পেঙ্গুইন যে ডায়রিটা ছাপছিল সেটা ১৯৮৯ ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। পুলিশ, যেটা পাণ্ডুলিপি খুঁজতে খুঁজতে মুনসীর শোবার ঘরে পেয়েছে, সেটাতে দৈনিক এনট্ৰ আছে ১৯৯০ পয়লা জানুয়ারি থেকে মুনসী মারা যাবার আগের রাত, অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ডায়রিটা সম্ভবত খাটের পাশের টেবিলে রাখা ছিল। সেখান থেকে মাটিতে পড়ে যায়। পুলিশ সেটাকে মাটিতেই পায়।

ডায়রিটা সোমের কাছ থেকে নিয়ে প্রথম পাতা খুলেই ফেলুদার চোখ কীসে আটকে গেল। কিছুক্ষণ ভ্রূকুটি করে পাতাটির দিকে চেয়ে থেকে আবার যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে পাশে দাঁড়ানো শঙ্করবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি জানতেন যে আপনার বাবা ডায়রি রাখার অভ্যোসটা শেষদিন পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন?

একেবারেই না। তবে শুনে যে অবাক হচ্ছি তা নয়, কারণ চল্লিশ বছর একটানা লিখে হঠাৎ বন্ধ করার তো কোনও কারণ নেই।

সুখময়বাবু জানতেন এই ডায়রির কথা?

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন।

আমরা সকলে বসবার ঘরে জমায়েত হয়েছিলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই সুখময় চক্রবর্তী

এলেন। ফেলুদা প্রশ্ন করতে সুখময়বাবু বললেন, ডা, মুনসী ডায়রি লিখবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু উনি কাজটা করতেন দিনের শেষে শুতে যাবার আগে। ডায়রিও শোবার ঘরেই থাকত নিশ্চয়ই, এই লাল বই আমি কোনওদিনই দেখিনি।

বসুন।

সুখময়বাবু দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, ফেলুদা বলতে যেন একটু অবাক হয়েই বসলেন। আমি বুঝলাম ফেলুদা আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়।

সুখময়বাবু, বলল ফেলুদা, আপনি নিশ্চয়ই চান যে ডাঃ মুনসীর আততায়ীর উপযুক্ত শাস্তি হাক। তাই নয় কি?

আমার দায়িত্ব, বলে চলল ফেলুদা, হল সেই আততায়ীকে খুঁজে বার করা। একটা কারণে এখন আমরা বুঝতে পারছি যে আততায়ী এই বাড়িতেই রয়েছেন। সেদিন আমি এই বাড়িতে যাঁরা থাকেন তাদের প্রত্যেককে জেরা করেছি। তার ফলে আমি এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। হয়তো আমার তরফ থেকেই যথেষ্ট প্রশ্ন করা হয়নি, এবং যাদের প্রশ্ন করেছি। তারা আমার সব প্রশ্নের জবাব দেননি। একটা প্রশ্ন আমি করিনি, আজ করতে চাই।

বলুন।

একটা ব্যাপারে আমাদের মনে খটকা জেগেছে।

কী??

শঙ্করবাবুর মতে ডাঃ মুনসী তাঁর লেখা এবং পেশেন্ট ছাড়া আর সবকিছু সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। কিন্তু আপনি তো তাঁর পেশেন্টও নন, তা হলে আপনার প্রতি তিনি এতটা স্নেহবর্ষণ করবেন কেন? ডায়রিতে পড়েছি পাঁচ বছর আগে আপনার অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়; তার সমস্ত খরচ মুনসী বহন করেন। অপারেশনের পর আপনি দশ দিনের জন্য পুরী যান; সে খরচও তিনি বহন করেন। কেন? এর কোনও কারণ আপনি দেখাতে পারেন? এই পক্ষপাতিত্ব কীসের জন্য?

জানি না।

উত্তরটা আসতে যৎসামান্য দেরি হল সেটা নিশ্চয়ই ফেলুদা লক্ষ করেছে। সেটা তার পরের কথা থেকেই বুঝতে পারলাম।

আমি আবার বলছি সুখময়বাবু, আপনি সত্যি কথা বললে, রা গোপন না করলে, আমাদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়৷

এবারে উত্তরে দেরি হল না।

আমি সত্যি বলছি।

 

লালমোহনবাবু আমাদের নামিয়ে দিয়ে টুমরো মর্নিং বলে গড়পার ফিরে গেলেন। ফেলুদা সোজা তার শোবার ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বুঝলাম সে ডায়রিতে মনোনিবেশ করবে। ঘড়িতে এখন তিনটে পঁচিশ।

পাখাটা ফুল স্পিড করে দিয়ে সোফায় গা ছড়িয়ে শুয়ে আমি একটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন খুলে অ্যানটাৰ্কটিকার বিষয় চমৎকার সব ছবি সমেত একটা লেখা পড়তে লাগলাম। সাড়ে চারটেয় শ্ৰীনাথ চা আনল। আমারটা টেবিলের উপর রেখে ফেলুদার ঘরের দরজায় টোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা বেরিয়ে এসে বলল, এ ঘরেই চা দাও।

বুঝতেই পারছি ডায়রিটা পড়া হয়ে গেছে, তাই জিজ্ঞেস করলাম, কিছু পেলে?

ফেলুদা কাউচে বসে পকেট থেকে ডায়রি আর চারমিনারের প্যাকেটটা বার করে টেবিলের উপর রেখে গরম চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল, তোকে কয়েকটা আইটেম পড়ে। শোনাচ্ছি। আমার মনে হয় চিন্তার খোরাক পাবি।

আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম। ডায়রির মাথার দিকটা দিয়ে কয়েকটা ছোড়া কাগজ উর্কি মারছে। ফেলুদা কোনওরকম তাড়াহুড়ো না করে একটা চারমিনার ধরিয়ে প্রথম টুকরো মার্কে ডায়রিটা খুলল।

শোন, এটা তিন সপ্তাহ আগের এনস্ট্রি। আমি ইংরিজি থেকে বাংলা করছি। আজ একটা নতুন পেশেন্ট। রাধানাথ মল্লিক। আমার ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে প্রথমেই পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে হাতের তেলোয় রেখে সেটার দিকে আর আমার দিকে বারিকয়েক দেখে কাগজটা দিলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিল। ওটা কী ফেললেন জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক বললেন, টেলিগ্রাফের খবর আপনার ছবি সমেত। আমি বললাম, আপনি কি যাচাই করে নিলেন ঠিক লোকের কাছে এসেছেন। কিনা? এবারে একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ ল। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, কাউকেই না! যাচাই করে নিতে হবে। বইকী!…পার্সিকিউশন মেনিয়া!

চার পাতা পরে দ্বিতীয় এনট্রি।

শোন–আর. এম.-কে নিয়ে সমস্যা। সে নিজের বাড়িতে একদণ্ড টিকতে পারে না। তার দাদা, তার পড়শি সকলেই তার মনে আতঙ্কের সঞ্চার করছে। ডিফিকাল্ট কেস। আমি বলেছি কাল থেকে যেন সে আমার এখানে চলে আসে। দুটো ঘর তো খালি পড়ে আছে দোতলায়; তার একটাতেই থাকবে।

তৃতীয় এনট্রি, এটাও দিন চারেক পরে।

আর, এম.-কে নিয়ে সমস্যা মিটছে না। আজ ওকে কাউচে শোয়ানোর আগে ও আমার আপিসে এসে বসেছিল। আমি তখন বিলেত থেকে সদ্য আসা একটা জরুরি চিঠি পড়ছি। পড়া শেষ করে ওর দিকে চেয়ে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম। আমার ভারী কাচের পেপার ওয়েটটা হাতে নিয়ে ও কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। ও যদি আমাকেও ওর শত্রুপক্ষ মনে করে তা হলে তো মুশকিল।

চার নম্বর এনট্রি।

আমার ওষুধের শিশিটা ভুল করে আপিস ঘরে ফেলে এসেছিলাম; রাত্রে শোবার আগে সেটা আনতে গিয়ে প্যাসেজ থেকেই বুঝলাম ঘরে বাতি জ্বলছে। ভেবেছিলাম হয়তো সুখময় কোনও কাজ করছে, কিন্তু গিয়ে দেখি শঙ্কর। সে আমার দিকে পিঠ করে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের নীচের দেরাজটা বন্ধ করছে। আমায় দেখে ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল ওর এয়ার মেল খাম ফুরিয়ে গেছে। তাই এখানে আছে কিনা দেখতে এসেছিল। আমি ওকে দুটো খাম দিয়েছিলাম। .ওই দেরাজেই থাকে আমার পাণ্ডুলিপি।

এরপরে একেবারে শেষ পাতায় শেষ এনট্রি। এর সঙ্গে রাধাকান্ত মল্লিকের কোনও যোগ নেই। আর এটা সত্যিই রহস্যজনক।

কী ভুলই করেছিলাম!..যাক, তবু যে ভুলটা ভেঙেছে! কিন্তু আর-এর জের কি তা হলে অনির্দিষ্টকাল ধরে চলবে? নাকি ওটা নিয়ে অযথা চিন্তা করছি?

ফেলুদা ডায়রিটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অদ্ভুত কেস!

তার মানে রহস্যের জট এখনও ছাড়াতে পারনি?

না, তবে কীভাবে প্রোসিড করতে হবে তার একটা ইঙ্গিত পেয়েছি। এবার কিছু দৈহিক পরিশ্রম আছে। রুটিন এনকোয়ারি। তুই জটায়ুকে ফোন করে বলে দে কাল যেন সকালে না। এসে বিকেলে আসেন। সকালে আমি থাকছি না।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়