০৬.

বরঞ্চ ইংরেজ সকাল বেলার বেকন আণ্ডা বজর্ন করে দেবে, বরঞ্চ ইংরেজ বড়দিনে গিঞ্জে কট করতে পারে, এমন কি, শাশুড়ীর জন্মদিনও ইংরেজের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভ নয়, কিন্তু ক্লাব-গমন বন্ধ করা ইংরেজের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু ক্লাব-গমন বন্ধ করা ইংরেজের পক্ষে হোস-অব-কমন পুড়িয়ে দেবার শামিল।

মুসলমানের কলমা ভুলে যাওয়া, হিন্দুর গো-মাংস ভক্ষণের তুলনায় চুলে চিমটি কাটার মত।

ডেভিড, মেব্‌ল্‌ তিন মাস ধরে ক্লাবে যায়নি।

যে মীরপুরের ছোট মেম ডুমুরের ফুল, সাপের ঠ্যাঙ দেখছেন বলে ক্লাবে দাবি করে থাকেন, তাঁকে পর্যন্ত স্বীকার করতে হ’ল, মধুগঞ্জের তাবৎ খানসামা বাটলার, মেথর ঝাড়দারকে ফালতো চা বখশিশ দিয়েও তিনি কারণটা বের করতে পারেননি।

এ-সব বাবদে সোজাসুজি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা ইংরেজের সর্বশাস্ত্রে বারণ। একমাত্র পাত্রীদের কিছু হক আছে। বুড়ো পাত্রী সন্তর্পণে প্রশ্ন শুধিয়ে নিরাস হলেন। বুড়ী মেম একবার ডেভিডের মফস্বলবাসের সময় মেবলের সঙ্গে রাত্তির কাটান। চর্তুদিকে কড়া নজর ফেলে, এমন কি শেষটায় জিজ্ঞেসবাদ করেও কোনো খবর যোগাড় করতে পারলেন না।

বুড়ী বেদনা পেয়েছিলেন। তৃতীয় রাত্রিতে ছিল পূর্ণিমা। জানলা দিয়ে চোখে চাঁদের আলো পড়তে তার ঘুম ভেঙে যায়। পাশের খাটের দিকে তাকিয়ে দেখেন মেব্‌ল্‌ নেই। পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দেখেন মেব্‌ল্‌ ডেকচেয়ারে সামনের দিকে ঝুঁকে দুহাত দিয়ে, মুখ ঢেকে বসে আছে তার দীর্ঘ বাদামী চুল হাত ছাপিয়ে ফেলেছে। বুড়ী মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, চুলে আঙুল চালাতে চালাতে হঠাৎ চুলের ডগাগুলো ভেজা ঠেকল।

প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি পাদ্রী-টিলার বহু তরুণী, বিস্তর যুবতীর অনেক বুকফাটা কান্না দেখেছেন, কোন কোন স্থলে সলা-পরামর্শ দিয়ে নানা দিকে নানা রকম কলকাঠি চালিয়ে এদের মুখে হাসি ফোঁটাতেও সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু এ নারীর বেদনা কি হতে পারে, সে সমস্যার সন্ধানে কোনদিকে হাতড়াতে হবে তার সামান্যতম অনুমানও তিনি করতে পারলেন না।

বুড়ো পাদ্রী সব শুনে বললেন, এসো, দুজনাতে মিলে প্রার্থনা করি।

সোম একদিন ও-রেলিকে প্রশ্ন শুধাল মাত্র দুটি শব্দ দিয়ে, এনি ট্রাবল?

উত্তরের জন্য মাত্র এক সেকেণ্ড অপেক্ষ করে সোম গুড বাই বলে বারান্দা থেকে নেমে লিচুতলা দিয়ে গেট খুলে বড় রাস্তায় নেমে গেল।

ও-রেলি ভাবলে মাত্র দুটি কথা, এনি ট্রাবল!

স্মরণই করত পারল না, তার জীবনে কখনো কোনো শক্ত ট্রাবল এসেছিল কিনা, যেটাকে সে কাত করতে পারেনি। সে তাগড়া জোয়ান, লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট না হলেও ভালো, গায়ের জোরে কমতি নেই, আর পাঁচটা ইংরেজের মত তিনটে কথা বলতে গেলে সাতবার হোঁচট খায় না-তার আবার ট্রাবল! হ্যাঁ, একটা সামান্য ট্রাবলের কথা মনে পড়ছে বটে। এমনিতে তার মুখে শুধু খই ফোটে না, টোস্ট পর্যন্ত সেঁকা যায়, তবে প্রেমের ব্যাপারে একটু মুখচোরা বলে মেবল্‌কে বিয়ের প্রস্তাব পাড়তে তার তিনটে রবির সন্ধ্যা লেগেছিল বটে, কিন্তু তারপরের অবস্থা দেখে সে থ-মেবল্‌ বাহান্ন রববারের আগের থেকেই নাকি তাকে বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ট্রলোর ডিজাইন বানাতে লেগে গিয়েছিল।  

ইস্কুলের ব্লু, চাকরির জন্য পরীক্ষা, রাগবিতে একখানা পাজর গুঁড়িয়ে যাওয়া এসব ও-রেলির কাছে কখনো ট্রাবল বলে মনে হয়নি। তার একমাত্র ভয় ছিল মেব্‌ল্‌ যদি তাকে গ্রহণ না করে। সেই মেকে পেতে তার তিনটি রববার–অর্থাৎ একুশ দিনের দ্বিারাত্র দুশ্চিন্তা–লেগেছিল বটে, কিন্তু আজকের তুলনায় সে কত সহজ। সেদিন পথহারা ও-রেলির সামনে থেকে হঠাৎ যেন কুয়াশা কেটে যায়, আর সমুখে দেখে বসন্তের মধুরৌদ্রে, নীল আকাশের পটে আঁকা মেব্‌ল্‌। ‘উতলা পবন বেগে মেঘে মেঘে’ যেন তার খোলা চুল উড়ে উড়ে চলেছে। হাতে তার একটি ছোট ফুল। তারই এক-একটা পাপড়ি ছিঁড়ছে আর বলছে হি লাভ মী, পরেরটায় বলছে হি লাভ মী নট এই করে করে ভাগ্য গণনা করছে। সর্বশেষের পাপড়িতে হি লাভস মী না হি লাভ মী নট-এ এই জীবন-মরণ সমস্যার সমাধান মিলবে।

ও-রেলির মনে পড়ল, মে সেদিন তার কানের ডগায় চুমো খেয়ে বলছিল, আমি সব সময়ই জানতুম, শেষ পাপরি হি লাভ মী-তেই শেষ হবে। একদিন যখন হল না তখন রীতিমত হকচকিয়ে গেলুম। পরে দেখি একটা পাপড়ি আগের থেকেই ছিঁড়ে গিয়েছিল-টুকরোখানা তখনো বোঁটায় লেগে আছে।

সেসব দিন চলে যাওয়ার পর আজ সোম জিজ্ঞেস করলে, এনি ট্রাবল।

.

তারপর আরো তিন মাস কেটে গিয়েছে। এ তিন মাসের ভিতর আরো পরিবর্তন ঘটেছে। ও-রেলিরা ক্লাব দুরে থাক কারো বাড়িতে পর্যন্ত যায়নি। তার থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল তারাও চায় না কেউ তাদের বাড়িতে আসুক। শেষ পর্যন্ত এক পাদ্রী মেম ছাড়া আর কেউ ও-রেলি টিলায় আসত না এবং তিনিও আসতেন যেন অতিশয় দায়ে পড়ে, অন্ধভাবে অন্ধকারে কোন এক ভবিষ্যৎ অমঙ্গল আবছা বুঝতে পেরে মানুষ যে-রকম আত্মজনের কাছে এসে দাঁড়ায়।

তারপর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের খরদাহের পর নামল বর্ষা। কলকাতার বদখদ দালান কোঠার উপর বর্ষা যখন নামে তখন বড়বাজারের বেরসিক মারোয়াড়ী পর্যন্ত আকাশের দিকে একবার না তাকিয়ে থাকতে পারে না, আর কলেজের মেয়েরা নাকি ছাদের উপর বৃষ্টির জলে ভেজবার অছিলা করে মেঘের জলের সঙ্গে চোখের জল মেলায়। আর তাতে আশ্চর্য হবারই বা কী আছে! ছেলেরা তো কলেজ পাসের পর অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রেম, বিয়ে শাদি মন থেকে কুলোর বাতাস দিয়ে খেদিয়ে দেয়। মেয়েরা শুধু অজানা ভবিষ্যতকে অতখানি ডরায় না বলে বে-এক্তেয়ার প্রেমে পড়ে আর তারই প্রকাশ খুঁজতে গিয়ে রবিঠাকুরের গান আর কবিতা বাঁচিয়ে রাখে। তবে কি রবিঠাকুর এ তত্ত্বটা জানতেন, তাই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের গান শিখিয়েছেন অনেক বেশী সযত্নে?

