আসতে দেখল বিলিকে।
ওকে আর রবিনকে কেবিনে পাহারায় রেখে কিশোর চলে যাওয়ার পর মুসা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বাইরে। অন্ধকার ছায়ায় গা মিশিয়ে বিলির আসার অপেক্ষা করছিল। রবিন ভেতরে, সে বাইরে, দুজন দুই জায়গায় থেকে পাহারা দিচ্ছিল।
বিলি যখন মিলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, নিঃশব্দে পিছু নিয়েছিল ওর। ওকে পরাস্ত করার জন্যে সুযোগ খুজছিল। কোন উপায় দেখেনি। যে লোক শুধুমাত্র ইচ্ছা-শক্তির সাহায্যে একজন মানুষকে মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারে, তার সঙ্গে সামনাসামনি লাগতে যাওয়া চরম বোকামি। সেই বোকামি করেনি মুসা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
মিলি যখন বিলির কাছ থেকে সরে যেতে শুরু করল, ওকে সাহায্য করার জন্যে পিছে পিছে ছুটল মূসা। অবশ্যই গাছপালা আর ঝোপের আড়ালে থেকেছে। সাবধান ছিল, বিলির চোখে যাতে না পড়ে…
মিলি! মিলি! ডাকছে আর শিশুর মত ফোপাচ্ছে বিলি। কোথায় তুমি? সাড়া দাও। প্লীজ। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। মাথায় তুলে রাখব। মিলি! মিলি!
আরও কাছে চলে এল সে। কাঁদতে লাগল।
কিন্তু তাকে শান্ত করার জন্যে ঝোপ থেকে বেরোল না মিলি। ওই দানবের সামনে যেতে চায় না আর। ওর কাছে গেলে ওর কথা মানতে হবে। সেটা মানা সম্ভব নয় মিলির পক্ষে। না মানলে ধৈর্য হারিয়ে এক সময় না এক সময় রেগে উঠবে বিলি। মায়াদয়ার বালাই না রেখে তখন ধ্বংস করে দেবে ওকেও।
কি চাই তোমার, মিলি? কাঁদতে কাঁদতে বলছে বিলি। যা চাও তাই দেব! সব দেয়ার ক্ষমতা আছে আমার।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে জ্বলে উঠল একটা আলোক রশ্মি। টর্চ। কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলেন শেরিফ, অ্যাই, ঘোরো এদিকে! তোমার কি হয়েছে জানি না আমি। তবে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাই।
আমি কোন প্রশ্নের জবাব দেব না! চিৎকার করে বলল বিলি। বরং আমার কথার জবাব চাই। ও কোথায়? মিলি কোথায়?
গাছের মাথা কাঁপিয়ে দিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল একঝলক ঝোড়ো বাতাস।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল বিলি, জবাব দিচ্ছ না কেন আমার কথার? কোথায় আছে ও? খুঁজে বের করো! জলদি!
মেঘ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো।
কিশোর এসে দাঁড়াল শেরিফের পাশে। হাতে উদ্যত পিস্তল। ফিসফিস করে বলল, কোন কিছু করতে যাবেন না এখন, শেরিফ। চোখের পলকে মেরে ফেলবে আপনাকে ও।
কিন্তু রোখ চেপে গেছে শেরিফের। ওর শয়তানির নিকুচি করি আমি। তুমি সরো!
ওদের কারও দিকেই আর নজর নেই এখন বিলির। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেই চলেছে। মেঘের কাছে, বাতাসের কাছে, বিদ্যুতের কাছে ওর প্রশ্নের জবাব চাইছে। বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করছে–মিলি কোথায়? মিলি কোথায়? মিলি কোথায়?
রাগে হাত মুঠো করে ওপর দিকে তুলে আঁকাতে লাগল সে। কিন্তু মেঘ ওর প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। ক্রমেই রেগে যাচ্ছে বিলি। আক্রোশ গিয়ে পড়ল বনের ওপর। ওই গাছই মিলিকে আড়াল করে রেখেছে।
মনকে আদেশ দিল সে। ভয়াবহ বজ্র-বাণ ছুটে গিয়ে আঘাত হানল একটা গাছের মাথাকে। গ্রেনেড ফাটার মত বিস্ফোরণ ঘটল যেন। আগুন লেগে গেল গাছের মাথায়। কয়েকটা ডাল ফেটে চৌচির হয়ে গোড়া ভেঙে ঝুপঝুপ করে পড়ল মাটিতে।
আরেকটা গাছের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল বিলি। তারপর আরেকটা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করতে লাগল। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন।
ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশও যেন খেপে উঠতে লাগল। ফুলে উঠল মেঘ। বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল ঘনঘন। বিকট শব্দে বাজ পড়ল।
মহা খেপা খেপেছে যেন আজ দুই দানব। একজন মাটিতে। আরেকজন আকাশে। দুটোতে মিলে প্রলয় কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। তছনছ করে দেবে। বেচারা হিলটাউন শহরটাকে।
তাজ্জব হয়ে এই কাণ্ড দেখছেন শেরিফ। কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে দেয়া যায় না এসব। মহাক্ষতি করে দেবে তাহলে বিলি। পিস্তল তুলে আচমকা গর্জে উঠলেন, বিলি, থামো! থামো বলছি! নইলে গুলি করব বলে দিলাম!
ফিরে তাকাল বিলি। বিদ্যুতের আলোয় বাঘের চোখের মত জ্বলছে ওর। দুই চোখ।
পিস্তল হাতে এগিয়ে গেলেন শেরিফ। বিলিকে হাতকড়া পরানোর ইচ্ছে।
কিন্তু তার সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। হঠাৎ গুঙিয়ে উঠে বুক চেপে ধরলেন। পিস্তলটা পড়ে গেল হাত থেকে। টলে পড়ে যাচ্ছেন। ধরার জন্যে ছুটে গেল কিশোর।
ঠিক এই সময় বাজ পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বন, পাহাড়, মাটি। চোখের কোণ দিয়ে পলকের জন্যে দেখতে পেল কিশোর, আকাশ থেকে তীব্র নীল একটা আগুনের শিখা ছুটে এসে লাগল বিলির মাথায়।
.
১৬.
লস অ্যাঞ্জেলেস স্টেট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালের চওড়া করিডরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। দরজায় লাগানো অভঙ্গুর কাচের মধ্যে দিয়ে বিলি ফক্সের সেলের ভেতরে তাকাল। ছোট্ট ঘর। টেলিভিশনের দিকে চেয়ে আছে বিলি। ভাবলেশহীন চেহারা। শূন্য দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে অনুষ্ঠান দেখছে না। দেখার মত অবস্থাও নাকি নেই ওর। সেদিনকার সেই বিদ্যুৎ-ঝড় ওর মনকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে। এটা অবশ্য ডাক্তারদের কথা।
কিশোর এই রায় বিশ্বাস করতে রাজি নয়। বিলির মাথায় বাজ পড়তে দেখেছে নিজের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে মরে যাওয়ার কথা ওর। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মরেনি। কয়েক মিনিটের জন্যে অবশ হয়ে গিয়েছিল। হাত-পা। নড়াচড়া করেনি। সেই সুযোগে মাথায় পিস্তলের বাড়ি মেরে ওকে বেহুশ করেছিল মুসা। শেরিফের গাড়ি থেকে দড়ি এনে হাত-পা বেঁধে ফেলেছিল।
হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে রেখে কয়েক ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তাররা তাকে এখানকার হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেটা দুদিন আগের কথা।
আজকে তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। কিন্তু কিশোরের ধারণা, ও ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাইবে না। তবুও এসেছে। যদি বলে।
দেখা করার অনুমতির জন্যে একজন নার্সকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছে কিশোর, এই সময় পায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখে ডক্টর এলিজা আসছে।
কখন এলেন?
এই তো, পনেরো মিনিট।
বিলিকে দেখতে নিশ্চয়?
মাথা ঝাঁকাল এলিজা। এখানে বিলিকে আনার পর থেকেই দিনে কয়েকবার করে এসে তাকে দেখে যাচ্ছে সে। তোমরা?
আমরাও দেখা করতে। অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করছি।
দরজার কাচের ভেতর দিয়ে বিলিকে দেখল এলিজা। আবার কিশোরের দিকে ফিরল। করোনারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। শেরিফ রবার্টসনের মৃত্যুটাকে দুর্ঘটনা বলে রায় দিয়েছেন তিনি।
বজ্রপাতে মৃত্যু?
মাথা ঝাঁকাল এলিজা। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির সঙ্গেও কথা বলেছি। কেসটা কিভাবে সাজাবেন বুঝতে পারছেন না তিনিও।
যে টেস্টগুলো করাতে বলেছিলাম, করিয়েছেন?
করিয়েছি?
কি বুঝলেন?
সব ঠিক আছে। ইলেকট্রোলাইট, ব্লাড গ্যাস লেভেল, ব্রেন ওয়েভ…সব আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।
অস্বাভাবিক কোন কিছু নেই শরীরে? কিছুই না?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল এলিজা। কি করে এটা আন্দাজ করেছিলে, বলো তো?
করাটাই স্বাভাবিক…এরকম অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী সচরাচর হয় না কোন মানুষ। বিদ্যুৎ হজম করতে পারে কেউ কেউ, কিন্তু পাচার করতে পারে। বলে শুনিনি কখনও।
দ্বিধা করতে লাগল এলিজা। অকারণে কেশে গলা পরিষ্কার করল। তারপর বলল, ডাক্তারি শাস্ত্রে এটা বিস্ময়কর এক ঘটনা। মানুষের দেহযন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা! যে যন্ত্র দিয়ে কাজটা করেছে বিলি, সেটা দেখতে অনেকটা বৈদ্যুতিক বান মাছের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রের মত। জন্ম থেকেই হয়তো ছিল ওটা ওর শরীরে। জন্মের সময় খুব ছোট ছিল, অক্ষম, ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বজ্রপাতের পর কোনভাবে চার্জ হয়ে গেছে ওটা।…প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়াল! ওকে নিয়ে ভালমত গবেষণা করা দরকার।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। বিলির দিকে তাকাল। ডাক্তাররা যতই বলুক সব ধুয়ে মুছে গেছে, বিলির ক্ষমতা কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি।
ভুরু কোঁচকাল এলিজা। কি করে বুঝলে?
টেলিভিশনের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
ঘুরে গেল তিন জোড়া চোখ।
একের পর এক চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে টেলিভিশনের।
এলিজা বলল, কিছু তো বুঝতে পারছি না।
চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা দেখছেন?
হ্যাঁ, কিন্তু এতে
কি দিয়ে বদলাচ্ছে ও? রিমোট তো হাতে নেই।
এতক্ষণে মুসা আর রবিনও লক্ষ করল, রিমোটটা টেলিভিশনের ওপরেই ফেলে রাখা হয়েছে। বেশ খানিকটা দূরে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল এলিজার। ঠিক থাকাটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওর এই ক্ষমতা নষ্ট না করে না দিলে তো আবার শুরু করবে শয়তানি।
দেখুন চেষ্টা করে, পারেন কিনা? তাহলে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে যাবে বিলি।
যা-ই বলো, ওর সঙ্গে তোমাদের দেখা করতে যাওয়া উচিত হবে না মোটেও! তোমরা ওর এক নম্বর শত্রু। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কখন কি করে, বসে…
ফিরে এল নার্স। যাকে অনুমতির জন্যে পাঠিয়েছিল কিশোর।
অনুমতি পাওয়া যায়নি। ওদের দেখলে খেপে উঠতে পারে বিলি, ডাক্তারেরও এটাই ধারণা।
এলিজা বলল, আমি ইচ্ছে করলে অনুমতি এনে দিতে পারি। কিন্তু, আবারও বলছি, উচিত হবে না।
দরজার বাইরে থেকেই বিলির সঙ্গে কথা বলার শেষ চেষ্টা করল কিশোর। চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল।
সাড়া দিল না বিলি। মুখও তুলল না। একভাবে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। কিশোর ডাকাডাকি শুরু করলে একটা পরিবর্তনই শুধু ঘটল, টেলিভিশনের চ্যানেল বদলানো বন্ধ হয়ে গেল।
দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, হবে না। কথা বলবে না ও। চলো, যাই। আর কিছু করার নেই আমাদের এখানে।
*
একটা কথা বুঝতে পারছি না, মুসা বলল। বাসে করে রকি বীচে ফিরছে ওরা। ছোঁয়া না লাগিয়েই বিদ্যুৎ পাচার করে কিভাবে বিলি?
প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি। কিংবা টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু। টেলিপ্যাথিকে একধরনের রিমোট কন্ট্রোল সিসটেম বলতে পারো। দেখা যাক, বেঁচে যখন আছে ও, গবেষণাতেই বেরিয়ে পড়বে।
ওর ব্যাপারটাকে টেলিপ্যাথি নাম দিলে ভুল হবে, রবিন বলল, টেলিভোলটেজ হলে কেমন হয়?
মন্দ না।