আমি রোমন্টিক নই। এ-প্রেম আমার সাজে না। এ-প্রেম তারই জন্য, যে বেদনা সইতে জানে, যে সংগ্রামে ভয় পায় না।

আমি ছেলেবেলা থেকেই ভীরু। কৈশোরে সাহস করে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা কইতে পারি নি। অনাদৃতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কোনও কোনও মেয়ের স্বভাব। তারা যেচে কথা কইলে আমি লজ্জায় ঘেমে নেয়ে কি উত্তর দিয়েছি তা আমি চেষ্টা করেও স্মরণ করতে পারব না।

চণ্ডীদাস পড়ে পেয়েছি ভয়। দিনের পর দিন শ্রীরাধার মত সইতে হবে আমাকে বিরহ দহন? দরকার নেই আমার কানুর প্রেম। গোপিনীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা হওয়ার আমার কোনও প্রয়োজন নেই। বনস্পতির গৌরব নিয়ে, উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎপাত ঝঞ্চা-বাত সইবার মত শক্তি আর সাহস আমার নেই। আমি মেহদির বেড়া হয়ে থাকতেই রাজী। আর তিনি যদি তার উপর দয়া করে সাদা মাটা দু’একটি ফুল ফোটান তবে আমি নিজেকে মহা ভাগ্যবান বলে তাঁকে বার বার নমস্কার করব।

আমি চেয়েছি ঘরের প্রেম, বন্ধুর প্রেম-বঁধুর প্রেম আমি চাই নি। সংসারের অবহেলা অনাদরের মাঝখানে এইটুকু সান্ত্বনা যে বাড়ি ফিরলে আমি সেখানে সবচেয়ে আদরের ধন। সারা দিনমান সে আমার সঙ্গে থাকবে স্বপ্নের মত—আমি চলাফেরা করব সেই স্বপ্ন সম্মোহনে, ঘুমে-চলার রোগী যে রকম হাঁটে। আর রাত্রিকালে সে পাশে থাকবে-জানালার কাছে চাঁদ যে রকম অপলক দৃষ্টিতে নিদ্রিতের শিয়রে জাগে।

মণি ভরা, প্রবাল-হার-পরা নীলার্ক্ষী নীলাম্বুজের ঝড়-ঝঞ্চার অশাস্তি ঐশ্বর্য আমি চাই নি। গ্রামের নদীটি পর্যন্ত আমি হতে চাই নি। আমি হতে চেয়েছিলুম বাড়ির পিছনের ছোট্ট পুকুরটি। যেটি আমার বধূর, আমার নির্জনে পাতা সংসারে জননীর একান্ত আপন। সেখানে সামান্যতম তরঙ্গ উঠে আমাকে বিক্ষুব্ধ করে না, আমার বধূকে ভীতার্ত করে না।

এ মণিহার আমায় নাহি সাজে।

তবু ভাগ্যের কাছে স্বীকার করব, এই চল্লিশ ঘন্টা আমার কেটেছে যেন এক অপূর্ব সঙ্গীতের সুরলোকে। চল্লিশ ঘণ্টার দিগন্তে দেখতে পাচ্ছি, আমার তীর্ধাবসানের দরগা-চূড়ো। আর যেতে যেতে দেখছি, পথের দুপাশে কত অতিথিশালার বিশ্রান্তি, কত সাধু-সজ্জন-সঙ্গম, শুনছি মন্দিরের ঘন্টা, দূর হতে ভেসে আসা ভোরবেলাকার আজান।

এবারে ঘরে ঢুকল ঝড়ের বেগে। যেন আসতে কত দেরী হয়ে গিয়েছে।

আমার সামনে এসে হিন্দুস্থানী কায়দায় নমস্কার-মুদ্রাতে হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললে, ‘হামি তোঁকে ব্বালোবাসি।’

প্রথমটায় বুঝি নি। তারপর হো হো করে হেসে উঠেছিলুম।

‘বুঝেছ?’

আমি বললুম, “এ তুমি শিখলে কোথা?”

আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললে, “আমি করলুম প্রেম নিবেদন, আর তুমি হাসলে। চোখ থেকে আগুন বেরুচ্ছে না বটে, কিন্তু ভেজা দিনের দেশলাইয়ের মত কখন যে জ্বলবে ঠিক নেই।”

আমি অতি কষ্টে তাকে শান্ত করলুম।

আমি কী মূর্খ! উচ্চারণ আর ব্যাকরণের দিকে গেল কান? বক্তব্যটা উপেক্ষা করে গেলুম। ধন্য সেই রাজা যিনি ভিখারিণীর ছেঁড়া কাপড় দেখেন নি-দেখেছিলেন তার মুখ, তার হৃদয়, আর তাকে বসিয়েছিলেন সিংহাসনে। আমি আহাম্মুক, শাহজাদীকে দেখছি ভিখারিণীর বেশে।

নিজের গালে নিজে চড় মেরেছি বহুবার এবার মারলুম লাথি!

বললে, ‘হিংসে হল না কেন তোমার? কোনও ইয়াংম্যান আমাকে শিখিয়েছে সেই সন্দেহে?’

আমি বললুম, ‘সে বাঙালী ইয়াংম্যান্ নয়।’

হাত মেনে বললে, ‘কান্দাহারে আমাদের এক চাপরাশী ছিল—সে যৌবনে কলকাত্তায় নৌকরী করত। তার কাছ থেকে শিখেছি।’

শব্‌নম ভালো করে উচ্চারণটা শিখল। কারণ এই কথাগুলো শুদ্ধভাবে বাঙলাতে বলতে বা উচ্চারণ করতে কোনও কাবুলীর অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। শুধু বাধল গিয়ে ‘ভ’ অক্ষরে। ভারতর্ষের বাইরে মহাপ্রাণ বর্ণ নেই বললেও চলে—এমন কি দক্ষিণ ভারতেও নেই।

শেষটায় যখন বললুম ‘ঠিক’ তখন ভারী খুশী হল। শুধালে, আর তো তোমার কোনও ফরিয়াদ নেই?

আমি চিন্তা করে বললুম, ‘আমার আর কোনও ফরিয়াদ নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না।’

সন্দেহ নয়নে তাকিয়ে শুধালে ‘হঠাৎ?’

হঠাৎ-ই। কালরাত্রে মনে পড়ল একটি সংস্কৃত শ্লোক :-

“শহতি সংযোগে বিয়োগে মিত্রমপ্যহো।
উভয়োর্দুঃখ দায়িত্ব কো ভেদঃ শক্ৰমিত্রয়োঃ?”

‘শত্রুর মিলনে মনে অতি কষ্ট হয়
বন্ধু বিচ্ছেদ হয় কষ্ট সাতিশয়।
উডয়েই বহু কষ্ট দেয় যদি মনে
শত্রু মিত্ৰে কিবা ভেদ তবে এ ভূবনে?”
(কবিভূষণ পূর্ণচন্দ্রের সূর্য)

শব্‌নম বলেন, ‘পয়লা নম্বরী প্যারাডকস্। এরপর আর কোনও ফরিয়াদ থাকার কথা নয়। তারপর চিন্তা করতে করতে বললে, কিন্তু এর উত্তরটা কি?’

তুমি বল।

‘দোস্ত মঙ্গল কামনা করে, দুশমন বিনাশ কামনা করে। আমি কামনাটা বড় করে দেখি। ফলটা অত বড় করে না।’

আমি বললুম, শাবাশ্‌। দোস্ত-ই-জান-ই-মন-আমার দিলের দোস্ত শাবাশ্‌। হিন্দুস্থানের ধর্মগুরুও বলেছেন, মা ফলেষু কদাচন।

আরও কিছু কথা হল।

আজ কিন্তু সমস্তক্ষণ লক্ষ্য করেছিলুম, আজ যেন শব্‌নমের মন অন্য কোনোখানে। হয়তো কোনও কথা বলতে চায় কিংবা শুধোতে চায়।

এমন সময় রাস্তায় হঠাৎ চেঁচামেচি আর আর্ত কণ্ঠরব শোনা গেল। এত জোর যে আমরা দুজনেই শুনতে পেলুম। শব্দটা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল দেখে আমি একটু উৎকণ্ঠিত হলুম। এমন সময় দূর হতে এক সঙ্গে অনকেগুলো বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল। দুজনাতে নিচে নেমে খবর নিয়ে জানা গেল ডাকাতের সর্দার বাচ্চায়ে-সকাও কাবুল আক্রমণ করতে এসেছে। আমানুল্লাকে তাড়াবে।

আফগানিস্থানের এ অধ্যায় বিস্ময়জনক। যে কোনও প্রামাণিক ইতিহাসে পাওয়া যায়। এক বাঙালী মুসলমানও এ বিষয়ে লিখেছেন।

শব্‌নম আমাকে হাত ধরে উপরে নিয়ে এল।

ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘন ঘন পায়চারি করতে লাগল। একবার বললে, ‘আমানুল্লাকে বাবা বার বার বলেছেন, তিনি বারুদের পিপের উপর বসে আছেন, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে চান নি। যাকগে আমার তাতে কি?’

এ রকম আর্তনাদ আর গুলির আওয়াজ মেশানো অট্টরোল আমি জীবনে কখনও শুনি নি। একবার ভাবলুম, শব্‌নমকে বলি, আমি আর আবদুর রহমান তাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি কিন্তু সে সঙ্কটে আমার সত্য কর্তব্য কি, কিছুতেই স্থির করতে পারলুম না। ঘরের চেয়ে রাস্তা যে বেশী বিপজ্জনক। ওদিকে আবার শব্‌নমের আপন ভদ্রাসন নিশ্চয়ই আমার বাড়ির চেয়ে অনেক বেশী সুরক্ষিত। কি করি?

শব্‌নম পায়চারি করছে। আপন মনে বললে, কেউ জানতো না। বাবাও জানতেন না।

পায়চারি বন্ধ করে বললে, “শুনতে পাচ্ছ, বন্দুকের শব্দ এগিয়ে আসছে?”

বহু দূরের কদুকের শব্দ এগিয়ে আসছে না পিছিয়ে যাচ্ছে বোঝবার মত সূক্ষ্ম শ্রবণশক্তি সৃষ্টিকর্তা নিরীহ বঙ্গ সন্তানকে দেন নি।

শব্‌নম আবার বললে, আমার তাতে কি?

আমি তার মানে বুঝতে পারলাম না।

আধাঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে প্রথম বন্দুকের আওয়াজ শোনার পর।

এমন সময় তোপল্‌ খান এসে ঘরে ঢুকল। সেলাম করে শব্‌নমকে শুধালে, বাড়ি যাবে না, দিদি?

শব্‌নম বললে, যাব। পরে। এখন তুমি নিচে গিয়ে আবদুর রহমানের সঙ্গে দেউড়ি দরজার উপর পাথর চাপও। আর যা-যা সব করতে হয়।

তোপল্‌ খান যেভাবে ঘাড় নেড়ে চলে গেল তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল শব্‌নমের প্রতি তোপলের নির্ভর মুর্শীদের উপর চেলার বিশ্বাসের মত। ভ্যালে’র কাছে তা হলে হিরোইন হওয়াটা অসম্ভব নয়।

শব্‌নমের মুখে হাসি ফুটেছে। আমার একটু দুঃখ হল! আমার গায়ের জোর ওর মত হল না কেন।

শব্‌নম আমার সামনে মুখোমুখি হয়ে বললে, “তুমি বড় সরল। ভাবলে, তোপল্‌কে দেখে আমি ভরসা পেলুম। এই বন্দুক পিস্তলের জমানায়? যাকগে।”

বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললে, ‘শোন’।

আমি বললুম, হ্যাঁ।

শান্ত কণ্ঠে, আমার চোখে চোখ রেখে বললে, ‘আমি স্থির করেছি, আমাদের বিয়ে হবে। তুমি?’

ধাক্কাটা কি রকম লেগেছিল আমি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব না। আমার মুখে কথা ফোটেনি এবং চেহারায় যদি কোন ভাব ফুটে থাকে তবে সেটা হতভম্বের।

সেই শান্ত কণ্ঠেই বললে, তোমার চোখ আমি চিনি। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। এবার আমি জিতেছি।

তারপর চেয়ারটা কাছে টেনে এনে আমার দু জানুর উপর দুহাতে ভর করে সামনের দিকে ঝুঁকে বললে, এবার সব কথা শোন।

আমার মুখ দিয়ে তখনও কথা ফোটে নি।

বললে, ‘আমি জানতুম, এর একটা বোঝা-পড়া একদিন করতেই হবে। তাই আজকের দিনটা ঠিক করেছিলুম, আস্তে ধীরে তোমার মনের গতি দেখে, প্রসন্ন মুহূর্তে আমি যে একান্ত সর্বস্বান্ত তোমার হতে চাই সেইটে জানাব। ইতিমধ্যে ডাকু এসে জিনিসটা যেমন কঠিন করে তুলল, তেমনি সহজও করে দিল। এখন কতদিন এ রকম চলবে, কেউ বলতে পারে না! আর সময় নেই। আজই, এখ্‌খনি আমাদের বিয়ে।

‘হ্যাঁ, এখ্‌খুনি।’

আমি কিছু বলতে চাই নি।

‘হ্যাঁ।এখখুনি। তুমি ভেবেছিলে, আমি উত্তেজিত হয়েছি, ডাকু এসেছে বলে। তা নয়। আমি খুঁজছিলাম বিয়ের দুজন সাক্ষী। আবদুর রহমান তো আছেই কিন্তু ভিড় ঠেলে কাকে ডেকে নিয়ে আসি, রাস্তায় এই ভয়ে-পাগলদের ডাকলেও কেউ আসবে না। তোপল্‌ খান আসাতে আমার দুশ্চিন্তার অবসান হল।’

উঠে দাঁড়িয়ে বললে, তুমি ওজু করে এস।

মোহগ্রস্তের মত ওজু সেরে বাইরে এসে দেখি, তোপল্‌ আর রহমান মিলে ড্রইং রুমের আসবাবপত্র সরিয়ে মাঝখানে আরেকখানা কার্পেট পেতেছে। শুনেছি চাকরবাকরদের বখশিশ দিলে তারা খুশী হয়। এদের মুখে আজ যে বদান্যতা দেলুম, সে তো লক্ষপতির মুখেও আমি কখনও দেখি নি।

শব্‌নম এক কোণে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কি যেন পড়ছে। তার মুখচ্ছবি বড়ই শান্ত। আমি কাছে যেতে কী কী করতে হবে বলে দিল।

দুজনাতে মুখোমুখি হয়ে বসলুম। শব্‌নম মুখের উপর ওড়না টেনে দিয়ে মাথা নিচু করলে। আমি বললুম, ‘আমি অমুক, অমুকের ছেলে, তুমি অমুক, অমুকের মেয়ে তোমাকে স্ত্রীধন দিয়ে-’

তোপল্‌ খান শুধালে, স্ত্রীধন কত?

আমি বললুম, আমার সর্বস্ব।

তোপল্‌ খান বললে, একটা অঙ্ক বললে ভাল হয়।

আমি জোর দিয়ে আবার বললুম, আমার সর্বস্ব।

‘—স্ত্রীধন দিয়ে মুহম্মদী চার শর্তে তোমাকে স্ত্রীরূপে পেতে চাই। তুমি রাজী?’

এ যেন শব্‌নমের গলা নয়। দূর থেকে ভেসে আসছে, অতি মৃদুকণ্ঠে তার সম্মতি।

তিনবার ওই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হল। তিনবার সে সম্মতি জানালে।

আমি সাক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘আপনারা এই বিবাহের শাস্ত্র-সম্মত দুই সাক্ষী। আপনারা আমার প্রস্তাব আর মুসম্মৎ শব্‌নম বানুর সম্মতি তিনবার শুনেছেন?’

দুজনাই বললে, শুনেছি।

শব্‌নমের কথা ঠিক হলে আনুষ্ঠানিক বিবাহ এইখানেই শেষ। তোপল্‌ খান বহু বিয়ে দেখেছে বলে দুহাত তুলে একটা প্রার্থনা করল। আমিও হাত তুললুম। শব্‌নম মাথা নিচু করে, একেবারে মাটির কাছে নামিয়ে, দুহাত দিয়ে প্রায় মুখ ঢেকে।

প্রার্থনাতে মাত্র একটি কথা ছিল। ‘হে খুদা, আদম এবং হাওয়ার মধ্যে, ইউসুফ এবং জোলেখার মধ্যে, হজরৎ এবং খাদিজার মধ্যে যে প্রেম ছিল, এ দুজনার ভিতর সেই রকম প্রেম হোক।’

আবদুর রহমান উদ্বাহু হয়ে প্রার্থনার সময় জোর গলায় ঘন ঘন বললে, ‘আমিন, আমিন হে আল্লা তাই হোক, তাই হোক।’

আমিন! আমিন!! আমিন!!!

ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই বসে রইলুম। কিছুই তো জানি নে তারপর কি করতে হয়। শব্‌নমও কিছু বলে নি।

উঠে গিয়ে সামনে বসে বললুম, শব্‌নম।

তাকিয়ে দেখি ওড়না ভেজা।

কিছু না ভেবেই ওড়না সরালুম। সুস্থ বুদ্ধিতে পারতুম না। দেখি, শব্‌নমের চোখ দিয়ে জল ঝরছে।

শুধালুম, “এ কী?”

শব্‌নম চোখ মেলে বললে, বলো!

তখন দেখি, আমার বলবার কিছুই নেই।

তাকে তুলে ধরে সোফার দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে দেখি সেটাকে সরানো হয়েছে। আমি সেদিকে যাচ্ছিলাম। বললে, ‘না। ওদের ডাক। তোমার ঘর আমি সেই রকমই চাই।’ ঘর ঠিক করা হল।

বললে, “তুমি শোও।”

আমার পাশে আধ-হেলান দিয়ে বসে আমার চুলের ভিতর আঙুল চালাতে চালাতে বললে, “ঠিক এরকম হবে আমি ভাবি নি। আমি ভেবেছিলুম, হয়ত খানা-পিনা গান-বাজনা বোমা-বারুদ ফাটিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা আমি করতে পারব। আর তা সম্ভব না হলে আমি অন্যটার জন্যও তৈরী ছিলুম।”

আমি বললুম, এই তো ভাল।

“সে কি আমি জানি নে? খানা-পিনা বন্ধু-সমাগম হল না, তার জন্যে আমাদের কি দুঃখ? তবে একটা পদ এত বেশী হচ্ছে যে আর সব পুষিয়ে দিচ্ছে। শুনছ শাদীর ‘শাদীয়ানা?’ বোমা-বারুদ? কী রকম কন্দুক মেশিনগানের শব্দ হচ্ছে? আমানুল্লার শালীর বিয়েতেও এর এক আনা পরিমাণও হয় নি! ডাকাত আমাদের বিয়ের শাদীয়ানার ভার নিয়েছে-না? এও তো ডাকাতির বিয়ে!”

আমি কিচ্ছুটি বলি নি। আমার হিয়া কানায় কানায় ভরা। আমার জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। পাল দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়াকে মুক্তি দিয়েছে। হাল-বৈঠা নিস্তব্ধ। উটের ঘন্টা আজ বাজছে না।

বললে, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই।

এবারে আমাকে মুখ খুলতে হল।

ডান হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে বললে, আমার শওহর—স্বামী কথা বলে কম। শোন-

‘তোমাকে বড় কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাকে কতখানি চাও, সে আমি জানতুম। আরও জানতুম, সর্বশেষ চাওয়া, সমাজের সামনে পাওয়া, তুমি সাহস করে নিজের মনের কাছেই চাইতে পার নি। আমার কাছে বল—সে তো বহু দূরে। আমার কিন্তু তখন বড্ড কষ্ট হয়েছে। যখন নিতান্ত সইতে পারি নি তখন শুধু বলেছি, আমার কাছে ওষুধ আছে। তুমি নিশ্চয়ই আস্‌মান জমীন হাতড়েছ, কী ওষুধ? তুমি বিদেশী, তুমি কী করে জানবে যে, যত অসুবিধেই হোক আমি আমার দেশের, সমাজের সম্মতি নিয়েই বিয়ে করতে চাই। আমার জন্য অতখানি নয়, যতখানি তোমার জন্যে। তুমি কেন ডাকাতের বেশে আমাকে ছিনিয়ে নেবে? মায়-মুরুব্বি, ইয়ার দোস্ত এবং আরও পাঁচ জনের প্রসন্ন কল্যাণ আশীর্বাদের মাঝখানে, আমরা একে অন্যকে বরণ করব। গুল বুলবুল এক বাগিচাতেই থাকবে। চতুর্দিকে আরও ফুল আরও বুলবুল। আমি কোন্ দুঃখে আমার শাখা ছেড়ে তোমাকে ঠোটে করে নিয়ে মরুভূমির কিনারায় বসব?’

‘সমাজ আপত্তি করলে?’

