আজ ঠিকই করে রেখেছিলাম যে বিকেলে একটু মন্দিরের দিকটায় যাব। মন্দিরের চেয়েও রথটা দেখার ইচ্ছে বেশি। ফেলুদার কাছেই শুনলাম যে এই বিশাল রথ নাকি প্রতিবারই রথযাত্রার পর ভেঙে ফেলা হয়। আর তার কাঠ দিয়ে খেলনা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হয়। পরের বছর আবার ঠিক একই রকম নতুন রথ তৈরি হয়।

যাবার পথে ফেলুদাকে কেন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। হয়তো এই দুদিনে নতুন আলাপীদের সঙ্গে যে সব কথাবাতা হয়েছে, সেগুলো ওর মাথায় ঘুরছিল। একটা কথা ওকে না বলে পারলাম না–

আচ্ছা ফেলুদা, নেপালটা কীরকম বারবার এসে পড়ছে, তাই না? যে লোকটা খুন হল সে নেপালের লোক, বিলাসবাবু কাঠমাণ্ডু গিয়েছিলেন, দুর্গাগতিবাবু ঠিক সেই সময় কাঠমাণ্ডুতে ছিলেন…

তুই কি এতে কোনও তাৎপর্য খুঁজে পেলি?

না। তবে–

সমপাত মানে জানিস?

না তো।

সমপাত হল ইংরিজিতে যাকে বলে কেইনসিডেন্স। যতক্ষণ না আরও এভিডেন্স পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ কাঠমাণ্ডুর ব্যাপারটা একটা কোইনসিডেন্স বলে ধরতে হবে—বুঝলি?

বুঝেছি।

পুরীর বিখ্যাত রথ দেখে মন্দিরের সামনে বিশাল চওড়া রাস্তার একপাশে দোকানগুলোয় ঘুরে ঘুরে পাথরের তৈরি খুদে খুদে মূর্তি, কোনারকের চাকা, এইসব দেখছি, এমন সময় সাব-ইনস্পেক্টর মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের আবির্ভাব। হঠাৎ চিনতে পারিনি, কারণ এই ফাঁকে কখন জানি চুল ছেটে এসেছেন। আমাদের এক দূর সম্পর্কের কাকা আছেন, যিনি হেয়ার কাটিং সেলুনে চেয়ারে বসলেই ঘুমিয়ে পড়েন; ফলে নাপিত বেহিসাবি কিছু করলে টের পান না। ঘুম ভাঙার পর অবিশ্যি প্রতিবারই কুরুক্ষেত্ৰ বেধে যায়। মহাপাত্ৰকে দেখে মনে হল এনারিও সে বাতিক আছে।

ফেলুদা ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞেস করল, তদন্ত এগোল? মেহেরালি রোডের মিস্টার সরকার কী বলেন?

ইনফরমেশন এসেছে আজি আড়াইটেয় বললেন মহাপাত্ৰ।চোদ্দো নম্বর মেহেরালি রোড হল একটা ফ্ল্যাট বাড়ি! সবসুদ্ধ আটটা ফ্ল্যাট, সরকার থাকেন তিন নম্বরে। দিন সাতেক হল ওঁর ঘর তালাবন্ধ। প্রায়ই নাকি বাইরে যান।

এবার কোথায় গেছেন জানতে পারলেন?

পুরী।

বটে? কে বলল?

চার নম্বরের বাসিন্দা। তাকে নাকি বলেছে চেঞ্জে যাচ্ছে।

চেহারা কেমন জানতে পারলেন?

লম্বা, মাঝারি রং, দাড়ি-গোঁফ নেই, বয়স পঁয়ত্ৰিশ থেকে চল্লিশ। এ ধরনের বর্ণনার অবিশ্যি কোনও মূল্য নেই।

পেশা?

বলে ট্র্যাভেলিং সেলসম্যান। কী সেল করে তা কেউ জানে না। বছর খানেক হল ওই ফ্ল্যাটে এসেছে।

আর রূপচাঁদ সিং?

সে এখানে এসেছে গতকাল সকালে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ছিল। ভাড়া চুকোয়নি। কাল রাত্রে নাকি একটা ফোন করতে চেয়েছিল হোটেল থেকে, ফোন খারাপ ছিল। শেষে একটা ডাক্তারি দাকান থেকে কাজ সারে। কম্পাউন্ডার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু খদ্দের ছিল বলে কী কথা হয়েছে তা শোনেনি! এগারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। ঘরে একটা সুটকেস পাওয়া গেছে, তাতে জামা-কাপড় রয়েছে কিছু। দুটো টেরিলিনের শার্ট দেখে মনে হয় লোকটা বেশ শৌখিন ছিল।

সেটা কিছুই আশ্চর্য না, বলল ফেলুদা, আজকাল ড্রাইভারের মাইনে আপিসের কেরানির চেয়ে অনেক বেশি।

কথাই ছিল রেলওয়ে হোটেল থেকে বিলাসবাবুকে আমরা তুলে নেব; ছটা বাজতে পনেরো মিনিটে আমরা হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। ব্রিটিশ আমলের হোটেল, এখন রং ফেরানো হলেও চেহারায় পুরনো যুগের ছাপটা রয়ে গেছে। সামনে বাগান, সেখানে রঙিন ছাতার তলায় বেতের চেয়ারে বসে হোটেলের বাসিন্দারা চা খাচ্ছে। তারই একটা থেকে উঠে পাশের চেয়ারে বসা দুজন সাহেবকে এক্সকিউজ মি বলে বিলাসবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।

চলুন, কপালে কী আছে দেখা যাক?

আজ লালমোহনবাবু আমাদের গাইড, তাই তাঁর হাবভাব একেবারে পালটে গেছে। দিব্যি গটগটিয়ে সাগরিকার গেট দিয়ে ঢুকে বাগানের মধ্যিখানের নুড়ি ফেলা পথ দিয়ে সটান গিয়ে বারান্দায় উঠে কাউকে না দেখে একটু থতমত খেয়ে তৎক্ষণাৎ আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সাহেবি মেজাজে কোই হ্যায় বলতেই বাঁ দিকে একটা দরজা খুলে গেল।

স্বাগতম!

বুঝলাম ইনিই লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। পরনে সিঙ্কের লুঙ্গি আর চিকনের কাজ করা সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। মাঝারি হাইটের চেহারার বিশেষত্ব হল সরু গোঁফটা, যেটা ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে প্ৰায় আধা ইঞ্চি নেমে এসেছে নীচের দিকে।

লালমোহনবাবু আলাপ করাতে যাচ্ছিলেন, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ওটা ভিতরে গিয়ে হবে। আসুন।

লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বৈঠকখানার বেশির ভাগটা দখল করে আছে একটা তক্তপোশ; বুঝলাম ওটার উপরে বসেই ভাগ্যগণনা হয়। এ ছাড়া আছে দুটো কাঠের চেয়ার, একটা মোড়া, একটা নিচু টেবিলের উপর ওড়িশা হ্যাঁন্ডিক্রাফটসের একটা অ্যাশট্রে, আর পিছনে একটা দেয়ালের আলমারিতে দুটো কাঠের বাক্স, কিছু বই, কিছু শিশি-বোতল-বয়াম ইত্যাদি ওষুধ রাখার পাত্র, আর একটা ওয়েস্ট এন্ড অ্যালার্ম ঘড়ি।

আপনি বসুন। এইখেনটায়—তক্তপোশের একটা অংশ দেখিয়ে বিলাসবাবুকে বললেন গণৎকার। —আর আপনারা এইখেনে।

চেয়ার আর মোড়া দখল হয়ে গেল।

লালমোহনবাবু এইবারে আমাদের সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিলেন। ফেলুদার বিষয় বললেন, ইনিই আমার সেই বন্ধু, আর বিলাস মজুমদারের নামটা বলে ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত ওয়াই–বলেই জিভ কেটে চুপ করে গেলেন। আমি জানি উনি বলতে গিয়েছিলেন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটাগ্রাফার; নিজের বুদ্ধিতেই যে নিজেকে সামলে নিয়েছেন সেটা আশ্চর্য বলতে হবে।

ফেলুদা বোধহয় কেলেঙ্কারিটা চাপা দেবার জন্যই বলল, আমরা দুজন অতিরিক্ত লোক এসে পড়েছি বলে আশা করি আপনি বিরক্ত হননি।

মোটেই না বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —আমার আপত্তি যেটাতে সেটা হচ্ছে স্টেজে উঠে ডিমনষ্ট্রেশন দেওয়ায়। সে অনুরোধ অনেকেই করেছে। আমি যে যাদুকর নই সেটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। এই যেমন-

ভদ্রলোকের কথা থেমে গেল। তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে বিলাস মজুমদারের দিকে। —কী আশ্চর্য! বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচাৰ্য্য—আপনার কপালে ঠিক থার্ড আই-এর জায়গায় দেখছি একটি উপমাংস!

উপমাংস মানে যে আঁচিল সেটা জানতাম না।

ঠিক ওইখানে খুলির আবরণের তলায় কী থাকে জানেন তো? ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন।

পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কথা বলছেন? ফেলুদা বলল।

হ্যাঁ—পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। মানুষের মগজের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ। অন্তত পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা তাই বলেন। আমরা যদিও জানি যে ওটা আসলে প্রমাণ করে যে আদিম যুগে প্রাণীদের তিনটি করে চোখ ছিল, দুটি নয়। ওই থার্ড আইটাই এখন হয়ে গেছে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। নিউগিনিতে একরকম সরীসৃপ আছে, নাম টারটুয়া, যার মধ্যে এখনও এই থার্ড আই দেখতে পাওয়া যায়।

ফেলুদা বলল, আপনার কপালে আঙুল রাখার উদ্দেশ্য কি এই পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের সঙ্গে যোগস্থাপন করা?

তা একরকম তাই বলতে পারেন? বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —অবিশ্যি যখন প্রথম শুরু করি। তখন পিনিয়াল গ্র্যান্ডের নামও শুনিনি। জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। এক রবিবার আমার জ্যাঠামশাইয়ের মাথা ধরল। বললেন, লখনা, আমার মাথাটা একটু টিপে দিবি? আমি তোকে আইসক্রিমের পয়সা দেব। কপাল টনটন করছে, কপালের মধ্যিখানে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে টিপছি, এমন সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। চোখের সামনে বায়স্কোপের ছবির মতো পরপর দেখতে লাগলাম—জ্যাঠার পৈতে হচ্ছে, জ্যাঠা পুলিশের ভ্যানে উঠছেন—মুখে বন্দেমাতরম স্লোগান, জ্যাঠার বিয়ে, জেঠিমার মৃত্যু, এমনকী জ্যাঠার নিজের মৃত্যু পর্যন্ত, কীসে মরছেন, কোন খাটে শুয়ে মরছেন, খাটের পাশে কে কে রয়েছেন, সব।..তখন কিছু বলিনি, কিন্তু এই মৃত্যুর ব্যাপারটা যখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল, তখন…বুঝতেই পারছেন—

লালমোহনবাবুকে দেখে বেশ বুঝছিলাম যে ওঁর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। বিলাসবাবু দেখলাম একদৃষ্টি চেয়ে রয়েছেন গণৎকারের দিকে।

ফেলুদা বলল, আপনি তো শুনেছি। ডাক্তারিও করেন, আর তার চিহ্নও দেখছি ঘরে। নিজেকে কী বলেন—ডাক্তার, না গণৎকার?

দেখুন, গণনার ব্যাপারটা আমি শিখিনি। আয়ুর্বেদটা শিখেছি। অ্যালোপ্যাথিও যে একেবারে জানি না তা নয়। পেশা কী জিজ্ঞেস করলে ডাক্তারিই বলব। আসুন, এগিয়ে আসুন, কাছে এসে বসুন।

শেষের কথাগুলো অবিশ্যি বিলাসবাবুকে বলা হল। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তক্তপোশে পা তুলে বাবু হয়ে বসে বললেন, দেখুন, কপালের ব্ল্যাক স্পটটি যদি ইনফরমেশনের সহায়ক হয়।

লক্ষ্মণবাবুর পাশেই যে একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটি রাখা ছিল সেটা এতক্ষণ লক্ষ করিনি। তার মধ্যে তরল পদার্থটা যে কী তা জানি না, কিন্তু দেখলাম লক্ষ্মণবাবু তাতে ডান হাতের কড়ে আঙুলের ডগাটা তিনবার চুবিয়ে নিলেন। তারপর একটা ধবধবে পরিষ্কার রুমালে আঙুলটা মুছে নিয়ে চোখ বুজে মাথা হেঁট করে আঙুলের ডগাটা মোক্ষম আন্দাজে ঠিক বিলাসবাবুর কপালের আচিলের উপর বসিয়ে দিলেন!

তারপর মিনিটখানেক সব চুপ। সবাই চুপ। কেবল ঘড়ির টিকটিক আর—এই প্রথম খেয়াল হল—বাইরে থেকে আসা একটানা ঢেউ ভাঙার শব্দ।

তেত্রিশ—তেত্রিশ—উনিশ শো তেত্রিশ—তুলা লগ্ন, সিংহ রাশি-পিতামাতার প্রথম সন্তান…

লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য চোখ বন্ধ করেই বলতে শুরু করেছেন।

সাড়ে আটে টনসিল অ্যাডিনয়েডস— পরীক্ষায় বৃত্তি— স্বর্ণপদক…বিজ্ঞান— পদার্থ বিজ্ঞান— উনিশে গ্র্যাজুয়েট— তেইশ উপার্জন শুরু— চাক…না, চাকরি না— ফ্রিল্যান্স— ফটোগ্রাফার— স্ট্রাগল… স্ট্রাগল দেখছি, স্ট্রাগল— উদ্যম, একাগ্রতা, অধ্যবসায়— পৰ্বতারোহণে পটুতা— বন্যপশুপক্ষী-প্রীতি— বেপরোয়া জীবন— ভ্ৰাম্যমাণ— অকৃতদার…

ভদ্রলোক একটু থামলেন। ফেলুদা গভীর মনোযোগের সঙ্গে ওড়িশা হ্যাঁন্ডিক্রাফটসের অ্যাশট্রেটা দেখছে। লালমোহনবাবু হাতদুটো মুঠো করে টান হয়ে বসেছেন। আমার বুক টিপ টিপ করছে। বিলাসবাবুর মুখ দেখলে কিছু বোঝার উপায় নেই, তবে ওঁর চোখ যে গণৎকারের দিক থেকে একবারও সরেনি, সেটা আমি লক্ষ করেছি।

সেভেনটি এইট—সেভেনটি এইট…

আবার কথা শুরু হয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেশ ষ্ট্রেন হচ্ছে ভদ্রলোকের সেটা বোঝা যায়।

বন দেখছি, বন—হিমালয়—অপঘাত—অপ— না—

পাঁচ সেকেন্ড চুপ থেকে ভদ্রলোক হঠাৎ বিলাসবাবুর কপাল থেকে আঙুল নামিয়ে নিয়ে চোখ খুললেন। তারপর সটান বিলাসবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, আপনার বেঁচে থাকার কথা নয়, কিন্তু রাখে হরি মারে কে?

অ্যাক্সিডোন্ট নয়? বিলাসবাবু ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন।

লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য মাথা নেড়ে পকেট থেকে পানের ডিবে বার করে একটা পান মুখে পুরে বললেন, যতদূর দেখছি, নট অ্যাক্সিডোন্ট! আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের প্রান্ত থেকে। অর্থাৎ, ডেলিবারেট অ্যাটেস্পট মাডার। মরেননি সেটা আপনার পরম ভাগ্যি।

কিন্তু কে ঠেলিল সেটা—?

প্রশ্নটা করেছেন লালমোহনবাবু। লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য মাথা নাড়লেন। —স্যারি। যা দেখেছি তার বাইরে বলতে পারব না। বললে মিথ্যে বলা হবে। দেবতা। রুষ্ট হবেন।

দিন আপনার হাতটা।

বিলাসবাবু করমর্দনের জন্য তাঁর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের দিকে।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়