আগেই বলেছি যে খিলেনমার্গ যেতে হলে তিন মাইল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দু হাজার ফুট উপরে উঠতে হয়। আমরা দুই ক্যাবিনে বাসিন্দারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। সেটাই করা হল।

আমাদের মধ্যে এক মিঃ মল্লিকই ঘোড়া নিলেন, আর সকলে হেঁটে যাওয়া স্থির করলাম। শুনেছি, পথের দৃশ্য অতি চমৎকার, আর দুপাশে অনেক ফুল গাছ।

লালমোহনবাবু বললেন, এই সাত দিনেই এনার্জি বেড়ে গেছে মশাই।হেঁটে দু হাজার ফুট পাহাড়ে ওঠাটা কোনও ব্যাপারই বলে মনে হচ্ছে না।

সত্যিই পথের দৃশ্য অপূর্ব। আমরা তিনজনে মোটামুটি একসঙ্গে হাঁটছি, বাকি ওদের দল ভাগ ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দলে আছি সবসুদ্ধ ন জন—আমরা তিনজন, মিঃ মল্লিক, বিজয় মল্লিক, ডাঃ মজুমদার, সুশান্তবাবু, মিস্টার সরকার আর বেয়ারা প্রয়াগ।

প্রায় দু ঘণ্টা লাগল দু হাজার ফুট উঠতে; আর উঠেই এক আশ্চর্য দৃশ্য আমাদের হকচাকিয়ে দিল। আমরা একটা পাহাড়ের পিঠে এসে উপস্থিত হয়েছি, মাটিতে বরফ, সামনে বরফের পাহাড় আর উলটা দিকে ছড়িয়ে আছে গাছপালা নদী হ্রদ-সমেত দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যক, আর তারও পিছনে আকাশের গায়ে যেন খোদাই করা রয়েছে নাঙ্গা পৰ্ব্বত।

ফেলুদা বলল, এই বোধহয় ক্লাইম্যাক্স। কাশ্মীরে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু আছে কি?

লালমোহনবাবু ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বার বার বলছেন, আসুন, একটা গ্রুপ তুলি, একটা গ্রুপ তুলি এই বরফের উপর দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ বাকি দল থেকে একটা শোরগোল শোনা গেল। সেটা একটা প্রশ্নের আকার নিয়ে আমাদের কানো এল।

মন্টু কই?

প্রশ্নটা করেছেন মিঃ মল্লিক, অত্যন্ত ব্যস্ত কণ্ঠে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে মন্টু হল বিজয় মল্লিকের ডাকনাম। কারণ দলের মধ্যে একমাত্র তিনিই অনুপস্থিত।

কোথায় গেলেন ভদ্রলোক? এতই পিছিয়ে পড়েছেন কি? না, তা তো হতে পারে না। এরা একটু ছাড়াছাড়ি ভাবে হাঁটছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিজয়বাবু কি একেবারে দলছুট হয়ে গিয়েছিলেন?

এবার সুশান্ত সোমের গলা শোনা গেল।আপনি এখানেই থাকুন মিঃ মল্লিক। আমরা নীচে খোঁজ করে আসছি।

যেমন কথা তেমন কাজ, আর এই অনুসন্ধানের পাটিতে আমরাও যোগ দিলাম।

যে পথ দিয়ে উপরে উঠেছি, এবার সেই পথ দিয়েই নেমে যাওয়া। আমার বুকের ভিতরটা টিপা-টিপ করছে। লোকটা গেল কোথায়?

সুশান্তবাবু গলা তুলে চিৎকার দিলেন।

বিজয়বাবু! বিজয়বাবু!

কোনও উত্তর নেই।

মিনিট পনেরো নামার পরেই হঠাৎ লালমোহনবাবু এক জায়গায় এসে থমকে থেমে গেলেন, তাঁর দৃষ্টি একটা ঝোপের দিকে।

ফেলুদা আর এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে দৌড়ে গেল ঝোপটার দিকে, কারণ পাতার ফাঁক দিয়ে একটা জুতো দেখা যাচ্ছে-পাহাড়ে ওঠার বুট।

মিঃ সোম, ফেলুদা হাঁক দিল।

মিঃ সোম দৌড়ে পৌঁছে গেল ফেলুদার পাশে, তার পিছনে বাকি চারজন।

ঝোপের পিছনে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বিজয় মল্লিক।

ফেলুদা নাড়ি টিপেই বলল, হি ইজ অ্যালাইভ। মনে হয় মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

কাছেই একটা ঝরনা ছিল, তার থেকে অজিলা করে জল এনে মুখে ঝাপটা দিতে ভদ্রলোক চোখ খুলে এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন। তারপর অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করলেন, কোথায়–?

ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনার এ অবস্থা কী করে হল?

কেউ…ধাক্কা…

আপনি যেখানে পড়েছেন, মনে হয় আপনাকে অনেক উপর থেকে গড়িয়ে পড়তে হয়েছে।

হ্যাঁ

অজ্ঞানটা হয়েছেন এই গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠোকা খেয়ে?

তাই হবে।

আপনি দেখুন তো উঠতে পারেন কি না।

ফেলুদা ভদ্রলোকের দু হাত ধরে নিজের কাঁধের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল। একটু টলোমলো অবস্থার পর ভদ্রলোক দেখলাম নিজেকে সামলে নিলেন।

ফেলুদা এবার মাথাটা দেখে বলল, একটা জায়গায় চোট লেগেছে, রুক্ত বেরোয়নি, তবে জায়গাটা ফুলে গেছে। দু-তিন দিন একটু ভোগাবে আপনাকে। এখন আপনি ফিরে চলুন! একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। তা না হলে আস্তে আস্তে হেঁটে চলুন। পরে এক সময় আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে রইল।

বিজয়বাবু এতক্ষণে মোটামুটি চাঙ্গা হয়ে গেছেন, কেবল দু-এক বার মাথার একটা বিশেষ জায়গায় আলতো করে হাত বোলালেন।

আমি মনে মনে ভাবছি।–ভদ্রলোকের এ দশা করল কে এবং কেন?

গুলমাৰ্গ ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। আমরা যে যার ক্যাবিনে চলে গেলাম। ফেলুদা বলল, আগে একটু চা খাওয়া দরকার।

খানসামাকে চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর লক্ষ করলাম ফেলুদার ভুরুটা অস্বাভাবিক রকম কুঁচকে আছে।

চায়ের পর দেখি বিজয়বাবু নিজেই এসে হাজির, সঙ্গে সুশান্তবাবু আর মিঃ সরকার।

বাধ্য হয়েই আপনার কাছে আসতে হল, বললেন বিজয়বাবু। আমি এত হতভম্ব আর কখনও হইনি।

আপনার উপর আক্রোশ থাকতে পারে এমন কেউ নেই এখানে?

কে থাকতে পারে বলুন! তা হলে তো সুশান্ত বা ডাঃ মজুমদার বা মিঃ সরকারের কথা বলতে হয়। সে তো হাস্যকর ব্যাপার হত!

কাশ্মীরে এসে পূর্বপরিচিত কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি?

না।

কলকাতাতে এমন কেউ নেই। যার আপনার উপর কোনও আক্রোশ থাকতে পারে।

আমি তো সে রকম কারুর কথা জানি না।

আপনি তো কলকাতাতেই পড়াশুনা করেছেন?

হ্যাঁ।

গ্র্যাজুয়েট?

হ্যাঁ। স্কটিশ চার্চ কলেজ।

মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট ছাত্রজীবন ছিল?

ঠিক তা বলা যায় না।

কেন?

কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে কুসঙ্গে পড়ি, নেশা ধরি, ড্রাগস।

হার্ড ড্রাগস?

হ্যাঁ-কোকেন, মর্ফিন….

তারপর?

বাবা টের পেয়ে যান।

বাবা তো তখনও জজিয়তি করতেন?

হ্যাঁ।

তারপর?

তিনি আমার এই অভ্যাস ছাড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। তারপর আশা ছেড়ে দেন।

এই অবস্থাতেও আপনি গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছিলেন?

আমি খুবই ভাল ছাত্র ছিলাম।

আপনি বাড়িতেই থাকতেন?

কিছু দিন ছিলাম, তারপরে আর পারিনি। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কানপুরে এক আশ্চর্য লোকের সংস্পর্শে আসি। সাধুই বলতে পারেন। নাম আনন্দস্বামী। তখনও আমি নেশায় মত্ত, কিন্তু ভদ্রলোকের সংস্পর্শে এসে আমার নেশা চলে যায়। একে মিরাকৃলি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না; আমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাই।

তারপর বাড়ি ফেরেন?

হ্যাঁ। বাবা আমার সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দেন।

তখন আপনার বয়স কত?

সাতাশ-আটাশ হবে।

তারপর? আপনি চাকরি করেন?

বাবাই একটা ফার্মে ঢুকিয়ে দেন। আমি এখনও সেখানেই আছি।

আপনার জুয়ার প্রতি একটা আসক্তি আছে না?

তা আছে।

সেটা কোনও সমস্যার সৃষ্টি করছে না তো?

না।

আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা যায় আপনার কোনও শত্ৰু আছে কি না, আপনি কী বলবেন?

যত দূর জানি, আমাকে খুন করতে চাইবে এমন কোনও শত্রু আমার নেই। ছাটখাটা শক্ৰ বোধহয় সকলেরই থাকে।–তার পিছনে ঈষা থাকতে পারে। এটা যে অস্বাভাবিক নয়, সেটা আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।

একশোবার।..এবার আরও দু-এক জন সম্বন্ধে আপনাকে আরও দু-একটা প্রশ্ন করে নিই। ডাঃ মজুমদারকে আপনি ক’দিন থেকে চেনেন?

উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আজ প্রায় পনেরো বছর হল।

বেশ। এবার সুশান্তবাবুকে একটা প্রশ্ন।

সুশান্তবাবু বললেন, বলুন।

আপনি কতদিন হল মিঃ মল্লিকের সেক্রেটারির কাজ করছেন?

ওঁর রিটায়ার করার সময় থেকেই। তার মানে পাঁচ বছর।

বেয়ারা প্ৰয়াগ কত দিন আছে?

ও-ও আন্দাজ পাঁচ বছর। মিঃ মল্লিকের পুরনো বেয়ারা মকবুল হঠাৎ মারা যায়। তারপর উনি প্ৰয়াগকে রাখেন।

বেশ, আজ এই পর্যন্তই থাক। তবে পরে দরকার হলে আবার প্রশ্ন করতে পারি তো?

নিশ্চয়ই, বললেন বিজয়বাবু।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়