মধগঞ্জে এ-সব বালাই নেই–মারোয়াড়ী নেই বললেই চলে, কলেজ নেই তাই কলেজের মেয়েও নেই। মধুগঞ্জী বালিকাদের বিয়ে হয়ে যায় চোদ্দ পেরতে না পেরতেই। এ বিষয়ে ওয়েলশ পাত্রী সাহেবও নেটিভ বনে গিয়েছেন, রুথ-মেরীদের ষোলো পেরতে না পেরতেই বরের সন্ধানে লেগে যান, তাঁর যুক্তি–প্রাচ্যে মেয়েরা বিবাহযোগ্য হয়ে যায় অল্প বয়সেই, এদেশে বিলিতি কায়দা মেনে নিলে শুধু অনর্থেরই সৃষ্টি হয়।

বিবাহ মাত্রই প্রেমের গোরস্তান, কিন্তু শান্তির, কিন্তু শান্তির আস্তানা।

তাই এখানে কোনো তরুণী অকারণ বেদনায় কাতর হয়ে রবিঠাকুরের কবিতা-গান নিয়ে নাড়াচারা করে না। রবিঠাকুর তাই সে যুগে মধুগঞ্জে অচল।

ঠিক সেই কারণেই প্রকৃতির সৌন্দর্যবোধ মধুগঞ্জে মদনভম্মের মত শহরের সবত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ এখানকার লোক নববরষশে ময়ূরের মত পেখম তুলে নাচে না, আবার উত্তরের পাহাড় পেরিয়ে দলে দলে নবীন মেঘ এসে যখন শহরের (জেনের উপর আহার খেয়ে পড়ে তখও মানুষ সেখানে বর্ষার মধুর) দিকটা সম্বন্ধে অচেতন হতে পারে না, আর হবেই বা কী করে? প্রথম যেদিন মধুগঞ্জে কদম ফুল ফোটে সেদিন তার গন্ধে সমস্ত শহর ম-ম করতে থাকে। সে গন্ধে নেশা আছে–রায়বাহাদুর চক্রবর্তীর মত রসকষহীন মানুষেকেও দেখা যায় বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় একড়াল কদম হাতে নিয়ে ফিরছেন।

কিন্তু পূর্ব-বাঙলা-আসামের সায়েবরা বর্ষাকালে প্রায় পাগল হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা বাগানের ছোট ছোট টিলাতে নির্জন বাসে থাকতে বাধ্য হয়। পাঁচ মাইলের ভিতরে একটা ইংরেজ নেই যার সঙ্গে দুটি কথা বলতে পারে, দিনের পর দিন অনবরত বৃষ্টি, রাস্তা-ঘাট জলে-জোয়ারে ভেসে গিয়েছে, ক্লাবে যাবার কথাই ওঠে না। শেষ পর্যন্ত গ্রামোফোন বাজানো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। হিসেব নিয়ে দেখা গিয়েছে বেশীর ভাগ সায়েবরাই এই সময় দেশী রমণী গ্রহণ করে। কেউ কেউ ম্যালেরিয়ায় তাদের শুষি লাভ করে সেরে উঠার পর, আর কেউ কেউ একটানা নির্জনবাসের ফলে হন্যে হয়ে গিয়ে।

ও-রেলির মাথার ইপগুলো জোর টাইট করে বাসানো। বর্ষা তাকে কাবু করতে পারে না। তার উপর মেবুও পাশের চেয়ারে বসে।

তবু বোঝা গেল, এ বর্ষা ও-রেলিকে পর্যন্ত অনেকখানি ঘায়েল করে দিয়েছে। ও-রেলি মুষড়ে পড়েছে।

.

০৭.

মাদামগুরের বড় সাহেব বললেন, এ কথাটা আমি কী করে বিশ্বাস করি বলো তো, পার্সি। মেব্‌ল্‌ মিশুকে হোক আর না-ই হোক, ওর মত ডিসেন্ট গার্ল আমি জীবনে অল্পই দেখেছি। কলেজ পর্যন্ত পড়েছে, উত্তম রুচি। সে কী করে অতখানি স্টুপ করবে? তুমি ছাড়া অন্য কেউ এ কথাটা বললে তার সঙ্গে আমার হাতাহাতি হয়ে যেত।

বিষ্ণুছড়ার সায়েবের বয়স যদিও কম তবু এ অঞ্চলে তার খ্যাতি-প্রতিপত্তি বিচক্ষণ লোক হিসাবে। আর পরচর্চা, গুজোব রটানো থেকে তিনি থাকেন সব সময়েই দূরে এবং আশ্চর্য, যারা এসব জিনিসে কান দেয় না পাকা খবর তারাই পায় বেশী এবং আর সকলের আগে। বললেন, আমার কাছে এখনো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমাকে তো বললুম, কিছুটা বিশ্বাস না করলে তোমার কাছে আমি কথাটা পাড়তুম না। অবশ্য একথাও আমি বলব, এসব জিনিস আমি শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস করারই চেষ্টা করি।

তোমার মেম, মীরপুরের মেম, এরা সব জানতে পেরেছে?

নিশ্চয় এখন পর্যন্ত না। শার্লট জানতে পারলে আমাকে রাত তিনটেয় জাগিয়ে খবরটা দিত এবং সঙ্গে সঙ্গে মীরপুর ছুটত এমিলিকে টেক্কা মারবার জন্য–অ্যাণ্ড ভাইস ভার্সা। তবে খুব বেশী দিন গোপন থাকবে না। সত্যই হোক আর মিথ্যেই তোক যে-সব মেয়েরা মেলের রুচিশীল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেদের ছোট মনে করত তাদের জিভের ললকানি খুব শিগগিরই আরম্ভ হয়ে যাবে।

সন্ধ্যের পর টেনিস লনের এক কোণে বসে দুই সায়েব অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে ভাবলেন। মধুগঞ্জ অঞ্চলের ইংরেজ কলোনির আসল সর্দার এরাই। বিষয়টি তারা আলোচনা করেছিলেন সেই কর্তব্যবোধ থেকে–এ সম্বন্ধে তাঁরা কিছু করতে পারেন কি না।

শেষটায় মাদামপুর হুঙ্কার দিলেন, বয়, দো ব্রা পেগ।

খবর কিংবা গুজোব যাই হোক, ব্যাপারটা মারাত্মক–গড ড্যাম সিরিয়স–মেব্‌ল্‌ নাকি নেটিভ বাটলারটার প্রতি অনুরক্ত।

ঐ মিশকালো, অষ্টপ্রহর মদে-মাতাল-রাঙা-চোখওলা হোঁতকা লোকটার প্রতি মেব্‌ল্‌ অনুরক্ত একথা কে বিশ্বাস করবে? একমাত্র শ্রীচরিত্র দেবতারাও জানে না তত্ব মানলে সব কিছুই বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু এই সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য স্ত্রী-নিন্দার সামনে দাঁড়িয়ে বরঞ্চ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে যায় দেবতারা না হয় দেবীদের চরিত্র চিনতে পারেননি, তাই বলে পুরুষকেও তার স্ত্রী-জাত সম্বন্ধে এই অজ্ঞতা মেনে নিতে হবে এবং মেনে নিয়ে স্ত্রী-জাতকে অপমান এবং নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে লাঞ্ছনা করতে হবে?

কিন্তু এসব তো পরের কথা। প্রথমেই যেটা মনে আসে সেইটেই মাদামপুরের বড় সায়েব বিষ্ণুছড়াকে বললেন- হাতাহাতি হয়ে যেত। তারপর হুড়হুড় করে মনে আসে একসঙ্গে দশটা প্রতিবাদ; ও-রেলির মত সুপুরুষকে ছেড়ে? এক বৎসর যেতে না যেতে? ও-রেলির এতখানি আদর-যত্ন পেয়েও? ও-রেলি কি তবে জানে না?

ঠাণ্ডা মাথা মাদামপুর বললেন, পার্সি, তবে কি তারা পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে?

বিষ্ণুছড়া একটুখানি ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু মেলামেশাটা বজায় রাখলেই তো মানুষের সন্দেহ হ’ত কম।

মাদামপুর দুই ঢোকে ডবল হুইস্কি খতম করে বললেন, মাই গড, নেটিভরা জানতে পারলে লজ্জার সীমা থাকবে না। ওঃ!’

তা ঠিক, তবে কি না জিনিসটা যখন চাবাগিচার ভিতরে আগেও হয়েছে তখন–

মাদামপুর বাধা দিয়ে বললেন, সে হয় শহর থেকে দূরে, বনের ভিতর, টিলার উপরে।

সে কথা ঠিক, কিন্তু পাদ্রী-টিলার বাচ্চারা কোথা থেকে আসে সে তত্ত্বও তো নেটিভদের অজানা নয়।

মাদামপুর একটুখানি অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, সে তো সাধারণভাবে, যে রকম ধরো অনাথাশ্রম হয়ে। কিন্তু এখানে সে ব্যক্তিবিশেষ, সমাজ যাকে চেনে। তা আবার এ, এস, পির মেম! মাই গড। আমি ভাবতুম, পুরুষরা এ-সব ঢলাঢলিতে যতখানি নিচু হতে পারে, স্ত্রীলোকেরা ততখানি পারে না।

দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। দেখা গেল বিষ্ণুছড়া আর মীরপুরের মেম আসছেন। সাপে নেউলে গল্প করতে আসছেন এ জিনিস প্রাণিজগতে কখনোই দেখা যায় না। দুর থেকে দেখে মনে হয় যেন এক লেঙ্গোটার ইয়ার–উহুঁ, এক ফ্রকের সই। অথচ এঁরা আসছেন ইনি ওঁকে ছোবল মারতে মারতে, উনি এঁকে কামড় দিতে দিতে। চোখ লাল না করে, দাঁত না খিঁচিয়ে, ফণা না বাগিয়ে ঝগড়া করতে পারে একমাত্র মানুষই–অবশ্য স্ত্রীলোকেরাই পায় মাইকেল ও-রেলি শীল্ড-পুরুষের কপালে কনসোলেশন প্রাইজ।

গুজোবটা ছড়াতে কত দিন লেগেছিল বলা শক্ত। গুজোবের স্বভাব হচ্ছে যে, প্রথম ধাক্কাতেই সে যদি কিছুটা সাহায্য না পায়, তবে কেমন যেন দড়কচ্চা মেরে যায়। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে মাদামপুর আর বিষ্ণুছড়া যদি সেটার টুটি চেপে না ধরতেন, তবে কী হত বলা যায় না; এ স্থলে গুজোবটাকে ফের চাঙ্গা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশ একটুখানি সময় লেগেছিল।

মধুগঞ্জে ‘আণ্ডা-ঘরে’ গুজোব-মাত্রেরই জন্মমৃত্যু জরা-যৌবনের বেশ একটা সুনির্দিষ্ট ঠিকুজি আছে। পুজোবের জননী যদি মীরপুরের ছোট মেম হন, তবে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। অবশ্য জানা কথা, বিষ্ণুছড়ার বড় মেম তখন আঁতুড়ঘরেই বাচ্চাটাকে নুন খাইয়ে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেন এবং আরো জানা কথা, বেশীর ভাগ স্থলেই বাচ্চা যেত। ঘোত করে নুনটা খেয়ে ফেলে দিব্য ট্যা-ট্যা করে দুধের জন্য আপন ক্ষুধা জানিয়ে দেয়। তার কারণ বিষ্ণুছড়ার বড় মেম পাঠা কাটতে চান তার পদমর্যাদার ভার দিয়ে তিনি বড় মেম, মীরপুর ছোট মেম–আর মীরপুর কাটে ধার দিয়ে। তার উপর ক্লাবে ছোট মেমদের সংখ্যা বেশী, কাজেই তারা সদলবল সায় দেয় মীরপুরের কথায় কথায়–হ্যায়, কলমাকস্ যদি আণ্ডা-ঘরে একটা টু মেরে যেতেন, তবে তিনি পতি বুর্জুয়ারী আর অৎ বুর্জুয়াজীর আড়াআড়ি সম্বন্ধে কত তত্ত্বকথা না রপ্ত করে যেতে পারতেন।

আবার বিষ্ণুছড়া যদি কোনো গুজোবের গডমাদার হন তবে সে বেচারীকে ষষ্ঠী-পুজোর দিন পর্যন্ত বাঁচতে হয় না।

মেব্‌লের সৌভাগ্য বলতে হবে যে, তার সম্বন্ধে গুজোবটা বিষ্ণুছড়া ক্লাবে বাপ্তি করেছিলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই মীরপুর বললেন, এ গুজোব তার কানে এসেছে বহুদিন হ’ল। তিনি এটা একদম বিশ্বেস করেননি। ও-রেলি বিপ্লবীদের পিছনে লেগেছে বলে নেটিভরা হিংসেয় এইসব আজগুবি যাচ্ছেতাই কেচ্ছা রটাচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। সে ময়না তদন্তে মেলের গোপনতম অস্ত্রবস্ত্রের সাইজ, রঙ কিছুই বাদ পড়ল না। সেদিন কিন্তু আরেকটু হলে মীরপুরই লড়াইয়ে হেরে যেতেন, কারণ দেখা গেল মেবলের সৌন্দর্যে হিংসুটে খাটাসমুখোগুলো পাইকারি হিসেবে জুটেছে বিষ্ণুছড়ার পিছনে। আরেকটু হলে মীরপুরকে রণে ভঙ্গ দিতে হত, কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তার ফিফথ কলাম জুটে গেল, বিষ্ণুছড়ার বড় সায়েবের সাহায্যে।

এ-সব কেলেঙ্কারি-কোদল মেমেরা করে সায়েবদের বাদ দিয়ে। আজকের আলোচনা কিন্তু এতই তপ্ত গরম হয়ে উঠেছিল যে, বিষ্ণুছড়ার বড় সায়েব যে কখন এসে একপাশে দাঁড়িয়েছেন কেউ লক্ষ্য করেনি।

হঠাৎ এক সময় তার স্ত্রীর কথা কেটে দিয়ে বললেআন, শার্লট, তুমি যে কথা বলছ সেটা কি খুব রুচিসঙ্গত?।

তারপর আর পাঁচজনের একটুখানি বাও করে, আপনারা আমাকে মাফ করবেন, বলে আস্তে আস্তে বাইরে চলে গেলেন।

সবাই থ। একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বরঞ্চ বিষ্ণুছড়া তার খাণ্ডার মেমের কথার প্রতিবাদ না করে কোট-পাতলুন ফেলে দিয়ে আখেলার টেবিলের উপর ধেই ধেই করে নেচে নেচে ধর্মসঙ্গীত গাইতে আরম্ভ করতেন তবু আণ্ড-ঘর এতখানি আশ্চর্য হত না, কারণ এ অঞ্চলে সবাই জানে, বিষ্ণুছড়া তার মেমকে ডরান কুলীদের স্ট্রাইকের চেয়েও বেশী। তাঁর যে এতখানি দুঃসাহস হতে পারে সেকথা সম্পূর্ণ কল্পনাতীত। সবাই থ। না, ধ নয়–একেবারে দ, ধ, দন্ত্য ন–বর্ণমালার শেষ হরফ পর্যন্ত।

সম্বিতে ফেরার পর মীরপুরের ছোট মেম ফিসফিস করে এস. ডি. ও’র মেমকে বললেন, নিশ্চয়ই এক জালা হুইস্কি খেয়েছে, বাঘের চর্বির সঙ্গে ককটেল বানিয়ে।

এস. ডি. ওর মেমের সরসিকারূপে খ্যাতি ছিল। ক্লাব থেকে বেরতে বেরতে বললেন, হ্যাঁ, একটা ছবিতে দেখছিলুম, হুইস্কির পিপে থেকে ছ্যাদা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হুইস্কি চুঁইয়ে বেরচ্ছে। এক ইঁদুরছানা সেইটে চুকচুক করে চুষে হয়ে গিয়েছে বেহেড। মাতাল। লাফ দিয়ে পিপের উপর উঠে আস্তিন গুটিয়ে চিৎকার করে বলছে, ঐ ড্যাম ক্যাটটা গেল কোথায়? নিয়ে এসো এইখানে আমি ব্যাটার সঙ্গে লড়ব।

মীরপুর বললেন, ভালো গল্প; টমকে বলতে হবে। আপিসের কাউকে ডিসমিস করতে হলে সেই সাত-ছটার সময় হুইস্কি খেয়ে আপিস যায়।

এস, ডি, ওমেম বললেন, আজ রাত্রে বেচারী পার্সির ডিনার জুটবে না। ওকে পট লাকে নেমন্তন্ন করলে হয় না? হঠাৎ কথা বন্ধ করে বললেন, ঐ দেখো, পার্সিকে ফেলে বেটি মোটর হাঁকিয়ে বাড়ি রওয়ানা হয়েছে। এই বয়সে পার্সি বেচারীর কী করে টাক হ’ল বুঝতে কষ্ট হয় না। তালুতে যে কুল্লে আড়াইখানা চুল আছে সেগুলোও আজ রাত্রে ছেঁড়া যাবে।

মীরপুর ততক্ষণে আপন ভাবনায় ডুব দিয়েছেন। গুজোবটা তিনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু এই যে বিষ্ণুপুরের বড় সায়েব জিনিসটাকে এত সীরিয়াসলি নিলে যে মেমকে পর্যন্ত ধমকে দিলে তবে কি?–কে জানে?

গুড নাইট।

গুড নাইট।

.

০৮.

