পরে শব্‌নমের কাছ থেকেই শুনেছি, আমি নাকি জাত-ইডিয়টের মত শুধু বিড়বিড় করে কি যেন একটা প্রশ্ন বার বার শুধিয়েছিলুম। তুমি কি করে এলে? আমি তো কোন শব্দ শুনি নি। তুমি কি করে এলে? আমি তো কোন শব্দ শুনি নি। আমার বিস্ময় লাগে, এইটেই কি আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল?

অপমানিত, পদদলিত, ব্যঙ্গ-কশাঘাতে জর্জরিত নিরাশ দীনহীন জনকে যদি রাজাধিরাজ ধর্মরাজ সহসা আদর করে ডেকে নিয়ে সিংহাসনের এক পাশে বসান তখন তার কি অবস্থা হয়?

আশৈশব অপমানিত, যৌবনেও আপন নীচ জন্ম সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন সূতপুত্র কর্ণ যেদিন মহামান্যা ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠা কুন্তীর কাছে শুনতে পেলেন তিনি হীনজন্মা নন, তখন তার কি অবস্থা হয়েছিল?

শব্‌নম এতটুকু বদলায় নি। সৌন্দর্যহর কাল যেন তার সম্মুখে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। গাত্ৰস্পর্শ করতে পারে নি। যাবার দিন যে রকমটি দেখেছিলুম, ঠিক সেই রকম। আমার বুকের ভিতর যে ছবি আমি এতদিন হিয়ার রক্ত দিয়ে মাখিয়ে রেখেছিলাম সে যেন আজ মুক্তিস্নান সেরে আমার সমুখে দেখা দিল। তার মুখে সব সময়ই শিশির-মধুমাস, আফগানিস্থান-হিন্দুস্থান বিরাজ করত; কপাল আফগানিস্থানের শীতের বরফের মত শুভ্র আর কপোল বোলপুরের বসন্তকিংশুকের মত রাঙা। হুবুহু সেই রকমই আছে।

শুধু কোথায় যেন ও পরিবর্তন হয়েছে। চোখে? সেইখানেই তো সর্বপ্রথম পরিবর্তন আসে। না। ঠোটের কোণে? না। গালের টোল ভরে গিয়েছে? না। সর্বশুদ্ধ? তাও না।

অকস্মাৎ বুঝে গেলুম ওর ভিতর আগুন জ্বলছে। সে আগুন সর্বাঙ্গ হতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

আমার কাছে এসে, দু হাত আমার কাঁধে রেখে মস্তকাঘ্রাণ করল। বনবাসমুক্ত রামচন্দ্রকে কৌশল্যা যে রকম মস্তকাঘ্রাণ করেছিলেন।

বললে, ছিঃ! তুমি রোগা হয়ে গিয়েছ।

বুঝলুম, ওকে পুড়িয়েছে বেশী। এবং সইবার শক্তিও তার অনেক অনেক বেশী আমার চেয়ে। হৃদয়ঙ্গম করলুম, ওর কথাই ঠিক। ওর ব্যাকুলতাই বেশী। এ জীবনে বিশ্বাস ওকেই করতে হবে। মরুভূমিতে মাত্র দুজনার এই কাফেলাতে সেই নিশানদার সর্দার।

বড় ক্লান্ত কণ্ঠে বললে, আমাকে একটু ঘুমুতে দেবে?

ঘুঙুরওয়ালা চরণচক্রপরা বাড়ির নূতন বউ চলাফেরা করার সময় যে রকম দক্ষিণী বীণা বাজে, ওর গলার শব্দ সেই রকম।

শুয়ে পড়ে একটি অতি ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, তুমি কিন্তু কোথাও যেয়ো না।

আশ্চর্য এ আদেশ! আমি আবার যাব কোথায়? তখন বুঝলুম, সে আদেশ দেবার পূর্বেই প্রতিপালিত হয়ে গেছে সেইটেই সত্যকার আদেশ, যে বাক্য অর্থহীন সেইটেই সব অর্থ ধরে।

তবে শুনেছি, স্বয়ং লক্ষ্মী এলেন ভাগ্যহীন চাষার কপালে ফোঁটা দিতে। সে গেল নদীতে মুখ ধুতে। ফিরে এসে দেখে তিনি অন্তর্ধান করেছেন। ওরে মূর্খ, ঘামে ভেজা কাদা-মাখা কপালেই তখন ফোঁটা নিয়ে নিতে হয়। এক বছরের অবহেলায় গৃহ শ্রীহীন। তাই বলে আমি কি এখন ছুটব ডেকোরেটরের দোকানে।

শব্‌নমের ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছিল। তারপর সত্যই ঘুমিয়ে পড়ল।

আমি জানি, রোমান্টিকেরা, আমার তরুণ বন্ধুরা, মর্মাহত হবেন। দীর্ঘ অদর্শনের পর এই অপ্রত্যাশিত মিলন; আর একজন গেলেন ঘুমুতে! আর আমি কি করলাম? সত্যি বলছি, একখানা বই নিয়ে পড়তে লাগলুম। একঘন্টা পরে দেখি, এক বর্ণও বুঝতে পারি নি। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধান! এক ঘন্টারও বেশী সে ঘুমিয়েছিল। কতদিনের জমানো ঘুম কে জানে? কত দুশ্চিন্তা, কত দুর্ভাবনা সে ওই ঘুমে চিরকালের তরে গোর দিতে চায় কে জানে? ঘুম থেকে উঠে চুপ করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি লাজুক ছেলে, বিপদে পড়লে যে রকম হয় সেই গলায় বললুম, কিছু বলছ না যে?

বললে,

“ওয়াসিল হরফ-ই চু ও চিরা বন্তে অস্তলব
চুন রহু তমাম গশৎ জ্বর্স বি-ভবান শওদ।
কাফেলা যখন পৌঁছিল গৃহে মরুভূমি হয়ে পার
সবাই নীরব। উটের গলায় ঘন্টা বাজে না আর।”

বড় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। যা বললে তার ভিতরই তার প্রতিবাদ রয়ে গিয়েছে। নিজের নীরবতা বোঝাতে গিয়ে শব্‌নম সরব হয়েছে। আর শুধু কি তাই? সেই পুরনো শব্‌নম—যে কবিতা ছাড়া কথা কইতে পারে না। যে পরওয়ানা প্রদীপের পানে ধায় না সে আবার পরওয়ানা। পরক্ষণেই বললুম, হে খুদা, এ কি অপয়া চিন্তা এনে দিলে আমার মনে—এই আনন্দের দিনে! মনে মনে ইষ্টমন্ত্র জপলুম।

শুনতে পেয়েছে। শুধালে, ‘কি বলছ।’

আমি পাছে ধরা পড়ে যাই তাই বললুম, তুমি ঘুমোবার আগে আমাকে কি যেন বলছিলে?

‘ও! বাড়ি ছাড়তে বারণ করেছিলুম, আর বলেছিলুম-

“দীরূনে খানা-ই খুদ হর গদা শাহানশাহ্-ইস্ত
কদম্ বারুন মনহ অজ হদ্দ-ই বওয়িশ ও সুলতান বাস্।

ভিখারী হলেও আপন বাড়িতে তুমি তো রাজার রাজা-
সে রাজ্য ছেড়ে বাহিরিয়া কেন মাত্র শুধু রাজা সাজা!”

কী রকম?

‘এই মনে কর ইরানের শাহ-ইনশাহ্ রাজার রাজা, মহারাজা। তিনি যদি আজ এদেশে আসেন তবে আমরা বলব ইরানের শাহ্‌-রাজামাত্র। কারণ আমাদের তো রাজা রয়েছেন। আমাদের শাহের তিনি তো শাহ নন।’

আর যদি বশ্যতা স্বীকার করেন?

কী বোকা?

‘হ্যাঁ! যেমন মনে কর তুমি তোমার আপন বাড়িতে অন্য অনেক জনের ভিতর শাহজাদা, কিংবা শাহজাদী, কিংবা ধরলুম, শাহ-ই। কিন্তু এ বাড়িতে তুমি শাহ-ইনশাহ-মহারাজা।’

‘ওতে আমার লোভ নেই।’

আমি দুঃখ পেলুম।

বললে, ‘ওরে বোকা, ওরে হাবা, ওইখানে, ওইখানে’ বলে তার আঙুল দিয়ে আমার বুকের উপর বার বার খোঁচা দিতে লাগল। তারপর বললে, ‘এবারে তুমি লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গিয়েছ। এখনও একটা ফরিয়াদও কর নি।’

‘করি নি? তা হলে কি করেছি এতদিন, প্রতি মুহূর্তে? হাফিজ সেটা জানতেন না? আমার হয়ে সেটা করে যান নি?-

“তুমি বলেছিলে ‘ভাবনা কিসের? আমি তোমারেই ভালবাসি।
আনন্দে থাকো, ধৈর্য-সলিলে ভাবনা সে যাক ভাসি।
ধৈর্য কোথায়? কিবা সে হৃদয়? হৃদয় কাহারে কয়?
সে তো শুধু এক বিন্দু শোণিত আর ফরিয়াদ-রাশি।”

বাঁধা দিয়ে তাড়াতাড়ি বললে, ‘ফরিয়াদ রাশি নয়, আছে ভাবনার রাশি।’

আমি বললাম, সে কি একই কথা নয়?

বললে, ‘কথাটা ঠিক। হৃদয় মানেই চিন্তা, ভাবনা, ফরিয়াদ—অতি কালে-ভদ্রে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা। সেই সান্ত্বনাটুকু না থাকলেই ভালো হত। বেদন-বোধটা হয় তো আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যেত। কিস্মতের এ কী বিসন্তোষী প্রবৃত্তি! নিরাশায় নুয়ে নুয়ে গাছটা মরে যাচ্ছে। মরতে দে না। তা হলে তে বাঁচি। না; তখন দেবে সান্ত্বনার এক ফোঁটা জল। আবার বাঁচ, আবার মর। যেন বেলাভূমির সঙ্গে তরঙ্গের প্রেম। দূর থেকে সাদা দাঁত দেখিয়ে হেসে হেসে আসে, আবার চলে যায়, আবার আসে আবার যায়।’ হঠাৎ হেসে উঠে বললে, ‘কিন্তু আমি শতবার মরতে রাজী আছি-একবার বাঁচবার তরে।’ এটা যেন আপন মনের কথা। তারপর আমাকে শুধালে, ‘এখন ফরিয়াদ করছ না কেন?’

আমি বললুম, কাজল যতক্ষণ দুরে থাকে ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ—সে কালো। চোখে যখন মেখে নিই তখন তো তার কালিমা আর দেখতে পাই নে। সে তখন সৌন্দর্য বাড়ায়। এটা আমার নয়-কবি, দার্শনিক, পণ্ডিত তিরুবলুবেরের।

“চমৎকার। আমাদেরও তো সুর্মা আছে, কিন্তু কেউ কিছু লিখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। আরও একটা বল।”

‘ওঁর কাব্য তো আমি সঙ্গে আনি নি। আচ্ছা দেখি।’ একটু ভেবে বললুম, নিঠুর প্রিয়ের সম্বন্ধে প্রিয়া বলেছেন, “সে আমার হৃদয়-বাড়িতে দিনে ঢোকে অন্ততঃ লক্ষ বার কিন্তু তার বাড়িতে কি আমাকে একটি বারও ঢুকতে দেয়? আমিই তাকে স্মরণ করি লক্ষ বার, সে একবারও করে না।”

হঠাৎ দেখি শব্‌নম গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। কবিতাটি ভাল হোক মন্দ হোক এতে তো গম্ভীর হওয়ার মত কিছু নেই।

কান্নার সুরে বললে, আমার বাড়িতে নিয়ে যাই নি তোমাকে? কবে যাবে বল।

আমি প্রথমটায় বুঝতে পারি নি ‘বাড়ি’ বলতে সে ‘হৃদয়’ বুঝেও সত্যকার আপন বাড়ি বুঝেছে।

আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে তার দু হাত চেপে ধরলুম। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরল না। কি যেন একটা হারাই হারাই ভাব বুকটাকে ঝাঁঝরা করে দিলে। আবার কথা বলতে গেলুম, পারলুম না।

আস্তে আস্তে তার হাত দুটি ছাড়িয়ে নিয়ে আমার হাতের উপর বুলোতে বুলোতে বললে, আমি পাগল, না, কি? বন্ধু, তুমি কিছু মনে কর না। এই এক বছর ধরে-

বাধা দিয়ে অতি কষ্টে বলল, আমার উপর মেহেরবান হও-প্রসন্ন হও। আমি কি জানি নে আমি কত অভাজন। তুমি এ শহরে—

এবারে হেসে উঠে বাধা দিয়ে বললে,—’—সবচেয়ে সুন্দরী (আমি কিন্তু তার কুল গোষ্ঠির কথা বলতে যাচ্ছিলুম)। না? আমি কুৎসিৎ হলে তুমি আমায় ভালোবাসতে না-সে তো কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু আমি মাঝারি হলে কি করতে, বল তো?’

আমি ঝড় কাটাতে ব্যস্ত। হালের সঙ্গে পাল। বললুম, এ রকম প্রশ্ন আমি কোনও বইয়ে পড়ি নি। সাধারণত মেয়ে শুধায়, সে সুন্দরী না হলে ভালোবাসা পেত কি না?

উত্তর দাও।

‘আমি নিজে তো মাঝারি। তুমি তো বেসেছ। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তুমি তুর্কী রমণী। তুমি-’

ব্যস্‌, ব্যস্‌, থাক থাক। এবার এদিকে এস। আমার ব্যাগটা খোল তো। হ্যাঁ, ওই রুমালে বাঁধা জিনিস।

সামনের টেবিলে সেটি রেখে রুপোতে সিল্কেতে কাজ করা কিংখাপের রুমালের গিঁট আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে খুলতে লাগল যেন তীর্থের প্রসাদী। আমি এক দৃষ্টে দেখছিলুম, তার আঙুলের খেলা। প্রত্যেকটি আঙুল যেন এক একটি ব্যালে নর্তকী। হাতের কব্জী দুটি একদম নড়ছে না আঙুলগুলো এখানে যায়, সেখানে যায়, একটা অসম্ভব এ্যাঙ্গেল থেকে চট করে আরেক অসম্ভব এ্যাঙ্গেলে চলে যায়। পিয়ানো বাজানো এর কাছে কিছুই নয়; সে তো শুধু ডাইনে বাঁয়ের নড়ন চড়ন।

দুখনা রুমাল খোলার পর বেরল গাঢ় নীল রঙের চামড়ায় বাঁধানো একখান ছোট্ট বই। চামড়ার উপর সূক্ষ্ম সোনালী কাজ। চার কোণ জুড়ে ট্যারচা করে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুললতা পাতার নকশার কাজ তারই মাঝে মাঝে বসে ক্ষুদে ক্ষুদে পাখি। বইয়ের মাঝখানে একটি জোরালো গোল মেডালিয়ন, নামাঙ্কন-স্বাক্ষরলাঞ্চন সহ।

বললে, আরও কাছে এস।

আঙুলের ডগা দিয়ে আস্তে আস্তে এক একটি করে পাতার প্রান্ত বুলিয়ে সেটিকে উল্টোয় আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে যেন একটি করে নূতন বাগান। পাতার মাঝখানে কুচকুচে কালো কালিতে হাতের লেখা ফার্সী কবিতা আর তার চতুর্দিকের বর্ডারে আবার সেই লতা আর পাখির মতিফ। অতি ছোট্ট ছোট্ট গোলাপী রজেটের পাশে ডালের উপর বসে ক্ষুদে ক্ষুদে বুলবুল। কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে লতার উপর দুলছে, কখনও বা ঘাড় নিচু করে গোলাপ কুঁডির সঙ্গে কানে কানে কথা কইছে। সখী, জাগো, জাগো। পাঁচ ছটা রঙের এক সপ্তকেই সঙ্গীত বাঁধা হয়েছে, কিন্তু আসল পকড় সোনালী, নীল আর গোলাপীতে।

বললে, ‘লেখাটা করে দিয়েছেন আগা-ই-আগা ওস্তাদ সিরবুলন্দ্‌ কিজ্‌লবাশ। উনিই আমাদের শেষ জরীন-কলম, সোনার কলমের মালিক। তাঁর ছেলে পর্যন্ত হিন্দুস্থান চলে গিয়েছে ছাপাখানার কাজ শিখতে!’ একটি ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।

প্রতি দু পাতার মাঝখানে এক একখানি করে অতি পাতলা সাদা কাগজ। আতর মাখানো।

বুঝিয়ে বললে, পোকায় কাটবে না আর আতরের তেলের স্নেহ কাগজকে শুকনো হতে দেবে না। আমার মনে পরল সত্যেন দত্তের ফার্সী কবিতার অনুবাদ,

‘তবু বসন্ত যৌবন সাথে দুদিনেই লোপ পায়
কুসুমগন্ধী যৌবন পুঁথি পলে উলটিয়ে যায়।’

আবার এ কী অপয়া বচন? না, না। সৃষ্টির প্রথম দিনের প্রথম বুলবুলের সঙ্গে প্রথম গোলাপের মৃদু মর্মর গানে মর্মের বাণীর কানাকানি এখনও আছে, চিরকাল থাকবে।

শব্‌নম কিন্তু-কিন্তু করে কি যেন বলতে চাইছে, বলছে না। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেমুখ একেবারে সিদুরের মত টকটকে।

আমি তাকাতেই সেই মুখে যেন ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। শব্‌নমের মুখে শব্‌নম! ঘাড় ফিরিয়ে অপরাধীর মৃদুকণ্ঠে বললে, আর বর্ডারগুলো আমার আঁকা!

বলেই ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে।

আমি হরিণশিশুকে নরগিস বনের ভিতর দিয়ে নাচতে দেখলুম। আমার বুখারা-কার্পেট ছিল নরগিস মতিফ।

সিঁড়ির মুখে গিয়ে হাকলে, ‘আগা আবদুর রহমান। চা খাবে?’

আবদুর রহমান হুঙ্কার ছাড়লে, ‘চশম।’-যেন হুকুমটা কান্দাহার থেকে এসেছে, জবাব সেখানে পৌঁছনো চাই।

কী সৌজন্য! ‘চা খাবে?’ ‘চা আন’, নয়। অর্থাৎ ‘তুমি যদি খাও, তবে আমিও যেন এক পেয়ালা পাই।’ ভৃত্যকে সহচরের মত মধুর সম্ভাষণ। আর আমার আবদুর রহমানও কিছু কম নয়। ‘চশম’— অর্থাৎ আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা আমার ‘চশম’, চোখের মত কিস্মৎবার মূল্যবান।

আমার মূল বিস্ময় কিন্তু এতে তো চাপা পড়ে না।

তুমি এঁকেছ?

নীরব বীণা।

তুমি এঁকেছ?

যেন অতি দূরে সে বীণার প্রথম পিড়িং শোনা গেল। ‘বড় কাচাঁ।’

আমি সপ্তমে বললুম, ‘কাঁচা? আশ্চর্য! কাঁচা? তাজ্জব! ক’টা ওস্তাদ এ রকম পারে?’

এবারে কাছে এসে হেসে বললে, তুমি কিছু জান না। তাই তোমাকে কবিতা শুনিয়ে সুখ, তোমাকে ছবি দেখিয়ে আনন্দ।

আমি রাগ করে বললুম, ‘তুমি কি আমাকে অজ গাঁইয়া পেয়েছ? দিল্লীর মহাফিজখানাতে আমার দোস্ত রায় আমাকে কলমী কিতাব দেখায় নি?’

আমাকে খুশী করার জন্য বললে, ‘তাই সই, তাই সই, ওগো তাই সই। কিন্তু আমার ওস্তাদ আগা জমশীদ বুখারী বলেন, “রোজ আট ঘন্টা করে ত্রিশ বছর আঁকার রেওয়াজ করলে তবে ছবি আঁকার কল রপ্ত হয়। এবং তারপর চলে যাবে চোখের জ্যোতি।”

আমি অবাক হয়ে বললুম, বল কি?

‘হ্যাঁ। এবং বলেন, “কিন্তু কোনও দুঃখ নেই। তুমি নিজেই জান না তোমার মূল্য কি?”

‘মধু তার নিজ মূল্য নাহি জানে?’

খুশী হয়ে বললে, বিলকুল!—“প্রকৃত জহুরী সমঝে যাবে তোমার প্রথম ছবিতে কোন শেষ কথা লুকনো আছে, আর তোমার শেষ ছবির মিলে যাবে প্রথম ছবির প্রথম ঠেকায়।” তারপর তিনি খুব জোর দিয়ে বলতেন, “হুনরে যখন পরিপূর্ণতাই এসে গেল তখন তার পুনরাবৃত্তি করে লাভ কি? এবং যদিস্যাৎ তার পরও কিছু উদ্ধৃত থেকে যায় তবে সেইটে ভাঙ্গিয়ে খাবে তোমার শিষ্যেরা-তাদের জন্যও তো কিছু রাখতে হয়। তখন তোমার পাকা গম রঙের বেহালার সুর শোনা যাবে তাদের কাঁচা সবুজ বেহালার রেওয়াজে।”

আমি বললুম, চমৎকার।

‘আমি তাঁর প্রত্যেকটি শব্দ কণ্ঠস্থ করে রেখেছি।’

আমি শুধলুম, কার কাব্য আছে এতে?

‘অনেকের। তোমাকে যেগুলো শুনিয়েছি আর যেগুলো শোনাব। তুমি যে ক’টি বলেছ তাও আছে। তবে বেশীর ভাগ আবু তালিব কলীম কাশানীর। ইনি আসলে ইরানী কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমাদের বাদশা জাহাঙ্গীরের সভাকবি হন। আর আছে সাদ তবরীজীর। ইনিও হিন্দুস্থানে কিছুকাল ছিলেন-কলীমের বন্ধু। তখন ইরানে রব উঠেছে-

‘সকল মাথায় তুর্কী নাচন তোমার লাগি, প্রিয়ে,
লক্ষপতি হবে সবাই হিন্দুস্থানে গিয়ে!’

‘এসব আমি এবারে কান্দাহারে শিখেছি। পরে বলব।’

বললে, তুমি কখনও জানবে কি, বুঝবে কি, ছবি আঁকার সময় প্রতিটি মুহূর্তে তুমি আমার সামনে ছিলে? প্রতিটি তুলির টানে আছে তোমার চুল, প্রতিটি বাঁকা রেখায় আছে তোমার ভুরু। তোমার হাসি থেকে নিয়েছি গোলাপী, তোমার স্বর থেকে নিয়েছি রূপালী।

আমি বললুম, দয়া কর।

‘আমায় বলতে দাও। এই একবারের মত।’

‘শেষ বুলবুলের চোখ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে জানেমন্-বড় চাচা-ঘরে ঢুকে বললেন, “চলো মুসাফির, বাঁধ গাটুরিয়া, বহুদূর জানে হোয়েগা।” কাল সকালেই কবুল যাত্রা। বাদশা আপন গাড়ি পাঠিয়েছেন। তাঁর সবুর সইছে না। তাই তো তোমাকে খবর দিতে পারি নি।’

আবদুর রহমান চা নিয়ে এল। শব্‌নম বললে, ‘আগা রহমান তুমি তোপল খানকে প্রতিবারে কোর্মা-কালিয়া খাইয়েছ আর সিনেমা দেখিয়েছ। খুদা তোমার মঙ্গল করুন। এদিকে এস। এই নাও। কান্দাহার থেকে এনেছি।’

ব্যাগ খুলে শব্‌নম বের করলে তাবিজের মত ছোট্ট একখানি কুরান্ শরীফ। সঙ্গে আতশী কাঁচ। তাই দিয়ে পড়তে হয়।

আবদুর রহমান নিচু হয়ে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে হাতখানি আপন চোখে চেপে ধরল। তারপর কুরান্‌খানি দু’হাতে মাথার উপর তুলে ধরে আস্তে আস্তে চলে গেল! তার মুখের ভাব কি করে বর্ণাই! জোয়ানের ইয়া ব্বড়া মুখখানা যেন কচি শিশুর হাসিমুখে পরিণত হল।

কী অসাধারণ বুদ্ধিমতী এই শব্‌নম। জানত, অন্য কিছু আবদুর রহমানকে গছানো যাবে না।

শব্‌নমের আঁকা বর্ডার দেখতে গিয়ে সে শুধালে, আচ্ছা বলতো, এই বুলবুলের নাম কি?

আমি বললুম, বুলবুল তো এক রকমেরই হয়।

‘এই বুলবুল, এ বইয়ের সব বুলবুল শব্‌নম। বুলবুল এসেছিল বাগানে, সেই প্রথম গোলাপকে প্রেম নিবেদন করবে। এসে দেখে গোলাপ আগের থেকেই বাতাসে বাতাসে তার প্রেমের বারতা বিছিয়ে রেখেছে। গোলাপের কাছে পৌঁছবার বহু পূর্বেই সে সৌরভের ডাক শুনতে পেল, “এস, এস, প্রিয়া।” মনে আছে?’

‘তুমি কেন দুঃখ কর, বুলবুল? শব্‌নম যদি সমস্ত রাত গোলাপের উপর অশ্রুবর্ষণ না করত তবে কি সে ফুটতে পারত?’

জড়ানো কন্ঠে বললে, সেই ভালো, ওগো শব্‌নমের শরৎ-নিশির স্বপ্ন। এই নাও তোমার বই।

আমি প্রতিবাদ করেছি।

শান্ত কণ্ঠে বললে, এতে আছে আমার চোখের ঝরা জল। সে জল তো আমি চোখে পুরে নিতে পারব না। এই জল দেখে যখন তোমার চোখে জল টলমল করবে তখনই তো এ তার চরম মূল্য পাবে।

আমি বইখানা দুই হাত দিয়ে তুলে ধরে ঠোঁট চেপে চুমা দিলুম-

কিন্তু আমার চোখ দুটি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।

শব্‌নম আস্তে আস্তে, অতি ধীরে ধীরে, ঘাড় ঘোরালে। তার চোখে ছিল স্বচ্ছ জলের অতল রহস্য।

আমি বললুম, কিন্তু বন্ধু, তুমি তো এর আগেই আমাকে সওগাত দিয়েছ।

অবাক হয়ে বললে, কখন?

‘প্রথম রাত্রেই।’ বলতে বলতে আমি ওয়েস্ট কোটের বুক পকেট থেকে বের করলুম একটি সোনার ভিজিটিং কার্ড কেস। এটি আমি সওগাত রাখবার জন্য প্যারিস থেকে আনিয়েছিলুম। শব্‌নমের হাতে দিলুম।

সে খুলে দেখে ভিতরে একখানি ভিজিটিং কার্ড। সেই কার্ডে অতি সযত্নে জড়ানো একগাছি চুল!

‘চোর, চোর’ বলে চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল। তারপর ওস্তাদ সেতারী বাজনা আরম্ভ করার পূর্বে যে রকম সব কটা ঘাটের উপর টুংটাং করে হাত চালিয়ে নেন, সেই রকম পর্দার পর পর্দা হাসলে। বললে, ‘তাই বল। আমি পরদিন সকালবেলা চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখি একগাছা চুল কম। খোঁজ খোঁজ, ঢোঁড় ঢোঁড় রব পড়ে গেল চতুর্দিকে। শাহজাদীর একগাছা চুল চুরি গেছে। বাদশা জানতে পরে কোটালকে ডেকে কোফতা কাবাব করেন আর কি! আমি স্বয়ং গেলুম টেনিসকোর্টে, তারপর গেলুম হোটেলে, তোমার ঘরে-’

আমি অবাক হয়ে বললুম, আমার ঘরে?

হ্যাঁ রে, জান, হ্যাঁ। আমার জান্ গিয়েছিল। তখন আকাশে আদম সুরৎ-কালপুরুষ। তারপর মেঘ। তারপর বৃষ্টি। আমার জান্ ভিজে নেয়ে বাড়ি ফিরল। সেই হৃদয়-যাকে তুমি বল, “সে তো একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি।”

তাই বল! আমি ভেবেছিলুম, তোমার চোখ থেকে ভানুমতী বেরিয়ে কালপুরুষের আয়োনোস্ফিয়ারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে ঢুকল আমার চোখে।

‘ওরে খোদার সিধে, তাহলে যে এ ব্রহ্মাণ্ডে যত লোক তাকিয়েছিল—’ হঠাৎ থমকে গিয়ে বললে ‘ওই য্‌ যা। যে কাজের জন্য এসেছি, তাঁর আসলটাই ভুলে গিয়েছিলুম। তুমি বুধবার দিন সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে পারবে? এই ধর, তিনটে নাগাদ।’

আমি বললুম, ‘কি যে বল? কিন্তু কেন? আমি যে ভয় পাচ্ছি।’

এখনও তোমার ভয় গেল না? ওরে ভীরু, আমাকে বিশ্বাস করতে শেখ।

ব্যাগটা খোঁজাখুজি আরম্ভ করলেই বুঝতুম, এবারে তার যাবার সময় এসেছে।

শব্‌নম আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাৎ করলে।

আমি কাতর কণ্ঠে বললুম, ও-রকম তুমি হঠাৎ যেতে চাইলে আমার বড় বাজে। আমাকে একটু সয়ে নিতে দাও।

বললে, আমি যখন আসি, তখন তো বল না, “বাইরে সিড়িতে গিয়ে বস, একটু সয়ে নিতে দাও।”

তার বিদায়ের বেলা আমার কোন উত্তর জোগায় না।

দেউড়ির কাছে এসে আকাশের দিকে নাকটি তুলে দুবার শ্বাস নিলে। বললে, ‘শব্‌নম পড়ছে।’

এবারে কথা বলার শক্তি দয়াময় দিলেন। বললুম, ‘আমার শব্‌নম যেন মাত্র একটি গোলাপে বর্ষে।’

‘গোলাপে ঢুকে সে মুক্তো হয়ে গিয়েছে।’

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী