আমি জানি, কাবুলের শেষ বল-ডান্স কাল রাত্রেই হয়ে গিয়েছে। তবু সন্ধ্যার পর সেই অন্ধকার ভূতুড়ে বাড়ির চতুর্দিকে ঘোরপাক খেলুম। জানি, আজ আর টেনিস কোর্টে কেউ আসবে না। তবু সেখানে গেলুম। শুধু সেই বেঞ্চিটিতে বসতে পারলুম না। বলুম, একটা দূরের বেঞ্চিতে ওইদিকে তাকিয়ে। হায় রে, নির্বোধ মন! তোমার কতই না দুরাশা! যদি, কেউ মনের ভুলে সেখানে এসে বসে।

টেনিস খেলার ছলে পৃথিবীর সর্ব টেনিস কোর্টেই বহু নরনারী আসে প্রিয়জনের সন্ধানে, তার সঙ্গসুখ মোহে। এই কোর্টেও আসে দেশী বিদেশী অনেক জন। আমিও আসতে পারি। কিন্তু আমার এসে লাভ? কাবুলী মেয়েরা তো এখনো বাইরে এসে কোনো খেলা আরম্ভ করে নি।

আমার বন্ধু আসে যখন সব খেলা সাঙ্গ হয়ে যায়। এ খেলাতে তার শখ নেই। দিনের আলোতে লো তো সহজ—সবাই সবাইকে দেখতে পায়। তাতে আর রহস্য কোথায়? অন্ধকারের অজানাতে ঠিক জনকে চিনে নিতে পারাই তো সব চেয়ে বড় খেলা। শিশু যেমন গভীরতম অন্ধকারে মাতৃস্তন্য খুঁজে পায়। তাই বুঝি মৃত্যুর ওপারে আমাদের জন্য চেয়ে বড় খেলা লীলাময় রেখেছেন।

মিথ্যা, মিথ্যা, সব মিথ্যা। কেউ এল না।

অত্যন্ত শ্লথ গতিতে সে রাত্রি বাড়ি ফিরেছিলুম। তীর্থযাত্রী যে রকম নিফল তীর্থ সেরে বাড়ি ফেরে।

ডিনার শেষ হয়ে গিয়েছিল। আবদুর রহমান কিছু স্যাণ্ডউইচ সাজিয়ে রাখছিল। তাড়াতাড়ি বললে, ‘এখনো কিচেন বোধ হয় বন্ধ হয় নি; আমি গরম সূপ নিয়ে আসি।’

আমি বললুম, না।

পরদিন বেলা দশটা নাগাদ আবদুর রহমান আমার কোট পাতলুন বুরুশ করতে করতে কথায় কথায় বললে, ‘সর্দার আওরঙ্গজেব খান কাল সন্ধ্যায়ই বিবি বাচ্চা-বাচ্চী সমেত কাবুল চলে গেছেন। তাঁর পিসী গত হয়েছেন।’

অন্য সময় হলে হয়তো শুনেও শুনতুম না, কিংবা হয়তো অলস কষ্টে নীরস প্রশ্ন শুধাতুম, ‘সর্দারটি কে।’

এখন আমি আবদুর রহমান কি জানে, কি করে জানে, কতখানি জানে, এসবের বাইরে। একদিন হয়তো আরো অনেকে জানবে, তাতেই বা কি? সেই যে ইরানী কবি বলেছেন,

“কত না হস্ত চুমিলাম আমি অক্ষমালার মত,
কেউ খুলি না কিস্মতে ছিল আমার গ্রন্থি যত।”

‘দন্ত-ই হর-কসরা বসানে সবহং বুসীদম্‌ চি সূদ
হীচ কসন কশওদ আখির অদয়ে কারে মরা।’

অক্ষমালার মত পূতপবিত্র হয়ে সাধুসজ্জনের মন্ত্রোচ্চারণের পূণ্যকর্মে লেগেও যদি তার ‘গেরো’ থেকেই যায়, তবে আবদুর রহমানের হাতে দু পাক খেতেই বা আপত্তি কি?

প্রথমটা সত্যই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলুম।

অথচ দিনের আলো যতই ম্লান হতে লাগল, ততই মনে হতে লাগল এই জঙ্গলী পাগমান শহরটা বড়ই নোংড়া। দুনিয়ার যত বাজে লোক জমায়েত হয়ে খামকা হৈ হুল্লোড় করে। এর চেয়ে কাবুল ঢের ভালো।

দেখি, আবদুর রহমানেরও ওই একই মত। অথচ এখানে সাত দিনের ছুটি কাটাবার জন্য সে-ই করেছিল চাপাচাপি। এখনো তার তিন দিন বাকী।

সকালে দেখি, আবদুর রহমান বাক্স-প্যাঁটরা গোছাতে আরম্ভ করেছে। মনস্থির করাতে সে ভারী ওস্তাদ।

হিন্দুস্থানী সদাগররা দুঃখিত হলেন। বললেন, ‘কাবুলে আবার দেখা হবে।’

বাস্ পাগমান ছাড়তেই মনে হল, সর্বনাশ!

শব্‌নম বানু যদি আবার পাগমানে ফিরে আসে?

আর ভাবতে পারি নে রে, বাবা!

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী