পরদিন সকলে ফেলুদা ব্রেকফাস্টের পর ট্যাক্সি নিয়ে শ্ৰীনগরে চলে গেল। বলল, মনে হচ্ছে, পরশু ফিরে আসতে পারব; তবে দু-এক দিন দেরি হলে চিন্তা করিস না।

ন’টা নাগাত পুলিশের জিপ এল, ইনস্পেক্টর সিং নামলেন। অন্য তাঁবুতে কাজ শেষ করে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।

হায়্যার ইজ মিঃ হোমস? হেসে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।

আমি বললাম ফেলুদা একটু শ্ৰীনগর গেছে।

এই কেসের ব্যাপারে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তার প্রয়োজন হচ্ছে কেন? এই কেস তো জলের মতো সোজা।

কী রকম? বেয়ারাটাই হচ্ছে অপরাধী। তার সুযোগ ছিল। সে একই তাঁবুতে শুত। তা ছাড়া এসব লোকের লোভ হওয়াটা স্বাভাবিক। বেয়ারাগিরি করে আর কত রোজগার হয়?

আপনি কি ওকে অ্যারেস্ট করছেন? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

আপাতত থানায় নিয়ে যাচ্ছি জেরার জন্য। তা ছাড়া, ও যে লেফট হ্যান্ডেড তাও প্রমাণ হয়ে গেছে। ওকে ওর নাম লিখতে বলেছিলাম। ডান হাতে লিখতেই পারল না, কিন্তু বাঁ হাতে বেশ পারল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও অস্বীকার করছে, সুতরাং ওকে বেশ ভাল রকম জেরা করা দরকার।

আংটিটাও পেতে হবে, বললেন জটায়ু।

সেটাও জেরার জোরে বেরিয়ে যাবে। পুলিশের পক্ষে খুঁজে পাওয়া তো মুশকিল। এই পাহাড়ি পরিবেশে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কে জানে?

ফেলুদা কি তা হলে বৃথাই গেল শ্ৰীনগর? কেসটা এতই সোজা? আমার কিন্তু তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। অত সহজ হলে ফেলুদা অত কাঠখড় পাড়াত না। আমি জানি ও কলকাতায় খোঁজ করবে। ওর লোক আছে যাদের বলে দিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওরা যে কোনও খবর জোগাড় করে দিতে পারে।

কিন্তু তার পরেই আবার মনে হয়ে যাচ্ছে বেয়ারা লেফট-হ্যান্ডেড।

কিন্তু এত সাহস হবে লোকটার? ও কি জানে না যে ওর ওপরেই প্রথমে সন্দেহ পড়বে?

ইনস্পেক্টর সিং বিদায় নিয়ে প্রয়াগকে সঙ্গে করে চলে গেলেন। লোকটাকে দেখে আমার কষ্ট হল, কারণ ও কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিয়েছে। পুলিশরা স্বীকারোক্তি আদায় করবার জন্য কত কী যে করতে পারে সে আমার জানতে বাকি নেই। ফেলুদাও এ নিয়ে বহুবার আক্ষেপ করে বলেছে। ও বলে পুলিশরা কাজ জানে, ওরা কর্মঠ, কিন্তু দয়ামায়া বলে কিছু নেই ওদের মধ্যে! অবিশ্যি উপায়ও নেই। অনেক সময় জরুরি তথ্য সংগ্ৰহ করতে কড়া রাস্তা নিতে হয়। সে কাজটা প্রাইভেট গোয়েন্দার চেয়ে পুলিশে অনেক বেশি ভাল পারে।

সুশান্তবাবু এবার দেখি আমাদের দিকে আসছেন। বললেন, মিঃ মিত্তির তো বোধহয় শ্ৰীনগর গেছেন।

আমি হ্যাঁ বলতে বললেন, আমরা কিছু না বলতেই উনি আমাদের জন্য এত করছেন, এটা খুব আশ্চর্য বলতে হবে।

আসলে উনি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছেন। রহস্য জিনিসটা ওঁর কাছে অসহ্য। যতক্ষণ না সেটার কিনারা করতে পারছেন, ততক্ষণ ওঁর সোয়াস্তি নেই।

লালমোহনবাবু বললেন, আপনি কি মিঃ মল্লিকের জীবনী লিখতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন?

তা এক রকম দিয়েছিলাম বইকী। খানিকটা করে লিখছিলাম, আর উনি সেটা দেখে দিচ্ছিলেন। খুবই চিত্তাকর্ষক বই হত বলে মনে হয়।

এখন তো কাজটা বন্ধ হয়ে গেল।

তা তো হলই।

আপনিও কি প্ৰয়াগকে সন্দেহ করেন?

মাটেই করিনি। ওর অত সাহস হবে বলেই আমার মনে হয়নি। কিন্তু পুলিশ যেভাবে চলছে…

মিঃ মিত্তিরের উপর আরেকটা অ্যাটেমাট হয়ে গেছে, সেটা বোধহয় জানেন না?

সে কি?

হ্যাঁ। এবার মাথায় বাড়ি মেরেছিল পাথর-টাথর কিছু দিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। কিন্তু কেউ যে ওর উপস্থিতি পছন্দ করছে না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

তা, উনি তো পুলিশ প্রোটেকশন নিতে পারেন।

প্রস্তুত।

আপনাদের তাঁস খেলা বন্ধ বোধহয়? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

মৃত্যুর ছায়া এখনও ঘনিয়ে আছে; এর মধ্যে কি ও সব চলে?

তা বটে।

*

ফেলুদার জন্য প্ৰাণটা ছটফট করছে, অথচ দ্বিতীয় দিনেও ও এল না। দিনটা আমরা সাইট সিইং-এ কাঁটালাম। টুরিস্ট আপিস থেকে খবর নিয়ে আড়াই মাইল দূরে শিকারগী লেক আর এক মাইল দূরে একটা পুরনো শিবমন্দির দেখে এলাম। তাঁবুতে থাকার চেয়ে দূরে থাকাই ভাল বুঝতে পারছিলাম। কারণ তাঁবুকে ঘিরে এখনও খুনের গন্ধ, ভাবতে গেলেই বুক ধড়ফড় করে।

তৃতীয় দিন সকাল দশটায় ভাবছি কী করা যায়, এমন সময় ফেলুদার ট্যাক্সি এসে হাজির। আমরা দুজনেই উদ্‌গ্ৰীব হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ও হাত তুলে বলল, সবুরে মেওয়া ফলে।

আপনার মাথা পরিষ্কার কি না সেইটে শুধু বলে দিন, বললেন লালমোহনবাবু।

পরিষ্কার, তবে অনেক জট ছাড়াতে হয়েছে। এমন একটা কেস সচরাচর পাওয়া যায় না।

সেটা ইনস্পেক্টর সিং-এর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হবে।

উনি কিন্তু খুনি ধরে ফেলেছেন এর মধ্যেই। মানে?

বেয়ারা প্ৰয়াগ।

সর্বনাশ! তা হলে তো আর সময় নষ্ট করা চলে না। আমি চললাম থানায়।

ফেলুদা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে শহরের দিকে চলে গেল।

ও যখন ফিরল। তখন আমাদের লাঞ্চ খাবার সময় হয়ে গিয়েছে। এসে বলল, আজি তিনটেয় মিটিং। ওঁদের তাঁবুতে।

আমার বুকটা কেঁপে উঠল। ফেলুদার রহস্যোদঘাটন যে না দেখেছে সে কল্পনা করতে পারে না সেটা কত নাটকীয় হতে পারে।

তিনটের পাঁচ মিনিট পরেই পুলিশের জিপ এসে গেল। ইনস্পেক্টর সিং ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আপনি কি বিশ্বাস করতে পারেন যে একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর ক্রাইম স্টোরির ভক্ত হতে পারে?

আপনি ওসব বই পড়েন নাকি?

ও ছাড়া আর কিছুই পড়ি না। বিশেষ করে প্রাইভেট ডিটেকটিভের গল্প হলে তো আর কথাই নেই। আজ। আপনার রহস্যোদঘাটনের ব্যাপারেও আমার পড়া অনেক গল্পের কথা মনে পড়ছে। অবিশ্যি আপনি যে কী বলতে যাচ্ছেন সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই।

সেটা তো অল্পক্ষেণের মধ্যেই জানতে পারবেন।

তাঁবুতে সকলে জমায়েত। দুটো তাঁবু থেকে চেয়ার এনে সকলের বসবার জায়গা করা হয়েছে। বিজয় মল্লিক, মিঃ সরকার, সুশান্ত সোম, ডাঃ মজুমদার—এঁরা সব চেয়ারে বসেছেন, আর তাবুর এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বেয়ার প্রয়াগ। এই শেষের লোকটির চেহারার মধ্যে একটা ক্লিষ্ট ভাব দেখে মনে হয় পুলিশ তাকে বেশ ভালভাবেই জেরা করেছে।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়