আট বিষ্ণুছড়া আণ্ড-ঘরে গুজোবটার উপর যে বম-শেল ফাটিয়েছিলেন তার ধুয়ো কাটতে কাটতে কেটে গেল পুরো তিনটি মাস। তার সাহসকে পুরস্কার দেবার জন্যই বোধ করি গুজোবটাকে মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো হ’ল সায়েবের উপর চটে গিয়ে বিষ্ণুছড়ার মেমও হপ্তা তিনেক ক্লাবে হাজিরা দেননি-ও নিয়ে বহুদিন ক্লাবে আর কোনো আলোচনা হল না। আর যত বড় রগরগে খবর কিংবা পরনিন্দা, পরচর্চাই হোক মানুষ এক জিনিস নিয়ে বেশীদিন লেগে থাকতে পারে না। পারলে কোনো ছেলেই পরীক্ষায় ফেল হত না, কোনো অবিষ্কারই অনাবিষ্কৃত হয়ে থাকত না। ইংরেজিতে এই মনোবৃত্তিরই নাম, গ্রাসহপার মাইও’, প্রতি মুহূর্তে হেথায় লম্ফ, হোথায় ঝম্ফ। ইতিমধ্যে আবার লাকাউড়া বাগিচায় একটা খুন হয়ে গেল। কলি-সদরের ডপকা বউ- মিস লাকাউড়া ডিস্পেনসারির কম্পাউণ্ডারের সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামো করছিল বলে সে তার গলাটি কেটে গামছায় বেঁধে থানায় নিয়ে গিয়ে স্বহস্তে পেশ করেছে। পথে পড়ে চ্যাঙের খাল, তার সঁকোতে এক-এক পয়সা করে পোল ট্যাক্স দিতে হয়। সর্দারকে বাধা দিতে সে বললে, সরকারী কাজে থানায় যাচ্ছে, তার ট্যাক্সো লাগবে না।

কি সরকারী কাজ?

সর্দার গামছা খুলে মুণ্ডুটা দেখালে। সবাই নাকি দেখামাত্র পরিত্রাহি চিৎকার করে চুঙ্গীঘরের দরজায় হুড়কো মেরে জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তুই শিগগির যা, তোর ট্যাক্সো লাগবে না, এ সত্যই বড্ড জরুরী সরকারী কাজ।

সর্দার নাকি এদের ভয় দেখে একটুখানি তাজ্জব বনে গিয়েছিল। ধীরে সুস্থে মুণ্ডুটা ফের গামছায় বেঁধে হেলে দুলে থানার দিকে রওয়ানা দিয়েছিল।

ম্যাজিস্ট্রেট মরতুজা সাহেবের এজলাসে যখন সর্দার দাঁড়ালে তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই মেয়েটাকে খুন করতে গেলি কেন?

সর্দার বললে, করবা না? বেটি আমাকে বললে, দেখো সর্দার, আমার উপর তুই যদি চটে গিয়ে থাকিস তবে আর কোনো মেয়েছেলেকে নে না, এই দুনিয়াতে আমিই তো একহ-ই-ঠো লড়কী নই। আর তোকে যদি আমার ভালো না লাগে তবে তুইও তো একহ-ই-ঠো মর্দ নস; তুই বেছে নে তোর-টা, আমি বেছেনি হামার-ঠো। ঐসী বেতমীজ? হারামজাদী আমার মুখের উপর এইরকম বেশরম বাত বললে। তাকে খুন করে আমি সরকারী কাম করেছি, হুজুর। আমাকে এরা বেহ হাজতে পুরে রেখেছে, আপনিই বলুন হুজুর।

ম্যাজিস্ট্রেট সর্দারকে দায়রায় সোপর্দ করার সময় সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে ইংরিজিতে বললেন, দেয়ার ইজ এ লট অব টুথ ইন ওয়াট দি গার্ল সেড। ঐ খুঁটি কথাটি মেনে নিলে পৃথিবীতে খুনের সংখ্যা অনেক কমে যেত।

এই নিয়ে ক্লাব মেতে রইল খুনের খবর পৌঁছানোর থেকে সর্দারকে চোদ্দ বছর জেল পর্যন্ত। তারপর এই লাকাউড়া বাগিচার ছোট সায়েব করলে আত্মহত্যা। কেন করল তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউ বললে, দেশে যে মেম সায়েবের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি ছিল সে নাকি আর কোরো সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছে, কেউ বলে, সায়েব যে এদিকে এক কুলি-রমণীর কৃষ্ণালিঙ্গনে চব্বিশ ঘন্টা চুর হয়ে থাকত সেই খবর শুনে সে রমণী অন্য পুরুষ খুঁজে নিয়েছে, কেউ বললে, তিনমাসব্যাপী ঝাড়া বাদলের ঠেলায় টিলার নির্জন বাসে খেপে গিয়ে মদ ধরে–তাও আবার কলীদের ধান্যেধরী–তারপর দিবা-রাত্তিরেও সে মদের নেশায় ছ-ঠ্যাঙওলা বাঘের দিকে সে অনবরত গুলী ছুঁড়তে থাকে, শেষটায় বাঘ নাকি তার মাথার ভিতর ঢুকে যায়, চিৎকার করে সেই ফরিয়াদ জানাতে জানাতে একদিন সেই বাঘকে আপন কানের ভিতর দিয়ে পিস্তলের গুলী চালিয়ে খুন করে।

ততদিন ও-রেলিদের কথা প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে। ক্লাব যখন গুলজাবের তাড়িতে মত্ত তখন ও-রেলির বংশধর জন্মের খবর পৌঁছল পানসে শরবতের মতো। কেউ সামান্য চাখলে,অর্থাৎ জিঞ্জেস করলে, তাই নাকি, কবে হ’ল? কেউ সামান্য ভুরু কোঁচকালে। মুরুব্বিরা বললেন, ভালোই হয়েছে, বাচ্চাই অনেক সময় বাপ মায়ের মাঝে সেতু হয়ে দুজনাকে এক করে দেয়।

শুধু বিষ্ণুছড়ার মেম বাঁকা হাসি হেসেছিলেন।

সে হাসির অর্থ, বলা কিছু শক্ত, কারণ এটা ব্যক্ত–দু জাহজের মাঝখানে তা পেতে যেমন এ-জাহাজে ও জাহাজে জোড়া লাগানো যায় টিক তেমনি ঐ তক্তা তুলে ধাক্কা মেরে দু নৌকার মাঝখানের দূরত্ব বাড়িয়েও দেওয়া যায়।

পয়লা বাচ্চার ব্যপ্তিস্ম করার সময় ক্যাথলিকরা ধূমধড়াক্কা করে বাঙালী ঠাকুরদার পয়লা নাতির অন্নপ্রাশনের চেয়েও বেশী। মেবল্‌ কিন্তু সবকিছু সারাতে চেয়েছিল সাদামাটাভাবে। ও-রেলি দেখা গেল ঠাকুরদা গোত্রের। সে চায় পালা পর করতে। ওদিকে পাদ্রী জোনস সাহ্বে প্রটেস্টানট তিনি ক্যাথলিকের বাচ্চাকে বাপ্তিস্ম করবেন কী করে? এ যেন পাড় বোষ্টমের ছেলেকে শাক্ত দিচ্ছে মদীক্ষাশানে মড়ার উপর মুখোমুখি বসে মড়ার খুলিতে কারণ-ভর্তি-হাতে! ও-রেলি কিন্তু জোনসকেই অনুরোধ করলে বাপ্রিশ্মের তাবৎ ব্যবস্থা করতে।

গড ফাদার অর্থাৎ ধর্মপিতার অভাব মধুগঞ্জে হত না। মাদামপুরের বড় সায়েব, ডি, এম, যে-কেউ আনন্দের সঙ্গে রাজী হতেন, পুয়োর ডেভিল-বেচারা–একলা একলি মনমরা হয়ে থাকে, ঔটুকুতে যদি সে খুশি হয় তবে হোয়াই নট-নিশ্চয়ই অফ কোর্স অবশ্যি, অতি অবশ্যি। কিন্তু ওদিকে দেখা গেল, ওবেলি পাড় ক্যাথলিক ক্যাথলিক বাচ্চার গডফাদার হবে প্রটেস্টানট। মন্ত্র যে খুশি পড়াক, বাপ্তিস্ম যে খুশি করুক, সে তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার; কিন্তু ধর্মকাপ তামাম জীবনের। সেখানে প্রটেস্টানট হলে চলবে কেন? কলমা যে খুশি পড়াক কিন্তু মুরশীদ ধরার সময় দেখে বেছে নিতে হয়।

ও-রেলি পরিবার বাদ দিলে মধুগঞ্জে আছে মাত্র একজন ক্যাথলিক–বাটলার জয়সুর্য। ও-রেলিদের মতই এক্কেবারে খাঁটি। ওবেলি বললে, সেই হবে ধাপ। শুনে পাদ্রী সায়েব পর্যন্ত অনেক যদি অনেক কিন্তু অনেক ইউ নো হোয়াট আই মীন অনকে বাট অফ কোর্স বলে ইতি-উতি করে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন, এমনকি, কলকাতা থেকে তার পরিচিত ভুদ্র ক্যাথলিক আনাবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু, ও-রেলি একদম নেই-আঁকড়া,বলে ধর্মের চোখে সব ক্যাথলিকই বরাবর–পোপ যা, জয়সূর্যও তা।

ও-রেলির কথার কোনো জমা-খরচ পাওয়া গেল না। বাপ্তিস্মর বেলায় সে দিলদরিয়া-হেরেটিক প্রটেস্টানটই সই অথচ ধর্বাপের বেলা সে কট্টর-ক্যাথলিক না হলে জর্ডনের জল অশুদ্ধ হয়ে যাবে। তখন বিদেশী ঠাকর ছেড়ে দেশের কুকুর। ওদের ভাষায় বলতে হলে মাই রিলিজিয়ন রাইট অর রঙ, মাই মাদার ড্রাঙ্ক অর সোবার।

হ্যাঁ, ড্রাঙ্ক অর সোবার কথাটা ওঠাতে ভালোই হ’ল। জয়সূর্য পৃথিবীর আর পাঁচ লক্ষ বাটলারের মত অধিকাংশ সময়ই থাকে ড্রাঙ্ক আর সোবারের মাঝখানে। আর মোকা পেলেই গুত্তা খেয়ে ড্রাঙ্কের দিকেই কাত। অবশ্য তাকে গডফাদার হতে হবে শুনে তমুহূর্তেই বেচারার নেশা কেটে গিয়েছিল। গবেটের মত বিড়বিড় করে কী একটা বলতে গিয়ে খেল ও-রেলির ধমক আর কড়া তম্বি,–অন্তত পরবের দিনটায় যেন সাদা চোখে গির্জায় যায়।

সে এক বিচিত্র বাপ্তিস্ম। মেবল্‌ দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতে অল্প অল্প কাঁপছে, ও-রেলি পাথরের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে, পাত্রী সায়েব নার্ভাস, আর জয়সূর্য তার বরাবরের গিঞ্জের পোশাক পরে বিহ্বলের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সবাই ভাবলে, ব্যাটা আজ টেনে এসেছে।

একমাত্র সোমই ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছুর তদারক করলে। পাদ্রী-টিলার মেয়েদের বেশীর ভাগই জয়সূর্য জাতের পরবের উৎকট দিকটা শুধু তাদেরই চোখে ধরা পড়ল না।

বাপ্তিস্মের পরই কিন্তু গির্জে থেকে বেরিয়ে জয়সূর্য না পাত্তা। সন্ধ্যের সময় সোম তাকে খুঁজে বের করল উজান গাঙের ঘাটে বাধা এক নৌকোর ভিতর। দু বোতল ধান্যেশ্বরী শেষ করে বুঁদ হয়ে বসে আছে।

সব খবরই আণ্ডা-ঘরে পৌঁছল।

বিষ্ণুছড়ার মেম বললেন, ডিসগ্রেসফুল।

মাদামপুর তার অন্তরঙ্গজনকে বললেন, থাক। এবার থেকে ওদের আর একদম ঘেঁটিও না। কাট দেম একদম ডেড। কী যে হল, কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনে।

দিশী কথায় বলে, ঐ বুঝলেই তো পাগল সারে।

.

০৯.

মুসলমান শাস্ত্রে বর্ণনা আছে, লাশ গোর দিয়ে লোকজন চলে আসার পর গোরের ভিতর কী কাণ্ড-কারখানা হয়।

কুরানে স্পষ্ট বলা আছে, ইয়োম-উল-কিয়ামত–অর্থাৎ প্রলয়ের দিন সবাইকে আল্লাতালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি তখন সকলের বিচার করে ধার্মিককে পাঠাবেন স্বর্গে আর পাপীকে নরকে। এখন প্রশ্ন, কিয়ামত কবে হবে তার তো কোনো হদিস পাওয়া যায় না, এই মুহূর্তেই হতে পারে আবার এক কোটি বৎসর পরেও হতে পারে–ততদিন অবধি গোরের ভিতর মরাদের কী গতি হয়?

কুরান নয়–অন্য শাস্ত্রে বলে,–গোর দিয়ে আত্মীয়স্বজন চল্লিশ পা চলে আসার পর দুই ফিরিস্তা–দেবদূত–গোরের ভিতর ঢুকে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার ইমান (ধর্মত) কী? সে যদি খাঁটি মুসলমান হয় তবে তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে, আল্লা এক, আর মুহম্মদ (দঃ) তাহার প্রেরিত পুরুষ। ফিরিস্তারা উত্তর শুনে খুশি হয়ে বলেন, তোমার ইমান ঠিক, কিন্তু এখনো তো কিয়ামতের কিছু দেরি আছে। ততক্ষণ অবধি এই নাও এক গাছা তসবী। আল্লার নাম স্মরণ করো। তারপর শাস্ত্র বলে, লোকটি খুশি হয়ে তব্বী হাতে নিতেই তার সুতোটি ছিঁড়ে গিয়ে তদ্বীর দানাগুলো কবরময় ছড়িয়ে পড়বে। সে তখন ব্যস্ত হয়ে দানাগুলো কুড়াতে না কুড়োতে দেখবে, কিয়ামতের শিঙে ফুকে উঠেছে–ছুটে গিয়ে আল্লার সামনে দাঁড়াবে আর সকলের সঙ্গে সারি বেঁধে।

আর যদি সে পাপাত্মা হয় তবে সে ইমান বলতে পারবে না। ফিরিস্ততারা তখন তাকে ধুনুরীরা যেমন তুলোর ভিতর যন্ত্র চালিয়ে দেয় ঠিক তেমনি তার সর্বসত্তা ছিন্নভিন্ন করে দেবেন–তুলোর মত সে বিশ্ব ব্রাহ্মাণ্ডময় ছড়িয়ে পড়বে। আবার সব কটা টুকরো জুড়ে দিয়ে ফিরিস্তারা আবার ঐ প্রক্রিয়া চালাবেন। পাপীর মনে হবে, এ যন্ত্রণা যেন যুগ যুগ ধরে চলছে।

অথচ পুণ্যাত্মারা হয়তো মরেছিল কিয়ামতের এক লক্ষ বৎসর পূর্বে; পাপাত্মা মরেছিল কিয়ামতের এক সেকেণ্ড আগে।

অর্থাৎ পুণ্যাত্মার বেলা আল্লা এক লক্ষ বৎসরকে তার চৈতন্যের ভিতর এক সেকেন্ডে পরিণত করে দেবেন, আর পাপাত্মার বেলা এক সেকেণ্ডকে লক্ষাধিক বৎসরে।

আজকের দিনের ভাষায় তুলনা দিতে বলা যেতে পারে পুণ্যাত্মার বেলা যেন তিন মিনিটের রেকর্ডের গতিবেগ বাড়িয়ে এক সেকেণ্ডে বাজিয়ে দেওয়া হ’ল, পাপাত্মার বেলায় সেই রেকর্ডই বাজানো হল এক ঘণ্টা ধরে।

তাই বোধ হয়, হিন্দু পুরাণেও আছে, নরের এক লক্ষ বৎসরে ব্রহ্মার এক মুহূর্ত।

কিন্তু এ কি শুধু মৃত্যুর পরই? জীবিত অবস্থায়ও তো ঐ-ই। মিলনের শত বৎসর মনে হয় এক মুহূর্ত, আর ক্ষণেক আড়ালে বারেক দাঁড়ালে মনে হয় লাখ লাখ যুগ ধরে সে যেন কোন সুদুরে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে।

মোতির মালা গল্পে তাই দীর্ঘ কুড়ি বৎসরের দুঃখ-দুর্দৈবের বর্ণনা মোপাসাঁ দিয়েছেন দশ ছত্রে আর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনীর তিনদিন মেয়াদের বর্ণনা দিয়েছেন ঝুগো পুরো একখানা কেতাব লিখে।

বাপ্তিস্ম-পরবের পর চার বৎসর কেটে গিয়েছে। এ চার বৎসর মেবল্‌ ডেভিডের কেটেছে তসবীর দানা কুড়োতে কুড়োতে না তুলোধুনো হয়ে হয়ে–তার খবর দেবে কে? কাজলধারা নদীর মত নিরবধি তাদের জীবনগতি সমুখ পানে ধেয়ে চলেছিল, না সামনের নীলপাথরী পাহাড়ের মত স্থাণু হয়ে পড়েছিল তাই বা বলবে কে? মধুগঞ্জ শুধু দেখল, যে বারান্দায় সায়েব আর মেম বসে থাকত, বাটলার রেকর্ডের পর রেকর্ড বদলে যেত সেখানে একটি চতুর্থ প্রাণী প্রথম দোলনায় শুয়ে তারপর পেরেম্বুলেটারে বসে এবং সর্বশেষে টলমল হয়ে হেঁটে হেঁটে বারাটাকে চঞ্চল করে তুলত। যেখানে আর দুটি প্রাণী–জয়সুর্যকে ধরলে কখনো বা তিনটি–আপন আপন আসনে ধ্যানমগ্ন সেখানে এই নুতন প্রাণীটির আনাগোনার অন্ত নেই। কখনো সে মেবলের কোলে মাথা গুঁজে দুটি খুদে হাত দিয়ে তার উরু জড়িয়ে ধরে, মে তার কালো চুলের ভিতর দিয়ে আঙুল চালিয়ে দেয়, কখনো সে ডেভিডের আস্তিন ধরে টানাটানি আরম্ভ করে, তখন সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর কখনো বা জয়সুর্যের গলা জড়িয়ে ধরে তার কাছ থেকে লেখা গান ধরত–

ক্‌-ক্‌-ক্‌-কেটি, হুয়েন দি ম্‌-ম্‌-ম্‌-মুন শাইনস্‌–

একমাত্র ওরই জীবনে এখনো তসবী, ধনুরী কেউই আসেনি। সময় কী বস্তু সে এখনো বোঝেনি-টেকোর ভয় নেই উকুনের।

বাচ্চা প্যাট্রিকের চতুর্থ জন্মদিনে ও-রেলিরা স্থির করলে মেবল্‌ বাচ্চাকে নিয়ে বিলেত চলে যাবে, সেখানে বাসা বেঁধে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করবে। মধুগঞ্জের ইস্কুল দিশীর কাছে অক্সফোর্ডসম হতে পারে, কিন্তু সায়েবের বাচ্চা যদি সেখানে ট্যাশ উচ্চারণ শেখে তবেই চিত্তির। বড় হয়ে সে বাপ-মাকে প্রতি সন্ধ্যায় অভিসম্পাত না দিয়ে উইস্কি-সোডা স্পর্শ করবে না, সে যে ইয়োরেশিয়ান নয়, সেকথা বোঝাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হবে,বোঝাবার মোকা না পেলে সেই মর্মে ডুবে মরতে হবে। টমাস কুক, অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস, আর দুনিয়ার যত জাহাজ কোম্পানীর ছবির বিজ্ঞাপন, চটি বই, জাহাজের টাইম-টেবিল ওবেলির বারান্দা ভরতি হয়ে গেল। হিন্দিতে বলে :

বাঘ কা ভাই বাঘেরা
কুপে পাঁচ তো কুদে তেরা

বাঘ যদি দেয় পাঁচ লম্ফ, তবে তার ভাই বাঘেরা মারে তেরাটা। বাঙলায় প্রবাদ ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। অর্থাৎ যাত্রী যদি কোম্পানিকে লেখে,আমি লণ্ডন যাব, তবে তারা যে শুধু ঐ জাহাজেরই খরওয়ালা চটি বইই পাঠায় তাই নয়, সঙ্গে পাঠায় আরেক হন্দর পথিক দিক-দর্শন–তাতে আছে নরওয়ের ফিয়োর্ডে যেতে হলে কোন জামাকাপড় অপরিহার্য, মধ্য আফ্রিকায় উট চড়তে হলে আগেভাগে ইনক্রোশন নিতে হয় কি না। ফলে এই পর্বতপ্রমাণ কাগজপত্রের মাঝখানে বিলাতগামী জাহাজের বিশল্যকরণী খুঁজে বের করা হনুমানের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। ও-রেলি সেই অষ্টাদশ পূর্বে উদয়াস্ত ডুব মেরে পরে রইল।

সোম এসেছিল একদিন সরকারী কাজে। কাগজপত্রের ডাঁই দেখে শুধালে, স্যার, গুষ্টিসুদ্ধ নর্থপোলে চললেন নাকি? এর চেয়ে অল্প দুলিল-দস্তাবেজ তো কিংবা শনিতে ভ্রমণ করে আসা যায়।

ও-রেলি এক তাড়া কাগজ সোমের দিকে ছুঁড়ে ফেলে বললে, মঙ্গল–শনির কথা বলতে পারিনে, কিন্তু নর্থপোলে যেতে হলে এসবের দরকার হয় না। সেখানে যাবার জন্যে কোনো স্টীমার-সার্ভিস নেই। আন্ত জাহাজ চার্টার করতে হয়। সেখানে ঠিক তার উলটো। কত সব অলটারনেটিভ দেখো। বোম্বাই থেকে জাহাজ ধরবে,না কলম্ব থেকে কিংবা মাদ্রাজ থেকে? পি, এণ্ড, ও, নেবে না মার্কিন জাহাজ, না জর্মন? ফরাসীও নিতে পারো–জাহাজগুলো বড় নোংরা কিন্তু রান্না ভারী চমৎকার। তুমি কি একটা প্রবাদ বলো না, দি ডোম ইজ ব্ল্যাইও ইন দি ব্যান্ডু-জাঙ্গল? আমার হয়েছে তাই।

বহুকাল পরে সায়েবের তাজ-দিল দেখে সোম খুশি হ’ল। বললে, তাহলে সায়েব, অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্ণইটদি বো ষ্টিং টুডে-অর্থাৎ সবচেয়ে সস্তা জাহাজ নিলেই হয়।

ও-রেলি বললে, দেখো সোম, আমাকে আর ধাপা দেবার চেষ্টা করো না। গোড়ার দিকে কিছু জানতুম না বলে তুমি তোমার আপন মাল গুড় ওড় ইণ্ডিয়ান উইজডম বলে পাচার করেছ বিস্তর। এখন আর সেটি চলছে না। আমার পনচা-টাণ্ট্রা, হিটোপডেস পড়া হয়ে গিয়েছে। ধনুর ছিলে খেতে গিয়ে তোমারই শেয়ালের কী হয়েছিল মনে আছে?

সোম ইস্কুলের ছেলেদের ভঙ্গীতে তড়াক করে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললে, খুব মনে আছে, স্যর! ছিলে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তা যাবে না? আপনারই তো বলেন, ডিম না ভেঙ্গে মমলেট বানানো যায় না।

ও-রেলি বললে,ডিম দিয়ে মামলেড কী করে হয় হে? মামলেড তো হয় কমলালেবুর খোসা দিয়ে।

আজ্ঞে মামলেড নয়, মমলেট?

ও! অমলেট!

আজ্ঞে না। অমলেট হয় বিলেতে, বিলিতি ডিম দিয়ে। দিশী ডিম হয় মমলেট। তা যখন মামলেড্‌ মমলেটের কথাই উঠল, ওসব তৈরী করেন মেয়েরা। জাহাজ বাছাইয়ের ভার মেমসাহেবের হাতে ছেড়ে দিলে হয় না?

ও-রেলির মুখ কঠিন হল। সোমের দৃষ্টি এড়াল না।

সুরসিক যদি বদমেজাজী আর খামখেয়ালী হয়, তবে তাকে নিয়ে বড় বিপদ। যন্ত্র চট করে বেসুরো হয়ে যায় আর তার বিকৃত স্বর সব কিছু বরবাদ করে দেয়।

ও-রেলির হুঃ বীণাবাদ্যের মাঝখানে প্যাচার কণ্ঠের মত শোনাল।

সোম বুঝলে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে ঢোঁড়া বেরিয়েছে। এইখানেই থামা উচিত, না হলে হয়তো কেউটে বেরুবে। কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে বিদায় নিলে সেটা হবে আরো বেতালা। একটুখানি ইতি উতি করে শুধালে, আপনি পোর্টে ওদের সী অফ করতে যাচ্ছেন তো?

ও-রেলি বললে,না

তারপর একটু ভেবে নিয়ে, জিজ্ঞেস না করা সত্ত্বেত্ত বললে, বাটলার পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে সে দেশে যাবে। অনেককাল ছুটি নেয়নি বলছিল।

কণ্ঠে কিন্তু বিরক্তির সুর।

সোম না হয়ে আর কোনো নেটিভ হলে ভাবত, এই সাদা-মুখ-গুলোর মতিগতি বোঝা ভার, কিন্তু সোম মেলা ইংরেজ চরিয়েছে। সে অত সহজ সমাধানে সন্তুষ্ট নয়। বড় ভারী মন নিয়ে সোম বাড়ি ফিরল। ও-রেলিকে সে সত্যই ভালোবেসে ফেলেছিল।

সোনমুগ সরু চাল সুপারি ও পান
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখানা
গুড়ের পাটালি কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভাণ্ড ভালো রাই সরিষার তেল—

এই সব পর্বত প্রমাণ মালপত্র নিয়ে আমারা সফরে বেরই, আর সায়েবরা কি রকম মাত্র একটি সুটকেস হাতে নিয়েই গটমট করে গাড়িতে উঠে,তাই দেখে বাঙালীর ভারি ঈর্ষা হয়। কিন্তু ঐ সুটকেসটির ভিতরকার মালপত্র তৈরি করতে গিয়ে সায়েবদেরও হিমসিম খেতে হয়। মোকামে পৌঁছনোর পর বাঙালী যদি দেখে ধুতির অনটন তাহলে সে কারো কাছ থেকে ও জিনিসটে ধার নিয়ে পরতে পায়- এমনকি কুর্তাতেও খুব বেশী আটকায় না-কিন্তু সায়েবরা কোট-পাতলুন ধার নিয়ে পরতে পারে না, ফিট হ’ল কিনা সেটা মারাত্মক প্রশ্ন।

মেব্‌ল্‌কে তাই বাচ্চার কাপড়-জামা তৈরি করাতে বেশ বেগ পেতে হ’ল। ভূমধ্যসাগর অবধি আবহাওয়া গরম, মধুগঞ্জের জামা-কাপড়েই চলবে ।কিন্তু তারপরের জন্য যে গরম জিনিসের প্রয়োজন সেতো মধুগঞ্জে পাওয়া যায় না। তাই ফ্লানের, সার্জ, টুইড আনাতে হ’ল শিলঙ থেকে,আর আনাতে হ’ল শহরের বুড়ো খলিফাঁকে। তাই নিয়ে পড়ে রইল মেব্‌ল্‌ দিনের পর দিন, আর ও-রেলি-সুটকেস-হ্যাটকেসে সঁটতে লাগল জাহাজের লেবেল। যে বা যাবে কেবিনে তার এক রঙ, এবং যেটা যাবে স্টোররুমে তর অন্য রঙ এবং যেটা হাতে থাকবে তার জন্য কোনো লেবেলের প্রয়োজন নেই। এই রামধনুর রঙের প্যাঁচ ও-রেলি তো একবার মতিচ্ছন্ন হয়ে বাচ্চার পিঠে লেবেল লাগিয়েছিল আর কি।

বিদায়ের আগের সন্ধ্যায় জিনিসপত্র-ফিটফাট ছিমছাম হ’ল পরদিন ভোর ছটায় ও-রেলি মোটর হাঁকিয়ে সবাইকে কুড়ি মাইল দুরে স্টেশনে পেঁছিয়ে দেবে। চাকর বাকরদের বললে তারা যেন বাড়ি গিয়ে তাড়াতারি শুয়ে পড়ে,কারণ পরদিন ভোরবেলা এসে মালপত্র ওঠাতে তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। কম্পাউণ্ডে রইল শুধু বাটলার-অন্য চাকর-বাকরদের সেখানে রাত্রিবাসের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

পরদিন ভোরের দিকে বৃষ্টি হ’ল। চাকর-বাকররা কোনোগতিকে ছটায় বাঙলো পৌঁছে দেখে সবাই চলেছে-গারাজ খালি, বাড়ি তালাবন্ধ। ও-রেলি সায়েবের সব কিছু তড়িঘড়ি ঝটপট, কাঁটায় কাঁটায়। চাকররা আন্দাজ করলে সামান্য পাঁচ মিনিট দেরিতে আসার জন্য তাদের একটু খানি বকুনি খেতে হবে।

সায়েব ফিরল বেশ বেলা গড়িয়ে যাবার পর। আরদালি আসমউ সায়েবের জন্য দুখানা কাটলিস আর আলুসেদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু সে কিছু না খেয়ে সোজা দোতলায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

সব কিছু শুনে রায়বাহাদুর কাশীশ্বর চক্রবর্তী বললেন, আহা, বেচারা, এবারে একদম একা পড়ে গেল।

তার জুনিয়ার তালেবুর রহমান বলেছেন, আমি ভাবছি অন্য কথা। বাচ্চাটা বিলেত গেল বাঘ হয়ে ফিরে আসবার জন্য। তখন লাগাবে নেটিভদের উপর জোর ডাণ্ডা।

মুল্লুকে থাকলে তাদের তরে দরদী হয়ে যেত, ছাতির খুন ঠাণ্ডা আর দিলও মোলায়েম মেরে যেত।

রায়বাহাদুর বললেন, সে কী কথা! ও-রেলির মত ভদ্রালোকের ছেলে কি কখনো বৈরীভাব নিতে পারে? কী বলো সোম? সোম বললে, আপনার ছেলের বিলেত যাওয়ার কী হল?

রায়বাহাদুর বললেন, জানেন ব্রাহ্মণী।

তালেবুর রহমান বললেন, সোম ভাবে সে একটা মস্ত ঘড়েল।

ক্লাবে হ’ল অন্য প্রতিক্রিয়া। প্রায় সবাই বললে, গেছে গেছে, আপদ গেছে। কেলেঙ্কারিটা তো চাপা পড়ল। এখন ক্লাবের ছেলে ও-রেলি ক্লাবে ফিরে এলেই হয়।

কিন্তু আরেকটি বৎসর কেটে গেল। ও-রেলি ক্লাবে এল না।

.

১০.

বাড়ির সামনের জ্যোতিমান এবং অন্ধকারে মানুষের তৃতীয় চক্ষুস্বরূপ ল্যাম্পপোস্ট সম্বন্ধেই যখন সে দুদিন বাদেই অচেতন হয়ে যায়, তখন অদৃশ্য ও-রেলিকে ক্লাব যে ভুলে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে। কিন্তু যেদিন খবর এল ও-রেলি মধুগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে গিয়েছে, সেদিন ক্লাবে তাঁর সম্বন্ধে আর-এক প্রস্ত আলোচনা করে নিলে।

মাদামপুর আর বিষ্ণুছড়াই প্ৰথম খবর পেলেন ডি, এম-এর কাছ থেকে।

মাদামপুর বললেন,’ভালই হল। যাচ্ছে ককসবাজার না কোথায়, সেখানে কেলেঙ্কারিটা হয়ত পেছয়নি এবং পেছলেও সেটা বাসি হয়ে গিয়েছে। ওখানে গিয়ে হয়তো পুয়োর ডেভিল আবার নর্মাল লাইফে ফিরে আসতে পারবে। আমি সত্যি তাকে বড্ড মিস করতুম।

বিষ্ণুছড়া চুপ করে রইলেন,ভালো মন্দ কিছু বললেন না।

মাদামপুর শুধালেন, কী হে, চুপ করে রইলে যে? হুইস্কি চড়েছে নাকি?

বিষ্ণুছড়া বললেন, সাতটা ছোটায়? আই লাইক দ্যাট-আপনিও যেমন!? তারপর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে খাড়া হয়ে বসে বললেন, আমি সে কথা ভাবছিনে। আমার কানে এসে সেদিন পৌঁছল, মেবা নাকি আদপেই ইংলণ্ড পৌঁছয়নি।

মাদামপুর বললেন, আমিও শুনেছি, কিন্তু তারা পৌঁছল কি না তার খবর দেবে। কে? মেবলের সঙ্গে ক্লাবের কারো তো এমন দহরম-মহরম ছিল না যে, বন্দর বন্দর থেকে পিকচার-পোস্ট কার্ড পাঠাবে আর লণ্ডন-পোছে কেবল। মোকামে পৌঁছে প্রতি মেলে স্কার্ফ, সুয়েটার আর গরম মোজা, প্যোর স্কটিশ উলে তৈরী। হোম মেড!

বিষ্ণুছড়া বুঝলেন, সায়েবের একটু চড়েছে বয়স হয়েছে কি না, আস্পেই একটু কেমন যেন হয়ে যান না হলে স্কার্ফ, সুয়েটারের কথা বলবেন কেন? ও বস্তু মধুগঞ্জে পরবে কে? সাদা চোখে এ ভুলটা করতেন না, হয়তো বলতেন টিটের বেকন, সার্ডিন। চেপে গিয়ে বললেন, কলকাতার ও শীর সঙ্গে নর্থ ক্লাবে দেখা হয়েছিল, সে বললে, মেব্‌ল্‌ আর তার বাচ্চাকে সে মাস তিনেক আগে দেখেছে মসুরিতে, সঙ্গে ও-রেলি। তোমার মনে আছে কিনা জানিনে, ও-রেলি তখন ছুটি নিয়ে মসুরি গিয়েছিল।

এবারে মাদামপুর হা হা করে হেসে উঠলেন, কে বলেছে? ও শী? কটা মেবল্‌ আর কটা ডেভিড দেখিছিল জিজ্ঞেস করেনি? ওতো সকালে খায় কড়া হর্স-নেক, দুপুরে জিন, সন্ধ্যায় রম আর রাত্রে হুইস্কি। সন্ধ্যায় দেখে থাকলে নিশ্চই দুটো,আর রাত্রে দেখে থাকলে চারটে রেলি দেখেছে কটা মসুরি দেখেছে সেকথা জিজ্ঞেস করেছিলে কি?

বিষ্ণুছড়া বুঝলেন, এখন আর কথা-কাটাকাটি করে কোনো লাভ নেই। তাই বললেন, সোমও বলছিল মেবা লণ্ডনে আছে।

মাদামপুর আশ্চর্য হয়ে শুধালেন, সোম বললে? আশ্চর্য! ওতো কখনো কোনো খবর কাউকে দেয় না। মধুগঞ্জের বানান জিজ্ঞেস করলে ভাবখানা করে যেন সরকারী টপ সিক্রেট। আমি তাকে একদিন বলেছিলুম, ‘ফাইন ওয়েদার, সোম’ মুখখানা করলে যেন আলীপুরের আবহাওয়া দফতর থেকে রির্পোট না এলে সে ঐ একসট্রি মলি কনফিডিয়েনশেল খবর কমফার্ম করতে প্রস্তুত নয়। তাই বলছি সোম যখন বলেছে তখন ওটা বাইবেল বাক্য।

কিন্তু বিষ্ণুছড়ারই ভুল। হঠাৎ চেয়ারখানা তার কাছে টেনে এনে মাদামপুর একটুখানি সামনের দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় অত্যন্ত সাদা গলায় গম্ভীরভাবে বললেন, কোথায় আছে, কোথায় নেই, ওসব খোঁচাখুঁচি করতে গেলে আবার সেই ধামাচাপা ডার্টি লিনেন বেড়িয়ে পড়বে। তাতে ইয়োরোপীয়ন কমিউনিটির কী লাভ? বরঞ্চ ক্ষতিরই সম্ভাবনা। নো নিউজই যদি হয়, তবে জান তো প্রবাদ, নো নিউজ ইজ গুড নিউজ। বিষ্ণুছড়া অভয় পেয়ে বললেন, বিশেষ করে সোমের কথাই পাকি খবর। কিন্তু ও-রেলিকে একটি বিদায়ভোজ দিতে হবেনা। ক্লাবে আসুক আর না-ই আসুক, চাদা তো ঠিক ঠিক দিয়ে গিয়েছে, এমন কি টেনিসের এস্ট্রাও। চ্যারিটি-ফ্যারিটির পয়সায়ও কামাই দেয়নি।

মাদামপুর বললেন, সাউণ্ড করে দেখতে পার। কিন্তু আসবে কি।

এ সম্বন্ধে মাদামপুর এবং বিষ্ণুছড়ার মনে সন্দেহ জাগা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ও-রেলি আসতে রাজি হল। তবে ইঙ্গিত করলে যে, ডিনারের বদলে মামুলি টি-পার্টি হলেই ভালো হয়। ক্লাব রাজী হ’ল।

ক্লাবের প্রায় সবাই সেদিন হাজিরা দিলেন। ও-রেলি সঙ্গে নিয়ে এল তার বদলী সমরসেট ভীনকে। চটপটে ছোকরা, সমস্তক্ষশ কথা কয় আর এক সিগারেট থেকে আরেক সিগারেট ধরিয়ে দেয়শলাইয়ের খর্চা বাঁচায়। রেলি ভীনকে ক্লাবের সঙ্গে সাড়ম্বর পরিচয় করিয়ে নিয়ে বললে, ইনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে খাশ তালিম নিয়ে তৈরি হয়ে এদেশে এসেছেন, মধুগঞ্জ এর সেবায় উপকৃত হবে।

গুজোব রটাতে ফিসফাস-গুজগাজ করতে ইংরেজ এবং বাঙালীতে কোনো তফাৎ নেই, কিন্তু যাকে নিয়ে এসব করা হয়, তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করাটা ইংরেজের অভ্যাস নয় এবং এটিকেটের খেলাফ। তাই মেব্‌ল্‌ সম্বন্ধে ও-রেলিকে মুখের উপর কেউ কোনো প্রশ্ন শুধালে না। একেবারে কোনো প্রকারের অনুসন্ধান না করাটা আবার মরুরিদের পক্ষে ভালো দেখায় না। তাই বুড়ো মাদামপুর ও ডি, এম, শ্রেণীর দু-একজন ও-রেলির পরিবারের খবর নিলেন, কোনো প্রকারের প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে, অর্থাৎ শুদু আশা প্রকাশ করলেন, মেরা বিলতে ভালো আছে নিশ্চয়ই। ও-রেলি ঘাড় নেড়ে সায় দিলে।

মোটের উপর পার্টিতে কোনরকমের অস্বস্তি কিংবা আড়ষ্টতার ভাব দেখা গেল না। ও-রেলি ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে কথা কইলে। বাঙলা দেশে তখন স্বদেশী আন্দোলন প্রায় সব শহরেই ছোট বড় দয়ের সৃষ্টি করেছে। কথাবার্তা হ’ল সেই সম্বন্ধেই বেশী। ও-রেলি আইরিশম্যান, তাই সে বুঝিয়ে বললে, এসব আন্দোলন নিমূল করা পুলিসের কর্ম নয়, বিলেতের পার্লামা যদি সময়োপযযাপী ব্যবস্থা অবলন না করেন, তবে সন্ত্রাসবাদ বাড়বে বৈ কমবে না। অবশ্য তার অর্থ এই নয়, পুলিস হাত পা গুটিয়ে বসে বসে বিড়ি ফুকবে-সে তার কর্তব্য করে যাবে, তবে তারও একটা সীমা আছে।

মাদামপুর এ বাবদে কট্টর। কিন্তু ও-রেলি তার বক্তব্য এমনভাবে গুছিয়ে বললে যে, তিনি পর্যন্ত বাগান ফেরার সময় বিষ্ণুছড়াকে বললেন, পিটি, ছোঁড়াটার পারিবারিক জীবন সুখের হ’ল না। ওকে কিন্তু দোষ দিয়ে লাভ নাই। ছেঁড়ার মাথাটা ঘাড়ের সঙ্গে ঠিকমত স্ক্র করাই আছে। আমি সত্যই প্রার্থনা করি, ও যেন জীবনে সুখী হয়।

বিষ্ণুছড়াও সায় দিয়ে বললেন, হোয়াই নট। ইট ইজনেভার টু লেট টু বিগিন এগে।

মীরপুরের মেম দরদী রমণী। তিনি ও-রেলিকে একবার এক লহমার তরে একেলা পেয়ে তার ডান হাত চেপে বলেছিলেন, ও-রেলি,তুমি আমার ছেলের বয়সী, তাই তোমাকে বলি, জীবনটা একেবারে বহু জিগলো ধাঁধার মতো প্রথমবারেই সব মেলাতে না পারলে নিরাশ হবার মতো কিছু নেই। তোমার উপর আমার আর্শীবাদ রইল।

ও-রেলি স্পষ্টই বিচলিত হয়েছিল। আধো-আধ্যে ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পড়েছিল।

পার্টি শেষ হতেই ও-রেলি নিয়ে গেল ভীনকে তার বাঙলোয়। ডিনার খেয়ে ও-রেলি তার ডেরা তুলে মোটরে যাবে স্টেশন, আর ডীন খাটাবে তার বাঙলোতে আপন ডেরা। চাকরি-জগতে সরকারী বাসা সম্বন্ধে এ-ই হচ্ছে এদেশে আইন অবশ্য সাদা কালিতে লেখা।

ডীন সবেমাত্র বিলেত থেকে এসেছে, তার উপর সে বকরবকর করতে ভালোবাসে এককালে ও-রেলি গালগল্প জমাতে কিছুমাত্র কম ওস্তাদ ছিল না কাজেই সে একটানা গল্প বলে যেতে লাগল। ও-রেলিই ব্যবস্থাটা মনঃপূত হ’ল, তাই যদি ডীন দু-একবার ভদ্রতার খাতিরে তাকে কথা বলবার চেষ্টা করলে সে তাতে সাড়া না দিয়ে উলটে দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তাকে আবার বকরবকর করাতে তাতিয়ে দিলে।

ও-রেলির মালপত্র মোটরে তোলা হয়ে গিয়েছে–এখন তার ওঠবার সময় হ’ল দেখে ডীন শুধালে, এখানে ভালো করে কাজ চালাবার জন্য আপনি টিপস দেবেন কি? আমার তাতে উপকার হবে।

ও-রেলি বললে, সে কথা যে আমি ভাবিনি তা নয় এবং দেবার মতো টিপস থাকলে আমি অনেক আগেই এ প্রস্তাব পাড়তাম–ভীন বললে,সরি আমি বড্ড বেশী কথা বলি,-না?

ও-রেলি বললে, নটেটোল। চুপ করে অন্যের কথা শুনলেই অপর পক্ষকে বেশী চেনা যায় তা নয়। অনেক সময় নীজে কথা বলে বলে অন্যের উপর কী প্রতিক্রিয়া। হয়-তার মাথা নাড়াতে, হা না বলাতে, কোন প্রসঙ্গে সে ইনটরেস্ট নিচ্ছে, কোনটাতে নিচ্ছে না-তাই দিয়ে মানুষ চেনা যায় অনেক বেশী। তার উপর সমস্তক্ষণ কথা বললে অন্য পক্ষ কোন প্রশ্ন শুধাবার সুযোগ পায় না যে প্রস্তাব তোলার ইচ্ছে নেই, সেটা বেশ এড়িয়ে যাওয়া যায়। মধুগঞ্জ লোক্যাল বোর্ড চেয়ারম্যান এব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। অপ্রিয় কথা ওঠবার সম্ভাবনা দেখলেই তিনি পাখি শিকার, ৯০ সালের ভূমিকম্প,আর গিরের ফিতে না ইঞ্চির ফিতে ভালো, এসব নিয়ে এমন গল্প জোড়েন যে, তার ঘর থেকে বেরনাই তখন মুশকিল হয়ে ওঠে।

সে কথা যাক। আমি মাত্র একটি টিপ দেব। আপনার আপিসের সো-তার সঙ্গে তো আপনার আলাপ হয়েছে বড় খাঁটি আর বুদ্ধিমান লোক। আপনি তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে অনেক পদ্ধতি শিখে এসেছেন,সেগুলোর কটা এখানে কাজে খাটবে জানিনে, তবে একথা আপনাকে বলতে পারি সোম যেখানে ফেল মারে, সেখানে করার মতো বড় কিছু একটা থাকে না। অন্তত আমি কিছু পারিনি।

ডীন একটুখানি অবিশ্বাসের সুরে বললে, দেখে তো কিন্তু বুদ্ধ বলে মনে হয়।

ও-রেলি হেসে বললে, প্রিসাইসলি। ঐ তার একটা মস্ত রেস্ত। কিন্তু এদেশে অল দ্যাট স্টিকস ইজ নট রটন ফিশ ঝলমল করলেই সোনা নয় হচ্ছে তার উল্টো প্রবাদ। বর্মাতে একরমক ফল আছে, তার গন্ধ পচা নর্দমার মতো, কিন্তু একবার সে ফল যে খেয়েছে,তার ঐ ফলের জন্য নেশা হয় আফিমের চেয়েও বেশী। সোম ঐ বর্মী-ফল।

তাহলে গুড নাইট।

গুড নাইট।

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী