বাড়ি ফিরতে ফিরতে বারোটা হয়ে গেল। লালমোহনবাবু সকালে স্নান সেরে বেরোন, কাজেই সে সমস্যাটা নেই। তাঁকে বললাম দুপুরের খাওয়াটা আজ এখানেই সরতে। ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন।

মহীয়সী মহিলা! পাখাটা খুলে ফুল স্পিড করে তাঁর প্রিয় কাউচটায় বসে বললেন লালমোহনবাবু, এত বড় একটা ট্র্যাজিডিতে এতটুকুটস্কীননি! অথচ ভাইটা একেবারে গোবর গণেশ।

সেই জন্যেই মহিলার ভাইয়ের উপর এত টান, বলল ফেলুদা, এ বড় জটিল মনোভাব, লালমোহনবাবু! মেহ, অনুকম্পা, এসব তো আছেই; তার মধ্যে কোথায় যেন একটা মাতৃত্বের রেশ রয়েছে। ভদ্রমহিলার নিজের কোনও ছেলেপিলে নেই, এবং ডাঃ মুনসীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছেলের প্রতিও টান নেই, এসব কথা ভুলবেন না।

তার উপরে যমজ।

তা তো বটেই।

আপনার কি মনে হয়। ভদ্রমহিলার ডাঃ মুনসীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না?

সেটা মুনসী পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ না থাকলে বলা মুশকিল। গোয়েন্দাকে যা বোঝার বুঝতে হয় দুটি ইন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে, কান আর চোখ।

এক্ষেত্রে কান কী বলছে?

মনে একটা খটকা জাগাচ্ছে।

কী সেটা?

সেটা আপনারা কেন বোঝেননি তা জানি না।

এবারে আমি একটা কথা না বলে পারলাম না।

তুমি বলতে চাও ওঁর কথা শুনে মনে হল উনি ডায়রিটা পড়েছেন?

সাবাস, তোপ্‌সে, সাবাস।

কেন মশাই ডায়রিতে কী ধরনের জিনিস আছে সেটা তো মুনসী মুখেও বলতে পারেন।

একই হল লালমোহনবাবু, একই হল।

মুনসীর কথায় মনে হয়েছিল ওই তিন ব্যক্তির ঘটনা ছাড়া জায়রিতে কী আছে তা কেউ জালে না। এখন মনে হচ্ছে কথাটা হয়তো ঠিক না।

তবে এটা তো বোঝা যাচ্ছে ডাঃ মুনসীর স্ত্রীর প্রতি মোটেই বিরূপভাব পোষণ করতেন না। ডায়রির প্রথম পাতা খুললেই সেটা প্রমাণ হয়। যে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা নেই, তাকে কেউ বই উৎসর্গ করে না।

আপনি দেখছি ফৰ্মে আছেন। ভেরি গুড।

আরেকটা ব্যাপারে। আমি কানকে কাজে লাগিয়েছি মশাই, আপনি নিশ্চয়ই অ্যাপ্রিশিয়েট করবেন। ডাঃ মুনসী নিজের ছেলের প্রতি যে মনোভার দেখিয়েছেন তাতে তাকে শুষ্কং কাষ্ঠং বলে মনে হওয়া আশ্চর্য নয়! কিন্তু সেইখেনে দেখুন, তাঁর সেক্রেটারির প্রতি তাঁর কত দরদ!

গুড। গুড। ফেলুদা যে অন্যমনস্কভাবে তারিফটা করে সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি আরম্ভ করে দিল।

কী ভাবছেন মশাই? প্রায় এক মিনিট চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলেন জটায়ু।

ভাবছি যে তিন উহ্য নামের মধ্যে একজনই রয়ে গেল। যার আসল পরিচয়টা পাওয়া গোল না। ফলে মামলাটার মধ্যে একটা ফাঁক রয়ে গেল যেটা আর পূরণ হবে না।

আপনার কি মনে হয় ডাঃ মুনসী কোনও তথ্য—

ক্রি-ং-ং-ং!

আমাদের এই নতুন নীল টেলিফোনটার আওয়াজ আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি জোর। ফেলুদা রিসিভারটা তুলে হ্যালো বলল।

অবিশ্বাস্য টেলিফোন। যাকে ফেলুদা টেলিপ্যাথি বলে এ হল ষোল আনা তাই। কার সঙ্গে কী কথাবার্তা হল সেটা ফেলুদা ফোন নামিয়ে রেখেই বলেছিল; আমি যখন ঘটনাটা লিখতে যাব, তখন ও বলল, যদিও তুই ফোনটার সময় শুধু আমার কথাগুলো শুনেছিলি, লেখার সময় এমন ভাবে লেখা যেন দুই তরফের কথাই শুনতে পাচ্ছিস। তা হলে পাঠক মজা পাবে।

আমি ওর কথামতোই লিখছি।

হ্যালো।

মিঃ মিত্তির?

হ্যাঁ।

আমি ‘আর’ কথা বলছি।

‘আর’?

মুনসির ডায়রির ‘আর’।

ও। তা হঠাৎ আমাকে ফোন কেন? মুনসীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা। আপনি জানলেন কী করে?

আপনি আজ সকালে মুনসীর বাড়ি যাননি?

তা তো যাবই। মুনসী আজ ভোর রাত্রে খুন হয়েছেন। সেই কারণেই যেতে হয়েছিল।

আপনার চেহারা অনেকের কাছেই পরিচিত। সেটা আপনি জানেন বোধহয়। মুনসীর বাড়ির সামনে ভিড় এবং পুলিশ দেখে প্রতিবেশীদের অনেকেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই একজন আপনাকে চিনে ফেলে–আমার এক পেশেন্ট। আমিও ডাক্তার সেটা জানেন কি? এই পেশেন্টের বাড়ি গেস্‌লাম ঘণ্টাখানেক আগে। তারই কাছে শুনি মুনসীর মৃত্যু ও আপনার উপস্থিতির খবর। দুইয়ে দুইয়ে চার করে বুঝি, মুনসী আপনাকে এমপ্লয় করেছিল।

আপনার আসল নামটা জানতে পারি কি?

না, পারেন না। ওটা উহাই থাকবে। আমি জানতে চাই মুনসী আপনাকে আমার সম্বন্ধে কী বলে।

উনি বলেন, আপনাকে উনি যথেষ্ট চেনেন এবং আপনাকে নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। ডায়রিটা বেরুচ্ছে এবং তাতে আপনার অতীতের ঘটনা থাকছে জেনেও নাকি আপনি কোনও আপত্তি করেননি।

ননসেন্স। সম্পূর্ণ মিথ্যা। ও আমাকে জানাবে কী করে? আমি তো পনেরো দিন বাইরে থেকে কলকাতায় ফিরেছি। সবে পরশু রাত্রে। বাড়িতে এসে পুরনো স্টেটসম্যান ঘাঁটতে ঘাঁটতে মুনসীর ডায়রি পেঙ্গুইন ছাপছে এ খবরটা দেখি। খবরটা পড়ে আমার অস্বস্তি লাগে। মুনসী সাইকায়াট্টিস্ট হওয়াতে অনেক মনোবিকারগ্রস্ত ব্যক্তির হাঁড়ির খবর সে জানে; আমার তো বটেই। সে সব কথা কি সে ডায়রিতে লিখেছে?

আমি মুনসীকে ফোন করি। সে স্বীকার করে যে আমার ঘটনা তার ডায়রিতে স্থান পেয়েছে, তবে আমার নাকি চিন্তার কোনও কারণ নেই। এই জন্যে যে আমার নামের শুধু প্ৰথম অক্ষরটা ব্যবহার করা হয়েছে। …কিন্তু তাতে আমি আশ্বস্ত হব কেন? আমি চব্বিশ বছর আগেও ডাক্তার ছিলাম, এখনও আছি। তখনকার অনেক পেশেন্ট এখনও আমার পেশেন্ট। ডায়রি থেকে তারা আমায় চিনে ফেলবে না তার কী গ্যারান্টি?

আমি কিন্তু ডায়রিটা পড়েছি। আমার মনে হয় আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই।

আপনি যখন পড়েছেন তখন আমিও পড়ব। সে কথাটা আমি মুনসীকে বলি। আমি বলি যে তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজে তোমার লেখা পড়ে বিচার করুব সেটা ছাপলে আমার কোনও ক্ষতি হবে কিনা। তুমি আমাকে লেখাটা দাও। যদি না দাও তা হলে তোমার অতীতের ঘটনা আমি ফাঁস করে দেব।

এ আবার কী বলছেন আপনি?

মিস্টার মিত্তির, আমি আর মুনসী একই বছর লন্ডনে যাই ডাক্তারি পড়তে। আমার বিষয় যদিও মনোবিজ্ঞান ছিল না, কিন্তু আমাদের দুজনের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। আমি মুনসীর যে চেহারা দেখেছি সে চেহারা কলকাতার কেউ দেখেনি। সে সেখানে উচ্ছন্নে যেতে চলেছিল, আমি তাকে সামলাই, তাকে সোজা পথে নিয়ে আসি। কলকাতায় ফিরে এসে প্র্যাকটিস শুরু করার পর সে ক্রমে ক্ৰমে নিজেকে সংস্কার করে।

আপনি মুনসীর বাড়ি গিয়ে তাঁর কাছ থেকে লেখাটা চেয়ে আনেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। গতকাল রাত এগারোটায়। বলেছিলাম দুদিন পরে লেখাটা ফেরত দেব। এখন অবিশিষ্ট তার কোনও প্রয়োজন নেই।

নেই মানে? আপনি পাণ্ডুলিপি ফেরত দিলেই সেটা ছাপা হবে। লেখকের মৃত্যুর পর তার বই ছাপা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। একে ইংরিজিতে পাসথু মাস পাবলিকেশন বলে সেটা আপনি জানেন না?

জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা হবে না। লেখাটা আমি পড়েছি। সেটা আমার কাছেই থাকবে। বই হয়ে বেরোবে না। আসি।

ফেলুদা রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল, তার মুখ গম্ভীর।

লোকটা এমন করে আমার উপর টেক্কা দিল! খপ করে সোফায় বসে বলল ফেলুদা। এ সহ্য করা যায় না!..আর এমন চমৎকার লেখা-এইভাবে বেহাত হয়ে গেল!

লেখাটা নিয়ে ভাববেন না, ফেলুবাবু। একটু যেন রাগত ভাবেই বললেন জটায়ু। দ্য খুন ইজ মাচ মোর ইমপট্যান্ট দ্যান দ্যা লেখা।

আপনি লেখাটা পড়েও একথা বলছেন?

বলছি। যেখানে মার্ডার হ্যাঁজ বিন কমিটেড, সেখানে আর ওসব কিছু তার কাছে তুচ্ছ।

শ্ৰীনাথ এসে খবর দিল ভাত বাড়া হয়েছে। আমরা তিনজনে খাবার ঘরে খেতে বসলাম। লালমোহনবাবু যদিও বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। এমনকী চিংড়ি মাছের মালাইকারিটা খেতে খেতে বললেন, আপনাদের জগন্নাথের রান্নার তারের তুলনা নেই; ফেলুদা শুকুতো থেকে দই পর্যন্ত একবারও মুখ খুলল না।

খাবার পর তিনজনে তিনটে পান মুখে পুরে বসবার ঘরে বসতেই ফোনটা বেজে উঠল। আমিই ধরলাম। ইনস্পেক্টর সোম। আমি ফেলুদার হাতে ফোনটা চালান দিলাম। বলুন স্যার-এর পর ফেলুদা কেবল দুটো কথা বলল। প্রথমে মিনিট খানেক কথা শুনে বলল, তা হলে তো খুনটা বাড়ির লোকে করেছে বলেই মনে হচ্ছে আর ফোনটা রাখবার আগে বলল–ভেরি ইন্টারেস্টিং আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

বলল ফেলুদা।

খুনটা বাড়ির লোকে করেছে। কেন বললেন? জটায়ুর প্রশ্ন।

কারণ নিস্তারিণী ঝি আবিষ্কার করেছে যে একটা হামানদিস্তা মিসিং! এ পারফেক্ট মার্ডার ওয়েপন।

আর ইন্টারেস্টিংটা কী?

মুনসীর একটা ডায়রি পাওয়া গেছে যাতে এ বছরের প্রথম দিন থেকে মারা যাবার আগের দিন পর্যন্ত এনটি আছে। …চলুন বেরিয়ে পড়ি।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়