‘থোড়াই পরোয়া করতুম। ধর্মমতে তুমি আমি, সমাজ কেন, বাপ-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করতে পারি। কিন্তু সমাজ কি শের না বাবুর, বাঘ না সিংহ, যে তাকে হামেহাল পিস্তল দেখাতে হবে? সমাজ তেজী ঘোড়া। দান-পানি দেবে, তার পিঠে চড়বে। বেয়াড়ামি করলে পায়ের কাঁটা দিয়ে অল্প গুঁতো দেবে, আরও বেশী হলে চবুক, আর এক দম বিগড়ে গেলে পিস্তল। তারপর নুতন ঘোড়া কিনবে-নুতন সমাজ গড়বে।

‘আর এখন।’

‘এখন তো সবকিছু ফৈসালা হয়ে গেল। প্রথম বলি, কাবুলের সমাজ আমাদের সমাজ নয়। আমাদের গুটিকয়েক পরিবার নিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ সমাজ। সে সমাজ এখন আমাদের আশীর্বাদ করবে। জান, এদেশে এরকম বিশৃঙ্খলা প্রায়ই হয়। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে লড়াই, শহরে শহরে লড়াই, রাজায় রাজায় লড়াই। রাজায় ডাকুতে অবশ্য এই প্রথম। তখন ভিন মহল্লায় গিয়ে কখনও কখনও পনেরো দিন, এক মাস আটকা পড়ে যেতে হয়। সমাজ শুনে বলবে, ‘এই তো ভাল। তারা শাস্ত্রানুযায়ী কাজ করেছে।’ পরে যখন সমাজপতিরা কানাঘুষো শুনবেন, আগের থেকে মহব্বৎ ছিল, তখন তারা আরও খুশী হয়ে দাড়ি দুলোতে দুলোতে বলবেন, ‘বেহ্‌তর শুদ, খয়ুলী বেহতর শুদ—আরও ভাল। লোকলজ্জার ভয়ে বিয়ে করার চেয়ে দিলের টানে বিয়ে করা অনেক ভাল-বহুৎ বেহতর।’

‘তুমি কিন্তু ভেবো না, তোমার বাড়িতে পনেরো দিন থাকতে হবে বলে সেই অছিলা নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি আমার হৃদয়ের হয়ে মনের কাছে প্রস্তাব পেশ করি হোটেলের বারান্দায়। মন বিচক্ষণ জন। সে সায় দিলে, অনেক ভেবে-চিন্তে নদী তীরে।’

‘আর এখন? এখন যে ভূতের নৃত্য আরম্ভ হল তার শেষ কবে, কোথায় কে জানে? তাই বিয়েটা চুকিয়ে রাখলুম। ফ্যাতাকঁপ্লি। আমার যা করার করা হয়ে গিয়েছে, এখন আর সবাই এর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াক।’

দুঃখ করে ফের বললে, ওরা দেখছে আমানুল্লার রাজমুকুট। ওদিকে তার যে শক্তিক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সেটা কেউ লক্ষ্য করছে না। কবি সাঈদ বড় বেদনাতেই বলেছিলেন-

“মোম বাতিটির আলোর মুকুট বাখানি কবি কী বলে!
কেউ দেখে না তো ওদিকে বেচারী পলে পলে যায় গলে।”

তারপর শব্‌নমের মনে কী ভাবোদয় হল জানি নে। আমার কানের কাছে মুখ এনে সেটাতে দিল কামড়। বললে, “ভেবো না, তোপল্‌ খানের প্রার্থনা তোমার কান কামড়ানোর স্বর্গদ্বার আমার জন্য খুলে দিল। ও জানে না, তুমিও জান না, আমি তার অনেক পূর্বেই স্বর্গের ভিতরে বসে আছি। কিন্তু বন্ধু, আমার মনে সন্দেহ জাগছে, তুমি আমার কথায় কান দিচ্ছ না।”

আমি খোলাখুলি সব-কিছু বলব স্থির করেছি।

বললুম, “দেখ শব্‌নম-”

শব্‌নম শিউলি- না,-“শিউলি শব্‌নম।”

আমি বললুম, ‘শিশির-সঞ্চিত শেফালি-শব্‌নমে ভেজা শিউলি। হিমিকা—’

এটা কী শব্দ! আগে তো শুনি নি।

শব্‌নমের প্রতি বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ। হিমালয় জান তো? তারই হিম। বাঙলায় শুধু হিমি।

‘আমার চেয়ে পছন্দ হয়েছে, “হিমিকা”।

আমি বললুম,

“কানে কানে কহি তোরে
বধূরে যেদিন পাব, ডাকিব হিমিকা নাম ধরে।”

