এটাকে কী বলবেন? ফাইভ স্টার না সিক্স স্টার? লালমোহনবাবুকে প্রশ্নটা করল ফেলুদা।

আমরা রেলওয়ে হোটেলে এসেছি ডিনার খেতে। বিলাসবাবু সাগরিকা থেকে বেরিয়েই আমাদের নেমস্তন্ন করলেন। বললেন, আপনারা আমার অশেষ উপকার করেছেন; আমার এই অনুরোধটা রাখতেই হবে।

রেলওয়ে হোটেলের খাওয়া যে অপূর্ব তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সেটা লালমোহনবাবুও না। স্বীকার করে পারলেন না। বললেন, রেলের খাওয়ার যা ছিরি হয়েছে আজকাল মশাই, আমি ভাবলুম রেলওয়ে হোটেলের খাওয়াও বুঝি সেই স্ট্যান্ডার্ডের হবে। সে ভুল ভেঙে গেছে—থ্যাঙ্কস টু ইউ।

বিলাসবাবু হেসে বললেন, এবার সুফ্‌লেটা খেয়ে দেখুন।

কী খাব সুপ প্লেটে? সুপ তো গোড়াতেই খেলুম।

সূপ প্লেট নয়। সুফ্‌লে-মিষ্টি।

এই সুফলে খেতেই বিলাসবাবু লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের দৌলতে মনে পড়ে যাওয়া ঘটনাটা বললেন। —

মিস্টার সেনের ঘরে দেখা সেই ঘটনাটা আমার মনে কোনওরকম খটকার সৃষ্টি করেনি। পরদিন ভদ্রলোক পোখরা যাচ্ছিলেন; আমাকে সঙ্গে যাবার জন্য ইনভাইট করলেন। জাপানি দল আসতে আরও তিনদিন দেরি, তাই রাজি হয়ে গেলুম। পোখরা কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার। পথে একটা জঙ্গল পড়ল, ভদ্রলোক সেখানে গাড়ি থামাতে বললেন। বললেন নাকি ভাল আর্কিড পাওয়া যায় ওই জঙ্গলে। আমিও ক্যামেরা নিয়ে নামলুম। আর কিছু না হাক, এক-আধটা ভাল পাখিও যদি পাই, তা হলেই বা মন্দ কী?—আমি পাখি খুঁজছি, উনি আর্কিড। দুজনে ভাগ হয়ে গেছি, কথা আছে আধা ঘণ্টা বাদে দুজনেই গাড়িতে ফিরব। ওপরে গাছের দিকে চোখ রেখে এগোচ্ছি, এমন সময় পিছন। থেকে মাথায় একটা বাড়ি, আর তারপরেই অন্ধকার।

ভদ্রলোক থামলেন। আর কিছু বলার নেই, কারণ বাকি ঘটনা উনি আগেই বলেছেন। ফেলুদা বলল, আঘাতটা কে মেরেছিল সেটা সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিত নন?

বিলাসবাবু মাথা নাড়লেন। —একেবারেই না, তবে এটা বলতে পারি যে সেই জঙ্গলে ত্ৰিসীমানার মধ্যে আর কোনও মানুষ চোখে পড়েনি। গাড়িটা ছিল মেন রোডে, প্রায় কিলোমিটার খানেক দূরে।

তা হলে অ্যাটেম্পটেড ম্যাডারটা যে মিঃ সেনের কীর্তি, আদালতে সেটা প্রমাণ করার কোনও উপায় নেই?

আজ্ঞে না, তা নেই।

লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উসখুসি করছিলেন, এবার বুঝলাম কেন। ভদ্রলোক বললেন, আপনি একবারটি সেনমশাইয়ের সামনে গিয়ে হাজির হন না। উনিই যদি কালপ্রিট হন, তা হলে আপনাকে দেখে বেশ একটা ভূত দেখার মতো ব্যাপার হতে পারে। সেটা মন্দ হবে কি?

সে কথা আমি ভেবেছি, কিন্তু সেখানে একটা মুশকিল আছে। উনি আমাকে নাও চিনতে পারেন। কারণ আমার তখন দাড়ি ছিল না। এটা রেখেছি। থুতনির ক্ষতচিহ্নটা ঢাকবার জন্য।

আরও মিনিট পাঁচেক থেকে বিলাসবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। ভদ্রলোক আমাদের গেট অবধি পৌঁছে দিলেন। মেঘ কেটে গেছে, গুমোট ভাবাটাও আর নেই। ফেলুদার পকেটে একটা ছোট্ট জোরালো টর্চ আছে জানি, কিন্তু ফিকে চাঁদের আলো থাকার দরুন সেটা আর জ্বালাবার দরকার হবে না।

রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্রের ধার অবধি বাঁধানো পথটা দিয়ে চলতে চলতে লালমোহনবাবু বললেন, এবার ফ্র্যাঙ্কলি বলুন তো মশাই, কী রকম দেখলেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যিকে। তাজ্জব ব্যাপার নয় কি?

না। বিলাস মজুমদারকে দুগাৰ্গতি সেনই হত্যা করার চেষ্টা করেছিল কি না সেটা জানতে হলে ফেলুমিত্তির ছাড়া গতি নেই।

আপনি তদন্ত করছেন তা হলে?

চাঁদের আলোতেই বুঝলাম লালমোহনবাবুর চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠেছে।

ফেলুদা কী উত্তর দিত। জানি না, কারণ ঠিক তখনই সামনে একজন চেনা লোককে দেখে আমাদের কথা থেমে গেল। মাটির দিকে চেয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে ব্যস্তভাবে এগিয়ে আসছেন। আমাদেরই পথ ধরে মিঃ হিঙ্গোরানি।

ভদ্রলোক আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন; তারপর ফেলুদার দিকে আঙুল নেড়ে বেশ ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ইউ বেঙ্গলিজ আর ভেরি স্টাবর্ন, ভেরি স্টাবর্ন!

হঠাৎ এই আক্রোশ কেন? ফেলুদা হালকা হেসে ইংরিজিতে প্রশ্ন করল। ভদ্রলোক বললেন, আই অফার্‌ড হিম টোয়েন্টি ফাইভ থাউজ্যাণ্ড, অ্যান্ড হি স্টিল সেড নো!

পঁচিশ হাজারের লোভ সামলাতে পারে এমন লোক তা হলে আছে বিশ্বসংসারে?

আরে মশাই, ভদ্রলোক যে পুথি সংগ্রহ করেন সেটা আগে জানতাম। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে গেলাম। বললাম তোমার সবচেয়ে ভালুয়েবল পিস কী আছে সেটা দেখাও। তৎক্ষণাৎ আলমারি খুলে দেখালেন—দ্বাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত পুঁথি। অসাধারণ জিনিস। চোরাই মাল কি না জানি না। আমার তো মনে হয়। গত বছর ভাতগাঁওয়ের প্যালেস মিউজিয়াম থেকে তিনটে পুঁথি চুরি গিয়েছিল, এটা তারই একটা। দুটো উদ্ধার হয়েছিল, একটা হয়নি। আর সেটাও ছিল প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি।

হায়ার ইজ ভাতগাঁও? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু। জায়গাটার নাম আমিও শুনিনি।

কাঠমাণ্ডু থেকে দশ কিলোমিটার। প্রাচীন শহর, আগে নাম ছিল ভক্তপুর।

কিন্তু চোরাই মাল কি কেউ চট করে দেখায়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল—আর আমি যতদূর জানি প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি একটা নয়, বিস্তর আছে।

আই নো, আই নো, অসহিষ্ণুভাবে বললেন মিঃ হিঙ্গোরানি। উনি বললেন এটা দালাই লামার সঙ্গে এসেছিল, উনি নাকি ধরমশালা গিয়ে কিনে এনেছিলেন। কত দিয়ে কিনেছিলেন জানেন? পাঁচশো টাকা। আর আমি দিচ্ছি পঁচিশ হাজার—ভেবে দেখুন!

তার মানে কি বলছেন। পুরী আসাটা আপনার পক্ষে ব্যর্থ হল।

ওয়েল, আই ডোন্ট গিভ আপ সো ইজিলি। মহেশ হিঙ্গোরানিকে তো চেনেন না মিস্টার সেন! ওঁর আরেকটা ভাল পুঁথি আছে, ফিফটিনথ সেনচুরি। আমাকে দেখালেন। আরও দুটো দিন সময় আছে হাতে। দেখা যাক ক’দিন ওর গোঁ টেকে।

ভদ্রলোক সংক্ষেপে গুডিনাইট জানিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন হোটেলের দিকে।

একটু সাসপিশাস্‌ লাগছে না? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। ফেলুদা বলল, কার বা কীসের কথা বলছেন সেটা না জানলে বলা সম্ভব নয়।

পাঁচশো টাকা দিয়ে কেনা জিনিস পঁচিশ হাজায়ে ছাড়ছে না?

কেন, মানুষ নির্লোভ হতে পারে এটা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? সিধুজ্যাঠা দুর্গাগতিবাবুকে পুঁথি বিক্রি করতে রিফিউজ করেছেন সেটা আপনি জানেন?

কই, সেটা তো মিঃ সেন বললেন না।

সেটা তো আমার কাছে আরও স্যাসপিশাস। ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র এক বছর আগে।

আমার মনে হল দুর্গাগতিবাবু শুধু পিকিউলিয়ার নন, বেশ রহস্যজনক চরিত্র। আর বিলাসবাবু যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়…

সাসিপিশন কিন্তু একজনের উপর পড়ে নেই বলল ফেলুদা, নিউক্লিয়ার ফল-আউটের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কাকে বাদ দেবেন বলুন। আপনার গণৎকার যে তৃতীয়-চক্ষু-সম্পন্ন সরীসৃপের কথা বললেন, সেটার নাম টারটুয়া নয়, টুয়াটারা। আর তার বাসস্থান নিউ গিনি নয়, নিউজিল্যান্ড। এ ধরনের ভুল জটায়ুর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য যদি তাঁর জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে লোককে ইমপ্রেস করতে চান, তা হলে তাঁকে আরও অ্যাকুরেট হতে হবে। তারপর ধরুন নিশীথবাবু। আড়িপাতার অভ্যাস আছে ভদ্রলোকের; সেটা মোটেই ভাল নয়। তারপর দুর্গাগতিবাবু বললেন ওঁর গাউট হয়েছে কিন্তু ওঁর টেবিলের ওষুধগুলো গাউটের নয়।

তবে কীসের?

একটা ওষুধ তো সবে গত বছর বেরিয়েছে, টাইম ম্যাগাজিনে পড়ছিলাম ওটার কথা। কীসের ওষুধ ঠিক মনে পড়ছে না, কিন্তু গাউটের নয়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, ভদ্রলোককে এত অন্যমনস্ক কেন মনে হয় বলে তো? আর তা ছাড়া বললেন, ওঁর ছেলেকে চেনেন না…

সেটারও তো কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না।

লালমোহনবাবু বললেন, ধরুন যদি উনি সত্যিই বিলাস মজুমদারকে খুব করার চেষ্টা করে থাকেন, তা হলে সেটাই একটা অন্যমনস্কতার কারণ হতে পারে। এখানে অবিশ্যি অন্যমনস্কতা ইজ ইকুয়াল টু নার্ভাসনেস।

এখানে আমাদের কথা থেমে গেল। শুধু কথা না, হাঁটাও।

বালির উপরে জুতোর ছাপ, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বা পাশে লাঠির ছাপ।

ছাপটা হয়েছে গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।

কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে বিলাসবাবু লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে সোজা হোটেলে ফিরে গিয়ে স্নান-টান সেরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এর মধ্যে আর নীচে আসেননি।

তা হলে এ ছাপ কার?

আর কে বাঁ হাতে লাঠি নিয়ে হেঁটে বেড়ায় পুরীর বিচে?

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়