১১.

খ্রীষ্টালয় থেকে সদ্যাগত–ফ্রেশ ফ্রম ক্রিষ্টিয়ান হোম-ওলাদের এদেশে এসে বায়নাক্কার অন্ত থাকে না। এটা নেই, ওটা চাই, সেটা কোথায়-সুবো-শাম লেগেই আছে। তবু যত বর উন্নাসিকই হোক না কেন, পুলিস সায়েবের বাঙলোটি কিছুমাত্র ফেলনা নয়।

ডিনার খেয়ে দুজনাই এসে বসেছিল চওড়া বারন্দায়। বস্তুত এ বারান্দাটাই বাড়ির সবচেয়ে আরামের জায়গা। ও-রেলি চলে যাওয়ার পর ডীন বেয়ারাকে দিয়ে সিগারেটের তাজা টী খুলে আরাম করে গা এলিয়ে বসল। লণ্ডন ছেড়েছে অবধি জাহাজে ট্রনে সর্বত্র হৈ হুল্লোড়ের ভিতর দিয়ে তার সময় কেটেছে, দুদণ্ড নিজের মনে নূতন নূতন অভিজ্ঞতার জমা-খরচ মিলিয়ে নিতে পারেনি-অথচ গুণীরাই জানেন যারা কথা কয় বিস্তর তারাই নির্জনতা খোঁজে শান্তজনের চেয়ে বেশী।

পেট্রোমান্স জ্বলছে। তার আলো বারান্দার বাইরের অন্ধকার কিন্তু ফুটো করতে পারছে না। এদিকে আবার বর্ষার গুমোট। আকাশ থমথম করছে। গাছগুলো অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া পর্যন্ত ডাইনে বাঁয়ে, উপরে নীচে কোনো দিকে যেতে চায় না। এ অবস্থায় মুখের ধোয়া দিয়ে খাসা রিং বানানো যায়। মুখ থেকে বেরিয়েই রিংগুলো একটার পিছনে আরেকটা সারি বেঁধে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে। থাকে। তখন সিগারেট খেকোরা আর সিগারেটের নেশা করে না। রিঙের নেশায় পিলপিল করে চক্করের পুর চক্কর বের করতে থাকে।

ব্যাচেলাররা দেরিতে শুতে যায়, এ-কথা সাবই জানে, আর তামাক-খোররা যায়। আরো দেরিতে। আরেকটা খেয়েই উঠছি, আরেকটা খেয়েই উঠব’ করে করে ঘুমে সিগারেটে যখন লড়াই বেশ জমে ওঠে তখন অনেক সময় রেফরি লড়াইয়ে ক্ষান্ত দিয়ে ঘুমের শরণ নেয়, সিগারেটও চটে গিয়ে কার্পেট মশারি পোড়ায়।

ভীনের চোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, ডান হাত চেয়ারের হাত থেকে খসে ঝুলে পড়ছে, টিলে আঙুল থেকে সিগারেটটা খসি-খসি করছে, এমন সময়–

এমন সময় ভীন দেখে তিনটি প্রাণী-মূর্তী কী বলি?-বেডরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় নেমে গেল। সে বসে ছিল বারান্দার এক প্রান্তে, বেডরুম অন্য প্রান্তে-সিঁড়ি তারই গা ঘেঁষে।

ভীনের চোখে কাঁচা ঘুমের ছানি। তার ভিতর দিয়ে সবকিছু যেন অবছা-আবছা, যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখা দিল, কিংবা যেন, সিনেমার পর্দায় দিলে ফোকাসের ছবি।

তিনটি মূর্তির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার পূর্বেই তারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। ভীন শুধু দেখলে প্রথমটি দৈর্ঘ্যে মাঝারি, দ্বিতীয়টি ছোট এবং তৃতীয় টি বেশ লম্বা ব্যস আর কিছু না।

সম্বিতে ফিরে ডীন ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নামল। চর্তুদিকে ঘোরঘুটি অন্ধকার, নিচের তলায় ছাতা ল্যাম্প বেরায়া অনেকক্ষণ হ’ল নিবিয়ে দিয়েছে,উপরের তালার আলো সেখানে পৌঁছায় না। ডীন সদ্য বিলেত থেকে এসেছে- মফঃস্বলে টর্চের কী প্রয়োজন এখনো জানতে পারেনি। তার টর্চ নেই। ছুটে গেল গেটের কাছে; সেখানে রাস্তার ক্ষীণ আলোতে দেখলে, চর্তুদিক জনমানবশূন্য।

সাপ, চোর, শেয়াল দেখলে আমরা চীৎকার করে চাকর-বাকরদের ডাকি, কারণ আপন দেহ রক্ষার জন্য এদের উপর আমরা নির্ভর করেছি যুগ-যুগ ধরে। বিলেতের লোক কাজকর্ম চালাচ্ছেন বিন চাকরে বহুকাল ধরে। তাই সম্বিতে ফিরেও ডীন চেঁচামেচি আরম্ভ করলে না। ধীরে ধীরে বারান্দায় ফিরে আবার চেয়ারে বসল।

আকাশ-কুসুম কেউ কখনো দেখেনি সে শুদ্ধ কল্পনামাত্র। স্বপ্ন আমরা দেখি, কিন্তু তার পিছনে কোনো বাস্তবতা নেই। রুজু দেখে যখন সর্পভ্রম হয় তখন সে সর্প বাস্তব নয় বটে, কিন্তু ভ্রম কেটে যাবার পরও রুজুটিকে ধরতে-ছুঁতে পাই। ডীন যা দেখল সেটা এর কোনো পর্যায়েই পড়ে না। তাহলে কি সে বাস্তব জিনিস প্রত্যক্ষ করল? তাই বা কী করে হয়? বেডরুমে তো কারো থাকার কথা নয়-ডিনার শেষ হওয়ার পর চাকররা চলে গিয়েছিল, ও-রেলি যাওয়ার পর উপরের তলায় তো সে একেবারে একা বসে ছিল। তবে কি ওরা মেথরের দরজা দিয়ে বাথরুম বেডরুম হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল? ডীন চেক-আপ করে দেখলে মেথরের দরজা ডবল বল্টে বন্ধ।

তবে কি মদ্যপান? অসম্ভব। খেয়েছে মাত্র ছোট দু পেগ-তাও ডিনারের আগে। দু পেগে বঙ্গ-সন্তানেরই চিত্তচাঞ্চল্য হয় না-ও দিয়ে তো ইংরেজ কপালে তিলক কাটে।

ছুটোছুটি আর উত্তেজনায় ডীনের ঘুম ততক্ষণে ক্ষীন নয় লীন হয়ে গিয়েছে। বিছানায় ছটফট না করার চেয়ে বরঞ্চ চেয়ারে বসে প্রতীক্ষা করাই ভালো, যারা গেছে তারা ফিরে আসে কি না। পুলিসের লোক- প্রথম সম্বিতে ফেরা মাত্রই সে ঘড়ি দেখে নিয়েছিল। এরা বেরিয়েছিল ১২টা ৩০ এবং ৩৫-এর মাঝামাঝি। যদি তারা নিতান্তই ফেরে তবে তো ফিরবে ভোরের আলো ফোঁটাবার আগেই। ডীন পিস্তলটা সুটকেশ থেকে বের করে পেগ টেবিলের উপর রেখে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।

ঘণ্টা চারেক সিগারেট পোড়ানোর পর লুপ্ত ঘুম ফিরে এল কিন্তু যাদের জন্য এত অপেক্ষা তারা আর এল না।

সকাল বেলা বেয়ারা বেড-টী এনে দেখে সায়েব চেয়ারের উপরে বেঘোর ঘুমে কাতর। শেষ সিগারেট হাত থেকে পড়ে গিয়ে পেগ টেবিলের বার্নিস পুড়িয়ে দিয়েছে।

আরো একটু ক্ষতি হ’ল ভীনের। সেদিনই আণ্ডাঘরের বেয়ারা-মহলে রটে গেল, নুতন সায়েব বোতলবাসী-পিয়সী। কেউ প্রশ্ন পর্যন্ত করল না, যে বেয়ারা চা এনেছিল সে বোতল খালি পেয়েছিল না ভর্তি।

.

সকাল হতে না হতেই ভিজিটারদের ঠ্যাল্যা। তাদের সঙ্গে লৌকিকতা করতে করতে ডীন ভাবছে আগের রাত্রের কথা। দিনের আলো প্রখর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের কাছে রাত্রের প্রহেলিকা হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়াল। স্বপ্নের ঘোরে কিংবা ঘুমের জড়তায় কী দেখতে কী দেখেছে তাই নিয়ে সে ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করলে-ইস্তেক পিস্তল বের করলে। কী আশ্চর্য! এদেশে একটানা বিশ বছর কাটানোর পর অসহ্য গরম আর সুদীর্ঘ বর্ষার ঠ্যালায় ইংরেজদের মাথায় ছিট জন্মায়-দেশে ফিরে গিয়ে তার ধকল কাটায় পুডিং দিয়ে খানা আরম্ভ করে আর সুপ দিয়ে শেষ করে। তাদেরই একজন, ভীনের এক মামাকে নিয়ে সে কতই না ঠাট্টামশকরা করেছে,আর বেচারী মামা কিছু না বলতে পেড়ে শুধু হম হম করেছে। আর তার নিজের সেই অবস্থা এই প্রথম রাত্রেই। পিস্তল ও চায় স্বপ্নের পেট ফুটো করতে? তার হ’ল কী?

এমন সময় সোম এসে খবর দিলে, কাল রাত্রে তের-সতীতে জলে ডাকাতির খবর এসেছে। বোধ হয় গোটা তিনেক খুনও হয়েছে। সে অকুস্থানে যাচ্ছে।

ইংরেজের বাচ্চা নিজেকে এতক্ষনে সংযত করতে শিখেছে। কোনো চাঞ্চল্য না। দেখিয়ে শুধালেন রাত কটায় কাণ্ডটা ঘটেছে? কী জানি, ঠিক বলা যাচ্ছে না দুপুর কিংবা শেষ রাতে।

সোম চলে গেল।

টু হেল–অর্থাৎ চুলোয় যাগগে বলে ডীন মধুগঞ্জের ম্যাপ মেলে গেজেটিয়ার খুলে পড়তে বসল।

কিন্তু চুলোয় যাগগে বললেই যদি সব আপদ চুলোয় যেত তাহলে গোটা পৃথিবীটাকেই হামেহাল নরককুণ্ডের মতো জ্বালিয়ে রাখতে হত। সন্ধ্যে হতে না হতেই দিনের বেলার হেসে উড়িয়ে দেওয়া আপদ ভীনের মনের ভিতর কিন্তু কিন্তু করে ইতি-উতি করতে লাগল। ডিনারে বসে মনে হ’ল কাল রাত্রের ঘটনা স্বপ্ন নয়,মায়া নয়, মতিভ্রম নয় ইংরিজিতে ভাবতে গেলে ইলুশন, ডিলুশন, হ্যাঁলুসিনেশন কিছুই নয়। প্রেসটিভিজিটেশনও নয় কারণ ঐ রাত সাড়ে চব্বিশটার সময় তাকে ম্যাজিক দেখিয়ে বোকা বানাতে যাবে কোন ভাড়?

বাগানে আম-জাম-লিচুর অন্ধকার ক্রমেই যেন বারান্দার দিকে গুঁড়িগুড়ি এগিয়ে আসছে। প্রতিপদ আকাশের মেঘময় অন্ধকার নেবে আসছে নিচের দিকে, দুই অন্ধকারের ভিতর কি যেন গোপন যোগসাজস রয়েছে।

সেই নিরেট জমে-ওঠা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে গাছপালার মধ্যে সূক্ষ্ম–অতি সুক্ষ্ম ছিদ্র করে কাজলধারার উপরদিয়ে-বেয়ে যাওয়া নৌকার ক্ষীণ প্রদীপের আলোক মাঝে মাঝে এসে পৌঁছচ্ছে বাংলোর দিকে। কিন্তু সে আলোক চোখে পড়ে ঐ দিকে অনেকক্ষণ ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে। সে আলো তখন যেন চোখকে আরো কানা করে দেয়। চতুর্দিকের অন্ধকার যে কতখানি পুঞ্জীভূত নীরদ্ধ তখনই ঠিক ঠিক বোঝা যায়।

অন্ধকারে মানুষ যেমন নিজকে সাহস দেবার জন্য শিশ দেয়, পেট্রোমাক্সটাও ঠিক তেমনি মৃদু একটানা শ-শব্দ করে যাচ্ছে আর ভয়ে মরছে হঠাৎ কখন অজানাতে অন্ধকার তার লম্বা আঙুল দিয়ে বাতির চাবিতে দম দিয়ে তার দম বন্ধ করে দেবে।

ভীন চাকর বাকরকে বিদেয় দিয়ে পিস্তল কোলে নিয়ে বসেছে সিঁড়ির দিকে মুখ করে। টিপয়ের উপর রিস্টওয়াচ।

রাত ঘনিয়ে এল। আগের রাত্রে ভোরের দিকে চোখের দু পাতা জুড়েছিল মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, দিন কেটেছে নানা কাজের ঠেলায় এখন বারে বারে ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু আজ তো সর্বচৈতন্য কোলম্যান মাস্টার্ডের মতো তীক্ষ্ণ সজাগ রাখতে হবে। সে আজ আদৌ মদ খায়নি, জাস্ট টু বি অন ১০০% সেফ সাইড।

ঘড়িতে বারোটা বেজেছে। ডীন ভাবলে এবারে আরো সজাগ হতে হবে। রুমালটা ভিজিয়ে এনে চোখে বোলাবার জন্য এদিক ওদিক খুঁজছে এমন সময় হঠাৎ দেখে সেই ত্রিমূর্তি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। ডীন মন স্থির করে রেখেছিল দেখামাত্র পিস্তল হাতে ছুটে গিয়ে ওদের ঠ্যাকাবে কিন্তু কাজের বেলায় এক মুহূর্ত দেরী হয়ে গেল ছুটে গিয়ে যখন নিচের বারান্দায় নামল তখন ত্রিমুর্তি বাগানের বড় জামগাছটার কাছে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে দেখে তখনো বারোটা-অর্থাৎ সকালে দম দেওয়া হয়নি।

এবারে ভীন ছুটোছুটি করলে না। মাই গড বলে চাপরাশীর টুলে বসে পড়ল-ভীষণ বিপাকে না পড়লে ইংরেজ মাই গড়’ বলে না।

অনেকক্ষণ পর সে বেডরুমে ঢুকল। ক্লান্তিতে নিদ্রা-জাগরণে মেশা আসৃপ্তির ভিতর দিয়ে রাত কাটল।

সকাল বেলা সোম এল।

তিনটে নয়, দুটো খুন।

সেদিকে খেয়াল না করে ডীন শুধালেন, সোম, এ বাড়ি ভূতরে?

সোম বললে, জানি নে স্যার।

তুমি ভূত মান?

নো, স্যার।

তাহলে এ বাড়ি কিংবা যে কোনো বাড়ি ভূতরে হয় কী করে?

জানি নে স্যার।

ডীন বলতে যাচ্ছিল, তুমি একটা গবেট, আর তোমার প্যারা বস একটা আস্ত গাড়ল না হলে তোমাকে শার্লক হোমসের মতো ঠাওরালে কেন? ঠিকই তো, বোকাকে বুদ্ধিমান মনে করা, এ যেন গাধা দেখে বলা এটা ঘোড়া। যে একথা বলে সে শুধু গাধা চেনে না তা নয়, ঘোড়াও চেনে না।

তারপর ডীন আরো পাকাপাকিভাবে আটঘাট বেঁধে ত্রিমূর্তির জন্য ত্রিরাত্রি অপেক্ষা করল, কিন্তু তাকে নিরাশ হতে হ’ল।

সপ্তাহের শেষে আই জি-কে রিপোর্ট লেখার সময় ডীন এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে লিখব কি লিখবনা করে করে কী করে যে লিখে ফেললে নিজেই বুঝতে পারলে না। ভাবলে ওটা কেটে ফেলি-সে বিলক্ষণ জানত, ইংরেজ এ সব কেচ্ছা নিয়ে নির্মম হাসাহাসি করে কিন্তু তাহলে আবার নুতন করে রিপোর্ট লিখতে হয়, আর লেখালেখির ব্যাপারেই পুলিশ বাবাজীরা হামেশাই একটুখানি কাহিল।

যাগকে বলে শেষটায় পয়লা পাঠই পাঠিয়ে দিলে।

তিন দিন বাদে উত্তর এল। তার শেষ ছত্র, ড্রিক লেস স্পিরিট।

ভীন খাঙ্গা হয়ে বললে, ড্যাম দি স্পিরিট।

.

১২.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয় করে ইংরেজ সগর্বে তার ইতিহাস রচনা করেছে। যুদ্ধে হেরে জর্মন সলজ্জ ইতিহাস লিখেছে। দুটোর কোনোটা থেকেই প্রকৃত সত্য জানবার উপায় নেই। তাই মনে হয়, ইংরেজের ইতিহাসটা যদি জর্মন লিখতে এবং জর্মনেরটা ইংরেজ তাহলেও হয়ত খানিকটে সত্যের কাছে যাবার উপায় থাকত। কিংবা যদি ভারতবাসী লিখত কারণ সে যে এ বাবদে অনেকখানি নিরক্ষেপ সে কথা অস্বীকার করা যায় না।

তাই চা বাগানের আশেপাশের, বিশেষ করে মধুগঞ্জের লোক বিলক্ষণ জানে ইংরেজ তার শৌর্যবীর্য নিয়ে যতই লম্ফঝম্ফ করুক না কেন চা-বাগিচার সায়েবদের ভিতর লেগে গিয়েছিল ধুন্ধুমার। তার ইতিহাস লেখা হয়নি, কোনো কালে হবেও না।

হাতিম-তাই না সিন্দাবাদ কোন এক দেশে গিয়েছিলেন যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে বুড়ো হয়ে কিংবা অসুখ-বিসুখ করে মরে না। প্রতি সন্ধ্যেয় সবাই এক জায়গায় ম্লান মুখে বসে কিসের যেন অপেক্ষা করে,আর হঠাৎ এক গম্ভীর ডাক শুনে ওদের একজন লাফ দিয়ে উঠে দূর দিগন্তে পালিয়ে যায়, কেউ তার পিছু নেয় না, সেও আর কোনো দিন ফিরে আসে না।

চা বাগিচার বড় মেজো ছোট বেবাক সায়েব রোজ সন্ধ্যেয় ক্লাবে বসে প্রতীক্ষা করেন,লড়াইয়ে যাবার জন্য বিলেত থেকে কোন দিন কার ডাক পড়ে। এবং কাজের বেলা দেখা গেল হাতিম-তাই-এর গল্পের লোকগুলোর মত এরা পত্রপাঠ বিলেতের দিকে ছুট দেন না- এদের অনেকেই আছেন ডাক এড়াবার তালে।

সিভিল সার্জেন ইংরেজ তার উপর কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, সাটিফিকেট পাওয়া অসম্ভব, কাজেই এদের উর্বর মস্তিষ্ক তখন লেগে যায় নূতন নূতন ফন্দি ফিকিরের অনুসন্ধানে। এক ভীত তো সাহস করে বাঁ হাতের কব্জিতে গুলি মেরে সেটাকে জখম করে লড়াই এড়ালে। মাদামপুর বিষ্ণুছড়া নিজেদের ভিতর লজ্জায় মাথা হেঁট করলেন।

তারই মাঝখানে কে যেন খবর এনে দিল ও-রেলি লড়ায়ে যাবার জন্য নিজের থেকে প্রস্তাব পেড়েছিল, কিন্তু ভারত সরকার রংরুটের অসুবিধা হবে তাকে যেতে দিল না, কারণ সে ইতিমধ্যেই জনপঞ্চাশেক বাঙালী ছোকরাকে করেছে এবং তার ভিতর গোটা পাঁচেক টেরেরিস্টও আছে।

ও-রেলি সম্বন্ধে আর সব কথা ক্লাব এক মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে একবাক্যে বললে, শাবাশ।

পুলিশের ক্লাবে আই জি. এসেছিলেন মধুগঞ্জে টুরে। ক্লাবে বসে ও-রেলির উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি শুনে নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রতি গর্ব অনুভব করলেন। তার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে না বলেই ক্লাবের নয়া-ঝুনা সব সদস্য দফে দফে তার গুণকীর্তন করলেন, এবং বিষ্ণুছড়ার ছোট মেমই বিগলিতা হলেন সবচেয়ে বেশী।

ক্লাব ভাঙল অনেক রাত্রে,পরদিন কাইজারের খড়ের মূর্তি পোড়াবার সুব্যবস্থা করে। বেয়ারারা তাই নিয়ে নিজেদের ভিতর বিস্তর হাসাহাসি করলে। সায়েবদের বড়ফাট্টাই যে কী বেহদ বেশরম ফাবেনে সে-কথা তারা লড়াই লাগাবার কয়েক মাস পরেই টের পেয়ে গিয়েছিল। ওদিকে আবার তাদের যে-সব ভাই-বোনদের সাতজন্মে কখনো লড়াই দেখেনি তারা যেতে আরম্ভ করল ইরাকে। তাই নিয়ে পূর্ব বাঙলায় গান পর্যন্ত রচনা হয়ে গেল। সেপাই ফিরে এসেছে মেসপট থেকে দেশে; বউ জিজ্ঞেস করছে,

মিয়া, গেছলায় যে বসরায়
দেখছনি দালান?
ছোট ছোট সেপাইগুলি লাল কুর্তি গায়
হাঁটু পানিৎ ল্যামা তার
পিস্তত মারা যায়
মিয়া গেছলায় যে বসরায়, মিয়া গে (সোম)।

এ গীতে তবু বরঞ্চ গ্রাম্য মেয়ের সরলতা আর কল্পনাশক্তির খানিকটা বিকাশ পেয়েছে, কিন্তু সায়েবদের ছেলেমানুষি কত চরমে পৌঁছে গিয়েছে তার প্রমাণ বেয়ারাগুলো পেল যেদিন মধুগঞ্জের পাগলা চেঁচিয়ে গান ধরলে,

মরি, রাই, রাই, রাই,
জর্মনিরে ধরে এনে,
হামনি বাজাই।

এ গানের না আছে মাথা না আছে কাঁথা-পাগলা জগাইয়ের গানে কখনো থাকতও না-অথচ সায়েবরা গান শুনে ভাবলেন জগাই জনির কান খুব করে মলে দিচ্ছে। পাগলকে ডেকে এনে ক্লাবে তার নৃত্যসম্বলিত গান শোনা হ’ল, প্রচুর বকশিশ দেওয়া হ’ল, এবং তাকে একটি মেডেল দেওয়া যায় কি না সে সম্বন্ধে আলোচনা হল।

‘বাঙাল’ গাছে ফলে না, বাঙালের চাষ পূর্ব বাঙলার একচেটে নয়, তাই সায়েবদের বাঙালপনা দেখে বাঙাল বেয়ারাগুলো হাসলে জোর একপেট আর পাগলা জগাইকে খেতাব দিলে জঙ্গীলাট।

রাত্রে আই জি’র নিমন্ত্রণ ছিল ভীনের বাংলোয়।

সূপ শেষ হতে না হতেই ডি, এম-এর বাংলো থেকে জরুরী খবর এল স্বদেশীদের আড্ডায় বোমা ফেটে দুজন মারা গিয়েছে-ডীন যেন তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। ডীন তাদের অভিসম্পাত দিতে দিতে খানা ছেড়ে উর্দি চড়ালে।

আই জি, বাঙালা ভাষা বেশ শিখে গিয়েছিলেন। একা খানা খাওয়ার একঘেয়েমি কাটাবার জন্য বাটলারের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। এককালে বড়লোকদের যদি শখ হত ছোট লোকদের সঙ্গে গল্প করার তবে তারা ডেকে পাঠাতেন চন্দ্ৰবৈদ্যকে-মুখচন্দ্রটিকে বিচক্ষণ বৈদ্যের মতো খাফসুরত করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নাপিত হুজুরকে দুনিয়ার নানা খবর নানা গুজব শুনিয়ে ওয়াকিফহাল করে তুলত। বিলেতে এখনো ও কর্মটি করে বাটলার এবং খানদানি সায়েবদের যারাই দেশী ভাষা শিখতে সক্ষম হয়েছেন তারাই এ দেশে সেই রেওয়াজটি চালু রেখেছেন।

সায়েবের মতির গতি ধরতে পেরে খয়রুম্পা আলোচনা আরম্ভ করলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে সায়েব সায় দিলেন, তারপর ভরসা দিলেন লড়াই শিগগিরই খতম হয়ে যাবে-সায়েব শুধু হু বললেন খয়রুল্লা কথার মোড় ফিরিয়ে বললে; দিশী লোক বসরা থেকে বেশ দু পয়সা বাড়িতে পাঠাচ্ছে-সায়েব আনন্দ প্রকাশ করলেন।

থানার শেষ পদ ছিল পনিরে রান্না আস্ত আণ্ডা। বহুকাল ধরে বিলেত থেকে পনির আসছে না বলে বড় সায়েব তাই নিয়ে প্রশংসা ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন। খয়রুল্লা দেমাক করে জানালে এ পনির বিলেতি নয়, এ জিনিস তৈরী হয় মৈমনসিংহের অষ্টগ্রামে। বিদেশী পনির যখন এ-দেশে পাওয়া যেত সেই আমলেই ও-রেলি সায়েবের মেম দিশী পনিরের সন্ধান পেয়ে তাই দিয়ে এই নুতন সেভারি আবিষ্কার করেন। খয়রুলার মতে তার মতো পাকা রাধুনী এদেশে কখনো আসেনি। তখন জয়সুর্যের মেট তার কাছ থেকে সে এ জিনিসটে বানাতে শিখেছে।

বড় সায়েব জানতেন মিসেস ও-রেলি বিলেতে। তবু কথার পিঠে কথা বলার জন্য আপন মনেই যেন শুধালেন, তা মেম সায়েব তো এখন বিলেতে?

খয়রুল একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, বোধ হয় তাই। তবে সঠিক কেউ বলতে পারে না। মীরপুর বাগিচার বেয়ারা বলছিল তিনি মসুরি না সিমলে কোথায় যেন।

এবারে সায়েব একটুখানি আশ্চর্য হলেন। বললেন, সে কী, হে? এই সামান্য খবরটাও সঠিক জান না?

খয়রুল্লার দিলে চোট লাগল। পুলিশ সাহেবেরে বেয়ারা হিসেবে জাতভাইদের ভিতর তার খুশ-নাম ছিল যে, সে দুনিয়ার সকলের নাড়ীনক্ষত্র জানে, তাকে কি না সায়েব স্পষ্ট ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন সে একটা আস্ত উজবুক, দুনিয়ার কোন খবর রাখে না। তার চেয়ে যদি তিনি তাকে খবর দিতেন যে সে এদিকে জানে না, ওদিকে কিন্তু তার বিবি বিধবা হয়ে গিয়েছেন, তা হলেও তার কলিজা এতখানি ঘায়েল হত না। তাই ইজ্জত বাঁচাবার জন্য বললে, সঠিক খবর তো দিতে পারেন শুধু ও-রেলি সায়েবই। তা, তিনি তো কারো সঙ্গে কখনো কথা বলেন না, তাকে শুধাতে যাবে কে?

বড় সায়েব খানদানী ঘরের ছেলে। সায়েব-মেমদের নিয়ে চাকর-নফরের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলতে চান না; আলোচনাটা ওদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে বললেন, ঠিক বলেছ।

খয়রুলাও পেটে আক্কেল ধরে। সায়েব যদি বা কথার মোড় ফেরালেন, সে তার সামনে খাড়া করে দিলে একখানা নিরেট পাচিল।

বললে, সে বহু মেহনত করে ক্লাব থেকে কিঞ্চিৎ উত্তম কফি যোগাড় করে এনেছে,পারকুলেটরে সেটা চড়িয়ে রেখেছে, সায়েব যদি একটু মর্জি করেন?

ডিনার শেষ হলেপর খয়রুলা বললে, সে সায়েবকে সার্কিট হাউসে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য নিচের তলায় অপেক্ষা করবে। কফি লিকার-সিগার তিনটিই উত্তম শ্রেণীর ছিল বলে সায়েব তদণ্ডেই ডেরা ভাঙবার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। জানালেন, তিনি একাই সার্কিট হাউস যেতে পারবেন।

রাত একটার সময় ডীন ফিরে এল। বড় সায়েবকে নিতান্ত একা-একা ডিনার খেতে হ’ল বলে আবার দুঃখ প্রকাশ করলে।

বড় সাহেব সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস ও-রেলি এখন কোথায় তুমি জান?

ভীন হেসে বললে, কেন? আপনিও কিছু শুনেছেন নাকি?

না তো। আমি শুনেছি, তিনি বিলেতে না মসুরিতে সে কথা কেউ জানে না। আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকল।

উনি বললে ঠেকারই কথা। কিন্তু এ নিয়ে কারো কানো কৌতূহল নেই। এর পিছনে আবার একটুখানি কেলেঙ্কারি কেচ্ছা রয়েছে। মেবল্‌ এখান থেকে সরে পড়াতে কেচ্ছাটি প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে।

তারপর ডীন ক্লাবে যা-কিছু শুনেছিল সে কথা তাকে সংক্ষেপে জানিয়ে বললে, পাছে আমি ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝতে পেরে এলোপাতাড়ি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, তাই মাদামপুরের সায়েক এ অঞ্চলে তিনিই মুরুব্রি-আমাকে এখানে আসার দিনই সমস্ত কথা খুলে বলে ইঙ্গিত করেন যে, এ ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করে কোনো লাভ নেই, ক্ষতিরই সম্ভাবনা। আমিও তাকে বলেছি, ব্রাদার অফিসারের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ারে আমি কনসার্নড নই।

বড় সায়েব বললেন, ঠিক বলেছে?

আরো পাঁচ রকমের কথা হ’ল বিশেষ করে লাড়াই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। দুজনেই ইয়র্কশায়ারের লোক, কাজেই দুজনারই পরিচিত অনেক লোকের প্রমোশন, জখম, বাহাদুরি, মৃত্যু নিয়ে অনেক সুখ-দুঃখ প্রকাশ করা হল।

রাত প্রায় একটার সময় বড় সায়েব শেষ ক্রেম দ্য আঁৎ খেয়ে উঠলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ বললেন, কই হে, তোমার ত্রিমূর্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না?

ডীন যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে বললেন, আপনি বাগদাদের কাজীর গল্প জানেন?

বেমক্কা হঠাৎ কাজীর গল্প কেন উপস্থিত হ’ল তার হদিস না পেয়ে বড় সায়েব বললেন, না তো!

ডীন বললে, মুর্গী খেতে খেতে কাজী বাবুর্চীকে শুধালেন, মুর্গীর আরেকটা ঠ্যাং কোথায়? বাবুর্চী বললে, মুর্গীটার ছিল মাত্র একটা ঠ্যাং। কাজী বললেন, একঠ্যাঙী মুর্গী কেউ কখনো দেখেনি। বাবুর্চী বললে, বিস্তর হয়, সে দেখিয়ে দেবে। তারপর শীতকালে এক দিন আঙিনায় একটা মুৰ্গী এক ঠ্যাং পালকের ভিতর খুঁজে দাঁড়িয়েছিল বাবুর্চী কাজীকে দেখিয়ে দিল একঠ্যাঙী মুর্গী। কাজী দিলেন জোর হাততালি। মুর্গী দুসরা ঠ্যাং বের কর ছুটে পালাল। কাজী বললেন, ঐ তো দুসরা ঠ্যাং। বাবুর্চী বললে, সেদিন খাওয়ার সময় তিনি হাত তালি দিলে দুসরা ঠাং-ও বেরোত।

বড় সায়েব বললেন, উত্তম গল্প, কিন্তু–

ডীন বললে, এতে আবার কিন্তু কী? আপনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন কম হুইস্কি খেতে-ত্রিমূর্তি হুইস্কি চোখে দেখেছিলাম কি না। আপনি যদি আচ্ছা করে আজ হুইস্কি খেতেন, তবে তার-ই হাততালিতে ত্রিমূর্তি বেরিয়ে আসতো। অথচ সায়েব খেয়েছিল পাঁচটা ব্রা বরা।

মনে মনে ভাবলেন, ছোকরা তুখোড়। বাইরে হেসে বললেন, আচ্ছা, আসচ্ছে বারে না হয়, ম্যাকবেথের তিন ডাইনির স্মরণে তিন বোতল খেয়ে ত্রিমূর্তিকে ইনভোক করা যাবে।

ডীন বললে–থ্রাইস ওথ-তিন সত্যি।

.

১৩.

লড়াইয়ের জন্য টাকা তোলার মতলবে ইংরেজ নানা ফন্দি-ফিকির চালালে–তারই একটা ‘আওয়ার ডে’, পুক-বাঙলার এই প্রথম ফ্ল্যাগ ডে। নেটিভরা বিদ্রূপ করে আওয়ার ডে-কে নাম দিল আওর দে অর্থাৎ অরো দে। ওদিকে ভারতবাসীদের কাছ থেকে এ দুঃসংবাদ আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না যে, ইংরেজ ক্রমাগতই লড়াই হারছে। চর্তুদিকে অভাব অনটনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজের গৌরবও কমে যাওয়াতে পুব-বাঙালায় আরম্ভ হ’ল বাজার লুট। ইংরেজ ভয় পেয়ে গেল যে, একবার যদি এ অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেটা ঠেকানো সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

দেখা গেল, ও-রেলির এলাকায় কোনো বাজারে লুট হয়নি। আই জি, গেলেন ঐ এলাকা পরিদর্শন করতে আর ও-রেলির কাছ থেকে সলাপরামর্শ নিতে।

ও-রেলির বাংলোয় বসে বসে আলাপচারি করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল দেখে সে সায়েবকে পটলোক খেয়ে যেতে বললে।

খেতে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ আরম্ভ হ’ল। বড় সায়েবের পরিবারও বিলেতে, তাই নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অবধি নেই, তবে সাত্বনা এই যে, তার স্ত্রী লড়াইয়ের কাজে যোগ দিয়েছেন আর বড় মেয়ে তো নার্স হয়ে ফ্রান্সে গিয়েছে।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সায়েব বললেন, লড়াইয়ে যে শুধু মানুষ জখম হয় আর মরে সেইটেই তো শেষ কথা নয়, কত পরিবার যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তার কি কোনো স্টাটিসটিকস কেউ নেয়? তোমার বউ বাচ্চা কি রকম আছে?

