ফেলুদা তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একবার সকলের দিকে দেখে নিল। তারপর এক গেলাস জল ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নিয়ে খেয়ে তার কথা শুরু করল–

মিঃ মল্লিক আজ আমাদের মধ্যে নেই, আমি তাঁকে দিয়েই আমার কথা আরম্ভ করছি। সিদ্ধেশ্বর মল্লিক। ত্ৰিশ বছর জজিয়তি করে তারপর কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই রিটায়ারমেন্টের কারণ ছিল অসুস্থতা। তা ছাড়া হয়তো মিঃ মল্লিক। তাঁর পেশায় কিছুটা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। প্ৰাণদণ্ড নিয়ে হয়তো তাঁর মনে একটা সংশয় দেখা দিয়েছিল। আমি এই সিদ্ধান্তের সত্যতা-অসত্যতার ভিতর যেতে চাইছি না। যা ঘটেছিল শুধু তাই বলছি।

মিঃ মল্লিক, দৈনিক ডায়েরি লিখতেন। এই ডায়েরির একটা বিশেষত্ব ছিল। যে দিন তিনি কাউকে ফাঁসির আদেশ দিতেন, সেই দিন ডায়েরিতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিটির নাম লিখে তার পাশে লাল কালিতে একটা ক্রস দিয়ে দিতেন। আর যে দিন এই দণ্ডের যথার্থতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা গভীর সন্দেহ দেখা দিত, সেদিন ক্রসের পাশে একটা প্ৰশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিতেন।

আমি মিঃ মল্লিকের ডায়েরিগুলি দেখেছি। সবসুদ্ধ ছটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। তার মানে ছটি প্রাণদণ্ডের সমীচীনতা সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন।

এইবার আমি আরেক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মিঃ মল্লিকের মনে দ্বন্দ্ব হচ্ছিল কি না হচ্ছিল সেটা সম্বন্ধে জনসাধারণ কিছুই জানতে পারত না। কিন্তু যারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কি মিঃ মল্লিক কখনও ভেবেছিলেন? মনে তো হয় না, কারণ তাঁর ডায়রিতে এর কোনও উল্লেখ নেই। ছেলের মৃত্যুদণ্ডে বাপ-মা কী ভাবছে, বাপের মৃত্যুদণ্ডে ছেলের বা ভাইয়ের বা স্ত্রীর বা অন্য আত্মীয়-স্বজনের কী মনোভাব হতে পারে, সেটা নিয়ে মিঃ মল্লিক বোধহয় কখনও চিন্তা করেননি। কিন্তু আমরা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারব যে, এই সব প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব অনেকেই নিশ্চয়ই গভীর বেদনা অনুভব করেছে।

এইটো উপলব্ধি করার পরেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে–এই রকম প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত কোনও ব্যক্তির আত্মীয়ই কি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মিঃ মল্লিককে হত্যা করে?

যত ভাবি, ততই মনে হয় এটা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যেখানে দণ্ড সম্বন্ধে জজের মনেও সন্দেহ আছে, সেখানে তো বটেই।

এর পরের প্রশ্ন হচ্ছে—এই ঘরে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে কি এমন ব্যক্তি কেউ আছেন?

এখানে প্রথমেই যাকে বাদ দেওয়া যায়, তিনি হলেন ডাঃ মজুমদার, কারণ তিনি আজ পনেরো বছর হল মল্পিকদের পরিবারিক চিকিৎসক।

বাকি থাকেন। আর চারজন-বিজয় মল্লিক, সুশাস্তু সোম, মিঃ সরকার আর বেয়ারা প্ৰয়াগ।

এখানে বিজয় মল্লিককে এই বিশেষ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁর কোনও আত্মীয়ের প্রাণদণ্ড হয়নি।

সেই রকম সুশান্ত সোমকেও এই একই মর্মে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁরাও কোনও নিকট জনের প্রাণদণ্ডের কথা আমরা ডায়েরিতে পাচ্ছি না।

বাকি রইলেন মিঃ সরকার ও প্রয়াগ বেয়ারা।

এখানে প্ৰয়াগকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।

প্ৰয়াগ চুপ করে দাঁড়িয়ে বইল।

ফেলুদা বলল, প্রয়াগ, সে দিন তুমি যখন নদীতে হাত ধুচ্ছিলে, তখন আমি তোমাকে লক্ষ করছিলাম। তোমার ডান হাতে একটি ছোট্ট উলকি আছে—দুটি ইংরেজি অক্ষর-HR। এটার মানে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।

প্রয়াগ গলা খাকরিয়ে নিয়ে বলল, ওর কোনও মানে নেই বাবু। উলকি করাবার ইচ্ছা হয়েছিল তাই করিয়েছিলাম।

তুমি বলতে চাও এটা তোমার নাম আর পদবির প্রথম অক্ষর নয়?

নেহি বাবু। মেরা নাম হ্যায় প্রয়াগ মিসির।

আমি যদি বলি তোমার নাম প্রয়াগ নয়। কারণ প্রয়াগ বলে ডাকলে তুমি চট করে উত্তর দাও না-অথচ অন্য ব্যাপারে মোটেই তুমি কালা নও।

আমার নাম প্ৰয়াগ মিসির, বাবু।

না! ফেলুদা চেঁচিয়ে উঠল। আমি জানতে চাই ওই R অক্ষরটা কীসের আদ্যক্ষর। কী পদবি তোমার?

আমি আর কী বলব বাবু!

সত্যি কথাটা বলবে। এখানে জীবন-মরণ নিয়ে খেলা হচ্ছে, এখানে মিথ্যা চলবে না।

তবে আপনিই বলুন।

আমি বলছি। ওই R হচ্ছে রাউত। এবার তোমার পুরো নামটা বলে। প্রয়াগ হঠাৎ কেমন জানি ভেঙে পড়ল। তারপর কান্নার মধ্যেই বলল, ও আমার একমাত্র ছেলে ছিল বাবু। আর ও খুন করেনি। ওর মামলা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে ওকে খুনি বলে মনে হয়। আমার একমাত্র ছেলে-ফাঁসি হল!

তা হলে তোমার পুরো নামটা কী দাঁড়াচ্ছে?

হনুমান রাউত, বাবু। কিন্তু আমি বাবুকে খুন করিনি, ওঁর আংটি আমি নিইনি!

সেটা কি আমি একবারও বলেছি?

তা হলে বাবু আমাকে মাপ করে দিন।

পুরোপুরি মাপ করা কি চলে? সত্যি কথা বলে তো।

হনুমান রাউত কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে ফেলুদার দিকে চাইল।

ফেলুদা বলল, তুমি খুন করনি, কিন্তু খুনের চেষ্টা করেছিলে।

না বাবু—

আলবৎ! ফেলুদা গৰ্জিয়ে উঠল। তোমার নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্য যিনি দায়ী, তুমি তাঁর ছেলেকে মারতে চেয়েছিলে যাতে তিনিও তোমার মতো পুত্ৰশোক ভোগ করেন। খিলেন।মার্গ যাবার পথে তুমি বিজয়বাবুর ঘাড়ে ধাক্কা মারোনি? ঠিক করে বলে তো। বাঁ হাতে তোমার আংটি রয়েছে, আর বা হাত দিয়ে তুমি ডান হাতের কাজ কর, তাই না?

কিন্তু উনি তো বেঁচে আছেন বাবু; উনি তো মরেননি।

খুনের অভিপ্ৰায়েরও শাস্তি আছে হনুমান রাউত—সে শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে!

দুজন কনস্টেবল এসে বেয়ারকে ঘর থেকে নিয়ে গেল।

ফেলুদা আরেক গেলাস জল খেয়ে নিল। তারপর আবার শুরু করল—এবারে আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। এটা আরও অনেক বড় প্রসঙ্গ। এখানে একজন ব্যক্তির প্রাণ নেওয়া হয়েছে! এ হল হত্যা। আর এর জন্য আমার মতে প্ৰাণদণ্ডই উচিত দণ্ড।

সকলে একদৃষ্টি ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে। তাঁবুতে পিন পড়লে তার শব্দ শোনা যেত নিশ্চয়ই যদি না বাইরে লিন্দর নদীর স্রোতের অবিশ্রান্ত শব্দ থাকত।

ফেলুদা বলল, আমি একজনকে এর আগেও কয়েকটা প্রশ্ন করেছি–এবার আরেকবার করতে চাই। মিঃ সরকার।

সরকার নড়েচড়ে বসে বললেন, করুন।

ফেলুদা বলল, আপনি কবে শ্ৰীনগর এলেন?

আপনাদের সঙ্গে একই ফ্লাইটে এলাম।

আচ্ছা, আপনার আঙুলের আংটির Sটা কীসের আদ্যক্ষর?

আমার পদবির অফিকোর্স-সরকার। কিন্তু, মিঃ সরকার, আমি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে, সেদিন যাত্রীর তালিকায় সরকার বলে কেউ ছিলেন না। সেন ছিলেন, দুজন সেনগুপ্ত ছিলেন, একজন সিং ছিলেন আর একজন সপ্রু ছিলেন।

বাট-বাট-

বাট হোয়াট, মিঃ সরকার? আপনার নাম বদলানোর দরকার হল কেন জানতে পারি কি?

মিঃ সরকার চুপ।

ফেলুদা বলল, আমি বলি? আমার ধারণ আপনি মনোহর সপ্রুর ছেলে। আপনার চেহারার মধ্যে একটা পরিষ্কার কাশ্মীরি ছাপ রুয়েছে। মিঃ মল্লিক মনোহর সপ্রুকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। মিঃ মল্লিককে প্লেনে দেখেই আপনি নাম বদল করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তখন থেকেই আপনার মনে প্ৰতিশোধের ইচ্ছা জাগে। আপনি ওই ফ্যামিলির সঙ্গে মিশে যান, এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন-টু স্ট্রাইক। সেই সুযোগ আসে পাহালগামে।

কিন্তু…কিন্তু…দিস ক্রাইম ইজ কমিটেড বাই এ লেফট-হ্যান্ডেড পার্সন।

আপনি ভুলবেন না, মিঃ সপ্রু-আমি আপনাকে তাস বাঁটতে দেখেছি। আর কেউ লক্ষ না করলেও আমি করেছি যে, আপনি বাঁ হাতে তাস ডিল করেন।

মিঃ সপু হঠাৎ কেমন যেন খেপে উঠলেন।

বেশ, ঠিক কথা-আমি ওঁকে ছুরি মেরেছি, কিন্তু তার জন্য আমার একটুও অনুশোচনা নেই। আমার যখন মাত্র পনেরো বছর বয়স তখন উনি আমার বাবাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলান–অ্যান্ড মাই ফাদার ওয়াজ নট গিল্টি! কিন্তু…কিন্তু…

সঙ্গুরা যেন হঠাৎ একটা নতুন কথা মনে পড়ল।

আমি ওঁর আংটি তো নিইনি! আই ওনলি কিলড় হিম।

না, বলল ফেলুদা। আপনি ওঁর আংটি নেননি। সেটা নিয়েছেন আরেকজন।

ঘরে আবার সেই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেল।

বিজয়বাবু–জুয়াতে আপনার অনেক লোকসান হয়েছে। তাই না? আমি কলকাতায় খবর নিয়েছি। আমার লোক আছে খবর দেবার, পুলিশেও আমার বন্ধু আছে। আপনার বিস্তর দেনা হয়ে গেছে।

বিজয়বাবু চুপ।

ফেলুদা বলে চলল, আর আপনার বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল যে, বাবা আপনাকে উইলে কিছু দিয়েছেন কিনা। সেই জন্য তাঁকে মেরে তাঁর আংটিটি আপনি হাত করেছিলেন।

মেরে মানে?

মেরে মানে কোনও ভাবী জিনিস দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত মেরে। আপনার বাবাকে আসলে দুজন খুন করে। কার দ্বারা তিনি হত হয়েছিলেন সেটা বোঝা যায় বিছানায় রক্ত দেখে। ছুরির আঘাতই আগে পড়ে, তারপর আপনি মাথায় বাড়ি মেরে হাত থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে যান। আপনি খুনি না চোর সেটা অবশ্য আইন বুঝবে, কিন্তু হাতকড়া বোধহয় তিনজনেই হাতেই পড়বে।

 

মল্লিকদের তাঁবু থেকে নিজেদের তাঁবুতে ফিরে এসে লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু মশাই আপনি একটা ব্যাপারে তো কোনও আলোকপাত করলেন না। আপনাকে দু বার মারার চেষ্টা করল কে?

সে ব্যাপারে আলোকপাত করিনি। কারণ আমি নিজেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে শিওর নাই। তিনজন অপরাধীর একজন করেছে তাতে সন্দেহ নেই, এবং সুযোগের দিক দিয়ে বিচার করলে প্ৰয়াগের কথাই মনে হয়। সপ্রু বা বিজয়বাবু দল থেকে বেরিয়ে এসে এটা করবেন, বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হাক, এর জন্য মূল রহস্যোদঘাটনে কোনও এদিক ওদিক হচ্ছে না। ধরে নিন এটা ফেলুমিত্তিরের একটা অক্ষমতার পরিচয়।

যাক, বাঁচা গেল! আপনার ভুল হতে পারে এটা জানতে পারলে একটু ভরসা পাওয়া যায়।

আপনি অযথা বিনয় করছেন। আমি কিন্তু বহু চেষ্টা করলেও আপনার মতো লিখতে পারতাম না।

থ্যাঙ্কস ফর দ্য খোঁচা।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়