বললে, ভারি মধুর। আমার ইচ্ছে হয়, সমস্ত রাত এই রকম কবিতা শুনি। কিন্তু এখন বল, তুমি কি ভাবছিলে।

‘তোমার বাবা কি তোমার জন্য চিন্তিত হচ্ছেন না?’ আমি ভয়ে ভয়ে কথাটা তুলেছিলুম। ও যদি কিছু মনে করে। আমার ভয় ভুল।

নিঃসঙ্কোচে বললে, আগে হলে বলতুম, তুমি তোমার বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াচ্ছ। এখন এটা তো আমার বাড়ি। এটা আমার আশ্রয়। এক্ষুণি যে মুহম্মদী চার শর্তে আমাকে বিয়ে করলে তার এক শর্ত হচ্ছে স্ত্রীকে আশ্রয় দেওয়া।

‘আপন বাড়িতে আশ্রয় দেব তো বলি নি। সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়।’

চোখ পাকিয়ে বললে, এ কি হচ্ছে? চার শর্তের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাবার পূর্বেই তুমি শর্ত এড়বার গলি খুঁজছ? তবে শোন, আমার আব্বাজান আমার জন্য এক দানা গম পর্যন্ত ভাববেন না। আমরা দু-দুটো-লড়াই-ফসাদ্‌ দেখেছি। একবার তিনি আটকা পড়েন। আরেকবার আমি। তিনি বয়েৎ-বাজি (কবির লড়াই) করেছিলেন কোন এক আস্তাবলে আর আমি পাশ বালিশ জাবরে ধরে ভস ভস করে ঘুমিয়েছিলুম এক বান্ধবীর বাড়িতে। আসলে তার দুশ্চিন্তার অবধি থাকবে না, যখন শুনবেন, তোপল্‌ খান বাড়ি ফেরে নি। ষণ্ডা হলে কী হয়, মাথায় যা মগজ তা দিয়ে মাছ ধরার একটা টোপ পর্যন্ত হয় না। এই দেখলে না, আজ সস্ক্যায় আরেকটু হলে আমাকে কী রকম ডুবিয়েছিল? তুমি বলছিলে, তোমার সর্বস্ব দেবে, স্ত্রীধন হিসেবে, আর ওই অগা তোপল্‌টা কনে পক্ষের সাক্ষী হয়ে “অঙ্ক” চেয়ে সেটা কমাতে যাচ্ছিল। আব্বা জানতে পেলে ওকে আইসক্রীম ফালুদা করে ছাড়বেন।

আমি শুধালুম, “তিনি জানবেন নাকি?”

উৎসাহের সঙ্গে বললে, ‘নিশ্চয়ই জানবেন। আজ না হয় না-ই বা জানলেন।’

আমি শুধালাম, তখন?

হেসে উঠে যা বললে সেটি রবীন্দ্রনাথ অতি সুন্দর ছন্দে গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন :

“ওরে ভীরু, তোর উপরে নেই ভুবনের ভার।”

বললে, জানেমন্‌ জানে আমি প্রেমে পড়েছি। আর কিছু না। কিন্তু আমার সম্পর্কে এক দিদিমণি আছেন। ফিরিশতার মত পবিত্র পুণ্যবতী। তাকে সব খুলে বলে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি এক লহমামাত্র চিন্তা না করেই বললেন, “যাকে তোর হৃদয় চায় তাকে বিয়ে করবার অধিকার তোকে আল্লাহ দিয়েছে। আর কারও হক্ক নেই তোদের মাঝখানে দাড়বার।” ব্যস। বুঝলে? আমার বাবা আমাকে ভালবাসেন।

‘সর্দার আওরঙ্গজেব খানকে আমি চটাতে পারি, দরকার হলে; কিন্তু আমার শ্বশুর মশাইয়ের বিরাগভাজন হতে চাই নে।’

খুশী হয়ে বললে, ঠিক তাই। আমিও তাই চাই বলে এত মারপ্যাচ। কিন্তু এ বিষয়ে আজ এই শেষ কথা। গ্রামোফোনের এই শেষ রেকর্ড। বুঝলে?

আর তার কী তুর্কী নাচ! কখনও ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে হাত পা নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে কংগ্রেসি লেকচার দেয়, কখনও ঝুপ করে কার্পেটের উপর বসে দু’হাঁটু জড়িয়ে ধরে চিবুক হাটুর উপর রেখে, কখনও আর্ম-চেয়ারে বসে আমার কাছের চেয়ারটা এনে তার পা দু’খানা লম্বা করে দিয়ে, কখনও আমার জানু জড়িয়ে ধরে আমার হাঁটুর ওপর তার চিবুক রেখে, কখনও আমাকে দাড় করিয়ে নিজে সামনে দাড়িয়ে আমার কাধের উপর দুহাত রেখে আর কখনও বা আমাকে সোফায় বসিয়ে একান্তে আমার পায়ের কাছে আসন নিয়ে।

আর ঘড়ি ঘড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, বল তো, তুমি আমাকে কতখানি ভালবাস? এক খরওয়ার? এক-ও-নীম খরওয়ার? এক গাধা-বোঝাই, দেড় গাধা-বোঝাই? বহর-ই-হিন্দ-ভারত সাগরের মত? খাইবার পাশের মত আঁকাবাকা না দারুন-আমানের রাস্তার মত নাক বরাবর সোজা? তোমার হিমিকার-ঠিক উচ্চারুণ করেছি তো—গালের টোলের মত ভয়ঙ্কর গভীর, না হিন্দুকুশ পাহাড়ের মত উচু?”

কখনও উত্তরের জন্য অপেক্ষাই করে না, আর কখনও বা গ্যাঁট হয়ে বসে গালে হাত দিয়ে অতি ঠাণ্ডাভাবে উত্তরের প্রতীক্ষা করে—যেন আমার উত্তরের উপর তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।

আমি যদি একই প্রশ্ন শুধাই তবে ছোট্ট মেয়েটির মত চেঁচিয়ে বলে, না, না, আমি আগে শুধিয়েছি।

আমি উত্তর দিতে গেলে স্কুল মাষ্টারের মত উৎসাহ দিয়ে কথা জুগিয়ে দেয়, তুলনা সাপ্লাই করে, প্যাডিং ট্রিমিং যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে ওটাকে, পূজোর বাজারে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেবার মত পোষাক-দুরুস্ত করে। আর কখনও বা তীক্ষ্ণ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে, ডান ভুরু ঠিক জায়গায় রেখে বা ভুরুর বা দিকটা ইঞ্চি খানেক উপরের দিকে তুলে আমাকে পই পই করে পাকা উকিলের মত ক্রস করে। ‘হিমালয়ের মত উঁচু?—সে আমার দরকার নেই। আমার হিন্দুকউশ্‌ হলেই চলে। তার হাইট কত? জান না? তবে বলছিলে কেন অতখানি উঁচু?’

একবার নিজে দেখালে, সে আমাকে কতখানি ভালবাসে।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুবাহু প্রসারিত করে পিছনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে ব্যালে-নর্তকীর মত দু হাতে দু পিঠ প্রায় দুইয়ে ফেলে বললে, ‘অ্যাত্তো খানি। প্লাস-প্লাস-’ বলতে বলতে আমার কাছে এসে, আমার চোখের সামনে তার কড়ে আঙুল তুলে ধরে, বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে কড়ে আঙুলের ক্ষুদ্রতম কণায় ঠেকিয়ে বললে, ‘প্লাস অ্যাটুকুন।’ তারপর শুধালে, এর মানে বল তো?

আমি বললাম, বলার একটা সুন্দর ধরন আর কী।

না। সবচেয়ে বেশী থেকে সবচেয়ে কম—দুয়ে মিলিয়ে, সেই হল ইনফিনিটি।

‘ওই য্‌ যা ভুলে গিয়েছিলুম-’ বলে ছুটে জানলার ধারে গিয়ে বললে, ‘ওই দেখ আদম-সুরৎ-পাগমানের আদম-সুরৎ কালপুরুষ। আমাদের বিয়ের ভোজে এসে বাইরে দাড়িয়ে আছে বেচারী।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে, তুমি আমাদের প্রেমের সাক্ষী।

আমি তাকে সপ্তর্ষির অরুন্ধতী বশিষ্ঠের গল্প বললুম। বৈদিক যুগে যে বর-কনেকে অরুন্ধতী দেখিয়ে ওঁরই মত তাকে পাশে পাশে থাকতে বলত সেটাও বললুম।

শব্‌নম উৎসাহের সঙ্গে বললে, কোথায়? কোথায় দেখিয়ে দাও তো আমায়।

আকাশে তখনও সপ্তর্ষির উদয় হয় নি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী