পুরাতন ভৃত্যকে ছেড়ে বাড়ি ফেরা পীড়াদায়ক হলেও, সে সঙ্গে থাকলেই গৃহ মধুময় হয়ে ওঠে তার কোনো প্রমাণ আমি পেলুম না। সেই নিরানন্দ নির্জন গৃহ। খান কয়েক বই। এগুলো প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।

আচমকা একটা বুদ্ধি খেলল মাথায়। এক দোর বন্ধ হলে দশ দোর খুলে যায়; বোবার এক মুখ বন্ধ হলে দশ আঙুল তার ভাষা তর্জমা করে দেয়। আমার যদি সব দ্বার বন্ধ হয়ে গিয়ে মাত্র একটি খুলে যায় তাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। সে দ্বার দিয়ে বেরিয়ে আমি কোথায় গিয়ে পৌঁছব তার খবরও আমি জানতে চাই নে। দিগন্তের কাবার ছবি আমি দেখতে চাই নে, হে প্রভু! তুমি শুধু একটি কদম ওঠাবার মত আলো ফেলো।

ফার্সী শিখব—যে ফার্সীকে এত দিন অবহেলা করেছি।

তরুণরা এটা শুনে নিরাশ হবে। তারা ওই সময়ে স্বপ্ন দেখে অসম্ভব অসম্ভব বিষয়ের। প্রিয়ার ঘরে যদি আগুন লাগে, দমকলের লোকও তাকে বাঁচাবার জন্যে সাহসে বুক বেঁধে না এগোয়, সে তখন কি রকম লাফ দিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে তাকে বাঁচাবার জন্যে। ইংরেজকে খুন করে প্রিয়া ধরা পড়েছেন; ফাঁসীর জন্যে তৈরী হয়ে সে সব দোষ আপন স্কন্ধে তুলে নিল-প্রিয়া জানতে পর্যন্ত পারলে না।

প্রবীণরা এসব স্বপ্নের কথায় হাসেন। আমি হাসি নে।

ধন্য হোক তাদের এ সুখ-স্বপ্ন! মৃত্যুঞ্জয় হোক তাদের এ দুরাশা! এগুলোই তো তপ্ত ভূতলোকে সরস শ্যামল করে রেখেছে। নন্দনকাননের যে হাসি মুখে নিয়ে শিশু-কুসুম চয়নে তার শেষ রেশ।

তার তুলনায় ফার্সী শেখা কিছুই নয়। বজ্র-নির্ঘোষে ঝিঁঝির নূপুরু-নিক্কণ!

প্রবীণরা অবশ্য এটাকেই প্রশংসা করতেন। আজ যদি আমি শব্‌নম বানুকে চিঠি লিখতে যাই? আমার ফার্সী কাঁচা, ফরাসী দড়কচ্চা।

বেরলুম ফার্সী বইয়ের সন্ধানে, কাবুলী বন্ধুদের বাড়িতে। তারা খুশী হবে। নিরপরাধ অকারণে বর্জিত প্রথমা প্রিয়ার সন্ধানে নির্গত প্রণয়ীর নব অভিসার প্রিয়জন প্রসন্ন বদনে আশীর্বাদ করে। ফার্সীকে আমি অকারণে বর্জন করেছিলুম।

এই বেরনোর পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, এ কথা বলব না।

আজ কেন, সেদিনও আমার মাতৃভূমিতে ক্ল্যাসিক আনাদৃত। অনুন্নত কাবুলে তা নয়। সেদিনও স্বয়ং মাইকেল যদি কলেজ স্ট্রীটে এসে নিজের বইয়ের সন্ধান করতেন তবে  সেগুলো বের করা হত পিছনের গুদোম থেকে। তিনি তখন ইরানী কবির মতই দুঃখ করে বলতে পারতেন,

“রাজসভাতে এসেছিলাম বসতে দিলে পিছে,
সাগর জলে ময়লা ভাসে, মুক্তো থাকে নিচে।”

মাইকেলের দুঃখ বেশী। পুস্তক-সভাতেও তিনি পিছনে।

এখানে হাফিজ সাদী কলীম পয়লা শেলফে। কিছু বই কিনলুম। ধারের বইয়ে নাকি বিদ্যার্জন হয় না।

ফেরার পথে কলেজের ছেলেদের সঙ্গে দেখা। তারা চেপে ধরলে, কাবুল নদীতে সাঁতারে যেতে। মনে মনে বললুম, ওখানে যা জল তা দিয়ে কাশীরাম দাশের জলের তিলকও ভালে কাটা যায় না। শেষটায় ঠিক হল তিন দিন পর, ছুটির শেষ দিনে।

তীব্র আবেগে ফল আসন্ন। তিন দিনেও অনেকখানি ফার্সী শেখা যায়।

তিন দিন পরে সাঁতারে এসেছি।

খানিকক্ষণ পরই ছেলেরা আমার কথা ভুলে গিয়ে আপন আনন্দে মেতে উঠল। আমি আস্তে আস্তে ভাটির দিকে বুকজল ঠেলে ঠেলে, কখনো বা দু দিক থেকে নুয়ে পড়া গাছের পাতা চোখের সামনে থেকে হাত দিয়ে ঠেলে এগুতে লাগলুম। সামনে একটু গভীর জল। সাঁতার কেটে ডান পায়ে উঠে গাছের ঝোপে জিরোতে বসলুম। যত দমন্থরই হোক, স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে সম্মোহন আছে।

পিছন থেকে শুনি, ‘এই যে!’

তাকিয়ে দেখি শব্‌নম।

এক লম্ফে জলে নামলাম। ভেবে নয়, চিন্তা করে নয়—সাপ দেখলে মানুষ যেরকম লাফ দেয়। আমার পরনে সাঁতারের কস্ট্যুম। কত যুগ যুগ সঞ্চিত প্রাচ্যভূমির এ সংস্কার।

‘উঠে আসুন, উঠে আসুন, এখুনি উঠে আসুন।’

কোনো উত্তর নেই।

‘উঠবেন না? আচ্ছা, তবে দেখাচ্ছি।’ বলেই হ্যাঁণ্ডব্যাগ হাতড়াতে লাগল।

মেরেছে! না—মারবে। পিস্তল খুঁজছে নাকি?

কাতর কণ্ঠে বললে, ‘দেখুন, আপনি মীন এডভেটেজ নেবেন না। আমার পিস্তলে গুলি নেই।’ একটু ভেবে বললে, ‘ও, বুঝেছি। পরনে কস্ট্যুম। তা, উঠে আসুন। এই নিন আমার গায়ের ওড়না। এইটে জড়িয়ে বসবেন।’

এ তো আরও মারাত্মক। কাবুলিনীবেশে ওরনা শুধু অঙ্গভরণ নহে, কিছুটা অঙ্গাবরণও বটে।

ততক্ষণে আমার বেশ বিষয়ের সংস্কার কেটে গিয়েছে। তার চেয়েও যে প্রাচীন সংস্কার সেইটে এসে সোনার বাঁশী বাজাতে আরম্ভ করেছে। সে সংস্কারের সোহাগে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নক্ষত্রলোক আপন গতি খুঁজে পায়।

‘আপনি আমাকে কি করে খুঁজে পেলেন?’

প্রথমটায় চুপ করে গেলুম। মিথ্যে উত্তর দিতে যে একেবারেই ইচ্ছে যায়নি এ কথা বলব না।

শব্‌নম চুপ করে থাকতে পারে না। উত্তর না দিলে শাসায়। এবারে কিন্তু নীরব প্রতীক্ষায় বসে রইল।

ভালো ভাবেই বুঝে গেলুম এবারে সে উত্তর না নিয়ে ছাড়বে না। বললুম, ‘আপনাকে আমি সব খানেই খুঁজছি।’

মুখ খুশীতে ভরে উঠল। হঠাৎ আবার আকাশের এক কোণে মেঘ দেখা দিল। শুধালে, ‘আমার বাগানবাড়ি কাছেই, জানতেন?’

কেন জানি নে, বলতে ইচ্ছে হল না যে, তাদের কাবুলের বাড়ি বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় তার স্বটুকু ওর বানানেওলা রাজমিস্ত্রির চেয়েও আমি বেশী জানি। বললুম, না।

এবারে যেন তার কান্না পেল। বললে, ‘ও! বুঝেছি। সাঁতার কাটবার ফুর্তি করতে এসেছিলেন।

এই এত দিনে আমার সত্যকার বাজল।

আজ না হয় ঠাট্ট-মস্কারা, রঙ্গ-রসিকতা করে মনের গভীর আবেগ, তার গোপন ক্ষুধা, তার অসম্ভব অসম্ভব স্বপ্ন-চয়ন, তার বদ্ধ পাগলামি যতখানি পারি ঢেকে চেপে বলছি কিন্তু তখন, হায়, এ হালকামি ছিল কোথায়?

বলুলম, “দেখুন, শব্‌নম বানু, আমি বিদেশী। বিদেশে অনেক মনোবেদনা। তার উপর যখন মানুষ ভালোবাসে-”

সঙ্গে সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে শব্‌নম তার হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল।

আমি ভয়ে লজ্জায় মারা গেলুম। ছি ছি! আমি কী করে এ কথাটা বলে ফেললুম? কোথা থেকে আমার এ সাহস এল? কিন্তু আমি তো সাহসে বুক বেঁধে এ কথা বলি নি। এ তো নিজের থেকেই বেরিয়ে গিয়েছে।

তার চেয়েও আশ্চর্য, শব্‌নম আমার মুখের উপর তার হাতের চাপও ছাড়ছে না।

বলো না, বলো না। আমি ঠিক করেছিলুম ও কথাটা আমি আগে তোমাকে বলব।

দুজনাই অনেকক্ষণ চুপ!

শব্‌নমই প্রথম কথা বললে।

বললে, ‘আমি ভেবেছিলুম আমি প্রথম বলব, আর তুমি আমাকে অবহেলা করবে।’

আমি অবাক হয়ে বললুম, “সে কি?”

তাড়াতাড়ি বললে, থাক, থাক। আজ এসব না। অরেক দিন এসব কথা হবে। আজ শুধু আনন্দের কথা বল। সর্ব প্রথম বল, তুমি কখন আমাকে ভালোবাসলে?

আমি বললুম, “সে কি করে বলি? তুমি কখন বাসলে বল।”

উৎসাহের সঙ্গে বললে, সে অতি সহজ। হোটেলের বারান্দায় যখন তোমাকে ডেকে পাঠালুম। তুমি যখন কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলে না, তখন। জান না ইস্পাহানি কবি সাঈব্‌ কি বলেছেন,

“খমূশী হতে নাতি বুদ জুইআই-ই-গওহররা,
কি আজ গওওয়াস দর দরিয়া নফস বীরুন নমীআয়াদ।।”

‘গভীরে ডুবেছে যে জন জানিবে মুক্তার সন্ধানে,
বুদবুদ হয়ে তার প্রশ্বাস ওঠে না উপর পানে।।’

আমি বললুম, এ কবি সত্যই জীবন দেখেছিলেন কাবুলে এ কবি কিন্তু জন্মাতে পারত না।

“কেন?”

‘ডুব দেবার মত জল এখানে কোথায়?’

‘সে কথা থাক। আমার কিন্তু ভারী দুঃখ হয়, তুমি আমার বয়েতের পাল্টা বয়েৎ দিতে পার না বলে।’

আমি নিশ্বাস ফেলে বললুম, সে কি আমার হয় না।

‘চুপ। আবার ভুল করেছি। বলেছিলুম দুঃখের কথা তুলব না।’

আমি কিন্তু জোর ফার্সী শিখতে আরম্ভ করেছি।

কী আনন্দ! বাবার মজলিসে কত বিদেশী আসে, কেউ ভালো ফার্সী বলতে পারে না। তুমি শিখলে আমার খুব গর্ব হবে। তুমি আমারই জন্য শিখছ। সে আমি জানি।

‘তোমার মুখে ‘তুমি’ বড় সুন্দর শোনায়।’

বাধা পড়ল। কার যেন গলার আওয়াজ।

তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে বললে, এবার তুমি এস। তোমাকে খুদার আমানতে দিলুম।

আমি জলে নামতে নামতে বললুম, আর কিছু বল।

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী