শ্ৰীনগরের সঙ্গে গুলমার্গের কোনও মিলই নেই। এখানে হ্রদ, নদী, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি কিছুই নেই; যা আছে, তা হল ঢেউ খেলানো পাহাড়ের গায়ে মসৃণ ঘন সবুজ ঘাস—যা দেখতে একেবারে মখমলের মতো; আর আছে ঝাউ বন আর পাইন বন আর ইতস্তত ছড়ানো কিছু কাঠের ঘর বাড়ি। সব মিলিয়ে ছবির মতো সুন্দর। এই পাহাড়ের গায়েই গলফ খেলা হয়। আর শীতকালে যখন ঘাস বরফে ঢেকে যায়। তখন স্কিইং হয়।

শ্ৰীনগর থেকে টাংমার্গ পর্যন্ত আঠাশ মাইল ট্যাক্সি করেই আসতে হয়, তারপর শেষের চড়াই চার মাইল যেতে হয় ঘোড়াতে। কলকাতায় থাকতেই ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বলে দিয়েছিল যে কাশ্মীরে ঘোড়ায় চড়তে হবে। -ভয় নেই, উটের চেয়ে অনেক সহজ। লালমোহনবাবু একেবারে পাকাপোক্ত রাইডিং ব্রিচেস করিয়ে এনেছিলেন। গুলমার্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বললেন ঘোড়া চড়ার মতো সহজ ব্যাপার আর নেই।

আমাদের সঙ্গে মল্লিক। মশাইরাও এসেছেন। আমরা আজকের রাতটা গুলমার্গে থেকে কাল এখান থেকে তিন মাইল দূরে আর দু হাজার ফুট ওপরে খিলেন।মার্গ দেখে বিকেলেই শ্ৰীনগর ফিরে যাব।

থাকার জন্য আমরা পাশাপাশি দুটো ক্যাবিন নিয়েছি। আমাদেরটা ছাট, ওদেরটা বড়। বিকেলে ক্যাবিনের বরাদ্দায় বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় তিনজন ভদ্রলোক এসে হাজির-সুশান্তবাবু, সিদ্ধেশ্বর মল্লিকের ছেলে বিজয়বাবু আর আরেকজন—ষাকে আমরা চিনি না, সুপুরুষ চেহারা, টকটকে রং, বয়স ত্রিশ-বেত্ৰিশ। সত্যি বলতে কী, তিনজনেই মোটামুটি এক বয়সী।

সুশান্তবাবু নতুন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, এঁর নাম অরুণ সরকারী! ইনি কলকাতায় ব্যবসা করেন। আমাদের সঙ্গে এখানে এসে আলাপ। জুয়াড়িদের একজন বললে বোধহয় আপনার চিনতে আরও সুবিধে হবে।

সকলেই হেসে উঠল। সুশান্তবাবু বললেন, আমরা এসেছি কেন বোধহয় বুঝতেই পারছেন। প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের সঙ্গে আলাপ করতে এঁরা দুজনেই খুব ব্যগ্ৰ। তা ছাড়া শুনছিলাম আপনার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীও তো একজন নামী লেখক-ওঁর সর্ব বই-ই নাকি বেস্ট-সেলার।

লালমোহনবাবু মাথা হেঁট করে হেঁ হেঁ করে একটু বিনয়ের ভাব দেখালেন।

বিজয় মল্লিক আর অরুণ সরকারের খাতিরে ফেলুদাকে তার গোটা দু-তিন বিখ্যাত কেসের বর্ণনা দিতে হল। শেষ হয়ে যাবার পর সরকার ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি কাশ্মীরে এই প্রথম?

ফেলুদা বলল, হ্যাঁ, এই প্রথম। আমি কিন্তু আপনাকে প্রথমে দেখে কাশ্মীরি ভেবেছিলাম। আপনি বোধহয় এখানে আর একবার এসেছেন?

তা এসেছি, বললেন সরকার। ইন ফ্যাক্ট, আমার ছেলেবেলার কয়েকটা বছর শ্ৰীনগরেই কেটেছে। বাবা এখানে একটা হোটেলে ম্যানেজারি করতেন। তারপর বছর কুড়ি আগে আমরা কলকাতা চলে যাই।

এখানকার ভাষা আপনার জানা নেই?

তা অল্পবিস্তর আছে বইকী।

এবার ফেলুদা বিজয় মল্লিকের দিকে ফিরল!

আপনার বাবার প্ল্যানচেট সম্বন্ধে আপনার কোনও কৌতূহল নেই?

বিজয়বাবু বেশ জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে না বললেন।

বাবার ভীমরতি ধরেছে, বললেন বিজয়বাবু। একজন খুনি মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাবে এর চেয়ে অন্যায়। আর কিছু হতে পারে না।

আপনি সে কথা বাবাকে বলেননি?

বাবার সঙ্গে আমার সে রকম সম্পর্ক নয়। উনি আমার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন না, আমিও ওঁর ব্যাপারে কিছু বলি না।

আই সি।

তবে বাবা যা করছেন তা করে যদি শান্তি পান, তা হলে আমার বলবার কিছু নেই।

আপনার মা নেই?

না। মা বছর চারেক হল মারা গেছেন।

এক দাদা ছিল, আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং করত, সে গত বছর মারা যায়। তার মেমসাহেব বউ আর এদেশে আসেনি। এক বোন আছে, তার স্বামী ভূপালে কাজ করে।

আমার বিশ্বাস আপনার কাশ্মীরের দৃশ্য সম্পর্কে খুব একটা কৌতূহল নেই।

কী করে বুঝলেন?

কারণ যে পরিমাণ সময় ঘরে বসে তাস খেলে কাটান।

আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার মনে কাব্য নেই। আমি কাঠখোট্টা মানুষ। আমার দু-একজন বন্ধু আর দু প্যাকেট তাস হলেই হল।

সরকার একটু হেসে বলল, আমি কিন্তু তাসও খেলি, আবার দৃশ্যও দেখি! সেটা বোধহয় ছেলেবেলায় কাশ্মীরে থাকার জন্য হয়েছে।

যাই হাক-বিজয়বাবু উঠে পড়লেন—আমাদের কিন্তু তাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আজ সুশান্তকে দলে টেনেছি। আপনারা কেউ—?

আমরা ভাবছিলাম একটু ঘুরতে বেরোব। আপনারা এখন কিছুক্ষণ খেলবেন তো?

এগারোটা পর্যন্ত তো বটেই।

তা হলে ফিরে এসে একবার ঢুঁ মারব।

বেশ। কাল আবার দেখা হবে।

তিন ভদ্রলোক গুডবাই করে চলে গেলেন। লালমোহনবাবু বললেন, এখন না বেরিয়ে আফটার ডিনার ওয়াকে বেরোলে ভাল হত না?

তথাস্তু, বলল ফেলুদা।

এখানে ক্যাবিনের সঙ্গে বাবুর্চি রয়েছে, তাকে বলে দিয়েছিলাম রাত্তিরে ভাত আর মুরগির কারি খাব। দেখলাম দিব্যি রান্না করে। সাড়ে আটটার মধ্যে খাওয়া হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না, তাই তিনজনেই বেশ উৎসাহের সঙ্গে রাতের গুলমার্গ শহর দেখতে বেরেলাম।

নিরিবিলি শহর, তার মধ্যে দিয়ে তিনজন হেঁটে চলেছি। পথে যে লোক একেবারে নেই, তা নয়। ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশি টুরিস্টও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। সত্যি বলতে কী, হিসেব নিলে বোধহয় বিদেশি টুরিস্টই সংখ্যায় বেশি হবে। লালমোহনবাবু এখনও গুনগুন করে গজল গাইছেন, খালি শীতের জন্য গল্যা মাঝে মাঝে অযথা গিটকিরি এসে যাচ্ছে।

শীত লাগছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

তা লাগছে, তবে মনে হয় খুব স্বাস্থ্যকর ঠাণ্ডা।

তা হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় এ সব জায়গায় বেশি রাত না করাই ভাল। চ তোপ্‌সে, ফেরা যাক।

আমরা উলটামুখে ঘুরলাম। শহর আর আমাদের ক্যাবিনের মধ্যে একটা ব্যবধান আছে। সেখানটা বসতি নেই বললেই চলে। আমরা সেই জায়গাটা দিয়ে হাটছি। এমন সময় হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটল। একটা কী জানি জিনিস শনশন শব্দে আমাদের মাথার পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারের একটা গাছের গায়ে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। আমাদের মাথা বলছি, কিন্তু আসলে সেটা ঠিক ফেলুদার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ফেলুদার কাছে টর্চ ছিল, সেটা জ্বলিয়ে গাছের তলায় ফেলতেই দেখা গেল বেশ বড় একটা পাথর। সেটা ফেলুদার মাথায় লাগলো নির্ঘাত একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড হত।

প্রশ্ন হচ্ছে -কে এই লোকটা, যে এভাবে আক্রমণটা করল? আর এর কারণই বা কী? আমরা তো সবে এখানে এসেছি। এখনও গোলমেলে ব্যাপার কিছু ঘটেনি, তদন্তের কোনও প্রশ্নই উঠছে না, তা হলে এই হুমকির মানে কী?

ক্যাবিনে ফিরে এসে ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগছে না। আমাকে পছন্দ করছে না কেউ; এবং গোয়েন্দাকে হটানোর চেষ্টার একটাই কারণ হতে পারে—কোনও কুকীর্তি হতে চলেছে। অথচ সেটা যে কী, সেটা আন্দাজ করার কোনও উপায় নেই।

লালমোহনবাবু বললেন, আপনার সেই -৩২ কোল্ট রিভলভারটা আশা করি এনেছেন। ফেলুদা বলল, ওটা বাক্সেই রাখা থাকে। কিন্তু রিভলভার ব্যবহার করার সময় এখন এল কই? কোনও ক্রাইম তো ঘটেনি এখনও।

যাই হাক, রাত্তিরে দরজা-জানালা সব ভাল করে বন্ধ করে শুতে হবে। এখানে রিস্ক নেওয়া চলবে না। আশ্চর্য ব্যাপার মশাই!—আপনার সঙ্গে ছুটিতে কোথাও বেরোলেই কি গণ্ডগোল শুরু হবে?

ফেলুদা একটু ভেবে বলল, যাই, ওদের সঙ্গে একটু তাস পিটিয়ে আসি। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরব। আপনারা শুয়ে পড়ুন।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়