ভালোই।

চিঠিপত্র ঠিকমতো পাচ্ছ তো।

হু। তারপর বলল, ওসব কথা বাদ দিন। আমি আমার মনকে আদপেই বিলেতমুখো হতে দিইনে। যতটা পারি কাজকর্মে ডুব মেরে থাকি।

বড় সায়েব বললেন, সরি। কিছু মনে কোরোনা ও-রেলি। আমি পরের পারিবারিক সুখ-দুঃখের কথা সচরাচর জিজ্ঞেস করি নি। নিজের দুশ্চিন্তারই আমার অবসান নেই।

ও-রেলি চুপ করে রইল।

মাস দুইপর বড় সায়েব ভীনকে চিঠি লিখলেন,

প্রিয় ডীন,

আমি বড় সমস্যায় পড়ে তোমাকে চিঠি লিখছি।

প্রায় দুমাস হল আমি রাধাপুর মফঃস্বল যাই। সেখানকার অবস্থা খুব সন্তোষজনক সে খবর তুমি জান–তার জন্য রেলিকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে হয়, সে কথাও তোমার অজানা নয়। দেশে যে সে শান্তিরক্ষা করতে পেরেছে, সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা নয়, আমি মুগ্ধ হয়েছি অন্য কারণে।

ভারতবর্ষে একদিন আমাদের প্রাধান্য আর থাকবে না, এ জিনিসটা আমার কল্পনার বাইরে নয়, কিন্তু আমরা জনির কাছে পরাজিত হব এবং ফলে আমরা জর্মন হুনদের তবেতে আসতে পারি, এ জিনিসটার কল্পনাও আমি করতে পারিনে। এ লড়াই জেতার, জন্য ভারতে শাস্তি গৌণ-মুখ্য,ভারতকে এই যুদ্ধে আমাদের হয়ে লড়ানো। ও-রেলি এ কাজটি তার এলাকায় অবিশ্বাস্যরূপে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। তার কার্যপস্থা ও সরলতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

তাই আমাদের সকলের কর্তব্য তাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করা।

গতবার যখন তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন তার পরিবারের কথা উঠেছিল। আমার প্রশ্নের সামান্যতম উত্তর না দিয়ে সে আমার দিকে যেভাবে তাকালে তাতে আমার মনে হল, এই বিষয় নিয়ে তার মনের কোণে এক গভীর বেদনা লুকানো আছে। আমার মনে হল, তার সম্বন্ধে আমরা যে-সব গুজব শুনেছি, সেগুলোর কিছুটা তার কানে। পৌচেছে এবং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই অসম্ভব জেনে চুপ করে সব আপবাদ সয়ে নিয়েছে।

হয়তো এটা বিচক্ষণের কর্ম। কিন্তু আমার মনে হল, এ বিষয়ে আমাদেরও কর্তব্যবোধ থাকা দরকার। যে মানুষ তার সম্বন্ধে জঘন্য অপবাদ সহ্য করেও আপন দেশের জন্য অম্লানমুখে অবিশ্রাম খেটে যাচ্ছে এবং খাটছে কাদের জন্য? যারা তার বিরুদ্ধে গুজব রটিয়েছে। তাদেরই জন্য-তার মনের জ্বালা লাঘব করার জন্য যদি আমরা আমাদের কড়ে আঙ্গুলটিও না তুলি, তবে আমরা যে নুন খেয়েছি তার উপযুক্ত সই। আর যদি আমাদের প্রফেশনের কথা তুলি তবে বলব, তুমি আমি পুলিশ; অসৎকে সাজা দেওয়া যেমন আমাদের কর্তব্য, সজ্জনকে অন্যায় আক্রমণ থেকে রক্ষা করা আমাদের ততোধিক কর্তব্য– ভারতীয় পুলিশ এ কথা ভুলে গিয়েছে।

আমি তাই স্থির করলুম, ও-রেলিকে না জানিয়ে তার স্ত্রীর অনুসন্ধান করে সত্য খবর মধুগঞ্জের ইউরোপীয় সমাজকে গোচর করাব। এবং তারপরও কারো বিষ-জিভ যদি লকলকানি আরম্ভ করে, তবে রাস্কেলটাকে মধুগঞ্জের ক্লাবহাউসের সিঁরিতে চাবকে দেব।  

মেবল্‌ এবং তার বাচ্চা কোন মাসে বিলেত গিয়েছিল সে খবর বের করে আমি বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলকাতা, কলম্বো এমন কি চাটগার বন্দরের সব প্যাসেঞ্জার লিস্ট তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করেও তাদের নাম পেলুম না।

ও-রেলিকে সরিতে নাকি মেবল্‌দের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল সব কটা ইউরোপীয় হোটেলে অনুসন্ধান করেও ওদের নাম পাওয়া গেল না, অথচ ও-রেলির নাম সাভয় হোটেলের রেজিস্ট্রিতে রয়েছে।

ভারতবর্ষের হিল স্টেশনে কোনো ইউরোপীয় রমণীর পক্ষে নাম ভাড়িয়ে বেশী দিন। কাটানো প্রায় অসম্ভব, ছদ্ম নামে ছদ্ম পাসপোর্ট নিয়ে বিলেত যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।

সবদিক যখন ব্ল্যাঙ্ক বেরল তখন আমি মেদের বাটলারটার অনুসন্ধান করলুম সিংহলে তার গ্রামে। খবর এল সাত বৎসর ধরে সে গ্রামে ফেরেনি।

তাই আমি বড় সমস্যায় পড়েছি।

তুমি কি মধুগঞ্জে অত্যন্ত সাবধানে এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে কোন্ পথে এগোতে হবে, সে সম্বন্ধে কিছু হদিস দিতে পার?

মনে রেখো, আমি এ যবাৎ সব অনুসন্ধান করেছি অতিশয় গোপনে, এবং বেশির ভাগ নিজে নিজেই পাছে ও-রেলি খবর পেয়ে মর্মাহত হয় যে, আমিও মধুগঞ্জের বক্সওয়ালাদের* মতো কচুটে। তুমিও সাবধানে কাজ করবে। আমাদের উদ্দেশ্য ও-রেলিকে মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্ত করা। সে-কর্মে সফলতা নাও পেতে পারি, কিন্তু তাকে আরো দুঃখ দেওয়া অত্যন্ত গহিত হবে।

সুভেচ্ছাসহ
ডাড্‌নি।

[* টী-চেস্ট বা চায়ের বাক্স নিয়ে কারবার করে বলে চা-বাগিচার সায়েবদের অবজ্ঞার্থ অন্য ইংরেজ নাম দিয়েছে বক্সওয়ালা। হিন্দী ‘ওয়ালা’ প্রত্যয় ব্যবহার করার অর্থ যে তারা হাফ-নেটিভ। ]

.

ঠিক সাতদিন পর বড় সায়েব ভীনের কাছ থেকে একখানি ছোট চিঠি পেলেন।

যতদূর সম্ভব শীঘ্র এখানে আসুন; সব আলোচনা মুখোমুখী হওয়ার প্রয়োজন।

বড় সায়েব খবর দিয়ে মধুগঞ্জে পৌঁছলেন। মোটরেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? ডীন উত্তর না দিয়ে শুধু ড্রাইভারের দিকে আঙুল দেখালে।

রাত্রে ডিনারের পর চাকরদের বিদায় দিয়ে ডীন বড় সাহেবকে তার স্টোর রুমের তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গেল।

সায়েব দেখলেন, টুকরো টুকরো হাড়ে জোড়া তিনটি কঙ্কাল। একটা বড়, একটা মাঝারি, আরেকটা ছোট শিশুর।

তালা বন্ধ করে দুজনে বারান্দায় ফিরে এলেন। বড় সায়েব একটা নির্জলা বড় হুইস্কি খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

কোথায় পেলে?

বাগানে লিচুগাছের তলা খুঁড়ে।

কী করে সন্দেহ হ’ল?

ডীন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আপনার চিঠি থেকে আমি দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছই যে, মেব্‌ল্‌দের কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আমি অবিশ্বাস্য জিনিসে বিশ্বাস করে আপন অনুসন্ধান আরম্ভ করলুম বরঞ্চ বলতে পারেন শেষ করলুম।

এ বাংলায় প্রথম দু রাত্রে আমি যে ত্রিমূর্তি দেখেছিলুম, সেগুলো আমার মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। যে গাছতলায় ছায়ামূর্তিগুলো হঠাৎ মিলিয়ে যায়, সে গাছটাকেও আমি স্পষ্ট মনে রেখেছিলুম। আপনার সব তল্লাসীই যখন নিষ্ফল হ’ল, তখন আমি যে কাজ করলুম সেটা শুনলে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে আমার গুরুরা হাসবেন। কিন্তু যে জিনিস আমি স্পষ্ট দেখেছি, যার সম্বন্ধে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই, সে জিনিস স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের কাছে আপনার কাছে-যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, আমার কাছে তাই বিশ্বাস্য সেই আমার খেই।

জায়গাটা খোঁড়ার আরেকটা কারণঃ যদি কিছু না পাই, তবে আমি সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারব।

বড় সায়েব দুহাত মাথা চেপে ধরে রইলেন অনেকক্ষণ ধরে।

ডীন সায়েবকে আরেকটা পেগ দিলেন।

সায়েব শুধালেন, তোমার কী মনে হয়?

ডীন কোনো উত্তর দিলে না, প্রশ্নটা যেন সে শুনতেই পায় নি।

এবারে সায়েব মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এ কাজ যদি রেলির হয়, তবে বলব, যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত কারণ না থাকলে তার দ্বারা এটা কখনো সম্ভবপর হত না।

ডীনও উঠে দাঁড়াল। বললে, খোঁড়াখুড়ি করার আমার তৃতীয় কারণ সেইখানেই। আপনার শেষ সিদ্ধান্ত যদি ও-রেলির সপক্ষে যায়, তবে এই কঙ্কালগুলো নিয়ে আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করতে পারবেন। এটা তো আপনার কেস।

বড় সায়েব বললেন, মাই কেন! ও গড়। বড় সায়েব পরদিনই রাধাপুর গিয়ে সোজা উঠলেন ও-রেলির বাংলোয়। কোনো ভূমিকা না দিয়েই বললেন,

ও-রেলি, মধুগঞ্জে তোমার বাংলোর বাগান খুঁড়ে তিনটি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। এ সম্বন্ধে তোমার কিছু বলবার আছে কি? কিন্তু তার পূর্বে তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি তুমিও জান–

সাহেব বাক্য শেষ করলেন।

ও-রেলি তখন একটু শুকনো হেসে বললে, আমাকে কিছু সাবধান করতে হবে না। এই নিন। বলে সে কোটের ভিতরে বুকের পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করে বড় সায়েবের হাতে দিলে।

.

১৪.

প্রিয় সোম,

এ চিঠিটা তোমাকে লিখছি; এ চিঠিটা বিশ্বসংসারের যে কোনো লোককে লেখা যেত। তবু তোমাকেই কেন লিখছি তার কারণ তুমি আমাকে হৃদয় আর মন দিয়ে যে রকম বুঝতে চেষ্টা করেছ এ রকমটা আর কেউ, কখনো করেনিনা এদেশে,না আমার আপন দেশে–এক মেব্‌ল্‌ ছাড়া। হৃদয় আর মন দিয়ে বলবার সময় আমি ইচ্ছে করেই হৃদয় আগে ব্যবহার করেছি তার কারণ আমি আইরিশম্যান,আমি ইংরেজ নই। আমি আমার পাঁচটা জাতভাইয়ের মতো হৃদয় দিয়ে ভাবি, আর মন দিয়ে অনুভব করি। ইংরেজ তার মনকে হৃদয়ের আগে স্থান দেয় এবং বহু ইংরেজের আদপেই হৃদয় আছে কি না তাই নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। কিন্তু থাক, এ-সব সস্তা পাইকারি হিসেবে কোনো জাত কিংবা দেশ সম্বন্ধে রায় প্রকাশ।শুধু শেষ একটা কথা বলি, বাঙালীর সঙ্গে এ বাবদ আইরিশম্যানের অনেকখানি মিল আছে। জানিনে, তোমার কাছে খবর পৌচেছে কি না, আলিপুরের মামলায় যারা হাজতে ছিল তাদের প্রতি দরদ দেখিয়ে এক আইরিশ ডাক্তারকে এদেশের ইংরেজ কর্তাদের কাছে হুমকি খেতে হয়েছে। এই আইরিশ ডাক্তারের সঙ্গে আমার হৃদয়ের মিল রয়েছে। দেশে আমার জাতভাইরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ছে স্বাধীনতার জন্য। তাদের জন্য আমার যথেষ্ট দরদ। ওদিকে ইংরেজ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটাকেও অস্বীকার করতে পারিনে। তোমার বেলাও তাই, অরবিন্দ কোম্পানির প্রতি তোমার সহানুভূতি; ওদিকে যে ইংরেজ রাজতন্ত্র এ দেশে প্রচলিত তার সদগুণগুলোও তোমার চোখ এড়ায় না। আইরিশ ডাক্তার, তোমার এবং আমার, আমাদের সকলের ভিতর একই দ্বন্দ্ব।

সাধারণ লোক এ ক্ষেত্রে বলে, তাহলে চাকরি ছেড়ে দিলেই পার? এর সদুত্তর যখন আমি আপন মনে খুজছি তখন তোমার মুরুরি–যাকে প্রথম দর্শনে মনে হয়, আস্ত একটা গাড় ড্যাম ফুল কাশীশ্বর চক্রবর্তীকে এক পুরস্কার-সভার বক্তৃতাতে অন্য কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনলুম, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব সংসারে তো চিরকালই লেগে থাকবে। তাই বলে কি আমরা সবাই সংসার ত্যাগ করে বনবাসে চলে যাই? আর যদি যাই-ও তাতেই বা কী? সেখানে কি দ্বন্দ্ব নেই।

কথায় কথায় কোথায় এসে পড়লুম। কিন্তু তোমার স্মরণ আছে, সোম, আমি যখন প্রথম এদেশে আসি তখন কী রকম মারাত্মক বাঁচাল ছিলুম। তুমিই নাকি মীরপুরকে একদিন বলেছিলে, সায়েব কথা কয় যেন ম্যাকসিম গানের মতো কট কট কট কট ট ট-ট। ঠিকই বলেছিলে। এবং আমিও মন্তব্যটা শুনে সেটাকে সবিশেষ প্রতিপন্ন করার জন্য আরো শ তিনেক রৌণ্ড তদণ্ডেই ছেড়েছিলুম।

সে বাঁচালতা একদিন আমার লোপ পায়। আজ আবার সেটা ফিরে এসেছে। দীর্ঘ সাত বছরের জমানো কথা আজ তোমাকে বলতে যাচ্ছি। যে কলম-ধরাকে আমি ভূতের মতো ডরাতুম, আজ আমাকে সেই কলম ধরেছে। আমার একমাত্র দুঃখ এ-চিঠি হয়তো কোনোদিন তোমার হাতে পৌঁছবে না। এটা হয়তো জবানবন্দীরূপে আদালতে পেশ করা হবে। যে অন্ন তোমাকে সাদরে আপন হাতে খাওয়াতে চেয়েছিলুম, সেটা পৌঁছবে তোমার কাছে, পাঁচশো জনের এটো হয়ে।

হ্যাঁ, আমার-ই কর্ম আমিই করেছি। এর জন্য আর কেউ দায়ী নয়। আমি একাই দায়ী। আমি জানি, একমাত্র তুমিই জানতে পেরেছিলে যে, আমি দায়ী। তুমি আমাকে ধরিয়ে দাওনি কেন তারও আন্দাজ আমি খানিকটা করতে পেরেছি। বিশ্বের আদালতে আমাকে খাড়া না করে তুমি আমাকে তোমার নিজের আদালতে খাড়া করে হয়তো যথেষ্ট প্রমাণ পাওনি, হয়তো তোমার প্রত্যয় হয়েছিল যে, এ অবস্থায় পড়লে তুমিও ঠিক এই রকম ধারাই করতে, হয়তো ভেবেছিলে আমি তোমার ওপরওলা, ওপরওলার অপরাধের বিচার করেন তার ওপরওলা, গুরুর বিচার করবেন ভগবান, চেলার তাতে কিসের জিন্মেদারি। এ নিয়ে আমার কোনো কৌতূহল নেই। জজ যখন আসামীকে খালাস দেয়। তখন জজ কেন তাকে ছেড়ে দিলে তাই নিয়ে মাথা ঘামায় কোন আসামী?

তুমি যে আমাকে হৃদয় দিয়ে খানিকট বুঝতে পেরেছিলে সে বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই, তুমি যেন অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলে, এইবারে আমি তোমাকে হাত ধরে বাকিপথটুকু দিয়ে যাব। কিন্তু যদি গুপ্তধনের কলসী তখন ফাঁকা বেরোয়, কিংবা যদি তার থেকে বেরোয় কেউটে…? তখন তুমি আমাকে দোষ দিয়ো না। আর তুমি যদি তখন তোমার রায় বদলাও তবে আমিও তোমাকে দোষ দেব না।

তাহলে গোড়া থেকেই আরম্ভ করি।

একদিন কথায় কথায় আমি তোমাকে আমার বাপ-মা সম্বন্ধে কী যেন সামান্য কিছু একটা বলি। তুমি সুযোগ পেয়ে এমন একটা প্রশ্ন শুধালে যার থেকে আমি আবছা

আবছা বুঝতে পারলুম, তুমি জানতে চাও আমি আমার রক্তে এমন কোনো দ্বন্দ্ব নিয়ে জন্মেছি কি না যার তাড়নায় আত্মবিস্মৃত হয়ে আমি অপরাধের পন্থা বরণ করলুম, এখানে বলে রাখি, সে স্থলে তুমি যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলে আমিও ঠিক সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতুম। কারণ অপরাধী নিয়ে আমাদের কারবার। হয় তাদের গায়ে বদ-খুন,–না হয় তারা বড় হয়েছে বদ আবহাওয়ার ভিতরে। আজ আমার আর স্পষ্ট মনে নেই তবে এটুকু এখনো স্মরণে আছে যে, তুমি কিন্তু প্রশ্নটি করেছিলে এমন সুচতুরভাবে যে, আমি কোনো অফেনস্ নিইনি।

তাই বলে রাখি, আমি আমার বাবার যেটুকু দেখেছি তার থেকে এমন কিছুই মনে পড়ছে না যা দিয়ে আমার চরিত্র বিশ্লেষণ করা যায়। তিনি ছিলেন খাঁটি আইরিশম্যান, অর্থাৎ দু মুঠো অন্ন আর তিন পাত্তর মদের পয়সা হয়ে গেলেই কাজে ক্ষান্ত দিয়ে সোজা চলে যেতেন পাড়ার মদের দোকানে তারপর তাকে আর এক মিনিটের তরে কাজ করানো যেত না। তুমি আয়ারল্যাণ্ডের মদের দোকান কখনো দেখনি, তাই তুলনা দিয়ে বলছি, সে হল কাশীশ্বর চক্রবর্তীর বৈঠকখানার মতো। সেখানে কুঁড়েমি আর গালগল্প ছাড়া অন্য কোন জিনিস হয় না–মদ সেখানে আনুষঙ্গিক মাত্র। মেয়েদের সামনে এসব জিনিস ভালো করে জমে না বলে মেয়েরা পাবে’ যায় না, চক্রবর্তীর বৈঠকখানায়ও তাদের প্রবেশ নিষেধ।

আমার বাবা ছিলেন গল্প বলায় ওস্তাদ, তাই তিনি ছিলেন পাবের’ প্রাণচক্রবর্তীর বৈঠকখানায় শুনেছি সেই ব্যবস্থা।

তার কোনো প্রকারের চরিত্র দোষ ছিল না, তাকে কোনো প্রকারের উচ্ছখল আচরণ করতে আমি কখনো দেখিনি। অথচ তিনি আমাকে জীবনে একটি মাত্র যে উপদেশ লক্ষাধিকবার দিয়েছেন সেটি ডেভিড, যা খুশি তাই করবি, কারো পরোয়া করিসনি। কেন তিনি এ উপদেশ দিতেন জানিনে, এর ভিতর কোনো দ্বন্দ্ব আছে কি না সে তুমি ভেবে দেখো। মা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু, তিনি মৃদু আপত্তি জানাতেন। বাবা তখন অন্য কথা পাড়তেন, কিন্তু যেদিনই ঝড় দুর্যোগ পাবে যেতে পারতেন না, সেদিনই আমাকে মজাদার কেচ্ছা-কাহিনী শোনাতেন এবং তার সবগুলোতেই ইঙ্গিত থাকত,–যা খুশি তাই করো, এমন কি ‘যাচ্ছে তাই করো’।

এ উপদেশ কিন্তু আমার মনের উপর কোনো দাগ কাটতে পারেনি–অন্তত তাই আমার বিশ্বাস।

এ ধরনের পরিবার আয়ারল্যাণ্ডে বিস্তর-এর মধ্যে কোনো বিদঘুঁটে নূতনত্ব নেই। এর থেকে আমি কোনো হদিস পাইনি-দেখো, তুমি পাও কি না।

তবে কি বাইরের দুষিত আবহাওয়া? এমন কোনো পৈশাচিক ঘটনা যা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি, এবং সেই স্তম্ভনের সময় আমার অজানাতে সে ঘটনাতে আমার হৃদয়মনে ঢুকে দুষ্ট জীবাণুর মত বছরের পর বছর আমার সর্ব অচেতন সত্তা বিষিয়ে দিয়ে দিয়ে শেষটায় হঠাৎ একদিন আমার মগজে ঢুকে আমায় বিবেকবুদ্ধিহীন উম্মাদ করে দিয়ে কিংবা কোনো মারাত্মক প্রবঞ্চনা–ফেদেবীকে হৃদয়ের পদ্মাসনে বসিয়ে দিনযামিনী পুজা করেছি, হঠাৎ দেখি সে মায়াবিনী, পিশাচিনী আমার বুকের উপরে বসে আমারই হৃৎপিণ্ড ছিন্ন করে রক্ত শোষণ করছে। কিংবা প্রেমের দেউলের মমতা-প্রতিমা গোপনে গোপনে বারাঙ্গনার আচরণ করছে হঠাৎ একদিন ধরা পড়ে গেল, আমার বিশ্বসংসার অন্ধকার হয়ে গেল?

না। আমার চোখের সামনে ঘটেনি। শুনেছি। তা সে তুমিও শুনেছ, সবাই শুনে থাকে, বইয়ে পড়ে থাকে।

তবে কি উল্টোটা? আবিশ্বাস্য আত্মবিসর্জন, বহুযুগের বিরহদহনের পর মধুর পুনর্মিলন, সমরে লুপ্ত পথের গৃহ-প্রত্যাগমনে মাতার বিগলিত আনন্দাশ্রু সিঞ্চন?

না। তাও দেখিনি। সেখানেও ইউ উইল ড্র ব্লাঙ্ক।

তবে হ্যাঁ, আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা, মেবল্‌কে দেখা তাকে পেয়েও না পাওয়া।

.

১৫.

আমার বাবা মা দুজনই এক মাসের ভিতর মারা যান। আমি বৃত্তি পেয়ে লণ্ডনে পড়াশুনা করতে এলুম।

আমার মনে হয় বড় শহরে মানুষের জীবন বৈচিত্র্যহীন। অকস্মাৎ সাঙ্ঘাতিক সেখানে কিছু একটা ঘটে না। তার কারণ বড় শহরের জীবনম্নেত বয় অতিশয় তীব্র গতিতে। তুমি তার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছ খরবেগে। সে বেগে চলার সময় ডাইনে বাঁয়ে মোড় নেওয়া অসম্ভব। আর ছোট শহর, কিংবা গ্রামে জীবনগতি শান্ত মন্দ। সে যেন গ্রামের নদী। তার উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় সামান্য খড়-কুটোটি নানা চক্করে বহু প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে এগিয়ে যায়। দেখে মনে হয় তার জীবনে স্বাধীনতা অনেক বেশী।

মানুষের জীবনের উপর লণ্ডনের চাপ জগদ্দল, তার দাবী বহুল-কিন্তু বৈচিত্র্যহীন। সকাল থেকে রাত বারোটা অবধি মানুষ যে কী বদ্ধ পাগলের মতো ছুটোছুটি হুটোপুটি করে সেই তুমি মধুগঞ্জের লোক বুঝবে কী করে? এবং যতদূর দেখতে পাচ্ছি, থ্যাঙ্ক গড়, মধুগঞ্জের কখনও বুঝতে হবে না।

কিন্তু জানো সোম, সেই খরস্রোতে ভেসে ভেসে হঠাৎ আমি একদিন শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলুম। দেখি সমুখে ঘন নীল সমুদ্র আর তার উপর ফিরোজা আকাশের ঢাকনা। বিলেতের সমুদ্র আর আকাশ সচরাচর নীল রঙের বাহার ধরতে জানে না কুয়াশা, বৃষ্টি আর বরফ তাকে করে রাখে ঘোলাটে, তামাটে, পাংশুটে। আমার সঙ্গে সমুদ্রের চারি চক্ষের মিলন হ’ল নিদাঘ মধ্যাহ্নে নীলাম্বুজ আর নীলাকাশ সেদিন বর্ষণশেষে আতপ্ত কিশোর রৌদ্রে দেহখানি প্রসারিত করে দিয়েছেন।

সে সমুদ্র মেবল্‌।

তোমাকে বোঝানো অসম্ভব, সোম, কারণ এ জিনিস বোঝার জিনিস নয়। তোমার বহু সদগুণ আছে স্বীকার করি, কিন্তু প্রেম কী বস্তু তা তুমি জান না। কতবার দেখেছি, ছোঁড়াছুড়ী পালিয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারী করেছে, তুমি সর্বদাই সমাজের হয়ে তাদের উপর কড়া শাসন করেছ, পুলিশের কুলিশ পাণি দিয়ে। তারা কিসের নেশায় পাগল হয়ে সমাজের সব বেড়া ভাঙল, সব দরাদরি ছিঁড়ল তুমি কখনো বুঝতে পারনি। অমি দু একবার ইঙ্গিত করে দেখেছি, তুমি অন্ধ, বরঞ্চ নৈতিক, সামাজিক ধর্ম রক্ষা করা যার সর্বপ্রধান কর্তব্য সেই পাদ্রী বুড়োবুড়ীর হৃদয়ে অনেক বেশী দরদ, তাদের চিত্ত বহুগুণে প্রসারিত।

মেব্‌ল্‌ সেই গ্রীষ্মের দুপুরে হাইড পার্কের গাছতলার বেঞ্চিতে বসে অলস নয়নে সার্পেন্টাইনের জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছিল।

তুমি তাকে দেখেছ, বার বহু পরিবেশে দেখেছ, আমার চোখ দিয়ে দেখনি, কিন্তু তুমি জান সে সুন্দরী। অসাধারণ সুন্দরী।

হিন্দুধর্ম, হিন্দু দর্শনের অনেক কিছু আমি এদেশে এসে শুনেছি, পড়েছি; কিন্তু তার অল্প জিনিসই আমি বিশ্বাস করতে শিখেছি। তার একটা, জন্মান্তরবাদ। না হলে কী করে বিশ্বাস করি সেই সামাজিক কড়াকড়ির যুগে বিনা মাধ্যমে কী করে আমাদের আলাপ হ’ল, প্রথম দর্শনেই কী করে দুজনার হৃদয়ে একে অন্যের জন্য ভালোবাসা জন্মাল। এ যুদ্ধ বিলেতের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে, অজানা মানুষের সঙ্গে বিলেতের আলাপ পরিচয় করা এখন আর কঠিন নয়, তার ধাক্কা সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমাদের আণ্ডাঘরেও এসে পৌচেছে, সে খবর তুমি জান, কিন্তু সে যুগে দুদণ্ডের ভিতর এতখানি হৃদ্যতা পূর্বজন্মের সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো স্বতঃসিদ্ধ দিয়ে বোঝানো যায় না।

মেবল্‌ আমার কাছে সমুদ্রের রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল।

সে সমুদ্র আমাকে নিদাঘে শীতল করেছে, শীতে আতপ্ত তৃপ্তিতে সর্ব সত্তা ব্যাপ্ত করে ভরে দিয়েছে।

বিলেতে বিয়ে করে ঘর বাঁধতে সময় লাগে। সংসার চালাবার মতো রোজগার করতে করতে বয়স প্রায় ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে যায়। আমার কিন্তু একদিনও তর সইছিল না। তাই আমি চাকুরী নিলুষ ভারতবর্ষে। যে মাইনে প্রথম চাকরিতে ঢুকেই এখানে পাওয়া যায় তাই দিয়ে অনায়াসে দুটো সংসার পাতা যায়। কিন্তু মেবল্‌কে বললুম, দাঁড়াও, দেশটা প্রথম দেখে আসি, তোমার সইবে কি না। মেব্‌ল্‌ আপত্তি জানিয়েছিল, সে তখন আমার সঙ্গে নর্থ পোল, সেন্ট্রাল আফ্রিকা সর্বত্র যেতে তৈরী। আমি কিন্তু তখন তাকে দিতে চেয়েছিলুম এমন কিছু যার জন্য তাকে মাকে যেন পরে পস্তাতে না হয়। যদি দেখি ভারতবর্ষের বাতাবরণে আমাদের প্রেম তার পরিপূর্ণতা পাবে না, তবে ফিরে যাব বিলেতে, না হয় বছর কয়েক খেটে সেখানেই সংসার পাতব।

বোম্বাই কলকাতা দু-জাগাতেই আমার মন কিন্তু-কিন্তু করেছিল কিন্তু পাদ্রীর টিলার মোর ঘুরে মধুগঞ্জে পৌঁছতেই আমার মন থেকে সর্বদ্বিধা অন্তর্ধান করল। এযে আমার আয়ারল্যাণ্ডের পাড়াগাকেও হার মানায়। এই বকস্ওয়ালা কেন যে ভ্যানর-ভ্যানর করে মধুগঞ্জের নিন্দে করে আমি ঠিক বুঝতে পারিনে, বোধহয় করাটা ফ্যাশান, কিংবা হয়তো ভাবে, না করলে খানদানী সায়েবরা ভাববে ওরা বুঝি নেটিভ, কালো আদমি বনে গিয়েছে।

লণ্ডনে থেকে মধুগঞ্জ। এর চেয়ে দূরতর পরিবর্তন আমি কল্পনা করতে পারিনে।

সেই মধুগঞ্জে আমি অনেক কিছু পেলুম। ভগবান অকৃপণভাবে ঢেলে দিলেন তার সব দৌলত, তার তাবৎ ঐশ্বর্য। নৌকো বাচ থেকে আরম্ভ করে পাদ্রী টিলার মেয়েগুলি।

ভালোই। এদের কথা উঠল। তুমি জান আমি ওদের সঙ্গে ঢলাঢলি করার মতলব নিয়ে পাদ্রী-টিলায় যায় নি, কিন্তু এক জায়গায় আমার অজানাতে আমি একটি ভুল করে ফেলি। প্রাচ্যদেশের মেয়েরা যে এত স্পর্শকাতর হয় আমি অনুমান করতে পারিনি তাই আমি তাদের সামন্যতম গতানুগতিক হৃদতা জানাতেই হঠাৎ দেখি, ওরা দিচ্ছে তরুণীর অকুণ্ঠ প্রেম। আমার আপসোসের অন্ত নেই যে, সে ভালোবাসার ন্যায্য সম্মান আমি দেখাতে পারিনি। আশা করি ওরা জানতে পেরেছে যে আমি ওদের ফিরিঙ্গি বলে অবহেলা করিনি। আমি জানতুম, তুমি এই বিশ্বাসটি গুদের ভিতর জন্মাতে পারবে তোমার পাকা মুন্সিয়ানা দিয়ে, তাই তোমারই এটি সঁপে দিয়েছিলুম।

তারপর আমি বিলেতে গেলুম মেকে নিয়ে আসতে।

এই পৃথিবীর গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে সর্বত্রই প্রতি মুহূর্তে নরনারীর ভিতর প্রেম মুকলিত হচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে, তার ফল কখনো মধুময় কখনো তিক্ত–এই হ’ল জীবনের দৈনন্দিন, গতানুগতিক ধারা। কিন্তু যদি প্রেমের মেলা দেখতে চাও, প্রেম যেখানে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে উপছে পড়ছে তবে একটিবারের জন্য কোনো এক জাহাজে করে সপ্তাহ তিনেকের জন্য কোথায়ও চলে যেয়ো। দেখবে কী উম্মাদ অবন্ধন,মেলার ফুর্তি সেখানে চলে–ইচ্ছা করেই মেলা বলছি, কারণ এ জিনিস দৈনন্দিন নয়। জাহাজের অধিকাংশ নরনারী সেখানে সমাজের সর্বপ্রকার কড়া বন্ধন থেকে মুক্ত, প্রতিবেশীকে ডরিয়ে চলতে হয় না পাছে নে কেলেঙ্কারি কেচ্ছা সর্বত্র রটিয়ে দেয় জাহাজ মোকামে পৌঁছলেইতো সবাই ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি, কে কাকে জানাতে যাবে, কে কী করেছে? এবং সবচেয়ে বড় কথা এ তিন হপ্ত মানুষ জীবন-সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, সর্বপ্রকার দায়িত্ব থেকে পূর্ণ মুক্ত। আহার হিদা আশ্রয়–এ তিন সমস্যার সমাধান হওয়া মাত্রই, তা সে যত সাময়িকই হোক না কেন,–তিন সপ্তাহ কি কম সময়?–মানুষের জাগে আসঙ্গলিপ্সা, যৌনক্ষুধা! সে যেমন বিরাট তেমনি বিকটস্থলবিশেষ। তাই এ রকম জাহাজে মানুষ এডনিস না হয়েও পায় কার্তিকের কদর মোনালিসা না হয়েও পায় ভিনাসের পূজা।

বৃথা বিনয় করব না। আমি জানি আমি কুরূপ কুচ্ছিত নই। তাই আমার কাছে তখন বহু হৃদয় অবারিতদ্বার, বহু যুবতী আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘন ঘন সাপ খেলাবার বাঁশি বাজাতে আরম্ভ করেছে। আর দু-চারটি ভীরু লাজুক তরুণী নির্জনে পেলে ফিক করে একটুখানি হেসে কিশোর-সুলভ নীতিস্ফীত নিতম্বে সচেতন ঢেউ তুলে দিয়ে জাহাজের নির্জনতর কোণের দিকে রওয়ানা দিত।

কিন্তু আমি তো চলেছি আমার বধুর সন্ধানে। আমার ফিয়াসে, যে আমার ব্রাইড হতে যাচ্ছে, আমার বঁধু যে আমার বন্ধু হতে চলেছে। প্রপেলারের প্রতি আঘাত আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারই কাছে, এই লক্ষ লক্ষ টাকার জাহাজ, হাজার হাজার টাকার বেতন ভোগী কর্মচারীরা এরা সবাই অহোরাত্র খাটছে আমাকেই, শুধু আমাকেই, আমার রানীর কাছে নিয়ে যাবার জন্যে। ঝড়-ঝঞ্ঝায় এ জাহাজ ডুবতে পারে না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লোপ পেলেও এ জাহাজ পৌঁছবে মার্সেলেস বন্দরে, যেখানে জাহাজ থেকে দেখতে পাব, আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন যে যে পোশাক পরে হাইড পার্কে বসেছিল সেই পোশাক পরে বন্দরের পারে দাঁড়িয়ে তার মভ রঙের রুমাল দোলাচ্ছে।

ভগবান কোথায়?–নাস্তিক জিজ্ঞেস করেছিল সাধুকে কৃচ্ছসাধনাসক্ত দীর্ঘতপস্যারত-চিরকুমার সাধু বলেছিলেন, তরুণ-তরুণীর চুম্বনের মাঝখানে থাকেন ভগবান। আমার হৃদয় আমার মেবলের রুমাল-নাড়ার মাঝখানে থাকবেন স্বয়ং

থাক, সোম। আগই বলেছি তোমাকে এ-সব বলা বৃথা। তবু বলছি, কেন জান? হয়তো বুঝতে পারবে, হয়তো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবে। অবিশ্বাস্য তো কিছুই নয়, অসম্ভবই বা কোথায়?

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী